রুশ রূপকথার খাবারদাবার

রুশসাহিত্যের সাথে বাঙালি পাঠকের প্রথম পরিচয়ের যোগসূত্র রূপকথা। আশির দশকের শৈশব-কৈশোরে পাড়ার দেওয়ালের লাল লিখন যখন ফিকে হতে শুরু করেছে, এ পাড়া ও পাড়া জুড়ে ছুটে বেড়ানো বিকেলের খেলার শেষে বাধ্যতামূলক পড়তে বসার তাগিদে পাঠ্যবইয়ের নিচে লুকিয়ে থাকা ঝলমলে রঙিন ছবির বইয়ের সে জগৎ বিশ্বসাহিত্যের সাথে অনাড়ম্বর, অনায়াস সরলতায় পরিচয় ঘটিয়েছে।

অরুণ সোম, ননী ভৌমিক, সুপ্রিয়া ঘোষ প্রমুখ অনুবাদকের কলমে রাজকুমারী ভ্যাসিলিসা, বোকা ইভান, সিভকা-বুর্কা, আলিওনুশকা-ইভানুশকা রাদুগা প্রকাশনের দৌলতে শিশু মানসে বন্ধুত্ব পাতিয়েছে লালকমল-নীলকমল, সুয়োরানী -দুয়োরাণী, শুকপাখি, কলাবতী রাজকন্যা, বাঁদর রাজকুমার, লাউ-গড়্গড় বুড়ির সাথে। শৈশবের সাথে রূপকথার সম্পৃক্ততা শিশুর মনে বিশ্ব সম্বন্ধে ধারণা সৃষ্টিতে যে অমোঘ গুরুত্বপূর্ণ তা বলা নিষ্প্রয়োজন। মৌখিক সাহিত্যের ধারায় পরম্পরাবদ্ধ লোকগাথায় গাঁথা থাকে সমাজ-রাজনীতি, ইতিহাস, লৌকিক বিশ্বাস, সমকালীনতার ছবি। গল্পের চরিত্রের মোটিফ বা বুননে গাঁথা যে ছবি পরিব্যপ্তি পায় তার সূক্ষ্ম কারুকাজের অন্যতম উপাদান ইচ্ছাপূরণের আনন্দ, দুর্গমতা-দুরবস্থা থেকে মুক্তির আনন্দ; সর্বোপরি যোগ্যতম হিসেবে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার পরিতৃপ্তি। যে কোন সভ্যতার রূপকথা জুড়ে এই বেঁচে থাকার সূত্রে জুড়ে আছে খাদ্যসংস্কৃতি।

পৃথিবীর রূপকথার ইতিহাসে প্রথম সঙ্কলক হলেন জার্মানীর গ্রিমভাতৃদ্বয়। জার্মানীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে তারা মৌখিক পরম্পরায় প্রচলিত লোককাহিনীর, ছেলেভুলানো গল্পের সংকলনের যে কাজটি করেন তা ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়। উইলহেল্ম গ্রিম ও জেকব গ্রিমের সম্পাদনায় "কিন্ডা উন্ড হাউসমার্হেন" নামে প্রকাশিত এই বই শিল্পসাহিত্যের রোমান্টিক ঘরানার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৮৫৫ থেকে ১৮৬৩ এর মধ্যবর্তো সময়কালে প্রায় ৬০০ কাহিনী নিয়ে আলেকজান্ডার আফানাসিয়েভ প্রকাশ করেন রুশ রূপকথা ও লোককাহিনীর। সংকলন। রাশিয়ার পাশাপাশি ইউক্রেন ও বেলারুশ অঞ্চলের গল্প এই সংকলনে স্থান পায়। ১৮৭৩ সালে উইলিয়াম র‍্যালস্টোন এবং ১৮৯০ সালে এডিথ হজেটস ইংরেজিতে রুশ রূপকথার অনুবাদ করেন। ১৯২২ সালে USSR (Union of Soviet Socialist Republic) প্রতিষ্ঠার পর  সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় রুশ সাহিত্য অনূদিত হতে শুরু করে। ১৯৩৪ সালে ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছিলেন প্রকৃত সাম্যবাদী চেতনার উন্মেষের জন্য লোকসাহিত্যের চর্চা ও প্রচার আশু প্রয়োজন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা ও তাদের কার্যক্রমের সূত্রে রাশিয়ার বই বাংলায় অনুবাদ শুরু হয়। ক্রমে দেশ স্বাধীন হয়। ঘুমে জাগরণে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার ডাকে সত্তরের গণ আন্দোলনে যে আহবান মাঠ ঘাট বন পেরিয়ে সদ্য স্বাধীন কিন্তু দেশভাগের দ্বন্দ্বে পীড়িত দেশে জেগে ওঠে তার স্বপ্ন দেখায় রুশ রূপকথার সৈনিক তরুণ বীর যে গ্রীষ্মের সবুজ আর শীতে বরফে সাদা প্রান্তর পেরিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে যায়। যে দেশ আয়তনে সে সময় পৃথিবীর সবচেয়ে বড়, যা উত্তর মহাসাগর থেকে ককেশাস-পামীর,আরেকদিকে আলাস্কা থেকে স্কান্ডিনেভিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত তার বিচিত্র জীবন-জীবিকা, খাদ্যাভ্যাস এই সব কাহিনীর উপাদান।ভালো মন্দের ধন্ধে রাজা-প্রজা যখন পড়ে জাদুমাছ বা বাবা ইয়াগার মতো ডাইনীবুড়ি সমাধান বাতলে দেয়।

বাংলা ভাষায় বহুল প্রচলিত যে সব রুশকাহিনী আছে তাতে খাবার হিসেবে  পাওয়া যায় মূলত রুটি, পরিজ,ফল-সব্জি এবং মাছ-মাংসের পদ। ছোট্ট গোল রুটি যাকে বুড়োর অনুরোধে হাঁড়ির ময়দা চেঁছেপুঁছে ঘিয়ে ভেজে বুড়ি বানিয়েছিল জানালায় রেখে দেয়া মাত্র সে গড়গড়িয়ে গান গেয়ে পথ চলতে শুরু করে। স্লাভিক অঞ্চলে এই জাতীয় কলোবক বা জিঞ্জারব্রেড জাতীয় রুটি খুব প্রচলিত ছিল। মাখন, সাওয়ার ক্রিমে বানানো ঈস্ট ছাড়া এই রুটি নিয়ে রুশ শিশুদের পছন্দের গান ছিল "ছোট্ট গোলরুটি চলছিল গুটিগুটি"।

রাশিয়ার খাদ্যাভ্যাসে রুটির অনেক রকমফের আছে। রাই, গম, বার্লি, ওট, মিলেট এসব শস্য রাশিয়ার মূল ফসল। স্লাভিক সভ্যতায় শস্য চাষের পাশাপাশি বেরি জাতীয় ফল, সবজি র চাষ হতো। রাশিয়ায় প্রচলিত চার প্রকারের খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে ১৮শ শতকের শেষভাগে সেন্ট পিটার্সবার্গভিত্তিক ঘরানা প্রচলিত হয়েছিল। রূপকথার খাবারে মূলত এর প্রভাব দেখা যায়। রাই আর গমের আটা দিয়ে বানানো রুটি চাষিঘরে প্রচলিত। দুই ভাইয়ের গল্পে শহুরে ধনী ভাই গরীব ভাইয়ের শারীরিক শ্রমের বিনিময়ে তাকে রুটি উপহার দেয়।গপ্পীবউয়ের স্বামী গুপ্তধনের খোঁজে বনে যাওয়ার সময় ঝোলায় পুরে নেয় সরু চাকলির মতো পাতলা ব্লিনি রুটি। পালাপার্বণে বানানো আলু বাঁধাকপি, মাংসের পুরে ঠাসা পিরোকি(Pirozhki)র দেখা রাজপ্রাসাদের গল্পে মেলে। ইউক্রেন ও বেলারুশ থেকে এসব রুটি রাশিয়ায় আসে স্লাভিক অঞ্চল থেকে। আর আসে কলোবক বা জিঞ্জারব্রেড জাতীয় রুটি। যমরাজ আর যোদ্ধার গল্পের যোদ্ধা তার সঞ্চয়ে থাকা রুটি ক্ষুধার্ত ভিখারি বৃদ্ধকে খেতে দেয়। রাজকুমারী ভাসিলিসাকে তার দাসীরা বানিয়ে দিয়েছিল নরম তুলতুলে সাদা রুটি যেটিকে তোয়ালে মুড়ে রাজসভায় পরিবেশন করে সে রাজপুত্রের মুখ উজ্জ্বল করেছিল। সিভকা-বুর্কা বাবার মৃত্যুর পর পরপর তিনদিন তার কবরে রুটি পৌঁছে দিয়ে তার কাছ থেকে পেয়েছিল জাদুঘোড়ার আশীর্বাদ।

রুটির পরেই আসে পরিজ বা জাউয়ের কথা যা 'কাশা' নামে প্রচলিত। দুধ, মাখন, মধু, ফলের জ্যাম, বাদাম কিসমিস দেয়া মিষ্টি পরিজের মূল উপাদান ওট বা বাকুইট। আর রোজকার খাবার হিসেবে গৃহস্থের সামর্থ্য অনুসারে তাতে যোগ করা হয় পেয়াঁজ, মাংস, মাশরুম ইত্যাদি। রূপকথার গল্পের কুড়ুলের জাউ রান্নার গল্প বুঝিয়ে দেয় কাহিনীকালে  রাজা তার প্রজাদের যোদ্ধা, ক্রীতদাস, চাষী তার ইচ্ছানুসারে যখন যেমন খুশি তেমন ভূমিকায় ব্যবহার করতে পারতেন। ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত সৈনিক যে ঘরে এসে খাবার চায় সে ঘরের মালকিন খাবার থাকা সত্ত্বেও তাকে কিছু  দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। নিতান্ত পীড়াপিড়ি করে ঘরে পড়ে থাকা ভাঙা কুড়ুল দিয়ে সৈনিক যে জাউ রান্না করতে গিয়ে ক্রমে তাতে যোগ হয় নুন, খুদ, ঘি। সব শেষে তা খেয়ে মুগ্ধ কর্ত্রী জানায় কুড়ুলের জাউ যে এত ভালো হয় তা তার জানা ছিল না। সাম্প্রতিক সময়ে জনপ্রিয় "মাশা আ্যন্ড দ্য বেয়ার" আ্যনিমেশন ছবির দুষ্টু খুকি মাশা তার আশ্রয়দাতা ভালুকের জন্য পরিজ রান্না করতে গিয়ে মুশকিলে পড়ে।অবশেষে ভালুক বাড়ি ফিরলে তার প্রতিকার হয়।

মাংস ছাড়া রুশ জীবনে খানাপিনা অচল। তাই রূপকথা জুড়ে মুরগী, হাঁস, শুয়োর, ছাগল, ষাঁড়ের মাংসের কথা। শীতপ্রধান দেশে শীত পড়ার আগেই গৃহপালিত পশু মেরে তার মাংস সংরক্ষণ করা হতো আর সেই মাংস দিয়ে বড়দিনে তৈরী হত মাংসের পুর দেয়া পিঠা বা রুটি। এছাড়াও রাজা, সওদাগর, সম্ভ্রান্ত বা ধনী বাড়ির ভোজে মদের সাথে মাংস ছিল অন্যতম আকর্ষণ। কাজখী এক রূপকথার গল্পে শিগাই বাইয়ের ছাউনিতে আলদার কোসে দেখেছিল কড়াইতে ভেড়ার মাংস রান্না হচ্ছে, সসেজ বানাচ্ছে একজন, আরেকজন ময়দা ঠেসে রুটি বানাচ্ছে। আলদারকে তারা খাবারের ভাগ দিতে রাজী না হলে সে লুকিয়ে মাংস খেয়ে সেই হাঁড়িতে তার জুতোজোড়া ফুটতে দেয়। নেনেৎস উপকথার গরীব বুড়োর ছোট মেয়ে পাহাড়ের ওপারের এক ছাউনিতে হরিণের মাংস রেঁধে ও হরিণের চামড়া থেকে দস্তানা সেলাই করে কতুরার মন জয় করে।

কেঠো পায়ের ভালুকের গল্পে যে ভালুক শালগম চুরি করেছিল তার একটা পা পাহারাদার কৃষক কেটে নিয়ে তার বৌকে রাঁধতে দেয়। সেই খবর পেয়ে ভালুক তার বাড়ি এলেও পড়শীদের বুদ্ধি ও উদ্যোগে সে ধরা পড়ে যায়। এমনই আরেক গল্পের বুড়োবুড়ি তাদের পোষ্যদের মেরে মাংস খেতে চাইলে তারা একজোট হয়ে বনে পালিয়ে যায়। মোরগ, ষাঁড় ভেড়া, শুয়োর আর হাঁস একসাথে পাজি নেকড়েকে তাড়িয়ে দিয়ে মনের সুখে ঘর বানিয়ে বাস করতে থাকে। যমরাজ আর যোদ্ধার গল্পের সৈনিক নিজের খাবার ভিখারিকে দিয়ে জঙ্গল থেকে বুনো হাঁস শিকার করে সরাইখানায় গিয়ে হাঁসের মাংস ভাজা করতে বলে। তিনটি হাঁসের একটির পরিবর্তে চেয়ে নেয় কিছু মদ। হাভরোশেচকার  গল্পে সে যে গরুটিকে মাঠে চরাতে যেত তাকে মেরে ফেলতে নিদান দিল মেয়েটির সৎমা। গরুটির অনুরোধে তার হাড় মাটিতে পুঁতে দিলে সেখানে এক ফলন্ত আপেল গাছ সোনার মতো ঝলমলিয়ে ওঠে। এক সুবেশ তরুণের অনুরোধে সেই আপেল বীর তরুণকে ছিঁড়ে দিয়ে তার ঘরনী হয়ে সুখে দিন কাটায় হাভরোশেচকা। ক্ষুদে ইভান তাদের তেত্রিশ ভাইয়ের জন্য গোমস্তার কাছ থেকে মুনিষ খাটার মজুরি হিসেবে চেয়ে নিয়েছিল তেত্রিশটি ষাঁড়ের রোস্ট।

রুশ রূপকথার গল্পে মাছ শুধুমাত্র খাদ্য নয়। মাছের জাদুকরী ক্ষমতা কাহিনীর চরিত্রদের অন্যতম ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হয়ে প্রায়শই ধরা দেয়। বরফজমা নদী থেকে বালতি করে বরফ সেঁচে বউদিদের হুকুমে মাছ ধরেছিল সরল ছোকরা ইয়েমেল্যা।মাছটির প্রাণরক্ষার আবেদন সে ফিরিয়ে দিতে পারে নি। বিনিময়ে মাছ তাকে শিখিয়ে দিয়েছিল যে কোন কাজ অনায়াসে হাসিল করার মধ্যে মতো মন্ত্র, "মাছের আজ্ঞায়, মোর ইচ্ছায়"। ক্রমে এই মন্ত্রের প্রয়োগে সে রাজকন্যা আর রাজত্বের অধিকারী হল। সোনালী মাছ যার জালে ধরা দিয়েছিল মাছটিকে জাল থেকে ছাড়িয়ে জলে ছেড়ে দিয়ে সে অতুল ধন সম্পদ লাভ করে। জাদুকরী ডাইনী বাবা ইয়াগার কাহিনীতেও খাদ্যভ্যাস গুরুত্বপূর্ণ। জঙ্গলে বসবাসকারী জলের দস্যু বাবা ইয়াগা শিশুদের আটকে রাখে, নয়তো জঙ্গলে আটকে পড়া কোনো প্রাণিকে কোনো সমাধানের পথ বাতলে দেয় নতুবা তার মায়াযাদু প্রয়োগ করে। সোনার ডিঙিতে রূপার দাঁড় বেয়ে পিলিপকা খোকন মাছ ধরতে যায়। বেলচা দিয়ে তাকে ডিঙি সহ ডাঙায় তুলে বস্তায় ভরে তার মাংস খাওয়ার জন্য বাবা ইয়াগা তাকে ঘরে নিয়ে আসে। বুদ্ধিবলে পিলিপকা পালিয়ে বাঁচে। হাঁসেদের সাথে উড়ে ঘরে ফেরে।

ফলের মধ্যে আপেল, রাস্পবেরি, বাদাম, কিশমিশ, বনের মধু, মাশরুম ইত্যাদির উল্লেখে গল্পে বারবার উঠে এসেছে আদিম কৃষিনির্ভর সভ্যতার ছবি। নিজের ধাইমার কাছে শৈশবে এসব গল্প শুনে বড় হয়েছেন পুশকিন। তাঁর পরিণত বয়সের সাহিত্যচর্চা, জীবনবোধে বারবার ফিরে এসেছে রূপকথার নানা প্রতীকী প্রয়োগ। ১৯৯১ তে সম্মিলিত সাম্যবাদী রাশিয়ার পতনের আগে অব্দি যত রুশ লোককাহিনী এবং বীলীনী নামের মহাকাব্যিক বীরগাথা লিখিত আকারে সংরক্ষিত এবং অনূদিত হয়েছে তাতে রাজনৈতিক আদর্শ অনুসারে আদর্শ সমাজ ও নাগরিক রক্ষার তাগিদে এসেছে কিছু পরিবর্তন বা পরিমার্জন। রূপকথা থেকে প্রাচীন পৌত্তলিক মায়াবী যাদুর প্রভাব কমিয়ে তার কাহিনীতে  মূল চরিত্রদের সাধারণ সর্বহারা মানুষের জীবনের প্রাত্যহিক লড়াইয়ের যন্ত্রণার সাপেক্ষে বিচার করে পাঠক অনায়াসেই তাদের সাথে একাত্ম হয়ে যান।

রূপকথার গল্পে মূলত ইউরোপে প্রচলিত লোকগাথায় যে সব স্যুপ, স্টু, সালাদ, জাউ, মাংসের পদ, গোটা ঝলসানো মাছের খাবারের কথা পড়ে পাঠকের নোলা সকসক করে তেমনি বেশ কিছু খাবারের কাহিনী, ইতিহাস, ছবি ও প্রণালী সহযোগে একটি বই প্রকাশ করেছেন এলিসা পিক্কিনি ও ক্যামেলিও বাক্কাসিনি। স্কুল শিক্ষিকা এই দুই সহকর্মী পড়ানোর বিষয় আলাদা কিন্তু আন্তরিক বন্ধুত্বের টানে, রূপকথায় প্রগাঢ় ভালোবাসার তাগিদে তারা যৌথভাবে লিখেছেন "রিসেটে দ্য ফেবিয়া"। মানুষের মুখে মুখে যেমন গান-গল্প ঘুরে বেড়ায় দেশ-বিদেশ, তেমনি বণিক-সওদাগর, রাজা-রানি, মন্ত্রী-সান্ত্রীর দেশান্তরে যাওয়ার মাধ্যমে খাবার আর পানীয়ও তাদের সঙ্গী হয়। তাই প্রচলিত খাবারের প্রণালীর ক্ষেত্রে তার ওই সময়ের সবচেয়ে প্রচলিত ও জনপ্রিয় ধারাটির কথা ভেবেছেন। যেমন-আলেকজান্ডার আফানাসিয়েভের রুশ রূপকথার রান্নার প্রসঙ্গে তারা উনিশ শতকের রাশিয়ায় প্রচলিত রান্নার বই ঘেঁটে দেখেছেন। রূপকথায় খাবারের গুরুত্ব সম্বন্ধে তারা একটি সাক্ষাৎকারে দীর্ঘ আলোচনায় জানিয়েছেন যে কোন কাহিনীতে খাবারের বিষয়টি আলোচিত  হয় প্রাচুর্য বা দৈন্য। গল্পের রাজা প্রচুর খাবারে সাজানো টেবিলে বসে আহার করেন আর ক্ষুধার্ত সৈনিক কুড়ুলের জাউ রান্না করে। ছোট্ট গোলরুটি এতোটাই মহার্ঘ্য যে বুড়ো বুড়ীর কাছে রুটি বানিয়ে দেবার আবদার করে।রাশিয়ার কনকনে শীতে এই রুটি সম্বল করে শত্রু নিধন করতে  দূর‍দেশ যাত্রা করে করে চাষার ছেলে, ক্রীতদাসের সন্তান, ক্লান্ত যোদ্ধা। তারা বলছেন কিভাবে খাবারে লুকিয়ে থাকা জাদুবিদ্যা পাঠককে পরাবাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়। রূপকথার গল্পে খাবার হিসেবে মাছ প্রায় অনুপস্থিত। জাদুবিদ্যায় পারদর্শী কথা বলা, ইচ্ছে পূরণ করে দেয়ার ক্ষমতাধর চরিত্র হিসেবে যে মাছ দেখা যায় তার সবটাই খেয়ে নিতে হয়। ক্রিশ্চান ধর্মবিশ্বাসের সাথে মাছের যোগ নিবিড়। গ্রীক ভাষায় মাছের প্রতিশব্দের অর্থ রক্ষাকারী ঈশ্বরের দূত যিশু।লক্ষ্যণীয় যে রাশিয়ায় খ্রিষ্টধর্মের প্রসারের সমসাময়িক যে কাহিনী পাওয়া যায় সেখানে এমন কথা বলা মাছ কাহিনীর আনন্দ-সমাপনের উৎস।আলেকজান্ডার পুশকিনের সোনালী মাছের কাহিনীর বুড়ো জেলে যে জাদুমাছ ধরে এনেছিল তাকে মেরে না ফেলে বাঁচিয়ে রাখার কৃতজ্ঞতায় মাছ জেলেনীর ইচ্ছেপূরণ করেছিল।কিন্তু তার লোভ যখন সীমাহীন হয়,শাস্তি দিতেও কসুর করে নি সেই মাছ। যাদুক্ষমতার বিচারে মাছের পরেই সব্জির স্থান। বসুধা মায়ের কোল-পোঁছা বীরুৎ জাতীয় গাছের ফল মটর, সীমবীজ নিজেরাই তাই ঘুরে বেড়ায়। শালগম চাষে আগেভাগে গাছের আগা নিতে চাওয়া ভালুক চাষীর কাছে ঠকে যায়।

ভূগোলের কাল্পনিক রেখায় রূপকথাকে সীমাবদ্ধ করা সহজ নয়। কাহিনীর চরিত্র পালটে গেলেও বিন্যাসের ক্রমে, জীবনযাত্রার বৈচিত্র্যময়তায় প্রতিভাত হয় জীবনের বিচিত্র সব কান্ডকারখানা। তবুও গাছের পাখি, বনের জন্তু-গাছপালা, পাহাড়-নদী-সমুদ্র সব রূপকথার হারিয়ে যাওয়া মানুষকে নিরাপদে থাকতে দেয়, খাবার দেয়, তার অভীষ্ট লক্ষ্যের সাধনে তাকে এগিয়ে দেয়। তাই মুখে মুখে ঘুরে বেড়ানো রূপকথাই মানুষের প্রথম ও অন্তিম আশ্রয়।