জীবনানন্দের ছোটগল্প : অদ্ভুত গোলকধাঁধার ভিতর

“ছোটো একচিলতে রেলের লাইন নদীর কিনারা দিয়ে গিয়েছে শুধু”

—এখন ২০২৫ চলছে। লেখকের আঁকা সুদূর অতীতের সেই চিত্র বদলেছে অনেক, ভারত বিভক্ত আজ। লেখক জীবনানন্দ দাশ এই যে ছোট্ট রেললাইনের কথা বলেছেন তাঁর ‘হৈমন্তিক’ গল্পে সেই জায়গাটির সঠিক হদিস আজ অনুমান সাপেক্ষ। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে নদী বেষ্টিত বরিশালে কোনো রেললাইন ছিল না। লেখকের কলকাতা বসবাস কালে শেয়ালদহ স্টেশন থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত রেললাইন বিস্তৃত ছিল। আবার খুলনা হয়েও স্টিমারে বরিশাল যাওয়া যেত। শুরুতেই এই লাইনটি তুলে আনার বিশেষ কারণ, তৎকালীন হেমন্তের রূপ প্রকৃতরূপে তুলে ধরতে হলে সময়ের চিহ্ন বুঝে নেওয়া দরকার। হেমন্ত এক ঋতু, যার সাথে কিছু প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ জুড়ে গিয়ে আমাদের মনে এক বিশেষ অনুভুতির সঞ্চার ঘটায়। আজ এই সময়ে যখন সারি সারি রেলের লাইনের উপর দিয়ে মাঠ, খেত দেখতে দেখতে ছুটে যাই, তখন জীবনানন্দের বর্ণনায় পাওয়া ওই একচিলতে লাইন কল্পনার গল্পকথার বিষয় হয়ে ওঠে। জীবনানন্দের হেমন্তের সাথে এই সময়ের হেমন্তের অনুভবকে মিলিয়ে নিতে হলে সেই কালের চেতনা স্পষ্ট হওয়া দরকার। কবি জীবনানন্দ দাশের বিভিন্ন লেখায় বিশেষত গল্প ও কবিতায় হেমন্ত যে অনুসঙ্গে এসেছে, তাতে শুধু প্রকৃতির পরিবর্তন নয়, খুব গভীরে বিশ্লেষণ করলে মানুষের জীবনচক্রের বিভিন্ন পরিবর্তিত ধাপ বা পর্যায় খুঁজে পাওয়া যায়। সমগ্র হেমন্ত ঋতুটা যেমন শরৎ ও শীতের মাঝের সেতুর মতো, তেমনই ঋতু অনুভবের ক্ষেত্রে তৈরি করে এক দ্বন্দ্ব বা মানসিক টানাপোড়েন। এই আলোচনায় এমন দুটি গল্পকে নির্বাচন করেছি, যাদের শিরোনামে হেমন্ত আছে। যে গল্পের বিস্তারের মধ্যে আছে হেমন্তের ভিন্নতর রূপ ও দ্বন্দ্ব। আলোচ্য গল্পদুটির একটির নাম ‘হৈমন্তিক’ ও দ্বিতীয়টির নাম ‘হেমন্তের দিনগুলো’।

“একদিকে তুমি চাকরি খুইয়েছ আজ, সংসারের চাপ যে কী— তা খুব ভালো করেই তা বুঝতে দিয়েছ, আর একদিকে জীবনটাকে একটা শালিখের মতো করে দিয়েছ তুমি হেমন্তের এই অফুরন্ত আস্বাদের কাছে”।

শালিখের ধূসর রং ধানের খেতের ছবির সাথে বারবার মিশে যেতে চায়। কল্পনা ভারি আশ্চর্য বিষয়! ফকির থেকে রাজা হতে মুহূর্তেরও কম সময় লাগে। জীবনানন্দের মতো প্রকৃতিপ্রেমী পরাবাস্তব অনুভূতির মানুষ যে এই কল্পনার আশ্রয়ে বাস্তবের পরাজয় ভুলে থাকবেন এ খুব স্বাভাবিক বিষয়। হৈমন্তিক নামক গল্পটির চরিত্রও ঠিক স্রষ্টার স্বভাবসম্পন্ন। তাই অকালে চাকরি যাওয়ার মধ্যেও আনন্দের উপাদান খুঁজে নিতে পারে। খুঁজে নিতে পারে জীবনের আস্বাদ। তার মনে হয়—“বেকার দিনগুলো পৃথিবীটাকে আস্বাদ করবার সুবিধে করে দেয় এত গভীর করে;” সে অকাল বেকারত্বের হাত ধরে কলকাতায় কাটানো দশ বছর পর গ্রামবাংলার হেমন্ত আর শীতের রূপ দেখার সুযোগ পায়। গল্পের শুরুর বর্ণনায় যে চিত্র পাওয়া যায়—“স্টিমার-অফিসের বাড়িগুলো—অফিসারদের কোয়ার্টার নদীর পাড় দিয়ে দিয়ে অনেক দূর চলে গিয়েছে; মাঝে মাঝে এক একটা বড়ো ফুটবলের মাঠ-- মাইলের পর মাইল ঝাউগাছের সারি; আশ্বিন-কার্তিকের ধানের ক্ষেত; হেমন্তের সন্ধ্যায় নদীর পাড়ের পথে বেরিয়ে মনে হয় যে, বরাবর কলকাতায় থাকা যার অভ্যাস তার সে-জিনিসটার হাড়নাড় চটকেও বিলেতের যতটুকু গন্ধ সে পায় তার চেয়ে ঢের গভীর করে কোন এক বিদেশের ঘ্রাণ যেন এইখানে পাওয়া যাচ্ছে”-- এই উদ্ধৃতির মধ্যে কতগুলি বিষয় বিশেষ লক্ষণীয়। চরিত্র সত্যেন চাকরি হারিয়ে অসময়ে দেশে ফেরার পথে হেমন্তের সন্ধ্যায় এই সব দৃশ্য দেখে দেশের মাটিতে বিদেশের গন্ধ অনুভব করছে। এখানে উল্লিখিত স্টিমার-অফিসের বাড়ির বর্ণনার সাথে গল্পের পরের অংশে যে চিত্র বর্ণিত হয়েছে, সেখানে এই বাড়িগুলি গথিক স্টাইলের স্থাপত্যের সাথে তুলনা করা হয়েছে। আবার পর্তুগিজদের বাংলো কম্পাউন্ড গুলো বাবলা গাছের বাউন্ডারিতে ঘেরা, সেই সব দৃশ্য তার মনে বিদেশের অনুভব জাগিয়ে তুলেছে। ছোট্ট যে পরিত্যক্ত রেললাইন সে দেখেছে নদীর পাড়ে, তার মনে হয়েছে আওরঙ্গজেবের আমলে কোনো একটা রেল কোম্পানি হয়তো এটা তৈরি করেছিল। এখানেই বিষয়টা গুরুত্বপুর্ণ হয়ে উঠেছে বর্তমান হেমন্তের প্রেক্ষাপটে সেদিনের হেমন্তের অনুভবকে মিলিয়ে নেওয়া। হেমন্তের অনুষঙ্গে উঠে এসেছে সুদূরের কাল চেতনা। ভারতবর্ষের ইতিহাস। এসব কল্পনা করলেই একদীর্ঘ ইতিহাসক্রম চোখের সামনে ভেসে ওঠে। পানিপথের যুদ্ধ থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের ৩০০ বছরের শাসনকাল, এর মধ্যেই ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলে পর্তুগীজদের উপনিবেশ স্থাপন, ব্রিটিশ শাসন। এই যে কালের চেতনা, আজ ২০২৫ সালেও আমাদের মস্তিষ্কের দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে, সেই যোগসূত্র তৈরি করেছেন জীবনানন্দ। তাঁর ইতিহাস চেতনা এতটাই বিস্তৃত যে, হেমন্ত দিয়ে তিনি এক অদৃশ্য সেতু নির্মাণ করেছেন। সেই সঙ্গে এই দীর্ঘ ইতিহাসের প্রক্ষাপটে সমাজ, জীবনের পর্যায়ক্রমিক বিবর্তন, স্পষ্ট ফুটে উঠেছে এইসব বর্ণিত স্থাপত্যের ক্ষয়িষ্ণু রূপে। ঠিক এই কারণেই বর্ণিত স্থানটি সম্পর্কে একটা আনুমানিক আভাস পাওয়ার দরকার ছিল। লেখক যে সময়ে কথা গল্পটিতে লিখেছেন, তখন বরিশালের স্টিমার ঘাট বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল বাণিজ্যিক কারণে। এখানে দুটি বড়ো বড়ো কোম্পানির অফিসও ছিল।

আগের উদ্ধৃতিতে যেমন কালের চেতনা পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে, পাশাপাশি হেমন্তের দ্বান্দ্বিক রূপটিও খুঁজে পাওয়া যায়। লেখক বলেছেন ‘আশ্বিন-কার্তিকের ধানের ক্ষেত’ হেমন্তের দৃশ্য বর্ণনায় এই দুটি মাসের নাম ঋতুর অনুভবের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব জাগায় যেমন, তেমনই মাঠের ফসলের পরিণত হওয়ার দীর্ঘ সময়েরও অনুভব জাগায়। আশ্বিন শরতের শেষ,কার্তিক হেমন্তের শুরু, কিন্তু ফসল এই দুই ঋতুর মাঝের সেতু। যেমন শরতের ভেজা ঘাম, আর শীতের শুষ্কতার মাঝের অনুভব হেমন্ত। এই দুই ঋতুর দ্বন্দ্ব যেন সত্যেনের সংসারের মাঝে মানুষের সাথে মানুষের দ্বন্দ্ব, পুরুষের সাথে নারীর দ্বন্দ্ব, বধূর সাথে শাশুড়ির দ্বন্দ্বের কথাই বলে। বাড়ি ফিরেই শুরু হয় সত্যেনের জীবনের টানাপোড়েন। পিতা ধর্মদাস হাজার চেষ্টাতেও ঘরের ভিতরে লুকিয়ে থাকা ব্যাঙের ডাক শুনে ব্যাঙটিকে খুঁজে বের করতে পারেন  না। ঘরের ভিতরে পরিজনের মাঝে লুকিয়ে থাকা সমস্যা যেন এই ব্যাঙ খোঁজার রূপকে তুলে ধরতে চান লেখক। সত্যেন বলে—“হেমন্তের সন্ধ্যাটা কেটে গেল—প্রথম রাতও” – বাবলা ফুলের গন্ধে স্মৃতির পথে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পরিবেশের এক অদ্ভুত গোলকধাঁধার  মাঝে জড়িয়ে গেল। হেমন্তে বাড়ি ফিরে সে যেভাবে কাটাতে চেয়েছিল বেকারজীবন,তার প্রথম রাতটা কাটল আশ্চর্য কিছু বাস্তবতার মধ্যে। ব্যাঙ তাড়ানোর কৌশলে স্ত্রী নির্মলাকে ধূপ আনতে বলাকে কেন্দ্র করে সত্যেন উপলব্ধি করল পিতা ধর্মদাস আর সে নিজে দুজনেই এই সংসারে অকেজো। সে উপলব্ধি করল মা নিরুপমা পুত্রবধূর উপর যে নিষ্ঠুর আচরণ করলেন, তা অমূলক, যেন গৃহকর্ত্রীর অধিকার ফলানোর আস্ফালন। সংসারের রাজনীতিটা উপলব্ধি করতে পারলেও কোন ঐশ্বরিক ক্ষমতা যেন তাকে চুপ থাকতে বাধ্য করল। এই ঐশ্বরিক ক্ষমতার নামই রাজনীতি। অমূলক অনশনে সারাবাড়ির প্রতিটি মানুষ একটা হেমন্তের সন্ধ্যা থেকে রাত্রি কাটিয়ে দিল। প্রকৃতিতে মানুষই একমাত্র প্রাণী, যারা অনশন করে। সত্যেন দেখতে পায় রান্নাঘরে কুকুর, বিড়ালদের যাওয়া আসা। বোউদির প্রতি ছোটো ভাইয়ের নিষ্ঠুর আচরণ, পরিবারের প্রতিটি মানুষ যেন একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। সত্যেন পরের বাড়ির মেয়ে নির্মলার গভীর যন্ত্রণা উপলব্ধি করলেও নিরুত্তর থেকে গেল পিতা ধর্মদাসের মতো। পিতা-পুত্র দুই অভুক্ত পুরুষের অনশনের খোঁজ না-নেওয়া স্ত্রীদের অবস্থান, দাম্পত্যের ফাটলটাকে ‘অনশন’ শব্দ দিয়ে গভীর ব্যঞ্জনাময় করে তুললেন লেখক। গভীর রাতে সন্তানের দুধের জোগাড়ে তোলা উনুনে আগুন দিতে থাকা নির্মলার রূপের দিকে তাকিয়ে ক্ষুধা জাগে সত্যেনের। জৈবিক ক্ষুধা,কিন্তু ঘরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে বধূ নির্মলার উপরে ঘটে যাওয়া নিষ্ঠুরতার থেকেও তার নিজের নিষ্ক্রিয় থাকার গ্লানিকে অনেক বেশি নিষ্ঠুর মনে হতেই সব আকর্ষণ যেন শেষ হয়ে ফুরিয়ে যায়। প্রকৃতির উন্মুক্ত রূপের বাগানে বিচরণ করা সত্যেন হারিয়ে যায় সংসারের অদ্ভুত গোলকধাঁধায়।

কিন্তু পরের গল্প ‘হেমন্তের দিনগুলো’ লেখক হেমন্তের অন্য এক রূপ তুলে ধরেন। ব্যক্ত করেন ভীষণভাবেই বিপরীত চিত্র ও অনুভূতির কথায়। এখানে শহরের ব্যস্ততার সাথে জীবনের বাস্তবতা আঁকলেন। কিছুটা নিজের বাস্তব চরিত্র অবলম্বনে গড়ে তুললেন এক শহুরে বেকার চরিত্র। অসিত মফস্বলের পাকা চাকরি ছেড়ে দিল নিজেই। সে শহরে থেকে গেল বিনা ভাড়ায় এক পরিচিতের খালিবাড়িতে।

গল্পের শুরুতেই লেখক লিখলেন— “হেমন্তের দিনগুলো কলকাতায় কেটে যাচ্ছে। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে— এখন যুদ্ধের পরের পৃথিবী”। যুদ্ধের পরের এই পৃথিবীকে তিনি আশ্চর্য কতগুলি শব্দে ব্যাখা করতে চাইলেন, যায় গভীর অন্তর্নিহিত অর্থ হয়তো সাধারণ পাঠক কেবল কাব্যময় শব্দগুচ্ছে আবদ্ধ রাখতেই পছন্দ করবেন। কিন্তু, এখানে এর গভীর অর্থটিও ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন এই কারণেই, যে অর্থের গভীরেই গল্পের মূল ভাবনার বা তিনি আসলে গল্পের ঠিক কোন জায়গাটা তুলে ধরতে চেয়েছেন, সেটা খানিকটা স্পষ্ট হতে পারে। শহরের লেকপাড়ের জলের ধারে বসে তার মনে হয় পৃথিবী সময়ের হিসেব শেষ করে তাকে দান করেছে— " সুখদুঃখের সত্ত্বশূন্য সময়ঘড়ির অস্তিত্বশূন্য আলোর দেশ”। এখানে ‘সত্ত্বশূন্য’, ‘সময়ঘড়ি’, আর ‘অস্তিত্বশূন্য আলো’, শব্দ গুচ্ছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।  তিনি সুখ-দুঃখের অস্তিত্ব নিয়েই যেন সন্দেহ প্রকাশ করলেন। সত্ত্বশূন্য বলতে বোধহয় তিনি বোঝাতে চাইলেন এইগুলি আসলে ভ্রম, এদের স্থায়িত্বের কোনো স্থিরতা নেই। সময়ঘড়ি চলমানতার প্রতীক। আর অস্তিত্বশূন্য আলো, মানে যে আলোর আসলেই কোনো উৎস নেই, কেবল এক মায়াময় অস্থিরতা মাত্র। দেশ মানে মনের প্রেক্ষাপট। তিনি দেশের পরিস্থিতির বর্ণানার মধ্যে নিজের মনের পেক্ষাপটের ছবিই হয়তো তুলে ধরলেন। পূর্বে উল্লিখিত শব্দগুচ্ছের প্রয়োগ এটাই প্রমাণ করে, তিনি জীবনের সুখ ও দুঃখকে মনের মায়াময় অস্থিরতায় নির্মিত এক ভ্রম বলে মনে করেন, আর এই ভ্রমকে কেন্দ্র করেই তিনি শহুরে পৃথিবীতে হেমন্তে কেবল ধ্বংসের ছবিই আঁকলেন। কলকাতার ভিতরের সমস্যা গুলো ফুটে উঠল নিখুঁত ভাবে। বন্ধু রমেশের সাথে ভাড়াটে বিবাদের চিত্র, পাড়ার ছেলে মনোহরের বখে যাওয়ার গল্পে স্ত্রীর প্রতি শহুরে সন্দেহ। শহরে দালালদের রমরমা ব্যবসা,কালোবাজারি, সিনামায় কাজের প্রলভন –

“ মনোহর বলেছে আজকাল সিনেমায় ভদ্রঘরের মেয়েদের দাবি চড়া দামে মেটানো হয়”

অসিত ও সীতার কথোপকথনের মধ্যেই ফুটে ওঠে শহুরে ফাঁদের গল্প। গল্পের চরিত্র শুরু থেকেই আটাকে রইল ঘরের চার দেওয়ালের মাঝে। সেখানে থেকেই স্ত্রী সীতার সাথে দাম্পত্য প্রেমের বদলে সুচারুভাবে চালিয়ে গেল সচ্ছল জীবনের অভিনয়। প্রথম গল্পের চরিত্র সত্যেন যেমন শহুরে বদ্ধভূমি ছেড়ে বৃহৎ প্রকৃতির মাঝে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিল, দ্বিতীয় গল্পের চরিত্র অসিত চারদেওয়ালের ভিতর থেকেই পৃথিবীকে দেখার নেশায় স্থবির হল। প্রথম গল্পটিতে সংসারের দ্বন্দ্বের একরূপ দেখালেন লেখক, দ্বিতীয় গল্পে সেই দ্বন্দ্ব শুধু স্বামী আর স্ত্রীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেল। হৈমন্তিক গল্পে যে সাংসারিক গোলকধাঁধায় বাঁধা পড়েছিলেন চরিত্রের আড়ালে লেখক, এই গল্পে তিনি একে একে সেই জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে এলেন যেন। দ্বিতীয় প্রসবে স্ত্রী সীতার মৃত্যু হল, ছেলেটিও মারা গেল। বাঁধন মুক্ত অসিত লেকের জলে পা-ডুবিয়ে ভাবতে লাগল তার দেখা হেমন্তের নারীর কথা। দেখা হয়েছিল কি তার সাথে? জীবনের জট খুলে সে একটা চাকরি পেল আর দেখা পেল এক বাজে স্ত্রীলোকের (লেখকের জবানিতে)।  লেকের জলে ভাসমান মুখগুলো সব তার নিজের লোক, একদিন যারা তাকে জড়িয়ে বেঁধে ফেলেছিল জালে। আকাশে তাদের ভাসমান রূপ দেখে অসিতের মনে হল, ওদের পৃথিবীটা অন্য, তার জন্য নয়। অথচ একদিন তাকেও যেতে হবে জীবনের সব অবসাদ, প্রাপ্তি ভুলে কালোবাজার আর সাদা ইয়ার্কির মেরুন রঙের দেশে। সে মেতে উঠল এক পরিণতিহীন অদ্ভুত খেলায়।

এতগুলো বছর পর জীবনানন্দের হেমন্ত, একে একে জলছবি এঁকে দেয়, আমাদের আজকের হেমন্তের গায়ে আর আমরা পাঠকগণ সত্যেনের প্রকৃতির বাগান থেকে কেঠো বাস্তবের শহরের পথে ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে যাই, অদ্ভুত গোলকধাঁধার ভিতর। হেমন্ত মানে প্রকৃতি ও জীবনের এক অদ্ভুত গোলকধাঁধা।