সোভিয়েত রাশিয়ার রূপান্তর : লেনিনের মৃত্যু থেকে মস্কো ট্রায়াল (১৯২৪ - ১৯৩৮)

১৯১৭ র বিপ্লবের সময় থেকে রাশিয়ায় যে উতরোল পরিস্থিতি তৈরি হল তা নানাভাবে ও নানা চেহারায় দীর্ঘদিন চলে। বিপ্লবের পরে চলেছিল বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দলের মধ্যে নানা বিষয়ক বিতর্ক। বলশেভিক, মেনশেভিক এবং সোশ্যালিস্ট রেভেলিউশনারিদের মধ্যে এই বিতর্ক দীর্ঘদিন ধরে বেশ তীব্র আকারে চলেছিল। বিশেষ করে জার্মানীর সঙ্গে আপোষমূলক ব্রেস্ট লিটোভস্ক চুক্তিকে কেন্দ্র করে এই বিতর্ক তীব্র চেহারা নেয়। এই চুক্তিকে কেন্দ্র করেই সোশ্যালিস্ট রিভোলিউশনারিরা সরকার থেকে বেরিয়ে যায়। জার্মান রাষ্ট্রদূতকে হত্যা ও নানা অন্তর্ঘাতমূলক কাজকর্মের পর বলশেভিক সরকার নানা দমনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতেও বাধ্য হয়।

আন্তর্জাতিক স্তরে বামপন্থীদের অন্যান্য অংশ বলশেভিকদের সমালোচনা করে মূলত সংবিধান সভা বাতিলের ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করে। জার্মান মার্কসবাদী কাউটস্কি এর তীব্র সমালোচনা করেন। পালটা কলম ধরেন লেনিন এবং বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের তুলনামূলক আলোচনা করে কাউটস্কির তীব্র সমালোচনা করেন, এমনকী তাঁকে রেনিগেট বা (বিপ্লবী) শিবিরত্যাগী বলেও চিহ্নিত করেন। তবে বলশেভিকদের সবচেয়ে বেশি সঙ্কট আসে ঘরে বাইরে সমাজতন্ত্র বিরোধী বুর্জোয়া শিবির যখন মিলিতভাবে বলশেভিক সরকার ও সোভিয়েত রাষ্ট্রকে আক্রমণ করে। রাশিয়া সীমান্তের কাছে নানা বিদেশী শক্তি সেনা সমাবেশ করে। এর মধ্যে ছিল ২ ডিভিশন ব্রিটিশ সেনা, ২ ডিভিশন জাপানী সেনা, এক ব্রিগেড কানাডিয়ান সেনা, এক ব্রিগেড মার্কিন সেনা, এক ব্রিগেড ইতালিয়ান সেনা, এক ব্রিগেড চিনা সেনা, ২ ব্যাটেলিয়ন ফরাসী সেনা ও এক লিজিয়ন চেক সেনা। এদের মদতে ও রাশিয়ার ভেতরে বলশেভিক বিরোধী প্রতিবিপ্লবী শিবিরের প্রয়াসে গড়ে ওঠে শ্বেতরক্ষী বাহিনী ও রাশিয়ায় শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। শ্বেতরক্ষী বাহিনীর তিনদিক থেকে বলশেভিক নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় রাশিয়া ও মস্কো, পেত্রোগ্রাদের মতো রাজনৈতিক কেন্দ্রগুলির দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। দক্ষিণ দিক থেকে অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন দেনিকিন। পূর্ব দিক থেকে আসা বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন কোলচাক  এবং উত্তর পশ্চিম দিক থেকে আসা শ্বেতরক্ষীবাহিনীর নেতা ছিলেন ইউদেনিচ। ১৯১৯ সালের মাঝামাঝি ইউক্রেনের ক্রিমিয়া সহ এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিদ্রোহ হয় এবং এর নেতৃত্ব দেন ইউক্রেনের অ্যানার্কিস্ট নেতা নেস্টর মাখনো। মাখনো বলশেভিক ও শ্বেতরক্ষীবাহিনী উভয়েরই বিরোধী ছিলেন তবে গৃহযুদ্ধের একটা পর্বে শ্বেতরক্ষীদের বিরুদ্ধে বলশেভিকদের সঙ্গে সমঝোতা গড়ে তোলেন। সেই সমঝোতা আবার ভেঙেও যায়। ইউক্রেনের শ্বেতরক্ষীবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন পিওতর ওয়ার‍্যাঙ্গেল।

১৯২০ সাল নাগাদ বলশেভিকরা শ্বেতরক্ষীদের নির্ণায়কভাবে পরাস্ত করতে সক্ষম হলেও দেশের অর্থনীতি ও পরিকাঠামো ভেঙে চুরে যায়। রাশিয়ার পুনর্গঠনের লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ থেকে খানিকটা পিছু হঠে নেওয়া হয় নয়া আর্থিক নীতি বা নেপ। এতে গ্রামাঞ্চলে ধনী কৃষক ও কুলাকদের অনেকটা ছাড় দেওয়া হয়, যাতে রাশিয়ায় কৃষি উৎপাদন বাড়ে এবং সেনাবাহিনী ও শহরে পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ বরাদ্দ থাকে। ভারী শিল্প ও কলকারখানা বেশ সঙ্কটগ্রস্থ অবস্থায় থাকলেও কৃষি উৎপাদন ক্রমশ বাড়তে থাকে।

লেনিনের মৃত্যুর পর নীতি ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব

রাশিয়ার অর্থনীতি ও বলশেভিক সরকার যখন ধীরে ধীরে স্থিতাবস্থার দিকে এগোচ্ছে সেই সময়েই লেনিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে তাঁর অসুস্থতার শুরু ও ১৯২৩ সালে দ্বিতীয় স্ট্রোকের পর তিনি চলৎশক্তিহীন ও বাকরহিত হয়ে পড়েন। লেনিনের সুস্থ হয়ে পার্টি ও সরকার পরিচালনার সম্ভাবনা ক্রমশ কমতে থাকে ও ১৯২৪ সালের ১৫ জানুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়। লেনিনের অসুস্থতার সময়েই যে প্রশ্নটি সামনে এসেছিল, লেনিনের মৃত্যুর পর সেটি তীব্র হয়ে ওঠে। পার্টি ও সরকারে লেনিনের অবিসংবাদী নেতৃত্বের উত্তরাধিকারী কে হবেন তাই নিয়ে যথেষ্ট দ্বন্দ্ব তৈরি হয়।

পার্টি এবং প্রশাসন দুয়ের ক্ষেত্রেই লেনিন ছিলেন অবিসংবাদী নেতা। অবিসংবাদী কিন্তু একনায়ক নন। লেনিনের সময়ে পার্টিতে নানা বিতর্ক হয়েছে এবং সেই বিতর্ক নানা সময়ে যথেষ্ট তীব্র ও তীক্ষ্ণ ছিল। এমনকি অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে লেনিনের মত পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে সংখ্যালঘু ছিল। ব্রেস্ট লিটোভস্ক চুক্তির সময়ে যে বিতর্ক চলছিল, সেই বিতর্কে দীর্ঘদিন চুক্তির স্বপক্ষে লেনিনের মতটি সংখ্যাগরিষ্টতা পায় নি। গৃহযুদ্ধের শেষদিকে পোলান্ডে রেড আর্মির ভূমিকা প্রসঙ্গে লেনিনের অবস্থান নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক হয়েছিল এবং পরবর্তীকালেও মনে করা হয়েছে যে সেই অবস্থানটি ভুল ছিল এবং তা বলশেভিক ভাবমূর্তির ক্ষেত্রে হানিকর হয়েছে। কিন্তু লেনিনের নেতৃত্বে সামগ্রিকভাবে পার্টি বিতর্কগুলিকে নিয়ে সফলভাবে বড় বড় সমস্যার মোকাবিলা করতে পেরেছিল এবং রাজনৈতিক বিতর্কগুলি সত্ত্বেও লেনিন পার্টির মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কের সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশটি মোটের ওপর বজায় রেখে চলতে সক্ষম হয়েছিলেন। ট্রটস্কির দীর্ঘ অ বলশেভিক সাংগঠনিক অতীত সত্ত্বেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সামরিক দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পণ করতে তিনি কার্পণ্য করেন নি এবং ট্রটস্কিও বিপ্লবী অভ্যুত্থান বা গৃহযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রেড আর্মির নেতৃত্ব দেওয়ার সময়ে সাফল্যের সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালন করেন। বুখারিনের সঙ্গে অর্থনীতি সংক্রান্ত নানা প্রশ্নে বিপ্লবের আগে এবং পরে লেনিনের গুরুতর মতপার্থক্য হয়েছে, বুখারিন লেনিনের সমালোচনায় আহত হয়েছেন কিন্তু শেষপর্যন্ত তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের স্নেহ শ্রদ্ধার জায়গাটি অটুট ছিল। বুখারিনের অসুস্থতার সময়ে লেনিন তাঁকে জার্মানীতে চিকিৎসার জন্য পাঠান এবং জার্মান চ্যান্সেলরকে এই বিষয়ে লেখা তাঁর ব্যক্তিগত চিঠিতে বুখারিনকে পুত্রবৎ বলে উল্লেখ করেন। কামেনেভ এবং জিনোভিয়েভ অক্টোবর বিপ্লবের সময়ে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেই শুধু ক্ষান্ত থাকেন নি, মেনশেভিক কাগজে সেই গোপন পরিকল্পনাকে ফাঁস পর্যন্ত করে দিয়েছিলেন। লেনিন অত্যন্ত কুপিত হন ও তাঁদের পার্টি থেকে বহিষ্কারের কথা পর্যন্ত বলেন। কিন্তু বিপ্লবের পর কামেনেভ ও জিনোভিয়েভ দুজনেই পার্টি ও প্রশাসনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পান।

ট্রটস্কি ও স্তালিন দ্বন্দ্ব

লেনিনের অসুস্থতার সময় থেকে পার্টির মধ্যে এমন কিছু প্রবণতা মাথা চাড়া দিতে থাকে যা লেনিনকে যথেষ্ট কুন্ঠিত হয়ে। ১৯২২ সালে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক হন স্তালিন। কিছুদিন পর থেকেই স্তালিনের নানা কাজ ও পার্টি পরিচালনা পদ্ধতি সম্পর্কে লেনিন আপত্তি জানাতে থাকেন। স্ত্রুপস্কায়াকে স্তালিনের অপমানের ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে স্তালিনের সঙ্গে লেনিনের ব্যক্তিগত সম্পর্কেরও অবনতি হয় এবং লেনিন তাঁর মনোভাব কঠোর ভাষায় স্তালিনকে জানিয়েও দেন। লেনিন আশঙ্কা করতে থাকেন ভবিষ্যতে বলশেভিক পার্টি নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে বিদীর্ণ হতে পারে এবং দ্বন্দ্বের মুখ্য দুই শরিক হতে পারেন ট্রটস্কি ও স্তালিন। স্তালিনকে পার্টির সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে অপসারণের কথাও তিনি বলেন এবং এর কারণ হিসেবে স্তালিনের ক্ষমতা অপব্যবহারের প্রবণতা, রূঢ়তা, কমরেডসুলভ সহমর্মিতার অভাবের কথা লিখিতভাবে উল্লেখ করেন। বিপরীতে ট্রটস্কি সম্পর্কে তাঁর আপত্তির জায়গা ছিল সবকিছুকে রাজনৈতিকভাবে সমাধানের বিপরীতে প্রশাসনিকভাবে সমাধানের দিকে অতি আগ্রহ।

১৯২৩ এর মাঝামাঝি সময়ে তৃতীয়বার স্ট্রোকের পর লেনিন পক্ষাঘাতগ্রস্থ, চলৎশক্তিহীন, বাকশক্তিরহিত হয়ে পড়েন। এইসময় বলশেভিক পার্টির (তখন তার নাম কমিউনিস্ট পার্টি হয়েছে) পলিটব্যুরোর পূর্ণ সদস্য ছিলেন লেনিন, ট্রটস্কি, স্তালিন, কামেনেভ ও জিনোভিয়েভ। লেনিনের রাজনৈতিক অনুপস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে স্তালিন কামেনেভ ও জিনোভিয়েভের মধ্যে একটি জোট তৈরি হয় ও এই জোট নানা প্রশ্নে ট্রটস্কি বিরোধী অবস্থান নেয়। ১৯২৪ বা ১৯২৫ এর পার্টি কংগ্রেসে অর্থনীতির নানা প্রশ্নে মতপার্থক্য থাকলেও সেগুলি ট্রটস্কি সেভাবে সামনে আনেন নি। তবে কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিটব্যুরোর অধিবেশনে মূলত দুটি প্রশ্নে তিনি পার্টি নীতির বিরোধিতা শুরু করেন। একটি ছিল পার্টির মধ্যে ক্রমবর্ধমান আমলাতান্ত্রিকতা সম্পর্কে ও দ্বিতীয়টি ছিল নেপ এর ফলে কুলাকদের বাড়বাড়ন্তর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের পক্ষে এবং কৃষি থেকে উদবৃত্ত সঞ্চয়ের মধ্যে দিয়ে দ্রুত শিল্পায়নের পক্ষে।

 

নীতির দ্বন্দ্ব : নেপ বনাম দ্রুত শিল্প শিল্পায়ন

দ্রুত শিল্পায়নের পক্ষে সওয়াল করা এই দ্বিতীয় মতটি অবশ্য পার্টিতে প্রথম বলিষ্ঠভাবে সামনে আনেন কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা প্রিয়ব্রাজোনেস্কি। কতদিনের জন্য সোভিয়েত অর্থনীতিকে নেপের আওতায় থাকতে হবে তার কোনও স্পষ্ট ইঙ্গিৎ লেনিনের লেখায় সেভাবে পাওয়া যায় না। পরিস্থিতির বিকাশের ওপরেই তিনি লক্ষ রাখার কথা ভেবেছিলেন। দীর্ঘ অসুস্থতা ও কর্মক্ষমহীন হয়ে পড়া তাঁকে এই নিয়ে নতুন ভাবনাচিন্তার সুযোগ দেয় নি। প্রিয়ব্রাজোনেস্কি নেপ এর বিরুদ্ধে লেনিনের মৃত্যুর পর যখন এই নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা সামনে আনলেন তখন রুশ কমিউনিস্ট পার্টিতে প্রবল বিতর্কর জন্ম হল। ১৯২৫ সালে প্রিয়ব্রাজোনেস্কির “সমাজতান্ত্রিক পূঞ্জীভবনের সূত্র” নামক তত্ত্বায়নটি সামনে আসে। এই তত্ত্বায়নে প্রিয়ব্রাজোনেস্কি বলেন কয়েকটি পুরনো কলকারখানা বাতিল করে নতুন কারখানা স্থাপণ করার মধ্যে দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ায় শিল্পায়ন সম্ভব নয়। পুরো শিল্পের কাঠামোটির খোলনলচে বদলাতে হবে। এজন্য দরকার অর্থ সম্পদ ও প্রভূত বিত্তের। রাশিয়ার যেহেতু পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর মতো উপনিবেশ নেই, যেখান থেকে এই বিত্ত সম্পদ পশ্চিম ইউরোপ তাদের শিল্পায়নের সময় আমদানি করেছিল, রাশিয়াকে এগোতে হবে অন্য পথে। নেপ জমানায় রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কর্তৃত্ত্বের বাইরে থাকা কৃষিক্ষেত্রকেই সম্পদের জোগানদার হিসেবে প্রিয়ব্রাজোনেস্কি চিহ্নিত করেন। মার্কস কথিত আদি ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুঞ্জীভবনের সূত্রটি হাজির করে তিনি ধনতান্ত্রিক পুঞ্জীভবন ও সমাজতান্ত্রিক পুঞ্জীভবনের পার্থক্যের দিকগুলিকেও ব্যাখ্যা করেন। প্রিয়ব্রাজোনেস্কি অবশ্যই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবাধ লুন্ঠনের পথে রাশিয়ার শিল্পায়নের কথা বলেন নি। তবে শোষণ ও সংগ্রহের কথা তিনি বলেছেন। কৃষিক্ষেত্রের উদবৃত্তকে শোষণ করেই রুশ শিল্পক্ষেত্রের বিকাশ সম্ভব বলেই প্রিয়ব্রাজোনেস্কি উল্লেখ করেন।

প্রিয়ব্রাজোনেস্কির প্রথম সূত্রায়নের চড়া অবস্থানকে তিনি নিজেই পরে খানিকটা স্থিমিত করে দেন। পরে তিনি বলেন কৃষকদের থেকে জোর করে ফসল বা কর আদায় করা হবে না। তাদের জমি ও শস্যও বাজেয়াপ্ত করা হবে না। প্রিয়ব্রাজোনেস্কি অসম বিনিময় নীতি চালু করার কথা বলেন। সরকার যেহেতু দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের অধিকারী তাই তার পক্ষে শিল্পজ দ্রব্যের ক্রয়মূল্য সরকারের তরফে বৃদ্ধি করা সম্ভব আর উল্টোদিকে কমানো সম্ভব কৃষিজ পণ্যের দাম। সরকারকে এই অসম মূল্য নীতি চালু করার প্রস্তাব দেন প্রিয়ব্রাজোনেস্কি এবং বলেন এর ফলে সরকার কম দামে কৃষিজ দ্রব্য কিনতে পারবে এবং চড়া দামে শিল্পজ দ্রব্য বিক্রির অধিকার পাবে। গ্রামাঞ্জলে সঞ্চিত সম্পদ সরকারের তহবিলে জমা পড়বে ও সেই তহবিলকে সরকার শিল্পস্থাপণের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবে। ট্রটস্কি এই সূত্রায়ণকেই এগিয়ে নিয়ে যান।

ট্রটস্কি ও লেফট অপজিশন

আমলাতান্ত্রিকতা নিয়ে ট্রটস্কির আক্রমণের মূল নিশানা ছিলেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক স্তালিন ও কৃষি থেকে উদবৃত্ত সঞ্চয়ের মাধ্যমে দ্রুত শিল্পায়নের পক্ষে নীতি বদলের জন্য তাঁর বিতর্কের মূল নিশানায় ছিলেন তখন পার্টির অন্যতম প্রধান অর্থনীতিবিদ ও পলিটব্যুরোতে সদ্য পূর্ণ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়া বুখারিন। এইসমস্ত বিতর্ক সত্ত্বেও ১৯২৫ এর চতুর্দশ পার্টি কংগ্রেস থেকে নির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিটব্যুরোতে ট্রটস্কি ছিলেন। এই সময়ে স্তালিনের সঙ্গে বুখারিন ও বুখারিন অনুগামীদের বোঝাপড়া দৃঢ় হয় এবং কামেনেভ ও জিনোভিয়েভের সঙ্গে স্তালিনের দূরত্ব বাড়ে। কামেনেভ ও জিনোভিয়েভও ট্রটস্কির মতোই দ্রুত শিল্পায়নের পক্ষে নীতি গ্রহণের দাবিতে সোচ্চার হন এবং ট্রটস্কি, কামেনেভ, জিনোভিয়েভ জোট লেফট অপজিশন বা ইউনাইটেড অপজিশন নামে পরিচিত হয়।

১৯২৫ এর পার্টি কংগ্রেসের পর কামেনেভ পলিটব্যুরোতে তাঁর পূর্ণ সদস্য পদ হারান, কিন্তু জিনোভিয়েভ আর ট্রটস্কি পলিটব্যুরোতে পুনঃনির্বাচিত হন। কামেনেভ থেকে যান কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে। তবে জিনোভিয়েভকে পলিটব্যুরোতে রেখেই তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা হ্রাসের প্রক্রিয়া শুরু হয়। পার্টি কংগ্রেসের অব্যবহিত পরেই সাংগঠনিক রদবদলের মাধ্যমে পেত্রোগ্রাদ, যার তখন নতুন নাম হয়েছে লেনিনগ্রাদ – তার নিয়ন্ত্রণ জিনোভিয়েভ অনুগামীদের হাত থেকে সরে আসে বুখারিন অনুগামীদের দিকে। পার্টির মুখপাত্র প্রাভদার সম্পাদক ছিলেন বুখারিন। প্রাভদায় এইসময় থেকে ট্রটস্কি নীতির বিরুদ্ধে নাম করে এবং ইঙ্গিৎ করে লেখা বেরোতে থাকে। ট্রটস্কিও পালটা প্রচার চালাতে থাকেন। পার্টির মধ্যে বিতর্ক তপ্ত ব্যক্তিগত বিরোধের আবহাওয়া তৈরি হয় এবং ১৯২৬ সালে পলিটব্যুরো থেকে ট্রটস্কি ও জিনোভিয়েভকে অপসারিত করা হয়। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশানালের মূল দায়িত্ব থেকে জিনোভিয়েভকে সরিয়ে সেখানে বসানো হয় বুখারিনকে।

ট্রটস্কির বহিষ্কার

বুখারিনের সময়ে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশানালের চিনা নীতি সে দেশের কমিউনিস্টদের বিপর্যয় ও ধ্বংসের কারণ হয়। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশানাল স্তালিন ও বুখারিনের মতানুযায়ী চিনের কমিউনিস্ট পার্টিকে কুয়োমিনটাঙের সঙ্গে সমঝোতা করে চলতে বলেছিল। চিনের পার্টি মনে করেছিল এই নীতি মারাত্মক হবে কিন্ত কমিন্টার্ন স্থানীয় কমরেডদের কথা না শুনে তার নীতি মানার জন্য জোর করে। ফল হয় ভয়াবহ। একটি অভ্যুত্থানের পর মস্কোর নির্দেশে চিনের কমিউনিস্টরা অস্ত্র সমর্পণ করেন এবং তারপর তৎকালীন কুয়োমিনটাঙ প্রধান চিয়াং কাই শেক এর সুযোগ নিয়ে চিনা কমিউনিস্টদের কচুকাটা করেন। হাজার হাজার চিনা কমিউনিস্টকে হত্যা করা হয়। এই মারাত্মক বিপর্যয়ের জন্য ট্রটস্কি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশানালকে এবং বুখারিন ও স্তালিনকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন। পার্টির মধ্যে ক্রমবর্ধমান আমলাতান্ত্রিকতা ও গণতন্ত্রকে খর্ব করার অভিযোগও তীব্রতর করেন। পার্টি অধিবেশনে স্তালিন এইসমস্ত আক্রমণের জন্য ট্রটস্কিকে ক্ষমা চাইতে বললে তিনি ক্ষোভে বিস্ফোরণে ফেটে পড়েন ও স্তালিনকে “বিপ্লবের কবর খনক” (গ্রেভ ডিগার অব রিভোলিউশন) বলে আক্রমণ করেন। ১৯২৭ সালের নভেম্বরে বিপ্লবের দশম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ট্রটস্কি ও তার অনুগামীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। ডিসেম্বরের পঞ্চদশ পার্টি কংগ্রেসের একমাস আগে ১৯২৭ এর নভেম্বরে ট্রটস্কি, জিনোভিয়েভ ও কামেনেভকে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে অপসারণ করা হয় ও পার্টি থেকেই বহিস্কার করা হয়। শুধু তাই নয় তাদের মস্কো থেকে বহুদূরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ট্রটস্কিকে নির্বাসিত করা হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রান্তে আলমা আটায়।

বুখারিন ও নেপের পক্ষে সওয়াল

প্রিয়ব্রাজোনেস্কির তত্ত্বায়নের পরে ১৯২৫ সালেই বুখারিন প্রিয়ব্রাজোনেস্কি সূত্রায়ন ও তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার রাজনৈতিক নেতৃত্ব ট্রটস্কি, কামেনেভ, জিনোভিয়েভদের মতের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়েছিলেন। ট্রটস্কি, কামেনেভ, জিনোভিয়েভদের সমর্থন প্রিয়ব্রাজোনেস্কি সূত্রায়নের পক্ষে ছিল বলে তাঁদের সঙ্গেও বুখারিনের প্রবল বিতর্ক হয়। প্রিয়ব্রাজোনেস্কির তত্ত্বায়নের বিরুদ্ধে বুখারিন তিন দিক থেকে তাঁর আপত্তি জানান – রাজনৈতিক, মানবিক, অর্থনৈতিক। তিনি বলেন প্রিয়ব্রাজোনেস্কি সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক চরিত্রটি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। বুখারিনের মতে, “কৃষকদের সঙ্গে যুদ্ধরত প্রলেতারিয় একনায়কতন্ত্র কোনওমতেই শক্ত ও দৃঢ় হতে পারে না”। বুখারিন মনে করেন প্রিয়ব্রাজোনেস্কি নীতি কৃষকেরা কখনোই মেনে নেবে না। লেনিনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বুখারিন বলেন কৃষক ও শ্রমিকের স্বার্থের মেলবন্ধনের মধ্যেই সোভিয়েত শাসনের সাফল্যের ভিত্তিটি নিহিত আছে। কৃষক বিরোধী নীতি তাই আত্মঘাতী হয়ে উঠতে পারে বলে তিনি মনে করেন। পুঁজিবাদী উন্নয়ন ও সমাজতান্ত্রিক উন্নয়নের মধ্যে জরুরী ব্যবধানের কথাটিও বুখারিন মনে করিয়ে দিতে চান। পুঁজিবাদী শিল্পায়নে গ্রামকে শোষণ করে শহরগুলি পরগাছার মতো বিকশিত হয়। সমাজতান্ত্রিক উন্নয়নে গ্রাম ও শহরের মধ্যে পরগাছা সম্পর্ক থাকতে পারে না। গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন ও বিকাশের মধ্যে দিয়েই সমাজতান্ত্রিক উন্নয়নের কথা ভাবা দরকার।

১৯২৫ এর সেই পর্বে ট্রটস্কি, কামেনেভ, জিনোভিয়েভদের লেফট অপোজিশনের মোকাবিলা স্তালিন বুখারিন ও বুখারিন অনুগামী পলিটব্যুরো সদস্য রাইকভ, তোমস্কিদের নিয়ে একযোগে করেছিলেন। সেইসময় বুখারিনের নেপকে কার্যকরী রাখার পক্ষে সওয়ালের বিরুদ্ধে স্তালিন জাননি। বরং বুখারিনের কৃষক ও শ্রমিক স্বার্থের মধ্যে সমন্বয়ের অবস্থানটির দিকেই ছিলেন। কিন্তু ১৯২৭ সালের পার্টি কংগ্রেসে ট্রটস্কি, কামেনেভ, জিনোভিয়েভদের সম্পূর্ণ পরাজয়ের পর স্তালিন তাঁর পুরনো অবস্থান পরিবর্তন করেন। ১৯২৮ এর প্রথম দিকে একদিকে যেমন বুখারিন ও স্তালিনের বিতর্ক শুরু হয়। স্তালিন কৃষির সমবায়ীকরণ ও দ্রুত শিল্পায়নের দিকে এগোতে থাকেন। এইসময়ে কামেনেভ ও জিনোভিয়েভরা পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিকে চিঠি দিয়ে ক্ষমা প্রার্থণা করেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল তাঁদের দ্রুত শিল্পায়নের মতটি যেহেতু পার্টি  গ্রহণ করে নিয়েছে, তাই এবার তারা পার্টিতে ফিরে পার্টি ও সোভিয়েত রাষ্ট্রের কাজে লাগতে চান। ট্রটস্কি গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পূর্ণ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কথাও তাঁরা বলেন।

কৃষির সমবায়ীকরণ ও বুখারিন স্তালিন দ্বন্দ্ব

১৯২৮ সাল থেকেই সোভিয়েত পার্টির তরফে কৃষির সমবায়ীকরণের নীতি নেওয়া হয় এবং এর মূল পরিকল্পনাকারি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক স্তালিন স্বয়ং। প্রথমদিকে বলা হয়েছিল এই সমবায়ীকরণ প্রক্রিয়ায় কোথাও কৃষকদের ওপর কোনওরকম জোরজুলুম করা হবে না। স্বেচ্ছায় বুঝিয়ে চাষীদের সমবায়ের মধ্যে আনার চেষ্টা করা হবে। সফল সমবায়ের উদাহরণ সৃষ্টির মাধ্যমে চাষীদের বেশি বেশি করে এর দিকে আকর্ষণ করার নীতি নেওয়া হয়। বাস্তবে অবশ্য ১৯২৯ থেকেই জোর করে সমবায়ের মধ্যে চাষীদের নিয়ে আসার কাজ শুরু হয় এবং ১৯২৯ থেকে ১৯৩৪ সালের মধ্যে ৭৫ শতাংশ কৃষিজমিই সমবায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই সমবায়ের মধ্যে আসার ক্ষেত্রে কুলাকদের থেকে সবথেকে বড় আপত্তি ওঠে এবং কুলাকদের নিকেশ করার নীতি নেওয়া হয়। হাজার হাজার কুলাককে গ্রেপ্তার করা হয়, সাইবেরিয়াতে নির্বাসন দেওয়া হয় এবং তাদের চাষের জমি বাজেয়াপ্ত করে তা সমবায়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অনেকে বলেন কুলাক দমনের আড়ালে মধ্য চাষীদের ওপরও আক্রমণ নামছে এবং সন্দেহের বশেও অনেককে অন্যায় হেনস্থা করা হচ্ছে।

১৯২৮ সাল জুড়ে পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে কৃষি বনাম শিল্প বিতর্ক, নেপকে বজায় রাখা বনাম তা থেকে সরে আসা, কৃষকের স্বাধীনতা বনাম সমবায় পদ্ধতিতে চাষ ইত্যাদি নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলে। স্তালিনের নেতৃত্বে যে ফোর্স কালেক্টিভাইজেশন ও কৃষির উদবৃত্তকে বেশি পরিমাণে সরিয়ে এনে শিল্প স্থাপণে ব্যয় করার নীতি পার্টি ও সোভিয়েত রাষ্ট্র গ্রহণ করেছিল বুখারিন ছিলেন সেই নয়া নীতির সবচেয়ে সরব প্রতিবাদী।

১৯২৭ এর পার্টি কংগ্রেসে অবশ্য ট্রটস্কিদের দীর্ঘদিনের দাবি মোতাবেক দ্রুত শিল্পায়নের দিকে এগনোর কথা বলা হয়। ১৯২৮ এর প্রথমদিকে কৃষকদের থেকে উদবৃত্ত সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় কিছু বল প্রয়োগের অভিযোগ তোলেন বুখারিন এবং দীর্ঘদিনের বোঝাপড়া পর্বের পর বুখারিন ও স্তালিনের মধ্যে মতান্তরের জন্ম হয়। কৃষকদের ওপর কোনওরকম জুলুমের বিপক্ষে বুখারিন বরাবর সরব ছিলেন এবং মনে করেছিলেন এজন্য যদি শিল্পায়নের গতি স্লথ রাখতে হয়, তাহলে সেটাও মেনে নিতে হবে। পলিটব্যুরোর দুই সদস্য রাইকভ ও তোমস্কিও ছিলেন বুখারিনের মতের অনুগামী। অন্যদিকে যেহেতু রাশিয়ার কোনও উপনিবেশ নেই তাই রাশিয়াকে যদি শিল্পায়নের দিকে দ্রুত এগোতে হয়, তাহলে কৃষিক্ষেত্র থেকে উদবৃত্ত সঞ্চয়ের মাধ্যমে এগনো ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা খোলা নেই বলেই দ্রুত শিল্পায়নের পক্ষের লোকেরা মনে করতেন।

সোভিয়েত পার্টির তরফে কৃষির সমবায়ীকরণের নীতি নেওয়া হয় এবং এর মূল পরিকল্পনাকারি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক স্তালিন স্বয়ং। প্রথমদিকে বলা হয়েছিল এই সমবায়ীকরণ প্রক্রিয়ায় কোথাও কৃষকদের ওপর কোনওরকম জোরজুলুম করা হবে না। স্বেচ্ছায় বুঝিয়ে চাষীদের সমবায়ের মধ্যে আনার চেষ্টা করা হবে। সফল সমবায়ের উদাহরণ সৃষ্টির মাধ্যমে চাষীদের বেশি বেশি করে এর দিকে আকর্ষণ করার নীতি নেওয়া হয়। বাস্তবে অবশ্য ১৯২৯ থেকেই জোর করে সমবায়ের মধ্যে চাষীদের নিয়ে আসার কাজ শুরু হয় এবং ১৯২৯ থেকে ১৯৩৪ সালের মধ্যে ৭৫ শতাংশ কৃষিজমিই সমবায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই সমবায়ের মধ্যে আসার ক্ষেত্রে কুলাকদের থেকে সবথেকে বড় আপত্তি ওঠে এবং কুলাকদের নিকেশ করার নীতি নেওয়া হয়। হাজার হাজার কুলাককে গ্রেপ্তার করা হয়, সাইবেরিয়াতে নির্বাসন দেওয়া হয় এবং তাদের চাষের জমি বাজেয়াপ্ত করে তা সমবায়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অনেকে বলেন কুলাক দমনের আড়ালে মধ্য চাষীদের ওপরও আক্রমণ নামছে এবং সন্দেহের বশেও অনেককে অন্যায় হেনস্থা করা হচ্ছে।

বুখারিন ছিলেন নয়া নীতির সবচেয়ে সরব প্রতিবাদী এবং ১৯২৯ সালের পর তাঁকে পলিটব্যুরো থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, প্রাভদার সম্পাদক পদ থেকেও তিনি অপসারিত হন। সরে যেতে হয় কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশানালের দায়িত্ব থেকেও। তবে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটিতে থেকে যান। তাঁকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক দায় দায়িত্বে ন্যস্ত করা হয়। এছাড়াও বুখারিন ১৯৩০ থেকে ১৯৩৮ এ তাঁর গ্রেপ্তারী ও হত্যার আগে অবধি শিল্প সাহিত্য বিষয়ে কাজ চালিয়ে যান। তবে সোভিয়েতের সরকারী সাহিত্য নীতি ‘সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম’ এর চেয়ে অনেক ভিন্ন ছিল তাঁর অবস্থান। বরিস পাস্তেরনাককে তিনি সমকালীন রাশিয়ার সবচেয়ে বড় কবি হিসেবে আখ্যা দিয়ে সরকারের বিরাগভাজন হয়েছিলেন।

স্তালিনের নেতৃত্বে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও একদেশে সমাজতন্ত্র গঠনের জাতীয়তাবাদী আবেগ

একদিকে যখন ফোর্স কালেক্টিভাইজেশন চলছে, অন্যদিকে তখন চলছে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আওতায় চলছে দ্রুত শিল্পায়ন। কৃষি থেকে উদবৃত্ত সঞ্চয়ের মাধ্যমে এই কাজ করা হচ্ছিল। শিল্প থেকে সঞ্চিত উদবৃত্তকেও পরে এই কাজে লাগানো হয়। শ্রমিকদেরও কম মজুরীতে এজন্য কাজ করতে হয়। তবে এই পর্বে কিছু ক্ষোভ বিক্ষোভ সত্ত্বেও সোভিয়েতের পুনর্গঠন, পশ্চিমা বিশ্বের সমকক্ষ শক্তি হয়ে ওঠার দেশপ্রেমিক আকাঙ্ক্ষা জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা সঞ্চার করে এবং এই উৎসাহ উদ্দীপনাই রাশিয়ার দ্রুত শিল্পায়ন ও আধুনিকীকরণে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। এই পর্বেই আবার ফোর্স কালেক্টিভাইজেশন, গুলাগ ইত্যাদি বিতর্কের জন্ম হয়। স্তালিন নিয়ে অসীম প্রশংসা ও বিরাট নিন্দাবাদ – উভয় বিপ্রতীপ অবস্থানের ক্ষেত্রেই এই পর্বটির একটি বড় ভূমিকা আছে। স্তালিন অনেক আগেই একদেশে সমাজতন্ত্রের বিজয় সম্ভব নয় - এই অবস্থানের সঙ্গে খানিকটা পার্থক্য তৈরি করে একদেশে সমাজতন্ত্রের পূর্ণ বিজয় না হলেও অনেক অগ্রগতি সম্ভব বলে মনে করেছিলেন। একদিকে যখন ১৯২৯ সালের পর পুঁজিবাদী দুনিয়ায় মহামন্দা জনিত সঙ্কট দেখা দেয়, তখন তার বিপ্রতীপে সোভিয়েত অর্থনীতি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার হাত ধরে দ্রুত এগোতে থাকে। দেশ গঠনের জাতীয়তাবাদী আবেগ ও সোভিয়েত রাশিয়াকে পুঁজিবাদী দুনিয়ার তুলনায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন এই গঠনাকার্যে যথেষ্ট সহায়তা করে।

রুশ বিরোধী ষড়যন্ত্রের নানা অভিযোগ ও বিচার

স্তালিন জমানার একটি বড় বিতর্ক হল ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত সংগঠিত গ্রেট পার্জের অধ্যায়টি। ১৯৩৪ সালের ১ ডিসেম্বর পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য কিরভ লেনিনগ্রাদের স্মোলনি ইনস্টিটিউটে গুলিতে খুন হন। হত্যাকারী ছিলেন নিকোলায়েভ নামে জনৈক ব্যক্তি। এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত সূত্রে গোয়েন্দা সংস্থা একটি বিরাট ষড়যন্ত্র খুঁজে পায় ও সেই সূত্র ধরে গ্রেট পার্জ ও মস্কো ট্রায়ালের অধ্যায় দেখে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই অধ্যায়টি নিয়ে নানা পরস্পর বিরোধী দাবি গত সত্তর বছর ধরেই করা হয়েছে, লেখা হয়েছে অজস্র বইপত্র যার অনেকগুলি একটি অপরটির ঠিক বিপরীত অবস্থান ও ভাষ্য তুলে ধরেছে। স্তালিনের পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণকারীরা এই নিয়ে নিরন্তর বিতর্কে লিপ্ত আছেন। বিষয়টি এতই বড় ও এত বিতর্কিত যে এই নিয়ে এই প্রবন্ধের স্বল্পায়তন পরিসরে সুনির্দিষ্ট কোনও কথা বলা কঠিন।

প্রথমে স্তালিন জমানার সরকারী ভাষ্যটি শোনা যাক। এই ভাষ্যটি বলে ১৯২৮-৩৩ এই পর্বে একদিকে যখন পুঁজিবাদী দুনিয়ায় মহামন্দা ও প্রবল অর্থনৈতিক সঙ্কট চলছে, সেই সময়েই প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, কৃষির সমবায়ীকরণ ও দ্রুত শিল্পায়নের মধ্যে দিয়ে সোভিয়েত সমাজতন্ত্র দ্রুত বিকশিত হতে থাকে। পশ্চিমী দুনিয়া সোভিয়েতের অগ্রগতিকে থামানোর জন্য এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ছক কষে। তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সন্ত্রাস, ব্যক্তিহত্যা, অগ্নিসংযোগ ঘটানো, শিল্প ও কৃষি উৎপাদনের কেন্দ্রগুলো অচল করে দেবার চেষ্টা চালিয়ে যায়। প্রথম দিকে এই ষড়যন্ত্রের স্বরূপ বা তার পূর্ণ চেহারাটা সোভিয়েত নেতৃত্ব বুঝতে পারেন নি। কলকারখানার দামি যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে যাওয়া, গুরুত্বপূর্ণ কারখানার ম্যানেজার বা কৃষিখামারের কর্তার দুর্ঘটনায় মৃত্যু, কয়লাখনিতে জল ঢুলে যাওয়া বা আগুন লেগে যাওয়ার মতো অনেক ঘটনাকে তারা আকস্মিক বলেই ভাবছিলেন। সতর্কতা বৃদ্ধির কথা বলছিলেন।

১৯২৮ সালে ডনেৎস বেসিনের শাখতি খনি অঞ্চলের ঘটনার পর তারা বুঝতে পারলেন এর পেছনে আছে বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পিত ছক। বিপ্লবের সময় এইসব খনির মালিকেরা রাশিয়া থেকে ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সে পালিয়ে গিয়েছিলেন। পরে আবার তারা ফেরেন। রাশিয়ার খনি ও কলকারখানা চালানোর জন্য প্রযুক্তিবিদ্যায় দক্ষ বিদেশীদের দরকার পড়ত। দেশের দক্ষিণপন্থী প্রযুক্তিবিদদের সাহায্যও নেওয়া হত। কারখানা পরিচালক ও প্রযুক্তিবিদদের সোভিয়েত বিরোধী অংশটি নাশকতায় সামিল হচ্ছেন – এটা শাখতি খনি দুর্ঘটনার তদন্তের সময় বোঝা গেল।

এই দুর্ঘটনাকে নাশকতা বলে চিহ্নিত করা হয় ও ষড়যন্ত্রকারীদের গ্রেপ্তার করে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৮ মে, ১৯২৮ সালে মস্কোর ট্রেড ইউনিয়ন হাউসে সংঘটিত এই বিচারে ৫৩ জন প্রথমে অভিযুক্ত হয়। পরে এর মধ্যে ছজন যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে মুক্তি পায়। বাকিদের নানা মাত্রায় শাস্তি দেওয়া হয়। সোভিয়েত নেতৃত্ব এই বিচার প্রক্রিয়ার সময় একে ভীষণ গুরুত্ব দেন ও প্রচারের অন্যতম বিষয় করে তোলেন। পার্টি মুখপত্র প্রাভদায় একের পর এক প্রবন্ধ বেরোতে থাকে, যার মূল কথা হল এই সব প্রযুক্তিদক্ষ বলশেভিক বিরোধীরা বৃহৎ ষড়যন্ত্রের অঙ্গ হিসেবে ভেতর থেকে সোভিয়েত ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিতে চাইছে। এটাকে তারা তাদের তরফে বলশেভিক বিরোধী এক শ্রেণিযুদ্ধ হিসেবে দেখছে। বলশেভিক সরকারকে এ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে এবং শ্রেণিযুদ্ধে শ্রেণিশত্রুদের চিহ্নিত করে নিকেশ করার কাজ চালিয়ে যেতে হবে। এর পরের কয়েক বছরে সোভিয়েত বিরোধী ষড়যন্ত্রের কিছু তদন্ত ও বিচার চলতে থাকে।

শাখতি দুর্ঘটনার বিচারের পর সোভিয়েত বিরোধী চক্রান্তের অভিযোগকে সামনে রেখে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয় ও অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হয়। এই প্রসঙ্গে তিনটি বিচার প্রক্রিয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলি হল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্টির বিচার (১৯৩০), মেনশেভিকদের বিচার (১৯৩১), ভিকার্স ইঞ্জিনিয়ারদের বিচার (১৯৩৩)।

১৯৩০ সালের ২৮ অক্টোবর অধ্যাপক র‍্যামজিন সহ বেশ কিছু নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযোগ তাঁরা গোপনে রাশিয়ায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্টি গড়ে তুলেছিলেন এবং তার সূত্র ধরে নাশকতা সহ নানা ধরনের রুশ বিরোধী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ২৫ নভেম্বর থেকে ৭ ডিসেম্বর, ১৯৩০ পর্যন্ত তাদের বিচার প্রক্রিয়া চলে। অধ্যাপক র‍্যামজিন, ভিকটর ল্যারিতচেভ সহ পাঁচজনকে মৃত্যদন্ড দেওয়া হয়। তিনজনকে দেওয়া হয় দশ বছর কারাবাসের শাস্তি।

ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্টিকে ধ্বংস করার পর হাত পরে মেনশেভিক নেতাদের ওপর। মেনশেভিক নেতাদের অনেকেই সোভিয়েত প্রশাসন ও প্রযুক্তি সংস্থায় উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন। এঁদের অন্যতম গ্রোম্যান, সোভিয়েত শিল্প পরিচালনা সংস্থা গসপ্ল্যানের অন্যতম কর্মকর্তা ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত ভুল হিসেব পেশ করে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাকে কম দেখিয়ে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার গতিকে স্লথ করে দেওয়ার অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত হন। জার্মানীতে পালিয়ে যাওয়া মেনশেভিক নেতা অ্যাব্রোমোভিচের মাধ্যমে গ্রোমান সহ মেনশেভিক নেতারা অর্থ ও অন্যান্য সাহায্য নিয়ে রাশিয়ার ক্ষতি করার চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে রুশ স্বরাষ্ট্র বিভাগ NKVD ও গুপ্তচর পুলিশ OGPU অভিযোগ করে। ১৯৩১ সালের ৯ মার্চ এই মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। অভিযুক্ত মেনশেভিক ষড়যন্ত্রকারীদের পাঁচ থেকে দশ বছর মেয়াদের কারাদণ্ড হয়।

পরের বছর ১৯৩৩ সালে ঘটে ভিকার্স ইঞ্জিনিয়ারদের গ্রেপ্তারী ও বিচার। গুপ্তচর পুলিশ OGPU ১১ মার্চ ১৯৩১ এ মস্কো থেকে গ্রেপ্তার করে ছ জন ব্রিটিশ ও দশ জন রুশ ইঞ্জিনিয়ারকে। এরা সবাই ছিলেন ব্রিটিশ ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান মেট্রোপলিটান ভিকার্সের কর্মী। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয় যে ব্রিটিশ সামরিক গোয়েন্দাবাহিনীর পক্ষ নিয়ে তাঁরা সোভিয়েত ইউনিয়নে গোয়েন্দাগিরি চালাচ্ছেন ও অন্তর্ঘাত ঘটাচ্ছেন। ১২ এপ্রিল মস্কোতে এই মামলার বিচার শুরু হয়। ১৮ এপ্রিল রায় ঘোষণা হয়। দশজন রুশীর মধ্যে একজন ছাড়া পায়। বাকি নজনকে তিন থেকে দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ব্রিটিশদের একজন নির্দোষ সাব্যস্ত হয়ে মুক্তি পান। তিনজনকে সোভিয়েত রাশিয়া ছেড়ে যেতে বলা হয়। দুজন ব্রিটিশের একজন লেসলি থনটর্ন কে দু বছর ও ম্যাকডোনাল্ডকে তিন বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পরে অবশ্য ব্রিটিশ ও সোভিয়েত সরকারের আপোষ মীমাংসার সূত্র ধরে তাদেরও অন্যান্যদের সঙ্গে ব্রিটিশ জাহাজে করে ইংলন্ডে ফেরৎ পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

কিরভ হত্যাকাণ্ড ও মস্কো ট্রায়াল

গোটা প্রক্রিয়াটি এক নতুন বাঁকের মুখে এসে দাঁড়ায় ১৯৩৪ সালের পয়লা ডিসেম্বর। ঐ দিনই ঘটে পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য কিরভের হত্যাকাণ্ড। কিরভ ছিলেন স্তালিনের বিশেষ ঘনিষ্ট সহযোগী। তিনি লেনিনগ্রাদের স্মোলনি ইনস্টিটিউটে গুলিতে খুন হয়েছেন শোনার পরই স্তালিন অন্যান্য পলিটব্যুরো সদস্যদের নিয়ে রাজধানী মস্কো থেকে লেনিনগ্রাদ তথা সেন্ট পিটার্সবুর্গে চলে আসেন ট্রেনে চেপে। তারপর শুরু হয় তদন্ত প্রক্রিয়া। এই তদন্ত প্রক্রিয়া তুলে আনে সোভিয়েত রাষ্ট্র ও নেতৃত্ববিরোধী বিরাট ষড়যন্ত্রের নীল নকশা। স্তালিন আমলের সরকারী ভাষ্যটি জানায় ষড়যন্ত্রের এই নীল নকশা সোভিয়েতের বাইরে বসে তৈরি করেছিলেন ট্রটস্কি। ভেতরে ছিলেন জিনোভিয়েভ, কামেনেভ সহ বিভিন্ন নেতৃত্ব। পরে রাদেক, পিয়াতকভ, সকোলনিকভ, রাইকভ, বুখারিন সহ আরো অনেকের নাম উঠে আসে। ১৯৩৬, ১৯৩৭, ১৯৩৮ সালে তিনটি আলাদা আলাদা বিচার প্রক্রিয়া হয়, যাদের ইতিহাসে মস্কো মামলা বলে অভিহিত করা হয়। প্রথম মস্কো মামলায় ১৯৩৬ সালে অন্যান্য কয়েকজনের সঙ্গে  ট্রটস্কিপন্থী নেতা স্মিরনভ, ম্র্যাচকোভস্কি, ড্রেইটজার ও প্রাক্তন পলিটব্যুরো সদস্য কামেনেভ ও জিনোভিয়েভকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ট্রটস্কি – জিনোভিয়েভ চক্র হিসেবে এই গোষ্ঠীটিকে সরকারী ভাষ্য চিহ্নিত করে। ১৯৩৭ সালের বিচারে মৃত্যুদণ্ড হয় রাদেক, পিয়াতকভ, সোকোলনিকভদের। ১৯৩৮ সালে রাইকভ, ক্রেস্টিনস্কি, স্বরাষ্ট্র দপ্তরের গোপন পুলিশ বাহিনী OGPU র প্রাক্তন প্রধান ইয়েগোদা, তার সহকারী পাভেল বুলানভ ও আরো কয়েকজন নেতার পাশাপাশি বুখারিনও যখন দোষী সাব্যস্ত হলেন এবং তার প্রাণদণ্ড হল ট্রটস্কি – বুখারিন চক্রের নেতা হিসেবে সোভিয়েত রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের কাণ্ডারী হিসেবে – তখন তা শুধু রাশিয়ায় নয়, গোটা দুনিয়াতেই প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে। সরকারী অভিযোগ মোতাবেক এই সমস্ত নেতারা জার্মান নাজিবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। ট্রটস্কির সঙ্গে নাকী নাজি নেতৃত্বের বৈঠক হয়েছিল ও সেই বৈঠকের সূত্র ধরে ঠিক হয়েছিল জার্মান সেনা সোভিয়েত আক্রমণ করবে। সেই সময় ভেতর থেকে সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রতিরোধকে ট্রটস্কি জিনোভিয়েভ কামেনেভ বুখারিন অনুগামীরা দুর্বল করে দেবেন। কলকারখানায় ধর্মঘট ঘটাবেন। জার্মানদের বিজয়ের পর সোভিয়েতের অনেকটা অংশ – ইউক্রেন, জর্জিয়া ইত্যাদি জার্মানদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। বিনিময়ে রাশিয়ার ক্ষমতায় বসানো হবে একজন ট্রটস্কিবাদীকে।

রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিচার ও শাস্তিদানের পাশাপাশিই চলএছিল সামরিক ব্যক্তিবর্গের বিচার। সোভিয়েত রাষ্ট্রের ভাষ্য অনুযায়ী সেনাবাহিনীর উচ্চপদের ব্যক্তিরাও জার্মান এজেন্টের কাজ করছিলেন ট্রটস্কি জিনোভিয়েভ চক্রের নির্দেশে। মিলিটারি জেনারেল মিখাইল চুকাচেভস্কি ও লালফৌজের  অন্য সাত জেনারেল ১৯৩৭ সালের ৩১ মে গ্রেপ্তার হন। ১৯৩৭ সালের ১১ জুন তাদের বিশেষ সামরিক আদালতে বিচার হয় ও পরদিন ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে সবাইকে হত্যার রায় দেওয়া হয়। রায় ঘোষণার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই তা কার্যকরী হয়।

মস্কো মামলার যে দলিল সরকারী ভাষ্য হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে অন্যান্য অভিযুক্ত ও দণ্ডপ্রাপ্তসহ জিনোভিয়েভ, কামেনেভ, রাদেক, বুখারিনরা সকলেই বিচারসভায় রাষ্ট্রীয় তদন্ত আনিত অভিযোগগুলি স্বীকার করে নিচ্ছেন ও জানাচ্ছেন তাঁরা সোভিয়েতবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। তাঁরা জানাচ্ছেন এই কৃতকর্মের জন্য তাঁরা অনুতপ্ত এবং এ জন্য কঠোরতম শাস্তি পাবার যোগ্য। সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকার ও স্তালিন শাসনকে উৎখাত করার জন্য ট্রটস্কি জিনোভিয়েভ চক্র এবং বুখারিন চক্র কী ধরনের রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র চালিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে স্তালিনপন্থী সরকারী ভাষ্যের বিস্তারিত ধারাবিবরণী রয়েছে মাইকেল সেয়ার্স ও অ্যালবার্ট ইউজিন কানের লেখা 'দ্য গ্রেট কনস্পিরেসি' বইতে । এই ভাষ্যের বিস্তারিত পরিচয় পেতে আগ্রহী পাঠক বইটি দেখতে পারেন। তৎকালীন সোভিয়েত সরকারের ভাষ্যকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টি মেনে নেয় ও প্রচার করে। আজও ভারত সহ নানা দেশের নানা কমিউনিস্ট পার্টি স্তালিন আমলের সরকারী ভাষ্যটিই কম বেশি মেনে চলে। কিন্তু এই সরকারী ভাষ্য - যেখানে বিপ্লবের প্রথম সারির নেতৃত্ব, কেন্দ্রীয় কমিটি ও শেষ পার্টি কংগ্রেসের অধিকাংশ প্রতিনিধি তথা পার্টির অগ্রণী নেতৃবৃন্দর অধিকাংশই রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্রে সামিল বলে চিহ্নিত – তাকে সহজ স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে কমিউনিস্ট শিবিরের বাইরের অনেকে তো বটে, ভেতরের অনেকেও মেনে নিতে পারেন নি।

স্তালিনের মৃত্যুর পর নিকিতা ক্রুশ্চেভ ক্ষমতায় আসেন। স্তালিন জমানায় পার্টির ওপরের স্তরে নেতৃত্বের মধ্যে থাকায় তিনি ঘটনাবলীকে সামনে থেকে দেখেছিলেন। ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে এক গোপন বক্তৃতায় তিনি মস্কো ট্রায়াল ও গ্রেট পার্জ বিষয়ে অনেক বাড়াবাড়ির কথা স্বীকার করে নেন। ১৯৬৮ সালে গ্রেট পার্জ ও মস্কো ট্রায়ালের ওপর গবেষণা করে একটি বিখ্যাত বই লেখেন রবার্ট কনকোয়েস্ট। ‘দ্য গ্রেট টেরর’ নামের এই বইতে কনকোয়েস্ট অভিযোগ করেন স্তালিন জমানার এইসমস্ত অভিযোগ অনেকটাই বানানো। স্তালিন ক্ষমতার একাধিপত্যে বিশ্বাস রেখে পলিটব্যুরো, কেন্দ্রীয় কমিটি ও পার্টি রাষ্ট্রের অসংখ্য বিরোধী কন্ঠস্বরকে নিকেশ করেছিলেন।

জিনোভিয়েভ, কামেনেভ, বুখারিন সহ  ষড়যন্ত্রকারী ও শত্রুর চর হিসেবে ঘোষিতদের ওপর আনা অভিযোগ অবশেষে ১৯৮৮ সালে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। গ্রেট পার্জ তথা তাঁদের হত্যাকাণ্ডের পঞ্চাশ বছর পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি গর্ভাচেভ জমানায় এই নিয়ে পুনর্তদন্ত করে ও তাঁদের ওপর আনা অভিযোগকে অমূলক বলে রায় দেয়। সোভিয়েত জমানার মহাফেজখানা গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত হবার পর এই নিয়ে নানা গবেষণা ও লেখালিখি হয়েই চলেছে নিরন্তর। ১৯০৮ সালে রবার্ট কনকোয়েস্টের ‘দ্য গ্রেট টেরর’ বইটির চল্লিশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে একটি নতুন সংস্করণ বেরিয়েছে। এই সংস্করণে একটি বড় ভূমিকা যোগ করেন কনকোয়েস্ট। এর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটেছে। কমিউনিস্ট জমানার অবসান ঘটেছে রাশিয়ায় ও সেখানকার আর্কাইভের নানা গোপন তথ্য গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেছে। সেই সব তথ্যাবলী ১৯৬৮ সালের বইটির মূল প্রতিপাদ্যকে কীভাবে আরো শক্তিশালী করে, এই ভূমিকায় সেটাই বলার চেষ্টা করেছেন কনকোয়েস্ট। এই ভূমিকার একটি তথ্যের দিকে নজর ফেরানো যেতে পারে। ১৯৯১ সালে গর্ভাচভ সোভিয়েত ভাঙনের কিছুদিন আগে ১৯৩৪ সালের সোভিয়েত পার্টি কংগ্রেসের গোপন খবর সামনে আনেন। দেখা যায় ১৯৩৪ সালের সেই পার্টি কংগ্রেসে স্তালিনের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রচুর পরিমাণ, শ খানেকের বেশি ভোট পড়েছিল। সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিলেন পলিটব্যুরো সদস্য কিরভ। তাঁর বিরুদ্ধে ভোট পড়েছিল মাত্র তিনটি। এই নতুন তথ্যের সঙ্গে আমরা যখন মিলিয়ে দেখি এর কয়েক মাসের পরেই সংগঠিত কিরভ হত্যাকাণ্ড ও তার সূত্র ধরে রাষ্ট্রবিরোধী চক্রান্তের অভিযোগে ১৯৩৪ সালের সেই সপ্তদশ কংগ্রেসে উপস্থিত প্রতিনিধি ও তাঁদের ভোটে নির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের পরিণতি – তখন সন্দেহ দানা না বেঁধে পারে না। সেই কংগ্রেসে উপস্থিত ১৯৯৬ জন প্রতিনিধি ও উপদেষ্টা প্রতিনিধিত্ব করছিলেন আঠারো লক্ষ বাহাত্তর হাজার চারশো অষ্টআশি পার্টি সদস্যের। এই ১৯৯৬ জন প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় কমিটিতে নির্বাচন করেন কেন্দ্রীয় কমিটির ১৩৯ পূর্ণ ও প্রার্থী সদস্যকে। ১৯৫৬ সালে বিশতম কমিউনিস্ট পার্টি কংগ্রেসের রিপোর্ট জানিয়েছিল, "১৭ তম কংগ্রেসে নির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটির ১৩৯ জন সদস্য এবং প্রার্থীদের মধ্যে ৯৮ জনকে, অর্থাৎ ৭০ শতাংশকে হয় গ্রেপ্তার নয় গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। (বেশিরভাগ হয়েছিল ১৯৩৭-৩৮ সালে)।" রিপোর্ট আরো জানিয়েছিল যে "১৯৯৬ জন প্রতিনিধি ও উপদেষ্টার মধ্যে ১২০৮ জনকে (৬০ শতাংশকে) বিপ্লববিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।" অর্থাৎ সোভিয়েত পার্টি নেতৃত্বের সামনের সারির বড় অংশটিই স্তালিনের কোপে পড়েন ও রাষ্ট্র বিরোধী হিসেবে অভিযুক্ত হন। পার্টি নেতৃত্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, রুশ বিপ্লবের কাণ্ডারী ও গোপন পার্টির যোদ্ধাদের অধিকাংশ বিদেশী শত্রুর দালাল হয়ে গিয়েছিলেন এবং স্তালিনের নেতৃত্বে সংখ্যালঘিষ্ট নেতৃত্ব সোভিয়েত রাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষায় কাজ করে চলেছিলেন, স্তালিন জমানার এই সরকারী বয়ানে নিরঙ্কুশ আস্থা স্থাপণ করা সহজ নয়।

১৯৯৩ সালে মহাফেজখানা উন্মুক্ত হবার পর নতুন তথ্যের আলোকে নতুন অনেক গবেষণা হয়েছে মস্কো ট্রায়াল ও তিরিশের দশকের সোভিয়েত আমল নিয়ে। আর্চ গেটি এবং রোবের্টা ম্যানিং এর সম্পাদনায় কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত বই ‘স্তালিনিস্ট টেরর : নিউ পার্সপেক্টিভ’ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। মিত্রোখিন আর্কাইভ সামনে এনেছে বিপুল পরিমাণ গোপন তথ্য। অন্যদিকে স্তালিন জমানার সরকারি ভাষ্যের পক্ষে একালেও গ্রোভার ফারের মতো অনেকে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। ফারের ‘ক্রুশ্চেভের মিথ্যাভাষণ’ বইটি বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশনা দপ্তর অনুবাদ করে প্রকাশও করেছে নানা দেশে। এই সমস্ত নতুন গবেষণা ও তথ্যাবলী নির্মোহ গবেষক, ইতিহাস উৎসুক পাঠক থেকে একালের কমিউনিস্ট কর্মীদের আহ্বান জানাচ্ছে নতুন করে গোটা বিষয়টিকে আর একবার পর্যালোচনা করতে। একুশ শতকের সমাজতন্ত্রের নির্মাণে যাঁরা লড়াই চালাচ্ছেন, গণতান্ত্রিক আধারের ওপর যাঁরা সমাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে চান, তাঁদের অবশ্যই বিশ শতকী সমাজতন্ত্রের মহৎ অর্জনগুলিকে মান্যতা দেবার পাশাপাশি খোলামনে এর নানা ধরনের ভুল, অন্যায়, সমস্যা ও সীমাবদ্ধতাগুলি থেকে শিক্ষা নিতে হবে।

 

আকর

১) লেনিন, ট্রটস্কি, বুখারিন, স্তালিন প্রমুখদের এই পর্বের বা এই পর্ব বিষয়ক রচনাবলী। (মার্ক্সিস্ট ডট অর্গ)।

২) দ্য প্রেয়ব্রাজেনস্কি পেপারস – তিন ভল্যুম – রিচার্ড বি ডে ও অন্যান্য সম্পাদিত।

৩) ই এইচ কার - ফ্রম লেনিন টু স্ট্যালিন।

৪) আইজাক ডয়েটশার - দ্য আনফিনিশড রেভোলিউশন : রাশিয়া ১৯১৭ – ১৯৬৭।

৫) উইলিয়াম হেনরি চেম্বারলিন - দ্য রাশিয়ান রেভেলিউশন।

৬) স্টিফেন এফ কোহেন – বুখারিন অ্যান্ড দ্য বলশেভিক রিভোলিউশন।

৭) আলেকজান্ডার এলরিচ – দ্য সোভিয়েত ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিবেট ১৯২৪ – ১৯২৮।

৮) আর্চ গেটি, রোবের্তা ম্যানিং (সম্পা) – স্তালিনিস্ট টেরর : নিউ পার্সপ্রেক্টিভস – কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস

৯) রবার্ট কনকোয়েস্ট – দ্য গ্রেট টেরর (২০০৮ সংস্করণ)

১০) মাইকেল সেয়ার্স, অ্যালবার্ট ইউজিন কান - দ্য গ্রেট কনস্পিরেসি