বিপ্লবোত্তর রাশিয়া : ১৯১৭ – ১৯২৩

১৯০৫ এর মতো ১৯১৭ র ফেব্রুয়ারি বিপ্লবও ছিল বুর্জোয়া বিপ্লব। কিন্তু ১৯০৫ এর বিপ্লবের সময় যে দ্যুমা বা রাশিয়ান পার্লামেন্ট তৈরি হয়, তা ছিল জারের নিয়ন্ত্রণাধীন। ১৯১৭ র ফেব্রুয়ারিতে জার দ্বিতীয় নিকোলাসকে অপসারিত করে রাশিয়ায় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হল। কেরেনেস্কি প্রথমে এই সরকারের আইনমন্ত্রী ছিলেন, তারপর প্রধানমন্ত্রী হন। আত্মগোপনে থাকা বলশেভিক, মেনশেভিক ও সোশ্যাল রেভেলিউশনারিরা এইসময় পেত্রোগ্রাদে ফিরতে শুরু করলেন। প্রথম যে দুজন সুপরিচিত বলশেভিক নেতা পেত্রোগ্রাদে ফেরেন – কামেনেভ ও স্তালিন - তাঁরা কেরেনেস্কি সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া করা ও সরকারকে সাহায্য সহযোগিতা করার পক্ষে ছিলেন। এপ্রিলের শুরুতে লেনিন সুইজারল্যাণ্ডের নির্বাসন দশা থেকে গোপনে পেত্রোগ্রাদে ফিরলেন এবং তারপরেই পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে মোড় নিল। লেনিন তাঁর এপ্রিল থিসিসের মধ্যে দিয়ে কেরেনেস্কি সরকারের সঙ্গে সমঝোতার নীতি থেকে বলশেভিকদের বের করে আনলেন এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য এগনোর নীতি নিলেন।

প্রধানমন্ত্রী কেরেনেস্কি ও রুশ পার্লামেন্টের অধিকাংশ সদস্যসহ রাশিয়ার প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দল যুদ্ধ চালিয়ে যাবার পক্ষে ছিলেন। তাঁরা মনে করেছিলেন যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে এলে তা রাশিয়ার স্বার্থ ও মর্যাদার পক্ষে ক্ষতিকারক হবে। একমাত্র লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরাই যুদ্ধ বন্ধ করা ও রাশিয়াকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসার কথা, শান্তির কথা বলতে থাকেন। রুশ সেনাবাহিনীর মধ্যে বলশেভিকদের প্রভাব ও সমর্থন বাড়তে থাকে।

কেরেনেস্কির শাসনের সময়েই স্থানীয়ভাবে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সংস্থাগুলির প্রভাব ছিল যথেষ্ট। এই স্থানীয় সংস্থাগুলি পরিচিত ছিল সোভিয়েত নামে। ১৯১৭ র জুন মাসে সারা রাশিয়া সোভিয়েতগুলির প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। আটশোর বেশি প্রতিনিধির মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রতিনিধি ছিল সোশ্যালিস্ট রেভেলিউশনারিদের – ২৮৫ জন। মেনশেভিকদের ছিল ২৪৮ জন। বলশেভিকদের ছিল ১০৫ জন।

সেপ্টেম্বরে কেরেনেস্কি সরকারের বিরুদ্ধে একটি মিলিটারি ক্যু সংগঠিত করে ক্ষমতা দখল করতে চান সেনাপতি কার্ণিলভ। কেরেনেস্কি এই ক্যু এর বিরুদ্ধে বলিষ্ঠভাবে লড়তে না পারলেও বলশেভিকরা এর বিরুদ্ধে প্রবল লড়াই গড়ে তুলল এবং কার্ণিলভকে পরাস্ত করল। এই লড়াই বলশেভিকদের জনপ্রিয়তা অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। বলশেভিক পার্টির সুপরিচিত দাবি ও স্লোগান ছিল ‘অল পাওয়ার টু দ্য সোভিয়েতস”। সোভিয়েতগুলিতে বলশেভিক নিয়ন্ত্রণ কম থাকার সময় খানিকটা পেছনে সরে যাওয়া এই স্লোগানকে নতুন পরিস্থিতিতে আবার সামনে আনেন লেনিন। কেরেনেস্কি সরকার লেনিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করায় তাঁকে আত্মগোপনে থাকতে হচ্ছিল। গোপনেই অক্টোবরে লেনিন এলেন পেত্রোগ্রাদে, বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে। এই কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে দুজন সদস্য – কামেনেভ ও জিনোভিয়েভ বাদে বাকিরা ক্ষমতা দখলের পক্ষে রায় দিলেন। একটি বিপ্লবী মিলিটারি কমিটির ওপর এর প্রস্তুতির দায়ভার ন্যস্ত হল এবং এই কমিটির প্রধান দায়িত্বে ছিলেন ট্রটস্কি। ট্রটস্কির নেতৃত্বে মূলত কারখানার শ্রমিকদের অগ্রণী অংশকে নিয়ে তৈরি এই বিপ্লবী কমিটি ৭ নভেম্বর (পুরনো রুশ ক্যালেন্ডার অনুসারে ২৫ অক্টোবর) পেত্রোগ্রাদের মূল সরকারী ভবনগুলির দখল নিল ও শীত প্রাসাদের দিকে এগোতে থাকল। অরোরা জাহাজের নিশানার মধ্যে ছিল শীত প্রাসাদ, যে জাহাজ ছিল এই বিপ্লবী মিলিটারি কমিটির নিয়ন্ত্রণে। প্রায় কোনও প্রতিরোধ ছাড়াই প্রভিন্সিয়াল সরকার আত্মসমর্পণ করল এবং কেরেনেস্কি পালিয়ে গেলেন। অনেক মন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হল। ক্ষমতা দখলের এই দিনটিকে পরিকল্পনা মাফিক বেছে নেওয়া হয়েছিল। সেদিনই ছিল সারা রাশিয়া সোভিয়েতগুলির দ্বিতীয় কংগ্রেস। কংগ্রেসে যোগ দিতে পেত্রোগ্রাদে যখন প্রতিনিধিরা এসে পৌঁছেছেন, তার সঙ্গে এই ক্ষমতা দখলের সময় মিলে গেল। যেদিন পেত্রোগ্রাদের গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলির দখল নিল বলশেভিকরা সেদিনই সন্ধ্যায় সোভিয়েত সমূহের দ্বিতীয় অধিবেশন বসল। ৬৪৯ জন নির্বাচিত সোভিয়েত প্রতিনিধির মধ্যে তখন বলশেভিক প্রতিনিধির সংখ্যা ৩৯৯।

বলশেভিক পার্টি রাশিয়ার ক্ষমতা দখলের শুরুটা করে ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর। রাশিয়ার তৎকালীন রাজধানী পেত্রোগ্রাদ বা সেন্ট পিটার্সবুর্গে ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়াটির মধ্যে দিয়ে। এই দখল ছিল অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ। মস্কোসহ দেশের অন্যত্র অবশ্য বলশেভিকদের নানা দুরূহ বাধা অতিক্রম করে অনেক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে এগোতে হয়েছিল।

প্রথম নির্দেশনামা (ডিক্রি) সমূহ

দ্বিতীয় সোভিয়েত কংগ্রেস প্রভিন্সিয়াল সরকারের অবসান ঘোষণা করল। রাষ্ট্র পরিচালনার ভার দিল সোভিয়েতগুলির দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের। পাশ করা হল তিনটি ডিক্রি। লেনিনের পেশ করা প্রথম ডিক্রিটিতে নবগঠিত “শ্রমিক ও কৃষকদের সরকার” প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান রাখল। দ্বিতীয় ডিক্রিটি ছিল জমি ও কৃষি সংক্রান্ত। জমিদারদের সমস্ত জমি ক্ষতিপূরণ ছাড়াই বাজেয়াপ্ত করা হল। সাধারণ কৃষক ও কশাকদের জমির অধিকার রক্ষিত হল। জমির ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা লুপ্ত হল। তবে নারী পুরুষ নির্বিশেষে নিজের জমিতে নিজের শ্রমে চাষের অধিকার স্বীকৃত হল। জমি কেনা বেচা বা লিজ দেওয়া নিষিদ্ধ হল। খনিজ সম্পদের ওপর সম্পূর্ণ অধিকার রইলো রাষ্ট্রের হাতে। এই দ্বিতীয় ডিক্রিটি লেনিন পেশ করলেও মূলত এটি নেওয়া হয়েছিল সোশ্যালিস্ট রিভোলিশনারিদের কর্মসূচী থেকে। বলশেভিকদের নিজস্ব দাবি ছিল জমির জাতীয়করণ। তৃতীয় ডিক্রিটি পেশ করেছিলেন কামেনেভ। রাষ্ট্র চালানোর জন্য “শ্রমিক ও কৃষকদের সরকার” এর একটি মন্ত্রী পরিষদ বা কাউন্সিল অব পিপলস কমিশার গঠনের কথা বলা হল সেখানে। এই পরিষদের সভাপতি হলেন লেনিন।

একদলীয় সরকার না কোয়ালিশন সরকার

দ্বিতীয় সোভিয়েত কংগ্রেসে বলশেভিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও একচ্ছত্র ক্ষমতা ছিল না৷ পেত্রোগ্রাদ দখল অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ হলেও মস্কো দখল তা হয় নি। কেরেনেস্কি সরকারের অনুগামীরা এখানে বলশেভিকদের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরাই বলশেভিকদের বিরোধিতা করলেন। মিলিটারির সঙ্গেও বলশেভিকদের লড়াই চলল। যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বানচাল করার জন্য ডাকা হল রেল ধর্মঘট। রেল ইউনিয়নের নেতৃত্বে তখন ছিলেন মেনশেভিকরা। এই ধর্মঘট সফল হল। তবে ক্রমশ বলশেভিকরা রাশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের ওপর খানিকটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেন। 

বিপ্লবের অব্যবহিত পরেই বলশেভিক পার্টির কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতা তথা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য চেয়েছিলেন বলশেভিকদের পাশাপাশি মেনশেভিক ও সোশ্যালিস্ট রেভেলিউশনারিরাও সরকারে থাকুন। এঁদের মধ্যে ছিলেন কামেনেভ, জিনোভিয়েভ, রাইকভ, শ্লিয়াপনিকভ প্রমুখরা। ১৫ নভেম্বর পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এই প্রস্তাব খারিজ করে দিলেও এর প্রতিবাদে ১৭ নভেম্বরেই কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন কামেনেভ, জিনোভিয়েভ, রাইকভ ও মিলিয়ুতিন। মন্ত্রী পরিষদ বা পিপলস কমিশার থেকে পদত্যাগ করেন নোগিন, রাইকভ, মিলিয়ুতিন, তেওদোরোভিচ, শ্লিয়াপনিকভ, রিয়াজানভ, ইয়ুরেনেভ ও লারিন। তাঁরা চিঠি লিখে জানান যে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রস্তাবের সঙ্গে তাঁরা সহমত হতে পারছেন না। এর পর সোশ্যালিস্ট রেভেলিউশনারিদের চারজনকে মন্ত্রী পরিষদে নেওয়া হয়। এই চারজন ছিলেন কোলেগাইয়েভ, স্পিরিদোনোভা, প্রোশিয়ান ও স্টাইনবের্গ। ব্রেস্ট লিটোভস্ক চুক্তি পর্যন্ত তাঁরা “শ্রমিক ও কৃষকদের সরকার”এ ছিলেন। সোশ্যালিস্ট রেভেলিউশনারিরা এই চুক্তির প্রবল বিরোধী ছিল। তারা জার্মান রাষ্ট্রদূতকে হত্যা করে। লেনিনের ওপরেও আক্রমণ শানায়। তারপরেই সোশ্যালিস্ট রিভেলিউশনারিদের সরকার থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় ও এস আরদের ধরপাকড় শুরু হয়।

বুর্জোয়া গণতন্ত্র ও সোভিয়েত গণতন্ত্র

২৫ নভেম্বর কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বব্লি বা সংবিধান সভা গঠিত হবে এটা কেরেনেস্কি সরকারের আমলেই স্থির করা ছিল। নতুন “শ্রমিক ও কৃষকদের সরকার”ও সেটা বহাল রাখল। ৫২০ জন এখানে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন সোশ্যালিস্ট রিভেলিউশনারি বা এস আর রা। তাদের সংখ্যা ছিল ২৬৭। বলশেভিক সদস্য সংখ্যা ছিল ১৬১। এছাড়া অসংখ্য ছোট ছোট গোষ্ঠীর থেকে অনেক প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে সংবিধান সভায় এসেছিলেন। সংবিধান সভার সদস্যরা ১৯১৮ র জানুয়ারি মাসে প্রথম বৈঠকে মিলিত হলেন। বুখারিন বলেছিলেন এই সংবিধান সভার প্রতিনিধিরা মূলত দু দলে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। সমাজতন্ত্রের পক্ষে আর বিপক্ষে। সংবিধান সভায় নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। তারপর এর সভা মূলতুবি করে দেওয়া হয়। অভিযোগ ওঠে “শ্রমিক ও কৃষকদের সরকার”জোর করে এর পরবর্তী অধিবেশন বানচাল করে দেয়। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের নিয়ম নীতি থেকে “শ্রমিক ও কৃষকদের সরকার” সরে আসতে শুরু করে। কেন বলশেভিকরা এই কাজ করল তারপক্ষে কলম ধরেন লেনিন। বিতর্ক বাড়তে থাকে। মেনশেভিক এবং সোশ্যালিস্ট রিভোলিউশনারিদের সঙ্গে বলশেভিকদের সংঘাত বাড়তে থাকে।

লেনিন তাঁর সংবিধান সভা সংক্রান্ত থিসিসে লেখেন –

১) সংবিধান সভা বসাবার দাবিতা ছিল বৈপ্লবিক সোশ্যাল ডেমোক্রেসির কর্মসূচীর খুবই ন্যায়সঙ্গত একটা অঙ্গ, কারণ কোনও বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্রে সংবিধান সভা হল গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ আকার। তার অন্য কারণ এই যে  কেরেনেস্কির নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী প্রজাতন্ত্র প্রাক পার্লামেন্ট স্থাপণ করার সাহায্যে নির্বাচনে জুয়াচুরি ও নানা উপায়ে গণতন্ত্র লঙ্ঘনের আয়োজন করছিল।

২) সংবিধান সভা বসাবার দাবির তোলার সঙ্গে সঙ্গে বৈপ্লবিক সোশ্যাল ডেমোক্রেসি ১৯১৭ সালের বিপ্লবের শুরু থেকে বরাবর বারবার জোর দিয়ে বলেছে, সংবিধান সভা যাতে থাকে এমন প্রচলিত বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্রের চেয়ে উন্নত আকারের গণতন্ত্র হল সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র।

৩) বুর্জোয়া ব্যবস্থা থেকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের জন্য, প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বের জন্য শ্রমিক, সৈনিক ও কৃষক প্রতিনিধিদের সোভিয়েতগুলির প্রজাতন্ত্র সংবিধানসভার মুকুট পরানো প্রচলিত বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে তুলনায় উন্নত ধরনের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শুধু তাই নয় অধিকন্তু একমাত্র এই আকারটাই সবচেয়ে কম যন্ত্রণাকর উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ ঘটাতে পারে।

৪) সংবিধান সভা বসছে এমন একটা সময়ে যখন ১৯১৭ সালের প্রাক বিপ্লব অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে পেশ করা বিভিন্ন প্রার্থী তালিকায় সাধারণভাবে জনগণের সংকল্প এবং বিশেষত মেহনতি জনগণের সংকল্পের যথাযথ অভিব্যক্তির সম্ভাবনা নেই। …

লেনিন এবং বলশেভিকরা যেটা বলতে চাইলেন সেটা হল যখন সংবিধানসভার জন্য প্রতিনিধি বাছা হয়েছিল, তখন বলশেভিকরা রাজনৈতিক শক্তিতে যে জায়গায় ছিল, নভেম্বর বিপ্লবের পর তার আমূল রূপান্তর ঘটে গিয়েছে। সংবিধানসভার প্রতিনিধিরা প্রাক বিপ্লবী পরিস্থিতির প্রতিনিধিত্ব করছেন, বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতিতে যখন সব আমূল বদলে গেছে তখন আগের সংবিধান সভার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ক্ষমতা ভারসাম্যর প্রতিনিধিত্ব করেন না। তাঁরা এও বলতে চাইলেন যে কৃষক শ্রমিক সরকারের বিরুদ্ধে যে প্রতিবিপ্লবী ষড়যন্ত্র গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করছেবুর্জোয়া গণতান্ত্রিক উপায়ে তার মোকাবিলা বা মীমাংসা করা সম্ভব নয়। [ লেনিন – নির্বাচিত রচনাবলী – খণ্ড ৭ – পৃষ্ঠা ৬১ – ৬৬]

এই বিতর্কটা রাশিয়া ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট মহলের বিতর্ক হয়ে উঠেছিল। বলশেভিকদের সংবিধানসভা বাতিলের সমালোচনা করে কাউটস্কি ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব’ নামে একটা বই লেখেন। সেখানে লেনিনের লেখা পূর্বোল্লিখিত সংবিধান সভা সম্পর্কে থিসিস, যা ১৯১৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রাভদা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, অনেক উদ্ধৃতি হাজির করে সেগুলির সমালোচনা করা হয়েছিল। এর প্রত্যুত্তরেই লেনিন লেখেন তাঁর আক্রমণাত্মক বই, “প্রলেতারিয়ান বিপ্লব ও বেইমান কাউটস্কি"। সেখানে লেনিন অভিযোগ করেন কাউটস্কি তাঁর লেখায় লেনিনের তোলা মূল প্রশ্ন – সংবিধান সভা ও সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের নির্দিষ্ট বিষয়টির সঙ্গে সংবিধান সভা ও সাধারণ বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্রের পার্থক্যের বিশ্লেষণের জায়গাটিকে এড়িয়ে গেছেন। সেই লেখায় কাউটস্কি অভিযোগ করেছিলেন বলশেভিকরা যখন দেখলেন সংবিধানসভায় তাঁরা সংখ্যালঘু, তখনই তাঁরা সংবিধানসভা ভেঙে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। লেনিন কাউটস্কির এই কথা যে নির্লজ্জ মিথ্যাচার তার প্রমাণ স্বরূপ বললেন ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসে লেখা এপ্রিল থিসিসের কথা। ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসের শেষে বলশেভিক পার্টির সম্মেলনেও যে এই সংক্রান্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল, তাও তিনি মনে করিয়ে দেন। এই সংক্রান্ত বিশদ আলোচনার জন্য দেখা যেতে পারে লেনিনের উল্লিখিত থিসিস ও বইটি।

লেনিনের সংবিধান সভা সংক্রান্ত থিসিস এর লিংক –

 https://www.marxists.org/archive/lenin/works/1917/dec/11a.htm

কাউটস্কির বই এর লিংক -  

https://www.marxists.org/archive/kautsky/1918/dictprole/index.htm

লেনিনের  ‘প্রলেতারিয়ান বিপ্লব ও বেইমান কাউটস্কি’ নামের বইয়ের লিংক  -

https://www.marxists.org/archive/lenin/works/1918/prrk/index.htm

এই বিতর্ক প্রসঙ্গে বুখারিনের লেখার লিংক -

https://www.marxists.org/archive/bukharin/works/1919/soviets-parliament.htm                                       

বিপ্লবের পরে বলশেভিকদের সামরিক, চ্যালেঞ্জ

বলশেভিক বিপ্লবের সময় রাশিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লড়ছিল জার্মান, অস্ট্রিয়া - হাঙ্গেরি ও তাদের সহযোগী শক্তিদের বিরুদ্ধে। ১৯১৭ র ফেব্রুয়ারিতে জার শাসনের অবসান হয় বুর্জোয়া বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে। তৈরি হয় কেরেনেস্কি সরকার। বলশেভিকরা লেনিনের নেতৃত্বে কেরেনেস্কি সরকারকে উৎখাত করে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত সরকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু করে। রুশ সেনাবাহিনীকে পাশে পাওয়া সম্ভব হয় যুদ্ধের অবসান ও শান্তির প্রতিশ্রুতির মধ্যে দিয়ে।

ক্ষমতা দখলের পর জারি করা প্রথম তিনটি ডিক্রির একেবারে প্রথমটিতেই বলশেভিকরা যুদ্ধবিরতি ও শান্তির কথা ঘোষণা করে। কিন্তু ফ্রান্স বা ব্রিটেনের মতো মিত্রশক্তি এতে আগ্রহ দেখায় নি। প্রতিপক্ষ জার্মানী যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়ে আলোচনা শুরু করল ব্রেস্ট লিটোভস্কে।

রাশিয়ার ভেতরের রাজনৈতিক মহলে, এমনকী বলশেভিকদের নিজেদের মধ্যেও বিতর্ক প্রবল হয়ে ওঠে ব্রেস্ট লিটোভস্ক চুক্তিকে কেন্দ্র করে। “শ্রমিক ও কৃষকদের সরকার” যুদ্ধ থেকে সরে আসার নীতি নিয়ে যুদ্ধরত অন্য পক্ষগুলিকে যুদ্ধ বন্ধ করার আবেদন জানালেও তাতে বিশেষ কাজ হয় নি। বিশেষ করে জার্মান সেনা তখন রাশিয়ার ভূখণ্ডেই ছিল। তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া না হলে যুদ্ধ চালিয়েই যেতে হত নতুন সরকারকে। বলশেভিক পার্টির প্রধান প্রতিশ্রুতিই ছিল যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তিস্থাপণ করা। পুরনো সেনা নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়া বলশেভিক সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। বলশেভিকদের নিজস্ব লাল ফৌজ ছিল অনভিজ্ঞ, সংখ্যায় অল্প এবং যুদ্ধের জন্য নিতান্তই অকার্যকরী। ফলে বলশেভিক শাসনকে রক্ষা করতে গেলে জার্মানীর সঙ্গে চুক্তি করতেই হবে – এইরকম একটা পরিস্থিতি অনিবার্য হয়ে উঠেছে বলে বলশেভিকদের একাংশ মনে করতে থাকেন। জার্মানী চুক্তির যে শর্ত দিয়েছিল তা মেনে নেওয়া অত্যন্ত কঠিন ছিল। কারণ চুক্তির শর্ত অনুসারে রাশিয়ার দেশের বিপুল পরিমাণ অংশ ও সম্পদ জার্মানীর হাতে তুলে দিতে হত।

এই বিতর্কে লেনিনের মত ছিল আপোষ করতেই হবে, চুক্তি করতেই হবে। একেবারে বিপরীত মত ছিল বুখারিন ও রেড কমিউনিস্টদের। তাঁরা মনে করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে এইরকম চুক্তি করলে তা হবে আন্তর্জাতিক বিপ্লবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। সোভিয়েত শাসনের পতনের বিনিময়েও আন্তর্জাতিক বিপ্লবের স্বার্থকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা তাঁরা বলেছিলেন। এই দুই মতের মাঝামাঝি অবস্থান নিয়েছিলেন ট্রটস্কি। তিনিই তখন বিদেশমন্ত্রী। তাঁর অবস্থান ছিল যুদ্ধও নয়, শান্তিও নয়। ট্রটস্কি ব্রেস্ট লিটোভস্কে শান্তি আলোচনার সময় যে পদ্ধতি নিলেন তা প্রচলিত কূটনৈতিক পদ্ধতির থেকে একেবারেই আলাদা ছিল। তিনি যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত দেশগুলির নাগরিক, বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণির কাছে বারবার আবেদন জানাতে থাকলেন। জার্মান কূটনৈতিকদের পাশাপাশি যুদ্ধবিরোধী আবেদন রাখলেন সাধারণ জার্মান সেনাদের কাছেও।  কিন্তু আলোচনার টালবাহানা করে কালক্ষেপ করার কৌশল জার্মানরা মানতে রাজী ছিল না। তারা নির্দিষ্ট সময়সীমার পর আক্রমণ শুরু করার হুমকি দিলে বাধ্য হয়ে চুক্তির আরো অপমানজনক শর্তে সই করতে হয়। এরপরই ট্রটস্কি বিদেশমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। পেত্রোগ্রাদ থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মস্কোয়।

রেড আর্মির গঠন

ব্রেস্ট লিটোভস্ক চুক্তি হয় ১৯১৮ সালের ৩ মার্চ। তার আগে ১৯১৮ র ২৩ ফেব্রুয়ারিতেই শুরু হয় রেড আর্মি গঠনের কাজ। প্রথমে এর নাম ছিল ওয়ার্কাস অ্যান্ড পিজান্টস রেড আর্মি। এর মূল দায়িত্বে ছিলেন ট্রটস্কি। তিনি বুঝেছিলেন রেড আর্মির শক্তি বৃদ্ধি করতে হলে পেশাদার সেনাদের যুক্ত করা দরকার। পুরনো আমলের সেনাদের যুক্ত করা শুরু হল। জারের আমলের অভিজ্ঞ সেনাপ্রধানদেরও নিয়োগ করা হল। ১৯১৭ সালে বলশেভিকদের রেড গার্ডে দশ হাজার মতো সদস্য ছিলেন। ১৯১৯ সালের শুরুতে রেড আর্মির সদস্যসংখ্যা পৌঁছয় ত্রিশ হাজারে। গৃহযুদ্ধ চলাকালীন ১৯২০ সালের মধ্যেই রাশিয়ার লাল ফৌজের সংখ্যা পৌঁছে যায় পঞ্চাশ লক্ষের বিশাল সংখ্যায়। এই লাল ফৌজের নেতৃত্বে ছিলেন ট্রটস্কি। তাঁর দক্ষ ও কৌশলী সামরিক পরিচালনা গৃহযুদ্ধে বলশেভিক সরকারকে সাফল্য এনে দেয়। তবে গৃহযুদ্ধের পরে ট্রটস্কির প্রশ্নহীন আনুগত্যের নীতি, প্রথাগত রাষ্ট্রীয় মিলিটারি ডিসিপ্লিনের পুনঃপ্রবর্তনা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে কারণ রুশ বিপ্লব এগুলিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ ধরনের নীতির প্রয়োজন যে ছিল এবং ট্রটস্কি যে সেই প্রয়োজনেই সাড়া দিয়েছিলেন, সেকথা অস্বীকার করা যায় না।

কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশানাল

দ্বিতীয় ইন্টার্নাশ্যানাল ভেঙে পড়ার পর তৃতীয় ইন্টারন্যাশানাল বা কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক গঠনের কাজ শুরু হয়। এটি কমিন্টার্ন নামেই বেশি জনপ্রিয়। জনা পঞ্চাশেক প্রতিনিধি নিয়ে এর প্রথম সম্মেলন হয় ১৯১৯ সালের মার্চ মাসে। এই সম্মেলনে প্রস্তাবিত ও অনুমোদিত আন্তর্জাতিকের নীতিমালাটি রচনা করেন ট্রটস্কি। সম্মেলনের পর আন্তর্জাতিকের প্রধান দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় জিনোভিয়েভের হাতে। পশ্চিম ইউরোপের ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে বিপ্লব না হলে, শ্রমিক শ্রেণি ক্ষমতা দখল করতে না পারলে বলশেভিক শাসন যে বেশিদিন টিঁকিয়ে রাখা যাবে না, এ বিষয়ে সকলেই তখন প্রায় এক মত ছিলেন।

সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক শক্তিগুলি এই বিপ্লব করবে না, বরং বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে যে সুযোগ শ্রমিক শ্রেণির কাছে এসেছে ভুল বুঝিয়ে তা নষ্ট করবে – এই বিশ্লেষণ থেকে কমিউনিস্ট ইন্টার্ন্যাশানাল বিপ্লবী শক্তিকে সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলল, জোর দিল তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার দিকে। এই নীতির প্রত্যক্ষ প্রভাবে জার্মানীতে কার্ল লিবনেখট, রোজা লুক্সেমবুর্গ প্রমুখরা সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির থেকে বিচ্ছিন্ন হলেন। প্রথমে স্পার্টাকাস লিগ ও তারপর জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করলেন। সেই অভ্যুত্থানকে দমন করা হল। হত্যা করা হল লিবনেখট ও রোজাকে।

দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট পার্টিগুলো গড়ে উঠতে লাগল। ১৯২০ সালের দ্বিতীয় কমিন্টার্নের অধিবেশনে কমিন্টার্নে প্রবেশের জন্য একুশ দফা নীতিমালা তৈরি হল। এগুলি মানলে তবেই কমিন্টার্নে প্রবেশের ছাড়পত্র মিলত। দ্বিতীয় ইন্টার্ন্যাশানালের ঢিলেঢালা চরিত্রের বদলে এর চরিত্র ছিল একেবারেই ভিন্ন ও আঁটোসাটো।

রাশিয়ার গৃহযুদ্ধ

রাশিয়ার গৃহযুদ্ধর সূচনাকাল বেশীরভাগ ঐতিহাসিক ১৯১৮ র মাঝামাঝি থেকে ধরতে চান এবং মনে করেন ১৯২০ পর্যন্ত তা চলেছিল। কিন্তু অনেকের মতে অক্টোবর বিপ্লবের অব্যবহিত পর থেকেই রাশিয়ার গৃহযুদ্ধর সূচনা ধরা উচিত, কেননা তখন থেকেই বলশেভিকদের রাশিয়ার নানা ফ্রন্টে নানা শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছিল। এটা ঠিক যে ১৯১৭ র ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সময় বলশেভিক পার্টির সদস্যসংখ্যা যেখানে ছিল মাত্র চব্বিশ হাজার, সেটা অক্টোবর বিপ্লবের সময় বেশ কয়েকগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল তিন লক্ষতে। কিন্তু রাশিয়ার বিপুল জনসংখ্যার তুলনায় শুধু নয়, রাশিয়ার রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের হিসেবেও সংখ্যাটা ছিল বেশ কম। উপরোন্ত বলশেভিকদের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার মধ্য ও উত্তর পশ্চিম অংশে যতটা ছিল, অন্যত্র ততটা ছিল না। শ্রমিকদের মধ্যে এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব থাকলেও কৃষকদের মধ্যে বলশেভিকদের প্রভাব ছিল তুলনায় কম এবং সোশ্যালিস্ট রিভোলিউশনারিদের (এস আর) কৃষকদের ওপর প্রভাব ছিল অনেক বেশি।

অক্টোবর বিপ্লবের কয়েকদিনের মধ্যেই বলশেভিকদের প্রধান ক্ষমতাকেন্দ্র পেত্রোগ্রাদে কিছু তরুণ ইয়ুঙ্কার কাদেত বিদ্রোহ করে। জেনারেল ক্রাসনভের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর কসাক রেজিমেন্টের একটি অংশও বিদ্রোহী হয়। সেনাবাহিনীর অন্য একটি অংশ বলশেভিক পন্থী আন্তোনোভ ও কর্ণেল মুরাভিয়েভের নেতৃত্বে এই বিদ্রোহকে দমন করে। মস্কো শহরে বেশ কিছুদিন রাস্তায় রাস্তায় চলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। মধ্য ও উত্তর পশ্চিম রাশিয়ার অন্যান্য প্রধান শহরগুলিতে বলশেভিকরা ক্ষমতা দখল করতে পারে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই, কিন্তু এজন্য তাদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। বছর শেষ হবার আগেই রাশিয়ার পঁচাত্তরটি প্রদেশ ও অঞ্চলের বেশিরভাগ জায়গায় বলশেভিকদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। রাশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ৯০০ টি সোভিয়েতে বলশেভিকদের শক্তি ক্রমশই বাড়তে থাকে। কিন্তু ককেশাস অঞ্চল, ফিনল্যান্ড, ইউক্রেনের চারটি প্রদেশ এবং কসাক অধ্যুষিত ওরেনবার্গ, ডন ও কুবান অঞ্চল বলশেভিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে যায়। ডন অঞ্চলে বলশেভিক বিরোধী অংশের নেতৃত্বে ছিলেন কসাক নেতা জেনারেল আলেক্সি কালেদিন।

বিপ্লবের অব্যবহিত পরে ঘোষিত ডিক্রিগুলি একান্ত বলশেভিক নীতির বদলে সাধারণ সোভিয়েত নীতি হয়ে ওঠায় বলশেভিক সরকারের জনপ্রিয়তা অনেকটা বেড়েছিল। বিশেষ করে দ্বিতীয় ডিক্রিটিতে বলশেভিকরা নিজেদের জমির জাতীয়করণ ও সোশালিস্ট ফার্ম গঠনের নীতির বদলে জমিদারদের জমি অধিগ্রহণ করে চাষীদের মধ্যে তা বন্টনের এস আর নীতিমালাটিই গ্রহণ করেছিল। এস আর দের মধ্যেও একটা বিভাজন হয় এবং বামপন্থী এস আর রা বলশেভিকদের কাছাকাছি চলে আসে ও সরকারে অংশগ্রহণ করে। এর ফলে বলশেভিকদের কাজ অপেক্ষাকৃত মসৃণ হয়। এস আর ও বলশেভিকরা ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি অনেকটা হীনবল হয়ে পড়েছিল। বিশেষত মধ্য ও দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক শিবির প্রতিদিন তাদের সমর্থন ও জনভিত্তি হারাচ্ছিল।

সংবিধান সভার নির্বাচনে সোশ্যালিস্ট রিভোলিউশনারিরা পেয়েছিল ৪০ শতাংশ ভোট আর বলশেভিকরা পেয়েছিল ২৭ শতাংশ। বিভিন্ন এথনিক মাইনরিটিরা পেয়েছিল ১৫ শতাংশ ভোট। তারাও বলশেভিক ও সোশ্যালিস্ট রেভেলিউশনারিদের মতো জমির বৈপবিক বন্দোবস্তের পক্ষে ছিল।  বিপ্লবের সময় রাশিয়ার জনসংখ্যা ছিল ষোল কোটি মত। তার একটা অপেক্ষাকৃত ছোট অংশ, দু কোটি ষাট লাখ মতো বিভিন্ন শহরে থাকত, জনসংখ্যার বড় অংশটিই ছিল গ্রামে। গ্রামে এস আরদের শক্তি অনেক বেশি থাকলেও শহরে বলশেভিকদের প্রভাব ছিল বেশি। শহরাঞ্চলে সাংবিধানিক গণতন্ত্রী কাদেতদের প্রভাব দ্রুত কমছিল। সংবিধানসভার নির্বাচনে শহরাঞ্চলে কাদেতরা পেয়েছিল ২৪ শতাংশ ভোট আর বলশেভিকরা পেয়েছিল ৩৬ শতাংশ ভোট। তবে শহরাঞ্চলগুলিতে বলশেভিকদের জনপ্রিয়তা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বাড়ছিল এবং সমীকরণ বলশেভিকদের অনুকুলে প্রতিদিন বদলে যাচ্ছিল। পেত্রোগ্রাদে বলশেভিকরা পেয়েছিল ৪৫ শতাংশ ভোট, মস্কোতে তা ৫০ শতাংশ ছাপিয়ে গিয়েছিল। সব মিলিয়ে শহরাঞ্চলের চার কোটি ভোটের মধ্যে বলশেভিকরা এক কোটি চল্লিশ লক্ষের বেশি ভোট পেয়েছিল।

রাশিয়ার সেনাবাহিনী ছিল বিশাল। ৬৩ লক্ষ সেনা লড়াইয়ের ময়দানে ছিল, বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েত ছিল আরো সাড়ে সাত লক্ষ। এছাড়া নৌবাহিনীতেও ছিলেন সাড়ে সাত লক্ষ সেনা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা সেনাবাহিনীর মধ্যে ভাঙন ধরিয়েছিল। সেনাপ্রধানদের পরামর্শেই ফেব্রুয়ারি মাসে জার দ্বিতীয় নিকোলাস পলায়ন করেন। নতুন সরকার যুদ্ধ চালিয়ে যাবার চেষ্টা করলেও বিপুল সংখ্যক সেনা যুদ্ধ বন্ধ করে ঘরে ফেরার জন্য ব্যাগ্র ছিল। বলশেভিকদের যুদ্ধ বন্ধ করে সেনাদের ঘরে ফেরানোর নীতি সৈনবাহিনীতে তাদের প্রবল জনপ্রিয় করে তোলে। সেনারা যেহেতু মূলত কৃষক পরিবার থেকে আসতেন, তাই কৃষকদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় এস আরদের প্রভাবও সেনাবাহিনীর মধ্যে ভালো মাত্রায় ছিল। সংবিধান সভার ভোটে প্রায় ৫০ লক্ষ সেনা ভোট দেন এবং সেই ভোটের মধ্যে বলশেভিকরা পায় ৪২ শতাংশ। এস আর রাও ৪১ শতাংশ ভোট পায়। রাজধানী পেত্রোগ্রাদে সেনাবাহিনীর অবশ্য বলশেভিকদের নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ ছিল। সেখানে বলশেভিকরা পায় ৮০ শতাংশ ভোট ও এস আর রা পায় ১২ শতাংশ ভোট। মস্কোতেও সেনাবাহিনীর ভোটের ৮০ শতাংশ পায় বলশেভিকরা, এস আর রা পায় ৬ শতাংশ।

প্রাথমিক সাফল্যের পর বলশেভিকদের রাজনৈতিক বিরোধিতা ও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়, যখন জানুয়ারি মাসে আহূত সংবিধান সভা তারা প্রথম রাতের অধিবেশনের পরেই ভেঙে দিল এতে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায়। কিন্তু সংবিধান সভা ভেঙে দেবার পরে এই বোঝাপড়া ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং তা চরমে ওঠে এই সময়েই চলা ব্রেস্ট লিটোভস্ক চুক্তিকে কেন্দ্র করে। এস আর রা এর তীব্র বিরোধিতা শুরু করে। জার্মান রাষ্ট্রদূতকে তারা হত্যা করার পর তাদের সরকার থেকে বের করে দেওয়া হয় ও ধরপাকড় শুরু হয়। বলশেভিকদের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ এই সময় থেকে আবার বাড়তে থাকে।

কিন্তু রাশিয়া জুড়ে বলশেভিকদের উত্তরোত্তর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সময়ে ভেতরের এই রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ এককভাবে গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটানোর মতো যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না। রাশিয়ার গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত হতে পেরেছিল জারপন্থী সেনাপ্রধানদের সক্রিয়তা এবং বিভিন্ন বৈদেশিক শক্তির প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের মধ্যে দিয়ে। ১৯১৭ র ব্যর্থ অগস্ট অভ্যুত্থানের পর থেকেই কার্ণিলভ বন্দী ছিলেন পেত্রোগ্রাদ থেকে চারশো মাইল দূরবর্তী সেনার সদর দপ্তর মগলিয়েভের নিকটবর্তী এক কারাগারে। বিপ্লবের সময় মগলিয়েভের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিজেকে অস্থায়ী সেনাপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করেন দুখোনিন নামের এক তরুণ সেনাপতি। তিনি রাজনৈতিকভাবে ছিলেন বলশেভিক বিরোধী। মধ্যপন্থী এস আরদের একটি অংশ পেত্রোগ্রাদ বলশেভিকদের হাতে চলে যাবার পর মগলিয়েভে চলে আসেন এবং দুখোনিনের সঙ্গে বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে একটি বলশেভিক বিরোধী ক্ষমতাকেন্দ্র গড়ার চেষ্টা চালাতে থাকেন। বিপ্লবের ছাব্বিশদিন পর ট্রেন বোঝাই করে বলশেভিক লাল রক্ষীরা মগলিয়েভে পৌঁছন, বাল্টিক সাগরের নৌ সেনারাও চলে আসেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন বলশেভিক সরকার নির্বাচিত নয়া সেনাপ্রধান ক্রাইলেঙ্কো। দুখোনিন রাস্তাতে একদল জনতার ক্রোধের সামনে পড়েন এবং তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তারা হত্যা করে। দুখোনিনের পতন হলেও নয়া সেনাপ্রধান ক্রাইলেঙ্কো মগলিয়েভে আসার ঠিক আগের দিন মগলিয়েভের দশ মাইল দূরে অবস্থিত সেনা কারাগার বাইখোভ জেল থেকে কার্ণিলভ পালিয়ে যান। তার সঙ্গেই পালান লুকোমস্কি, দেনিকিন, মার্কভ সহ অগস্ট প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থানের অন্যান্য অনেক বন্দী সেনাপতি। তারা বুঝলেন মধ্য রাশিয়ায় তাদের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। ৬০০ মাইল দীর্ঘ পথ পেরিয়ে তারা চলে যান দক্ষিণ পূর্ব রাশিয়ায় ডন নদী তীরবর্তী কসাকদের এলাকায়। এই বাইকভ বন্দীরাই এরপর গড়ে তুললেন ‘শ্বেতরক্ষী বাহিনী’ এবং গৃহযুদ্ধ শুরু করলেন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শক্তির মদতে। রাশিয়ার রক্ষণশীল চার্চ এবং দক্ষিণপন্থী বলশেভিক ও সমাজতন্ত্র বিরোধীশক্তিগুলিও তাদের মদত জোগাতে থাকল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ ও জারের রাশিয়া যেহেতু একপক্ষে থেকে জার্মানদের বিরুদ্ধে লড়ছিল, তাই রাশিয়াকে অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করার জন্য উত্তরে ফিনল্যান্ড সীমান্তের কাছে মার্মাস্ক এ একটি বন্দর ও মার্মাস্ক থেকে পেত্রোগ্রাদ অবধি একটি রেল লাইন তৈরি করা হয়েছিল। ব্রেস্ট লিটোভস্ক সন্ধির সময় থেকে এখানে ব্রিটিশরা সেনা মোতায়েন করে। তাদের লক্ষ্য ছিল মার্মাস্ক যেন জার্মানদের হাতে চলে না যায়। পরে বলশেভিকদের হাতেও এর নিয়ন্ত্রণ যেন না যায়, সেই চেষ্টাও তারা চালিয়ে যায়। এই সময়েই আর্খানজেলেক্স এ মার্কিন সহায়তায় শ্বেতরক্ষী বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে ও ব্রিটিশরা তাদের মদত দিতে থাকে। রাশিয়া সীমান্তের কাছে নানা বিদেশী শক্তি সেনা সমাবেশ করে। এর মধ্যে ছিল ২ ডিভিশন ব্রিটিশ সেনা, ২ ডিভিশন জাপানী সেনা, এক ব্রিগেড কানাডিয়ান সেনা, এক ব্রিগেড মার্কিন সেনা, এক ব্রিগেড ইতালিয়ান সেনা, এক ব্রিগেড চিনা সেনা, ২ ব্যাটেলিয়ন ফরাসী সেনা ও এক লিজিয়ন চেক সেনা।

ব্রিটিশরা ১৯১৮ সালের অগস্টে বাকু বা আজারবাইজান দখল করে এবং সেখান থেকে ক্রমশ ছড়াতে থাকে। ১১ নভেম্বরে জার্মানীর আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। এর সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশরা রাশিয়ার শ্বেতরক্ষী বাহিনীকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও নানা সাহায্য দিয়ে বলশেভিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করতে শুরু করে। জানুয়ারি ১৯১৯ এ বলশেভিক বিরোধী শ্বেতরক্ষীদের সংখ্যা হয় তিন লক্ষ এবং মার্চ ১৯১৯ এর মধ্যেই তা পাঁচ লক্ষে পৌঁছে যায়। ব্রিটিশরা শ্বেতরক্ষী বাহিনীর হাতে দশ লক্ষ রাইফেল, পনেরো হাজার মেশিনগান, সাতশো সাঁজোয়া গাড়ি, ট্যাঙ্ক এবং প্রচুর গোলাবারুদ, পোশাক ও অন্যান্য নানা সামগ্রী তুলে দেয়। ফ্রান্স থেকেও তাদের জন্য সাহায্য আসে। বিশ্বযুদ্ধ শেষে ষাট হাজার সেনাসমৃদ্ধ চেক লিজিয়নও শ্বেতরক্ষী বাহিনীর হয়ে বলশেভিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

১৯১৯ সাল জুড়ে শ্বেতরক্ষী বাহিনীর তিনদিক থেকে বলশেভিক নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় রাশিয়া ও মস্কো, পেত্রোগ্রাদের মতো রাজনৈতিক কেন্দ্রগুলির দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। দক্ষিণ দিক থেকে অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন দেনিকিন। পূর্ব দিক থেকে আসা বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন কোলচাক  এবং উত্তর পশ্চিম দিক থেকে আসা শ্বেতরক্ষীবাহিনীর নেতা ছিলেন ইউদেনিচ। ১৯১৯ সালের মাঝামাঝি ইউক্রেনের ক্রিমিয়া সহ এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিদ্রোহ হয় এবং এর নেতৃত্ব দেন ইউক্রেনের অ্যানার্কিস্ট নেতা নেস্টর মাখনো। মাখনো বলশেভিক ও শ্বেতরক্ষীবাহিনী উভয়েরই বিরোধী ছিলেন তবে গৃহযুদ্ধের একটা পর্বে শ্বেতরক্ষীদের বিরুদ্ধে বলশেভিকদের সঙ্গে সমঝোতা গড়ে তোলেন। সেই সমঝোতা আবার ভেঙেও যায়। ইউক্রেনের শ্বেতরক্ষীবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন পিওতর ওয়ার‍্যাঙ্গেল।

এই সময় বলশেভিকদের রেড আর্মির নেতা ছিলেন লিও ট্রটস্কি। তিনি বুঝেছিলেন পিপলস মিলেশিয়া দিয়ে কেবল শ্বেতরক্ষী বাহিনীকে হারানো যাবে না। তাই সমালোচনা সত্ত্বেও ট্রটস্কি জার আমলের পেশাদার সেনা ও সেনাপতিদের রেড আর্মিতে অন্তর্ভুক্ত করার কাজ চালিয়ে যান। পাশাপাশি মস্কো সহ বিভিন্ন শহরাঞ্চলের শ্রমিক শ্রেণির হাতেও অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়। এই জোড়া কৌশলের মাধ্যমে রেড আর্মির শক্তি অনেক বৃদ্ধি পায় এবং তারা ক্রমশ রণাঙ্গনে সাফল্য পেতে থাকে। ট্রটস্কি একটি বিশেষ ট্রেনে রাশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল গৃহযুদ্ধের গোটা সময়টায় চষে ফেলেন এবং সামনে থেকে শ্বেতরক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে রেড আর্মির প্রতিরোধ আক্রমণকে নেতৃত্ব দেন।  ১৯১৯ সালের শেষ ও ১৯২০ সালের শুরুর দিকে বলশেভিকরা শ্বেতরক্ষীবাহিনীকে অধিকাংশ রণাঙ্গনে কায়েম করে ও কেবল বিচ্ছিন্ন কিছু জায়গাতেই বিক্ষিপ্তভাবে আরো কিছুদিন লড়াই চলে।

১৯২০ সালের মধ্যেই রাশিয়ার গৃহযুদ্ধ কার্যত শেষ হয়ে যায় এবং শ্বেতরক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে রেড আর্মি ও বলশেভিকদের নির্ণায়ক বিজয় হয়। ১৯২১ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে ইতস্তত বিচ্ছিন্ন কিছু লড়াই চলে কোনও কোনও অঞ্চলে। পূর্বদিকের সীমান্তে ও মধ্য এশিয়ার এই সমস্ত লড়াইতেও বলশেভিকরা জেতেন। জর্জিয়া রেড আর্মির অধিকারে চলে আসে ১৯২১ এর ফেব্রুয়ারি মাসে। এপ্রিলে রেড আর্মি আর্মেনিয়ার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ২৫ অক্টোবর ১৯২২ এ জাপান ভ্লাদিভস্তোক ত্যাগ করে এবং তার পরে রাশিয়ার মাটি বিদেশী সেনা মুক্ত হয়। ১৯২২ এর শেষদিকে পূর্ব সীমান্তের দিকের লড়াইগুলিও শেষ হয়ে যায় ও সে সব জায়গা বলশেভিক নিয়ন্ত্রণে আসে। 

গৃহযুদ্ধের সাফল্যের জন্য বলশেভিকরা বিশেষভাবে নির্ভর করেছিল কৃষক ও শ্রমিক মৈত্রীর ওপর। বিশেষ করে কুলাকদের কোণঠাসা করে ছোট ও মধ্য কৃষকদের বড় অংশটিকে নিজেদের দিকে নিয়ে আসার মধ্যে দিয়েই শ্বেতরক্ষী ও বিদেশী হানাদারদের সাঁড়াশি আক্রমণের মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছিল। উইলিয়ম হেনরী চেম্বারলিন বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার প্রথম চার বছরের অনুপুঙ্খ ইতিহাস লেখার সময়ে গৃহযুদ্ধ প্রসঙ্গে তাঁর বিখ্যাত বইতে বলেছিলেন এই যুদ্ধে শ্বেতরক্ষী ও বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে বলশেভিক ও লাল ফৌজের বিজয় নেহাৎ কোনও সামরিক ঘটনা নয়। এই জয়ও রাজনৈতিক বিজয় এবং বলশেভিকদের শ্রেণি সংগ্রামের অংশ। এই প্রসঙ্গে লেনিনের একটি বক্তৃতা প্রণিধানযোগ্য।

১৯১৯ সালের মার্চ মাসে লেনিন রেড আর্মির উদ্দেশ্যে সেই বক্তৃতায় বলেন - 

"লাল ফৌজের কমরেড সেনানীরা,

ব্রিটেন, আমেরিকা ও ফ্রান্সের পুঁজিবাদিরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারা শ্রমিক ও কৃষকদের সোভিয়েতের প্রজাতন্ত্রর ওপর প্রতিশোধ নিতে চায়। কারণ এই প্রজাতন্ত্র জমিদার ও পুঁজিপতিদের শাসনকে উচ্ছেদ করে গোটা বিশ্বের সামনে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপণ করেছে। রাশিয়ার জমিদাররা সাইবেরিয়া, দন তীরবর্তী অঞ্চল, উত্তর ককেশাস থেকে সেনা নিয়ে আসছে এবং এই কাজে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকা তাদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করছে। তাদের লক্ষ্য জারের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং জমিদার ও পুঁজিপতিদের ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা। কিন্তু এইটা হবে না। লাল ফৌজ তাদের সেনা সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ভোলগা অঞ্চল থেকে তারা জমিদার বাহিনী ও শ্বেতরক্ষী দলের সেনাপতিদের তাড়িয়ে দিয়েছে। রিগা লাল ফৌজের দখলে এসেছে৷ দখলে এসে গেছে প্রায় গোটা ইউক্রেন। লালফৌজ এখন এগিয়ে চলেছে ওডেশা ও রস্তভের দিকে। 

আর একটু চেষ্টা, আর কয়েকমাস শত্রুর সঙ্গে লড়াইয়ের পরই আমরা চূড়ান্ত বিজয় হাসিল করতে পারব। লাল ফৌজ শক্তিশালী কারণ তারা অত্যন্ত সচেতনভাবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে কৃষকদের জমির অধিকার, শ্রমিক ও কৃষকদের শাসন ও সোভিয়েতের ক্ষমতার জন্য লড়ছে। 

লাল ফৌজ অপ্রতিরোধ্য কারণ তারা লক্ষ লক্ষ কৃষককে শ্রমিকদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। তারা লড়তে শিখেছে, কমরেডসুলভ নিয়মানুবর্তিতা শিখেছে, তারা ভয় পায় না। কিছু প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে তারা ইস্পাতের মতো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ক্রমশই তারা আরো বেশি দৃঢ়তার সঙ্গে শত্রুর বিরুদ্ধে এগিয়ে যাচ্ছে এবং জয়ের বিষয়ে তারা সুনিশ্চিত। 

লাল ফৌজের সেনানী কমরেডরা, লাল ফৌজের মধ্যে শ্রমিক ও কৃষকদের ঐক্য খুবই সুদৃঢ়, ঘনিষ্ট ও অবিভাজ্য। কুলাক ও ধনী কৃষকেরা সোভিয়েত শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের চেষ্টা করছে। কিন্তু তারা অতি ক্ষুদ্র ও নগণ্য এক শক্তি। তারা কৃষকদের সামান্যই বোকা বানাতে পেরেছিল এবং তাও খুব সামান্য সময়ের জন্য। কৃষকেরা জানে কেবল শ্রমিকদের সঙ্গে ঐক্যের ভিত্তিতেই তারা জমিদারদের ধ্বংস করতে পারবে৷...

মধ্য কৃষকেরা শ্রমিকদের শত্রু নয়, বরং তারা সোভিয়েত শক্তির বন্ধুশক্তি। শ্রেণি সচেতন শ্রমিকরা ও সোভিয়েত মতাদর্শে প্রকৃত আস্থাশীলরা মধ্য কৃষকদের কমরেড বলেই মনে করেন। মধ্য কৃষকেরা অন্যের শ্রমকে আত্মস্যাৎ করে না। কুলাকদের মতো অন্যের সম্পদের বিনিময়ে তারা ধনী হয়ে ওঠে না। 

সোভিয়েত সরকার কুলাকদের ধ্বংস করবে। যারা মধ্য কৃষকদের ওপর অন্যায় আচরণ করে তাদের খুঁজে বের করে সাহায্য করবে। শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে সমস্ত গরীব ও মধ্য কৃষকদের মৈত্রীর নীতিতে চলবে।" 

ট্রটস্কির ‘মাই লাইফ’ নামক আত্মজীবনীতেও গৃহযুদ্ধকালীন নানা পরিস্থিতি ও সংগ্রামের অনেক অন্তরঙ্গ ভাষ্য পাওয়া যায়। একটি বিশেষ ট্রেনে সামরিক দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবে ট্রটস্কি ও তাঁর সঙ্গীরা রাশিয়ার নানা প্রান্ত গৃহযুদ্ধের সময় যেভাবে চষে ফেলেছিলেন সেই অধ্যায়টিই কেবল আলাদা একটি আলোচনার যোগ্য।

রাশিয়ার গৃহযুদ্ধর দিনকাল সংক্রান্ত একটি সময়রেখা ঘটনা পরম্পরাকে বুঝতে সহায়ক হবে।

১৯১৭ সালের ঘটনাক্রম -

৭ নভেম্বর – বলশেভিকদের পেত্রগ্রাদ দখল ও রুশ বিপ্লবের সূচনা

১৩ নভেম্বর – ব্যর্থ হল কেরেনেস্কির প্রতিবিপ্লব প্রচেষ্টা

১৫ নভেম্বর – দন নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে মিখাইল আলেক্সিভ একটি সেনাবাহিনী গঠন করলেন, উদ্দেশ্য বলশেভিকদের মোকাবিলা।

২০ নভেম্বর – ইউক্রেনে সেন্ট্রাল রাডা তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করল।

২ ডিসেম্বর – বাইকভ জেল থেকে পালালেন অগস্ট ক্যু এর বন্দী নেতারা। এদের মধ্যে ছিলেন কর্ণিলভ, দেনিকিন, রোমানভস্কি, লুকমস্কি, মারকভ। তারা দীর্ঘ পথ পেরিয়ে গেলেন দন অঞ্চলের দিকে।

৬ ডিসেম্বর – ফিনল্যান্ড স্বাধীনতা ঘোষণা করল

২২ ডিসেম্বর – ব্রেস লিটভস্কে শুরু হল শান্তি আলোচনা

১৯১৮ সালের ঘটনাবলী

১২ জানুয়ারি – লাটভিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করল

১৯ জানুয়ারি – সংবিধান সভার অধিবেশন বন্ধ করে দিল বলশেভিকরা

৮ ফেব্রুয়ারি – বলশেভিক রেড আর্মি কিয়েভ দখল করল

১৪ ফেব্রুয়ারি – পুরনো ক্যালেন্দার ছেড়ে জর্জিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণ করল রাশিয়া। ঐ দিনই ট্রান্স বৈকাল অঞ্চলে সেনাবিদ্রোহ ঘটালেন গ্রেগরি সেমেনভ।

১৬ ফেব্রুয়ারি – লিথুয়ানিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করল

১৯ ফেব্রুয়ারি – ইউক্রেনের মধ্যে দিয়ে সেন্ট্রাল পাওয়ার রাশিয়ার দিকে এগোতে থাকল

২২ ফেব্রুয়ারি – বলশেভিক বিরোধী স্বেচ্ছাসেবী সেনা শুরু করল আইস মার্চ

২৪ ফেব্রুয়ারি – এস্তোনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করল

২৫ ফেব্রুয়ারি – জেনারেল কালেদিন এর নেতৃত্বাধীন দন কসাক ফ্রন্ট পরাজিত হল

২ মার্চ – জার্মানরা কিয়েভে প্রবেশ করল

৩ মার্চ – ব্রেস্ট লিটভস্ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হল

১২ মার্চ – পেত্রোগ্রাদ থেকে রাজধানী সরিয়ে আনা হল মস্কোয়

১৪ মার্চ – রেড আর্মি একাটেরিনোদর দখল করল

৩ প্রিল – জার্মান সেনা ফিনল্যান্দে এল

৪ এপ্রিল – সাইবেরিয়াতে ব্রিটিশ সেনা আসা শুর হল

৫ এপ্রিল – মার্মানস্ক বন্দরে ব্রিটিশ সহ বিভিন্ন মিত্রশক্তির সেনা সমাবেশ শুরু হল। ঐ দিনই জার্মানরা খারকোভ দখল করে নিল

৬ এপ্রিল – জাপানী সেনা নামল ভ্লাদিভোস্তকে

১৩ এপ্রিল – একাটেরিনোদর এ খুন হলেন শ্বেতরক্ষীবাহিনীর নেতা কার্ণিলভ

৬ মে – দন অঞ্চলের কসাকরা এই অঞ্চলের রাজধানী নোভোচেরকাসক পুনর্দখল করল

৮ মে – জার্মানরা স্তভ অন দন এ সেনা সমাবেশ করল

১১ মে – দন কসাকরা পিতর ক্রাসনভকে তাদের নেতা নির্বাচিত করল

২৫ মে – চেক লিজিয়ন বলশেভিকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করল

২৬ মে – জর্জিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করল

৩০ মে – চেক লিজিয়ন পেনগজা ও সিজরান দখল করল

১ জুন – সাইবেরিয়ার ওমক্সে প্রভেন্সিয়াল সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করা হল

৮ জুন – চেক লিজ্যন সামারা দখল করল ও সেখানে বলশেভিক বিরোধী জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করল।

২৩ জুন – চেক লিজিয়ন উফা দখল করল

১৪ জুলাই – আশখাবাদ ও ট্রান্স কাশপিয়ান অঞ্চলে বলশেভিক বিরোধী শক্তি ক্ষমতা দখল করল

১৬ জুলাই – একাতেরিনবার্গে জার ও তার পরিবারের লোকেদের হত্যা করা হল

২১ জুলাই – ইয়ারসলাভালের এস আর বিদ্রোহকে দমন করল বলশেভিকরা

২৫ জুলাই – চেক লিজিয়ন বলশেভিকদের নিয়ন্ত্রণে থাকা একাতেরিনবার্গ দখল করে নিল

২ অগস্ট – বলশেভিক বিরোধী শক্তি আর্চাঙ্গেল দখল করল। পরদিনই সেখানে মিত্রশক্তির বাহিনী এসে পোঁছল

৩ অগস্ট – ভ্লাদিভস্তকে এসে পোউঁছল মার্কিন সেনা

৪ অগস্ট – ব্রিটিশ সেনা বাকুতে এল

৬ অগস্ট – চেক লিজিয়ন ও সহযোগীরা কাজান দখল করল

১৫ অগস্ট – বলশেভিক বিরোধী স্বেচ্ছাসেবীবাহিনী একাতেরিনদারের নিয়ন্ত্রণ নিল

২৬ অগস্ট – স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী নভরোসিকে প্রবেশ করল

৪ সেপ্টেম্বর – মার্কিন সেনা আর্চাঙ্গেলে প্রবেশ করল

১০ সেপ্টেম্বর – রেড আর্মি কাজান পুনর্দখল করল

২৩ সেপ্টেম্বর – উফায় বলশেভিক বিরোধী প্রভিন্সিয়াল সরকারের প্রতিষ্ঠা হল

৮ অক্টোবর – রেড আর্মি সামারাতে প্রবেশ করল

৩০ অক্টোবর – রেড আর্মি নার্ভা, পাসকোভ দখল করে নিল

১১ নভেম্বর – শান্তিচুক্তির মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষিত হল। ঐ দিনই পোল্যান্ড স্বাধীনতা ঘোষণা করল।

১৮ নভেম্বর – ওমস্ক অঞ্চলের শাসক হিসেবে নির্বাচিত হলেন আলেকজান্ডার কোলচাক

১৭ ডিসেম্বর – ওডেশাতে প্রবেশ করল ফরাসী সেনাবাহিনী

২৫ ডিসেম্বর – কোলচাক ও শ্বেতরক্ষীবাহিনী পার্ম দখল করে নিল

১৯১৯ সালের ঘটনাবলী

৩ জানুয়ারি – রেড আর্মি খারকোভ আর রিগা দখল করল

৬ জানুয়ারি – রেড আর্মির দখলে এল কিয়েভহ

১৫ ফেব্রুয়ারি – দক্ষিণ রাশিয়ার শ্বেতরক্ষীবাহিনীর (AFSR) নেতা নির্বাচিত হলেন আন্তন দানিকিন

১৩ মার্চ – কোলচাকের নেতৃত্বাধীন শেতরক্ষীবাহিনী পূর্বদিক থেকে বলশেভিক অঞ্চলের ওপর আক্রমণ শুরু করল

৫ এপ্রিল – ব্রিটিশরা ট্রান্স কাস্পিয়ন অঞ্চল থেকে সরতে শুরু করল

৮ এপ্রিল – ফরাসীরা ওডেশা অঞ্চল থেকে সরতে শুরু করল

২৩ মে – শ্বেতরক্ষীবাহিনী জার্মানদের সহায়তায় রিগা দখল করল

২৭ জুন – দেনিকিন খারকভ দখল করলেন

১৫ জুলাই – রেড আর্মি আসখাবাদ দখল করল

২১ জুলাই – রেড আর্মি পের্ম দখল করল

২৫ জুলাই – রেড আর্মি চেলিয়ানবিনস্কে প্রবেশ করল

১৯ অগস্ট – ব্রিটিশ সেনা বাকু ও আজারবাইজান ছেড়ে চলে গেল

২৩ অগস্ট – দানিকিনের নেতৃত্বাধীন শ্বেতরক্ষীবাহিনী ওডেসা সখল করল

৩১ অগস্ট – দানিকিন বাহিনীর দখলে এল কিয়েভ

২০ সেপ্টেম্বর – দানিকিন বাহিনী কুর্স্ক দখল করল

২৬ সেপ্টেম্বর – ইউক্রেনের অ্যানার্কিস্ট নেতা নেস্তর মাখনো পেরেজোনোভাতে শ্বেতরক্ষীবাহিনীকে হারিয়ে দিলেন

২৮ সেপ্টেম্বর – উত্তর পশ্চিমা বাহিনী পেত্রোগ্রাদের দিকে এগোতে শুরু করল

৩০ সেপ্টেম্বর - মিত্রশক্তি আর্চাঙ্গেল ছেড়ে চলে গেল

১২ অক্টোবর – মিত্রশক্তি মার্মানেস্ক ছেড়ে চলে গেল

১৪ অক্টোবর – দানিকিল বাহিনী ওরেল দখল করল

২৪ অক্টোবর – রেড আর্মি ওরেক্স পুনর্দখল করল

৯ নভেম্বর – মাখনো একাতেরিনোস্লাভ দখল করলেন

১১ নভেম্বর – কসাকেরা কাস্তোরনায়াতে পরাজিত হল

১৪ নভেম্বর – রেড আর্মি ওমস্ক দখল করল

১২ ডিসেম্বর – রেড আর্মি খারকভ দখল করল

১৬ ডিসেম্বর – কিয়েভের দখল নিল রেড আর্মি

৩০ ডিসেম্বর – একাতেরিনোস্লাভ দখল করল রেড আর্মি

১৯২০ সালের ঘটনাবলী

৩ জানুয়ারি – রেড আর্মি জারিৎসিন দখল করল

৪ জানুয়ারি – শ্বেত্রক্ষীবাহিনীর একের পর এক পতনের মুখে কোলচাক পালিয়ে গেলেন

৮ জানুয়ারি – তাগানরোগ, নোভোচেরকাসক, রস্তভ অন দন এল রেড আর্মির দখলে

২ ফেব্রুয়ারি – এস্তোনিয়া বলশেভিকদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করল

৭ ফেব্রুয়ারি – কোলচাক ইরকুতস্কে ধরা পড়লেন এবং তাকে হত্যা করা হল। অঈ দিনই রেড আর্মি ওডেসার দখল নিল

১৯ ফেব্রুয়ারি – উত্তরাঞ্চলের শ্বেতরক্ষীবাহিনীর সরকার ও আর্চাঙ্গেলের পরন ঘটল রেড আর্মির হাতে

১৭ মার্চ – রেড আর্মি একাতেনিদোর দখল করল

২৭ মার্চ – রেড আর্মি নভরোসিকে প্রবেশ করল

১ এপ্রিল – মার্কিনি সেনা সাইবেরিয়া ছেড়ে চলে গেল

৪ এপ্রিল – দেনিকিন পদত্যাগ করলেন, দক্ষিণ রাশিয়ার শ্বেতরক্ষীবাহিনীর (AFSR) নেতা নির্বাচিত হলেন পিতর ওয়ার‍্যাঙ্গেল

২৪ এপ্রিল – রাশিয়া ও পোল্যান্ডের যুদ্ধ শুরু হল

২৭ এপ্রিল – রেড আর্মি আজারবাইজান দখল করল

৬ মে – পোল্যান্ড কিয়েভ দখল করে নিল

১২ জুন – রেড আর্মি কিয়েভ পুনর্দখল করল

১১ জুলাই – রেড আর্মি মিনস্ক দখল করল

১৪ জুলাই – রেড আর্মি ভিলনা দখল করল

১২ অক্টোবর – রাশিয়া ও পোলান্ডের মধ্যে শান্তিচুক্তি হল

১৪ নভেম্বর – ওয়ার‍্যাঙ্গেল ক্রিমিয়া থেকে পালিয়ে গেলেন

২৫ নভেম্বর - রেড আর্মি আর্মেনিয়া দখল করল

গৃহযুদ্ধকালীন অর্থনীতি : ওয়ার কমিউনিজম

গৃহযুদ্ধর পরিস্থিতিতে পরিস্থিতি সামলাতে একগুচ্ছ নীতি ও কার্যক্রম গ্রহণ করে বলশেভিক সরকার। ১৯১৮ থেকে ১৯২০ পর্যন্ত গৃহযুদ্ধকালীন এই বিশেষ আর্থিক নীতিকে বলা হয় ওয়ার কমিউনিজম বা যুদ্ধকালীন সাম্যবাদের নীতি। এই নীতির মূল দুটি দিকের একটি ছিল সমস্ত ব্যক্তিগত ব্যবসায় অবসান ও সেগুলির রাষ্ট্রীয়করণ। ১৯১৮ র জুন মাসেই একটি ডিক্রি জারি করে সমস্ত বড় শিল্পের জাতীয়করণ করা হয়।

যুদ্ধকালীন সাম্যবাদের অন্য গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক নীতিটি ছিল কৃষকদের দ্বারা উৎপাদিত খাদ্যশস্যর সমুদয় উদবৃত্তকে রাষ্ট্রের হেফাজতে নিয়ে আসা, যাতে সেই খাদ্য রেড আর্মিকে ও শহরের শিল্পশ্রমিকদের যোগান দেওয়া যায়।

গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই রাশিয়ার অর্থনীতি সঙ্কটে পড়েছিল। মূল সমস্যা ছিল খাদ্যের। শহরের শ্রমিক ও সেনাবাহিনীর জন্য খাদ্য সংগ্রহ সমস্যাজনক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গ্রামাঞ্চলে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয় কিন্তু সেগুলি মোটের ওপর ব্যর্থ হয়। গৃহযুদ্ধ এই সমস্যাকে আরো তীব্র করে তোলে। জনগণের থেকে কর আদায়ের কোনও ব্যবস্থা তখনো ভালোভাবে তৈরি করা সম্ভব হয় নি। গ্রামাঞ্চল থেকে উদ্বৃত্ত খাদ্য সংগ্রহও ছিল সমস্যার।

গ্রাম থেকে উদবৃত্ত খাদ্য শ্রমিক ও সৈনিকদের থেকে সংগ্রহ করার জন্য কুলাক শ্রেণির ওপর নানারকম চাপ সৃষ্টি করা শুরু হয়।

গৃহযুদ্ধের সময়ে যে সমস্ত সামাজিক শক্তি এই প্রতিবিপ্লবী কার্যকলাপকে মদত দিয়েছিল তার মধ্যে ছিল পুঁজিপতি ও কুলাকরা। কুলাক বলতে রাশিয়ায় বড় বড় জমির মালিক তথা ধনী চাষীদের বোঝায়। এই ধনী চাষীরা শুধুই যে চাষের কাজ করত তা নয়। তারা টাকা পয়সা ধার দিত চড়া সুদের বিনিময়ে, বন্ধকী কারবারও চালাত।

গৃহযুদ্ধ চলাকালীন স্বাভাবিকভাবেই এই কুলাকদের ক্ষমতা খর্ব করতে চেয়েছিলেন রুশ কমিউনিস্টরা। গ্রামে কুলাকরা ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী। কুলাকরা যাতে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিতে ধার্য করা অতিরিক্ত শস্য ভাণ্ডারে জমা দেন, সেটাও নিশ্চিত করার চেষ্টা হল। গৃহযুদ্ধের পর্বের প্রথমদিকে ছোট ও গরীব কৃষকদের সংগবদ্ধ করে তাদের হাতে গ্রাম পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন কমিউনিস্টরা।  কুলাকদের ক্ষমতা কমানোর জন্য গরীব কৃষকদের জোটগঠন ও তাদের ওপর গ্রামীণ ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ দেবার চেষ্টা শুরু হয় ‘কমিটি ফর পুওর পিজান্টস’ গঠনের মাধ্যমে। এই পরীক্ষা নিরীক্ষা অবশ্য বেশিদিন চলে নি। ১৯১৮ র জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই পরীক্ষা চালাবার পর বলশেভিক নেতৃত্ব মনে করেন গরীব প্রান্তিক চাষীদের চেয়ে গ্রামের নিয়ন্ত্রণ ও খাদ্য সংগ্রহের জন্য গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিতে বেশি করে নির্ভর করতে হবে মধ্য চাষীর ওপর। ১৯১৮ র ডিসেম্বরেই গরীব কৃষকদের কমিটিগুলি ভেঙে দেওয়া হয়।

বলশেভিকদের উদ্যোগে কৃষি কমিউন তৈরি করা শুরু হয়। এই সময়ে তৈরি সমবায়ভিত্তিক কৃষি ফার্মগুলোকে সোভিয়েত ফার্ম নামে অভিহিত করা হত। কেন্দ্রীয় সরকারী উদ্যোগে যেমন এরকম বেশ কিছু ফার্ম তৈরি করা হয়, তেমনি প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক উদ্যোগেও এই ধরনের ফার্ম গঠনের কথা বলশেভিকদের পক্ষ থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এই ফার্মগুলির জন্য মজুরী শ্রমিক নিয়োগ করা হত। এগুলিকে সমাজতান্ত্রিক শস্য কারখানা হিসেবেও উল্লেখ করা হত। এগুলির মূল লক্ষ্য ছিল রেড আর্মি ও শহরের শ্রমিকদের জন্য খাদ্য সরবরাহ করা।

কৃষকরা নিজেদের জমির অধিকার ছাড়তে রাজি ছিল না। এই মনোভাব লক্ষ করে লেনিন বলেছিলেন তারা নিজেদের বুশেভিক সমর্থক ভাবে, কারণ বলশেভিকরা জমিদারদের তাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু তারা নিজেদের কমিউনিস্ট সমর্থক ভাবে না কারণ কমিউনিস্টরা ব্যক্তিগত জমি মালিকানা রাখতে চায় না।

শহরের শিল্প কারখানাগুলিও প্রবল সঙ্কটে পড়েছিল। উৎপাদনের একটা বড় লক্ষ্য ছিল রেড আর্মির প্রয়োজন মেটানো। কিছু কিছু অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎপাদনের দিকে বেশি নজর দিতে গিয়ে অনেক কিছুর উৎপাদনে ঘাটতি পড়ে। ছোট আকারের কারখানাগুলো অল্প শ্রমিক নিয়ে চলত। শহর ও গ্রামের কারিগর উৎপাদন ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল, তবে তারা প্রায়ই কাঁচামালের সমস্যায় ভুগত। প্রচুর লোককে রেড আর্মিতে ওন্তর্ভুক্ত করে রণাঙ্গনে পাঠাতে হয়েছিল। এর ফলে কারখানার উৎপাদনে শ্রমিক সংখ্যায় ভাঁটা পড়ে। যথেষ্ট সংখ্যক খাদ্য না মেলায় শহর ছেড়ে অনেকে চলে যেতে থাকে গ্রামে। রাশিয়ার বড় বড় শহরগুলোতে জনসংখ্যা বিরাট মাপে কমতে থাকে। গৃহযুদ্ধের তিন বছরে মস্কোর জনসংখ্যা ৪৪.৫ শতাংশ কমেছিল। পেত্রোগ্রাদে এটা কমে ৫৭.৫ শতাংশ। এর ফল শিল্পোৎপাদনের ওপর প্রবলভাবে পড়েছিল। এপ্রিল ১৯১৮ তে একটা ডিক্রি জারি করে বলা হয়েছিল চাষীদের খাদ্যশস্যর বিনিময়ে ভোগ্যপণ্য কেনা যাবে। কিন্তু বাস্তবে এই বিনিময় বাজারটা প্রায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। খাদ্যশস্যর যোগান কম থাকায় দালাল ও মজুতদাররা চড়া দামে তা শহরগুলোতে বিক্রি করত। এই সব দালালকে গ্রেপ্তার করা বা গুলি করার ভয় দেখিয়েও এই ধরনের চোরাকারবারি বন্ধ করা সম্ভব হয় নি।

শ্রমিক নীতিতেও গৃহযুদ্ধের বিশেষ পরিস্থিতি অনেক কঠোর নীতি নিতে বলশেভিকদের বাধ্য করেছিল। বিপ্লবের অব্যবহিত পর কারখানাগুলিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফ্যাক্টরি কমিটি ও ওয়ার্কাস কন্ট্রোল গড়ে ওঠে। কিন্তু গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিতে উৎপাদনের ওপর সরাসরি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ চাপাতে হয় বলশেভিক সরকারকে, কঠোর করতে হয় শ্রমনীতি। যে ওয়ান ম্যান ম্যানেজমেন্ট এর পদ্ধতিকে লেনিন নিজেই একদা ‘যন্ত্রের কাছে মানুষের দাসত্ব’ বলে বাতিল করে দিয়েছিলেন, সেই ব্যবস্থাকে উৎপাদন বাড়ানোর প্রয়োজনে চালু করতে হয়। নীতিগতভাবে এটা ছিল ওয়ার্কাস কন্ট্রোলের বিপরীত। কারখানায় ধর্মঘটকে নিষিদ্ধ করা হয়। ত্রেড ইউনিয়নের ভূমিকা নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়। অনেকে ট্রেড ইউনিয়নের স্বাধীন অধিকার রক্ষার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু গৃহযুদ্ধের নির্দিষ্ট বাস্তবতায় ট্রেড ইউনিয়নের অধিকারকে রাষ্ট্রের প্রয়োজনের মধ্যে বিলীন করে দেওয়া হয়। লেনিন এও বলেন “কাজ যে করবে না, সে খেতেও পাবে না।” এপ্রিল ১৯১৯ এই চালু করা হয়েছিল সেনাবাহিনীতে সরবরাহ অব্যাহত রাখার জন্য বিশেষ রাষ্ট্রীয় উৎপাদন নীতি। সাজাপ্রাপ্তদেরও উৎপাদনের কাজের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। যারা গৃহযুদ্ধে প্রতিবিপ্লবী কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তারা ধরা পড়লে পাঠানো হত বিশেষ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে এবং তাদের কঠোর পরিশ্রম করিয়ে নানা উৎপাদনের কাজে লাগানো হত। মিলিটারি ইউনিটগুলো যখন যুদ্ধের কাজ থেকে দূরে থাকত, তখন সে মিলিটারি ইউনিটগুলোকেও নানা পণ্য উৎপাদনের কাজে যুক্ত করে দেওয়া হত। এই কঠোর রাষ্ট্র আরোপিত নিয়মের পাশাপাশি শ্রমিক রাষ্ট্রকে রক্ষা করার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে শ্রমিকদের শ্রমদানের আহ্বানও রাখা হয়। ১৯১৯ এর মে মাসে লেনিন ‘কমিউনিস্ট শনিবার’ পালন করার কথা বললেন। প্রতি শনিবার মস্কো ও পেত্রোগ্রাদের কয়েক হাজার শ্রমিক কারখানায় অতিরিক্ত কয়েক ঘন্টা কাজ করল বিনা পারিশ্রমিকে, যাতে করে রেড আর্মির কাছে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি যথাসময়ে সরবরাহ করা যায়। এইভাবে কঠোর শ্রমনীতি ও শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের জোড়া নীতি ব্যবহার করে কঠিন গৃহযুদ্ধকে বলশেভিকরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছিল ও সেখানে বিজয়ী হতে পেরেছিল।

গৃহযুদ্ধের বাস্তবতার চাপ ছাড়াও ওয়ার কমিউনিজমের নীতিমালা গ্রহণে বিপ্লবোত্তর আবেগ যে অনেকটা প্রভাব বিস্তার করেছিল, সেটা লেনিন আত্মসমালোচনার ঢঙে পরে স্বীকার করেন।  দি নিউ ইকনমিক পলিসি অ্যাণ্ড দ্য টাস্কস অব দি পলিটিক্যাল এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট নামের গুরুত্বপূর্ণ এক লেখায় তিনি লেখেন, “(বিপ্লবের পরে) উৎসাহ উদ্দীপনার তরঙ্গ শীর্ষে আরোহণ করে, প্রথমে রাজনৈতিক উৎসাহ এবং তারপরেই সামরিক উৎসাহ জাগিয়ে আমরা আশা করেছিলাম যে, আমাদের রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকাণ্ডের সাফল্যের মতোই সরাসরি উৎসাহ উদ্দীপনার ওপর ভর করেই আমরা আর্থিক ক্ষেত্রেও সফলতা অর্জন করতে পারব। অর্থহাৎ আমরা ভেবেছিলাম যে আমরা সরাসরি কমিউনিস্ট উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থাতে চলে যেতে পারব।” (লেনিন – কালেক্টেড ওয়ার্কস খণ্ড ৩৩, পৃষ্ঠা ৫৮)।

নয়া আর্থিক নীতি (নেপ)

১৯২০ সালের নভেম্বরে লেনিন মস্কোর নিকটবর্তী এক গ্রাম কাশিনোতে যান এক বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন করতে। সেখানে কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা হয়। সরোকিন নামের এক কৃষক লেনিনকে  জানান যে আগে তারা মাঠে শন বুনতেন। কিন্তু সব উদবৃত্ত সরকার নিয়ে যাবে এই ভয়ে তারা আর শণ বোনেন না। সারায়েভ নামে আরেক কৃষক বলেন যে উদবৃত্ত বাজেয়াপ্ত করার আইনকে তারা ভয় পান। কাশিন নামের এক কৃষক বলেন তারা না চাইলেও সরকারের নীতির জন্য তারা গরুভেড়া মেরে খেয়ে ফেলেন বা তাদের লুকিয়ে রাখেন। লেনিন তাঁর জনসংযোগের সুত্রে ওয়ার কমিউনিজমের নীতিমালার পরিবর্তনের প্রয়োজনিয়তার দিকটা বুঝতে পারছিলেন।

অর্থনীতির পুনর্গঠন বা নেপের প্রয়োজনিয়তা নিয়ে বিস্তারিত চর্চা হয়েছিল ১৯২১ সালের দশম পার্টি কংগ্রেসে। তার আগেই বেশ কিছু বিদ্রোহের মুখোমুখি হতে হয়েছিল বলশেভিক সরকারকে। এই বিদ্রোহগুলো শ্বেতরক্ষীদের বিদ্রোহের চেয়ে ছিল একেবারেই আলাদা ধরনের। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় পেত্রোগ্রাদের ক্রনসতাদ নৌঘাটিতে নৌ সেনাদের বিদ্রোহের কথা। এরা ছিলেন বলশেভিক অনুগত। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা বিদ্রোহ করেন। দাবি তোলেন শ্রমিক এবং কৃষকদের বেশ কিছু ছাড় দিতে হবে, সোভিয়েতগুলোর অবাধ নির্বাচন করতে হবে। উদবৃত্ত বিধি তুলে নিয়ে শস্য উৎপাদক এলাকাগুলিতে বাধামুক্ত ব্যবসা বা খোলাবাজার ব্যবস্থার প্রচলন ছিল তাদের প্রধান দাবি। ক্রনসতাদ বিদ্রোহকে রেড আর্মি দ্রুতই দমন করে। কিন্তু লেনিন এর বিপদ সংকেতটা টের পান। তিনি সোভিয়েত রাষ্ট্রের সামাজিক ভিত্তি সংকীর্ণ হবার বিপদের দিকটি নিয়ে ক্রনসতাদ বিদ্রোহের অব্যবহিত পরেই সংগঠিত বলশেভিক পার্টির দশম কংগ্রেসে বিষয়টিকে বিস্তারিত চর্চার মধ্যে নিয়ে আসেন।

সেনাবাহিনী বা কৃষকদের পাশাপাশি শ্রমিকদের একাংশও সোভিয়েত সরকারের নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। ক্রনসতাদ বিদ্রোহের আগে পেত্রোগ্রাদে এবং আরো কয়েকটা শহরের কলকারখানায় বেশ কয়েকটা ধর্মঘট হয়ে যায়। শ্রমিকদের জীবনধারনের অবস্থার অবনতি, খাদ্য ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অনিয়মিত সরবরাহ, জ্বালানির অভাবে কয়েকটা কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো বিষয়গুলি বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল। শ্রমিকরা বেশ কয়েকটি প্রস্তাবও সরকারকে দেয়। তার মধ্যে একটি প্রধান দাবি ছিল ছোটখাটো ব্যবসা এবং কৃষি ও শিল্প পণ্যের মধ্যে বিনিময়ের ওপর থেকে বিধি নিষেধের বোঝা হালকা করতে হবে। শ্রমিকদের প্রতিনিধিরা শিল্পপণ্যের বিনিময়ে গ্রামানগচল থেকে খাদ্য জোগাড় করে শহরে নিয়ে আসার যে ব্যবস্থাপণা চালু করেছিল তার ওপর প্রায়শই হামলা চালানো হত। এই হামলা বন্ধ করার দাবি করে এই ব্যবস্থাটিকে বজায় রাখার আর্জিও তারা রেখেছিল।

শ্লিয়াপনিকভের মতো অগ্রণী ধাতু শ্রমিক, যিনি প্রথম সোভিয়েত সরকারের শ্রম মন্ত্রী ছিলেন, বলশেভিকদের শ্রম নীতির তীব্র রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের দিকটির বিরোধিতা করেন এবং কারখানার ওপর শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণের নীতির পক্ষে সওয়াল করেন। তাঁর এই ওয়ার্কাস কন্ট্রোল আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়ান বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আলেকজান্দ্রা কোলোনতাইও।

কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশানালের চতুর্থ কংগ্রেসে দেওয়া এক বক্তৃতায় লেনিন এই প্রসঙ্গে বলেন যে, “১৯২১ সালে আমরা সোভিয়েত রাশিয়াতে একটা গভীর সংকটের চাপ অনুভব করেছি। আমি মনে করি এটা ছিল গভীরতর সংকট। এই সংকতের মধ্যে দিয়ে শুধু যে কৃষকদের একটা রীতিমতো বড় অংশের অসন্তষই আমাদের দৃষ্টিপথে এসেছিল তা নয়, শ্রমিকদেরও একটা অংশের অসন্তুষ্টিকে আমরা দেখতে পেয়েছিলাম।” (কালেক্টেড ওয়ার্ক, খণ্ড ৩৩, পৃষ্ঠা ৪২১)

তথ্যের দিকে তাকালেও বোঝা যায় গৃহযুদ্ধের পরে অর্থনীতির পুনর্গঠন কেন জরুরী এক কার্যক্রম হিসেবে সামনে এসেছিল। গৃহযুদ্ধের ফলে জাতীয় সম্পদের এক চতুর্থাংশ নষ্ট হয়েছিল, জাতীয় আয় নেমে এসেছিল এক তৃতীয়াংশে। অধিকাংশ কলকারখানার উৎপাদন সঙ্কটে পড়েছিল। ভারি শিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। ১৯১৩ সালে প্রথম যুদ্ধ শুরু হবার আগে ভারী শিল্পে উৎপাদন যা হত, ১৯২০ সালে তা নেমে এসেছিল তার এক সপ্তমাংশে। ইস্পাত গলানোর পরিমাণ নেমে যায় শতকরা ৫ ভাগে। পরিবহন ব্যবস্থা অনেকটাই অকেজো হয়ে পড়ে। দেখা দেয় তীব্র খাদ্য সঙ্কট ও দুর্ভিক্ষ। গৃহযুদ্ধ ২ কোটির বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। কর্মক্ষম মানুষের প্রায় ২০ শতাংশ গৃহযুদ্ধে মারা যান। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বলশেভিকদের সমর্থনভিত্তির বিরুদ্ধেই একের পর এক বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়। নতুন করে রুশ দেশ, সমাজ ও অর্থনীতির গঠনকার্য শুরু করা জরুরী হয়ে পড়ে। এই নতুন গঠনকার্যের জন্য নতুন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতি নেওয়া হল। এটাই নেপ বা নিউ ইকনমিক পলিসি নামে বিখ্যাত হয়ে আছে৷

নেপ এর নয়া নীতির সময়ে পুরনো বেশ কিছু নীতি থেকে সরে এল সোভিয়েতরা। কৃষকনীতিতে পরিবর্তন ছিল এর অন্যতম। লেনিনের অভিমত ছিল নেপ এর শুরু করতে হবে অধিকাংশ কৃষকের প্রয়োজনের সঙ্গে রফা করে, কারণ দেশে সবচেয়ে জরুরী প্রয়োজন ছিল খাদ্যের এবং কৃষকরাই তার যোগানদার। “সব কিছুকেই প্রধানতম দিকতির বিবেচনাধীন করতে হবে এবং প্রধানতম দিক হল যে কোনও মূল্যে খাদ্যের উৎপাদন বাড়ানো” (লেনিন, কালেক্টেড ওয়ার্কস, খণ্ড  ৪৩, পৃষ্ঠা ৩১৮)। যন্ত্রশিল্পের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং তার প্রসার ও বৃদ্ধিকে  কিছুদিনের জন্য দ্বিতীয় স্তরের গুরুত্ব দিয়ে দেখবার কথা তখন বলেছিলেন লেনিন। মনে রাখতে হবে শ্রমজীবীদের নেতৃত্বে রেখে তার সঙ্গে কৃষকদের মৈত্রীর ওপর জোর দিয়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল রণনীতিটা গড়ে তুলেছিলেন লেনিন। কিন্তু তিনি যখন নেপ সংক্রান্ত ভাবনা চিন্তা করছেন তখন সোভিয়েত সমাজ ও সোভিয়েত রাষ্ট্রের কৃষক ওংগকে আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দিলেন। ১৯২০ সালের শেষের দিকে নেপ শুরু হবার আগেই তিনি লিখছেন, “আমাদের রাষ্ট্রকে প্রকৃতপক্ষে একটি শ্রমিক রাষ্ট্র বলা যায় না। একে বলা যায় শ্রমিক ও কৃষকদের রাষ্ট্র।” (লেনিন, কালেক্টেড ওয়ার্কস, খণ্ড ৩২ – পৃ ২৪)। কৃষি অর্থনীতিবিদ এ বি চায়নভ, সাইবেরিয়া অঞ্চলের সোশ্যালিস্ট রিভোলিউশনারি (এস আর) দলের নেতা চের্নভ প্রমুখের লেখাপত্র এইসময় লেনিনকে প্রভাবিত করে। লেনিন ক্রমশ বুঝতে থাকেন “পার্টির বাইরের কৃষকেরা উদবৃত্ত বাজেয়াপ্ত করার নীতির বদলে শস্যে কর পরিশোধ করতে চাইছে (ট্যাক্স ইন কাইন্ড)। সেই আকাঙ্ক্ষাটি পূরণ করা দরকার।” (রাফ ড্রাফট অব থিসিস কনসার্নিং দি পেজেন্টস, লেনিন কালেক্টেড ওয়ার্কস, খণ্ড ৩২, পৃ – ৩৪৩)

বলশেভিক পার্টির দশম কংগ্রেসে নিউ ইকনমিক পলিসি সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের পর কৃষকদের কাছ থেকে আদায়ের পরিমাণ ৪০ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়।  নতুন পরিমাণটি স্থির করা হয় শহর এলাকা ও শ্রমিকদের নিম্নতম চাহিদাটিকে মাথায় রেখে। ফলন কম হলে আদায়ের পরিমাণ আরো কমানো হত। নেপ এর সূত্রে এই প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয় যে দেশের আর্থিক পরিস্থিতি যত উন্নত হতে থাকবে, কর আদায়ের পরিমাণও সেই হারে কমানো হবে। ১৯২১ সালের মার্চের এক নির্দেশিকায় বলা হয় নির্ধারিত পরিমাণ কর আদায়ের পর উদবৃত্ত বাকি পরিমাণ ফসল কৃষক ও সরকারের পারস্পরিক সম্মতিতে ক্রয়বিক্রয় করা যাবে। ১৯২৩ সালে এক নতুন নীতিনির্দেশ জারি করা হয়। এই নির্দেশবলে  কৃষক একপাক্ষিকভাবে উদবৃত্ত ফসল বাজারে বিক্রি করার অধিকার লাভ করে কৃষকেরা।

১৯২৩ সাল থেকেই বীজ বোনার এলাকাগুলো ক্রমশ বাড়তে থাকে, গরু ছাগল মুরগী পালনেও জোয়ার আসে। বিপ্লবের পরে প্রথমবারের জন্য রাশিয়ার উদবৃত্ত ফসল বিশ্ববাজারে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯২২ থেকে ১৯২৫ সালের মধ্যবর্তী পর্বে সোভিয়েত খাদ্যশস্যের উৎপাদন ৫ কোটি ৬০ লক্ষ টন থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৭ কোটি ৪৭ লক্ষ টন, বিট চিনির উৎপাদন বেড়েছিল ১৯ লক্ষ টন থেকে ৯১ লক্ষ টনে। গরু ঘোড়া মোষের সংখ্যা ৪ কোটি ৫৮ লক্ষ থেকে বেড়ে হয়েছিল ৬ কোটি ২১ লক্ষ। পশ্চিম ইউরোপের চেয়েও বৃদ্ধির হার ছিল দ্রুততর।

কুলাক বিরোধী নানা নীতি ও পদক্ষেপ থেকে ১৯২১ এর পর কিছুটা সরে এলেন কমিউনিস্টরা। তখন গৃহযুদ্ধর অবসান হয়েছে। কমিউনিস্টরা শ্বেতরক্ষী বাহিনীকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলিও সরে গিয়েছে সোভিয়েত সীমান্ত থেকে৷

তত্ত্বগতদিক থেকে কুলাকদের পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্রের শত্রুপক্ষ হিসেবে যে বিচার কমিউনিস্টরা করেছিল, সেই বিচার থেকে সরে না এসেও কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদে গৃহযুদ্ধ অবসানের পর কুলাকদের সঙ্গে কিছু সমঝোতা করা হয় ও কুলাকনীতিকে খানিকটা নমনীয় করা হয়। সবচেয়ে বেশি উৎপাদন করতে পারছেন এমন কুলাক তথা ধনী কৃষকদের ইনসেনটিভ দেওয়া শুরু হয়। সমগ্র কৃষকদের মধ্যে চার শতাংশ কুলাক তখন ছিলেন। নতুন এই নীতির যুগে কুলাকরা অনেক জায়গাতেই তাদের সামাজিক রাজনৈতিক ক্ষমতাকে অনেকটা বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হন। অনেক এলাকাতেই সোভিয়েত সরকারের প্রতিনিধির বদলে তারাই গ্রাম সমাজের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন।

তবে নেপ এর অবসানে ১৯২৭ সাল থেকেই আবার বিপরীত নীতির যুগে ফেরেন রুশ নেতৃত্ব। ১৯২৯ সালে সোভিয়েত রাশিয়ায় জোরকদমে শুরু হল কৃষির সমবায়ীকরণ প্রক্রিয়া। কুলাকরা তাদের নিজস্ব জোতকে বড় বড় সমবায় জোতের মধ্যে নিয়ে আসার প্রকল্পের তীব্র বিরোধিতা করল। পালটা প্রতিক্রিয়া এল কমিউনিস্টদের তরফেও। শ্রেণি হিসেবে কুলাকদের অস্তিত্বকেই ধ্বংস করার ডাক দেওয়া হল।১৯৩৪ সালের মধ্যেই সোভিয়েত রাশিয়ার সমস্ত কৃষিজমির ৭৫ শতাংশকে নিয়ে আসা হল সমবায়ের মধ্যে। যে সব কুলাকরা এই সমবায়ীকরণের বিরোধিতা করল তাদের হয় গ্রেপ্তার করা হল বা বিভিন্ন প্রান্তিক অঞ্চলে নির্বাসন দেওয়া হল এবং তাদের জমি বাজেয়াপ্ত করে নেওয়া হল। মাঝখানে কেবল নেপ এর কয়েকবছর কুলাকরা গৃহযুদ্ধের পর অর্থনীতির পুনর্গঠনের তাগিদে কিছুটা ছাড় পেয়েছিলেন। 

নয়া আর্থিক নীতি এবং তার অন্যতম সোপান সম্পর্কে লেনিন বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন তাঁর 'ট্যাক্স ইন কাইন্ড - দ্য সিগনিফিকেন্স অব দ্য নিউ ইকনমিক পলিসি' বইতে।

 

 

আকর প্রসঙ্গে

১) লেনিন, ট্রটস্কি, বুখারিন, স্তালিন প্রমুখদের এই পর্বের বা এই পর্ব বিষয়ক রচনাবলী। উৎস www.marxists.org

২) ই এইচ কারের তিনখণ্ডে লেখা দ্য বলশেভিক রেভেলিউশন (১৯১৭ – ১৯২৩)। সেই সঙ্গে ওনার আরেকটি বই ফ্রম লেনিন টু স্ট্যালিন।

৩) আইজাক ডয়েটশারের দ্য আনফিনিশড রেভোলিউশন : রাশিয়া ১৯১৭ – ১৯৬৭

৪) উইলিয়াম হেনরি চেম্বারলিনের দ্য রাশিয়ান রেভেলিউশন বইয়ের দুটি খণ্ড।

৫) ডেভিড বুলকের দ্য রাশিয়ান সিভিল ওয়ার (১৯১৮ – ১৯২২)

৬) ইভান মাডস্লের দ্য রাশিয়ান সিভিল ওয়ার


৭) ইয়েভগেনি আমবার্তসুমভের লেনিন’স নিউ ইকনমিক পলিসি