রুশ গল্পকার নিকোলাই গোগল

১৮০৯ সালে ইউক্রেনের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে জন্ম নিকোলাই ভাসিলিভিচ্ গোগোল-এর। সপ্তদশ শতক থেকে ইউক্রেন রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হলেও ইউক্রেনবাসী নিজেদের পুরোপুরি রাশিয়ান বলে মনে করতেন না। ইউক্রেন বহুবার রাশিয়া থেকে আলাদা হয়ে গেছে। এঁদের বলা হত ‘লিটল রাশিয়ান’। ইউক্রেনের মানুষজন উপকথা-লোককথা শুনতে বড় পছন্দ করেন। হাইহিল বুটজুতো, ফুলো ফুলো ট্রাউজার, মাথায় চামড়ার টুপি পরা যাযাবর কথকরা উপকথা শুনিয়ে বেড়াতেন। গোগোল প্রাণভরে শুনতেন এইসব গল্প। গোগোলের বাবাও লেখালেখি করতেন। তিনি লিখতেন এমন সব নাটক, যেগুলোর শেষে অবশ্যম্ভাবী ভাবে থাকত একটা ‘হ্যাপি এন্ডিং’। গোগোলের স্বপ্ন ছিল, তিনি আইনব্যবসায়ী হবেন। বড় কিছু করবেন। সেন্ট পিটাসবার্গে আসেন, পড়াশোনা করেন। কিন্তু স্বপ্নগুলো রয়ে যায় অধরা। তাঁর বড় হয়ে ওঠা যেহেতু গ্রামে, নাগরিক জীবনের সাথে তিনি শেষপর্যন্ত খাপ খাইয়ে উঠতে পারেননি। জীবনধারণের জন্য বেছে নিয়েছেন বহু জীবিকা। চেহারাখানা জুতসই না হলেও ছেলেবেলা থেকেই ভালো মিমিক্রি করার সহজাত প্রতিভা গোগোলের ছিল। আর ছিল তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর। সরকারী প্রেক্ষাগৃহে অভিনয়ের জন্য অডিশন দিয়েছেন, প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। ছেলেবেলা থেকেই ছিল কবিতা লেখার নেশা। নিজস্ব খরচে কবিতার বইও ছাপিয়ে ফেলেন এবং বন্ধুদের পড়তে দেন। কেউই খুব একটা প্রশংসা করেননি। কয়েকজন স্পষ্টবাদী বন্ধু সরাসরি জানিয়েই দেন, এইগুলো ঠিক কী হয়েছে তা বলা যাচ্ছে না, তবে নাকি ‘কবিতা’ হয়নি। গোগোল বইগুলো পুড়িয়ে দেন।

গোগোলের মধ্যে আজীবন ছিল এক বিরাট নিঃসঙ্গতা। নারীসান্নিধ্য তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলত, অথচ তিনি কল্পনায় বুনে নিতেন একেবারে উল্টোরকম ছবি। মা’কে তিনি চিঠিতে লিখতেন, কোনও সুন্দরী মেয়ের প্রলোভন এড়াতে তাঁকে নাকি অমানুষিক পরিশ্রম করতে হচ্ছে। অথচ বাস্তবে নাকি এমন নারী-র অস্তিত্বই ছিল না তাঁর জীবনে। বাবা মারা যাবার পর সেন্ট পিটাসবার্গে হতদরিদ্র অবস্থায় কিছুদিন কাটিয়ে কোনওমতে মায়ের কাছ থেকে টাকাপয়সা জোগাড় করে তিনি চলে যান জার্মানি। পরে সরকারি চাকুরে হয়ে ফিরে আসেন সেন্ট পিটাসবার্গেই। দারিদ্র্যকে ঘৃণা করলেও দারিদ্র্য তাঁর সঙ্গী হয়ে রয়ে গেছে আমৃত্যু। রাশিয়ান সাহিত্যের আকাশে পুশকিন তখন উজ্জ্বল এক নক্ষত্র, আর গোগোল স্রেফ একজন উঠতি লেখক, যার দু’চোখে অনেক অনেক কিছু করে দেখানোর স্বপ্ন। ১৮৩১-এ প্রকাশিত হল গোগোলের ইউক্রেনীয় গল্প সংকলন ‘Evenings on a farm near Dikanka’, ছেলেবেলায় শোনা ইউক্রেনীয় উপকথাগুলো এক নতুন মোড়কে তুলে আনলেন। অত্যন্ত সমাদর পেয়েছিল বইটি। পুশকিনও মন্তব্য করেছিলেন, এই গল্পগুলোর মধ্যে এক সহজ আনন্দ-র উৎস রয়েছে। তবে গোগোল এটুকুতেই সন্তুষ্ট হননি। নিজের জীবন থেকে তুলে আনা ছোট ছোট মুহূর্তগুলো জুড়ে জুড়ে তিনি আঁকতে থাকেন সম্পূর্ণ অন্যরকম ছবি, যা ছেলেবেলায় শোনা উপকথা বা তাঁর বাবার লেখা মিলনান্তক নাটকগুলোর চেয়ে একেবারে আলাদা এক গোত্রের লেখা। বাস্তব জীবনটা যে ফেয়ারিটেল নয়, সেখানে রোজ স্বপ্নরা জন্মায় আর রোজ তাদের গলা টিপে খুন করতে বাধ্য করা হয়— এই রূঢ় সত্যিটাই গোগোল দেখাতে চাইলেন তাঁর লেখায়। ১৮৪২-এ লিখলেন ‘ওভারকোট’ গল্পটি, বলা যেতে পারে এই একটি গল্পই তাঁকে জায়গা করে দিয়েছিল রুশ সাহিত্যের ইতিহাসে। গোগোলের ‘The overcoat’ গল্পটিকেই প্রথম সার্থক ছোটগল্প হিসেবে দেখা হয়, যা পড়ে দস্তয়েভস্কি মন্তব্য করেছিলেন, ‘we all came out from under Gogol's overcoat’। ‘ওভারেকোট’ গল্পের মুখ্য চরিত্র আকাকি আকাকিভিচ্ বাশমাচকিন। পেশায় সে নকলনবিশ কেরানি অর্থাৎ কিনা অফিসের জেরক্স মেশিন। কেউ তাকে আলাদা করে লক্ষ্য করে না। কোনও কিছু নকল করানোর দরকার হলে স্রেফ কাগজখানা তার দিকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। না থাকে কোনও সৌজন্য বিনিময়, না থাকে কোনও শিষ্টাচার। আকাকিভিচ্ তাতেই অভ্যস্ত। সেও কথাটুকু না বলে কাগজখানা নকল করতে বসে যায় যন্ত্রের মতোই। মানুষটি অবিবাহিত একা একজন পুরুষ, গোগোলের মতোই। তার কোনও ‘সোশ্যাল লাইফ’ নেই। কেউ তাকে কোনও পার্টিতে ডাকেও না। অফিস সেরে বাড়ি ফিরে সে রোজ খায় স্বাদগন্ধহীন বাঁধাকপির স্যুপ আর ঠান্ডা বিফ স্টেক। এরপর যেটুকু ফাঁকা সময় সে পায়, অফিস থেকে নিয়ে আসা কাগজ নকল করে কাটায়।  বিষণ্ণতা তাকে ঘিরে থাকে অষ্টপ্রহর। আর থাকে দারিদ্র্য। বছরে সর্বসাকুল্যে সে মাইনে পায় চারশো রুবল, এখনকার সময়ে যা ভারতীয় মুদ্রায় তিনশো সাতান্ন টাকা নিরানব্বই পয়সা। তার সবুজ ইউনিফর্মে লালচে বাদামি রঙ ধরেছে, তার পরনের ওভারকোট শতচ্ছিন্ন, জোড়াতালি মেরে মেরে সেটার আর কিচ্ছুটি অবশিষ্ট নেই। এভাবেই হয়তো টেনেটুনে কেটে যেতে পারতো আকাকি আকাকিভিচের নশ্বর জীবনখানা। গল্পের মোড় ঘুরে যায়, যখন আকাকিভিচ তার শতচ্ছিন্ন ওভারকোটে তালি বসাতে দর্জি পেত্রোভিচের কাছে আসে। বেঢপ, কদাকার, জরাজীর্ণ ওভারকোটে তালি মারার জায়গা খুঁজে পায় না পেত্রোভিচ। এদিকে শীতও জাঁকিয়ে পড়তে চলেছে। অবস্থা গিয়ে দাঁড়ালো এমন পর্যায়ে, একটি নতুন ওভারকোট তৈরি করাতেই হবে এবং তার জন্য লাগবে দেড়শো রুবল। আকাশ থেকে পড়ল আকাকিভিচ। বাস্তব পরিস্থিতিখানা হজম করার পর সে প্রাণপণ চেষ্টা করেছে কোনওমতে যদি পেত্রোভিচ সস্তায় কাজখানা উতরে দিতে রাজী হয়। পেত্রোভিচ কখন নেশার ঘোরে থাকে, বেছে বেছে সেই সময়ে গিয়ে সে হানা দিয়েছে। কথা বলতে সে পটু নয়, তবু যতরকমভাবে অনুরোধ করা যায়, সে করেছে। কিন্তু ভবি তাতে ভোলেনি। এইবার শুরু হল এক অকল্পনীয় কৃচ্ছ্রসাধন— “আকাকি আকাকিভিচ ভেবে ভেবে শেষকালে ঠিক করল তার রোজকার খরচপত্র কমাতে হবে— অন্তত একবছরের জন্য তো বটেই, সন্ধ্যাকালীন চায়ের অভ্যাস তাকে ছাড়তে হবে, সন্ধ্যায় মোমবাতি জ্বালানো চলবে না, আর নেহাতই যদি দরকার হয় তাহলে বাড়িওয়ালির ঘরে গিয়ে তার মোমবাতির আলোয় কাজ করতে হবে, রাস্তায় চলতে গিয়ে যতদূর  সম্ভব আলতো করে ও সন্তর্পণে, প্রায় আলগোছে, বাঁধানো ফলক ও খোয়ার উপর পা ফেলতে হবে যাতে জুতোর তলি তাড়াতাড়ি ক্ষয়ে না-যায়; ধোপার বাড়িতে জামাকাপড় যতদূর পারা যায় কম ধুতে দিতে হবে, আর জামাকাপড় যাতে বেশি পরার ফলে ফেঁসে না যায় তার জন্য বাড়িতে এসেই তা খুলে ফেলে পরতে হবে মোটা সুতি কাপড়ের ড্রেসিংগাউনটা– যদিও বহুকালের পুরনো, তবু খোদ সময় পর্যন্ত সেটার প্রতি কৃপাপরবশ। সত্যি কথা বলতে গেলে কী, প্রথম প্রথম এহেন বিধিনিষেধের গণ্ডির মধ্যে চলতে অভ্যস্ত হওয়া তার পক্ষে খানিকটা কঠিন মনে হল, কিন্তু পরে কেমন যেন অভ্যাস হয়ে গেল এবং  ঠিকঠাক চলতে লাগল দিব্যি; এমনকি সন্ধ্যাবেলায় সম্পূর্ণ উপোস দেবার অভ্যাসও সে করতে লাগল কমবেশি; তার মনের খোরাক, একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ঐ ভবিষ্যতের ওভারকোট।”

আর এভাবেই জন্ম নিয়েছিল একটি ক্ষুদ্র আশার প্রতীক— ‘the birth of a little man’। একদিন সত্যি সত্যি তার সেই স্বপ্নের ওভারকোটের জন্য বরাদ্দ টাকা জমেও গেল। পেত্রোভিচ বানিয়েও ফেলল সেটি। ওভারকোট গায়ে দিতেই যেন একটা বড়সড় পরিবর্তনের হাওয়া বয়ে গেল। নতুন ওভারকোট গায়ে পথে নামল নতুন একজন আকাকিভিচ। যে মানুষটা হেঁটে গেলে ওপর থেকে লোকজন বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করেই তরমুজের খোসা, ফুটির খোসা ছুঁড়ে ফেলত এবং বিনা প্রতিবাদে আকাকিভিচ মাথা নীচু করে সরে যেত, আজ সেই আকাকিভিচ মাথা উঁচু করে হাঁটছে। পরম আকাঙ্খিত বস্তুখানা আজ তার শরীরে, চাপা গর্ব আর তৃপ্তির আভাস তার চলাফেরায় যেন এক আলাদা মাত্রার আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছে। অফিসে মুহূর্তে চাউর হয়ে গেল, আকাকিভিচের শতচ্ছিদ্র আলখাল্লামার্কা ওভারকোট আর নেই, সে নতুন ওভারকোট বানিয়েছে। যে এতদিন ছোকরা সহকর্মীদের ঠাট্টার খোরাক ছিল, যার দিকে কেউ কোনওদিন ঠিকমতো তাকিয়েও দেখেনি, আজ তার চারপাশে মানুষের ভিড়। নতুন ওভারকোটের অনারে হেডক্লার্কের বাড়িতে চায়ের নিমন্ত্রণও জুটে গেল তার। এই প্রথমবার কেউ তাকে ডাকছে, এই প্রথমবার তার নিজেকে ‘কাঙ্খিত’ মনে হচ্ছে। তার অস্তিত্বটা যে সে জানান দিতে পারছে, এ অনুভূতি তার কাছে আনকোরা নতুন। অফিস আর বাড়ি ছাড়া যে মানুষের আর কোনও যাবার জায়গা ছিল না, সে আজ নৈশভোজের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে পথে নেমেছে। রাতের প্রাণচঞ্চল নগরীটাকে দেখার সুযোগও তার এই প্রথমবার। কিন্তু সুখ যে বড় ক্ষণস্থায়ী। বিপত্তিটা ঘটল সেই নিমন্ত্রণ থেকে ফেরার পথে। দুজন গুন্ডা ছিনতাই করে নিয়ে গেল আকাকিভিচের ওভারকোট। সাধের ওভারকোট হারিয়ে আকাকিভিচ প্রায় উন্মাদ। তিলে তিলে জমানো টাকা দিয়ে বানানো ওই ওভারকোট একটাদিনের জন্য তাকে রাজা বানিয়ে দিয়েছিল। ওভারকোট খসে যেতেই পুনর্মূষিক ভব। সে দৌড়ল পুলিশ সুপারিনটেন্ডেন্টের কাছে। বারচারেকের ব্যর্থতার পর সে মরিয়া হয়ে বলে বসল, সে সরকারি কাজে দেখা করতে এসেছে সাহেবের সঙ্গে, ঢুকতে না দিলে ফল খারাপ হবে। সে এখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া একজন মানুষ, ওভারকোটখানা ফিরে পাওয়ার জন্য যতদূর যেতে হয়, সে যাবে।

নীচের তলার মানুষদের কথা শোনার সময় ওপরতলার মানুষজনের শ্রবণশক্তি হ্রাস পায়। সর্বকালে, সর্বদেশে এমনটাই নিয়ম। সুপারিনটেন্ডেন্ট আকাকিভিচের সমস্যাটা তো বুঝলেনই না। উল্টে জেরা শুরু করলেন সে অত রাতে সেখানে কী করছিল! এরপর আকাকিভিচ দ্বারস্থ হল শহরের এক গণ্যমান্য ব্যক্তির। কিন্তু সেই গণ্যমান্য ব্যক্তিটি জনগণের কাছে যে তিনি ‘মান্য’ স্রেফ সেটুকু প্রমাণ করতে আকাকিভিচের ওপর আচ্ছারকম চোটপাট করলেন। অপমানের ঝাঁঝ এতই বেশি ছিল, আকাকিভিচ আর সইতে পারল না। সে পড়ল জ্বরে এবং শেষ নিঃশ্বাসটুকু ত্যাগ করল। কারওর কিচ্ছুটি যায় আসল না। কেউ তার জন্য একটা ফোঁটাও চোখেরষজল ফেলল না। অফিসে তার শূন্য চেয়ারখানা পরদিনই দখল করে বসল অন্য একজন নবাগত নকলনবীশ। দুনিয়া চলতে থাকল তার নিজের নিয়মেই। কিন্তু আকাকিভিচের গল্প এখানেই শেষ নয়। স্বপ্ন মরে যাবার পর পড়ে থাকে শুধু হতাশা। তবে কখনও কখনও সেই চরম হতাশা-রা দুরন্ত এক প্রতিশোধের ছদ্মবেশ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। শহরের রাস্তায় রাত নামলেই দেখা যেত আকাকিভিচের প্রেতাত্মাকে, যে পথচারীদের ওভারকোট টেনে ছিঁড়ে নিত। একদিন সে শিকার হিসেবে পেল সেই গণ্যমান্য ব্যক্তিটিকে যার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আকাকিভিচকে শুনতে হয়েছিল অকথ্য গালাগাল। তার ওভারকোটও ছিনিয়ে নিয়ে গেল আকাকিভিচের ভূত। আর তারপরেই বন্ধ হল সে ভূতের দৌরাত্ম্য। হয়তো বিশেষভাবে এই লোকটির ওভারকোটের জন্যই অপেক্ষায় ছিল আকাকিভিচের অতৃপ্ত প্রেতাত্মা। ওভারকোট আকাকি আকাকিভিচের দ্বিতীয় সত্তা। তার প্রেতাত্মা আসলে আঙুল তুলেছে সমাজের ক্ষমতালোলুপ, পুঁজিবাদী শ্রেণীটির দিকেই। ‘ওভারকোট’ গল্পটির উপস্থাপনার ভঙ্গি আগাগোড়াই ব্যঙ্গ ও কৌতুকমিশ্রিত। বস্তুত এটিকে social satire বলা যেতে পারে। এর সঙ্গে ছদ্ম মহাকাব্যের মিল আছে বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তা আপেক্ষিক। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র কোনও ব্যঙ্গকাহিনীর নায়ক নয়। আকাকি আকাকিভিচ বাশমাচকিন একজন ক্ষুদ্র মানুষ— তার জীবন, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ এবং সীমিত ক্ষমতার প্রতিরোধ নিয়ে এক ক্ষুদ্র মানুষের ক্ষুদ্র জীবনের কথা এই প্রথম উঠে এসেছে সাহিত্যের পাদপ্রদীপের আলোয়। এমনভাবে একজন সামান্য মানুষের সাভান্য জীবন এবং তার চাইতেও সামান্যতম একটি ওভারকোটের ইচ্ছেপূরণকে নিয়ে এর আগে কখনও সাহিত্য রচিত হয়নি। ‘দি ওভারকোট’ এমনই এক রচনা, যার মধ্যে প্রথম দেখা মিলল একটি সাধারণ মানুষের খণ্ড জীবনের পরিসরে প্রতিফলিত বৃহৎ জীবন ও সমাজের ছবি, যাকে অনায়াসে বলা যেতে পারে ‘বিন্দুতে সিন্ধুদর্শন’।

অরুণ সোম তাঁর নিকোলাই গোগল রচনাসপ্তক নামক চমৎকার অনুবাদটির টীকা অংশে এই গল্প সম্পর্কে জানিয়েছেন যে, এটি "প্রথম মুদ্রিত হয় ১৮৪২ সালে, গোগলের রচনাসঙ্কলনের তৃতীয় খন্ডে। 'ওভারকোট' এর প্রাথমিক পরিকল্পনা ১৮৩০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে। অতঃঅপর ১৮৩৯-১৮৪০ সালের মধ্যে গোগল বারবার এটি নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, কেবল ১৮৪১ সালেই উপাখ্যানটি শেষ করেন।

আলেক্সান্দর গের্ৎসেন (১৮১২-১৮৭০) 'ওভারকোট'কে 'কলোসাস রচনা' আখ্যা দিয়েছেন। স্বৈরাচারী ভূমিদাস সমাজে 'নগণ্য মানুষের' ভাগ্য সংক্রান্ত যে বিষয়বস্তু গোগল উপস্থাপণ করেন এতে কেবল তার উপসঙ্ঘারি রচিত হল না, এতে রুশ লেখকদের রচনায় উক্ত বিষয়বস্তুর ভবিষ্যৎ বিকাশের পথ উন্মুক্ত হল। ফরাসী সমালোচক ম দে ভোগিউয়ের সঙ্গে ৪০-৬০ এর দশকের রুশ লেখকদের সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে ফিওদর দস্তয়েভস্কি মন্তব্য করেন যে তাঁদের সকলেরই আবির্ভাব গোগলের 'ওভারকোট' থেকে।"

গোগোলের অন্যান্য ছোটগল্পগুলির মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত গল্প ‘The Nose’। গল্পটি তিনটি ভাগে বিভক্ত। প্রথম অংশে শহরের এক নাপিত ইভান নিজের পাঁউরুটিতে তার খদ্দের মেজর কভালিয়ভের নাক পায়। নাকটা চুপিচুপি ফেলতে গিয়ে পুলিশের কাছে ধরা পড়ে। দ্বিতীয় অংশে দেখা পাওয়া যায় মেজর কভালিয়ভের। মেজর কভালিয়ভ একজন আতম্ভরী, উন্নাসিক, দাম্ভিক মানুষ। সে যখন দেখল, তার নাকটি খোয়া গেছে, তার মনে হল যেন তার গোটা অস্তিত্বখানাই বেমালুম হারিয়ে গেছে। এই নাকই ছিল তার যাবতীয় উন্নাসিকতার উৎস। নিজেকে সে অনেক বড় কিছু হিসেবে দেখানোর ভান করত। আর সেইসঙ্গে উল্টোদিকের মানুষজনকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখা ছিল তার স্বভাব। কিন্তু এখন কভালিয়ভের নাক রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে সরকারি উর্দি পরে। সেই নাক কভালিয়ভের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সম্পূর্ণ আলাদা এক সত্তা হয়ে গিয়েছে। কভালিয়ভ খুব চেষ্টা করছে তাকে ধরতে, কিন্তু কভালিয়ভের নাক তার চেয়েও বেশি চতুর। বারেবারে তার চোখে ধুলো দিয়ে পালাচ্ছে, কিছুতেই তার নাগাল পাচ্ছে না কভালিয়ভ। পেপারে হারিয়ে যাওয়া নাকের বিজ্ঞাপন দিতে গেল কভালিয়ভ, সংস্থার পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপন নেওয়াই হল না। শেষমেশ পুলিশ তার নাক এনে দিল। কিন্তু জোড়া আর লাগাতে পারে না ডাক্তার। কভালিয়ভ ভাবল, এ নিশ্চয়ই সেই বুড়ির কাজ, যে ওর মেয়ের সঙ্গে কভালিয়ভের বিয়ে দিতে চায়। কভালিয়ভ বিয়ে করতে চায় না বলে হয়তো বুড়ি জাদু করেছে। বুড়িকে সে চিঠি লিখল। বুড়ি কিন্তু চিঠির মানে উল্টো বুঝল, সে ভাবল কভালিয়ভ বুঝি তার মেয়েকে প্রোপোজ করেছে। বুড়ির উত্তর পড়ে কভালিয়ভ বুঝল, বুড়ি নির্দোষ। এদিকে শহর জুড়ে তার নাক নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছে। লোকজন বিনোদনের নতুন খোরাকও পাচ্ছে। গল্পের তৃতীয় এবং শেষ অংশে দেখা গেল, কভালিয়ভের নাক যথাস্থানে ফিরে এসেছে। নাক হারিয়ে কভালিয়ভ যে আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগছিল, তাও দিব্যি সে কাটিয়ে উঠেছে। গোগোলের গল্পের প্লট আপাতদৃষ্টিতে খুবই সহজ, সরল। অতি সাধারণ মানুষ এবং তার সাধারণ জীবন, কিন্তু সেখানে যখন হঠাৎই এক আকস্মিকের অনুপ্রবেশ ঘটে তখন পূর্ব প্রতিষ্ঠিত সামাজিক তথা বিশ্বাসের কাঠামোটা সম্পূর্ণ ভেঙেচুরে যায়।

এই গল্পটির রচনাতথ্য প্রসঙ্গে অরুণ সোম পূর্বোক্ত গ্রন্থে জানাচ্ছেন যে, "উপাখ্যানটি রচনার সূত্রপাত ১৮৩৩ সালে, গোগল রচনাটির পরিসমাপ্তি ঘটান ১৮৩৬ সালের গোড়ায়। আলেক্সান্দর পুশ্‌কিন ১৮৩৬ সালের 'সভ্রেমেন্নিক' (সমকালীন) এর তৃতীয় খন্ডে এর মুদ্রণকালে সম্পাদকীয় মন্তব্যে লেখেন: 'নিকোলাই ভাসিলিয়েভিচ গোগল এই জিনিসটি মুদ্রণের ব্যাপারে দীর্ঘকাল আপত্তি করেন; কিন্তু এর মধ্যে আমরা এমন অনেক অপ্রত্যাশিত, কল্পনাপ্রবণ, আনন্দোচ্ছল ও মৌলিক বস্তুর সন্ধান পাই যে তাঁর পাণ্ডুলিপি আমাদের যে তৃপ্তি দান করে জনসাধারণকে সেই তৃপ্তির ভাগীদার করার জন্য আমরা শেষ পর্যন্ত তাঁর কাছ থেকে অনুমতি আদায় করে নিই'। উপাখ্যানটির বিষয়বস্তুর ইঙ্গিত হয়ত গোগল পেয়ে থাকবেন ২০-৩০ এর দশকে প্রচলিত অনুরূপ বিষয়মূলক কমিক উপন্যাস ও গল্পকথার মধ্যে।"

তথ্যসূত্রঃ

১) The Collected Tales of Nikolai Gogol, Vintage Classics ed Edition, ISBN-10: 9780375706158

২) শ্রেষ্ঠ গল্প— নিকোলাই গোগোল, সম্পাঃ শহিদুল আলম, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রকাশনা, চতুর্থ সংস্করণ, চতুর্থ মুদ্রণ অক্টোবর ২০১২

৩) নিকোলাই গোগল রচনাসপ্তক - মূল রুশ থেকে অনুবাদ ও টীকা অরুণ সোম - রাদুগা প্রকাশন, মস্কো ১৯৮৬