রুশ বিপ্লব : এক শতাব্দীর ইতিহাসচর্চা
- 07 November, 2022
- লেখক: কুনাল চট্টোপাধ্যায়
লিখেছেন কুণাল চট্টোপাধ্যায়।
১৯১৭-র রুশ বিপ্লবের পর একশ বছর কেটে গেলেও, তা এখনো এক তীব্র রাজনৈতিক লড়াইয়ের বিষয়বস্তু। তাই রুশ বিপ্লবের ইতিহাসচর্চা নিয়ে সংঘাত নিছক পণ্ডিতে পণ্ডিতে কেতাবী তর্ক নয়, বরং এক প্রশস্ত সামাজিক-রাজনৈতিক লড়াইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বুর্জোয়া ইতিহাসবিদ, রাষ্ট্রতত্ত্ববিশারদ, সমাজতাত্ত্বিক, সাংবাদিক, এমনকি মনস্তত্ত্ববিশারদরা পর্যন্ত রুশ বিপ্লবের ব্যাখ্যা করে বলেন, কেন তা অবান্তর, বা ক্ষতিকর। আর গত প্রায় ত্রিশ বছর ধরে তাঁদের সঙ্গে অনেকটা গলা মিলিয়েছেন একদা বামপন্থী, এমনকি মার্ক্সবাদী বলে পরিচিত বিভিন্ন লেখক, যারা কেউ উদারনীতির কাছে মাথা হেঁট করেছেন, কেউ “মার্ক্সবাদের চেয়ে উন্নততর” বিকল্প পেয়েছেন, আর কেউ আবিষ্কার করেছেন যে মার্ক্সের পর তিনিই প্রথম সাচ্চা মার্ক্সবাদী, তাই রুশ বিপ্লব হয় গোড়া থেকেই গোলমেলে, নাহলে লেনিন আর ত্রৎস্কী থেকে গুলাগের দূরত্ব কয়েক ইঞ্চি মাত্র।
এরিক হবসবম, সারা জীবন বামপন্থী গবেষণা করার পরও, ১৯৯৭ সালে প্রদত্ত ডয়েটশার স্মৃতি বক্তৃতায় বলেন যে মহাফেজখানা (আর্কাইভ) থেকে যে সব তথ্য বেরোচ্ছে, তাদের হিসেবে নিয়ে সরকারী মিথ্যা ও অর্ধসত্যকে বাতিল করে উন্নততর বোধের দিকে এগোতে হবে।১ যদি মহাফেজখানা দেখাটাই একমাত্র কাজ হত, তাহলে ১৯১৭-র ইতিহাস রচনা অনেক বাঁয়ে মোড় নিত। মূল সমস্যাটা মতাদর্শের। প্রবল বুর্জোয়া রক্ষণশীল আক্রমণের ফলে তথ্য সংগ্রহ ও সাজানোটা কমিউনিস্ট এবং শ্রমিক বিরোধী হয়েছে বারে বারে। তাই আমাদের নিজেদের যুগের শ্রেণি সংগ্রামের সঙ্গে মিলিয়ে রুশ বিপ্লবের ইতিহাস চর্চার ইতিহাসকে দেখতে হবে।
প্রথম পর্বঃ ১৯১৮-১৯২৯
বিপ্লবের পর থেকে প্রথম যে সব লেখা বেরোয়, তারা স্পষ্টভাবে, খোলাখুলি, কোনোরকম রাখঢাক না করেই বিভিন্ন পক্ষ নিয়েছিল। বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবের দ্বৈরথের বছরগুলিতে, অর্থাৎ ১৯১৮-১৯২১-এ, রুশ লেখকরা খুব বেশী লেখার অবস্থায় ছিলেন না, যদিও দুয়েকজন ব্যতিক্রম ছিলেন। রাশিয়ার বাইরে থেকে যারা আসেন, তাঁদের, বিশেষত সাংবাদিকদের কয়েকজন গোটা বই লেখেন। তিনজন মার্কিন সাংবাদিক এখানে উল্লেখযোগ্য। ১৯১৮-র অক্টোবরে লুইস ব্রায়ান্ট প্রকাশ করেন তাঁর বই – সিক্স মান্থস ইন রেড রাশিয়া।২ বেসি বিটি লেখেন দ্য রেড হার্ট অভ রাশিয়া। তিনি বলেন, “রুশ বিপ্লবের মধ্যে আশা দেখতে ব্যর্থ হওয়া হল অন্ধের সূর্যোদয় দেখার মত”।৩
কিন্তু সবার নজর কাড়ে তৃতীয় বইটি। জন রীড ইতিমধ্যেই বামপন্থী সাংবাদিক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। রুশ বিপ্লবের সাংবাদিকতা করতে গিয়ে তিনি গভীরভাবে বলশেভিকদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, এবং আমেরিকা ফিরে কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের কাজে জড়িয়ে পড়েন। রীডের টেন ডেজ দ্যাট শুক দ্য ওয়ার্ল্ড (দুনিয়া কাঁপানো দশদিন) প্রকাশিত হয় ১৯১৯ সালে, এবং বইটি পড়ে উৎসাহিত লেনিন একটি সংক্ষিপ্ত মুখবন্ধ লিখে দেন, যা এইরকম -
“আমি গভীরতম উৎসাহ ও নিরবিচ্ছিন্ন আগ্রহের সঙ্গে জন রীডের বই টেন ডেজ দ্যাট শুক দ্য ওয়ার্ল্ড পড়েছি। আমি নির্দ্বিধায় পৃথিবীর শ্রমিকদের এই বইটি পড়তে বলব। আমি চাই, এই একটি বই, যা মিলিয়ন কপিতে মুদ্রিত হোক এবং সমস্ত ভাষায় অনুদিত হোক। প্রলেতারীয় বিপ্লব এবং শ্রমিক শ্রেণির ডিক্টেটরশীপ বাস্তবে কাদের বলে, তা বোঝার জন্য [এই বই] তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাবলীর যথার্থ এবং চিত্তাকর্ষক বর্ণনা দেয়। এই সমস্যাগুলি এখন ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে, কিন্তু কেউ এই ধারণাগুলি গ্রহণ বা বর্জন করার আগে তাঁকে বুঝতে হবে তাঁর সিদ্ধান্তের পূর্ণ তাৎপর্য কী? জন রীডের বই নিঃসন্দেহে এই প্রশ্ন স্পষ্ট করতে সাহায্য করবে, এবং এগুলি হল আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের মৌলিক সমস্যা”।৪
কিন্তু এই কারণেই, ১৯২৪ সাল থেকে যখন বিপ্লবের ইতিহাস লেখা নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে সরকারী চাপ তৈরী শুরু হয়, তখন রীডের বই কুনজরে পড়ে। রীড অক্টোবর অভ্যুত্থানের নির্ণায়ক দিনগুলিতে স্তালিনকে কোনো জায়গাই দেন নি, আর ত্রৎস্কীকে দেখিয়েছিলেন লেনিনের সম-পর্যায়ের নেতা হিসেবে। ১৯৩০-এর দশক থেকে স্তালিনের মৃত্যু পর্যন্ত বইটি সোভিয়েত ইউনিয়নে আর মুদ্রিত হয় নি এবং পাশ্চাত্যে, যেখানে রীড কপিরাইট দিয়ে গিয়েছিলেন ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টিকে, সেখানে বহুদিন বইটি পুনর্মুদ্রিত হত ত্রৎস্কী সম্পর্কে ইতিবাচক কথা ছেঁটেকেটে।৫
গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পরাজিত পক্ষ অনেক সময় পেয়েছিল বারে বারে নিজেদের কথা প্রচার করার। পাশ্চাত্যে তাদের ঠাঁই জুটেছিল “গণতান্ত্রিক” রাশিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে। ইতিহাস লেখেন প্রসিদ্ধ উদারপন্থী ইতিহাসবিদ এবং উদারপন্থী রাজনৈতিক দল ( Constitutional Democrat বা Cadet) নেতা পাভেল মিলিউকভ, গৃহযুদ্ধে শ্বেতরক্ষীদের অন্যতম প্রধান নেতা জেনারেল দেনিকিন, উদারপন্থী ও সমাজতন্ত্রীদের ভরকেন্দ্রে অবস্থিত এবং এক পর্যায়ে রাষ্ট্রের প্রধান আলেক্সান্দর কেরেনস্কী, এবং বিভিন্ন সমাজতন্ত্রী। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মেনশেভিক আন্তর্জাতিকতাবাদী নেতা নিকোলাই সুখানভ - যিনি রাশিয়া ত্যাগ করেননি।৬
বিপ্লবীরা কেউ লেখেন নি তা নয়। ১৯১৮ সালের গোড়াতেই, ব্রেস্ট লিটভস্ক শান্তি আলোচনা চালানোর সময়ে, লেভ ত্রৎস্কী লেখেন তাঁর প্রথম, সংক্ষিপ্ত বর্ণনা।৭ মূলতঃ স্মৃতি থেকে লেখা এই পুস্তিকার উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়ার বাইরের শ্রমিকদের কাছে রুশ বিপ্লবের একটা ছবি তুলে ধরা। সোভিয়েত রাষ্ট্র ও কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক এক সময়ে পুস্তিকাটির যথেষ্ট প্রচার করেছিল, কিন্তু ১৯৩০-এর দশকে বইটি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। যেহেতু ত্রৎস্কী পরে অনেক বিশাল কলেবরে বিপ্লবের ইতিহাস রচনা করেছিলেন এবং তা স্বতন্ত্রভাবে আলোচিত হবে, তাই এই বইটির বিষয়ে আর আলোচনা অপ্রয়োজনীয়।
এই পর্বের আরো বহু লেখকের এবং বইয়ের নাম করা যায়। তার চেয়ে জরুরী, মূল ঘটনার বর্ণনাতে এঁদের মধ্যে প্রধান মতভেদ বা তর্ক কোথায় তা দেখা। প্রথমত, মেনশেভিক, সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারী, উদারপন্থী, সকলেই ফেব্রুয়ারী বিপ্লবকে সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত বলে দেখাতে চেয়েছিলেন। তার কারণ, ২৭শে ফেব্রুয়ারী সকাল (কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুপুর) পর্যন্ত, অর্থাৎ সাধারণ ধর্মঘটের দিনগুলি ও সেনা অভ্যুত্থানের সময়ে, এই দল ও নেতারা ছিলেন নীরব, এমনকি কেউ বা বিপ্লব বিরোধী। বিপ্লবের নেতৃত্ব খুঁজতে গেলে পাওয়া যাবে প্রথমে কয়েকজন বলশেভিক নারী শ্রমিককে, তার পর ভাইবর্গ জেলা বলশেভিক কমিটির সদস্যদের, বিশেষত কায়ুরভকে, এবং আন্তঃজেলা কমিটি (মেঝরায়ংকা) নামে একটি সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক সংগঠনকে, যার ১৯১৭তে বলশেভিকদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়। স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লব তকমা লাগাতে পারলে ২৭শে ফেব্রুয়ারী যখন জারতন্ত্রের পতন আসন্ন বুঝে অস্থায়ী সরকার এবং সোভিয়েত কার্যনির্বাহী কমিটি গড়ার দিকে এগোলো যথাক্রমে ক্যাডেট দল এবং নরমপন্থী সমাজতন্ত্রী দলরা, সে দিনটাকেই বিপ্লবের প্রথম সচেতন পদক্ষেপ হিসেবে দেখানো সহজ হত। [আর স্তালিন যুগ থেকে, যখন স্তালিনের ভূমিকাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এবং মহান বিপ্লবী হিসেবে দেখানো শুরু হল, তখন থেকে কায়ুরভ, শ্লিয়াপনিকভ, বা মেঝরায়ংকা নেতা ইউরেনেভের ভূমিকা যত খাটো করা যায় ততই ভাল।]
দ্বিতীয় যে বিষয় নিয়ে তর্ক দেখা যায়, তা হল জুলাই মাসে লেনিনের, এবং বলশেভিকদের উদ্দেশ্য নিয়ে তর্ক, আর তার সঙ্গে জুড়ে থাকা দাবী, যে লেনিন জার্মান সোনা নিয়ে যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয়ের জন্য সচেষ্ট ছিলেন। রুশ ক্যালেন্ডারের ৩-৪ জুলাই (পাশ্চাত্য ক্যালেন্ডারের ১৬-১৭ জুলাই), রাজধানীর কিছু সৈন্য এবং শ্রমিক সশস্ত্র বিক্ষোভের পথ ধরেন এবং বলশেভিক নেতৃত্ব একরকম শ্রেণিকে ছেড়ে যাওয়া যাবে না বলে ঐ বিক্ষোভের সঙ্গে থাকেন এবং সেটা যাতে অসময়ে অভ্যুত্থানে পরিণত না হয় সেই চেষ্টা করেন। বলশেভিকবিরোধীরা দাবী করেন, বাস্তবে লেনিন অভ্যুত্থানের চেষ্টাই করেছিলেন। পরে, আমরা এ নিয়ে আরো বিভিন্ন গবেষণা দেখব। এখানে বিশেষভাবে বলা দরকার, বলশেভিকদের এই সব রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা সফল হয়েছিলেন, জুলাই সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়াতে। কিন্তু বিশেষত কেরেনস্কী দাবী করেছিলেন, লেনিন টাকা নিয়ে জার্মান সাম্রাজ্যবাদের চরবৃত্তি করছেন। জার্মান সাম্রাজ্যের পতন হয় ১৯১৮ সালের শেষে। তারপর ১০০ বছরের মধ্যেও জার্মান মহাফেজখানা থেকে কোনো ইতিহাসবিদ এক চিলতে কাগজও দেখাতে পারেন নি, যা প্রমাণ করে যে জার্মান সরকার বা জেনারাল লুডেনডর্ফ - কেউ লেনিনকে টাকা দিয়েছিল।
তৃতীয় যে বিতর্ক এই সব লেখা থেকে উঠে আসে তা হল, বলশেভিকরা কী, গণতন্ত্র উচ্ছেদ করে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করার উদ্দেশ্য নিয়ে বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছিলেন? এই তর্কগুলি পরে পন্ডিতদের হাত ঘুরে ফিরে আসবে।
সাধারণীকরণ ও বিতর্কঃ ১৯২৪-১৯৩৮
নানা ধরণের বিপ্লবীরাই বিপ্লবের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলেন। ১৯২১ সালে গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকেই বিপ্লবীরা স্মৃতিচারণ ও ইতিহাস রচনা আরম্ভ করেন। ১৯১৭তে বলশেভিক কেন্দ্রীয় কমিটির রুশ ব্যুরোর নেতা আলেক্সান্দর শ্লিয়াপনিকভ ১৯২০-২১-এ ছিলেন ওয়ার্কার্স অপোজিশন বা শ্রমিক বিরোধীপক্ষের অন্যতম নেতা। ১৯২১-২২-এ তাঁরা পরাজিত হন। লেনিনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও, মার্চ মাসে যারা বলশেভিক দলের নেতৃত্বে আসেন, সেই স্তালিন ও কামেনেভের ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর ছিল গভীর অবজ্ঞা। তিনি চার খণ্ডে স্মৃতিচারণ প্রকাশ করেন।৮ ১৯২৩ সালে প্রকাশিত এই স্মৃতিচারণে তিনি দেখান, ফেব্রুয়ারীতে বলশেভিকরা অস্থায়ী সরকারের খোলাখুলি বিরোধী ছিলেন এবং সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরোধী ছিলেন, কিন্তু কামেনেভ-স্তালিন-মুরানভ এই ত্রয়ী ফিরে এসে নেতৃত্ব নেওয়ার পর পার্টির নীতি অনেক মোলায়েম হয়ে যায়। পরে স্তালিন শ্লিয়াপনিকভকে বইটি নতুনভাবে লিখতে বাধ্য করেন, এবং আরও পরে তাঁকে নিন্দা করা হয়, বইটি নিষিদ্ধ হয়। প্রথম দুই খন্ড ১৯৮২তে ইংরেজী অনুবাদে প্রকাশিত হয়। কিন্তু ১৯১৭-র উপর যে দু-খন্ড, সেদুটি নতুন করে প্রকাশিত হয় রুশ ভাষায় সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর।
১৯২৪ সালে, লেনিনের মৃত্যুর পর, পার্টিতে আমলাতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র নিয়ে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। প্রলেতারীয় গণতন্ত্রের দাবীতে গড়ে ওঠে বামপন্থী বিরোধী গোষ্ঠী। প্রাথমিক লড়াইতে তাঁরা হেরে গেলেও, তর্ক চলতে থাকে। ত্রৎস্কীর ১৯১৭-র বক্তৃতা ও রচনার সংকলন যখন তাঁর রচনাবলীর একটি খণ্ড হিসেবে প্রকাশিত হয়, তখন তিনি তার ভূমিকা হিসেবে লেখেন উরোকি অক্টিয়াব্রিয়া (অক্টোবরের শিক্ষা)। এই রচনাতে তিনি দাবি করেন, শ্রেণি সংগ্রাম তীব্র হলে নেতৃস্থানীয় দলের মধ্যেও বাম-দক্ষিণ বিভাজন ঘটে, পুরোনো চিন্তার জড়তা কাটাতে লাগে তলা থেকে শ্রমিক শ্রেণির ধাক্কা। উপরন্তু তিনি নির্দিষ্ট কয়েকজনকে অক্টোবরের দিনে পার্টির দক্ষিণপন্থী বলে চিহ্নিত করেন – কামেনেভ, জিনোভিয়েভ, নগিন, প্রমুখ। আর, তিনি বলেন যে পার্টি একা বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয় নি – সোভিয়েতদের ভূমিকা পুনরায় স্মরণ করিয়ে তিনি প্রকারান্তরে প্রলেতারীয় গণতন্ত্রের প্রসংগ আবার তুলতে চাইলেন। এই বইটি প্রকাশের ফলে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়। ১৯১৭তে যেহেতু জিনোভিয়েভ, কামেনেভ বা স্তালিন, অর্থাৎ ১৯২৪-এ পার্টির তিন প্রধান, কেউই ত্রৎস্কীর মতো ভূমিকা পালন করেন নি, তাই একদিকে শুরু হল প্রাক ১৯১৭ পর্বে ত্রৎস্কীর ভূমিকা নিয়ে সত্য (১৯০৩-এ দ্বিতীয় কংগ্রেসে মেনশেভিক ছিলেন, ১৯০৪-এ লেনিনকে তীব্র সমালোচনা করে পুস্তিকা রচনা, ১৯১২তে অগাস্ট জোট গঠন) এবং মিথ্যা (নিরন্তর বিপ্লবের অর্থ কৃষকদের অবহেলা করা, ১৯১৭ পর্যন্ত তিনি ছিলেন মেনশেভিক এই দাবি করা, বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর অবস্থান ছিল মধ্যপন্থী, ইত্যাদি) নানা প্রচার, আর অন্যদিকে ১৯১৭-র ইতিহাস নতুন করে লেখার ও লেখানোর প্রচেষ্টা। স্তালিন, জিনোভিয়েভ, কামেনেভ, বুখারিন প্রমুখ নেতা ছাড়া, পকরভস্কি এবং ইয়ারোস্লাভস্কির মত পার্টি-সদস্য ইতিহাসবিদরাও এই কাজে সক্রিয় হলেন। তাঁদের বক্তব্য হল, ১৯১৭ সালে লেনিনের সঙ্গে কামেনেভ-স্তালিনের মতের খুব অমিল ছিল না, ত্রৎস্কী কৃষকদের অবহেলা করেছিলেন তাই তিনি ১৯০৫ থেকে ১৯১৭ অবধি যে রণনীতির কথা বলেছিলেন তার সঙ্গে লেনিনের ১৯১৭-র রণনীতির কোনো মিল ছিল না, এবং তিনি শ্রমিকদের ক্ষমতাকে খাটো করে দেখছিলেন ও একই সঙ্গে পার্টির ভূমিকাকে যথাযথ গুরুত্ব দেন নি।৯
এই সময় থেকে সোভিয়েত পার্টির সরকারী লাইন ভিত্তিক ইতিহাস লেখা স্পষ্ট হতে শুরু করে। কিন্তু স্তালিনের একক ক্ষমতা দখলের ফলে একাধিকবার ইতিহাস নতুন করে লেখার দরকার হয়। ১৯২৪ সালে ত্রৎস্কীর মূল লক্ষ্য ছিলেন জিনোভিয়েভ ও কামেনেভ। কিন্তু ১৯২৫ সালে প্রলেতারীয় লেনিনগ্রাদের চাপে জিনোভিয়েভ (এবং তাঁর সঙ্গে কামেনেভ) স্তালিনের বিরুদ্ধে ঘুরে দাড়ান। ফলে আবার ইতিহাস লেখা পালটায়। ১৯২৯ সালে বুখারিন ক্ষমতা থেকে ছিটকে গেলে ফের প্রয়োজন হল, তাঁর ভূমিকা খাটো করার। অবশেষে ১৯৩০-এর দশকে জোর পড়ল, লেনিন ও স্তালিন ছাড়া পুরোনো নেতাদের জীবিত যারা তাঁরা প্রায় সকলে বিশ্বাসঘাতক, প্রতিবিপ্লবী, প্রমাণ করার। এই নয়া ইতিহাসের রূপরেখা তৈরী হল হিস্ট্রি অভ দ্য সি পি এস ইউ (বি)- শর্ট কোর্স বইয়ে। বইটির একটি অধ্যায় স্তালিনের লেখা, অন্য অনেক ক্ষেত্রেই প্রবলভাবে স্তালিনের হাতের ছাপ রয়েছে। পার্টির অভ্রান্ত নেতৃত্বের যে কাহিনী ইতিমধ্যেই গড়ে উঠেছিল, তার সঙ্গে যুক্ত হয় আরো নির্দিষ্ট কিছু উপাদান। প্রথমত, লেনিনের ব্যক্তিগত অভ্রান্ততার তত্ত্ব। দ্বিতীয়ত, ১৯০২ সালে কি করিতে হইবে? থেকে, ১৯০৩-এ পার্টি কংগ্রেস হয়ে ১৯১৭ পর্যন্ত বলশেভিকবাদের সরলরেখায় অগ্রগতি, এবং পার্টি ও শ্রেণির সম্পূর্ণ সমাপতনের কাহিনী। তৃতীয়ত, ১৯১৭ সালে লেনিনের প্রধান সহকর্মী হিসেবে স্তালিনের আবির্ভাব। যদিও ১৯৫৩-র, বা বিশেষ করে ১৯৫৬-র (অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতি কংগ্রেসে ক্রুশ্চেভের বক্তৃতার) পর, সবচেয়ে উৎকট মিথ্যা দাবীগুলি সরানো বা কমানো হয়, তবু, এই বইটি পরবর্তী অর্ধশতাব্দীর সরকারী (রুশ-চীনপন্থী) কমিউনিস্ট পার্টিদের রুশ বিপ্লব সংক্রান্ত ইতিকথার ভিত্তি ছিল, এবং এখনও বহু দেশে স্তালিনবাদী বা স্তালিনবাদের উত্তরসূরী সংগঠনদের রুশ বিপ্লব কাহিনীর মূল ভিত্তি। অধ্যাপক মিন্টসের লেখা রুশ বিপ্লবের ইতিহাস, যেটিকে ১৯৬০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত প্রামান্য ইতিহাস বলে দেখা হত, তা কিছুটা সংশোধিত হলেও প্রধানত এই বইটির কাছে ঋণী।১০ তিন হাজার পাতার বেশী দীর্ঘ এই তিন খন্ড বইকে বলা যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের স্তালিনবাদী প্রতিষ্ঠা-মিথের বৃহত্তম আখ্যান। লেনিন অভ্রান্ত। বিদেশী ইতিহাসবিদদের বিকৃতি থেকে রুশ ইতিহাসকে মুক্ত করতে হবে (স্তালিন জমানা থেকেই রুশ বিপ্লবের সরকারী ভাষ্যগুলি শ্রেণির প্রতর্ককে ক্রমে জাতীয়তাবাদী মোড়কে পুরে ফেলছিল); লেনিনের পরেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন স্তালিন, কামেনেভ ক্রমাগত ভ্রান্তিই করে গিয়েছিলেন, ত্রৎস্কী অভ্যুত্থানের পক্ষে ভোট দিলেও আসলে অভ্যুত্থান চান নি; বস্তুত অক্টোবর বিপ্লবে তাঁর বিশেষ ভূমিকাটা পাশ্চাত্য ইতিহাসবিদদের তৈরি গল্প; শ্রেণি চেতনার ধারাবাহিকতা শ্রেণির বাস্তব ইতিহাস থেকে না, লেনিন ও তাঁর শীর্ষস্থানীয় কমরেডদের মননের ধারাবাহিকতা থেকে আসে। ঘটনা প্রবাহের নৈরাজ্যকে শৃংখলাতে রূপান্তরিত করল পার্টি আর তার “সক্রিয় ক্যাডাররা”।
হিস্ট্রি অভ দ্য সি পি এস ইউ (বি)- শর্ট কোর্স বইয়ের কয়েক বছর আগে প্রকাশিত হয় এর বিপরীত ধাঁচের দুটি বই। উইলিয়ম হেনরী চেম্বারলিন ছিলেন পেশায় সাংবাদিক, যিনি সোভিয়েত মহাফেজখানা গবেষকদের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই বহু তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। ফলে তাঁর লেখা দুখণ্ড বই দ্য রাশিয়ান রেভল্যুশন ১৯১৭-১৯২১, পাঠকদের কাছে বিপ্লব ও গৃহযুদ্ধের এক সার্বিক বিবরণ রাখে, যা আজও বিশেষভাবে বলার মত।১১ সোভিয়েত/রুশ ইতিহাস চর্চায় সুপরিচিত লেখিকা শীলা ফিটজপ্যাট্রিক বলেছেন “বিপ্লব ও গৃহযুদ্ধের সেরা সার্বিক বর্ণনা” আছে এই বইটিতে।১২ চেম্বারলিনের বইয়ের এক প্রধান গুরুত্ব, তিনি গৃহযুদ্ধকে বিপ্লবের অঙ্গ হিসেবে দেখিয়াছিলেন। গৃহযুদ্ধে লালফৌজের জয় যে শ্রেণি সংগ্রামের অঙ্গ, নিছক সামরিক কৌশলে উন্নততর পক্ষের জয় না, সেটা বেরিয়ে আসে। গৃহযুদ্ধ একদিকে রাজনৈতিক বিপর্যয় ঘটায়, কারণ শুধু বুর্জোয়া শ্রেণি না, সংস্কারপন্থী সমাজতন্ত্রী দলগুলি ও বিভিন্ন সময়ে কৃষকদের কোনো কোনো অংশ, সোভিয়েত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে ধরেছিল। ফলে প্রলেতারীয় গণতন্ত্র ক্রমেই সঙ্কুচিত হতে থাকে। কিন্তু ঐ সংকোচনের পিছনে যে গৃহযুদ্ধ, সে সম্পর্কে পাশ্চাত্যের ইতিহাসবিদরা বহু সময়েই চুপ থেকেছেন। মার্ক্স থেকে টুকরো উদ্ধৃতি সাজানো একরকম মার্ক্সবাদীও গৃহযুদ্ধ কারা শুরু করেছিল, সেটা কতটা হিংস্র ছিল, সে সব না দেখেই লেনিন, ত্রৎস্কী, সভের্দলভ, এঁরা কেন ফৌজ নির্মান করলেন, কেন যুদ্ধ করলেন, কেন প্রতিপক্ষীয়দের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিলেন, এই নিয়ে সমালোচনার ঝড় তোলেন। লেনিন, ত্রৎস্কীরা বেশ কিছু ভুল করেছিলেন সে কথা বলা যায়। যেমন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চেকা নির্মান। কিন্তু গৃহযুদ্ধ যারা শুরু করল, যারা অস্ত্র হাতে, বর্বর হিংস্রতা দেখিয়ে শ্রমিক শ্রেণির শাসনকে খতম করতে চাইল, তাদের কেন সে কাজ করতে দেওয়া হল না, এই প্রশ্ন করলেন যিনি তাঁর শ্রেণিগত অবস্থান নিয়েই প্রশ্ন তোলা দরকার। চেম্বারলিনের বই ঠিক এই কারণেই জরুরী। ঠান্ডাযুদ্ধের বিকৃতির বহু আগে, তিনি তুলে ধরেছিলেন, কেন গৃহযুদ্ধ, কেনই বা লাল ঝান্ডার জয়।
১৯৩০ সালে রুশ ভাষায় লেখা হলেও, রুশে প্রকাশিত হয় কার্যত অনেক পরে, বরং ইংরেজী, ফরাসী বা জার্মান ভাষায় অনুদিত হয়ে প্রকাশিত হয় লেভ ত্রৎস্কীর দ্য হিস্ট্রি অভ দ্য রাশিয়ান রেভল্যুশন।১৩ শ্রমিক শ্রেণির ক্ষমতার উপর স্তালিনের তীব্র আক্রমণের পাশে চলছিল বিপুল মিথ্যা প্রচারের স্রোত। মার্ক্সীয় তত্ত্ব, বলশেভিক দলের ইতিহাস, ত্রৎস্কীর ব্যক্তিগত ভূমিকা, সব কিছু নিয়ে বিকৃতি্র জবাবে ত্রৎস্কী অন্তত তিনটি বই ও বেশ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। দলিলের ভিত্তিতে মার্চ-এপ্রিলে স্তালিন-কামেনেভের ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছিল দ্য স্তালিন স্কুল অভ ফলসিফিকেশন-এ। নিজের ভূমিকা সম্পর্কে, এবং লেনিন ও জার্মান সেনা সংক্রান্ত মিথ্যা প্রচারে কেরেনস্কীর জবাবে, অনেকটা আলোচনা করা হয় তাঁর আত্মজীবনীতে।১৪ কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচিত হল এই বইটিতে। ত্রৎস্কীর ইতিহাসের ক্ষেত্র বিশাল। রুশ সমাজ-অর্থনীতির বিকাশ, বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার প্রবেশ, যুদ্ধের ফলে শ্রমিক ও কৃষকের উপর শোষণের মাত্রা বৃদ্ধি, এ সবের পরও আলোচনা ঘুরে যায় জার ও জারিনার দিকে। প্রাসাদ-ষড়যন্ত্র দেখাল, শাসক শ্রেণি কতটা বিভক্ত, পুরোনো কায়দায় শাসন চালাতে কত অক্ষম। বিপ্লব অনিবার্য, তাই খুঁটিনাটি ঘটনা দেখার দরকার নেই, এমন মনোভাব ইতিহাসবিদ হিসেবে তাঁর মধ্যে ছিল না। জারতন্ত্রের পতন ও পাঁচদিনের বিক্ষোভ যা সাধারণ ধর্মঘট এবং অভ্যুত্থানের রূপ নিল, এবং তাতে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা থেকে সাধারণীকরণের মাধ্যমে তিনি কতকগুলি বিতর্কে তাঁর মত জানাতে চেষ্টা করেন। ফেব্রুয়ারী বিপ্লব কি স্বতঃস্ফুর্ত ছিল? স্বতঃস্ফূর্ত মানে কী? আসলে তার নেতারা ছিলেন কম বিখ্যাত, অনেকে পরে হারিয়ে গেছেন, যদিও অন্তত ভাইবর্গ জেলা বলশেভিক কমিটি এবং মেঝরায়ংকার নাম আমরা এখানে স্পষ্ট করে পাই। কিন্তু বিপ্লব করেছিল শ্রমিক শ্রেণি এবং সৈনিকের উর্দী পরা কৃষকরা। তাহলে ফেব্রুয়ারী বিপ্লব কোন অর্থে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ছিল?
সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে, এবং সরকারী কমিউনিস্টদের বাইরে, ত্রৎস্কীর ইতিহাস ছিল এমন এক গবেষণার ফসল, যা পরের ৭০-৭৫ বছরের না- স্তালিনবাদী না- কমিউনিস্ট বিরোধী দক্ষিণপন্থী এমন এক তৃতীয় অবস্থানের ইতিহাসচর্চার আদিকল্প হিসেবে এক বিরাট ভূমিকা নিয়েছিল। আমরা পরে দেখব, ১৯৭০-এর দশক থেকে নতুন করে যে প্রগতিবাদী গবেষণা দেখা দেয়, সেগুলি তাঁর গবেষণার পাশে ফেললে আর অত নতুন মনে হয় না। কিন্তু ত্রৎস্কীর গবেষণাতে একটি বড় ফাঁক থেকে গিয়েছিল। রুশ বিপ্লবে নারী শ্রমিকদের ভূমিকা, বুর্জোয়া নারীবাদীদের সঙ্গে বলশেভিক মেয়েদের দ্বন্দ্ব, বলশেভিক পুরুষদের মধ্যে পুরুষপ্রাধান্যবাদের উপস্থিতি এবং তার বিপরীতেও বলশেভিক মেয়েদের দীর্ঘ প্রয়াস, এ নিয়ে কোনো উল্লেখ নেই, যদিও এ বিষয়ে ত্রৎস্কী কিছু জানতেন না এমন নয়, কারণ অন্য সময়ে তিনি এ নিয়ে লিখেছিলেন। সুতরাং ধরে নিতে হয়, শ্রেণি যে লিংগদ্বারা বিভক্ত এবং শ্রেণি সংগ্রামের সার্বিক ছবি তুলে ধরতে গেলে যে স্বতন্ত্রভাবে মেয়েদের লড়াইকেও তুলে ধরতে হবে, এ নিয়ে তাঁর তত্ত্বগত সীমাবদ্ধতা বাধা দিয়েছিল। বস্তুত, ১৯৬০-এর দশকের নারীবাদের উত্থানের আগে কেউই এ নিয়ে গবেষণা করেন নি, সুবিন্যস্তভাবে মেয়েদের এই লড়াইয়ের ইতিহাসের ছবি তুলে ধরেন নি।
অন্যদিকে, ত্রৎস্কী শ্রেণি ও দলের দ্বান্দ্বিক আন্তঃসম্পর্ক চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তোলেন তাঁর ইতিহাসে। বিপ্লবী দলের ভূমিকা কেন জরুরী সেটা দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি দেখান, বিপ্লবী দল শ্রমিক শ্রেণির প্রতিস্থাপনা করলে প্রলেতারীয় বিপ্লব সম্ভব নয়।
ঠান্ডা যুদ্ধের যুগে পশ্চিমী দক্ষিণপন্থী ইতিহাসব্যাখ্যা - ১৯৪৯-- ১৯৯১
ঠান্ডা যুদ্ধের সূচনা থেকে, রাজনৈতিক প্রয়োজনে রুশ ইতিহাসের এবং মার্ক্সবাদের চর্চা শুরু হয় পাশ্চাত্যে। ঠান্ডাযুদ্ধের নেতা হিসেবে এই কাজে অগ্রগণ্য ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সে দেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে সোভিয়েত চর্চা (১৯৪৯-এর পর চীন-চর্চা-ও) বিভাগ, অধ্যাপক পদ খোলা হয়, যেমন গজিয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক এক মার্ক্সবাদচর্চার ধারা। উগ্র মতাদর্শগত আক্রমণ গোড়া থেকেই এঁদের লক্ষ্য ছিল, তাই প্রবল প্রচার বাস্তবকে প্রায়ই ঢেকে দিত। কিন্তু একথাও বুঝতে হবে, যে বলশেভিক পার্টি, বা অন্তত তার যে সব সদস্যরা স্তালিনের সীলমোহরপ্রাপ্ত, তাঁরা সকলে সন্ত, পার্টি কখনো ভুল করেনি, রাশিয়াতে প্রশস্ত সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র রয়েছে, গুলাগে পাঠানো হয় কেবল প্রকৃত অপরাধীদের, এই সব মস্কো-নিঃসৃত গল্পের বিরুদ্ধে তাঁরা প্রচুর তথ্য তুলে ধরেছিলেন, তাই ব্যাখ্যার কাঠামো বিকৃত হলেও, দলিল-দস্তাবেজের মাধ্যমে সেটার একরকম গ্রহণযোগ্যতা, কেবল উগ্র দক্ষিণপন্থী মহলে না, উদারপন্থী এবং অ-স্তালিনবাদী বাম মহলেও অনেক সময়ে তৈরী হয়েছিল। বস্তুত, পাশ্চাত্য ইতিহাস রচনাতে সোভিয়েত ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে ঠান্ডাযুদ্ধের কাঠামো উগ্র দক্ষিণপন্থী আর উদারপন্থীদের এক ঐক্য গড়ে দিয়েছিল। তার সঙ্গে যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টি থেকে সরে যাওয়া বা বিতাড়িত বিক্ষুব্ধরা। শ’য়ে শ’য়ে বই, প্রবন্ধ, লেখা হয়েছিল। তাদের সকলের তালিকা একটা গোটা পুস্তিকার মত বড় হয়ে যাবে। আমাদের উদ্দেশ্য মূল ধারা এবং উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বইয়ের আলোচনা করা।
প্রথম যার নাম আসে তিনি বার্ট্রাম ডেভিড উলফ। জন রীড এবং লুইস ফ্রাইনার সঙ্গে সোশ্যালিস্ট পার্টির বামপন্থী গোষ্ঠীর সদস্য, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য এবং তার প্রথম পত্রিকা সম্পাদক, “বুখারিনপন্থী’ বলে পরিচিত লাভস্টোন উপদলের অন্যতম নেতা, এবং প্রথম ও দ্বিতীয় মস্কো বিচার-প্রহসনের সমর্থক (জিনোভিয়েভ-কামেনেভ এবং র্যাডেক-পিয়াতাকভ), উলফ স্তালিনের বিরোধী হন বুখারিন-রাইকভ বিচারের সময়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও তার পর তিনি উগ্র দক্ষিণপন্থী হয়ে ওঠেন। এরপর তিনি মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের পরামর্শদাতা ছিলেন, এবং স্ট্যানফোর্ড ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগেও যুক্ত হয়েছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে উলফ যে তত্ত্বায়ন করেন, স্টিফেন কোহেন পরে তার নাম দিয়েছিলেন “ধারাবাহিকতা তত্ত্ব” বা continuity thesis। ১৫
এই তত্ত্বের মূল কথা হল, ১৯০২ সালে লেনিন স্তো দিয়েলাত (What Is To Be Done?) নামে একটি বই লিখেছিলেন, এবং তাতেই এক কেন্দ্রীয় কর্মসূচী তৈরী করেছিলেন। তা অনুযায়ী, একটি অগ্রণী “এলিট” একনায়কতন্ত্র কায়েম করবে, একটি অতি-কেন্দ্রীকৃত সংগঠন নির্মান হবে। উলফ বলেন, ‘তাঁর [লেনিনের] স্বতন্ত্র [পার্টি] যন্ত্র এবং তার উপর তাঁর স্বৈরতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ শুরু হয় ... ১৯০৩ থেকে”। ঐ সময় থেকে, স্তালিনের মৃত্যু (১৯৫৩) অবধি, “বলশেভিকদের দুজন মাত্র কর্তৃত্বপরায়ণ নেতা ছিলেন” – লেনিন ও স্তালিন।১৬
অনেকেই উলফ প্রদর্শিত পথে এগোলেন। আলফ্রেড মেয়ার বলেন, স্তালিনবাদ হল লেনিনবাদ থেকে নিঃসৃত চিন্তা ও কার্যপদ্ধতি।১৭ রবার্ট ড্যানিয়েলস দেখিয়েছিলেন, কমিউনিস্টদের মধ্যে নানা মত ছিল, বারে বারে গণতন্ত্র ফেরানোর দাবী তাঁরাই তুলেছিলেন, অথচ তিনি সেই সঙ্গে দাবী করলেন, ত্রৎস্কীবাদীদের সঙ্গে বৈপরীত্য ছিল “স্তালিন ও লেনিনের বেশী প্রত্যক্ষ অনুগামীদের”, আর বললেন যে “লেনিনবাদ দুটি নির্নায়ক ক্ষেত্রে স্তালিনবাদের জন্ম দিয়েছিল”।১৮
কন্টিনুইটি থিসিসের এক প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে দেখা দেয় লিওনার্ড শ্যাপিরোর দ্য অরিজিনস অভ দ্য কমিউনিস্ট অটোক্রেসী।১৯ শ্যাপিরো সরাসরি অস্বীকার করেন যে রুশ বিপ্লবে বলশেভিকরা কোনো সময়েই গণতান্ত্রিক ছিলেন। তাঁর বই শুরু হয় এই মন্তব্য করে, যে তিনি দেখাবেন, কীভাবে এক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বেশী গণসমর্থন পাওয়া শক্তিদের হঠিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিল। ১৯১৭ থেকে ১৯২২, গণতান্ত্রিক অধিকার সংকোচনের এমন বহু তথ্য তিনি তুলে ধরলেন, যেগুলি অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু শ্যাপিরোর বর্ণনায় একমাত্র শয়তানের নাম বলশেভিক দল। গৃহযুদ্ধ, তাতে শ্বেতরক্ষীদের নৃশংসতা, নরমপন্থী সমাজতন্ত্রীদের তাদের সঙ্গে হাত মেলানো, এ সব গৌণ হয়ে যায়, অনেক ক্ষেত্রে উচ্চারিতই হয় না।
আরেকজন উল্লেখযোগ্য লেখক রিচার্ড পাইপস। রুশ ও সোভিয়েত ইতিহাসের উপর তিনি ২২টি বই লিখেছেন বা সম্পাদনা করেছেন। তাই তাঁর সম্পর্কে সার্বিক আলোচনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু তাঁর মূল বক্তব্য দেখা খুবই জরুরী। পাইপস পুরোমাত্রায় ঠান্ডাযুদ্ধের যোদ্ধা। সোভিয়েত-মার্কিন সুসম্পর্ক বা দেতাঁতকে তিনি ১৯৭০-এর দশকে তীব্র নিন্দা করেছিলেন, এবং রোনাল্ড রেগনের রাষ্ট্রপতিত্বের সময়ে তিনি মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির সদস্য ছিলেন। পাইপস ১৯৯০ সালে রুশ বিপ্লবের উপর একটি বৃহদায়তন বই লেখেন। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় বলশেভিক শাসনের প্রথম পর্ব নিয়ে তাঁর বই। ১৯৯৬ সালে আর্কাইভ থেকে দলিল নিয়ে তিনি সম্পাদনা করেন “অজ্ঞাত লেনিন” সম্পর্কিত বই।২০
পাইপসের প্রথম বইটিতে দুটি বিশেষত্ব লক্ষ্য করা যায়। তাঁর মতে, জারতন্ত্রী রাশিয়ার রাষ্ট্র ছিল ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। আধা-সামন্ততান্ত্রিক জার্মানী, অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরি ইত্যাদির সঙ্গী রাশিয়ার ফারাক হল, রাশিয়ার জারেরা রাষ্ট্রকে পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে দেখতেন। ১৯৭৪ সালেই তিনি একটি বইয়ে এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছিলেন। এই কারণেই নাকি রাশিয়াতে সর্বাত্মক জারতন্ত্র-বিরোধী বিপ্লব হয়েছিল। পাইপস তাঁর থেকে ভিন্নমতের গবেষণাদের আদৌ আমল দিতে রাজী না। তাই আর্নো মেয়ার যে গোটা ইউরোপ জুড়ে পুরোনো ব্যবস্থার সংকটের ছবি তুলে ধরেছিলেন, পাইপস তাতে নির্বিকার।২১ মেয়ার দেখান, রাষ্ট্রকাঠামো ও রাজনীতিতে পুরোনো ব্যবস্থা ইউরোপে কতটা ছড়িয়েছিল, এবং দেশ থেকে দেশে তাদের মধ্যে কতটা মিল ছিল। পাইপসের বইয়ের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ভাগে আছে ফেব্রুয়ারী বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব, এবং অক্টোবর বিপ্লব থেকে বলশেভিক শাসনের প্রথম মাসগুলি। এখানে পাইপসের মত স্পষ্ট। তিনি সামাজিক ইতিহাস চর্চায় বিশ্বাসী নন। শ্রেণি, বা অন্য সামাজিক বর্গগুলির কোনো যৌথ পরিচিতি ও চেতনা আছে এবং তা নিয়ে ১৯৭০-এর দশক থেকে বহু পি এইচ ডি, বহু বই ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এমনকি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে - পাইপসের তাতে কিছু আসে যায় না।
১৯৭০-এর দশকের সামাজিক ইতিহাস চর্চা, “নীচে থেকে ইতিহাস” বা history from below, বিভিন্ন শহরের শ্রমিকদের লড়াই রাজনৈতিক দিশা, কৃষকদের লড়াই ও চেতনার রূপান্তর, সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীতে বিপ্লবী মতের বিস্তার, জাতিসত্ত্বাদের লড়াই, এ নিয়ে বিশদ গবেষণা হয়েছিল, যা পরে আলোচিত হবে। সেই সঙ্গে লেখা হয় ক্যাডেট, সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারী, মেনশেভিক বিভিন্ন দলের ইতিহাস, নৈরাজ্যবাদীদের ইতিহাস, ইত্যাদি। বিপ্লবে নারী আন্দোলন ও লিঙ্গ সমতার লড়াই নিয়ে বহু বই রচিত হয়। পাইপসের বইয়ে ঐ সব গবেষণা নিতান্ত গৌণ, অনেকেই অনুচ্চারিত। তিনি ইতিহাসের ব্যাখ্যাতে সামাজিক ইতিহাস বা শ্রেণি সংগ্রামের কোনো অস্তিত্ত্বই দেখতে পান না। গৃহযুদ্ধের উপর তিনি সাত অধ্যায় ব্যয় করেছেন, যার মধ্যে একটি গোটা অধ্যায় জার পরিবারের হত্যা নিয়ে। কিন্তু শ্বেতরক্ষীদের বর্বরতা, যা বহু আগেই অনেকে তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন, তা পাইপসের বর্ণনাতে ঠাঁই পায় না।
প্রত্যেক ইতিহাসবিদেরই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থাকে, তাই সেটা দোষের নয়। কিন্তু ইতিহাসবিদ তখন নিজের পেশার প্রতি অপরাধ করেন যখন মতামত চাপাতে গিয়ে তিনি তথ্যের বিকৃতি ঘটান। পাইপস রাশিয়া আন্ডার দ্য বলশেভিক রেজিম-এ সেই কাজই করেছেন। এই বইয়ে তিনি গৃহযুদ্ধ সম্পর্কিত আলোচনা প্রসঙ্গে দেখাতে চেয়েছেন, “সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ” বলে আসলে কিছু ঘটেনি।২২ কিন্তু তাঁর দেওয়া তথ্য খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, সবকটা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি একজোট হয়নি, এবং লয়েড জর্জ মনে করেছিলেন বলশেভিকদের সঙ্গে রফা হোক। অর্থাৎ, একজন পাশ্চাত্য নেতার মত দিয়ে প্রমাণ হল, সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ হয় নি। সাম্রাজ্যবাদ যে সরাসরি ফৌজ পাঠিয়েছিল এবং অন্য ভাবেও প্রতিবিপ্লবকে সামরিক ও আর্থিক সাহায্য করেছিল, সেটা প্রমাণ নয়।২৩
বলশেভিকদের সম্পর্কে, বিশেষত গৃহযুদ্ধে তাঁদের জয় সম্পর্কে, পাইপসের বক্তব্য নিতান্ত হাস্যকর। গৃহযুদ্ধে লালফৌজের প্রধান রণনীতি নির্মাতা ছিলেন ত্রৎস্কী, এ কথা সুবিদিত।২৪ পাইপস গৃহযুদ্ধের উপর উল্লেখযোগ্য গবেষণাগুলি অবহেলা করে কেবল দমিত্রি ভলকোগোনভের মতের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, সমরনীতিতে ত্রৎস্কী ছিলেন অপটু।২৫ বোঝা গেল না, তা হলে লাল ফৌজের জয় কীভাবে হল। “লাল সাম্রাজ্য” অধ্যায়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনের যে বর্ণনা আছে, তাতে বলশেভিকদের জাতীয়তা সংক্রান্ত নীতিকে তিনি ভন্ডামি বলে এক কথায় ফেলে দিয়েছেন। লেনিন যে প্রথমেই ফিনল্যান্ডের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, সেটা এড়িয়ে গিয়ে পাইপস লিখেছেন, জার্মানরা ফিনদের স্বাধীন হতে উৎসাহ দিয়েছিল।২৬
মতাদর্শগত-রাজনৈতিক বিদ্বেষ পাইপসকে বারে বারে বিকৃতির দিকে নিয়ে গেছে। তিনি দাবী করেছেন, শ্বেত সন্ত্রাস লাল সন্ত্রাসের মত নিয়মিত ঘটনা ছিল না।২৭ বাস্তবে, ফিনল্যান্ডে অভ্যুত্থানের পরাজয়ের পর শ্বেত সন্ত্রাস প্রায় ২০,০০০ শ্রমিককে হত্যা করে, প্রধানত শ্রেণিভিত্তিক পরিচয়ে। বন্দী করা হয় আরো ৭০,০০০ শ্রমিককে। তখন পর্যন্ত রাশিয়াতে লাল সন্ত্রাস আদৌ শুরু হয়নি। স্পষ্টতই, মৃত্যুরও শ্রেণিভেদ আছে, তাই জারের পরিবারের মৃত্যুর জন্য একটা গোটা অধ্যায় জোটে, কিন্তু ফিনল্যান্ডের ২০,০০০ শ্রমিকের কোনো উল্লেখ হয় না। ২৮
গৃহযুদ্ধের পর, ১৯২১-২২ সালে মেনশেভিকরা অনেকে রাশিয়া ছেড়ে চলে যান। ফেদোর ড্যান এবং রাফায়েল আব্রামোভিচ সহ অনেকে বইও লেখেন। তবে সেই বইগুলি আমাদের বর্তমান আলোচনার কেন্দ্রে নেই। ১৯৩০-এর দশকে, হিটলারের উত্থানে শঙ্কিত সমাজতন্ত্রীরা বহু দেশ থেকেই ঐতিহাসিক দলিল সরাতে থাকেন। বহু সমাজতন্ত্রী নিজে চলে যান ব্রিটেনে বা আমেরিকাতে। মেনশেভিক এবং সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীদের অনেকে আমেরিকাতে উপস্থিত হন, এবং হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড বা কলম্বিয়া সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা পড়ে তাঁদের নথিপত্র। এর থেকে দুটি প্রকল্প দানা বাধে। ১৯৬১ সালে স্ট্যানফোর্ড থেকে প্রকাশিত হয় রবার্ট পল ব্রাউডার ও আলেক্সান্দর কেরেনস্কীর সম্পাদনাতে, তিন খণ্ডে ১৪০০-র বেশী দলিল।২৯ আর এক বিশাল প্রকল্প তৈরী হল – মেনশেভিকদের ইতিহাস লেখার প্রকল্প। এর দায়িত্ব পড়ে সে সময়ে তরুণ অধ্যাপক লিওপোল্ড হেমসনের উপর। অ্যালান ওয়াইল্ডম্যান, সোলোমন শোয়ার্জ, হেমসন নিজে, বিভিন্ন বই প্রকাশ করেন।৩০ আব্রামোভিচ এবং লিডিয়া ড্যান, যারা রুশ বিপ্লবের ইতিহাস রচনা এবং সেই রচনাকর্মে প্রবাসী মেনশেভিকদের কেন্দ্রীয় ভূমিকা চেয়েছিলেন, তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল বলশেভিকরা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী ছিলেন না, সেটা দেখানো। এই প্রকল্পে সেই কাজের উপর জোর পড়ে, যদিও শ্যাপিরো বা পাইপসের মত উগ্রতা এই রচনাগুলিতে সব সময়ে ছিল না।
ব্রাউডার ও কেরেনস্কীর বইটির স্বতন্ত্র উল্লেখের প্রয়োজন রয়েছে। সম্পাদনার মানে কিছু সমস্যা ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে এর আগেই ৬ খণ্ডে প্রচুর দলিল প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু তা যেহেতু রুশ ভাষায়, তাই রুশ জানা না থাকলে সেসব পড়া সম্ভব হত না। ব্রাউডার ও কেরেনস্কী দলিলগুলি ইংরেজী অনুবাদে প্রকাশ করেন। উপরন্তু, তাঁদের উদ্দেশ্য যাই হোক, অ-বলশেভিক দলিল, বিশেষত অস্থায়ী সরকারের দলিল এবং মধ্য ও দক্ষিণপন্থী দলদের লেখাপত্র পাঠকের হাতে দিয়ে তাঁরা বাস্তবে বুঝতে সাহায্য করলেন, যে ১৯১৭ সালে কোনো অ-বলশেভিক “গণতান্ত্রিক বিকল্প” কেন গড়ে ওঠে নি।
বিকল্প ইতিহাসের সন্ধানে - কার, ডয়েটশার থেকে রাবিনোউইচ
ঠান্ডাযুদ্ধের দুই পক্ষ, অর্থাৎ মার্কিন সরকারী সাহায্যপুষ্ট লেখকরা বনাম সোভিয়েত সরকারী মদতপুষ্ট লেখকরা যে ছবি তুলে ধরেছিলেন, এবং যেটা ছিল যেন একই ছবির হয় পজিটিভ নাহলে নেগেটিভ (সর্বদা সঠিক সন্ত বলশেভিক বনাম কুটিল বদমায়েশ বলশেভিক, এবং অবশ্যই ১৯১৭ থেকে স্তালিনবাদের ধারাবাহিকতা) – তার বাইরে গিয়ে ইতিহাস লেখা শুরু হয় ঐ ঠান্ডা যুদ্ধের পর্বেই। এখানে অগ্রগণ্য ছিলেন দুজন – ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড হ্যালেট কার, এবং পোলিশ মার্ক্সবাদী, ব্রিটেনের বাসিন্দা, আইজ্যাক ডয়েটশার। যদিও ডয়েটশার আগে লিখতে শুরু করেছিলেন, তবু কারের গবেষণার প্রসঙ্গ আগে তোলা যায়।
কার ছিলেন উদারনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী, এবং দুই মহাযুদ্ধের অন্তর্বর্তীকালের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস নিয়ে তাঁর যে বই, তা সূক্ষ্মভাবে বল্ডউইন ও চেম্বারলেন, দুই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর হিটলার তোষণ নীতির পক্ষ নিয়েছিল, সমালোচকরা এমন কথাও বলেছেন। সে দিক থেকে, কারের রূপান্তর লক্ষ্যণীয়। তিনি রূশ বিপ্লবের ইতিহাস লিখতে চান নি, চেয়েছিলেন সোভিয়েত রাষ্ট্রের ইতিহাস লিখতে। কিন্তু সেকাজ করার জন্য পুরোনো রাষ্ট্র ভেঙ্গে পড়া, বিপ্লব, গৃহযুদ্ধ-পর্ব পেরিয়ে তবেই যেতে হয়। ফলে কারের ১৪ খন্ড বইয়ের মধ্যে চার খন্ড বিপ্লব ও তার অব্যবহিত পরবর্তী যুগের পিছনে ব্যয় করা হল।৩১ কার বিপ্লবের যে ইতিহাস লিখেছেন তা অনেকের তুলনায় সংক্ষিপ্ত, এবং তাঁর বইয়ের পর্যালোচনা করতে গিয়ে রুশ ও সোভিয়েত বিশারদ অধ্যাপক মাইকেল ফ্লোরিনস্কি বলেছিলেন, অনেক উচু থেকে সংক্ষেপে বর্ণনা দেওয়ার গুণ ও দোষ দুটোই তাঁর বইতে আছে। অ-বিশেষজ্ঞ পাঠক কারের বইয়ে মোটামুটি তথ্যনিষ্ঠ রূপরেখা পাবেন বিপ্লবের, কিন্তু সংক্ষেপ করতে গিয়ে অনেক সূক্ষ্মতা, অনেক কঠোর বাস্তব দৃষ্টির অগোচরে চলে গিয়েছে। কিন্তু তা হলেও, কারের ১৪ খণ্ড ইতিহাস সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাস জানতে চাইলে অবশ্যপাঠ্য। তিনি মার্ক্সবাদী ছিলেন না, কিন্তু তার রচনায় সত্যের প্রতি আনুগত্য তাঁর চিন্তায় বিবর্তন ঘটিয়েছিল। কারের প্রথম তিনখণ্ড পর্যালোচনা করে আইজ্যাক ডয়েটশার লিখেছিলেন, কার বিপ্লবী লেনিনকে তাঁর রাষ্ট্র ধ্বংসকারী ভূমিকা সত্ত্বেও ক্ষমা করে দিয়েছিলেন, কারণ রাষ্ট্রনায়ক লেনিন রাষ্ট্র গড়েছিলেন। অর্থাৎ কারের চোখটা ছিল নেতাদের দিকে, সরকারী নীতির দিকে। উদারপন্থী ইতিহাসচর্চার এই অভ্যাস তিনি ছাড়েন নি। কিন্তু তিনি লেনিন বা ত্রৎস্কীকে দানব হিসেবে দেখতে প্রস্তুত ছিলেন না।৩২ এই কারণে ঠান্ডা যুদ্ধবাজ ইতিহাসবিদরা কারকে তীব্র আক্রমণ করেছিলেন। সমস্যাটা একটা উদাহরণের মাধ্যমে বোঝানো যায়। তাঁর বিখ্যাত বই What Is History? তে কার বলেন, সোভিয়েত শিল্পায়ন অবশ্যই কৃষকের উপর প্রবল বোঝা এনে তবেই হতে পেরেছিল। কিন্তু, তিনি প্রশ্ন করেন, কোন শিল্পবিপ্লবে তা হয় নি? প্রশ্নটা দু তরফের কাছেই বিরক্তিকর। প্রাথমিকভাবে ক্ষুব্ধ হলেন পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের প্রবক্তারা – কারণ সোভিয়েত কৃষকের উপর স্তালিনবাদী বর্বরতার সম্পর্কে নিটোল গল্পের মাঝে তাঁদের নিজের দেশের পুরোনো ইতিহাস নিয়ে এই সব বিরক্তিকর প্রশ্ন তাঁরা ভালো চোখে দেখলেন না। কিন্তু ভালো করে পড়লে তাহলে বোঝা যায়, কার স্তালিনীয় শিল্পায়নকে একইভাবে দেখেছিলেন। বুর্জোয়া সমাজে শাসকেরা যেমন ভবিষ্যতের উন্নয়নের জন্য আপাতত খেটে খাওয়া মানুষকেই ত্যাগ স্বীকার করতে বলে, স্তালিনের শিল্পায়নও ভবিষ্যতের ধুয়ো তুলে কৃষকের (এবং শ্রমিকের) উপর অত্যাচার নামিয়ে এনেছিল। যদি প্রভেদ এত কম, তাহলে রাশিয়াতে বুর্জোয়া শ্রেণি না থাকলেও, আমলাতান্ত্রিক শিল্পায়ন কতটা সমাজতান্ত্রিক? প্রশ্নটা কারের নয়, কারণ তিনি উপর থেকে নেতাদের কাজের উপরে জোর দিয়েছেন। কিন্তু তিনি যে তথ্যকে নির্মোহভাবে সাজিয়ে গেছেন, তা প্রশ্ন তোলে, মার্ক্সবাদ যদি শ্রমিক শ্রেণির নিজের দ্বারা নিজের মুক্তির কথাই বলে থাকে, তবে আমলাতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র কি কোনোভাবে সমাজতান্ত্রিক ছিল? কারের এই কষাঘাত আরো তীব্র এই কারণেই, যে তিনি না উগ্র দক্ষিণপন্থী, না ত্রৎস্কীবাদী “অতিবাম” বিরোধী।
আইজ্যাক ডয়েটশারের রচনা সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমে তাঁর সম্পর্কে জানতে হয়। ডয়েটশার ছিলেন পোল্যান্ডের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, এবং বে-আইনী পার্টির পর্বে এক সময়ে পার্টির গোপন পত্রিকার সম্পদক। ১৯৩১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন গিয়ে নিজের চোখে সেখানের পরিস্থিতি দেখেন এবং দেশে ফিরে এসে পার্টিতে দলিল লেখেন, হিটলার ও সোশ্যাল ডেমোক্রেসী যমজ, এই তত্ত্ব ভ্রান্ত, চাই শ্রমিক শ্রেণির যুক্তফ্রন্ট। এজন্য তিনি ও তাঁর কিছু কমরেড পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হন। এরপর তাঁরা আন্তর্জাতিক বামপন্থী বিরোধী জোটের সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু ১৯৩৮ সালের সম্মেলনে যখন ত্রৎস্কী ও তাঁর সমর্থকরা চতুর্থ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন, তখন পোল্যান্ডের প্রতিনিধিরা আপত্তি করেন, কারণ তাঁরা মনে করেন শ্রমিক শ্রেণি এই ঘোষণাতে সাড়া দেবেন না। ১৯৩৯ সালে একটি পোলিশ সংবাদপত্রের চাকরী নিয়ে তিনি লন্ডনে যান। এতে তাঁর প্রাণ বাঁচে, কারণ হিটলার পোল্যান্ড দখলের পর সে দেশের বেশির ভাগ ইহুদী পরবর্তী কয়েক বছরে প্রাণ হারান। ব্রিটেনে কিছুদিন ত্রৎস্কীপন্থী সংগঠন রেভল্যুশনারী ওয়ার্কার্স লীগের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। ১৯৪০ সালে তিনি পোল্যান্ডের ব্রিটেনস্থ সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে চাইলে সরকার তাঁকে বিপজ্জনক কমিউনিস্ট হিসেবে গৃহবন্দী রাখে। এরপ তিনি ইংরেজী প্রবন্ধ লিখে ব্রিটিশ পত্রপত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি সোভিয়েত বিশারদ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। স্তালিনের শাসনকে অপছন্দ করলেও, ত্রৎস্কীবাদীদের সঙ্গে তাঁর মতভেদ বাড়ে, কারণ ত্রৎস্কীবাদীরা মনে করতেন, গণতান্ত্রিক প্রলেতারীয় বিপ্লবের মাধ্যমে আমলাতন্ত্রকে হঠাতে হবে, আর ডয়েটশার মনে করতে থাকলেন, আমলাতান্ত্রিকভাবে হলেও, স্তালিন রাশিয়াতে সমাজতন্ত্রের একটা রকমফের এনেছেন, এবং ভিতর থেকে সংস্কার করে উন্নতি সম্ভব। এই অবস্থান পুরো বোঝা গেল তিনি যখন স্তালিনের জীবনী লিখলেন।৩৩ এই বইয়ে তিনি একদিকে দেখালেন, স্তালিন সম্পর্কে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে যে সব স্তুতি গান প্রকাশিত হচ্ছিল, সেগুলি কি ভীষণ অতিরঞ্জিত, এমনকি সরাসরি মিথ্যা কথায় ভরা। অন্যদিকে, তিনি দাবী করলেন, বর্বর, অনগ্রসর রাশিয়াতে, স্তালিন বর্বরতার সঙ্গে হলেও, সমাজতন্ত্র নির্মাণ করেছেন। এটা ঠান্ডা যুদ্ধের কন্টিনুইটি থিসিস না। এখানে ধারাবাহিকতা ও ছেদ, দুটোই পাওয়া যায়। ত্রৎস্কীর বিশ্লেষণ থেকে কিছুটা নিলেও৩৪ আমলাতন্ত্রের স্ব-সংস্কারের সম্ভাবনাই তিনি বড় করে দেখেন।৩৫
ডয়েটশারের এই দিশা কতটা সঠিক, তা এই প্রবন্ধের বিষয়বস্তু নয়। কিন্তু রুশ বিপ্লবে স্তালিনের ভূমিকা কেমন ছিল, সেই আলোচনা নতুনভাবে করায় তাঁর বই আক্রান্ত হয় সব মহল থেকেই – আমেরিকার দক্ষিণপন্থীদের কাছে, আমেরিকার কমিউনিস্ট পার্টির কাছে, ত্রৎস্কীবাদিদের কাছে, সোশাল ডেমোক্র্যাটদের কাছে। ১৯১৭তেই স্তালিন দানব ছিলেন, একথা ডয়েটশার মানতে রাজী ছিলেন না। অন্যদিকে, মস্কো বিচার-প্রহসনের নিন্দা, পার্টিতে ও দেশে শ্রেণিশত্রু মারার নামে গণহত্যা এসবের নিন্দা করায় স্তালিনবাদীরা কুপিত ছিলেন। কিন্তু ডয়েটশারের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গবেষণা আসে এরপর। তা হল তিনখণ্ডে ত্রৎস্কীর জীবনী।৩৬ প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় ডয়েটশার পাঠককে মনে করিয়ে দেন, তিনি যখন এই গবেষণাতে হাত দিয়েছিলেন, তখন স্তালিন জীবিত এবং সোভিয়েত ও সোভিয়েত প্রভাবিত রচনাতে, অর্থাৎ বামপন্থীদের বড় অংশে প্রতিনিয়ত ত্রৎস্কী সম্পর্কে কুৎসা-অপপ্রচার চলছিল। ডয়েটশারের এই জীবনী ছোট্টো ত্রৎস্কীবাদী মহলের বাইরে ত্রৎস্কীর জীবন ও রুশ এবং আন্তর্জাতিক বিপ্লবী আন্দোলনে তাঁর অবদানের কথা তুলে ধরল। ব্রিটিশ ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিস্টস/ সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টি ধারার সঙ্গে ডয়েটশারের মতভেদ নানাবিধ। এই ধারার অন্যতম প্রসিদ্ধ বুদ্ধিজীবি, নীল ডেভিডসনের মতে, ডয়েটশারের এই তিনখণ্ডের গুরুত্ব হল, ডয়েটশার একটা নরম আশার বাণী শোনাচ্ছিলেন। যখন পাশ্চাত্যে শ্রেণি সংগ্রাম নিম্নগামী (ডেভিডসনের হিসেবে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৯—হিসেবটা স্পষ্ট নয়, হয়তো সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টি ’৯০-এর দশককে ধীরগতি হলেও বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবের সংঘাতের দশক বলে ঘোষণা করেছিল বলে [the ‘30s in slow motion]) তখন কোথাও একটা, কোনো একরকম সমাজতন্ত্র আছে, এটা সান্তনা দিয়েছিল, এই তাঁর মত। কিন্তু ডয়েটশারতো ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৯ তে লেখেননি। তাই ডয়েটশারের নিজের বক্তব্যের দিকে তাকানো জরুরী। ১৯৯০-এর দশক থেকে ত্রৎস্কীর বিভিন্ন জীবনী রচিত হয়েছে। রবার্ট সার্ভিস, আয়ান থ্যাচার এবং জেফ্রি সোয়েন প্রত্যেকেই জীবনী লিখেছেন খানিকটা এই মনোভাব নিয়ে, যে এই একজন কমিউনিস্ট, যার সুনামে কালি পড়েনি, কিন্তু রুশ বিপ্লব সম্পূর্ণ বাতিল করতে গেলে সেটা দরকার। রুশ জেনারেল ও ইয়েলতসিন যুগের একরকম দরবারী ইতিহাসবিদ ভলকোগনভও ত্রৎস্কীর জীবনী লেখেন।৩৭ আমরা যদি এই লেখকদের উদ্দেশ্য দেখি (যা তাঁরা খোলাখুলি ভাবে জাহির করেছেন) তবে বোঝা যায়, ডয়েটশারের কাজ কেন গুরুত্বপূর্ণ ছিল। থ্যাচার এবং সোয়েন তো সরাসরি ডয়েটশারকে আক্রমণ করেছেন। থ্যাচারের মতে, মানুষ ত্রৎস্কীর বদলে ডয়েটশার এক ত্রৎস্কী “মিথ” তৈরী করেছেন। ঐ তিনখণ্ডে আছে কেবল “বীরপূজা”, এবং ত্রৎস্কী কোনো বিষয়েই অন্যদের চেয়ে গভীর চিন্তা করেছিলেন এটা ডয়েটশারের বানানো সন্দেহজনক গল্প। সার্ভিসের গোটা বইটা এক বাক্যে ছোট করে বলা যায় – ত্রৎস্কী ছিলেন নিষ্ঠুর, ঠান্ডা মাথার খুনী, এবং সেটা খুলে দেখাতে হবে। সোয়েনের বইয়ে ত্রৎস্কীর জীবনের কতকগুলি পর্যায় বা ঘটনা নিয়ে আলোচনা খুবই কম, এবং সেটা স্থানাভাবে নয়। ফ্রিডা কাহলোর সঙ্গে ত্রৎস্কীর প্রেম নিয়ে ছাপানো দু-পৃষ্ঠা লেখা গেলেও, ১৯২৩-এর জার্মান বিপ্লবের পরাজয়ের আন্তর্জাতিক তাৎপর্য ও ত্রৎস্কীর দিশা আলোচনা না করে, লেখক বিনা প্রমাণে শুধু বলে দিয়েছেন, ওসব “আসলে” রাশিয়ার ভিতরে আন্তঃপার্টি বিতর্কে ত্রৎস্কীর হাতিয়ারমাত্র।
ডয়েটশারের জীবনীর গুরুত্ব, যখন ত্রৎস্কীকে দেখানো হত প্রতিবিপ্লবী, এবং অনেক সময়ে কখনো জার্মান, কখনো পশ্চিম ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের চর হিসেবে (সোভিয়েত বৈদেশিক নীতির প্রয়োজন অনুযায়ী) তখন তিনি বিপুল তথ্যপ্রমাণ সহযোগে ত্রৎস্কীর কাজ ও চিন্তা প্রকাশ্যে তুলে ধরেন। স্কটল্যান্ডের খনি শ্রমিক নেতা এবং ১৯৫৬ পর্যন্ত ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, লরেন্স ড্যালি লিখেছিলেন, স্তালিন ও ত্রৎস্কী সম্পর্কে ডয়েটশারের বই হাজার হাজার রাজনীতি সচেতন ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী ও শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীকে শ্বাসরোধকারী ছদ্ম-মার্ক্সবাদ থেকে মুক্ত করেছিল।৩৮
প্রথম খণ্ডে ডয়েটশার ত্রৎস্কীর রাজনৈতিক বিবর্তনকে এবং তাঁর চিন্তার বৈশিষ্ট্যগুলিকে তুলে ধরেন। ১৯০৩-এর পার্টি কংগ্রেস, ১৯০৫-এর বিপ্লবে সোভিয়েতের প্রধান নেতা এবং একই সঙ্গে একাধিক পত্রিকা পরিচালনার মাধ্যমে তাঁর ভূমিকা ও জনপ্রিয়তা, নিরন্তর বিপ্লবের তত্ত্ব, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তাঁর আন্তর্জাতিকতাবাদী অবস্থান, ১৯১৭তে তাঁর ভূমিকা, যা পার্টির বাইরে ছিল লেনিনের চেয়ে অনেক প্রকাশ্য এবং জনপ্রিয়, ব্রেস্ট-লিটভস্ক শান্তি আলোচনার প্রকৃত তর্ক কী কী বিষয়ে এবং কাদের মধ্যে ছিল, গৃহযুদ্ধ ও লালফৌজ গঠনে ত্রৎস্কীর ভূমিকা; এবং সেই সঙ্গে ১৯০৩-০৪ এ তাঁর মেনশেভিক উপদলে থাকা, অগাস্ট ব্লক গঠনে তাঁর ভূমিকা, ট্রেড ইউনিয়ন বিতর্কে তাঁর অবস্থান – অর্থাৎ ত্রৎস্কীর সাফল্য ও ব্যর্থতা, কৃতিত্ব ও অগৌরব, এবং সবটা, নিছক ব্যক্তির জীবন হিসেবে না দেখে রুশ বিপ্লবী আন্দোলনের এবং রুশ বিপ্লবের সার্বিক প্রেক্ষাপটে লেখা। দ্বিতীয় খণ্ডে লেনিনের শেষ সংগ্রাম, আন্তঃপার্টি দ্বন্দ্ব, বিশ্ব বিপ্লবের সমস্যা, সমাজতন্ত্র গঠন নিয়ে দ্বন্দ্ব ও সংযুক্ত বিরোধীদের পরাজয় এবং ত্রৎস্কীর আলমা-আটাতে নির্বাসন আলোচিত। সেখানে আবার সমাজতন্ত্র গড়া, বিশ্ববিপ্লব, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও সংস্কৃতির বিষয়ে ত্রৎস্কীর মতামত এসেছে। ত্রৎস্কী নিছক পরাজিত স্তালিন, বামপন্থী বিরোধীদের সঙ্গে প্রলেতারীয় বিকল্পের কোনো সংযোগ ছিল না, ডয়েটশারের দ্বিতীয় খন্ড এই দাবির ভিত্তি ধংস করে দিয়েছিল। একদিকে বেতেলহাইমের মত লেখক, অন্যদিকে যে সব দক্ষিণপন্থীদের উদ্দেশ্য বিপ্লবী মার্ক্সবাদ ও স্তালিনবাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই দেখানো, তাঁদের সকলকেই তাই হয় ডয়েটশারের বই লেখাই হয় নি এমন ভাব দেখাতে হয়, না হলে ডয়েটশারের উপর আক্রমণ নামাতে হয়, যেমন করেছেন থ্যাচার।
ব্যক্তি ত্রৎস্কীর পাশে ডয়েটশারের গবেষণা তুলে ধরল, যে যুগে তা নিয়ে বিশেষ কথা হত না, সেই প্রলেতারীয় গণতন্ত্রের প্রসঙ্গ। ১৯১৭ সালে যে সোভিয়েতরা ছিল প্রাণবন্ত সংগঠন, সেটা ১৯৫৪ সালে তিনি যেভাবে দেখালেন, তখনকার দিনে তা ছিল চমকপ্রদ। কিন্তু ত্রৎস্কীর সঙ্গে ডয়েটশারের পার্থক্যও দেখা যায়। তিনি মহান স্তালিনের জায়গায় মহান ত্রৎস্কীকে বসাতে চান নি, ত্রৎস্কীর ত্রুটিগুলো দেখিয়েছেন, এটা তাঁর অন্যতম শক্তি। কিন্তু তিনি ১৯৪০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে প্রলেতারীয় রাজনীতি থেকে সরে গিয়েছিলেন, এবং তার ফলও তাঁর লেখাতে পাওয়া যায়। শ্রমিক শ্রেণির সংগঠিত লড়াইয়ের সম্পর্কেই তাঁর কিছুটা সন্দেহ জন্মেছিল। তাই গৃহযুদ্ধের শেষে তিনি শ্রমিক শ্রেণির এক সর্বাত্মক incapacity-র কথা বলেন। শ্রেণি যে দুর্বল হয়ে পড়েছিল তা বাস্তব। কিন্তু মৌলিক অক্ষমতার প্রস্তাবনা দেখায়, কেন তিনি স্তালিনের নির্মিত রাশিয়াকে এক রকমের সমাজতন্ত্র বলে মানতে রাজি ছিলেন, যদিও তাঁর লেখায় যথেষ্ট প্রমাণ আছে, ক্লাসিকাল মার্ক্সবাদের সমাজতন্ত্র বিষয়ক চিন্তা সম্পর্কে তিনি ভালই অবহিত ছিলেন।
কার এবং ডয়েটশারের গবেষণা ষাটের দশকে নতুনভাবে, ঠান্ডা যুদ্ধের যুযুধান দুই পক্ষের ছকের বাইরে, নানাভাবে রুশ বিপ্লব নিয়ে ভাবতে শেখালো। ডয়েটশারের কাজের আর একটি সম্ভাব্য গুরুত্ব, এর পর অনেকেই রুশ বিপ্লবের বিভিন্ন চরিত্রের জীবন গবেষণা করেন। রবার্ট টুকার স্তালিনের উপর তথ্যসমৃদ্ধ বই লিখলেন।৩৯ টুকারের ছাত্র স্টিফেন কোহেন নিকোলাই বুখারিনের পূর্ণাঙ্গ জীবনী লিখলেন।৪০ লেনিনকে নিয়ে মার্শেল লিয়েবম্যান বই লিখলেন।৪১ বিপ্লবের বছরগুলির উপর নয়, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথমদিকের ইতিহাসের উপর উল্লেখযোগ্য গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করেন মোশে লেউইন।৪২
মেনশেভিক গবেষণা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত যে সব লেখক নতুন ভাবে গবেষণা করেন, তাঁদের মধ্যে লিওপোল্ড হেমসনের উল্লেখ আগে করেছি। সামাজিক ইতিহাস চর্চা প্রসঙ্গে তাঁর কথায় আবার ফিরে আসতে হবে। এ ছাড়া উল্লেখ করা যায় অ্যালেক্সান্ডার দালিন, ইসরায়েল গেটজলার, এবং আলেক্সান্দর রাবিনোউইচের কথা। গেটজলার মেনশেভিক নেত, মার্তভের একটি সহানুভূতিশীল জীবনী লেখেন।৪৩ প্লেখানভের জীবনী রচনা করেন স্যামুয়েল ব্যারন।৪৪ আর এক গোড়ার দিকের রুশ মার্ক্সবাদী ও পরে মেনশেভিক নেতা, পাভেল আলেক্সরদের জীবনী লেখেন আব্রাহাম অ্যাশার।৪৫ সোশালিস্ট রেভল্যুশানারি দলের ইতিহাস লেখা হয়। এই কাজে প্রধান ভূমিকা ছিল অলিভার র্যাডকির।৪৬ নৈরাষ্ট্রবাদীদের ইতিহাস লেখেন পল আভরিচ।৪৭ অর্থাৎ লেনিন-স্তালিন বনাম শ্রেণি শত্রু, অথবা একদিকে উদারনীতিক গণতন্ত্র অন্যদিকে বলশেভিক ষড়যন্ত্র, এই ছবিটা ভেঙ্গে এক জটিল ছবি সামনে চলে আসতে থাকে। সাধারণ ভাবে এসব বইয়ের লেখকরা ছিলেন নিজেদের বেছে নেওয়া দল বা ব্যক্তি বা রাজনৈতিক ধারার প্রতি সহানুভূতিশীল। তার ফলে স্তালিন যুগের, বা স্তালিন-পরবর্তী যুগেরও, সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসচর্চায় এঁদের যেভাবে এক কথায় পেটি বুর্জোয়া, প্রতিক্রিয়াশীল, ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, তার অবসান ঘটে। বিকল্প বামপন্থী ঘেঁষা দৃষ্টি থেকেই অনেক সময় এঁদের দেখা হয়। কিন্তু সেই কারণেই এই দল ও তাঁদের ব্যক্তিত্বদের অনেকের সীমাবদ্ধতা অনেক জ্বলন্ত ভাবে ধরা পড়ে। ব্যারনের লেখা প্লেখানভের জীবনী থেকে দেখা যায়, প্লেখানভ দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের গোড়ার দিকে এক ভাষণে বলেছিলেন, রুশ বিপ্লব জয়ী হলে তা হবে শ্রমিক শ্রেণির উদ্যোগে। অথচ "বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক" বিপ্লবে বুর্জোয়া শ্রেণির অনিবার্য প্রাধান্যের গোঁড়া ধারণা থেকে প্লেখানভ ১৯০৫এর সময় থেকেই শ্রমিক শ্রেণির "হঠকারিতার" বিরোধী হয়ে পড়েন, এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষকে সমর্থন করে, অবশেষে ১৯১৭ সালে এমন দক্ষিণপন্থী অবস্থান নেন যে মূল মেনশেভিক ধারাও তাঁর থেকে সরে থাকে। অ্যাশারের লেখা আক্সেলরদের জীবনী দুটি কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ । লেনিনের What Is To Be Done? -কে বারে বারে বলা হয়েছিল রুশ মার্ক্সবাদীদের সকলের সাধারণ মত থেকে ভিন্ন। অ্যাশার আক্সেলরদের জীবনী বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেন, বইটি যখন প্রকাশিত হয়, তখন আক্সেলরদ সহ পরে যাঁরা মেনশেভিক হলেন, তাঁরা সকলেই তাঁর সঙ্গে সহমত ছিলেন। অর্থাৎ লেনিন যে দাবী করেছিলেন, What Is To Be Done? ইস্ক্রা গোষ্ঠীর সকলের বক্তব্যই ছিল, লেনিনের সমালোচকের মত অনুসন্ধান করে অ্যাশার সেটাই দেখালেন। অ্যাশার দ্বিতীয় যে তথ্য দেখালেন, তা হল, ১৯০৫-এর বিপ্লবের পরাজয়ের পর আক্সেলরদের নেতৃত্বে মেনশেভিকদের এক বড় অংশ জারের শাসনের মধ্যেই আইনী পথে রাজনীতি করতে চেয়ে ছিলেন। গোপনে পার্টি কমিটি গঠন না করে প্রকাশ্যে শ্রমিক কংগ্রেস করে নতুন পার্টি ছেয়েছিলেন তাঁরা। এখানে তর্কটা নিছক সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে নয়। যে দেশে ট্রেড ইউনিয়নের কমিটিও সরাসরই পুলিশের হস্তক্ষেপ ছিল আইনী, সেখানে নিছক আইনী পথে শ্রমিক দল গড়লে, সেই দল বিপ্লবী রাজনীতি প্রচার বা তাঁর ভিত্তিতে শ্রমিকদের সংগতি করতে পারত না। অর্থাৎ, আবারও, দেখা গেল যে "বিলোপবাদ" (liquidationism) নিয়ে যে বিতর্ক, তাতে লেনিনের বক্তব্যের মধ্যে যথেষ্ট যুক্তি ছিল।
অলিভার র্যাডকি ১৯১৭ সালে সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারী দলের যে ইতিহাস লেখেন, তাতে তিনি দেখান, দলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নেতা ভিক্টর চের্নভ ছিলেন এক গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক, এবং জনপ্রিয় নেতা। কিন্তু, র্যাডকির লেখা পড়লে বারে বারে তাঁর একটা আক্রোশ দেখা যায় - চের্নভ যেন বিপ্লবের নায়ক হতে পারতেন, কিন্তু হলেন না, কারণ তিনি দলের দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে বিতর্ক হলে বেশীদূর লড়াই না করে, নিজের বিশ্বাসের থেকে সরে এসে রফা করতেন। দ্বিতীয়ত র্যাডকি দেখালেন, যে যদিও সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারিদের জন্ম রাশিয়ার নারদনিক ধারা থেকে, অর্থাৎ যাঁরা কৃষক জনতাকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অংশীদার বলেই মনে করতেন, তবু তাঁরা ১৯১৭ সালে মেনশেভিকদের তত্বগত প্রভাব মেনে ঘটমান বিপ্লবে বুর্জোয়া বিপ্লব হিসেবে দেখলেন, এবং এই জন্য ক্যাডেট দলের উপর নিরভ্র করতে থাকলেন। তৃতীয়ত, র্যাডকির গবেষণা থেকে বেরোয় যে সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীদের মূল অংশ বলশেভিকদের ধারাবাহিক ভাবে অবজ্ঞা করেছিলেন, এবং শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে তাঁদের প্রভাব যে ক্রমে মজবুত হচ্ছিল, এমন কি বলশেভিকরা যে সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীদের কৃষি কর্মসূচীকে অনেকটাই আপন করে নিলেন, তার তাৎপর্য বোঝেন নি। র্যাডকির সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হল, ১৯১৭ সালে সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারী দল নামে কৃষকের দল হলেও, তাঁর নেতৃত্ব ছিল বাস্তবে নিছক পেটিবুর্জোয়া (এবং গোঁড়া তত্ত্ববাগীশ) বুদ্ধিজীবীদের দল।
আভরিচের নৈরাষ্ট্রবাদীদের উপর বইগুলি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বহুকাল পরে, তাঁর রচনার ফলে উৎপাদনের উপর শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গটা ফিরে আসে। মরিস ব্রিন্টনের দ্য বলশেভিকস অ্যান্ড ওয়ার্কার্স কন্ট্রোল ৪৮ গ্রন্থে বিষয়টি এলেও, আভরিচ নৈরাষ্ট্রবাদীদের ভূমিকাকে অনেক স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে চান। তিনি ১৯১৭-র পরবর্তী ঘটনাবলিতেও আলোকপাত করেন, যেমন নৈরাষ্ট্রবাদী নীতি অনুসরণ করে স্থানীয় ভিত্তিতে স্বাধীন কমিউন গড়ার চেষ্টা, গৃহযুদ্ধে নৈরাষ্ট্রবাদীদের ভূমিকা, বিভিন্ন নেতৃস্থানীয় নৈরাষ্ট্রবাদীর ভূমিকা, ইত্যাদি। বলশেভিকরা বিপ্লবে একমাত্র বিপ্লবী বা বামপন্থী পক্ষ ছিলেন না, বামপন্থী সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীরা, বা নৈরাষ্ট্রবাদীরাও ছিলেন, এই তথ্য যেমন বাস্তব, তেমন কিন্তু প্রশ্ন উঠে আসতে বাধ্য, তাহলে বলশেভিকরাই কেন শেষ পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেণির, সৈনিকদের, ও অনেকাংশে কৃষকদেরও সমর্থনলাভে সক্ষম হলেন? আলেক্সান্দার রাবিনোউইচ দুটি বইয়ে এর উপর নতুন করে আলোকপাত করলেন।৪৯
রাবিনোউইচের বাবা ইউজিন রাবিনোউইচ ছিলেন রাশিয়া ত্যাগী রুশ গবেষক। আমেরিকাতে তাঁদের বাড়িতে আসতেন কেরেনস্কী, সেরেতেলি, বরিস নিকলাইয়েভস্কি সহ অনেকে, যারা অন্যান্য বিষয়ে তর্ক করলেও, সকলেই একমত ছিলেন যে অক্টোবর বিপ্লব ছিল একান্তই সামরিক ষড়যন্ত্র, কোন সমাজবিপ্লব নয়। প্রথমে শিকাগোতে লিওপোল্ড হেমসনের কাছে, ও পরে ইন্ডিয়ানাতে জন টমসনের কাছে রুশ বিপ্লব নিয়ে তিনি গবেষণা করতে যান।
রাবিনউইচের প্রথম বই প্রিলিউড টু রেভল্যুশন, দেখেছিল "জুলাই দিবস"- এর ঘটনাকে। পেত্রোগ্রাদের বলশেভিকদের সম্পর্কে বিপুল তথ্য সংগ্রহ করে তিনি দেখান, বলশেভিক দল রোবট বাহিনী ছিল না। ১৯৬৮ সালে ইঙ্গ-মার্কিন পণ্ডিত মহলে এ ছিল যথেষ্ট চাঞ্চল্যকর দাবী। তিনি দেখালেন, লেনিন আদৌ চান নি, অস্ত্র হাতে সৈন্য আর শ্রমিকরা পথে নেমে আসুন, কারণ পেত্রোগ্রাদ গোটা রাশিয়া নয়, এবং গোটা রাশিয়া হিসেবে বলশেভিকরা আদৌ সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনের কাছাকাছি ছিলেন না। এই ঘটনাটা ঘটেছিল অনেকটা পার্টির সামরিক কমিটির উদ্যোগে। সোভিয়েত সমালোচকরাও রাবিনোউইচের বই নিয়ে খুশি ছিলেন না। জি.এল. সোবোলেভ বলেন, রাবিনোউইচ কেন্দ্রীয় কমিটি, সামরিক সংগঠন, এবং পিটার্সবুর্গ কমিটি, এই তিনটি নেতৃত্বের মধ্যে বিভাজন ও মতভেদকে তুলে ধরে বাস্তবে পাশ্চাত্যের "অবাস্তব দাবী" ব্যবহার করছেন।
রাবিনোউইচ দেখান, লেনিন রাশিয়াতে ফেরার পর এপ্রিল মাস ধরে তর্ক-বিতর্কের শেষে যে নীতিগত অবস্থান গৃহীত হল, তার মধ্যে কৌশলগত মতভেদের জায়গা যথেষ্ট ছিল, এবং অপেক্ষাকৃত নরমপন্থী ও অপেক্ষাকৃত উগ্রপন্থী, নানা কৌশল প্রস্তাবিত হতে থাকে। এই পরিবেশে, ১০ই জুন বলশেভিকরা একটা বড় শ্রমিক মিছিল ডাকার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রথম সারা রাশিয়া সোভিয়েত কংগ্রেসে মেনশেভিক-সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারী নেতৃত্বের প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং ঐ মিছিল বাতিল করতে হয়। সোভিয়েতের নেতারা এরপর নিজেদের পিছনে কত শ্রমিক সমর্থন আছে দেখাতে চেয়ে ১৮ জুন একটা মিছিল ডাকেন। কিন্তু বলশেভিকদের সাফল্য হয় এবং যে ৪ লক্ষাধিক শ্রমিক ও সৈনিক মিছিলে আসেন, তাঁদের অধিকাংশের হাতে ছিল বলশেভিকদের প্রস্তাবিত স্লোগান লেখা পোস্টার ও ব্যানার- "সোভিয়েতদের হাতে সব ক্ষমতা", এবং "দশজন পুঁজিবাদী মন্ত্রী নিপাত যাক"।
জুলাইয়ের গোড়ায় অস্থায়ী সরকার নতুন উদ্যমে যুদ্ধ চালাবার উদ্যোগ নেয়। বলশেভিকরা এর বিরুদ্ধে প্রচার তীব্র করেন। ৩-৪ জুলাই রাজধানীতে সশস্ত্র প্রতিবাদ ফেটে পড়ে। সৈন্য ও শ্রমিকরা বলশেভিক দলের সদর দপ্তরে জমায়েত হয়। তাঁদের উদ্দ্যেশ্য ছিল দলের নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকারকে উচ্ছেদ করা। রাবিনোউইচ দেখিয়েছেন, লেনিন অভ্যুত্থান চান নি, এবং সশস্ত্র মিছিল করার আহবানও মেনে নিয়েছিলেন চাপে পড়ে। দ্য বলশেভিক কাম টু পাওয়ার, রাবিনোউইচের দ্বিতীয় বই, দেখাল, বলশেভিকরা স্বয়ংসম্পূর্ণ দল হিসেবে কাজ করতেন না, বরং প্রথমত, দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব (যার অর্থ একা লেনিন না, বরং এক বিভক্ত কেন্দ্রীয় কমিটি) কাজ করতেন মধ্যে স্তরের কর্মী ও নেতাদের সঙ্গে এবং তাঁরা আবার ফ্যাক্টরী স্তর পর্যন্ত শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলতেন। দ্বিতীয়ত, ত্রৎস্কীর গবেষণা যেখানে শ্রেণি ও দলের পারস্পরিক সম্পর্কের উপর জোর দিয়েছিল, রাবিনোউইচ তার সঙ্গে আনলেন বামপন্থী সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারী এবং মেনশেভিক আন্তর্জাতিকতাবাদী, এই দুই দলের সঙ্গে বলশেভিক সম্পর্কের ইতিহাস। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বের মেনশেভিক আন্তর্জাতিকতাবাদীরা বিভিন্ন সময়ে বলশেভিকদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন। কিন্তু এই বিভিন্ন মৈত্রী ভাঙ্গাগড়ার ইতিহাস এতটা দক্ষভাবে আগে কেউ দেখান নি।
সামাজিক ইতিহাস - নতুন দিশা, চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা
রাবিনোউইচের দ্বিতীয় বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে। ইতিমধ্যে নতুন একটি ধারা জন্ম নিয়েছে। তা হল রাজনৈতিক ইতিহাসকে সরিয়ে রেখে সামাজিক ইতিহাস লেখার প্রবণতা। ১৯৬০-এর দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে আমেরিকায় এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নতুন ধরণের সামাজিক আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে- মার্টিন লুথার কিং-এর নেতৃত্বে কালো মানুষের সমতার লড়াই, ও তার মধ্যে ম্যালকম এক্স প্রমুখের জঙ্গী ধারা, নারীবাদী আন্দোলন; ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলন; দেশে দেশে ছাত্র আন্দোলন; এবং এদের মধ্য থেকে, এক নতুন ধরণের বামপন্থা। এক কথায় তাকে "নিউ লেফট" বলা হত। কিন্তু এর মধ্যে সকলে বিপ্লবী বামপন্থী না, সকলে মার্কসবাদীও না। তবে গবেষণার ক্ষেত্রে এদের কতকগুলি প্রভাব পড়ে। শ্রেণি, লিঙ্গ, জাতি, এই বড় বড় সামাজিক স্তরগুলিকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা নতুন করে উঠল। অ্যামেরিকান হিস্টোরিকাল রিভিউ নামের প্রসিদ্ধ পত্রিকায় রোনাল্ড গ্রিগর সানি একটি প্রবন্ধ লেখেন, 'টুওয়ার্ড আ সোশ্যাল হিস্ট্রি অফ দ্য অক্টোবর রেভল্যুশন'। এই ধারাতে পড়েন অনেকে -- সানি নিজে, ভিক্টোরিয়া বনেল, রোস গ্লিকম্যান, স্টিভ স্মিথ, ডায়ান কোয়েনকার, ডোনাল্ড র্যালে, রেক্স ওয়েড , ডেভিড ম্যান্ডেল, এমন কি পূর্ববর্তী যুগের ইতিহাসবিদ লিওপোল্ড হেমসন।৫০
সামাজিক ইতিহাসের গুরুত্ব হল, মহামানব ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক ইতিহাস থেকে বিপ্লবের বর্ণনা ও বিশ্লেষণকে আবার ফিরিয়ে আনা ব্যাপক মানুষের মধ্যে। “মূলস্রোতের” মার্কসবাদী ইতিহাস চর্চা যেহেতু ত্রৎস্কীকে অনেকটাই এড়িয়ে গিয়েছিল, তাই এই কাজে মার্কসবাদীদের উপর বড় প্রভাব ছিল সপ্তদশ শতকের ইংল্যান্ডের বিপ্লবের কোনো কোনো ইতিহাসবিদের - যেমন ক্রিস্টোফার হিল, ব্রায়ান ম্যানিং, দানিয়েল গের্যাঁ, আলবের সবুল বা জর্জ রুডের প্রভাব। কিন্তু সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, বিশেষ করে রুশ বিপ্লব চর্চার ক্ষেত্রে পার্টি ও নেতা সর্বস্ব ইতিহাসকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা। এখানে অগ্রগতি এবং সমস্যার এক দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক তৈরী হয়। প্রতিটি বই, প্রতিটি প্রবন্ধের প্রতি আমরা সমান নজর দিতে পারব না। কিন্তু কয়েকটি রচনার দিকে তাকালেই অগ্রগতির চরিত্র বোঝা যাবে। বনেল, ওয়েড, স্মিথ, ম্যান্ডেল, কোয়েনকার, এঁরা সকলেই গবেষণা করেছিলেন শ্রমিক শ্রেণিকে নিয়ে। স্মিথ ও ম্যান্ডেলের বিষয়বস্তু ছিল রাজধানী পেত্রোগ্রাদের শ্রমিক শ্রেণি। কিন্তু কোয়েনকার মস্কোর শ্রমিকদের দেখতে চাইলেন।
মস্কোর শিল্পায়ন কোথায় ভিন্ন, তার ফলে শ্রেণির গঠনে কেমন ভিন্নটা এসেছিল? শ্রেণি সংগ্রামে কি মস্কো নিছক রাজধানীর পিছনে পিছনে হেঁটেছিল, না তার নিজস্বতা ছিল? এই প্রশ্নগুলি তুলে কোয়েনকার দেখালেন, বিপ্লবের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসের জন্য চাই অন্যান্য বড় শিল্পনগরীগুলির শ্রেণি বিন্যাস ও শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। তিনি এবং রোসেনবার্গ যৌথভাবে গবেষণা করে কয়েকশ ধর্মঘটের চরিত্র বিশ্লেষণ করলেন, দেখালেন ধর্মঘটের গবেষণা থেকে তলা থেকে শ্রমিক শ্রেণির মানসিকতা পরিবর্তনের ইতিহাস কীভাবে লেখা যায়।৫১
স্মিথ এবং ম্যান্ডেল দু'জনেই পেত্রোগ্রাদের ওয়ার্কার্স কন্ট্রোল আন্দোলন, অর্থাৎ ফ্যাক্টরী স্তরে কমিটি গড়া, উৎপাদন একা মালিক স্থির করবে না শ্রমিকরা মালিকের কাজের উপর নজর রাখবে, সেই কাজ শ্রেণি সমঝোতা কি না, কিভাবে আনা হবে, এই লড়াইগুলির দিকে মানুষ, যাঁদের নিয়ে এতদিন খুব একটা কথা বলা হত না। পার্টির নেতাদের দিকে তাকালেও, লেনিন, ত্রৎস্কী, কামনেভ, এমন কি শ্লিয়াপনিকভের নাম আসে না, আসে বলশেভিক এভডোকিমভ, স্ক্রিপনিক, নৈরাষ্ট্রবাদী বিভিন্ন কর্মীর নাম, এবং বামপন্থী মেনশেভিকদের কিছু ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী ও গোর্কির মতো বাম-মেনশেভিক বুদ্ধিজীবীর নাম।
তার চেয়েও বড় কথা, এই গবেষণা দেখাল, শ্রেণি সংগ্রাম কেবল রাজনৈতিক স্তরে ঘটেনি, বরং ফেব্রুয়ারীর পর থেকেই শ্রমিকরা প্রথমে চায় নিয়মিত কাজ, আট ঘণ্টা শ্রমদিবস, ফ্যাক্টরীতে ফোরম্যানদের অত্যাচার বন্ধ। কিন্তু মালিকরা এতেও দেখে তাঁদের অধিকারে শ্রমিকদের অনধিকার চর্চা। আবার জেনারাল কর্নিলভের অভ্যুত্থানের পরাজয়ের পর, বুর্জোয়া শ্রেণি মনে করেছিল সম্পত্তির মালিকানা ও উৎপাদনের উপর নিয়ন্ত্রণ তাদের শেষ অস্ত্র। তাই সেপ্টেম্বর মাসে ফ্যাক্টরী স্তরে শ্রেণি সংগ্রাম তীব্রতর হয়, এবং সেটা আবার শ্রমিকদের চরমপন্থি সমাধানের দিকে ঠেলে দেয়। সুতরাং নিছক লেনিনের প্রবন্ধ, ত্রৎস্কী – ভোলোদারস্কি - কোলোনতাইদের বাগ্মিতা, এ সব নয়, সোভিয়েতের মধ্যে লড়াইও শুধু নয়, অর্থনীতিক স্তরে শ্রেণি সংগ্রামও বলশেভিকদের হাত শক্ত করেছিল।
ডোনাল্ড র্যালে, রোনাল্ড সানি, প্রমুখের গবেষণা কৃষকের লড়াই, সংখ্যালঘু জাতিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াই, এই সব বিপ্লবী আন্দোলনকে কেবল পেত্রোগ্রাদের "মূল" লড়াইয়ের পাদটীকা থেকে উদ্ধার করে তাদের নিজেদের গুরুত্ব দেখায়।
অন্য ধরণের তাৎপর্য রয়েছে প্রাক-১৯১৭ যুগের সামাজিক ইতিহাস চর্চার। ভিক্টোরিয়া বনেলের সুবৃহৎ গবেষণা তুলে ধরল কীভাবে শ্রমিক শ্রেণির শ্রেণি সংগ্রামে, ট্রেড ইউনিয়ন গড়া ও গোপন পার্টির আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে বিতর্কে, শ্রমিকদের তাৎক্ষনিক সমস্যার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী বিপ্লবী রণকৌশলের লড়াই থেকে বলশেভিক উপগোষ্ঠী ক্রমে বলশেভিক দল হওয়ার দিকে এগোলো। তাতে দেখা যায়, তর্কমূলক প্রবন্ধ লেনিন যে ভাবে বিলোপবাদী, বিপ্লবী আর হঠকারী, এই তিন ভাগে পার্টি সদস্যদের বিভক্ত করেছিলেন, তা ছিল বেশ কিছুটা সরলীকরণ। বলশেভিক উপদলের মধ্যেই অনেকে ছিলেন, যাঁরা লেনিনের অবস্থানের সঙ্গে পুরো একমত ছিলেন না। এবং তাঁদের মতকে গুরুত্ব দিয়ে, গোপন পার্টি আর প্রকাশ্যে কর্মীর মধ্যে সমতা রক্ষার কথা মেনে নিয়ে, তবেই লেনিন-জিনভিয়েভরা বলশেভিক প্রাধান্য আনতে পেরেছিলেন।
কিন্তু সামাজিক ইতিহাস রচনা যাঁরা করতে গেলেন, তাঁদের এক বড় অংশের মধ্যে প্রবণতা দেখা দিল, রাজনৈতিক ইতিহাসকে সামাজিক ইতিহাস থেকে সরিয়ে রাখার, বা সামাজিক ইতিহাস থেকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তদের যান্ত্রিকভাবে সামাজিক ইতিহাস প্রসূত বলে দেখানর। এটা সবচেয়ে উৎকটভাবে দেখান জে আর্চ গেটি, স্তালিন যুগের অত্যাচার, ব্যাপক হত্যা, সমস্ত কিছুকে সামাজিক উৎস দিয়ে ব্যাখ্যা করে।৫২
গেটি, বা শিলা ফিটজপ্যান্ট্রিক, বা কিছুটা অর্ল্যান্ডো ফাইজেস, বলতে চেয়েছেন যে রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক সামাজিক অনুশীলন তার সঙ্গে যুক্ত যে দমনপীড়ন, তা বলশেভিকদের অসহিষ্ণুতার ঐতিহ্য, এবং শ্রমিক শ্রেণির বা বিপ্লবী রাজনীতির সন্দেহবাতিক, হিংসা, ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত।৫৩
রুশ শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে থেকে উঠে আসা বিপ্লবীদের বাস্তব চরিত্র অসহিষ্ণু, বা সন্দেহবাতিকগ্রস্থ, বা হিংস্র কি না তার জন্য আলেকসান্দর শ্লিয়াপনিকভ, সেমিওন কানাৎচিকভ ও অন্য বেশ কিছু শ্রমিক বলশেভিকের জীবনী এবং আত্মজীবনী আছে। শ্লিয়াপনিকভের সাম্প্রতিক জীবনীকার দেখাতে চেয়েছেন, শ্লিয়াপনিকভ যথেষ্ট স্বাধীনচেতা ছিলেন, এবং লেনিনের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে তাঁর মতভেদ ছিল।৫৪ এই শ্রমিক বলশেভিকরা ছিলেন বলেই বলশেভিক দল ১৯১৭ সালে মেনশেভিকদের মত বুদ্ধিজীবীসর্বস্ব দল হয়নি, বরং প্রলেতারীয় দল হিসেবে দানা বেঁধেছিল।
কিন্তু যে প্রশ্নটা ১৯১৭-এর ক্ষেত্রেও জরুরী, এবং, যেখানে সামাজিক ইতিহাসের প্রবক্তাদের বড় অংশের সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট , তা হল, শ্রমিক শ্রেণি কেন জঙ্গি হল, এই ব্যাখ্যা থেকে অক্টোবর অভ্যুত্থান কেন হল, সেখানে পৌঁছন যায় না। সামাজিক এবং রাজনৈতিক, দুই স্তরের মধ্যে মধ্যস্থতা চাই, এবং রাজনৈতিক দলদের ইতিহাস ফিরিয়ে না আনলে তা সম্ভব নয়। অবশ্যই, বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে রয়েছে এক শোষণমূলক সামাজিক, অর্থনীতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যা দেশের ব্যাপক মানুষের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল। এই ব্যাপক মানুষের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল শ্রমিক শ্রেণি যারা সংখ্যায় অপেক্ষাকৃত ছোটো, কিন্তু যারা গতিশীল, এবং যাদের অবস্থান এমন, যে তাঁদের পক্ষে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা নেওয়া সম্ভব। তাদের মধ্যে সচেতন, সক্রিয় যারা, তারা ট্রেড ইউনিয়ন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সোভিয়েত, ফ্যাক্টরী কমিটি, শ্রমিকদের সশস্ত্র বাহিনী (মিলিশিয়া) ইত্যাদিতে সংগঠিত করেছিল। এর মধ্যে একটি সচেতন বিপ্লবী ধারা ছিল, যারা মার্ক্সবাদী এবং যাদের মধ্যে ছিলেন এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তিত্ব, যাঁরা তত্ত্বগত ভাবে, সাংগঠনিক ভাবে ও রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম ছিলেন। ডেভিড ম্যান্ডেল ছাড়া, সামাজিক ইতিহাস রচয়িতা ধারার এক বড় অংশ এই যোগসূত্র দেখাতে ব্যর্থ হন।
ক্ষমতা দখল ছাড়া, কোন সমাজ বিপ্লব সম্ভব নয়। একটা গোটা শ্রেণি যখন ক্ষমতা দখল করে, তখন তাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন থাকে। বুর্জোয়া রাজনীতির উত্থানের সময় থেকে রাজনৈতিক দল এমন এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। অবশ্যই, রাজনৈতিক দল একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নয়। শুধু সামাজিক ইতিহাসবিদরা না, জন রীড থেকে রাবিনোউইচ, অনেকেই সোভিয়েত এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানদের কথাও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলি নানা কারণে কেন্দ্রীয় ছিল। তিনটি বড় ও একটি ছোটো শ্রমিক দল (বলশেভিক, মেনশেভিক, সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারী ও অন্য) প্রায় সব রকম প্রতিষ্ঠান (সোভিয়েত, ফ্যাক্টরী কমিটি, ট্রেড ইউনিয়ন, রেড গার্ড, কৃষক কমিটি, ফৌজি কমিটি) উপস্থিত ছিল। তাই একদিকে, রাজনৈতিক দলের মধ্যে এই সবরকম প্রতিষ্ঠানে ঘটে চলা চিন্তা ও সিদ্ধান্ত চলে আসছিল। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দলের পক্ষে এই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এক জায়গায় আনা যতটা সহজ ছিল, অন্য কারো পক্ষে তা ছিল না। তাই নিছক একাধিক দলের মধ্যে মল্লযুদ্ধ নয়, ১৯১৭-র ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর যা ঘটেছিল, তা হল নিপীড়িত, শোষিত শ্রেণি ও জনগোষ্ঠীদের জাগরণ, তাঁদের নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন নিরমান। কিন্তু বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি এই প্রক্রিয়ার বাইরে ছিল না। বরং এই দলগুলি ছিল ঐ নিপীড়িত, শোষিত মানুষের সবচেয়ে পুরনো সংগঠন। ফেব্রুয়ারী থেকে, বিশেষত এপ্রিলে লেনিন ফেরার পর থেকে, ঐ দলগুলির মধ্যে যে সংঘাত, তা সামাজিক স্তরে ঘটেছিল, শ্রমিক-কৃষক-সৈনিক-নিপীড়িত জাতিদের সংগঠনগুলির মধ্যেই ঘটেছিল। এই কারণে, দলীয় রাজনৈতিক মধ্যস্থতাকে না বুঝলে, দল চাই না, "স্বাধীন" শ্রেণি সংগঠন-ই যথেষ্ট , এই স্লোগান বাস্তবে শ্রেণি সংগ্রামকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে বাধা-ই দেয়।
নারী শ্রমিকদের সংগ্রাম -
সামাজিক ইতিহাসের এক স্বতন্ত্র ধারা হল নারীবাদ প্রভাবিত গবেষণা। রুশ বিপ্লবের ইতিহাস রচনায় এই ধারা নানাভাবে এসেছে, বিশেষত ১৯৮০-র দশক থেকে। প্রথম আসে রুশ সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে নারীবাদের প্রভাব এবং নারী সমতার লড়াইকে কেন্দ্র করে গবেষণা। এরপর আসে কিছু জীবনী রচনা। কিন্তু সেই সঙ্গে, বিপ্লবী দলগুলির সঙ্গে নারী লড়াই, এই প্রসঙ্গগুলিও আসতে থাকে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয় মার্ক্সবাদী মহলে নারীবাদ নিয়ে বিতর্ক। রুশপন্থী স্তালিনবাদী, মাওবাদী, এবং বেশ কিছু ত্রৎস্কীবাদী ধারা নারীবাদকে এক কোথায় পেটি বুর্জোয়া বলে প্রত্যাখ্যান করতে চেষ্টা করেছিলেন, বিশেষত ১৯৬০-এর এবং ১৯৭০-এর দশকে। রুশ বিপ্লব চর্চাতেও তার প্রভাব পড়েছিল। ১৯১৭ সালে পেত্রোগ্রাদের শ্রমিক শ্রেণির ৪০ শতাংশের বেশী ছিলেন নারী শ্রমিক। ফেব্রুয়ারী বিপ্লব আরম্ভ হয়েছিল আন্তর্জাতিক নারী শ্রমিক দিবসে নারী শ্রমিকদের বলশেভিকদের ভাইবর্গ জেলা কমিটির জঙ্গি নেতা কায়ুরভের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে ধর্মঘট আরম্ভ করলে। অথচ ত্রৎস্কীর দীর্ঘ ইতিহাসেও নারী শ্রমিকদের সম্পর্কে খুব একটা আলোচনা নেই। ২০১৬-র শেষে প্রকাশিত একটি বইয়ে পল লে ব্লাঙ্ক ইতিহাসচর্চার উপর যে আলোচনা করেছেন, তাতে একরকম ছবি পাওয়া যায়, যা তাৎপর্যপূর্ণ।৫৫ তিনি দেখিয়েছেন এমন বহু মার্ক্সবাদী ছিলেন (বলশেভিকদের মধ্যেও ছিলেন) যাঁরা সরলীকরণ করে, সংকীর্ণতাবাদী অবস্থান নিয়ে বলতেন, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করবে শ্রমিক শ্রেণি। সেটা সবরকম খারাপ জিনিসকে শেষ করে দেবে। তার মধ্যে পড়বে নারী শোষণও। তাই এর আগে স্বতন্ত্র লড়াই শ্রমিকদের বিভক্ত করবে, শ্রেণি সংগ্রাম থেকে তাঁদের সরিয়ে দেবে, এবং প্রাথমিক কাজ, অর্থাৎ ধনতন্ত্র উচ্ছেদের লড়াইকে দুর্বল করবে। লে ব্লাঙ্কের তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, "এই যুক্তি পুরুষ (...) শ্রমিক ও কমরেডদের মধ্যে অস্বস্তি সৃজন না করার জন্য, এবং নারীদের 'তাদের যথাযথ জায়গায়' রাখার জন্য সুবিধাজনক হত।৫৬
কিন্তু প্রশ্ন হল, মেয়েরা তাহলে বলশেভিকদের দিকে এসেছিলেন না আসেন নি, আর এসে থাকলে স্বতন্ত্র নারী অধিকারের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন না তোলেন নি? বড় বড় ফ্যাক্টরী থেকে মেয়েদের ভোটে যখন বলশেভিক প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে সোভিয়েত বা ফ্যাক্টরী কমিটিতে আসেন, ট্রেড ইউনিয়নে যখন হাজার হাজার, এবং ক্রমে আরো বেশী নারী শ্রমিক যোগ দেন, এবং ট্রেড ইউনিয়নেও যখন ক্রমে বলশেভিক প্রাধান্য বাড়তে থাকে, তখন বলশেভিকরা কিছু করেন নি, এমন ভাবা কঠিন। কিন্তু তাঁরা ঠিক কি করেছিলেন?
নারীবাদ প্রভাবিত ইতিহাসচর্চার ভিত্তিতে রুশ বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম প্রথম কাজ রিচার্ড স্টাইটসের।৫৭ একই সময়ে আসে গেইল ল্যাপিডাসের বই, যার মূল বিষয় ছিল সোভিয়েত সমাজে মেয়েরা, কিন্তু যাতে প্রাক-বিপ্লব সমাজও আলোচিত ছিল।৫৮রোজ গ্লিকম্যানের গবেষণা দেখাল, প্রাক-বিপ্লব রাশিয়ার নারী-শ্রমিকের বাস্তব জীবন কেমন ছিল, তাঁদের যে পার্টি কর্মীরা এক কথায় পিছিয়ে পড়া বলে অবহেলা করতেন, তার পিছনে থাকা সামাজিক বাস্তবতার চরিত্র কি ছিল। বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বিপ্লবী দল, বিশেষত লেনিনবাদী বিপ্লবী দল, “অগ্রণী শ্রমিকদের” সংগঠন, মার্ক্সবাদী রাজনৈতিক কর্মী এবং মার্ক্সবাদী ইতিহাসবিদ উভয়েই এইভাবে দেখতে অভ্যস্ত। মেয়েরা “পিছিয়ে পড়া”, এটা যদি স্বতঃসিদ্ধ হয়, তাহলে পার্টি কেন মেয়েদের দলে টানতে বেশী সচেষ্ট ছিল না, বা কর্মসূচীর যথেষ্ট লিঙ্গায়ন হয়েছিল কি না, মেয়েরা কেন নেতৃত্ব ওঠেন নি, এই সব প্রশ্ন অবান্তর বলে ধরে নেওয়া যায় সেক্ষেত্রে। সামাজিক ইতিহাস এই ক্ষেত্রে কিছু প্রশ্ন, কিছু সন্দেহ জাগিয়ে তোলে। কিন্ত অমার্ক্সবাদী নারীবাদ এর পুরো ব্যাখ্যা দেয় নি। অন্যদিকে নারীবাদ বিরোধী মার্ক্সবাদীদের রচনা নতুন সমস্যার জন্ম দেয়।
ইংরেজীভাষী জগতে ১৯৮০র দশক থেকে একবিংশ শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল ছিল ব্রিটীর সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টি। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা ও কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন টোনি ক্লিফ (ইগায়েল গ্লুকস্টাইন)। ক্লাস স্টাগল অ্যান্ড উইমেন্স লিবারেশন নামে তিনি যে বইটি লেখেন তাতে জার্মানীতে ক্লারা জেটকিনদের রাজনীতি এবং রাশিয়াতে বলশেভিকদের রাজনীতির এক অপব্যাখ্যার মাধ্যমে তিনি দেখাতে চাইলেন, বিপ্লবী মার্ক্সবাদী রাজনীতির অর্থ নিরন্তর নারীবাদ বিরোধিতা। ৫৯
ক্লিফের সমস্ত অতিসরলীকরণ, ও ফলতঃ কোনো কোনো ক্ষেত্রে কার্যত তথ্য বিকৃতি, এখানে আলোচনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু মৌলিক ক্ষেত্রেও তাঁর বক্তব্যে যে অতিসরলীকরণ ও বিকৃতি ছিল, তাঁর একটি নজীর দেব। ক্লিফ লিখছেন, সমান কাজে সমান মজুরীর ক্ষেত্রে, "বলশেভিকরা অসম মজুরীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।"৬০ প্রমাণ স্বরূপ তিনি ৫ মে ১৯১৭তে প্রাভদাতে প্রকাশিত আলেকজান্দ্রা কোলোনতাইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের উল্লেখ করেছেন। কিছু ১৯০৩ সালের পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত কর্মসূচীতে সমান কাজে সমান কাজে সমান মজুরীর দাবী ছিল না। আর তাই, ১৯১৭ সালে, যখন একজন নারীবাদী মার্ক্সবাদী বলশেভিক দলের নেতৃস্থানীয় সদস্য হলেন, তখনই এই দাবী উঠতে পারল। অর্ধসত্য এইভাবে সত্যের বিকৃতি ঘটায়।
উপরন্তু, মার্ক্সবাদী-নারীবাদী গবেষণা দেখায়, ১৯১৭ সালে, যে সব প্রতিষ্ঠানে বলশেভিকদের প্রাধান্য ছিল, সেখানেও লিঙ্গ সমতার লড়াই ছিল কঠিন, অনেক সময়ে সীমাবদ্ধ। কিন্তু তাঁরা একই সঙ্গে দেখিয়েছেন, বলশেভিকরা অন্য যে কোনো দলের চেয়ে মেয়েদের অধিকারের জন্য বেশী লড়াই করেছিলেন। অর্থাৎ, বলশেভিকদের তত্বগত সীমাবদ্ধতা ছিল, কিন্তু বলশেভিকরা, বিশেষত বলশেভিক মেয়েরা, যতটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তা অন্য শ্রমিক দলগুলি নেয় নি।৬১
ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে সমস্যাটা অনেকাংশে পার্টিদের কাজের সমস্যার মতই। মেয়েদের বিষয়গুলি "বিশেষ" সমস্যার অঙ্গ, আর "সাধারণ" কর্মসূচী, দাবী, বা "সার্বিক শ্রেণি সংগ্রাম"-এর দিশা বারে বারে নির্ধারিত হয়েছে পুরুষের দৃষ্টিকোণকে "সার্বিক", বা "সাধারণ" মনে করে, শ্রমিক দলদের, এমন কি বলশেভিকদের ইতিহাসে এটা ঘটেছে। অনেকটা একই ভাবে, রুশ বিপ্লবের "সাধারণ" ইতিহাসে লিঙ্গবৈষম্য এবং শ্রেণি ও লিঙ্গের পারস্পরিক সম্পর্কও, আলোচনা করা হয়েছে খুবই কম। ত্রৎস্কী থেকে রাবিনোউইচ, অথবা ক্লিফ, আর্নেস্ট ম্যান্ডেল বা পল লে ব্ল্যাঙ্ক (লে ব্ল্যাঙ্কের বই পরে আলোচিত হবে) কেউই তাদের রুশ বিপ্লব বিষয়ক মূল বইগুলিতে নারী শ্রমিকদের প্রসঙ্গ সেরকম কেন্দ্রীয়ভাবে টানেন নি।৬২ মার্ক্সবাদী-নারীবাদীরা "সাধারণ" ইতিহাস লিখলে, তবেই শ্রেণি ও লিঙ্গের অন্তঃসম্পর্ক, এবং কিভাবে নারী শ্রমিকদের লড়াই পুঁজিপতির শোষণের মোকাবিলা করতে পাশাপাশি লিঙ্গভিত্তিক অসাম্যকে লড়তে চেয়েছে, তাঁর সামাজিক- অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করতে পেরেছে। সোমা মারিকের বই ও প্রবন্ধে এর বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায়।৬৩ জার্মানি সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক দলে নারীমুক্তির সংগ্রাম সম্পর্কে আলোচনায় একই সঙ্গে মারিয়া মিয়েজের মত মার্কসবাদের সমালোচকদের সঙ্গে তর্ক আর অন্যদিকে টোনি ক্লিফের লিঙ্গ বিষয়ে অন্ধতা (যা কার্যত মেয়েদের অসাম্যকে 'ওটুকু তো হয়েই থাকে' গোছের বক্তব্যে পরিণত হয়), তাঁর সঙ্গেও তর্ক করা হয়েছে।৬৪ রুশ বিপ্লব প্রসঙ্গে একগুচ্ছ প্রবন্ধ ও উপরে উল্লিখিত বইয়ে দেখানো হয়েছে, বলশেভিকদের মধ্যে যেমন অনগ্রসরতা ছিল, তেমনি ছিল বলশেভিক মেয়েদের লড়াই, যে লড়াইয়ে পুরুষদেরও একাংশের সমর্থন ছিল, এবং তার ফলেই ১৯১৭ সালে পার্টির সঙ্গে শ্রেণির যে দ্বান্দিক সম্পর্ক, তার অংশও হয় নারী শ্রমিকের সংগ্রাম। তবে এটাও লক্ষণীয়, যে গবেষণা দেখাছে, বলশেভিক মেয়েরা অনেকেই ছিলেন জঙ্গি এবং দলের বামপন্থী অংশের অন্তর্ভুক্ত। ভেরা স্লুৎস্কায়া ১৯১৭তে প্রথম নারী শ্রমিকদের ও অন্য নিপীড়িত মেয়েদের দলে টানার জন্য স্বতন্ত্র সংগঠনের প্রস্তাব করেছিলেন, তিনি ছিলেন অক্টোবর বিপ্লবের পর পরই প্রতিবিপ্লবী সামরিক আক্রমণ প্রতিরোধে পুলকোভা হাইটসের যুদ্ধের অন্যতম শহীদ। আলেকজান্দ্রা কোলোনতাই ছিলেন আন্তঃ-পার্টি বিতর্কে লেনিনের অন্যতম প্রথম সমর্থক।
আবার কোলোনতাই, কঙ্করদিয়া স্যামইলোভা ও অন্যরা মিলে নতুন উদ্যমে নারী শ্রমিকদের জন্য পার্টির স্বতন্ত্র পত্রিকা 'রাবোৎনিসা' প্রকাশ আরম্ভ করেন। এই পত্রিকাকে ঘিরেই পার্টিতে নারী শ্রমিকদের টানার চেষ্টা বারে। বলশেভিক মেয়েদের উদ্যোগে, ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের পরবর্তী কালের প্রথম ধর্মঘট শুরু করেন পেত্রোগ্রাদের লন্ড্রিগুলিতে কর্মরতা কয়েক হাজার মেয়ে।৬৫ মস্কোতে লেনিনের আর এক ঘনিষ্ঠ সমর্থক ইনেসা আরমান্দের নেতৃত্বে আর একটি মেয়েদের জন্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
এই প্রসঙ্গেই বলা জরুরি, ১৯৭০-এর দশক থেকে, নারীবাদী আন্দোলনের প্রভাবেই, বলশেভিক (এবং অন্য) নারী রাজনৈতিক কর্মীদের জীবনী রচনা আরম্ভ হয়, যদিও তাদের সবগুলি নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রচিত নয়। আলেকজান্দ্রা কোলোনতাইয়ের অন্তত তিনটি ইংরেজি জীবনী প্রকাশিত হয়।৬৬ ইনেসা আর্মান্দ অবশেষে ইতিহাসের নিছক পাদটীকা, এবং লেনিনের অনুবাদক, ও (হয়ত) ঘনিষ্ঠ বান্ধবী থেকে নিজে একজন কমিউনিস্ট বিপ্লবী এবং নারীবাদী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। বার্ট্রাম উলফের মত একদা কমিউনিস্ট, পরে উগ্র কমিউনিস্ট বিদ্বেষীরা প্রধানত লেনিনের "নৈতিকতা" নিয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য গল্প ফেঁদেছিলেন, লেনিন-আর্মান্দ সম্পর্ক তুলে। রালফ কার্টার এলউডের গবেষণা এ বিষয়ে বড় রকম প্রশ্ন তুলল যে আর্মান্দ এবং লেনিনের ব্যক্তিগত সম্পর্কের উপর জোর দিয়ে আর্মান্দের বিপ্লবী ভূমিকাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে, এবং কার্যত ইঙ্গিত করা হয়েছে যে তিনি যা করেছিলেন লেনিনের প্রতি তাঁর অনুভূতির জন্য, নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে নয়।৬৭
এ ছাড়া বহু আগেই ক্রুপস্কোর জীবনী লেখেন রবার্ট ম্যাকনিল। অনেক পরে, লেনিনের তিন বোন, যাঁরা সকলেই বিপ্লবী আন্দোলনে অংশও নিয়েছিলেন (এবং বড়জন, আনা এলিজারোভা, মার্কসবাদী আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন লেনিনের প্রভাবে নয়, বরং একই সময়ে), তাঁদের জীবনী লেখেন কেটি টুর্টন।৬৮
১৯১৭ সালের গোড়ায় বলশেভিক দলের সদস্য ছিলেন ২৪,০০০। এঁদের সঙ্গে যোগ দেন দুটি ছোটো গোষ্ঠী- ত্রৎস্কী, ইউরেনেভ প্রমুখের নেতৃত্বাধীন মেঝরায়ঙ্কা গোষ্ঠী, এবং মার্তভের সমর্থক মেনশেভিক-আন্তর্জাতিকতাবাদী গোষ্ঠী থেকে ভেঙ্গে আসা অল্প কিছু সদস্য। অর্থাৎ সব মিলিয়ে বড়জোর আরো হাজার দুয়েক। এই প্রাক-১৯১৭ যুগের সংগঠিত বিপ্লবীদের পরবর্তীকালে বলা হত "ওল্ড বলশেভিক" (ষষ্ঠ পার্টি কংগ্রেসে পূর্ববক্তি দুটি গোষ্ঠীর সদস্যদের পুরো সদস্য পর্যায়কে পার্টির সদস্যকাল হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়)। এই আনুমানিক পঁচিশ থেকে ছাব্বিশ হাজার সদস্যর মধ্যে মোটামুটি ২৫০০ ছিলেন নারী সদস্য। কেন, কিভাবে এঁরা পার্টিতে এলেন, মেয়ে হিসেবে বিপ্লবী রাজনীতি করার বারটি কোনো অসুবিধা ছিল কি না, এই নিয়ে গবেষণা হল বারবারা ইভানস ক্লিমেন্টসের বই বলশেভিক উইমেন-এর বড় অংশ।
কৃষক বিদ্রোহ, জাতীয় বিদ্রোহ -
১৯০৫-এর বিপ্লবের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ত্রৎস্কী লিখেছিলেন, ‘এ কথা বলাই বাহুল্য, যে প্রলেতারিয়েত তার ঐতিহাসিক কর্তব্য পালন করবে, যেমন একদা করেছিল বুর্জোয়া শ্রেণি, কৃষক এবং পেটি বুর্জোয়াদের সাহায্য নিয়ে। তাঁদের গ্রামাঞ্চলের নেতৃত্ব দিতে হবে, তাঁকে তাঁদের পরিকল্পনাতে আকৃষ্ট করতে হবে। কিন্তু অনিবার্যভাবেই প্রলেতারিয়েতকে থাকতে হবে নেতা। এটা “প্রলেতারিয়েত ও কৃষকদের ডিক্টেটরশিপ নয়, এ হল প্রলেতারিয়েতের ডিক্টেটরশিপ, যার পিছনে আছে কৃষকদের সমর্থন”। ৬৯ অর্থাৎ ১৯০৫-এর শেষ থেকেই রুশ বিপ্লবীদের একাংশ কৃষকদের সমর্থন নিয়ে শ্রমিক রাজ প্রতিষ্ঠার কথা মনে করেছিলেন। কিন্তু কৃষক বিদ্রোহের চেহারাটা কেমন ছিল? আর রাশিয়ার গ্রামাঞ্চলের শ্রেণি বিন্যাসই বা কেমন ছিল?
প্রাক-বিপ্লব রাশিয়ার কৃষি ব্যবস্থা নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। রুশ বিপ্লবকে সামন্ততন্ত্র থেকে ধনতন্ত্রে উত্তরণের সঙ্গে যাতে কোনোভাবে যুক্ত করা না যায় এই জন্য রিচার্ড পাইপস বলতে চেয়েছেন, রুশ সমাজ ও রাষ্ট্র ছিল ভিন্ন ধাঁচের- তাঁর কথায় পৈত্রিক সম্পত্তিভিত্তিক রাষ্ট্র (patriomonial state)।৭০
কিন্তু জারতন্ত্রী রাশিয়ার সমাজ যে সামন্ততান্ত্রিক ছিল, এবং জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের সংস্কার কৃষকের উপর থেকে ভার তুলে নেয় নি, তার বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছিলেন গেরয়েড রবিনসন, ১৯৩২ সালে।৭১ রবিনসন দেখালেন, কৃষককে বলা হল, 'ব্যক্তিগতভাবে' মুক্তি দেওয়া হচ্ছে বিনা খরচে, কিন্তু জমির জন্য 'ক্ষতিপূরণ' দিতে হবে। বহু এলাকায় বিনা জমিতেই ' মুক্তি ' দেওয়া হল। যেখানে জমি দেওয়া হল সেখানে চাপল ক্ষতিপূরণের বিপুল বোঝা। আর কৃষকের স্বাধীনতার বদলে, পুরনো 'মির' বা কৃষকের যৌথ সমাজকে "ক্ষতিপূরণের" দায়িত্ব দেওয়া হল।
১৮৮০-র দশকে জর্জ প্লেখানভ মার্ক্সবাদী গবেষণা করে দেখতে চেয়েছিলেন, ধনতন্ত্র গ্রামাঞ্চলে জাঁকিয়ে বসছে। লেনিনের 'রাশিয়াতে ধনতন্ত্রের বিকাশ' বইটির উদ্দেশ্য ছিল কৃষিতে যে আধা-সামন্ততন্ত্র ধনতন্ত্রের অধীনে এসেছে, সেটা দেখানো। লেনিন মনে করেন নি, যে কৃষকের বিপ্লবী লড়াই সমাজতন্ত্র অবধি যাবে। কিন্তু তাঁর বক্তব্য ছিল, ধনতন্ত্র দু'ভাবে আসে -- হয় তলা থেকে, বা যাকে তিনি বলেছিলেন মার্কিন পথ, অথবা উপর থেকে, বা প্রুশীয় পথ। রাশিয়া ঐ দ্বিতীয় পথটি ধরেছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জন ম্যারট এই অবস্থানের বিরোধিতা করেছেন। ম্যারটের বক্তব্য, রুশ কৃষিতে ১৯১৭ পর্যন্ত সামন্ততন্ত্রের প্রাধান্য ছিল, এবং ১৯১৭-১৮-র বিপ্লবী কৃষি সংস্কারের ফলে স্বাধীন ছোটো উৎপাদনকারী কৃষক সমাজ গড়ে উঠল। তাঁর বক্তব্য হল, নেপ থেকে সমাজতন্ত্র উত্তরণ বিতর্কে ত্রৎস্কী , প্রিয়ব্রাজেন্সকি, এবং বুখারিন সকলেই যে বড় ভুল করেছিলেন, তা হল কুলাকদের একটি বড় শক্তি হিসেবে দেখা। এই ত্রুটি থেকে দুই পক্ষ পরস্পরকে প্রধান বিপদ বলে চিহ্নিত করেন, এবং বুঝতে ব্যর্থ হন যে স্তালিন ও তাঁর সমর্থকরা মধ্যপন্থী কমিউনিস্ট না, আমলাতান্ত্রিক প্রতিবিপ্লবের কেন্দ্র, বরং "বাম" ও "দক্ষিণ" কমিউনিস্টরা উভয়েই কমিউনিস্ট। উপরন্তু ম্যারটের মতে লেনিনের মূল বিশ্লেষণেই ভুল ছিল, তাই কৃষককে যৌথ খামারের দিকে নিয়ে যাওয়ার আশাই ছিল বৃথা।.৭২
কিন্তু ম্যারটের গবেষণা মার্ক্সবাদীদের বিতর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও, ১৯১৭ তে কৃষক বিদ্রোহের উপর খুব বেশী আলোকপাত করে না। কৃষক বিদ্রোহ সম্পর্কে ত্রৎস্কীর ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল - তা হল, ফেব্রুয়ারী থেকে অক্টোবরের মধ্যে অধিকাংশ সংঘাত ছিল জমিদারদের সঙ্গে গোটা কৃষক সমাজের সংঘাত, ধনি কৃষক বা পুঁজিপতির সঙ্গে দরিদ্র কৃষক ও ক্ষেতমজুরের সংঘাত নয়। কিন্তু এ তো গোটা রুশ সাম্রাজ্যের গড় ছবি। এর মধ্যে এলাকাভিত্তিক বহু প্রভেদ ছিল। অ-রুশ প্রদেশগুলিতে বড় জমিদার বহু ক্ষেত্রেই ছিল ক্ষেত্রেই ছিল রুশীয় আর কৃষকরা ছিল স্থানীয়। ফলে শ্রেণি ও জাতিস্বত্ত্বার মধ্যে নির্দিষ্টভাবে মেলবন্ধন ঘটে। গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদীরা দাবি করেন, ভাষাভিত্তিক সেনাবাহিনী গঠন করতে হবে। মে থেকে ক্রমে নিজেদের উদ্যোগে তাঁরা এ কাজ করতে থাকেন।
বিভিন্ন অঞ্চলে জাতীয় স্বায়ত্ত্বশাসন/স্বাধীনতার লড়াই নানা ভাবে বিকশিত হয়। মধ্য এশিয়াতে, সেখানে স্থানীয় মানুষেরা ছিলেন তুরকি বা তাজিক ভাষী, সেখানে "সোভিয়েত" ক্ষমতার নামে মেনশেভিক ও সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীরা রুশ প্রাধান্যকে মদৎ দেন। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল শ্রেণি ও ধর্মের প্রশ্ন। মধ্য এশিয়ার স্থানীয় জনগণ ছিলেন মূলতঃ মুসলিম। আর যখন অস্থায়ী সরকার "স্থানীয় অধিকার”-এর স্বীকৃতি দেয়, সেটা হয়েছিল আমীরদের সঙ্গে রফা করে, এবং সংস্কারপন্থী জাদিদ আন্দোলনকে অগ্রাহ্য করে। এ বিষয়ে পাশ্চাত্য গবেষণার বৃহত্তম ত্রুটি, অস্থায়ী সরকারের পর্বকে অগ্রাহ্য করে ইসলামের উপর বলশেভিক হামলার ছবি আঁকা।৭৩ ভারতে ও অন্যত্র অন্য ধরণের গবেষণা অবশ্য আছে।৭৪
তুলনায় ইউরোপীয় অঞ্চলের জাতিস্বত্ত্বাদের উপর অনেক উন্নত মানের গবেষণা হয়েছে। এখানে অগ্রগণ্য রনাল্ড সানির বাকু সম্পর্কিত রচনা, যাতে তিনি দেখিয়েছেন, বামপন্থী জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে কীভাবে বলশেভিকদের জোট হয়েছিল। সানির কাজ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মার্ক ফেরো রুশ বিপ্লবের সামাজিক ইতিহাস লেখার নামে দাবী করেছেন, জাতীয়তাবাদীদের প্রতি বলশেভিক সমর্থন ছিল সুবিধাবাদী।.৭৫
কিন্তু জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বলশেভিকদের দ্বন্দ্ব ও সমঝোতার জটিলতা দেখা দেয় অক্টোবরের পরে। কৃষকদের প্রসঙ্গ অক্টোবরের আগেই বড় হয়ে দেখা দেয়। এক গুচ্ছ গবেষণা দুঃখ প্রকাশ করেছে, যে বিশ্বযুদ্ধ না হলে স্তলিপিনের ভূমি সংস্কার রাশিয়ার কৃষির আধুনিকরণ ঘটাত, এবং তা হলে ব্যক্তিগত ভাবে জমির মালিক হয়ে কৃষকরা রক্ষণশীল হয়ে পড়তেন।৭৬ কিন্তু হস্কিং-এর গবেষণা দেখায়, তৃতীয় এবং চতুর্থ ডুমাতে ক্যাডেট দল ক্রমেই মোলায়েম হচ্ছিল, ফলে ভূমি সংস্কার কখনোই বেশী দূর এগোতো না। উপরন্তু, আমরা বিশ্বযুদ্ধকে বাইরে থেকে চাপানো ঘটনা বলতে পারবনা। জারতন্ত্রী রাষ্ট্র, এবং বুর্জোয়া শ্রেণি, উভয়েই চেয়েছিল ইউরোপে, বিশেষত কনস্টান্টিনোপলের দিকে ও কৃষ্ণসাগর থেকে ভূমধ্যসাগরে বেরোনোর নৌপথ নিয়ন্ত্রণের দিকে এগোতে। ১৯১৪-র আগেও তৎরা দুই বলকান যুদ্ধের সময়ে নিজেদের আধিপত্য বাড়াতে সচেষ্ট ছিল। তাই আভ্যান্তরীণ সংস্কার আটকে গিয়েছিল শাসনে দুই মিত্র, পুরনো রাষ্ট্র ও ক্ষয়িষ্ণু অভিজাত শ্রেণি, এবং বুর্জোয়া শ্রেণি, এদের বৃহত্তর স্বার্থেই।
১৯১৭তে গ্রামাঞ্চলে নানা ধরণের সংগঠন তৈরি হয়। কৃষকরা শহুরে প্রতিষ্ঠানদের উপরে খুব বেশী ভরসা রাখতেন না। কিন্তু তাঁদের সমস্যা ছিল, তাঁদের বিকল্প সংগঠন অনেক সময়েই স্থানীয় সীমা ছাড়াতে পারে নি। কেন্দ্রীয় কৃষ্ণ-মৃত্তিকা ও মধ্য ভল্গা অঞ্চলের গবেষণা করে আওয়েন দাবী করেছিলেন, মার্চ থেকে অক্টোবরে কৃষকরা মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে (অর্থাৎ বেশী জমিদারের প্রাণহানি না করেই) বিপ্লব করেছিলেন। আলোচিত অঞ্চলে কৃষকের হাতে জমি ছিল কম জনসংখ্যা বাড়ছিল, তাই সবটাই "শান্তিপূর্ণ" এমন বলা যায়না। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে কৃষকের সশস্ত্র এবং হিংসাত্মক উত্থান বাড়তে থাকে। সেপ্টেম্বরে খাদ্য সঙ্কটের মোকাবিলা করতে সরকার সৈন্যও পাঠায়। কৃষকের কাছেও সমস্যা ছিল ময়দা, চিনি এবং মাখনের অভাব।
জন চ্যানন দেখিয়েছেন, কৃষকদের দলবদ্ধ আক্রমণ ও "লুঠ" করানোতে নেতৃত্ব দেয় বহু ক্ষেত্রেই ছুটিতে দেশে আসা সৈনিকরা। তারা আবার জমিদারের জমিতে অবস্থিত মদের দোকান থেকে মদও দাবী করে।৭৭ কিন্তু গবেষণার বড় অংশ এই অঞ্চলকে ঘিরে হয়েছে। যারা সংখ্যালঘু জাতিস্বত্ত্বাদের নিয়ে আলোচনা করেছেন তাঁরা অনেকে শ্রেণি সংগ্রামের প্রশ্ন বেশী তলিয়ে দেখেন নি। রুশ ভাষী এলাকাতেও সর্বত্র ছবিটা একরকম ছিল না। এরন রেটিশ বর্তমান শতাব্দীতে তাঁর গবেষণায় বলতে চেয়েছেন, আওয়েন বা চ্যানন প্রমুখের আঁকা ছবির একটা বড় দিক হল, কৃষকরা মদের জন্য মারপিট করছে। ভায়াতকা প্রদেশের কৃষকদের উপর গবেষণা অনেকগুলি প্রসঙ্গকে সামনে তুলে আনে, যেগুলি গত কয়েক দশকে ইতিহাসবিদ্রা ভাবতে শুরু করেছেন। বিশ্বযুদ্ধের ফলে বহু প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষকে সেনাবাহিনীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মেয়েরা দ্বিগুণ চাপে পড়েন। এর ফলে তাঁদের রাজনৈতিক চেতনা বাড়তে থাকে। ১৯১৭তে তাঁরা পুরুষদের চেয়ে বেশী সংখ্যায় ভোটে অংশও নিয়েছিলেন। অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে তাঁদের দ্বন্দ্ব তীব্র হয় যুদ্ধকালীন সমস্যার উল্লেখ করে জোর করে শস্য দখলের ফলে। দ্বিতীয়ত, রেটিশ দেখিয়েছেন, বলশেভিকরা ১৯১৭তে এবং পরে (১৯২২ পর্যন্ত), পার্টি কাঠামোর বাইরে কৃষকদের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা চালাতে, এবং রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ এড়াতে সচেষ্ট ছিলেন। “যুদ্ধ কমিউনিজম” সম্পর্কে যে চিরাচরিত ধারণা, তাকে রেটিশের এই বক্তব্য প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়। তাঁর গবেষণা আরো দেখায়, কৃষকদের বড় অংশও স্তোলিপিন সংস্কারে লাভবান 'স্বাধীন কৃষক'দের সকলের সঙ্গে যৌথভাবে জমি দখলের ও বণ্টনের প্রক্রিয়াতে রাখতে চেষ্টা করেছিলেন। এই তথ্য দেখায়, স্তোলিপিন সংস্কার যুদ্ধের জন্য নয়, গ্রামাঞ্চলের শ্রেণি সংগ্রামের জন্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল।৭৮
বারবারা ইভানস ক্লিমেন্টস ১৯৮২ সালে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের অর্ধেক ব্যয় করেছিলেন কৃষক মেয়েদের উপর । তিনি দেখান, শ্রেণি ও লিঙ্গের সম্পর্ক কতটা জটিল হয়ে উঠতে পারত। পুরুষ কৃষকের মধ্যে বিপ্লব স্বতঃস্ফূর্তভাবে নারী সমতার ধারণা আনে নি। বরং বলশেভিকদের "নারীমুক্তির" কথা কৃষকদের মধ্যে শঙ্কা জাগায়। মাক্সিম গোর্কি ১৯১৭-১৮তে বলশেভিকদের কড়া সমালোচক ছিলেন। তাঁর কাছে কৃষকদের চিঠি আসে, মেয়েদের সমতার আইন থেকে বেআইনি কাজ বাড়বে, পরিবার ধ্বংস হলে কৃষি ধ্বংস হবে। পরিবারের পুরুষ প্রাধান্যের প্রতি বলশেভিকরা বিপ্লবের গোড়ার দিকে যে চ্যালেঞ্জ এনেছিলেন, তা এই ধরণের প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যায়। ফলে বলশেভিকদের সঙ্গে কৃষকের সম্পর্ক ছিল- বলশেভিকরা যে জমি বণ্টনের পক্ষে, কৃষক তাতে খুশী কিন্তু গৃহযুদ্ধের জন্য বলশেভিকরা যে ফের খাদ্যশস্য অধিগ্রহণ করেছে, এবং তার সঙ্গে নারীমুক্তির আইনের ফলেও কৃষক (পুরুষ) অখুশী। ১৯২৩ সালে রাশিয়ার ১৫টি কেন্দ্রীয় প্রদেশে নারী ব্যুরো (জেনোৎদেল)-এর সভায় অংশও নেন মাত্র ১৪৭০৯ জন কৃষক মেয়ে। ফলে জেনোৎদেলের নেত্রীরা জোর দেন তাৎক্ষনিক সুবিধার উপর, এবং তাঁরা গ্রামের জীবন ধ্বংস করতে চান না, এই কথা বারে বারে বলা হয়। ইভানস ক্লিমেন্টস এর পর দেখিয়েছেন, নেপ-এর গোড়া থেকে একরকম চাপে (যার মধ্যে মেয়ে কৃষকদেরও অনেকে ছিলেন) জমি পুনর্বন্টনে ক্ষতিগ্রস্থ হন সেই সব মেয়ে কৃষক, যাঁরা পরিবারের প্রধান ছিলেন (অর্থাৎ যাঁরা কোনো পুরুষের উপর নির্ভরশীল ছিলেন না)।৭৯
লেনিন, ত্রৎস্কী , পার্টি, রণনীতি -
বিপ্লবী দল হিসেবে বলশেভিকরা কীভাবে গড়ে উঠেছিল? এই দল কতটা লেনিনের বশংবদ ছিল? বিপ্লবে লেনিনের ভূমিকা কি ছিল, ত্রৎস্কীরই বা কী ছিল? এই প্রশ্নগুলি আবার ব্যক্তিকেন্দ্রিক ইতিহাসের দিকে ফিরিয়ে আনে। কিন্তু আমরা দেখব, উত্তর নানা ধরণের, এবং তা বিপ্লবের ইতিহাসের উপর নানাভাবে আলোকপাত করে।
১৯০২ সালে ভ্লাদিমির উলিয়ানভ লেনিন ছদ্মনামে একটি বই প্রকাশ করেন। রুশ ভাষায় বইটির নাম ছিল স্তো দেলাত? ইংরেজিতে সাধারণ অনুবাদ What Is To Be Done? পরবর্তীকালে অনেক সময়ে দাবী করা হয়েছে, এই বইটিই বলশেভিক বাদের সূচনা, অথবা, এখান থেকেই লেনিনের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের প্রমাণ পাওয়া শুরু।
১৮৯৮ সালে রুশ মার্ক্সবাদী গোষ্ঠীরা মিলে পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু নব নির্বাচিত নেতৃত্বের অনেকে অল্পদিনের মধ্যে গ্রেপ্তার হন। নতুন করে বিচ্ছিন্ন মার্ক্সবাদী গোষ্ঠীদের ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নেয় দুটি গোষ্ঠী- প্লেখানভ, আক্সেলরদ ও জাসুলিচের নেতৃত্বে অঝবোবঝদেনি ট্রুডা বা 'শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি' গোষ্ঠী এবং রাশিয়ার ভিতরের একটি গোষ্ঠী যাতে ছিলেন উলিয়ানভ-লেনিন, নাদেঝভা ক্রুপস্কায়া, ইউলি বা জুলিয়াস মার্তভ ও আলেক্সান্দর পত্রেসভ। এঁরা একমত ছিলেন, যে ঐক্যবদ্ধ পার্টির একটি মার্ক্সবাদী কর্মসূচী চাই, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বিতর্কে এঁরা বার্নস্টাইনের সংশোধনবাদের সমালোচক এবং কাউটস্কির মার্ক্সবাদের সমর্থক ছিলেন। এই উদ্দেশ্যে এঁরা দুটি পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন- 'ইস্কা' এবং 'জারিয়া'। ইস্ক্রা ছিল জনপ্রিয় পত্রিকা, আর জারিয়া ছিল তাত্ত্বিক পত্রিকা। এছাড়া তখন দু'তিনটি পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছিল- কে.এম.তাৎতারেভ এবং কে.এ.কক সম্পাদিত রাবোচায়া মিসল (শ্রমিকের চিন্তা) এবং বোরিস ক্রিচেভস্কি, ভ্লাদিমির আকিমভ ও আলেক্সান্দার মার্তিনভ সম্পাদিত রাবোচিয়ে দিয়েলো। রাবোচায়া মিসলকে বলা হত "অর্থনীতিবাদী"। অর্থনীতিবাদ ছিল একটি রাজনৈতিক ধারা, যা গণতন্ত্র ও সাধারণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক লড়াইকে অবহেলা করতে চাইত এবং মনে করত যে ট্রেড ইউনিয়নের লড়াইয়ের উপর জোর দিলেই শ্রেণি সংগ্রাম স্পষ্ট হবে। রাবোচিয়ে দিয়েলো অপেক্ষাকৃত মার্ক্সবাদী অবস্থান নিত, কিন্তু অর্থনীতিবাদীদের প্রতি সহনশীল ছিল। প্লেখানভ বা লেনিন আদৌ তা ছিলেন না।
What Is To Be Done?-এ লেনিনের মূল বক্তব্য ছিল, সমাজতন্ত্রের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণির লড়াইয়ের মেলবন্ধন ঘটান সম্ভব এবং কাম্যও। কিন্তু এ জন্য দরকার বিপ্লবী দলের। রাশিয়ার বাস্তব পরিস্থিতি হল, গন জাগরণ তীব্রতর হচ্ছে, কিন্তু বিপ্লবীরা খণ্ডিত, স্থানীয়ভাবে, সেকেলে পদ্ধতিতে কাজ করে চলেছেন। এর বদলে চাই "পেশাদার বিপ্লবী"। গোটা সমাজের শ্রেণি সংগ্রামের অভিজ্ঞতার কেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী সচেতনা সৃষ্টি করতে হবে। এমন সংগঠন তৈরি করতে হবে যাতে পুলিশী ধরপাকড় সত্ত্বেও কাজ চালু রাখা যায়। লেনিন তাঁর বইয়ে স্পষ্ট উল্লেখ করেন রুশ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের কাছে আদর্শ হল জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক দল।
এর সঙ্গে ছিল রাবোচিয়ে দিয়েলোর সঙ্গে বাদানুবাদ। যেহেতু রাবোচিয়ে দিয়েলো-ও দাবী করত, তার রাজনৈতিক অবস্থান মার্ক্সবাদী, তাই তর্কটা ছিল যত না মূল নীতি নিয়ে, তার চেয়ে বেশী রণকৌশল নিয়ে।
রাবোচিয়ে দিয়েলোতে বোরিস ক্রিচেভস্কির একটি প্রবন্ধে স্টিখিইনোস্ত কথাটা প্রথম আসে। এই শব্দটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে spontaneity হিসেবে, এবং বারে বারে দাবী করা হয়েছে, লেনিন স্বতঃস্ফূর্ততাকে বুর্জোয়া রাজনীতি মনে করতেন। বইটিতে বাস্তবে তিনি বলেছিলেন, ঐতিহাসিকভাবে অনেক বেশী সম্ভাবনা হল, স্বৈরতন্ত্র পড়ে যাবে কোনো একটি স্টিখিইনি বিস্ফোরণের ফলে, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দল তেমন বিস্ফোরণের আশায় থেকে তার কাজকর্ম স্থির করতে পারে না।
যখন এই বইটি প্রকাশিত হয়, তখন সমগ্র ইস্ক্রা গোষ্ঠী এটিকে তাঁদের যৌথ অবস্থান বলেই মনে করেছিলেন। ১৯০৩-এর দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসে লেনিন স্বীকার করেন, তিনি তর্কের খাতিরে অতিরঞ্জিত কথা বলেছিলেন। ১৯০৫-এর তৃতীয় (বলশেভিক) কংগ্রেসে লেনিন যখন প্রস্তাব করেন, পার্টি কমিটিগুলিতে বেশী করে শ্রমিকদের আনা হোক, তখন বলশেভিক কর্মীরা অনেকে তাঁর বিরোধিতা করেন। এই অভিজ্ঞতাগুলির ফলেই, যখন তাঁর একটি রচনা সঙ্কলন প্রকাশিত হয়, তার ভূমিকায় লেনিন বলেন, What Is To Be Done? হল ইস্ক্রার ১৯০১-২ এর কৌশল ও সাংগঠনিক নীতির নির্যাস মাত্র। তিনি আরো বলেন, তিনি ট্রেড ইউনিয়ন ও অর্থনৈতিক সংগ্রামের বিরোধী, এটা মিথ্যা প্রচার।
মার্ক্সবাদী মহলে ১৯২০-র দশকের গোড়া পর্যন্ত এই বইটিকে খুব কেন্দ্রীয় মনে করা হত না। কিন্তু ১৯৩০-এর দশকে যখন হিস্ট্রি অভ সি পি এস ইউ (বি)- শর্ট কোর্স প্রকাশিত হয়, তখন দাবী করা হয়, লেনিন এই বইয়ে প্রথম দেখিয়েছিলেন, সুবিধাবাদের মতাদর্শগত উৎস হল স্বতঃস্ফূর্ত শ্রমিক আন্দোলনের উপাসনা করা। কার্যত, এই প্রথম বলা হল, What Is To Be Done? নিছক রণকৌশলগত রচনা নয়, বলশেভিকবাদের মতাদর্শগত ভিত্তি। তবে ১৯২৪ সালে জিনোভিয়েভের রচনা থেকে এই ধারার সূত্রপাত, এ কথা বলা যায়।
ঠাণ্ডা যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ ও দক্ষিণপন্থী লেখকরা এই কথাগুলিকেই তুলে ধরলেন। কিন্তু জন প্লামেনাৎজ তখনও বলেন, What Is To Be Done? -এ উল্লিখিত মত আদৌ অগণতান্ত্রিক নয়।৭৮
কিন্তু বারট্রাম উলফ, লিওপোল্ড হেমসন, অ্যালান ওয়াইল্ডম্যান, ইসরায়েল গেটজলার বা আব্রাহাম অ্যাশার, অন্য বহু বিষয়ে মতভেদ থাকলেও, এক্ষেত্রে লেনিনের দোষের ব্যাপারে একমত ছিলেন।৭৯ তাঁদের বক্তব্য হল, লেনিন শ্রমিক শ্রেণির স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন, কারণ তিনি জনগণকে বিশ্বাস করতেন না। তিনি চেয়েছিলেন, শ্রমিক আন্দোলনকে তাঁর স্বাভাবিক গতিচ্যুত করে বাইরে থেকে (বুর্জোয়া) বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা পরিচালিত করতে।
সমস্যা হল, ১৯৮১তে একটি তথ্যানুগ গবেষণা এই ছবিটা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ডেভিড লেন নামে এক সমাজতাত্তিক দেখালেন, বলশেভিকরা ১৯০৫-এর বিপ্লবে মেনশেভিকদের চেয়ে বেশী বিপ্লবী ছিলেন। আর, দেখা গেল, পঞ্চম পার্টি কংগ্রেসে বলশেভিক প্রতিনিধিদের মধ্যে আনুপাতিক হারে শ্রমিক এবং শ্বেত কলার শ্রমিক বেশী (যথাক্রমে ৩৬.২% এবং ১১.৪%) আর মেনশেভিকদের মধ্যে কম (৩১.১% এবং ৫.১%)। অন্যদিকে মেনশেভিকদের মধ্যে পেশাদার বিপ্লবী প্রতিনিধি ছিলেন ২২.১%, বলশেভিকদের ১৭.১%।৮০ কিন্তু তথ্য পরিসংখ্যান, এ সব দিয়ে পাঠককে গুলিয়ে দেওয়া কি দরকার? লেনিন বড় স্বতঃস্ফূর্ততা বিদ্বেষী এবং শ্রমিকদের দিকে সন্দেহের চোখে তাকাতেন, এই কাহিনী গ্রন্থ থেকে গ্রন্থ, প্রবন্ধ থেকে প্রবন্ধ, এগিয়ে গেল। রেজিনাল্ড জেলনিক দাবী করেন, শ্রমিকরা বুদ্ধিজীবীদের কাছে প্রশিক্ষণ নিতে রাজি ছিলেন না এবং লেনিন শ্রমিকদের এই প্রবণতার বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই করেছিলেন।৮১
রিচার্ড পাইপস লিখেছেন, লেনিনের 'অকথিত' ('unspoken') ধারণা ছিল জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিক্রিয়াশীল এবং গণতন্ত্র প্রতিক্রিয়ার দিকে যাবে। 'অকথিত', তাই পাইপসকে খেটেখুটে লেনিনের রচনাবলী থেকে দশ-বিশটা উদ্ধৃতি দিয়ে পাঠকের কাছে কিছু প্রমাণ করতে হয় না।৮২
পাশ্চাত্যর মূলস্রোতের জন কয়েক পণ্ডিত অবশ্য এই বন্যায় ভেসে যান নি। নীল হার্ডিং লেনিনের রচনাবলী পড়ে তবে লেনিন সম্পর্কে মন্তব্য করা জরুরি, এ কথা মনে করেছিলেন, এবং তিনি বলেন আলোচ্য যুগে লেনিন নিজেকে গণতন্ত্রী বলে মনে করতেন। ৮৩
মার্ক্সবাদী মহলেও What Is To Be Done? বিতর্কিত রচনা ছিল। রোজা লুক্সেমবুর্গ ও লেভ ত্রৎস্কী , দুই বিপ্লবী মার্ক্সবাদীকে ঠাণ্ডা যুদ্ধে দক্ষিণপন্থীরা সাক্ষী মানার চেষ্টা করেন। লুক্সেমবুর্গ একটি প্রবন্ধে লেনিনের সমালোচনা করেন। তিনি (বা নয়ে জাইট পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে কাউটস্কি) প্রবন্ধটির শিরোনাম দিয়েছিলেন রুশ সোশ্যাল ডেমক্র্যাসীর সাংগঠনিক সমস্যা। বারট্রাম উলফ প্রবন্ধটি পূণর্মুদ্রণের সময়ে নাম দেন Marxism or Leninism?
লুক্সেমবুর্গ লেনিনকে সমালোচনা করেছিলেন, শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামদের অবহেলা করার জন্য। কিন্তু আমরা জানি, তিনি যে সংগ্রামগুলির উল্লেখ করেছিলেন, তাদের সম্পর্কে তিনি জেনেছিলেন, 'ইস্ক্রা'তে মুদ্রিত স্বাক্ষরবিহীন প্রবন্ধ থেকে, যেগুলি ছিল লেনিনেরই লেখা। ১৯২৩-২৪ থেকে, বলশেভিক পার্টিতে যখন নতুন করে দ্বন্দ্ব শুরু হয়, তখন গ্রিগরী জিনোভিয়েভ এবং স্তালিন "লেনিনবাদ" বলে একটি মতাদর্শ সৃজন শুরু করেন। What Is To Be Done? -এর প্রথম উচ্চ প্রশংসা আসে জিনোভিয়েভের লেখা পার্টির ইতিহাসে।৮৪
ত্রৎস্কীর রচনায় আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মত দেখি। তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি নিজের পুরনো প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেন, সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত অবস্থায় তিনি পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করা ও কেন্দ্রীকতার পক্ষে ছিলেন। ১৯০৩-এ পার্টি কংগ্রেসের প্রথম দিকে তিনি প্রবলভাবে লেনিনকে সমর্থন করেন, কিন্তু সম্পাদকমণ্ডলী নির্বাচনের প্রশ্নে লেনিনের বিরোধিতা করেন ও সংখ্যালঘু (মেনশেভিক) অবস্থান নেন। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে, বিশেষ করে উদারপন্থীদের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে, তিনি মেনশেভিকদের সঙ্গে একমত ছিলেন না বলে ১৯০৪-এ মেনশেভিক উপদল ছেড়ে দেন।
১৯০৪ সালে বেরোয় তাঁর পুস্তিকা, যাতে তিনি লেনিন প্রতিস্থাপনাবাদের দায়ে দুষ্ট বলে আক্রমণ করেন।৮৫ কিন্তু প্রতিস্থাপনাবাদ বলতে তিনি ঠিক কি বুঝেছিলেন? প্রথম ডয়েটশার, পরে আরো অনেকে, মনে করেছেন, শ্রেণিকে সরিয়ে পার্টিকে একমাত্র সক্রিয় রাখাই হল প্রতিস্থাপনাবাদ। ১৯২১ থেকে ক্রমে সোভিয়েত ইউনিয়নে এমন ঘটেছিল, তাই ত্রৎস্কীর ১৯০৪-এর পুস্তিকাকে অনেকে গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু পুস্তিকাটি খুঁটিয়ে পড়লে দেখা যায়, তিনি জোর দিয়েছিলেন গণআন্দোলন বনাম পার্টির নিজস্ব ছকে চলার বৈপরীত্যের উপর, যে অভিযোগ লেনিনের যুগের বলশেভিকদের ক্ষেত্রে খুব একটা প্রযোজ্য নয়, যদিও ছোটো ছোটো গোষ্ঠীদের ছদ্ম-লেনিনবাদের ক্ষেত্রে আজকাল অনেক সময়ে প্রযোজ্য।
অ-স্তালিনবাদী মার্ক্সবাদী মহলে লেনিনবাদ ও সংগঠন সম্পর্কে টোনি ক্লিফ ও ব্রিটিশ সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টির ধারার বই ও প্রবন্ধগুলি তাৎপর্যপূর্ণ। ক্লিফ--এর ধারা যখন চতুর্থ আন্তর্জাতিক থেকে সরে যায়, তখন তারা সাংগঠনিক ক্ষেত্রে রোজা লুক্সেমবুর্গ-এর মতের উপর গুরুত্ব দেয়। কিন্তু ১৯৬৮-তে ছাত্র-যুব আন্দোলনের পর, ফ্রান্সে চতুর্থ আন্তর্জাতিকের সংগঠনের আপেক্ষিক সাফল্য ও ব্রিটেনে ও অন্যত্র ক্লিফদের অপেক্ষাকৃত কম সাফল্য ক্লিফকে অন্য দিকে ঘোরায়। তিনি লেনিনের যে চারখন্ড জীবনী লেখেন, তাতে ত্রৎস্কীর সমালোচনা করে তিনি বলেন ত্রৎস্কী রুশ বিপ্লবের ইতিহাসে পার্টির ভূমিকাকে খাটো করে দেখেছিলেন।৮৬ এরপর জন মলিনিউ মার্ক্সবাদ ও পার্টি বিষয়ক গ্রন্থে বলেন, মার্ক্স-এঙ্গেলস ছিলেন বেশী বিষয়বাদী (objectivist) । রাশিয়ার, এবং ঐ যুগের জন্য লেনিনের পথই ছিল সম্পূর্ণ সঠিক।৮৭
এই তাৎক্ষনিক প্রয়োজনীয়তা ভিত্তিক বিশ্লেষণের বাইরে আসার চেষ্টা ছিল না, এমন নয়। আর্নেস্ট ম্যান্ডেলের পুস্তিকা , দ্য লেনিনিস্ট থিওরি অভ অর্গানাইসেশন তার এক নজীর।৮৮ কিন্তু ম্যান্ডেলের ত্রুটি, তিনিও ওই লেনিন, একজন ব্যক্তি, ও তাঁর তত্ত্বের উপর একপেশে ভাবে জোর দিয়েছিলেন। পরিবর্তন আনলেন পল লে ব্ল্যাঙ্ক।৮৯ রাশিয়ার শ্রেণি সংগ্রাম, শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে বিপ্লবী কর্মী ধারা গড়ে ওঠা, এবং শীর্ষ নেতৃত্ব, মধ্য স্তরের কর্মী এবং সংগ্রামি শ্রমিকদের যে তিন স্তরকে নিয়ে ম্যান্ডেল কেবল ছক তৈরী করেরছিলেন রুশ ইতিহাস থেকে তাঁদের বাস্তব ছবি তুলে ধরে লে ব্ল্যাঙ্ক দেখালেন, বলশেভিক দল কোনো ছক থেকে তৈরি হয় নি, তত্ত্ব ও প্রয়োগের, নেতৃত্ব ও কর্মীর, শ্রেণি সংগ্রাম ও তার ওঠানামার দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল। লেনিন এই প্রক্রিয়ায় খুব বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন, কিন্তু তাঁকে যে দৈব (বা দানবিক) চরিত্র দেওয়া হয়, সেটা ভ্রান্ত। লে ব্ল্যাঙ্ক এই কাজে সফল হন, সংকীর্ণতাবাদ কাটিয়ে, সামাজিক ইতিহাস সহ বহু ধরণের গবেষণা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে।
লে ব্ল্যাঙ্কের, এবং অংশত অচিন বিনায়ককে৯০ অনুসরণ করে, কিন্তু দীর্ঘতর এক প্রেক্ষিতে, মার্ক্স-এঙ্গেলস থেকে রুশ বিপ্লব পর্যন্ত অভিজ্ঞতাকে একত্র করে আলোচনা করেন সোমা মারিক। মারিকের বক্তব্য হল পার্টি গঠনকে 'সাংগঠনিক' বলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা সম্ভব নয়। রণনীতি, কর্মসূচী, আর সাংগঠনিক প্রথা, পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। লেনিন ও বলশেভিকদের সাফল্যের কারণ এই নয় যে তাঁরা সবসময় সঠিক ছিলেন। তাঁদের সাফল্যের এক বড় কারণ নেতৃত্ব ও কর্মীদের মধ্যে আদানপ্রদান, এবং নেতৃত্বের দক্ষতা ও নমনীয়তা। বিলোপবাদের সঙ্গে লড়াইয়ের সময়ে লেনিনের প্রথমে প্রবণতা ছিল আইনী পথের কর্মী ও বিলোপবাদীদের অভিন্ন হিসেবে দেখার । কিন্তু ১৯১০-এর কেন্দ্রীয় কমিটি সভায় "মধ্যস্থতাপন্থী" (conciliator) দের জয় থেকে তিনি বোঝেন, বহু কর্মী আছেন যাঁরা পার্টির পুরনো কর্মসূচীর পক্ষে, গোপন সংগঠনের মাধ্যমে পুলিশের নজর এড়িয়ে পুরোদমে বিপ্লবী প্রচার করার পক্ষে, কিন্তু এটাকে নিছক প্রয়োজনভিত্তিক গোপনীয়তা মনে করেন। তাঁরা ট্রেড ইউনিয়ন সহ প্রকাশ্যে কাজ করার ক্ষেত্রে বাইরে থেকে গোপন সংগঠনের নির্দেশ মানার পক্ষে না, বরং আত্মগোপন করা কর্মী ও প্রকাশ্যে কাজ করা কর্মীর সমতা চাইছেন। ১৯১১-১২ থেকে লেনিন ও তাঁর সমর্থকরা রণকৌশল পাল্টান, ফলে রাশিয়ার ভিতরের বহু মধ্যস্থতাপন্থী বা conciliator কে তাঁদের সঙ্গে টেনে নিয়ে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে বলশেভিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।
এই গোটা বিতর্কে নতুন মাত্রা আসে লার্স লি-র গবেষণা থেকে। What Is To Be Done? রচনার এক শতাব্দী পরে এই প্রথম একজন গবেষক বইটির প্রেক্ষাপট, যাদের সঙ্গে তর্ক হচ্ছে তাঁদের বক্তব্য সমস্ত কিছু সংগ্রহ করে বইটির উপর এক দীর্ঘ বই রচনা করলেন, এবং মূল বইটির নতুন ইংরেজি অনুবাদও করলেন।৯১
লি দেখিয়েছেন, ১৯০০ থেকে ১৯০৩-এর মধ্যে লেনিন ইস্ক্রা ও জারিয়া, দুটি পত্রিকার জন্য মোট ৫০টি প্রবন্ধ লেখেন। এর মধ্যে ২৭টি ছিল রাজনৈতিক প্রচারমূলক প্রবন্ধ এবং ২৩টি নানা রকম বিতর্কমূলক, যথা আন্তঃপার্টি বিতর্ক, উদারনীতিবিদদের সঙ্গে বিতর্ক, নারোদনিকদের সঙ্গে বিতর্ক, বিভিন্ন রকম জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিতর্ক, ইত্যাদি। সুতরাং তাঁর এই গোটা পর্যায়ের চিন্তা ও কাজকে নিছক "সাংগঠনিক" হিসেবে দেখার অর্থ তাঁর রাজনৈতিক কাজকে অবহেলা করা।
What Is To Be Done? -এ দুটি বিখ্যাত অংশ আছে যা নিয়ে বারবার সমস্যা হয়েছে। একটিতে কাউটস্কির অনুসরণ করে লেনিন বলছেন যে সমাজতন্ত্র শ্রমিক শ্রেণির ভিতরে তৈরি হয় না, বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীরা তা বাইরে থেকে আনেন। তিনি বলেন, সব দেশের ইতিহাস দেখায়, শ্রমিক শ্রেণি কেবল নিজের উদ্যোগে শুধু ট্রেড ইউনিয়নবাদী চেতনার বিকাশ ঘটাতে পারে, অর্থাৎ বুঝতে পারে যে লড়াই করা দরকার, সরকারকে শ্রম বিষয়ক আইন পাশ করতে বাধ্য করান দরকার, ইত্যাদি। আর সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব বুদ্ধিজীবীদের দার্শনিক, ঐতিহাসিক ও অর্থনৈতিক তত্ত্ব থেকে উদ্ভুত।
লেনিন বলেন, শ্রমিক আন্দোলনের স্টিখিইনোস্ট বিকাশ হলে তা বুর্জোয়া মতাদর্শের অধীনে চলে আসে, কারণ স্টিখিইনোস্ট বিকাশের অর্থ ট্রেড ইউনিয়নবাদ। এই জন্য স্টিখিইনোস্ট থেকে শ্রমিক আন্দোলনকে বিপ্লবী সোশ্যাল ডে্মোক্রেসীর নেতৃত্বে আনতে হবে।
কিন্তু লেনিন একথাও বলেছিলেন, যে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের আদর্শ কোনো ট্রেড ইউনিয়নের সেক্রেটারি নয়, জনগণের প্রতিনিধি হওয়া, যে সবরকম অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখাবে, এবং সকলকে বোঝাবে শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি সংগ্রামের ঐতিহাসিক তাৎপর্য কি!
টোনি ক্লিফের বক্তব্য ছিল, লেনিনের এই মত ভুল। কিন্তু তিনি এটা "ব্যাখ্যা" করার জন্য যে উপমা দিলেন তা হল, "অর্থনীতিবাদী"রা লাঠিকে একদিকে বেশী বাঁকিয়েছিল, এবং লেনিন সেটা সোজা করার জন্য উলটোদিকে বাঁকালেন। এর বিপরীতে, ম্যান্ডেলের ব্যাখ্যার মূল কথা হল, শ্রেণি সংগ্রামের থেকেই শ্রেণি চেতনা জন্ম নেয়। বিপ্লবী দল হল অগ্রণী চিন্তাবিদ ও অগ্রণী শ্রমিক স্তরের চেতনার মিলন। ফলে ম্যান্ডেল প্রকারান্তরে বোঝালেন, এক দল বিপ্লব মনস্ক ছাত্র বা প্রাপ্তবয়স্ক বুদ্ধিজীবী একত্র হলে সেটা বিপ্লবী প্রলেতারীয় দলে পরিণত হয় না। অগ্রসর শ্রমিক হল সেই শ্রমিক, যারা শ্রেণি সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে ধারাবাহিক সংগঠন নির্মাণের চেতনা অর্জন করেছে।
লি-র বইয়ের পর ম্যান্ডেল সম্পর্কে এই আলোচনা জরুরী, কারণ লি বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থার পথ ধরে যে কাজটা করেছেন, তা হল, তাঁর আগের সমস্ত গবেষক একেবারে ভুল, তিনিই প্রথম লেনিনকে বুঝেছেন, এরকম একটা আভাস দিতে চান। ফলে তিনি এক অতি সরল বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর মতে, লেনিনের বিকৃতি সাধন জিনোভিয়েভ বা স্তালিনের হাতে বেশী হয় নি। কেবল বুর্জোয়া পণ্ডিতরাই বিকৃতি করেছেন। আর এ যুগের "রাজনৈতিক কর্মী" (activist) লেখকরা সবাই একই রকম ভুল করেছেন। ওই অ্যাখ্যা দিয়ে তিনি ক্লিফ ও মলিনিউ-য়ের সঙ্গে ম্যান্ডেল বা লে ব্ল্যাঙ্ককেও জড়িয়ে ফেলেন।
লি-র অন্যতম বড় শক্তি হল ১৮৯০-এর দশকে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে কাউটস্কির মার্ক্সবাদের চরিত্র পর্যালোচনা করা। লি প্রশ্ন তুলেছেন, বিশ্বযুদ্ধে কাউটস্কির ভূমিকায় লেনিনে এত ক্রদ্ধ কেন ছিলেন? তার কারণ এর আগে কাউটস্কিই তাঁর কাছে আদর্শ মার্ক্সবাদী ছিলেন। অন্যভাবে বললে, লি-র মতে লেনিন ছিলেন প্রবল কাউটস্কিবাদী- কাউটস্কির যখন পদস্খলন, হল, লেনিন তখনও কাউটস্কির মূল নীতিই ধরে থাকলেন।
কি সেই মূলনীতি? একদিকে তা হল এক দৃঢ় বিশ্বাস, যে সমাজতান্ত্রিক চেতনা ও শ্রমিক আন্দোলনের মেলবন্ধন কাম্য ও সম্ভব। অন্যদিকে তা হল ক্ষমতার জন্য লড়াইয়ের কতকগুলি নির্দিষ্ট কৌশল ও নীতি। এরফুর্ট কর্মসূচীর ব্যাখ্যা থেকে ১৯০৯ পর্যন্ত কাউটস্কি যে বই ও প্রবন্ধগুলি লিখেছিলেন, তা বিপ্লবী রাজনীতি।
লি-র বক্তব্যে একটা বড় বাস্তবটা ধরা পরে। লেনিন, ত্রৎস্কী , লুক্সেমবুর্গ, প্রত্যেকেই কাউটস্কিকে বিপ্লবীদের নেতা মনে করতেন। তাই রুশ বিপ্লবের পরবর্তী কালে কাউটস্কির ভূমিকা দেখে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট মহল যেভাবে কাউটস্কির সব রচনা বর্জন করেছিল সেটা অনৈতিহাসিক।
কিন্তু লি যখন দাবী করেন যে লেনিন কাউটস্কির অনুগামী ছিলেন, তিনি তখন আবার পার্টি গঠন প্রক্রিয়াকে ঐতিহাসিক বিবর্তন থেকে প্রতর্কের স্তরে (discursive level) নিয়ে আসেন। এর ফলে, শুধু লে ব্ল্যাঙ্ক না, এলউডের গবেষণা, ভিক্টোরিয়া বনেলের গবেষণা, ও ১৯০২ থেকে ১৯১৭ পর্যন্ত শ্রেণি সংগ্রামের সঙ্গে পার্টি গঠনের আন্তঃসম্পর্কের দীর্ঘ কাহিনী মুছে যায়। যে রাশিয়াতে লেনিন জার্মানদের কাছ থেকে শেখা তত্ত্ব প্রয়োগ করছিলেন, সেই রাশিয়া জার্মানির হুবহু নকল ছিল না। ফলে লিকে অনুসরণ করে যদি মনে করাও হয় , যে লেনিন নিছক সাচ্চা কাউটস্কিবাদী ছিলেন, তাহলেও রাশিয়াতে যে পার্টি গড়ে উঠল তা অন্যরকম হতে বাধ্য ছিল। তাঁর রণনীতি, রণকৌশলের প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে অবশ্য বলা দরকার, লেনিন ২৭শে অক্টোবর ১৯১৪তে শ্লিয়াপ্লনিকভকে লেখা চিঠিতে বলেন, "রোজা লুক্সেমবুর্গ সঠিক ছিলেন যখন তিনি বহুদিন আগেই লিখেছিলেন, যে কাউটস্কির আছে 'তাত্ত্বিকের মত মাথা হেঁট করার অভ্যাস'- আরো সহজ ভাষায় দাসত্ব, পার্টির সংখ্যাগোষ্ঠীর দাসত্ব, সুবিধাবাদের কাছে দাসত্ব।"৯২
অর্থাৎ লেনিন ১৯১৪ সালে মনে করছিলেন, ১৯১০-১১তে যখন কাউটস্কি-লুক্সেমবুর্গের দ্বন্দ্ব হয়েছিল, তখন থেকেই কাউটস্কির রাজনীতি ভুল। লেনিন যেহেতু সেই পর্বের বলশেভিক রাজনীতি ত্যাগ করতে বলেন নি তাই বলশেভিকরা যে প্রয়োগ ক্ষেত্রে ভিন্ন ছিলেন তা বোঝা যায়।
এই ভিন্নতা রণনীতি-রণকৌশল থেকেই বুঝতে হবে। বর্তমান প্রবন্ধে আমরা রণনীতির পর্যালোচনা করছি না, বরং তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের বিতর্কটুকু দেখছি। রণনীতি ও কৌশলের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব বনাম নিরন্তর বিপ্লব বিতর্ক, এবং কৃষকের সঙ্গে সম্পর্ক। আর গুরুত্ত্বপূর্ণ ১৯১৭ সালে লেনিনের এপ্রিল থিসিস এবং তা নিয়ে কামেনেভ প্রমুখের সঙ্গে তাঁর বিতর্কের ইতিহাস।
এ ক্ষেত্রে নীল হার্ডিং-এর রচনা আবার গুরুত্বপূর্ণ চেষ্টা। হার্ডিং দেখাতে চেষ্টা করেছেন, লেনিন খুব ধ্রুপদী মার্ক্সবাদী ছিলেন, এবং প্রতি পদে দর্শন- অর্থনীতি- রাজনীতি এই ভাবে তাঁর বিশ্লেষণ এগোতো। তাঁর প্রথম অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের মূলে ছিল The Development of Capitalism in Russia. এই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তিনি সিদ্ধান্তে আসেন, রাশিয়াতে ধনতন্ত্র তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে যায় নি, তাই রুশ বিপ্লব হবে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। কিন্তু এখানে লেনিনের সঙ্গে মেনশেভিকদের মতভেদ দেখা দিল। মেনশেভিকরাও মনে করতেন, রুশ বিপ্লব হবে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। এ থেকে তাঁদের সিদ্ধান্ত হল বুর্জোয়া উদারপন্থীরা যতদূর যাবে, শ্রমিক শ্রেণি তার চেয়ে এগোতে পারবেনা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে লেনিনের নতুন করে হেগেল চর্চার পর আসে "টোট্যালিটি"র বর্গ গ্রহণ, এবং তার ফলে বিশ্ব ধনতন্ত্রের সামগ্রিক ব্যাখ্যা, যার থেকে এল সাম্রাজ্যবাদ তত্ত্ব। এর ফলে তিনি মনে করেন, বিশ্ব ধনতন্ত্র বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত, তাই একা রাশিয়া নয়, বিশ্ব বিপ্লবের অঙ্গ হিসেবেই রুশ বিপ্লব হবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব।
প্রশ্নটা ওঠে, লেনিন, লুক্সেমবুর্গ ও ত্রৎস্কী র অবস্থান নিয়ে । নর্মান গেরাস, মিশেল লোয়ি, ও কুণাল চট্টোপাধ্যায়ের আলোচনা দেখায় ত্রৎস্কী র ১৯০৫-৬-এর অবস্থান এবং লেনিন বা লুক্সেমবুর্গ ১৯১৭-র অবস্থানের সঙ্গে অভিন্ন ছিল।৯৩
এক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রিচার্ড ডে ও দানিয়েল গাইডো সম্পাদিত Witnesses to Permanent Revolution । ১৯০২ থেকে শুরু করে কাউটস্কি, রিয়াজনভ, পারভুস, ত্রৎস্কী , লুক্সেমবুর্গ, প্রমুখের বেশ কিছু প্রবন্ধকে একত্র করে তাঁরা দেখিয়েছেন, ১৮৪৮-এর বিপ্লবের সময়ে ও তার অভিজ্ঞতা থেকে মার্ক্স ও এঙ্গেলস মনে করেছিলেন, শ্রমিক শ্রেণির কাজ বুর্জোয়া বিপ্লবকে গণতন্ত্র আদায়ের স্বার্থ স্থায়ী করা,এবং তার ফলে ওই বিপ্লবের প্রলেতারীয় বিপ্লবে রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় এই ধারণা ফিরে আসে। একমাত্র ত্রৎস্কীই তা থেকে রাশিয়াতে প্রলেতারীয় বিপ্লবের বিজয়ের কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু অনেকেই মনে করেছিলেন, শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্ব ছাড়া বিপ্লব হবে না।৯৪ কাউটস্কির ১৯০২ থেকে ১৯০৭-এর মধ্যে ৭টি প্রবন্ধে দেখা যায়, ওই পর্যায়ে তিনি প্লেখানভের চেয়ে অনেক বামপন্থী ছিলেন, এবং রুশ শ্রমিক শ্রেণি যে রুশ বুর্জোয়া শ্রেণির চেয়ে অনেক বেশী বিপ্লবী, এ কথা স্পষ্ট করে বলেছিলেন। লেনিন ও ত্রৎস্কী দু'জনেই কাউটস্কির প্রবন্ধগুলি ব্যবহার করেন। তাঁদের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করেছেন চট্টোপাধ্যায়, লোয়ি, জন পিটার রবার্টস এবং ডগ লোরিমার।৯৫
চট্টোপাধ্যায় ও লোয়ির বক্তব্য ত্রৎস্কী বিশ্ববিপ্লবের প্রেক্ষিতে রাশিয়াকে রেখেছিলেন ১৯০৫ থেকেই। এই জন্য, বিশ্ব অর্থনীতি, বিশ্ববিপ্লবকে কেন্দ্রে রাখার ফলে ১৯১৭ সালে লেনিন একই অবস্থানে আসেন। লারস লি সাম্প্রতিক কিছু প্রবন্ধে এই মতের বিরোধিতা করে দাবী করেছেন, ১৯১৭তে কামেনেভ এবং লেনিনের মধ্যে পার্থক্যকে বাড়িয়ে দেখানোটা ত্রৎস্কী ও ত্রৎস্কীবাদীদের অতিরঞ্জন। ১৫ই মার্চ থেকে যে কামেনেভ ও স্তালিনের হাতে প্রাভদা বিশ্বযুদ্ধ বিরোধিতা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিল, তাকে তিনি গৌণ প্রসঙ্গ মনে করেন।
এখানে লি-র পদ্ধতির দুর্বলতা ধরা পড়ে। তিনি ঘটনার ইতিহাসে উৎসাহী না। তিনি অনেক বেশী উৎসাহী দলিলের সঙ্গে দলিল, প্রবন্ধের সঙ্গে প্রবন্ধ মেলানোতে। স্পষ্টত, এ এক নতুন বিতর্ক যা ভবিষ্যতে চলবে। বর্তমান সংকলনের অন্যত্র তা কিছুটা আলোচিত হবে।
তাহলে অবক্ষয় কেন?
স্পষ্টতই, রুশবিপ্লবের ইতিহাস আলোচনা ৭ই নভেম্বরে থামতে পারে না। বর্তমান সংকলনের প্রবন্ধগুলি ক্ষমতা দখল পেরিয়ে বেশিদূর যাবেনা। কিন্তু ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে কিছু কথা বলা দরকার। আমরা দেখেছি, দক্ষিণপন্থী ইতিহাসবিদরা মনে করেন, স্বৈরতন্ত্র কায়েম করা গোড়া থেকেই বলশেভিকদের লক্ষ্য ছিল। যদি সে কথা অস্বীকার করা হয়, তা হলে প্রশ্ন ওঠে, কেন অবক্ষয় হল, কেন স্তালিন যুগে শ্রমিক ও কৃষকদের উপর অত্যাচার হল, কেন পুরোনো বলশেভিকদের এত বড় অংশকে হত্যা করা হল, কেন এক দলীয় ব্যবস্থা থেকে গেল?
১৯২৩-২৪, অর্থাৎ বিপ্লবের মাত্র বছর ছয়েকের মধ্যে শ্রমিক শ্রেণির ডিক্টেটরশিপ পরিণত হল এক দলীয় শাসনে, এবং ক্রমে সেই দলের মধ্যেও তর্ক-বিতর্ক বন্ধ হতে থাকল। কেন সেটা ঘটল? ১৯১৯-এর গোড়ায় রোজা লুক্সেমবুর্গের মৃত্যু হয়। কিন্তু তার আগে তিনি সমস্যাটা খোলা চোখে দেখেছিলেন। তিনি বলেন, লেনিন, ত্রৎস্কী ও তাঁদের কমরেডরাই প্রথম এগিয়ে গেছেন, এবং সেই ঐতিহাসিক অর্থে ভবিষ্যত বলশেভিকবাদের, কিন্তু তিনিই সাবধান করে দেন, দেশে রাজনীতির উপর দমনপীড়ন এলে সোভিয়েতগুলি পঙ্গু হয়ে যাবে, সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র আসবে না।৯৬
অবক্ষয় কেন, কীভাবে হল তার বিভিন্ন মত আছে। কিন্তু গত কয়েক দশকে যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তা দেখায়, স্তালিন যুগকে সমাজতন্ত্র বলার অর্থ এক ভয়াবহ শ্রমিক-কৃষক দমনকারী ব্যবস্থাকে সমাজতন্ত্র বলা।৯৭
কিন্তু হঠাৎই কি স্তালিন ১৯৩০-এর দশকে বিপ্লবের গতি রুদ্ধ করলেন? নৈরাষ্ট্রবাদীদের রচনায়, যথা ব্রিন্টনের বইয়ে বলা হয়েছে বলশেভিকদের রাষ্ট্রবাদী চেতনার ফলে এটা গোড়া থেকে অনিবার্য ছিল। অন্যদিকে ভিক্টর সার্জ, এক নৈরাষ্ট্রবাদী যিনি কমিউনিস্ট হন, তিনি এ কথা অস্বীকার করেন। তিনি মনে করেছিলেন, বিভিন্ন সম্ভাবনা ছিল। গৃহযুদ্ধ বিপদ সৃষ্টি করল। কিন্তু তার পরও এক প্রতিবিপ্লবের দরকার ছিল, যা ছাড়া বিপ্লবের প্রতিশ্রুতিগুলিকে উপড়ে ফেলা যেত না।৯৮
এই প্রক্রিয়াটা দেখা জরুরি। আলেকজান্ডার রাবিনোউইচের তৃতীয় বই ক্ষমতাশীল বলশেভিকদের প্রথম বছরকে তুলে ধরেছে, দেখিয়েছে, তাঁরা কোনো পূর্ব পরিকল্পনা নিয়ে ক্ষমতা দখলও করেন নি, উপর থেকে নীতি চাপাতেও যান নি।৯৯
চার-পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের প্রসঙ্গ তুলে এই আলোচনা শেষ করব। স্যামুয়েল ফার্বার দাবী করেছেন, প্রধানত বলশেভিকরা যে পথ বেছে নিয়েছিলেন, তার ফলেই স্তালিনবাদের উত্থান হয়েছিল।১০০ ফার্বারের প্রধান ত্রুটি, তিনি গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতাকে আদৌ আলোচনায় আনতে পারেননি।
সোমা মারিকের বইয়ের শেষ দুটি অধ্যায়ে গৃহযুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, তিনি দেখান, তা্র মধ্যেও, বলশেভিক নেতাদের দায়িত্ব ছিল। অনেকসময় বিপ্লবের লাভগুলি রক্ষা করতে তাঁদের আপৎকালীন ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল, যার হয়ত কোনো বিকল্প ছিল না। কিন্তু ওই ব্যবস্থাকে বিপ্লবের অগ্রগতি বলা ছিল ক্ষতিকর। বিশেষ করে, জর্জ লেগেটের১০১ গবেষণার উপর ভিত্তি করে মারিকের বক্তব্য, লাল সন্ত্রাস একরকম, কিন্তু সন্ত্রাসকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার অর্থ জনগণের ক্ষমতা নয়, বরং নতুন এক রাষ্ট্রদানব তৈরী করা, যে আদৌ ক্ষয়ে যেতে শুরু করবেনা, বরং আরো তীব্র হবে।
কেভিন মারফি১০২ এবং সাইমন পিরানি১০৩ রুশ বিপ্লবের অবক্ষয় ও শ্রেণি সংগ্রামের ওঠানামা দেখিয়েছেন নেপ-এর গোড়ার দিক পর্যন্ত. নেপ কীভাবে মজুরিকে ফিরিয়ে আনল, অথচ ট্রেড ইউনিয়নদের ক্ষমতা খর্ব করা হল, সেটা তাঁদের গবেষণার অন্যতম অঙ্গ।
কিন্তু ১৯২০-এর দশকের শেষ দিকে গুণগত পরিবর্তন হল। স্তালিন ক্ষমতা কুক্ষিগত করা, শ্রমিক ও কৃষকের উপর হিংস্র যুদ্ধ, পুরনো বলশেভিক পার্টিকে রক্তের স্রোতে খতম করা, এগুলি অন্য পর্যায়ের ঘটনা। তাই ১৯২০-এর দশকের শেষদিকে এক ধরণের রাজনৈতিক প্রতিবিপ্লব ঘটেছিল, এ কথা বলা যায়। তার চরিত্র, এবং তার ফলে সৃষ্ট আমলা-শাসিত রাষ্ট্রের চরিত্র, এক স্বতন্ত্র বিতর্কের ও স্বতন্ত্র আলোচনার বিষয়। তবে মার্শেল ফান ডের লিন্ডেন সেই বিতর্কের একটি দীর্ঘ পর্যালোচনা ইতিমধ্যেই করে রেখেছেন।১০৪ বর্তমান গ্রন্থের যে দৃষ্টিকোণ, তা মোটামুটি ট্রটস্কীর দ্য রেভল্যুশন বিট্রেড১০৫, এবং আর্নেস্ট ম্যান্ডেল১০৬ ও টম টুইসের১০৭ গবেষণা অনুসরণ করে চলেছে। এছাড়া উল্লেখ করা যায় ক্লিফ, বেতেলহাইম, মিখাল রেইম্যান প্রমুখের কথা, এবং বিভিন্ন ধাঁচের মার্ক্সবাদী বিশ্লেষণেরর কথা।১০৮
টীকাঃ
১। Eric Hobsbawm, ‘Can we write the History of the Russian Revolution?’, in Eric Hobsbawm, On History, The New Press, New York, 1997, p. 242.
২। Louise Bryant, Six Months in Red Russia, The Journeyman Press, London, 1982 (reprint).
৩। Bessie Beatty, The Red Heart of Russia, The Century Co., New York, 1918, pp. 479-480.
৪। https://www.marxists.org/archive/lenin/works/1919/dec/31.htm বাংলা অনুবাদ আমার।
৫। George Orwell, ‘The Freedom of the Press, Orwell’s Proposed Preface to Animal Farm’, online: orwell.ru/library
৬। P. Miliukov, Political Memoirs, 1905-1917 (Edited by A.P. Mendel, translated by C. Goldberg), University of Michigan Press, Ann Arbor, 1967; Anton Ivanovich Denikin, The Russian Turmoil – Memoirs: Military, Social and Political, Hutchinson and Company, London, 1922; Alexander Kerensky, The Catastrophe: Kerensky’s Own Story of the Russian Revolution, D. Appleton and Company, New York, 1927; and N. N. Sukhanov, The Russian Revolution 1917: A Personal Record (edited and condensed in translation by Joel Carmichael), Oxford University Press, Oxford, 1955.
৭। Leon Trotsky, History of the Russian Revolution to Brest Litovsk, George Allen and Unwin, London, 1919.
৮। Alexander Shlyapnikov, On the Eve of 1917, Alison and Busby, London and New York, 1982; এবং A. G. Shliapnikov, Semnadsatyi god, http://revarchiv.narod.ru/shliapnikov/oeuvre/1917.html
৯। Frederick C. Corney, Trotsky’s Challenge, Haymarket Books, Chicago 2017, ইংরেজীতে এই প্রথম ঐ বিতর্কের গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধগুলি একসঙ্গে এনেছে।
১০। I. I. Mints, Istoriia Velikogo Oktyabrya, volumes 1-3, Moscow, Izdatel'stvo Nauka, 1967-1972.
১১। W. H. Chamberlin, The Russian Revolution, 1917-1921, Princeton University Press, Princeton, New Jersey, 1987.
১২। উপরে উল্লিখিত বইয়ের পিছনের মলাটে ফিটজপ্যাট্রিকের মন্তব্য।
১৩। L. Trotsky, The History of the Russian Revolution, Aakar Books, New Delhi , 2014, with a new introduction by Kunal Chattopdhyay and Soma Marik.
১৪। L. Trotsky, My Life: An Attempt at an Autobiography, Charles Scribner’s Sons, New York, 1930; L. Trotsky, The Stalin School of Falsification, Pathfinder Press, New York, 1979.
১৫। Bertram D. Wolfe, An Ideology in Power: Reflections on the Russian Revolution, Stein and Day, New York, 1970; Bertram D. Wolfe, Three Who Made a Revolution, Dial Press, Washington, 1948. Stephen F. Cohen, ‘Bolshevism and Stalinism’, in Robert C. Tucker (Editor), Stalinism: Essays in Historical Interpretation, revised edition, Transaction Publishers, New Brunswick and London, 1999.
১৬। Bertram D. Wolfe, An Ideology in Power: Reflections on the Russian Revolution, pp 187, 188.
১৭। Alfred G. Meyer, Leninism, Frederick A Praegar, New York, 1962, p. 282.
১৮। Robert Vincent Daniels, The Conscience of the Revolution: Communist Opposition in Soviet Russia, Simon and Schuster, New York, 1969, p. 410.
১৯। Leonard Schapiro, The Origins of the Communist Autocracy, G. Bell and Sons, London, 1955
২০। Richard Pipes, The Russian Revolution, Vintage Books, London and New York, 1990; Richard Pipes, Russia Under the Bolshevik Regime 1919-1924, Harvill, London, 1994; Richard Pipes, (Ed), The Unknown Lenin: From the Secret Archives, Yale University Press, New Haven and London, 1996.
২১। Arno Meyer, The Persistence of the Old Regime: Europe to the Great War, Verso, London 2010 (originally published 1981).
২২। Richard Pipes, Russia Under the Bolshevik Regime 1919-1924, p. 63.
২৩।ব্রিটিশ হস্তক্ষেপের সেনাপ্রধানের নিজের স্মৃতিচারণের জন্য দ্রষ্টব্য Major General C. B. Dunsterville, The Adventures of Dunsterforce, Edward Arnold, London, 1920.
২৪। গৃহযুদ্ধের জন্য দ্রষ্টব্য, Mark von Hagen, Soldiers in the Proletarian Dictatorship: The Red Army and the Soviet Socialist State, 1917-1930, Cornell University Press, Ithaca, 1990; Evan Mawdsley, The Russian Civil War, Allen and Unwin, Boston, 1987; W. Bruce Lincoln, Red Victory: A History of the Russian Civil War, Touchstone, New York, 1989; John Ericson, The Soviet High Command 1918-1941, St Marin’s Press, London, 1962; Peter Kenez, Civil War in South Russia, 1919-1920, University of California Press, Berkeley, 1977.
২৫। Richard Pipes, Russia Under the Bolshevik Regime 1919-1924, p. 56.
২৬। Ibid., pp. 146, 151.
২৭। Richard Pipes, The Russian Revolution, p. 792
২৮। ফিনল্যান্ড সম্পর্কে দ্রষ্টব্য Victor Serge, Year One of the Russian Revolution, www.marxistorg/archive/serge/1930/year-one
২৯। R.P. Browder and A. F. Kerensky (Eds), The Russian Provisional Government , 1917: Documents, 3 volumes, Stanford University Press, Stanford, 1961.
৩০। Allan K. Wildman, The Making of a Workers’ Revolution: Russian Social Democracy, 1891-1903, Chicago University Press, Chicago, 1967; Solomon Schwarz, The Russian Revolution of 1905, The Workers Movement and the Formation of Bolshevism and Menshevism, Chicago University Press, Chicago, 1967; Leo Haimson (Ed), The Mensheviks from the Revolution of 1917 to the Second World War, Chicago University Press, Chicago, 1974.
৩১। E. H. Carr, The Bolshevik Revolution 1917-1923, a History of Soviet Russia, vol. 1, MacMillan, New York, 1951; vol.2, MacMillan, New York, 1952; Vol. 3, MacMillan, New York, 1953; E. H. Carr, The Interregnum 1923-1924, MacMillan, New York, 1954.
৩২। কারের ১৪ খন্ডই প্রকাশ করেছিল ম্যাকমিলান, ১৯৭৮ পর্যন্ত। তাঁর গবেষণার সংক্ষিপ্তসারের জন্য দ্রষ্টব্য E. H. Carr, The Russian Revolution from Lenin to Stalin 1917-1929, Palgrave MacMillan, New York, 2004. কারের গবেষণা প্রসংগে আলোচনার জন্য দেখুন Jonathan Haslam, The Vices of Integrity: E. H. Carr 1892-1982, Verso, London, 2000; Michael Cox (Ed), E. H. Carr, A Critical Appraisal, Palgrave MacMillan, New York, 2000.
৩৩। Isaac Deutscher, Stalin: A Political Biography, Oxford University Press, Oxford, 1949. For the revised edition covering Stalin’s last years see Stalin: A Political Biography, Pelican, London, 1966.
৩৪। L. Trotsky, The Revolution Betrayed, Pathfinder Press, New York, 1972.
৩৫। Isaac Deutscher, Russia After Stalin, Hamish Hamilton, 1953; Isaac Deutscher, The Unfinished Revolution: Russia 1917-1967, Oxford University Press, Oxford 1967.
৩৬। Isaac Deutscher, The Prophet Armed: Trotsky, 1879-1921, Oxford University Press, Oxford, 1954; Isaac Deutscher, The Prophet Unarmed: Trotsky, 1921-1929, Oxford University Press, Oxford, 1959; Isaac Deutscher, The Prophet Outcast: Trotsky, 1929-1940, Oxford University Press, Oxford, 1963.
৩৭। Robert Service, Trotsky: A Biography, MacMillan, London, 2009; Goeffrey Swain, Trotsky, Pearson Longman, London, 2006; Ian D. Thatcher, Trotsky, Routledgee, London, 2003
৩৮। Lawrence Daly, ‘A Working Class Tribute’, in David Horowitz (Ed), Isaac Deutscher: The Man and His Work, MacDonald and Company, London, 1971.
৩৯। Robert C. Tucker, Stalin As Revolutionary: 1879-1929, W.W. Norton and Co., New York, 1988; Robert C. Tucker, Stalin in Power: The Revolution from Above, 1928-1941, W.W. Norton and Co., New York, 1990.
৪০। Stephen Cohen, Bukharin and the Bolshevik Revolution: A Political Biogtraphy, 1888-1938, Oxford University Press, 1980.
৪১। Marcel Liebman, Leninism under Lenin, Jonathan Cape, London, 1975.
৪২। Moshe Lewin, Russian Peasants and Soviet Power, W.W. Norton and Co., New York, 1975; Moshe Lewin, Lenin’s Last Struggle, (originally published 1968), New Edition with a new introduction by the author, Michigan University Press, Ann Arbor, 2005; and Moshe Lewin, The Making of the Soviet System: Essays in the Social History of Interwar Russia, The New Press, New York, 1994.
৪৩। Israel Getzler, Martov: A Political Biography of a Russian Social Democrat, Cambridge University Press, Cambridge, 1967.
৪৪। Samuel H. Baron, Plekhanov: The Father of Russian Marxism, Stanford University Press, Stanford, 1963.
৪৫। Abraham Ascher, Pavel Axelrod and the Development of Menshevism, Harvard University Press, Cambridge, Mass., 1972.
৪৬। O. H. Radkey, The Agrarian Foes of Bolshevism: Promise and Default of the Russian Socialist Revolutionaries, February to October 1917, Columbia University Press, New York, 1962; O. H. Radkey, The Sickle Under the Hammer: The Russian Socialist Revolutionaries in the Early Months of Soviet Rule, Columbia University Press, New York, 1964.
৪৭। Paul Avrich, The Russian Anarchists, Princeton University Press, Princeton, 1971.
৪৮। Maurice Brinton, The Bolsheviks and Workers’ Control: The State and Counter-Revolution, Solidarity, London, 1970.
৪৯। Alexander Rabinowitch, Prelude to Revolution, Indiana University Press, Bloomington, 1968; Alexander Rabinowitch, The Bolsheviks Come to Power: The Revolution of 1917 in Petrograd, Norton, New York, 1976.
৫০। Ronald G. Suny, ‘Toward a Social History of the October Revolution’, American Historical Review, Vol. 88, No. 1, February 1983; Daniel H. Kaiser, ed., The Workers’ Revolution in Russia 1917, Cambridge University Press, Cambridge, 1987; Victoria E. Bonnell, Roots of Rebellion, Harvard University Press, Cambridge, Mass., 1983; Rose Glickmann, Russian Factory Women: Workplace and Society, 1880-1914, University of California Press, Berkeley, Los Angeles and London, 1984; Diane Koenker, Moscow Workers and the 1917 Revolution, Princeton University Press, Princeton, N.J., 1981; Steve Smith, Red Petrograd, Cambridge University Press, Cambridge, 1983; Donald J. Raleigh, Revolution on the Volga: 1917 in Saratov, Cornell University Press, Ithaca, N.Y., 1986; Rex Wade, ‘Workers’ Militia and thre Red Guard’, in R. C. Elwood Ed., Reconsiderations on the Russian Revolution, Columbia, Ohio, 1976; David Mandel, The Petrograd Workers and the Fall of the Old Regime, St. Martin’s Press, New York, 1983; David Mandel, The Petrograd Workers and the Soviet Seizure of Power, Macmillan, London, 1984; Leopold H. Haimson, ‘The Problem of Social Stability in Urban Russia: 1905-1917’, pts 1 and 2, Slavic Review, Vol. 23 No.4, December 1964 and Slavic Review, Vol. 24, No. 1, March 1965; Leopold H. Haimson, ‘The Problem of Social Identities in Early Twientieth Century Russia’, Slavic Review, Vol. 47, No. 1, Spring 1988.
৫১। Diane P. Koenker, William G. Rosenberg, Srikes and Revolutuon in Russia, 1917, Princeton University Press, Princeton, N.J., 2014. [originally a long article in the 1980s].
৫২। J. Arch Getty, Origins of Great Purges: The Soviet Communist Party Reconsidered, 1933-1938, Cambridge University Press, Cambridge, 1985; J. Arch Getty, and Oleg V. Naumov, The Road to Terror: Stalin and the Self-Destruction of the Bolsheviks, 1932-1939, Yale University Press, New Haven, 1999.
৫৩। Sheila Fitzpatrick, The Russian Revolution, Oxford University Press, 1994, pp.8-9; Getty and Naumov, p. 14.
৫৪। Barbara C. Allen, Alexander Shlyapnikov, 1885-1937, Haymarket Books, Chicago, 2016. এছাড়া এই শ্রমিক বলশেভিকদের নিজেদের রচনার জন্য R.E. Zelnik (Tr. and Ed.), A Radical Worker in Tsarist Russia: The Autobiography of Semen Ivanovich Kanatchikov, Stanford University Press, Stanford, 1986; R. E. Zelnik (Ed.), Workers and Intelligentsia in Late Imperial Russia: Realities, Representations Reflections, University of California Press, Berkeley, CA, 1999; Mark Steinberg, Proletarian Imagination: Self, Modernity and the Sacred in Russia, 1910-25, Cornell University Press, Ithaca, NY, 2002.
৫৫। Paul Le Blanc, ‘Making Sense of October 1917’, in Fred Leplat (Ed), October 1917: Workers in Power, The Merlin Press Ltd., London, 2016, pp. 12-13.
৫৬। Ibid., p. 12.
৫৭। Richard Stites, The Women’s Liberation Movement in Russia: Feminism, Nihilism and Bolshevism, 1860-1930, Princeton University Press, Princeton, N.J., 1978.
৫৮। Gail Warshofsky Lapidus, Women in Soviet Society: Equality, Development and Social Change, University of California Press, Berkeley, CA, 1978.
৫৯। Tony Cliff, Class Struggle and Women’s Liberation: 1640 to the Present Day, Bookmarks, London (Second Printing), 1987, pp. 67-109, 138-152.
৬০। Ibid., p. 107.
৬১। এ প্রসঙ্গে বহু আলোচনা হয়েছে গত চার দশকে। উৎসাহী পাঠক-পাঠিকারা দেখতে পারেন Anne Bobroff, ‘The Bolsheviks and Working Women 1905-1920’, Soviet Studies, Vol. 26, No.4, October 1974; Moira Donald, ‘Bolshevik Activity Amongst the Working Women of Petrograd in 1917’, International Review of Socil History, Vol. 27, 1982; Barbara Evans Clements, Bolshevik Women, Cambridge University Press, Cambridge, 1997; Jane McDermid and Anna Hillyar, Midwives of the Revolution: Female Bolsheviks and Women Workers in 1917, Taylor and Francis, London, 1999, Soma Marik, ‘Gendering the Revolutionary Party: The Bolshevik Practice and Challenges before the Marxists in the 21st Century’. In B. Chatterjee and K. Chattopadhyay (Eds.) Perspectives on Socialism. Progressive Publishers, Kolkata, 2004.
৬২। Tony Cliff, Lenin, Vol 1, Building the Party, Bookmark, London, 1975, Tony Cliff , Lenin Vol 2 All Power to the Soviets, Bookmark, London, 1977; Ernest Mandel, October 1917, Coup d’etat or Social Revolution, IIRE, Montreal, 1992
৬৩। Soma Marik, Reinterrogating the Classical Marxist Discourses of Revolutionary Democracy, Aakar, New Delhi, 2008
৬৪। Soma Marik, ‘German Socialism and Women’s Liberation’, in A. Chanda, M. Sarkar, and K. Chattopadhyay (Eds), Women in History, Progressive Publishers, Kolkata, 2003.
৬৫। Soma Marik, Reinterrogating…, p.331
৬৬। Barbara Evans Clements, Bolshevik Feminist: The Life of Alexandra Kollontai, Indiana University Press, Bloomington and London, 1979; Cathy Porter, Alexandra Kollontai, Merlin, London, 2013, (2nd edition, original 1980); Beatrice Farmsworth, Alexandra Kollontai: Socialism, Feminism and the Bolshevik Revolution, Stanford University Press, Stanford, 1980.
৬৭. Ralph Carter Elwood, Inessa Armand: Revolutionary and Feminist, Cambridge University Press, Cambridge, 1992; Bertram D. Wolfe, Lenin and Inessa Armand’, Slavic Review, March 1963
6৮. R.H. McNeal, Bride of the Revolution: Krupskaia and Lenin, Victor Gollanez Ltd, London, 1973, Katy Turton, Forgotten Lives: The Role of Lenin’s Sisters in the Russian Revolution, 1864-1937, Palgrave Macmillan, London, 2007.
৬৯। L. Trotsky, ‘Our Differences’, in L. Trotsky, 1905, https://www.marxists.org/archive/trotsky/1907/1905/ch25.htm (accessed on 26 May 2018).
.৭০। Richard Pipes, Russia Under the Old Regime, Penguin Books, Harmondsworth, 1995 (original publication 1974)
৭১। Geroid T. Robinson, Rural Russia Under the Old Regime: A History of the Landlord-Peasant World and a Prologue to the Peasant Revolution of 1917, Macmillan, New York, 1961 (original publication, 1932)
৭২। John Eric Marot, The October Revolution in Prospect and Retrospect: Intervention in Russian and Soviet History, Brill, Leiden, 2012
৭৩। Helene Carriere d’Eneausse, Central Asia, a Century of Russian rule, Columbia University Press, 1967; Helene Carriere d’Eneausse, The great challenge: nationalism and the Bolshevik state 1917-1930, Holmes and Meier, New York, 1992; Stuart R. Schram, Marxism and Asia: An introduction with readings, Allen Lane, London, 1969; Edward A Alworth and Alexandre Bennigsen, Soviet Nationality Problems, Columbia University Press, 1971
৭৪। R. Vaidyanath, The Formation of The Soviet Central Asian Republics 1917-1936, People’s Publishing House, Delhi, 1967; Nandini Bhattacharya, Dueling Isms: Soviet and Regional Identity in Central Asia, Shipra Publications, Delhi, 2008
৭৫। Ronald G. Suny, The Baku Conmune 1917-1918, Princeton University Press, Princeton, 1972; Marc Ferro, The Bolshevik Revolution: A Social History of the Russian Revolution, Routledge and Kegan Paul, London, 1985, p. 98
৭৬।Geoffrey A. Hosking, The Russian Constitutional Experiment: Government and the Duma, 1907-1914, Cambridge University Press, Cambridge, 1973; George L. Yaney ‘The Concept of Stolypin Land Reform’, Slavic Review, Vol.23, No.2, June, 1964
৭৭। John Channon, ‘The Peasantry in the Revolution of 1917’, in E.R.Frankel et al (Eds), Revolution in Russia: reassessments of 1917; Cambridge University Press, Cambridge, 1992; I.A. Owen, The Russian Peasant Movement 1907-1917, P.S. King, London, 1937
৭৮। Aaron B. Retish, Russia’s Peasants in Revolution and Civil War: Citizenship, Identity and the Creation of the Soviet State, 1914-22, Cambridge University Press, New York, 2008
৭৯। Barbara Evans Clement, “Working Class and Peasant Women in the Russian Revolution, 1917-1923, Signs, Vol.8, No.2, Winter 1982, pp 215-235
78. John Plamenatz, German Marxism and Russian Communism, Longman Green, London, 1954, pp 225-6
79. যে বইগুলি এখনো উল্লিখিত নয়, সেগুলি হল Leopold Haimsen, The Russian Marxists and the Origins of Bolshevism, Harvard University Press, Boston, 1955; Adam Ulam, Lenin and the Bolsheviks, Penguin, Harmondsworth, 1969; J.L.H.Keep The Rise of Social Democracy in Russia , Oxford, 1963; Alan Wildman, The Making of a Worker’s Revolution, Chicago University Press, Chicago, 1967; Alfred G. Meyer, Leninism, Praeger, New York, 1962.
80. David Lane, Leninism: A Sociological Interpretation, Cambridge University Press, Cambridge, 1981; David Lane, The Roots of Russian Communism, Van Gorcum, Assen, 1969, p.40
৮১। Reginald E.Zelnik, ‘A Paradigm Lost? Response to Anna Krylova’, Slavic Review , Vol.62, No.1, 2003, pp.24-33; and Reginald E.Zelnik, ‘Worry about Workers:Consensus of the Russian Intelligensia from the 1870s to What Is To Be Done?” in Marsha Seinfert (Ed) Extending borders of Russian History, Central European University Press, Budapest, 2003
৮২। Richard Pipes, ‘The Origins of Bolshevism’ in Richard Pipes (Ed), Revolutionary Russia, Harvard University Press, Cambridge, Mass., 1968, p.49.
83. “It is argued that Lenin…“lost faith” in the spontaneous mass movement, despaired it ever attaining socialist consciousness and concluded that the revolution would have to be engineered by a professional elite. This interpretation…raises, however, considerable, indeed insuperable problems for anyone who actually reads and attempts to make sense of Lenin’s writings.” Neil Harding, Lenin’s Political Thought: Theory and Practice in the Democratic and Socialist Revolution, Humanities Press, New York, 1983, pp.156-7.
84. G.Zinoviev, History of the Bolshevik Party, New Park, London, 1983.
85. N.Trotskii, Nashi politischeskie zadachi (takaticheskie; organizatsionnye vopresy), Izdanie Sotsialdemokraticheskoi Robochei Partii, Geneva, 1904; L.Trotsky, Our Political Tasks, New Park, London, 1980; L.Trotsky, My Life: An Attempt at an Autobiography, Penguin, Harmondsworth, 1975
86. T.Cliff, Lenin, Vols 1 & 2, বিশেষ করে দ্বিতীয় খণ্ডের মুখবন্ধ।
87. J.Molyneux, Marxism and the Party, Pluto, London, 1978
88. Ernest Mandel, The Leninist Theory of Organisation, Antar Rashtriya Prakashan, Baroda, 1977
89. Paul Le Blanc, Lenin and the Revolutionary Party, Humanities Press, 1990.
90. Achin Vanaik, ‘In Defence of Leninism’, Economic and Political Weekly, September 13, 1986
৯১। Lars.T.Lih, Lenin Rediscovered, Haymarket Books, Chicago, 2008
৯২। V.I. Lenin, Collected Works, Volume 35, Progress Publisher, Moscow, 1976, p.167
৯৩। Norman Geras, The Legacy Of Rosa Luxemburg, Verso, London,1976; Michael Lowy, The Politics of Combined and Uneven Development , Verso, London, 1981; Kunal Chattopadhyay, Leninism and Permanent Revolution, Antar Rashtriya Prakashan, Baroda, 1987; Kunal Chattopadhyay, The Marxism of Leon Trotsky, Progressive Publisher, Kolkata, 2006.
৯৪। Richard B.Day and Daniel Gaido, Witnesses to Permanent Revolution: The Documentary Record Haymarket Books, Chicago, 2010.
৯৫। Doug Lorimer, Trotsky’s Theory of Permanent Revolution: A Leninist Critique, Resistance Books, Sydney, 1998; John Peter Roberts, Leon Trotsky and the Theory of the Permanent Revolution, Wellred Publication, London, 2007.
৯৬। Rosa Luxemburg, ‘The Russian Revolution’, in Mary-Alice Waters, (Ed), Rosa Luxemburg Speaks, Pathfinder Press, New York, 1970.
৯৭। Tariq Ali (Ed) The Stalinist Legacy: Its Impact On Twentieth Century World History, Haymarket Books, Chicago, 2013; Lynn Viola, Peasant Rebels Under Stalin: Collectivization and the Culture of Peasant Resistance, Oxford University Press, Oxford, 1999; Lynn Viola, (Ed), Contending With Stalinism, Soviet Poer and Popular Resistance on the 1930s, Cornell University Press, Ithaca, 2002; Donald Filtzer, Soviet Workers and Stalinist Industrialisation, Pluto, London, 1987, Vadim Rogovin, 1937: Stalin’s Year of Terror, Mehring Books, 1998; Vadim Rogovin, Stalin's Terror of 1937-1938: Political Genocide in the USSR , Mehring Books, 2009, and books cited earlier।
৯৮। Victor Serge, Year One Of The Russian Revolution, London, 1992; Victor Serge, Memoirs of a Revolutionary, 1901-1941, London, 1963.
৯৯। Alexander Rabinowitch, The Bolshevik in Power: The First Year of Soviet Rule in Petrograd, Indiana University Press, Bloomington, 2008.
১০০। Sam Farber, Before Stalinism: The Rise and Fall of Soviet Democracy, Verso, London, 1990.
১০১। G.Leggett, The Cheka: Lenin’s Political Police, Oxford University Press, Oxford, 1987
১০২। Kevin Murphy, Revolution and Counter-Revolution:Class Struggle in a Moscow Metal Factory, Haymarket Books, Chicago, 2007
১০৩। Simon Pirani, The Russian Revolution in Retreat, 1920-24: Soviet Workers and the New Communist Elite, Routeledge, London, 2008
১০৪। Marcel van der Linden, Western Marxism and the Soviet Union: A Survey of Critical Theories and Debates since 1917, Haymarket Books, Chicago, 2009
১০৫। Leon Trotsky, The Revolution Betrayed, Pathfinder Press, New York, 1987.
১০৬। Ernest Mandel, Power and Money: A Marxist Theory of Bureaucracy, Verso, London, 1992.
১০৭। Thomas M. Twiss, Trotsky and the Problem of Soviet Democracy, Haymarket Books, Chicago, 2015.
১০৮। Tony Cliff, State Capitalism in Russia, Pluto, London, 1974; Charles Bettelheim, Class Struggles in the USSR, First Period, 1917-1923, Monthly Review Press, New York, 1976; Second Period, 1923-30, New York, 1978; Third Period, 1930-1941, T. R. Publications, Madras, 1994; M. Reiman, Birth of Stalinism: The USSR on the Eve of the Second Revolution, Indiana University Press, Bloomington, 1987.
(লেখাটি র্যাডিক্যাল সোশালিস্ট পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। রুশ ইতিহাস চর্চায় প্রবন্ধটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে বলে এটি আমরা পুনঃপ্রকাশ করছি।)