কমিন্টার্ন, ফ্যাসিবাদ বিরোধী জোট গঠন ও শ্রেণি সংগ্রামের লাইন সম্পর্কে বিতর্ক প্রসঙ্গে

সংসদীয় গণতন্ত্রের মোকাবিলায় কমিউনিস্টদের ব্যর্থতা

১৯১৮ সালে ইয়োরোপ বিপ্লবের দোরগোড়ায় ছিল। কিন্তু ব্যর্থ হল কমিউনিস্টরা। ১৯২৯ সালে কমিউনিস্টরা ভেবেছিলেন এবার একটা হেস্তনেস্ত হবে। বদলে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। ১৯৪৫-৪৬ সালে, ইয়োরোপের কম্যুনিস্ট দলগুলি চমকপ্রদ ভোট পেল। ফ্রান্স, ইতালি, ফিনল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, লুক্সেমবুর্গ, বেলজিয়াম পশ্চিমে আর পূর্বে হাঙ্গেরির, চেক কমিউনিস্টরা দক্ষিণপন্থীদের সাথে জোট সরকারে গেলেন। পশ্চিম জার্মানিতে তারা সরকারে না গেলেও প্রধান বিরোধী দল হলেন। ইংল্যন্ডে কমিউনিস্টরা না এলেও সমাজতন্ত্রী লেবার পার্টি ক্ষমতায় এলো। কিন্তু কমিউনিস্টরা পশ্চিমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারলেন না। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে পুঁজিবাদ মোটামুটি সংকট মুক্ত থেকে গেল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রক্রিয়ায় লুটে নেওয়া সম্পদের একাংশ মার্শাল ঋণের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত পশ্চিম ইয়োরোপকে দিল আমেরিকা। পুঁজিবাদ টিকে গেল। ৫০-র দশকে এসে কমিউনিস্টরা দুর্বল হয়ে গেল। যদিও ফ্রান্স ইতালিতে তারা আরও কিছুদিন শক্তিশালী থাকলো। ১৯৬০-র দশকের ইয়োরোপ প্রায় বেকারহীন। ইয়োরোপ দেখেছিল ট্রেড ইউনিয়নের শক্তিবৃদ্ধি, রেকর্ড ধর্মঘট, যে ট্রেড ইউনিয়নে দাপট ছিল বামপন্থীদের (সাম্যবাদী ও সমাজতন্ত্রী, দুই অংশেরই) দের প্রভাব, ফলে ১৯৬০-র দশকে তারা নাকি বিরাট শক্তিশালী ছিলেন, এমন ধারণা নিয়ে আজও বসে আছে কম্যুনিস্ট শিবির!! ১৯৭০-র দশকে পৌঁছে পুঁজিবাদের দীর্ঘ স্বর্ণ যুগ শেষ হল। আবার তীব্র বেকারত্ব।  বিপ্লবী সংকট বলতে যদি সেই অবস্থা হয় যখন জনগণ আর পুরোনো ব্যবস্থা চাইছেন না আবার শাসকরাও পুরোনো ব্যবস্থা দিয়ে শাসন চালাতে পারছে না, তবে ১৯৭০ দশকের সংকট খুব মন্দ ছিল না। কিন্তু কমিউনিস্টরা এবারও কিছু করে উঠতে পারলেন না। ইংল্যন্ডে তারা হয়তো একটা আসন জিতলো, কিন্তু সেই সব ঘটনা অকিঞ্চিতকর। আবার ফ্রান্সে ১৯৭৪ সালের ভোটে কমিউনিস্টরা জোটে কান ঘেঁষে হেরেছিল তারা। সেই ভোটের মুখ মিতেরঁ ১৯৮১ সালে ক্ষমতায় গেলেন এবং সেই সরকারে কমিউনিস্টরাও অংশ নিল। কিন্তু সেই সরকার আর বুর্জোয়া সরকারের মধ্যে তফাত করা অসম্ভব। আবার ইতালিতেও ১৯৭৬ সালে কমিউনিস্টরা ৩৪% ভোট পেল, এবং বাইরে থেকে দক্ষিণপন্থী সরকারকে সমর্থন করলো। পর্তুগালে ১৯৭৫ সালে স্বৈরতন্ত্রকে হঠিয়ে দেওয়ার পর থেকে তারা যথেষ্ঠ শক্তিশালী। অথচ সমাজতান্ত্রিক সংস্কার কর্মসুচির কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি সংসদীয় গণতান্ত্রিক ইয়োরোপে। অন্যদিকে চিলিতে কমিউনিস্টরা জোটে ক্ষমতায় গিয়ে হাতে লাগাম নিয়ে নিতে পারলেন। হেরে গেলেন ঠিকই কিন্তু তা কম্যুনিস্ট আন্দোলনকে পরাজিত করেনি। যাই হোক, আবার নিজের উপায়েই পুঁজিবাদ সংকট মোচনের পথ খুঁজে নিল- মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তথ্যপ্রযুক্তিতে টাকা ঢাললো, অস্ত্র প্রতিযোগিতায় তাদের সোভিয়েত ব্লক থেকে অনেক এগিয়ে দিল। অস্ত্র ও প্রযুক্তি আমদানি ক্রমেই পূর্ব ইয়োরোপকে ঋণ ফাঁদে জড়িয়ে ফেললো। সুতরাং এবার গৃহযুদ্ধ বাঁধানোর সবরকম উপায় খুলে গেল। মানুষের ক্ষোভ বিক্ষোভ তো ছিলই। যুগোস্লাভিয়া যার কুৎসিততম উদাহরণ। স্রেফ গৃহযুদ্ধকে অস্ত্র করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইয়োরোপে পতনের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ব্লকের বাজার তারা কব্জা করলো। নব অর্জিত সম্পদের ব্যবহারে ১৯৯০-র দশক পুঁজিবাদ সাময়িক ভাবে হলেও প্রাণ ফিরে পেল। আবার সেই সম্পদের সমবন্টনের চাহিদায় ইয়োরোপের দেশে দেশে, সর্ববৃহৎ চারটি দেশেও সমাজতন্ত্রীরা বেশ ভাল পরিমাণ ভোট পেয়ে জোট সরকারে গেল। কিন্তু কম্যুনিস্টদের হাতে কিছুই এলো না। ২০০৯ সালের পর এক দশক অতিক্রান্ত, পুঁজিবাদের সংকট থেকে পরিত্রাণের লক্ষণ নেই। বিপ্লবী সংকট, বা প্রাক বিপ্লবীসংকট, বা যে ভাষাই ব্যবহার করি না কেন, বাস্তবে জনগণ পুরোনো ব্যবস্থাটা চাইছে না। শাসকরাও নতুন ব্যবস্থার খোঁজ করছে। গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাজার দখল, পরিচিতি সত্ত্বার রাজনীটিতে হাতিয়ার করে অস্ত্র ব্যবসার স্বাদ পেয়ে পুঁজিবাদ দিকভ্রান্তের মত এদিক ওদিক ছুটছে। ভোটহীন পুঁজিবাদ আজ তাদের কাছে যথেষ্ট আকাংখিত। ভারতের মত দেশে ফ্যাসিবাদ মাথা চাড়া দিয়েছে, আমেরিকার মত দেশেও মৌলিক রূপান্তরের চাহিদা নিয়ে মানুষ ফ্যাসিস্টদের দিকে পাল্লা ভারী করেছেন। সাধারণ ভাবে রিপাব্লিকানদের সমর্থন আর ট্রাম্পের জেতা এক ছিলনা। আফগানিস্তান ফের দখল করেছে তালিবানরা। আগেও দেখেছি স্বৈরতান্ত্রিক চিলিতে আয়েন্দেকে সামনে রেখে ৭০-র গোড়ায় কম্যুনিস্টদের সরকারে প্রবেশ কম্যুনিস্ট আন্দলনকে দাঁড় করাতে পেরেছিল। আবার এই পর্যায়েও স্বৈরতন্ত্রের মোকাবিলা করে কম্যুনিস্ট-সমাজতন্ত্রীরা বেশ কিছু অগ্রগতি ঘটিয়েছে। যেমন, নেপাল বা ভেনেজুয়েলা। অর্থাৎ স্বৈরতান্ত্রিক দেশে কমিউনিস্টরা যদি বা  এগোতে পারছে, সংসদীয় গণতন্ত্রের উন্নত দুনিয়ায় কিছুই করতে পারছি না আমরা। যত সংসদীয় গণতন্ত্র বিকাশ করছে, ততই কম্যুনিস্ট আন্দোলন দুর্বল হয়েছে। স্বাধীনতার আগে চীনের ভারত তুলনায় সাংঘাতিক উন্নত অর্থনীতির ছিল এমন নয়। কিন্তু এদেশে ১৮৮০-র দশক থেকেই ভোট-আঞ্চলিক সরকার, সবই ছিল। চীনে যার লেশমাত্র ছিল না। সংসদীয় গণতন্ত্রের সেই আংশিক রূপকেই মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছিল ভারতের সাম্যবাদী আন্দোলন। 

জোট ও সংস্কার

অবিচ্ছিন্ন সমান্তরালবাদের শিকার আমরা। প্রতিশ্রুতিবিহীন বা কাল্পনিক সমান্তরাল বিকল্প মডেলের অবাস্তব পুজারী আমরা। সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী আর্থিক মডেলকে পাশাপাশি রেখে প্রতিযোগিতায় আনতে চাইছি। কিন্তু মডেলকে আশু কাজে রূপায়িত করার প্রতিশ্রুতি নেই তা নিয়ে মানুষের মাথাব্যথা হবে কেন? যেমন, পুঁজিবাদের চরম বেকারত্ব-র কারণেই জার্মানি ও ইতালিতে ফ্যাসিবাদ এসেছিল, হিটলারের সোজাসাপ্টা কথা ছিল, যুদ্ধ করলে চাকরি হবে। বাস্তবে কমিউনিস্টরা যেমন রাজনৈতিক পরিসরে জোট-আপোষ নিয়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন, তেমনই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংস্কার বিষয়েও। আমরা সংস্কার আর বিপ্লবকে মুখোমুখি দাঁড় করাই। সমান্তরালবাদেরই বহিঃপ্রকাশ হল ইয়োরোপের দুই স্তরের তত্ত্ব। ‘কাউটস্কাইট মার্ক্সবাদ’ অনুযায়ী সরকারে কমিউনিস্টরা যাবে ঠিকই, কিন্তু তা কোনো সংস্কারের জন্য নয়। স্রেফ রিলিফ দিতে আর সংখ্যা বাড়াতে। কোনো একদিন তারা সেই স্ফীত চেহারা নিয়ে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে অভ্যুত্থান করবেন। ট্রটস্কি বলছেন ৬ মাসের মধ্যে, আর তোগলিয়াত্তি বলছেন আর একটু রয়ে সয়ে, এই যা তফাত। সব সংস্কার তার পরে। এই আলোচনায় পরে আসছি।

সংসদীয় গণতন্ত্রের চারটে চরিত্রের সাথে সংঘাত ও ঐক্যের মধ্য দিয়ে চলতে হয় সব রাজনৈতিক দলকে, কম্যনিস্টদেরও।

1. সরকার গঠন। জার্মানিতে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের ভোটে চমকপ্রদ ফলাফল দেখে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের ধারণা ছিল আইনি সংগ্রাম এখন বেআইনি সংগ্রামের থেকেও বেশী তীক্ষ্ণ। ধনতান্ত্রিক দুনিয়ায় কমিউনিস্টরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারেননি তা দেখে মাও সেতুং এডগার স্নো-এর কাছে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। 

2. বহু দলীয় ব্যবস্থা ও জোট সরকার। ভোটের মধ্য দিয়ে যতবার কমিউনিস্টরা সরকারে গেছে ততবারই জোট সরকারে গেছেন। আবার যে সব দেশে দুটি দলের থেকে বহু দলীয় ব্যবস্থা সেখানে তাদের সরকারে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশী তৈরী হয়েছে। যেমন ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত।

3. সংস্কার। জোট সরকার মানেই ন্যূনতম কর্মসুচীর সরকার। থোরেজ, ফরাসী কম্যুনিস্ট নেতা, যিনি ১৯৩৬ সালের জানুয়ারি মাসে, তাদের দলের অষ্টম কংগ্রেসে বললেন যে জোট সরকারের কাজ হবে বড়লোকদের উপর কর চাপানো, এবং যে সরকার হবে অভ্যুত্থানের ভূমিকা, তিনিই ঐ জোটের ভোটে জেতার পর বললেন যে আপাতত ঐ সরকারের কাজ হবে মূলত রক্ষণাত্মক। অর্থাৎ তিনি যখন সংস্কারের পক্ষে দাঁড়ালেন তখন কিন্তু দক্ষিণপন্থীদের মত করে। সরকারে গেলে বুর্জোয়া হতে হবে, আর কর বসাতে গেলে অভ্যুত্থান করতে হবে। অথচ ফ্রান্সে কম্যুনিস্টদের শক্তি এমনই ছিল যে সেখানে পুঁজিবাদকে পরাস্ত করতে পারলে ইয়োরোপের পরিস্থিতি অন্য রকম হয়ে যেত।

4. পুঁজিবাদের প্রতিনিধি দলগুলি নিজেরাই সংসদীয় গণতন্ত্রের এই তিনটে বৈশিষ্টকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে, একচেটিয়াদের একাংশের শাসন জারি করে, ফ্যাসিবাদকে বার বার ফিরিয়ে আনে।

ভারতে কেরালাতে দ্বিতীয়বার সরকারে এলেন কমিউনিস্টরা। দক্ষিণপন্থীদের সাথে জোটে। পশ্চিমবঙ্গেও তাই, বাম-অবাম জোট। এর আগের তিন দশক ধরে (পরাধীন ও স্বাধীন দুই পর্যায়েই ধরা হচ্ছে) জাতীয় রাজনীতিতে বিরোধী দল হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে তাদের দেখা যায়নি। কিন্তু বাস্তব ঘটনাক্রম ও জ্যোতি বসুর জোট রাজনীতিতে নামার তাগিদ বামপন্থীদের সেই সুযোগ করে দিল। জ্যোতি বসুর এই অবদান ঐতিহাসিক। মন্ডল কমিশনকে বিরোধিতা করে ফ্যাসিস্টদের উত্থান বামপন্থীদের জাতীয় জোট রাজনীতিতে ঠেলে দেয়। ১৯৯৬ সালে জ্যোতি বসুর সামনে জোটের প্রধানমন্ত্রীত্বের সুযোগ এলো।  জোটের প্রধানমন্ত্রী হতে অস্বীকার করে তারা জাতীয় রাজনীতিতে দেশ জোড়া দল হয়ে ওঠার সুযোগ হারালেন। কিন্তু নিজেরা না হলেও তখনো জোটের রাজনীতিতে বামেরা সক্রিয়। জোটকে সমর্থন, বাইরে থেকে। প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে ৬০ জন সাংসদ। কিন্তু ২০০৮ সালে এসে জোট-ধর্মকে অস্বীকার করে আত্মহত্যা করলেন বামেরা।

দলীয় ঐক্য মুর্দাবাদ, শ্রেণী ঐক্য জিন্দাবাদ ?

১০০ বছর আগে ১৯২৪ সালে, কমিন্টার্নের পঞ্চম কংগ্রেসে বলা হয়েছিল ফ্যাসিস্ট যা, সোশ্যাল ফ্যাসিস্টও তাই। কিন্তু এর বীজ রোপন করা হয়েছিল ১৯১৮ সালেই।  জার্মানিতে ক্ষমতায় থাকা সমাজতন্ত্রীদের হাতেই মৃত্যু হয়েছে রোজা লুক্সেম্বুর্গ, কার্ল লিবনেক্টদের। শ্রমিক আন্দোলনকে দমন করার জন্য ফ্যাসিস্টদের ডেকে এনেছিল ইবার্ট সরকারই । ভাইমার আমলেই হু-হু করে বেকারত্ব এবং দুর্নীতিও বেড়েছে। ডয়েচমার্ক মূল্যহীন হয়েছে। আর এই বাস্তবতা শুধু জার্মানিতে নয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইয়োরোপের প্রতিটা দেশেই। সমাজতন্ত্রীদের হাত দিয়েই হয়েছে সব। জনগণের একাংশের সাথেই তাল মিলিয়ে কমিউনিস্টরা বললো, নতুনদের পরে বুঝে নেব, আগে চেনা শত্রু হঠো। কমিন্টার্ন ফতোয়া দিল, আর দেশে দেশে কম্যুনিস্ট পার্টির মধ্যে ‘লুকিয়ে থাকা’ সোশ্যাল ফ্যাসিস্টদের খুঁজে খুঁজে চিহ্নিত করে তাদের বহিষ্কার করা শুরু হল। যদিও মুখে ফ্যাসিস্ট আর সোশ্যাল ফ্যাসিস্টদের সমান শত্রু বললেও, বাস্তবে ফ্যাসিস্টরাই হয়ে উঠলো better evil।  

দলীয় ঐক্য মুর্দাবাদ, শ্রেণী ঐক্য জিন্দাবাদ, এই স্লোগান কম্যুনিস্ট- ফ্যাসিস্ট জোট বা বিরোধী পক্ষের গোপন আঁতাতকে সাহায্য করলো। এক কথায় বললে ফ্যাসিস্টদের সাথে বন্ধুত্ব করার সুযোগ করে দিল। জার্মানিতে লোকের মুখে মুখে ফিরতো লাল-খয়েরী (রেড-ব্রাউন) জোটের কথা। ভাইমার সরকার, বা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে কম্যুনিস্ট আর নাজিরা একসাথে চলেছিল। গণ আন্দোলন থেকে আঞ্চলিক সরকার গঠন পর্যন্ত। কুখ্যাত রেড-ব্রাউন রেফারেন্ডাম সরকারের কথা আমরা জানি।  আবার ১৯৩২ সালে, ভোটের ঠিক আগে ইতিহাসের মোড় ঘোরানো একটি পরিবহন ধর্মঘটে, নাজি আর কমিউনিস্টরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাস্তায় নামে। সেই ধর্মঘট রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। কমিউনিস্টরা তখন মনে করছে অভ্যুত্থানের পরিস্থিতি এসে গেছে। ফলে অভ্যুত্থানে তারা নাজিদের তলাকার জনসমর্থনকে পেতে চাইছিলেন।  তবে শুধু জার্মানি নয় এরকম উদাহরণ সেই সময় ইয়োরোপ জুড়েই দেখতে পাওয়া গেছিল। ১৯৩৪ সালে, দিমিট্রভের লাইন আসার আগে, ফরাসী সরকারের বিরুদ্ধে, ফরাসী সংসদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ফ্যাসিস্টরা মিছিল করে যায়, আর তাদের পাশে পাশে হাঁটে কম্যুনিস্ট বাহিনি!! ফরাসী কম্যুনিস্ট পত্রিকায় স্পষ্ট বলা হয় যে বুর্জোয়া সংসদের উপর যে কোনো হামলাকেই তারা সমর্থন করেন। এই হামলার উপর যদি কোনো সরকারি আক্রমণ নামে তবে প্রমাণিত হবে যে আসলে এই সরকারই ফ্যাসিস্ট!!! এর চার দিনের মাথাতেই সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা একটি যৌথ জমায়েত করার প্রস্তাব কম্যুনিস্ট নেতা কমরেড থোরেজকে দেন, সম্ভাব্য ফ্যাসিস্ট অভুত্থানের বিরুদ্ধে। কিন্তু কমরেড থোরেজ প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। তলা থেকে প্রচুর চাপ আসায় তারা রাজী হয়, কিন্তু তা আনুষ্ঠানিক করতে রাজী হয় না। যদিও কোনো যৌথ ঘোষণাপত্রে সই করতে ফরাসী পার্টি রাজী হয় না। ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় সমাজতন্ত্রী কম্যুনিস্টদের যৌথ স্বাক্ষর পেতে।  সুইডিশ সমাজতন্ত্রী দল জার্মানির সাথে বোঝাপড়া করে চললো। যুদ্ধে বা ইহুদী চালানে সাহায্য করেছিল। সুইডিশ কম্যুনিস্টদের তারা বেশী শত্রু বলে মনে করেছিল।  ১৯২৪ সালে, লেনিন মারা যাওয়ার পর  পঞ্চম কংগ্রেসে এসে জিনোভিয়েভের সভাপতিত্বে কমিন্টার্ন ঘোষণা করল যে আক্রমণের মূল লক্ষ্য হোক সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা, যারাও এক ধরনের ফ্যাসিস্ট। বরং সরকারে থাকার ফলে বেশী শত্রু।  ১৯২৭ সালের মধ্যেই ইয়োরোপের দেশে দেশে পার্টিগুলি টুকরো টুকরো হয়ে গেল। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের নির্বাচনে কম্যুনিস্ট দলগুলিকে একলা চলার নির্দেশ দেওয়া হল। ১৯১৯ সালের বিচিত্র ২১ টি নিয়মাবলী দলগুলির হাত পা বেঁধে দিয়েছিল। এমনকি সুদূর চীনে, দক্ষিণপন্থীদের সাথে যুক্তফ্রন্ট নিয়ে কেন যথেষ্ট আপত্তি তুলছে না কমিন্টার্ন, তা নিয়ে ১৯২৭ সালে কমিন্টার্নের অভ্যন্তরেই শোরগোল উঠেছিল!

প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ ভাল

প্রশ্ন হল, কমরেড দিমিট্রভ বা কমিন্টার্ন কি এই প্রবাদ বাক্য মনে রেখেছিলেন? দিমিট্রভ কি কমিন্টার্নের দশ বছরের অপরাধকে নাকচ করেছিল? পুঁজিবাদ টিকে থাকলেই ফ্যাসিবাদ ফিরে আসবে। দিমিট্রভ লাইন কি ভবিষ্যতের বামপন্থীদের হাতে ফ্যাসিবাদকে মোকাবিলা করার অস্ত্র তুলে দিতে পেরেছিল? নির্দ্বিধায় বলা যায়, পারেনি। ইয়োরোপ জুড়ে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কমিন্টার্নের হুঁশ ফিরেছিল। যখন ফ্যাসিস্টরা বিরোধী পক্ষ, যখন জনগণ ক্ষমতায় থাকা দলের থেকে পরিত্রাণ পেতে মরীয়া তখন সেই ক্ষমতায় থাকা পচনশীল দলের সাথে জোট করে ফ্যাসিস্টদের অভ্যুত্থানকে রোখার স্পষ্ট নির্দেশ কি দিতে পেরেছেন দিমিট্রভ? না পারেননি। বহু আগেই ১৯২২ সালের চতুর্থ কংগ্রেসকে স্বীকৃতি দিতে হতো। এবং সেই কংগ্রেসের সীমাবদ্ধতাকেও টপকে যেতে হতো। 

১৯২২ সালের চতুর্থ কংগ্রেস কম্যুনিস্ট আন্দোলনের এগোনোর বিরাট সম্ভাবনা খুলে দিয়েছিল। লেনিনের এই শেষ বিরাট মাপের অবদানকে ভুলে গেছি আমরা। এই কংগ্রেস ছিল বিতর্কের কংগ্রেস। লেনিন সহ বলশেভিক নেতাদের মধ্যে বিতর্ক হয়েছে, অন্য দেশের নেতারাও বিতর্কে জড়িয়েছিলেন। যার মধ্যে কয়েকটি গুরত্বপূর্ণ নাম হল আর্নস্ট মায়ার, রুথ ফিশার, বোরদিগা, ক্লারা জেটকিন, বেলা কুন, সেরাতি। যে লেনিন ১৯১৯ সালে নিজের হাতে অনুশাসনের ১৯টি পয়েন্ট লিখেছিলেন এবং ইতালীয় বোরদিগার আবদারে আরও দুটো শৃংখল যুক্ত করেছিলেন,  ১৯২২ এর এই কংগ্রেসে সে সব খড়কুটোর মত ভেসে গেলো। এই কংগ্রেস প্রায়শ্চিত্ত করার কংগ্রেস। কমিন্টার্নের জন্ম থেকে ইয়োরোপের বাম হঠকারী লাইনকে যেভাবে ধারাবাহিক প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, তার ভুল সংশোধন করার কংগ্রেস ছিল এটি।

১৯১৮-১৯২২

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইয়োরোপ বিপ্লবের দোরগোরায় ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রাথমিকভাবে রোজা লুক্সেমবুর্গ ১৯১৮ সালে ভোট বয়কট করে অভ্যুত্থানের ডাক দিতে চাননি। কমিন্টার্ন থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি কমরেড রাদেক যদি তাঁর অবস্থানকে জোর দিয়ে সমর্থন করতেন তবে কি সেই অভ্যুত্থান হতে পারতো? প্রায় রাষ্ট্রহীন ইবার্ট সরকার যখন নির্বাচনের ডাক দিচ্ছে, যখন অন্যদিকে ফ্যাসিস্ট ফ্রাইকর্পসদের রাস্তায় নামাতে চাইছে ইবার্ট, তখন অভ্যুত্থানের ডাক দেওয়া হল! আবার ইতালিতে যখন সমাজতন্ত্রী দল ভাঙতে চাইছে না পার্টির অনেকেই, দল তিন খন্ডিত হচ্ছে এই প্রশ্নে, তখন অভ্যুত্থানের সময় হয়েছে বলে দল ভাঙার জন্য রীতিমত পীড়াপীড়ি করলো কমিন্টার্ন। ইয়োরোপের প্রতিটা দেশেই এই নির্দেশ। দল ভাঙতে হবে। যদিও হাঙ্গেরীতে সমাজতন্ত্রীদের সাথে জোট সরকার অতি স্বল্প সময়ের জন্য হলেও  কমিউনিস্টরা প্রতিষ্ঠা করেছিল। রোজাদের এই অভ্যুত্থানের ডাকের ফলে সমাজতন্ত্রী ইবার্ট সরকার সহজেই ফ্রাই কর্পসদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিল। ১৯২০ সালে প্রতিক্রিয়াশীল কাপ (kaap putsch) অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রী ও সাম্যবাদীদের বাস্তব জোট হওয়া মাত্র কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিকে নাক সিঁটকানো শুরু হয়েছিল। যদিও সমস্ত আপত্তি উড়িয়ে এই কাপ অভ্যুত্থানকে পরাজিত করে এক ফ্যাসিবিরোধী আঞ্চলিক সরকার গঠিত হল। ক্ষমতায় থাকা সমাজতন্ত্রীদের কুখ্যাত ট্রেড ইউনিয়ন নেতা কার্ল লাইজেন সেদিন এই ধর্মঘটেরর নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এবং পরে তিনিই যৌথ শ্রমিক সরকারের প্রস্তাবও দিলেন। দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হল ওই সময় লাইজেনের বিরুদ্ধে কম্যুনিস্টদের রুখে দাঁড়াতে উৎসাহিত করলেন এমনকি লেনিন নিজেই। কমিউনিস্টরা কেন দ্রুত লাগাম হাতে নিতে পারছেন না তা নিয়ে ভর্ৎসনা করা হল। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ১৩ই মার্চ ঘোষণা করেছিল যে তারা হেরে যাওয়া সমাজতন্ত্রী সরকারের পক্ষে একটা আঙ্গুলও নাড়বেন না!! (“to lift a finger for the democratic republic”) জার্মান কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা ব্র্যান্ডলার যেভাবে ঐ প্রতিরোধে সামিল হয়েছিলেন, সকলকে জড়ো করেছিলেন, তার জন্য এতটুকুও অভিনন্দন জানানো হল না তাঁকে। এমনকি জার্মান দলের কেন্দ্রীয় কমিটি যখন ওই ফ্যাসিস্ট কাপ ক্ষমতার বিকল্প যে সরকার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তার সাথে অবৈরিমুলক দ্বন্দ্বের সম্পর্ক (loyal opposition) রাখার কথা ঘোষণা করলো তখন কমিন্টার্ন রাগে ফেটে পড়লো। বেলা কুন বললেন, the democratic counter revolution in Germany found an anti democratic competitor…..। যদিও কয়েকদিনের মধ্যেই সাধারণ শ্রমিকদের ধর্মঘটে উৎসাহ ও সক্রিয়তা দেখে কমিন্টার্ন ঢোঁক গিলতে বাধ্য হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত lesser evil ইবার্ট সরকারকে রক্ষা করার এই প্রতিরোধকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন, the tactics adopted was beyond doubt fundamentally correct  এই সিদ্ধান্ত নিতে এত দেরী হওয়ার কথা ছিল না কারণ বলশেভিকরা নিজেরা কর্নিলভের বিরুদ্ধ্বে সশস্ত্র ভাবে কেরেন্সিকে রক্ষা করেছিলেন! ইতিহাসের অনেক দুর্ভাগ্য তখনো বাকি। 

১৯২২, ১৯২৩ সালে স্যাক্সনিতে সমাজতন্ত্রীরা নিজেদের দলের মধ্যে চাপের মুখে পড়ে কম্যুনিস্টদের প্রস্তাব দিল, জোট সরকার গঠন করার। ন্যূণতম কর্মসুচীর ভিত্তিতে। থালহাইমারের মত নেতারা রাজী ছিলেন। কিন্তু কমিন্টার্ন রাজী হলনা। ফলে জোট ভেঙে গেল। যা হলে ইতিহাস হয়তো অন্য খাতে বইতো। ইতালির দিকে তাকানো যাক। মুসোলিনি ক্ষমতায় যাওয়ার মাত্র কয়েক মাস আগেও দক্ষিণপন্থীদের মূল শত্রু ভাবেনি সেখানকার সাম্যবাদীরা। যখন একটি বাস্তব প্রতিরোধ বাহিনি গড়ে উঠলো, ‘আরদিতি দেল পোপোলো’ নামে, তখনও সাম্যবাদীরা তার বিরোধিতা শুরু করলো আর সমাজতন্ত্রীরা দক্ষিণপন্থীদের সাথে হাত মেলালো। কমিন্টার্নও আরদিতির বিরোধিতা করলো। একমাত্র লেনিন এই গণ আন্দোলনের প্রশংসা করলেন, যদিও তিনি ভেবেছিলেন যে এটি সাম্যবাদীদের নেতৃত্বে হচ্ছে (জার্মান কম্যুনিস্টদের দেওয়া চিঠিতে ইতালি সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, সত্যটা জানলে কি বলতেন তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়)। জিনোভিয়েভ ফ্যাসিবাদের উত্থানের পরেও বলছেন যে ফ্যাসিস্টরা প্রকৃত বিপদ নয়, তারা প্রহসন। “কয়েক মাস, বড়জোর কয়েক বছর তারা থাকবে, তার পর চলে যাবে। আর এই পরিবর্তন আমাদের খুব ক্ষতি করবে না”। ওদিকে আর এক বিজেমূলপন্থী ইতালীয় কম্যুনিস্ট নেতা বোরদিগা বলছেন, “তৎকালীন সোশ্যাল ফ্যাসিস্ট শাসনের তুলনায় মুসোলিনিরা গণতান্ত্রিক হবে”। 

রুশ পরিস্থিতির চাপ

লেনিনের নেতৃত্বে রুশ কমিউনিস্টরা নিজেদের বিপ্লব বাঁচাতে মরীয়া ছিলেন তখন। সাতটি সাম্রাজ্যবাদী দেশ চারিদিক থেকে তাদের ঘিরে ধরেছে। তাদের স্বাভাবিক ইচ্ছা হল, যুদ্ধ থামিয়ে সাত দেশের নতুন সরকার এসে সোভিয়েতের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলুক। উপরন্তু রুশ সরকারের কোনো সৈন্য বাহিনি নেই। ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’এর আলোচনার ধারাবাহিকতায় তারা পাকাপোক্ত সেনা রাখবেন না এমনই তাদের সিদ্ধান্ত,  ফলে এখন বিপ্লবের দোহাই দিয়ে রণক্লান্ত সৈনিকদের ফ্রন্টে ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়। জার্মান সরকারের অন্যয্য দাবীর কাছে হার স্বীকার করে ব্রেস্ট লিতভস্ক চুক্তি সম্পাদন করতে হয়েছিল রুশ শিশু সরকারকে। তখন তাদের একটাই আশা। ইয়োরোপে, অন্তত জার্মানিতে বিপ্লব হোক। বিপ্লব না হলেও অন্তত অভ্যুত্থান হোক। সেই আশার একটি চিত্র তুলে ধরেছেন রাশিয়ায় কয়েকমাস কাটানো এক ইংরেজ সাংবাদিক। ব্রেস্ট লিত্‌ভস্ক চুক্তিতে সই করার সিদ্ধান্ত হচ্ছে একটি বৈঠকে, যেখানে এই ইংরেজও উপস্থিত। খবর এলো যে জার্মানির কোনো একটি আন্দোলন ফেটে পড়েছে। অমনি ঘরভর্তি বলশেভিকরা নাকি বিপুল উল্লাসে ফেটে পড়ল। ইয়োরোপে অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা কোনোভাবেই বাতিল বা স্তিমিত না হয়। ফলে সমাজতন্ত্রীদের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক রাখুক ইয়োরোপের সাম্যবাদীরা, তা রুশ পার্টির নেতৃত্বে চলা কমিন্টার্ন ও তার নেতা লেনিন কিছুতেই চান নি। যার পরিণতি, বিশ্ব বিপ্লবের নামে শিশুসুলভ বিশৃংখলাকে প্রশ্রয় দেওয়া। বৃটিশ সাম্যবাদী সিল্ভিয়া প্যঙ্ঘার্স্টকে লেখা তাঁর চিঠিটি এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত উদাহরণ, 

I have no doubt at all that many workers who are among the best, most honest and sincerely revolutionary members of the proletariat are enemies of parliamentarism and of any participation in Parliament….I am personally convinced that to renounce participation in the parliamentary elections is a mistake on the part of the revolutionary workers of Britain, but better to make that mistake than to delay the formation of a big workers’ Communist Party in Britain out of all the trends and elements, listed by you, which sympathise with Bolshevism and sincerely support the Soviet Republic. 

যদিও এই চিঠিতেই তিনি এর বিপরীত কথাও লিখেছেন। ইয়োরোপ জুড়ে তখন বেলা কুন, বোরদিগাদের দাপট। যদিও ইতালি, ফরাসী ও জার্মান দলে বিরোধও ছিল।

লেনিন কিন্তু ১৯২০ সাল থেকেই নিজেদের ভুল বুঝতে শুরু করলেন। ইয়োরোপের সমস্যা বুঝতে শুরু করেছিলেন। তিনি ১৯২০ সালের জুলাই মাসে ইংল্যন্ডের কম্যুনিস্টদের বললেন

“we would put up candidates in a very few but absolutely safe constituencies, namely constituencies where our candidates would not give any seats to the liberals at the expense of labour candidates’। 

কাপ অভ্যুত্থান বিরোধী প্রতিরোধকে সমর্থন জানালেন, একটু দেরী করে হলেও। এবং সবচেয়ে বড় কথা জার্মান ও ইতালীয় বাস্তব যুক্ত ফ্রন্টের অভিজ্ঞতা দেখে ১৯২১ সালের ডিসেম্বরেই কমিন্টার্ন এক্সিকিউটিভ কমিটি জোটের লাইন গ্রহণ করল। ১৯২২ সালের পুর্ণ সভাতে যা ফেলা হল।

তবে স্বীকার করতেই হবে, যে দৃঢ়তা নিয়ে এই লাইন গ্রহণ করার কথা ছিল তা করেনি কমিন্টার্ন। ১৯২০ সালে প্যাঙ্ঘার্স্টদের বিরুদ্ধে কলম ধরলেও  ‘তোমাদের আবেগকে স্যালুট জানাই, কিন্তু রাজনীতিটা বুঝতে হবে তো’ গোছের ভাষা ব্যবহৃত। লেনিনসুলভ নির্দয়তার অভাব লক্ষণীয়। ১৯২০ সালের জুন মাসেই (শিশুসুলভ বিশৃংখলা লেখার একই মাসে) লেনিন লিখলেন সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের উচ্চতম পর্যায়-র দ্বিতীয় ভূমিকা। সেখানেও ভোট-জোট বিরোধী, ফ্যাসিবাদপ্রেমী যুক্তিকাঠামোর প্রতি নরম তিনি। যতই বলশেভিকরা ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকুন যে ফ্যাসিবাদ বিরোধী জোট মানে শুধু তলাকার তথাকথিত শ্রেণী জোট নয়, তা ওপরতলার দলীয় জোট, নেতাদের জোট, তবু বোরদিগা, রুথ ফিশার, এর মত নেতারা বিরাট আপত্তি তুলেছেন দলীয় জোট গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। জিনোভিয়েভের জবাবী ভাষণেও সেই প্রলাপ - অদলীয় শ্রেণী জোটের উপর জোর। লেনিন যে নতুন করে  ভাবছেন তা বোঝা গেল যখন জোটের স্বার্থে তিনিই শাসক সমাজতন্ত্রীদের সম্পর্কে যে ভাষা খসরায় ব্যবহৃত হয়েছিল (বিশ্বপুঁজিবাদের ম্যানেজার) তা বাদ দিতে বললেন। সাবধান করলেন যে এই বাক্য দেখিয়েই সমাজতন্ত্রীরা জোট ভেঙ্গে দেবে বা আদৌ করবেই না। যদিও লেনিন নিজেই এর থেকেও কঠোর শব্দ ব্যবহার করেছেন সয়ামজতন্ত্রীদের সম্পর্কে আগের তিন বছরে। লেনিন বোঝালেন যে রুশ কমিউনিস্টরা নিজেরাই এই সব জোট বিরোধী কথা মেনে চলেনি।  পরিস্থিতি বিচার করে কখনো জোট, কখনো ভোট, কখনো আপোষে চলেছিলেন। কাপ অভ্যুত্থানকে কর্নিলভ প্রতিক্রিয়ার সাথে তুলনা করলেন। তবে রাশিয়ায় বাস্তব পরিস্থিতির পরিবর্তন লেনিনকে দৃঢ় হতে সাহায্য করেছিল। রাশিয়াতে নয়া আর্থিক নীতি প্রচলন, বিদেশী ধনতান্ত্রিক দেশের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে সফল হওয়া, বিশেষত পোল্যান্ড যুদ্ধে তাদের পরাজয়, আর বিদেশী বিনিয়োগ আনার চেষ্টা - সবই লেনিনকে ও কমিন্টার্নকে ১৯-২০-২১ সালের তত্ত্ব বাতিল করতে সাহায্য করেছিল।

১৯২২

১৯২২ সালের কংগ্রেসে ইয়োরোপের প্রথম সারির কম্যুনিস্ট প্রতিনিধিদের তরফ থেকে উঠে আসা প্রশ্নগুলি নিয়ে চর্চা হলে ভবিষ্যত কম্যুনিস্ট আন্দোলনের উপকার হতো। যেমন,

  • সাম্যবাদী-সমাজতন্ত্রী জোট কি সাময়িক?

একদিকে বেলা কুন বা ভারগার মত বিজেমূলপন্থী আর অন্যদিকে ক্লারা জেটকিন, বুলগেরিয়ার কমিউনিস্টরা। যারা বাস্তবে যুক্ত ফ্রন্ট গড়ে তুলেছিলেন বলেই কমিন্টার্ন বাধ্য হয়েছিল এই নীতি গ্রহণ করতে। সমাজতন্ত্রীরা বুর্জোয়া দলের বাম অংশের সঙ্গে জোট চাইছে। আর কমিউনিস্টরা শুধু সমাজতন্ত্রীদের সাথে, এমন একটা জটিলতা নিয়েও আলোচনা হয়েছিল। মাথায় রাখতে হবে তখন সমাজতন্ত্রীদের শুধু দক্ষিণপন্থীই নয়, একেবারে ফ্যাসিস্ট সরকার বলা হচ্ছে।  

  • জোট শুধু সমাজতন্ত্রী-সাম্যবাদী হবে নাকি বাম ও দক্ষিণপন্থীও হতে পারে?

কাপ অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ আগেই তুলেছি। লাঞ্জিয়েনের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রীরা একটি সাংবিধানিক সংসদীয় মডেলের বাম-অবাম সরকার চাইছিল। কম্যুনিস্টদের মধ্যে বিভাজন দেখা দিল। অন্যদিকে ফ্রান্সে বাম-দক্ষিণপন্থী জোট হয়েছিল, ফ্রান্স নিয়ে জিনোভিয়েভ বলার চেষ্টা করেন যে ওটা ফ্রান্সেরই বৈশিষ্ট।

  • জোট সরকারকে দেরী না করে দ্রুত অভ্যুত্থানের হাতিয়ারে পরিণত করতে হবে

১৯২৩ সালে শেষে কমিউনিস্টরা স্যাক্সনিতে জোট সরকারে প্রবেশ করলো। কিন্তু অভ্যুত্থানের ঘোষিত উদ্দেশ্যের ফলে সেই সরকার টিকলো না। সরকার ভেঙে গেল। শ্রমিক সরকার কি ধরনের কাজ করবে? সেই প্রশ্নের উত্তরে বলা হল যে তারা শ্রমিকদের সশস্ত্র করবে, বড়লোকদের উপর কর বসাবে, কলকারখানাগুলোতে শ্রমিক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা হবে, ইত্যাদি। সশস্ত বাহিনির সুরক্ষিত পাহারায় তৈরী হবে এই সরকার। যদিও লেনিন মনে করেছেন। 

pro-capitalist Labour government would enable workers ‘to be convinced by their own experience’ that the Labour leadership was ‘absolutely good for nothing’

কিন্তু এই উদ্দেশ্য সম্পন করতে হলে কম্যুনিস্টদের সংস্কার কর্মসুচী দরকার। শ্রমিকদের সশস্ত্র বা নিরস্ত্র যার মুখ্য বিষয় হতে পারে না। আর্থিক-সামাজি-সাংস্কৃতিক সংস্কারের কর্মসূচির অভাব লক্ষণীয়। অন্যদিকে ট্রটস্কি ৬ মাসের মধ্যে অভ্যুত্থানের পরামর্শ দিলেন, সংস্কার বিরোধিতার চূড়ান্ত বার্তা।

কমিন্টার্ন সিদ্ধান্ত নিল যে তারা বুর্জোয়া সরকার আর শ্রমিক সরকারের মধ্যে পার্থক্য টানবে। ১৬ই নভেম্বর লেনিন-ট্রটস্কি-বুখারিন-জিনোভিয়েভ, সকলেই একমত ছিলেন যে সরকারে যাওয়া উচিত না। কিন্তু এক মাসের মধ্যেই তারা মত বদলালেন। তবে অনেক শর্ত সাপেক্ষে। সরকারে গেলেও দ্রুত অভ্যুত্থান করতে পারবে, এটাই হাতিয়ারে পরিণত হবে ইত্যাদি। জার্মানির উদাহরণ টেনে বলা হল যেহেতু কেন্দ্রীয় বার্লিন সরকার বুর্জোয়া আর স্যাক্সন সরকারের সীমিত ক্ষমতা। এমনকি প্রথম দুটো খসড়ায় এই শ্রমিক সরকারকে একনায়কতন্ত্র বলা হল। জিনোভিয়েভ বললেন যে এই সরকার তৈরী হবে বুর্জোয়াদের উচ্ছেদ করে। ক্রমে বিতর্ক বাড়তে লাগলো। কাপ অভ্যুত্থানের পর যে সরকার হল, সেটা ঠিক কি? বুর্জোয়া একনায়কতন্ত্র নাকি শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র? লেনিন জুন মাসে ১৯২০ সালে যেহতু জার্মান কম্যুনিস্টদের শর্তসাপেক্ষ সমর্থনকে সীলমোহর লাগিয়েছেন ফলে আপাতত আর কেউ কিছু বলল না। কিন্তু এক বছর পর মার্চ মসের অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টার পরে আবার বিতর্ক সামনে আসে। ভাইমার সরকারের হাতে বহু হত্যার পর। যদিও কয়েক মাস পরে রাদেক আবার সেই হত্যাকারীদের সাথেই জোটের পক্ষে সওয়াল করতে শুরু করেন। জিনোভিয়েভ বললেন যে স্লোগানকে সাধারণভাবে ব্যবহার করা অনুচিত। সরকার গঠন সত্ত্বেও অভ্যুত্থান দরকার হবে, বললেন তিনি।

  • জোট সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন যদি বা দেওয়া যায়, সেই সরকারে অংশ কি নেওয়া সম্ভব?
  • এই সরকার ভোটের মধ্য দিয়ে সরকার নাকি অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকার?

এমন নয় যে সরকার শব্দটা না জেনে ব্যবহার করা হয়েছে। বোরদিগা সতর্ক করলেন যে এই স্লোগান শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে এমন ধারণা তৈরী করবে বুঝি বা সশস্ত্র ক্ষমতা দখলের আর দরকার নেই! ট্রটস্কি বললেন যে স্যাক্সনিতে সরকারে কম্যুনিস্টদের অংশগ্রহণ করা সমীচন তখনই যদি তারা নিজেদের মন্ত্রীদের ব্যবহার করে আগামী ৬ মাসের মধ্যেই অভ্যুত্থান ঘটাতে পারেন! অর্থাৎ এই সরকার শব্দ যে ভোটের মধ্য দিয়ে হতেই পারে তা নিয়েই বিতর্ক চলেছে। তাই জিনোভিয়েভ বলার চেষ্টা করলেন যে সরকার মানে আসলে তা শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কতন্ত্র অর্থেই (উনি pseudonym শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন) ব্যবহৃত। খুব সাবধানে এই স্লোগান ব্যবহার করতে হবে, একমাত্র সেখানেই যেখানে আমাদের পাল্লা ভারী, সশস্ত্র জনতার দ্বারা পরিবেষ্টিত আমরা। যদিও জোটপন্থী রাদেকও এই মতকেই সমর্থন করলেন। ১৯২২ সালের ঐতিহাসিক অবদান এটাই যে জোট শুধু আন্দোলনের নয়, ক্ষমতার জন্য জোট। সরকার গঠনকে কেন্দ্র করে খসড়াটিই সবচেয়ে বেশী বার পরিমার্জিত, পরিবর্দ্ধিত হয়। শুধু তাই নয় জোট সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হওয়ার পরেও তিনটে ভিন্ন দলিল ভিন্ন দেশের দলগুলিকে বিলি করা হয়!! দেখা যায় যে ইংরেজিতে যে দলিলটি বিলি হয় সেটি যা গৃহীত হয়েছিল তার থেকে আলাদা!! (এটি বলছেন রিড্‌ল সাহেব) জার্মান কমিউনিস্টরা সরকার গঠনের লাইন চেয়েছে্‌ কারণ তারা তা বাস্তবে করেছে। যদিও জার্মান দলেও সর্বজন গ্রাহ্য সিদ্ধান্ত হয়নি। কমিন্টার্ন পরিচালন কমিটির বৈঠকে যে খসড়া হয় সেটা নিয়ে কমিন্টার্ন মিটিঙে জিনোভিয়েভ প্রথমেই বলেন যে জার্মান দল প্রেরিত খসরা টি যথেষ্ঠ পরিষ্কার নয়। কিন্তু বাস্তবে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল সেখানে ‘প্রায় সর্বত্র’ (almost everywhere) শব্দটাই ব্যবহৃত হল। সুতরাং বহু বিতর্কের পর সরকার শব্দটা থাকলো শুধু তাই নয়, প্রায় সর্বত্র কথাটাও থাকলো।

  • জোট এবং জোট সরকার, কোন প্রেক্ষিতে অনুমোদন যোগ্য

যখন পুঁজিবাদ দুর্বল, যখন পুঁজিবাদ সবল নাকি সবসময়? এই প্রশ্নে খুব বিতর্ক হয়নি। মূলত ট্রটস্কি প্রতিষ্ঠা করেন যে এই জোট বা সরকার সবই এই কারণেই যে পুঁজিবাদ আপাতত দুর্বলতা কাটিয়েছে। সে আগ্রাসী হয়েছে। যদিও মাত্র সাত বছরের মধ্যেই মহাপতন হয় পুঁজিবাদের!  

বহু বিতর্কের মধ্য দিয়ে ১৯২২ সালের ওই ঐতিহাসিক কংগ্রেস ভারসাম্য রক্ষা করলো ঠিকই কিন্তু আগামী দিনের কম্যুনিস্টদের জন্য সার কথা বলে গেল।

১) কমুনিস্টরা প্রয়োজনে দক্ষিণপন্থী সরকারকে সমর্থন করতে পারবে।

২) কমিউনিস্টরা সেই সরকারে যোগদানও করতে পারবে।

3) সেই সরকার ভোটের মধ্য দিয়েও হতে পারে।

4) সেই সরকারই অভ্যুত্থানের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।

যেখানে সমাজতন্ত্রীরা শয়ে শয়ে কম্যুনিস্ট খুন করছে, যেখানে সমাজতন্ত্রীদের সরকারের আমলে লাখে লাখে বেকার তৈরী হচ্ছে, যেখানে তাদের সাথে আন্দোলনের জোটই মানা হছে না, যেখানে একটানা তিন বছর ধরে জোট-ভোট পন্থীদের দল থেকে বের করে দেওয়াই রেওয়াজ হয়ে আছে, সেখানে এই ধরনের সিদ্ধান্ত বিরাট ব্যাপার। ১৯৩৪ সালের কমিন্টার্ন চাইলে এই গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কগুলির সারসংকলন করে আগামী কম্যুনিস্ট আন্দোলনকে পথ দেখাতে পারতো।

কম্যুনিস্টদের বাড়তে থাকা আপাত জনপ্রিয়তা বিপদ ডেকে আনলো

১৯২৪ সালে এসে ১৯২২ সালের এই মহামূল্যবান দলিলকে নাকচ করা হল। ১৯২২ সালের ‘ভারসাম্য রক্ষা’ করা সিদ্ধান্ত বিপদ ডেকে আনলো। বলা হয়েছিল যে পুঁজিবাদ দুর্বল হলে আর জোট-ঘোঁট চলবে না। বাস্তবে দেখাও গেল পুঁজিবাদের বিপর্যয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের দৃপ্ত অগ্রগতির ফলে জোট-সরকার ছাড়াই কম্যুনিস্ট দলগুলিতে আবার সদস্য সংখ্যা বাড়তে শুরু করলো। ফরাসী কম্যুনিস্টদের সদস্যপদ চার বছরে ৩০ হাজার থেকে তিন লক্ষ হয়ে গেল। সাংসদ সংখ্যা ১৪ থেকে ৭২ হয়ে গেল। ৮% থেকে ১৫% ভোট পেল তারা (১৯৩২ থেকে ১৯৩৬) 

কিন্তু কম্যুনিস্টদের এই বাড়তে থাকা ভোট বিপদ ডেকে আনলো। জার্মানিতে কম্যুনিস্ট ভোট বাড়লো, সমাজতন্ত্রীর আগের মতোই ২০% থেকে গেল। যেহেতু জোটের সমস্ত সম্ভাবনাই খারিজ হয়েছে, সুতরাং জার্মানিতে ভাইমার সরকার আরও বেকায়দায় পড়লো। নাজিদের সুযোগ বাড়তে থাকলো। ফলে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠরা অর্জন করার পরিস্থিতিতে থাকলো না। জার্মানিতে কম্যুনিস্টদের আর নাজিদের ভিত্তি ছিল একই, বেকার বাহিনি। ভাইমার সরকারের নীতির ফলে বেকার বাড়ছে, ফলে তাদের সাথে জোট করার কল্পনাও করতে পারছে না কমুনিস্টরা। যে বেকার বাহিনির মুখ চেয়ে তারা জোটে গেলেন না তারাই কয়েক দিনের মধ্যেই কম্যুনিস্টদের মধ্যে কোনো ভবিষ্যত দেখতে না পেয়ে দ্রুত ফ্যাসিস্টদের দিকেই ঢলে পড়লেন। এবং এই বেকার বাহিনিই হিটলারের অন্যতম ভক্তবৃন্দ হয়ে উঠলো। যুদ্ধ অর্থনীতির মধ্য দিয়ে বেকার সমস্যা সমাধানের স্বপ্ন দেখানো হল। যদিও বেকার বাহিনি বহুবার আশা করেছে যে কমিউনিস্টরা সরকারে যাবে। ১৯৩২ সালের ভোটে, কম্যুনিস্ট আর সমাজতন্ত্রী মিলে পেয়েছিল ২২১ টা আসন, ৩৭% ভোট। যেখানে নাজিরা পেয়েছিল ১৯৬ টা আসন আর ৩৩% ভোট। কিন্তু তারা জোট করেনি, ফলে ১৯৩৩ সালের মার্চের ভোটে তাদের মোট আসন সংখ্যা নাজিদের থেকে কমে গেল। ফ্রান্সেও ১৯৩২ সালে সমাজতন্ত্রী-সাম্যবাদী ও মধ্যপন্থীরা মিলে ৩৪০টা আসন পেয়েছিল, মোট আসন ছিল ৬০৭। কিন্তু জোট হয়নি। ফরাসী কমুনিস্টদের মুর্খামির নমুনা দেখুন, 

The tactic of class against class… tested in France during four years of economic or political struggles will be firmly applied by the whole of the Party during the course of this electoral campaign. The responsible organisms of the Party, from the cells up to the Political Bureau, will be on the alert so that there nowhere re-occur the defections and compromises with the Socialist, or even the Radical, Party, as occurred in certain regions in 1928…During its electoral campaign our Party must be on the alert so as not to fall into the error where right opportunism allies itself with the most narrow-minded sectarianism… It must once again be repeated that far from being a sectarian tactic, our tactic of class against class, which prohibits any electoral bloc in any form with the Socialist Party, supposes and signifies a united front at the base with Socialist workers…

ফলে সরকার করেছিল দক্ষিণপন্থীরা। ফ্রান্স বেঁচে গেছিল কারণ ১৯৩৪ সালে পরবর্তী ভোট টা হয়েছিল, আর জার্মানিতে তা হয়েছে ১৯৩৩ সালে। ফ্রান্সের মত জার্মানিতেও বা স্পেনেও যদি এক বছর পরে ভোট হতো, তবে ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দিমিট্রভ                

কেউ কেউ হয়তো বলবেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর peoples’ democracy –র যে ধারণা গড়ে উঠলো সেটাই দিমিট্রভের ভাবনার ধারাবাহিকতা। যা সমাজতন্ত্র বা নয়া গণতন্ত্র নয়। যা ভোটের মধ্য দিয়ে জোট সরকারকে বোঝাচ্ছে, যা শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র নয়, যা জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস নেবে। কিন্তু তাহলে প্রশ্ন আসবে কেন সেই ধারণা মূলত পূর্ব ইয়োরোপেই বহাল হল? কেন তবে দিমিট্রভ নিজেই বললেন যে পিপলস ডেমোক্র্যাসি আসলে সোভিয়েত ডেমোক্রাসি। সবচেয়ে বড় কথা কি কি প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল?

এমন নয় যে দিমিট্রভের তত্ত্বের কোনো প্রভাবই পড়েনি। 

চার্চিল বিজয়ী দেশের প্রধান, তা সত্ত্বেও মানুষ তাদের জেতাল না। ইয়োরোপ জুড়ে মানুষ সোশাল ডেমোক্র্যাট ও কম্যুনিস্টদের শক্তিশালী করলো। যাতে জনকল্যাণের কাজটা বা সংস্কার সুসম্পন্ন হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতেই, ১৯৪৫ সালে ভোটে কম্যুনিস্টদের ভোট শতাংশ এরকম ছিল – অস্ট্রিয়া — ৫.৪%। বেলজিয়াম - ১২.৭%। ডেনমার্ক - ১২.৫%। ফিনল্যান্ড - ২৩.৫%। ফ্রান্স - ২৬%। ইতালি - ১৯%। নরওয়ে - ১২%। সুইডেন - ১০.৩%। পঃজার্মানি - ৬%। ফ্রান্সে পর পর দুটি ভোটেই কমিউনিস্টরা খুব ভাল ফল করলো। ১৯৪৫ সালে ২৬% আর ১৯৪৬ সালে আরও বেশী, প্রায় ২৯%। সমাজতন্ত্রী আর কম্যুনিস্টদের যৌথ ভোট ধরলে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ইতালিতে। ১৯৪৬ সালের ভোটে ইতালীয় কম্যুনিস্ট পার্টি পাচ্ছে ১৯% ভোট আর সমাজতন্ত্রীরা পাচ্ছে প্রায় ২১% ভোট। অন্যদিকে দক্ষিণপন্থী দল পাচ্ছে ৩৫% ভোট। বামেরা সরকার বানাতে পারছে না!! এর থেকে শিক্ষা নিয়ে পরের বছর কম্যুনিস্ট আর সমাজতন্ত্রীরা একসাথে লড়ছে, কিন্তু ততদিনে প্রায় ৮% ভোট চলে গেছে তাদের। ফিনল্যান্ডে তারা মধ্য পন্থী অবাম দলের সাথে জোট সরকারে থাকল। এছাড়া হাঙ্গেরী আর চেকোস্লোভাকিয়াতে কম্যুনিস্ট পার্টি ভোটে ভাল ফল করলো। এই পাঁচটি দেশেই তারা দক্ষিণপন্থী দলের সাথে জোট করে সরকারে আসীন হল। ফ্রান্সে ক্যাথলিক Republicain Populaire (the MRP); ইতালিতে Democrazia Cristiana (DC-Christian Democratic Party), আর ফিনল্যান্ডে Agrarian Party-র সঙ্গে। কিন্তু ১৯৫০ সালের মধ্যেই কম্যুনিস্টদের অবস্থা খারাপ হতে শুরু করলো। কেন? পরের অধ্যায়ে সেই প্রসঙ্গে কিছু কথা বলবো। ১৯৪৮ সালে পশ্চিম জার্মানি, ডেনমার্ক, নরওয়ে, বেলজিয়াম, ইংল্যন্ড, হল্যান্ড আর অস্ট্রিয়াতে স্বাধীন শক্তি হিসেবে তাদের গুরুত্ব কমে গেল। ইংল্যন্ডে মাত্র দুটি আসন জিতল কমিউনিস্টরা। স্পেন আর পর্তুগাল, যেখানে তখনো ক্ষমতায় স্বৈরতান্ত্রিক দক্ষিণপন্থা, সেখানে কমিউনিস্টরাই মুখ্য বিরোধী পক্ষ থাকলো। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উন্নত দুনিয়ায় কম্যুনিস্টদের এগোনোর বিরাট সুযোগ সামনে এলো অথচ আমরা পারলাম না।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ইয়োরোপের পুঁজিবাদী দেশগুলিকে হুমকি দিয়ে রেখেছিল, মার্শাল ঋণ দেওয়ার একমাত্র শর্ত হল বাম মুক্ত পশ্চিম ইয়োরোপ গড়ে তুলতে হবে। ফ্রান্সের মার্কিন দূত জেফারসন কাফেরির ভাষায়, I told Ramadier no communists in government or elsewhere..  ১৯৪৭-১৯৪৮ সালের মধ্যে ফ্রান্স, ইতালি, বেলজিয়াম, লুক্সেমবুর্গ, অস্ট্রিয়া, ফিনল্যান্ডে কম্যুনিস্টদের শাসক জোট থেকে বহিষ্কার করলো বেইমান দক্ষিণপন্থী দলগুলি। সব ধরনের নোংরামির আশ্রয় নিল দক্ষিণপন্থীরা। ইতালিতে মাফিয়াদের উত্থান ঘটাতে পিছুপা হল না। মাফিয়ারা বাম খুঁজে খুঁজে হত্যা করা শুরু করলো। শেষে তোগলিয়াত্তিকেও গুলি করা হল। যে কোনো ভাবেই হোক কমিউনিস্টরা যাতে বিক্ষোভে নামে, এটাই ছিল উদ্দেশ্য। বিক্ষোভ হল, উত্তাল হল ইতালির শহর, ব্যাস, কমিউনিস্টরা অভ্যুত্থান করতে চাইছে, এই অজুহাত তুলে তাদের বের করে দেওয়া হল। ফ্রান্সেও একটি শ্রমিক আন্দোলন আসলে গোপনে অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নিচ্ছে, এই বলে বিতাড়িত হলেন বামেরা। এর সাথে চেকোস্লোভাকিয়ার কম্যুনিস্ট দলের কৌশলকে নিয়ে অপপ্রচার চালালো দক্ষিণপন্থীরা। চেকোস্লাভিয়াতে দক্ষিণপন্থীদের সাথে জোট সরকারে থেকে তারা সেই সরকারকে হাতিয়ার করে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছালেন এবং পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকে চূর্ণ করার কাজে হাত দিয়েছিলেন। তাদের কৌশিক্সে দলিল যা কৌশিক্সে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মসুচী, সেই সময় বিরাট বিতর্কের জন্ম দেয়। দক্ষিণপন্থীদের সাথে জোট সরকারে যাওয়া এবং সেই সরকারকেই অভ্যুত্থানের হাতিয়ার করার থিসিস অনুযায়ী তারা সফলও হলেন। যদিও সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতা না থাকলে এই সাফল্য অত সহজে হতো না, তা বলাই বাহুল্য। তাছাড়া পশ্চিম ইয়োরোপে এভাবে বিতাড়নের ঘটনা না হলে, পুর্ব ইয়োরোপে দক্ষিণপন্থীদের তাড়ানো হতো না, সোভিয়েত ইউনিয়ন এই যুক্তি অবশ্যই দিয়েছিল। এবার কথা হোল, সাম্রাজ্যবাদের কাজ তারা করেছে, করবেই। 

প্রশ্ন হোল, পশ্চিম ইয়োরোপের কমিউনিস্টরা এই আক্রমণকে মোকাবিলা করার জন্য কতটা প্রস্তুত ছিলেন? পশ্চিম ইয়োরোপের দেশগুলিতে কমিউনিস্টরা কি বুর্জোয়া দলগুলির উপর একটু বেশী ভরসা করেছিলেন? হয়তো ভেবেছিলেন ফ্যাসিবাদ বিরোধী যে জোট হয়েছে তা যুদ্ধের পরও বহাল থাকবে?? তা হয়নি, হওয়ার কথাও ছিলনা। সেক্ষেত্রে ফ্রান্স-জার্মানি-ইংল্যন্ডের কম্যুনিস্ট পার্টিগুলির আপ্রাণ চেষ্টা থাকার কথা যাতে তারা জোট সরকারে থেকে যেতে পারেন, আবার বেশীদিন সময় তারা পাবেন না সেটাও মাথায় রাখার কথা। কম্যুনিস্ট দলগুলির তাগিদ ছিল না তা নয়। সরকার থেকে বিতাড়নের আগে, November 1946, থোরেজ বললেন যে তারা একটি ফরাসী শ্রমিক দল তৈরী করতে চান যা কম্যুনিস্ট ও সমাজতন্ত্রীদের যৌথ মঞ্চ হবে। উদ্দেশ্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। ১৯৪৪ সালেও তিনি একবার সমাজতন্ত্রীদের নিয়ে একটি পার্টি করার কথা বলেন। ওদিকে তোগলিয়াত্তি ভ্যাটিকান সিটির স্বশাসন নিয়ে যে চুক্তি আগে হয়েছিল তাকে অনুমোদন দিলেন। ফলে বোঝা যায় যে তাদের তাগিদ ছিল। কিন্তু সেই তাগিদ ছিল বুর্জোয়াদের তোষামদি। কারণ সংস্কারের কথা আর শোনা গেল না।

ইংল্যন্ডের দিকে তাকালে আমরা দেখবো, যেহেতু তাদের ভোট ফ্রান্স-ইতালি বা ফিনল্যাণ্ডের মত ছিল না অতএব তাদের তাগিদও থাকলো না। বামপন্থী সংস্কার কর্মসূচী কার্যকর করার জন্য বিরোধী পক্ষ হয়ে ওঠার তাগিদটুকুও থাকলো না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই লেবার দলের সঙ্গে আবার আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক হয়ে গেল তাদের। সম্পর্ক স্থাপনের জন্য যদিও তারা ১৯৫১ সালে ‘british road towards socialism’ নামে কর্মসুচী গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ১৯৪৫ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ছয় বছর অতিক্রান্ত, বড্ড বেশী দেরী হয়ে গেল না? সেখানে সংস্কারের কর্মসুচিত ছিল, কিন্তু সেগুলি মৌলিক ছিল কি? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিটা দেশেই জোট সরকারের সুযোগ এসেছিল, এবং প্রায় সর্বত্রই আমরা অভ্যুত্থানের জন্য বেশী আগ্রহী ছিলাম। এক্ষেত্রে গ্রীসের ব্যর্থ অভ্যুত্থান নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করেছিল। অথচ কমিনফর্ম তাগিদপন্থীদের পাশে না দাঁড়িয়ে বিচ্ছেদপন্থীদের পাশেই দাঁড়াল।

দক্ষিণপন্থীদের এই বহিষ্কার নিয়ে কমিনফর্ম ইতালি-ফ্রান্সের কম্যুনিস্টদেরকেই দোষারোপ করা শুরু করলো। কেন তারা নিজেরাই আগে বেরোয়নি। বা কেন তারা জোট সরকারে গেল!? কমিনফর্ম বৈঠকে সোভিয়েত প্রতিনিধি আন্দ্রেই স্‌দানভ ইতালীয় প্রতিনিধি লোঙ্গো কে বলেন যে তাদের আক্রমণাত্মক হওয়া উচিত ছিল আগেই। যুগোস্লাভিয়ান প্রতিনিধি অভিযোগ করেন যে আসলে ইতালীয় কমরেড শান্তিপূর্ণ পথে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা ভাবছেন এবং তার সঙ্গে এও যোগ করেন, 'The Italian leading comrades did not take sufficient and consistent use of our experiences”. যুগোস্লাভিয়ার আর এক কম্যুনিস্ট মাইলোভ্যান জিলাস (যিনি নিজে আবার কালক্রমে টিটোর সাথে সংঘাতে বিপদে পড়েন) ফরাসী ও ইতালীয় কম্যুনিস্টদের সুবিধাবাদের খপ্পড়ে পরার অভিযোগ করেন এবং বলেন, 'draw lessons from their work and the mistakes they have made'… ইতালীয় ও ফরাসী প্রতিনিধিরা জো হুজুর বলে চলে আসেন। কমরেড লোঙ্গো যদিও নীরবই থাকেন, কিন্তু আর এক ফরাসী কমরেড জাঁক দুক্লোঁ স্বীকার করেন যে তাদের মধ্যে সংসদীয় রাস্তার প্রতি অবাঞ্ছিত মোহ তৈরী হয়েছিল, 'obviously excessive respect for legalism and parliamentarism'!! যদিও লোঙ্গো সোভিয়েত প্রতিনিধিকে এই প্রশ্ন করতেই পারতেন যে কেন সোভিয়েত উনিয়ন ইংল্যন্ডের আগেই দ্য গলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল?!!

হয়তো আবার চর্চা শুরু হতো। peoples democracy, Kosice manifesto, BRS নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে আলাপ আলোচনা শুরু হতো। হয়তো অস্টিয়ান সমাজতন্ত্রীদের ৩০-র দশকের ভাবনা চিন্তা নিয়েও সামগ্রিকভাবে আলোচনা শুরু হতো। অস্ট্রিয়ার সমাজতন্ত্রী শিবিরর এক নেতা হিলফার্ডিং-এর সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে গবেষণাকে যেমন লেনিন সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে উন্নত করেছিলেন, সেই ভাবনার সীমাবদ্ধতাকে টপকে গেছিলেন। ১৯৩০-র দশকের সাম্যবাদী শিবির তা গ্রহণ করলো না। ১৯৭০-র দশকে ইউরো কম্যুনিজমের প্রবক্তারা সংস্কার-জোটের কথা বললেন। প্রাগ আক্রমণের পর কম্যুনিস্ট দলগুলির উপর দানবীয় অনুশাসনের শৃংখল থেকে মুক্তির আওয়াজ তুললেন।  কিন্তু জোট করলে সংস্কার থাকবে না, কোনোক্রমে একটা রাস্তাই রাস্তা স্লোগান দেওয়ার জন্য মরীয়া ভাব কিছুতেই কাটলো না। চীনা পার্টি ও সোভিয়েত পার্টির তথাকথিত মহাবিতর্ক সব সম্ভাবনা চূর্ণ করলো। অস্ট্রিয়ান সমাজতন্ত্রী অটো বাউয়ারের যে চমৎকার কথা তা আবার প্রমাণিত হল। where the working class is divided, one workers' party embodies sober, day-to[1]day Realpolitik, while the other embodies the revolutionary will to attain the ultimate goal. Only where a split is avoided are sober Realpolitik, and revolutionary enthusiasm united in one spirit. (১৯২৭ সালের লেখা) ১৯৬০-র দশকে ইয়োরোপের দেশে দেশে ট্রেডইউনিয়নে কম্যুনিস্টদের বিরাট প্রভাব থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ছিল না। ওই দশকে রেকর্ড পরিমাণ ধর্মঘট হয়। জঙ্গী আন্দোলন বহু হয়, কিন্তু কম্যুনিজমের আকর্ষণ হ্রাসমান। চীন ও রুশ পার্টির মধ্যে অহেতুক বিতর্ক নতুন করে আন্তর্জাতিক কম্যুনিস্ট আন্দোলনে জোট বিরোধী, সংস্কার বিরোধী, ভোট বিরোধী মনোভাবের বিস্তার ঘটালো। দুটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি কেন্দ্রিক বিরোধকে খামোখা একটি বিরাট মতাদর্শগত চেহারা দেওয়া হল। ওই পর্যায় থেকেই আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী শিবিরে দৈন্য প্রকট হয়ে ওঠে। যেমন, কমিউনিস্টরা বিশ্বাস করতে শুরু করলো, তোগলিয়াত্তির নাকি দোষ ছিল এটা যে তিনি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আটকানোকে প্রধান দায়িত্ব বলেছিলেন। ইতালির কম্যুনিস্ট পার্টির দশম কংগ্রেসে তাঁর ভাষণ নিয়ে তুলকালাম শুরু হয়। বিতর্কে চীনা পার্টি বলে, “সাম্রাজ্যবাদ কি এতটা ঝুঁকি নেবে? যেখানে এই যুদ্ধ হলে সাম্রাজ্যবাদের পতন হবে আর সমাজতন্ত্রের বিজয় হবে”, পাঠক বুঝতেই পারছেন মার্ক্সবাদীদের কি নিদারুণ দৈন্য! একজন ইতালীয় কম্যুনিস্ট নাকি তাতে বলেছিলেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যদি আনবিক যুদ্ধও হয়, ক্ষতি কী! যে দেশগুলিতে বোমা পড়বে না তারা তো সাম্রাজ্যবাদের শেকল ছিঁড়তে পারবে!!!  আবার খ্রুশ্চেভ প্রসঙ্গে চিন্তা ভাবনাও একই রকম বিভ্রান্ত। আজও যদি কম্যুনিস্ট দলগুলিকে জিজ্ঞেস করা হয় খ্রুশ্চেভের দোষ ঠিক কী ছিল? বদহজম হওয়া মার্ক্সবাদের ছাত্রদের সকলেই হয়তো বলবেন, তিনি শান্তিবাদী ছিলেন!! অথচ বাস্তব হল খ্রুশ্চেভের দোষ এখানে যে তিনি শান্তিবাদী ছিলেন না। মুখে শান্তির কথা বললেই শান্তিবাদী হওয়া যায় না। ওটা ছিল তার অজুহাত। চীনকে পরমাণু শক্তিধর হতে না দেওয়ার অজুহাত। দেশে দেশে কম্যুনিস্ট দলগুলিকে একা বা জোটে সরকারে যেতে নিরুৎসাহ করার অজুহাত। আসলে খ্রুশ্চেভের দোষ ছিল এই যে তিনি সোভিয়েত বন্ধু সরকারগুলিকে বিরক্ত করবেন না। তাই ভারতে কংগ্রেসকে হারাও, বা কংগ্রেসের সাথে ক্ষমতা ভাগ কর, সিপিআই-র কাছ এই বার্তা আসেনি। অবান্তর মহাবিতর্ক ১৯৭০-র দশকের পুঁজিবাদের নতুন সংকটকে মোকাবিলা করার মত অবস্থায় রাখল না। আবার ১৯২৪ সালে ফেরত নিয়ে গেল। 

নমনীয়তার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস

Izvestiya (March, 1918) carried a leading article by its editor Stelkov, two imperialisms, of which one has taken us by throat (Japan), and the other (US) in its own interest of course is ready to hold out to us a helping hand….ঠিক যে সময়ে ইয়োরোপে বামপন্থী হঠকারীতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, সেই সময়ে রুশ দেশের বৈদেশিক নীতি ছিল আমেরিকাকে বন্ধু হিসেবে পেতে মরীয়া।  আবার স্তালিনকে দেখুন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতেই মিত্র শক্তির দেশ গুলির কাছে আবেদন জানালেন তিনি সমবেত প্রতিরোধের। কিন্তু পুঁজিবাদীরা রাজী হবে কেন? তাদের ইচ্ছা হিটলার -স্তালিন নিজেদের মধ্যে মারপিট করে ধ্বংস হোক। স্তালিন কিন্তু সময় নষ্ট করলেন না। সোজা হিটলারের সাথে অনাক্রমণ চুক্তি সেরে ফেললেন।  রাশিয়া বা চীনে বিপ্লবের আগে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন হয়নি। ফলে উদারনৈতিক বুর্জোয়াদের সঙ্গে আঁতাতের মধ্য দিয়ে প্রাথমিকভাবে সংসদীয় ব্যবস্থা তৈরী করার প্রচেষ্টা নেওয়া যার মধ্য শেষ পর্যন্ত কমিউনিস্টরাই ক্ষমতায় আসবে এবং পুরোনো রাষ্ট্রটির খোলনলচে বদলে সমাজতন্ত্রের দিকে যাত্রা শুরু করবে, দুই দেশেই কমিউনিস্টরা এই প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছিলেন। আবার বুর্জোয়াদের সঙ্গে জোট একমত্র তখনই করা যায় যখন নিজেদের প্রবল শক্তি থাকে, এহেন  ভ্রান্ত তত্বায়নকে ভুল প্রমাণ করে মাও-রা কুয়োমিন্টাঙকে সন্তুষ্ট করতে নিজেদের সৈন্যবাহিনীকে এক চতুর্থাংশে নামিয়ে এনেছিলেন। ১৯৩৬ সালে সিয়ান ঘটনার পর কুয়োমিন্টাঙদের সরকারকে তারা সশস্ত্র পথে উৎখাত করবেন না এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। লেনিনের ইতিহাসটা দেখা যাক…১৯০১-১৯০২ সালে,  ইস্ক্রার পুরানো সম্পাদকমণ্ডলীতে সাত জনের মধ্যে একজন ছিলেন দক্ষিণপন্থী স্ত্রুভ। ১৯০৫ সাল্লে এসে কৃষক-শ্রমিক জোটকে (যা কিন্তু আজকের মত মার্ক্সবাদের গৃহীত সত্য ছিল না) মান্যতা দেওয়া হল, আর বুর্জোয়াদের সাথে জোটেও সম্মতি জানানো হল।

Resolution on a Provisional Revolutionary Government

“1) both the direct interests of the proletariat and the interests of its struggle for the final aims of socialism require the fullest possible measure of political liberty and, consequently, the replacement of the autocratic form of government by a democratic republic;

“2) the establishment of a democratic republic in Russia is possible only as a result of a victorious popular insurrection whose organ will be a provisional revolutionary government, which alone will be capable of ensuring complete freedom of agitation during the election campaign and of convening a constituent assembly that will really express the will of the people, an assembly elected on the basis of universal and equal suffrage, direct elections and secret ballot;

“3) under the present social and economic order this democratic revolution in Russia will not weaken, but strengthen the rule of the bourgeoisie, which at a certain moment will inevitably try, stopping at nothing, to take away from the Russian proletariat as many of the gains of the revolutionary period as possible:

“The Third Congress of the Russian Social-Democratic Labour Party resolves that:

“a) that it is necessary to disseminate among the working class a concrete idea of the most probable course of the revolution and of the necessity, at a certain moment in the revolution, for the appearance of a provisional revolutionary government, from which the proletariat will demand the realisation of all the immediate political and economic demands contained in our program (the minimum program);

“b) that subject to the relation of forces, and other factors which cannot be exactly determined beforehand, representatives of our Party may participate in the provisional revolutionary government for the purpose of relentless struggle against all counter-revolutionary attempts and of the defence of the independent interests of the working class;

“c) that an indispensable condition for such participation is that the Party should exercise strict control over its representatives and that the independence of the Social-Democratic Party, which is striving for a complete socialist revolution and, consequently, is irreconcilably hostile to all bourgeois parties, should be strictly maintained;

“d) that irrespective whether the participation of Social-Democrats in the provisional revolutionary government prove possible or not, we must propagate among the broadest masses of the proletariat the necessity for permanent pressure to be brought to bear upon the provisional government by the armed proletariat, led by the Social-Democratic Party, for the purpose of defending, consolidating and extending the gains of the revolution.”

বাস্তবেও নির্বাচনের দ্বিতীয় পর্যায়ে বুর্জোয়াদের ভোট দেওয়া হল। যে সোশ্যালিস্ট বিপ্লবীদের পেটি বুর্জোয়াদের দল বলা হল, তাদের সাথেই জোট করা হল। ১৯০৭ সালের দুমা ভোটে। ১৯১২ সাল পর্যন্ত তারা মেনশেভিকদের সাথে একটি পার্টির মধ্যেই থাকলেন, যে মেনশেভিকদের বুর্জোয়াদের দালাল বলেছেন তারা ধারাবাহিকভাবে। যুদ্ধের সময় কাউটস্কিপন্থী, শেরনভদের মত সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনরি বা মার্তভ দের মত মেনশেভিকদের সাথে জোট করে চলেছেন। বিপ্লবের মুহূর্তে গ্রামীণ পাতি বুর্জোয়া অংশ ও কৃষকদের পেতে বুর্জোয়া কৃষি কর্মসুচী হুবহু গ্রহণ করেছেন (যা এঙ্গেলসের লেখা অনুযায়ী গর্হিত) এবং একটি জোট সরকারের প্রস্তাব করেছেন। যাদের করলাম তারা অনেকেই থাকলো না ১৯১৮ সালের পর এবং আমাদের সরকার ফেলার জন্য সশস্ত্র অভ্যুত্থানে নামল। দক্ষিণপন্থীদের সাথে জোট তো বটেই এমনকি বলশেভিকদের চরমতম শত্রু কেরেন্সকিকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়েছিল বলশেভিকরা। কেরেন্সকি সময়ের ইতিহাসটা একবার হাজির করলাম। যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করে বিদেশমন্ত্রী, অক্টোব্রিস্ট মিলিউকভের গোপন টেলিগ্রাম ফাঁস হয়ে গেল এবং তিনি পদত্যাগ করলেন। বলশেভিকরা হারানো জমি ফেরত পেতে শুরু করলেন। এসআর এবং মেনশেভিক-রা সরকারে যোগ দিল। প্রতিরক্ষামন্ত্রী হয়ে কেরেন্সকি যুদ্ধে নামলেন সরাসরি, গালিসিয়ায়। সৈন্য মনোবল তলানিতে, বিদ্রোহ দানা বাঁধলো। কেউ কেউ গ্রামে ফিরে বলশেভিকদের অনুপ্রেরণায় জমি বন্টনের কাজে হাত লাগালেন। জার্মানরা পালটা আক্রমণ করলো। একদিকে সীমানায় বিপদ, অন্যদিকে দেশের ভেতরেও শ্রমিকরা প্রতিবাদে সামিল হলেন। সৈন্যদের অস্ত্র এবার বন্ধু শ্রমিকদের হাতে। সরকারের মাথা কাদেত লবোভ পদত্যাগ করলেন। কেরেন্সকি হাল ধরলেন। ক্ষমতায় বসেই, একহাতে সংস্কার করলেন আর অন্য হাতে সন্ত্রাস নামালেন। মেয়েদের ভোটাধিকার দিলেন আর মৃত্যুদন্ড পুনর্বহাল করলেন। প্রাভদা নীষিদ্ধ হল, লেনিন পলাতক, বহু বলশেভিক গ্রেপ্তার। সোভিয়েতগুলি দুর্বল, সোভিয়েতের হাতে সব ক্ষমতা, এই স্লোগানের গুরুত্ব থাকলো না। শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা দখলের সুযোগ আর থাকলো না। দেশের ব্যাংকার-রা, মিত্রশক্তির দেশগুলি দুশ্চিন্তায় যে কেরেন্সকির মত দুর্বলচিত্তের প্রধান কেমন করে সামলাবেন। জার্মান দালাল লেনিন ও বলশেভিকদের প্রতি কঠোর না হতে পারার জন্য দুষলেন তারা কেরেন্সকিকে। তারা ভেবেছিলেন কেরেন্সকিই আত্মসমর্পন করবেন, কনির্লভের প্রতি সমর্থন জানালেও রুশ দেশের ভেতরে অন্তর্দ্বন্দ্ব চরমে। সরকারের সব মন্ত্রী পদত্যাগ করেছে, কেরেন্সকিকে সাহায্য করার জন্য প্রেসও আর প্রস্তুত নয়। স্টক এক্সচেঞ্জ কর্লিলভের আসন্ন জয় নিয়ে উৎফুল্ল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ কর্নিলভের পক্ষে অবিরাম আশীর্বাদ প্রদর্শন করে চলেছে এবং আপোষ করার জন্য কেরেন্সকির উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এই অবস্থায় ঘটনাক্রম এক নাটকীয় মোড় নিল। ২৭শে আগস্ট তৈরী হল প্রতিবিপ্লব বিরোধী সংগ্রাম কমিটি। বলশেভিক মেনশেভিক ও এসআর-দের সদস্যদেরই নিয়ে। অর্থাৎ সরকারি অত্যাচারিদের সাথে নিয়ে। তারা কেরেন্সকি সরকারকে প্রজাতন্ত্র ঘোষণার জন্য শর্ত দিল। কিন্তু সরকার মানেনি। কিন্তু এই প্রতিক্রিয়া বিরোধী কমিটি  বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম করলো এবং কেরেন্সকি সরকারকে রক্ষা করলো। কেরেন্সকির এক মন্ত্রী প্যালচেনস্কিও তা স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। বলশেভিক নেতাদের কিন্তু মুক্তি হল না। বলশেভিকরানানা প্রকরণ ব্যবহার করলো, জোট ধর্মেও বিচ্যুত হল না। মেনশেভিক ও এসআর-রা চাইছিল না যে জনগণ অস্ত্র হাতে নিক, বলোশেভিকরাও তাতে আপত্তি করেনি। একটা চমৎকার উদাহরণ দেওয়া যাক। এক মুসলিম প্রতিনিধি দলকে পাঠানো হল শত্রু শিবিরের ককেশীয় স্কোয়াডের সাথে কথা বলতে। ককেশীয় রীতি অনুযায়ী দুতদের হত্যা করা যাবে না। ইতিমধ্যে কেরেন্সকি সরকার রক্ষা করার আবেদন জানিয়েছেন বলশেভিকদের কাছে। কর্নিলভ পরাস্ত হল, এবার কেরেন্সকির সাগরেদ আক্ষেলিয়েভোকে বললেন বলশেভিক মুঠি আলগা করতে হবে। তা হল না, কাদেতদের বিশ্বাসঘাতকতা, কেরেন্সকির অপদার্থতা প্রমাণিত হল। শীতপ্রাসাদ জনগণের দখলে এলো।

তাদের নমনীয়তার আর একটি উদাহরণ দেখুন। all power to the soviets, এই স্সলোগান যখন তোলা হচ্গছে তখন সেই সব সোভিয়েতের নেতৃত্বে রয়েছেন সংস্কারবাদীরা। সেই জন্যই বোধহয় ১৯২২ সালের দলিলে লেনিন জোর করে একটি বাক্যটি রাখলেন-- বলশেভিকরা ১৯১৭-র আগে বহুবার জোটের মধ্য দিয়ে গেছে। বহু আপোষ, বহু বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই বলশেভিকরা গেছিল। 

চীন বিপ্লবের অত্যাশ্চর্য স্বকীয়তা ও নমনীয়তা

সেপ্টেম্বর ১৯৪৪ সালে মার্কিন প্রতিনিধি প্যাট্রিক হার্লির সাথে মাও সেতুং-এর বৈঠক হল। চিয়াং কাইশেকদের সাথে এই মার্কিন প্রতিনিধির বৈঠক এর আগেও হয়েছে। উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে পারস্পরিক বৈঠকগুলি হয়। জোট সরকারের প্রসঙ্গ এসে পড়ায় মাও ১৯৪৫ সালে লিখে ফেললেন তার গ্রন্থ on coalition government, সেখানে তিনি স্পষ্ট করেই বললেন যে কম্যুনিস্টদের দায়িত্ব হল একটি সাংবিধানিক গণতন্ত্র গড়ে তোলা, বহুদলীয়। যে অস্থায়ী সরকার, বহু দলের উপস্থিতিতে  গোলটেবিল বৈঠকের মধ্য দিয়ে তাদের ন্যূনতম কর্মসূচি ঠিক করবে এবং একটি সাধারণ নির্বাচন আহ্বান করবে। যেখান থেকে পরবর্তী সরকার গঠিত হবে। এবং ভোটের মধ্য দিয়ে যে সরকার গড়ে উঠবে সেটাও জোট হলেই ভাল হয়। ইতিমধ্যেই চুংকিং শান্তি চুক্তির উদ্দেশ্যে বৈঠক শুরু হয়ে গেছে, এই বৈঠক যখন চলছে ৪৩ দিন ধরে, ঠিক সেই সময়ে ইয়েনান ঘিরে ফেলেছে কুয়োমিণ্টাঙ বাহিনি, আর কম্যনিস্টদের কচুকাটা করা চলছে। যদিও সেই কারণ দেখিয়ে মাও আলোচনা থামাননি। জাপান চলে যাওয়ার পর একটি বহুদলীয় গণতন্ত্র হবে, এবং একটি সংবিধান সভা আহ্বান করা হবে। কিন্তু কুয়োমিণ্টাঙ চুক্তি ভেস্তে দিল। আর ইয়েনানে যখন ডুকে পড়লো দেখলো একজন কম্যনিস্টও আর নেই, কারণ মাও তাদের প্রতিরোধ করার জন্য থাকলেন  না। চুক্তিতে তারা কতটা আন্তরিক প্রমাণ করলেন। নভেম্বরে নতুন মার্কিন প্রতিনিধি নিযুক্ত হলেন, জর্জ মার্শাল। চুক্তি অনুযায়ী ডিসেম্বরে গড়ে উঠলো জর্জ মার্শালের মধ্যস্থতায় তিন সদস্যের কমিটি। কুয়োমিন্টাঙের চাং চুং, এদিকের চৌ এন লাই ও মার্কিন প্রতিনিধি হিসেবে মার্শাল নিজে। সিদ্ধান্ত হল যৌথ বিবৃতি দেবে একসাথে চিয়াং ও মাও। সিদ্ধান্ত হল চারটি রাজনৈতিক দল (কম্যুনিস্ট আর কুয়োমিন্টঙ বাদ দিয়ে আরও দুটো) ও নির্দল প্রতিনিধিদের নিয়ে (মাও-দের মুক্তাঞ্চলের সরকারগুলিতে এনারা গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছিলেন) তৈরী হবে অস্থায়ী সরকার, এবং একই সঙ্গে সাংবিধানিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংবিধান এর খসড়া করবে যৌথ কমিটি। তার পর যথারীতি জল গড়ালো ইয়াংশি নদী দিয়ে। দক্ষিণপন্থী কুয়োমিন্টাঙ কি আর চুক্তি মানে? সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র আমেরিকা কি আর সত্যিই নিরপেক্ষ অবস্থান রাখে!! কেউই তা রাখেনি। এর চার বছর পর, যখন আবার বিপদে পড়ে কুয়োমিনয়টাং শান্তি আলোচনায় বসতে চাইলো, আগের মতোই আমেরিকা মধ্যস্থতায় থাকুক, এমনটাই চাইলো তারা। মাও আপত্তি করেননি। কিন্ত আমেরিকাই আর থাকতে রাজী হল না। স্বাভাবিক। হেরো দলের জন্য কে আর সময় নষ্ট করে। কুয়োমিন্টাঙের পরাজয় তখন সময়ের অপেক্ষা। তাছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও শেষ। আমেরিকার উৎসাহ কম।

সংস্কার বনাম বিপ্লব

আগস্ট 1945, সালে জোট সরকারের আর্থিক নীতি নির্ধারণের জন্য বিশেষ সম্মলেন আহ্বান করলো ইতালির কম্যুনিস্ট পার্টি, সেখানে তোগলিয়াত্তি ভর্তুকির বিরোধিতা করলেন। জাতীয় পরিকল্পিত অর্থনীতিকে ইউটোপিয়া বললেন। ট্রেড ইউনিয়নগুলিও বেশী মাইনে বাড়ানোর দাবি করতে বারণ করলেন। আবার ফ্রান্সে, ১৯৪৫ সালের নভেম্বরে সরকারি কর্মসূচীর প্রস্তাব হিসেবে কম্যুনিস্ট পার্টি জাতীয়করণের কথা বললো না। এমনকি শিল্প ক্ষেত্রে শ্রমিক নিয়ন্ত্রণ নিয়েও কিছু বললো না। ব্যক্তি পুঁজি ও উদ্যোগের পক্ষে তারা সওয়াল করলেন। যদিও একচেটিয়া অর্থে নয়। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে বিপুল পরিমাণ কালো টাকা মজুত হয়েছিল ফ্রান্সের একাংশের সিন্দুক থেকে তা বের করে আনার জন্য মেঁত ফ্রঁস যে প্রস্তাব দিলেন তাকেও রুখে দিল কমিউনিস্টরা।  সরকারে থাকা ফিনিশ দলের অবস্থান দেখা যাক। এপ্রিল, 1945 সরকারি দলগুলির মধ্যে বোঝাপড় হল। বামেরা এক তৃতীয়াংশ পেয়েছিল মন্ত্রীসভায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও তাদের হাতে। অবাক কান্ড কম্যুনিস্ট পার্টি হঠাৎ 'রাস্তাই রাস্তা' বলে রাস্তায় নেমে পড়লেন। এক বছর যেতে না যেতেই, ১৯৪৬ সালে তারা হঠাৎ গণ আন্দোলনে নামলেন। দাবি ছিলঃ- সামাজিক সংস্কার, সৈন্য বাহিনি ও প্রশাসনে গণতান্ত্রিকীকরণ।  ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, 1947, সালে জোট ভাঙ্গার কয়েক মাস আগে তোগলিয়াত্তি ক্ষেদ নিয়ে বলছেন, যে গত কয়েক বছরে, মানে জোটের বছরগুলিতে কোনো রাজনৈতিক ধর্মঘটই হোল না। শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হোল যে এককালের জোটপন্থী তোগলিয়াত্তি বড় জোর বুখারিনের ছাত্র হতে পারেন কিন্তু লেনিন বা স্তালিনের নয়। ফলে পুঁজিবাদের স্থায়িত্বের, সুস্বাস্থ্যের কথা বলে কম্যুনিস্ট সংস্কার বিমুখ অবস্থান রাখলেন। আর যারা পুঁজিবাদের স্বাস্থ্য দেখলেন না তারাও বাম হঠকারী অবস্থান থেকে সংস্কার বিমুখ অবস্থান রাখলেন। ফলে সংস্কার আর বিপ্লবকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে শুধু বাম হঠকারীদের সুবিধা হয় তাই নয়, সংস্কারবাদকেও প্রশ্রয় দেয়।

ফ্রান্সের সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে দেখা গেল ফরাসী কম্যুনিস্ট পার্টি, এক কক্ষের সংসদ নাকি দুই কক্ষের এই নিয়ে অযথা জেদাজেদি করল। গণভোটের দিকে এগিয়ে গেল তারা। বামেদের একটা বড় অংশও দ্বি-কক্ষের পক্ষে ভোট দেয়। এই পরাজয় তাদের জনপ্রিয়তায় ফাটল ধরায়। আসলে ফরাসী দলের সমস্যা এটাই ছিল যে তাদের শক্তি, তাদের ভোট, তাদের আসন এবং ফ্রান্সে সমাজতন্ত্রীদের ভোট ইতালির তুলনায় শক্তিশালী ছিল। যার ফলে কম্যুনিস্টদের চিরকালের অভ্যেস মত, ফরাসী কম্যুনিস্ট পার্টি বৃহদ বাম জোটের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, এবং ফ্রান্স মোটামুটি দুই জোটের রাজনৈতিক মঞ্চে পরিণত হোক এটাই চাইলেন।

পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন বিকল্প আর্থিক মডেল নিয়ে কম্যুনিস্ট আন্দোলনের একাংশ বার বার চাপ সৃষ্টি করার কারণ। সংস্কার ও বিপ্লবের যোগসূত্র নিয়ে এক বিভ্রান্তি তৈরী হয়ে আছে কম্যুনিস্ট আন্দোলনে। ফলে সংস্কারের পক্ষে না দাঁড়িয়ে বিকল্প মডেলের প্রসঙ্গটি বার বার উঠে আসে। যে দলগুলি ভীষণ শক্তিশালী ছিল, তারা সরকারি ক্ষমতাকে কি চোখে দেখেছেন তা উপরোক্ত ঘটনাগুলি থেকেই স্পষ্ট। তাদের কাছে সরকারি ক্ষমতার অর্থ ছিল সরকারে থেকে দল বাড়িয়ে তার পর অভ্যুত্থানে নেমে পড়া। যখন সরকারে থাকবেন তখন কোনো রূপ সংস্কারের চেষ্টা করা হবে না।  

অথচ এই ২০২১ সালে পুঁজিবাদে কোনো সংস্কারই সম্ভব নয় কম্যুনিস্টদের ছাড়া। কারণ দুর্নীতি সংস্কারের ক্ষেত্রে সব চেয়ে বড় বাঁধা। আর দক্ষিণপন্থী দল মানেই দুর্নীতি।

অথছ কম্যুনিস্টদের মুখে হয় একদম চূড়ান্ত দাবি নয়তো পাক্কা বুর্জোয়া দাবি—এর মাঝে আর কিছু দেখাই যায় না। 

এরফুর্ট কর্মসুচির একটি চমৎকার ইতিবাচক সমালোচনা করে এঙ্গেলস ন্যূনতম আর চূড়ান্ত দাবির মধ্যে সামঞ্জস্য রাখার ব্যাখ্যা করেছিলেন। লেনিন তাদের পার্টি গঠনের সময়েই দেখা যায় ন্যূনতম ও চূড়ান্ত কর্মসুচি নির্ধারণ করেন। মাও সেতুং তাঁর জোট সরকার নিবন্ধে খুব নিখুঁত হাজির করেছেন এই দুই-এর মধ্যে সম্পর্ক। 

অটো ব্রাউয়ার চেয়েছিলেন ধীরে সুস্থে এগোতে। মুখে যতই অটো ব্রাউয়ারদের বিরোধিতা করুক কম্যুনিস্ট শিবির বাস্তবে ঐ একই ভাবনা তাদের।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে স্পেনে যে রিপাব্লিকান সরকার এসেছিলো, সেখানে সমাজতন্ত্রীরা নিজেদের সংস্কারের কর্মসুচি হাজির করেছিলো কিন্তু কম্যুনিস্টদের দিক থেকে কিছুই আসেনি। তারা সরকারে অংশগ্রহণও করেনি। ফ্রান্সেও পপুলার ফ্রন্টের সংস্কার কর্মসুচি নিয়ে কমিউনিস্টরা উদাসীন ছিলেন। যদিও এমন নয় যে সরকারে যাওয়ার আগে যা যা কর্মসূচি ম্যানিফেস্টোতে লেখা থাকে সবই হুবহু পালন করা যায়, জোট সরকারের পক্ষেও তা সম্ভব নয়। Peasant war in germany গ্রন্থে এঙ্গেলস কৃষকদের জন্য জমির জাতীয়করণকেই কার্যকর পদক্ষেপ বলেছিলেন। লেনিন নিজের দেশে তা মেননি, কিন্তু হাঙ্গেরীয় কম্যুনিস্ট বেলা কুন তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন, এবং সোভিয়েত হাঙ্গেরী ধ্বংস হয়েছিল, চার মাসের মধ্যেই। মত অন্ধভাবে চললো আর দেশের মধ্যে জনসমর্থন হারিয়ে বসলো। অথচ লেনিন নিজে ঠিক বিপরীত আচরণ করেছিলেন। এই হল সংস্কার আর বিপ্লবের সম্পর্ক। ১৬টি পুঁজিবাদী দেশ মার্শাল পরিকল্পনার টাকা নিয়ে সংস্কার করছে। দক্ষিণপন্থী, আধা দক্ষিণপন্থী সরকারগুলি মার্শাল টাকা নিয়ে, কম্যুনিস্টদের তাড়িয়ে দিয়ে একের পর এক জনকল্যানকারী রাষ্ট্রের সংস্কারগুলি করেছে। যেমন, বহু মূল শিল্পের জাতীয়করণ হয়েছিল। ফ্রান্সে পরিকল্পিত অর্থনীতির পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল। শিল্পের পরিচালন ব্যবস্থায় ট্রেড ইউনিয়নের মতামতের গুরুত্ব বাড়ানো হোল, যৌথ কমিটি বাধ্যতামুলক করে। সার্বজনীন স্বাস্থ্যের জন্য বেশ কিছু সংস্কার হোল ইংল্যন্ড সহ স্ক্যান্ডানাভিয়ান দেশগুলিতে। ইংল্যন্ডে গৃহীত হোল Family Allowance Act, Industrial injuries Act, National insurance Act, Landlord and Tenant Act। ইয়োরোপ জুড়েই স্বাস্থ্য বীমা, নিখরচায় শিক্ষা, বেকার ভাতা, বার্ধক্য ভাতা ও পেনশন, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ভর্তুকি, লিঙ্গ সাম্যের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার—এই ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করে পশ্চিম ইয়োরোপের দেশগুলি। কর ব্যবস্থাও প্রগতিশীল হয়। অন্যদিকে ধর্মঘট করার অধিকার স্বীকৃত হোল। বোঝাই যাচ্ছে একদিকে বাজার সৃষ্টি আর একদিকে কম্যুনিস্টদের দুর্বল করাই লক্ষ্য ছিল।  বোঝাই যাচ্ছে এইগুলি সবই একচেটিয়া পুঁজির বিকাশের স্বার্থে, ফ্রান্সের খনিজ সম্পদকে উন্মুক্ত কওরে দেওয়ার স্বার্থে। মার্শাল টাকা নিলেই মহাভারত অশুদ্ধ হয় না। মহাভারত অশুদ্ধ হয় তখনই যখন সরকারে গিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দেশের আর্থিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার কমিউনিস্টরা করতে ভয় পায়। 

বুর্জোয়া সংস্কারের সাথে কম্যুনিস্টদের প্রতিযোগিতা করার ন্যূনতম ইচ্ছে দেখা যায়নি।

শেষ কথা

ভারত চরম বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে। যে সমস্ত শক্তির জন্য বিজেপির উত্থান, যারা অনবরত আপোষকামী, জনগণের শত্রুতে পর্যবসিত হয়েছে, তাদের সাথে জোট ছাড়া এগোনো মানে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। কিছু ভোট বাড়ছে বলে জোটের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানেও তাই। জনগণের লেজুড়বৃত্তি মানেও তাই। বিভ্রান্ত জনগণের সামনে দাঁড়ানোর অতি কঠিন দায়িত্ব আমাদের কাঁধে। যেদিন লেনিন সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে বিশ্লেষণ করলেন সেদিনই জোট-ভোটের লাইন তাত্ত্বিকভাবে প্রতিটা দেশের কম্যুনিস্টদের ক্ষেত্রে সাধারণ লাইনের পরিণত হয়েছিল। যেদিন লেনিন অতিমুনাফার সাথে মুনাফার দ্বন্দ্বকে কেন্দ্রে রাখলেন, একচেটিয়াকত্ব বনাম মুক্ত প্রতিযোগিতার দ্বন্দ্বকে কেন্দ্রে রাখলেন, সেদিন থেকে জোট-ভোট-স-ংস্কার আর কোনো বিশেষ দেশের বিশেষ কৌশল থাকল না। তাই The differences between the Churchills and the Lloyd Georges —with insignificant national distinctions, these political types exist in all countries—on the one hand, and between the Hendersons and the Lloyd Georges on the other, are quite minor and unimportant from the standpoint of pure (i.e., abstract) communism, i.e., communism that has not yet matured to the stage of practical political action by the masses. However, from the standpoint of this practical action by the masses, these differences are most important. To take due account of these differences, and to determine the moment when the inevitable conflicts between these “friends”, which weaken and enfeeble all the friends” taken together, will have come to a head—that is the concern, the task, of a Communist who wants to be, not merely a class-conscious and convinced propagandist of ideas, but a practical leader of the masses in the revolution. It is necessary to link the strictest devotion to the ideas of communism with the ability to effect all the necessary practical compromises, tacks, conciliatory manoeuvres, zigzags, retreats and so on, ....One will readily agree that any army which does not train to use all the weapons, all the means and methods of warfare that the enemy possesses, or may possess, is behaving in an unwise or even criminal manner. This applies to politics even more than it does to the art of war. In politics it is even harder to know in advance which methods of struggle will be applicable and to our advantage in certain future conditions.