রবীন্দ্রনাথের মানসী
- 07 October, 2024
- লেখক: প্রধন্যা মিত্র
“প্রথম পর্বে কবি নিজেকে ঘোষণা করেন অর্থাৎ কারও কাছে দরদ আদায় করবার ইচ্ছেটাই তাঁর তখন প্রবল। দ্বিতীয় পর্বে কবি বেদনাকে অবিকল ব্যক্ত করেন না, তখন তিনি সৃষ্টি করবার জন্য সুখদুঃখের সীমাকে অতিক্রম করে যান। প্রথম পর্বের মতন অন্যের কাছে নিজের বেদনার জন্য দরদ প্রার্থনা করেন না।”
কেন জানি না, এই প্রথম আমি কাব্যগুচ্ছ সম্পর্কে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যে উক্তি করছেন তার সাথে একমত হতে পারছি না। যেমন একমত হতে পারছি না সূচনা পর্বের কথাতেও। সেখানে তিনি মূলত গাজীপুরে কাটানো সময়ের স্মৃতিচারণ করে কাগজ নষ্ট করেছেন মাত্র। যেন মনে হয়, মানসী-র কবিতাগুলো সেখানে বসে লেখা। একথা ঠিক যে কেন্দ্রগত কবিতাগুলো ওই সময়েই লেখা। সঞ্চয়িতার ভূমিকায় তিনি লিখছেন, “মানসী থেকে আরম্ভ করে বাকি বইগুলির কবিতায় ভালো মন্দ মাঝারির ভেদ আছে, কিন্তু আমার আদর্শ অনুসারে ওরা প্রবেশিকা অতিক্রম করে কবিতার শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছে।” কবির সাথে সহমত। তৎকালীন ক্রিটিকেরাও মানসী-র ভূয়োসী প্রশংসা করেছেন। প্রমথ চৌধুরীর ভাষায়, মানসীতে Despair এবং Resignationএর ভাব প্রবল। রবীন্দ্রনাথ উত্তরে লিখছেন, “ভাল করে ভেবে দেখতে গেলে মানসীর ভালবাসার অংশটুকুই কাব্যকথা। ... ওর আসল সত্যিকথাটুকু হচ্চে এই যে, মানুষ কি চায় তা কিচ্ছু জানে না। ... আমি যদি ঈশ্বর হতে পারতুম! মানুষের মনে ঈশ্বরের মত অসীম আকাঙ্ক্ষা আছে, কিন্তু ঈশ্বরের মতো অসীম ক্ষমতা নেই। ... আমি ভালবাসি অনেককে --- কিন্তু মানসীতে যাকে খাড়া করেচি সে মানসেই আছে --- সে Artist-এর হাতে রচিত ঈশ্বরের প্রথম অসম্পূর্ণ প্রতিমা। ক্রমে সম্পূর্ণ হবে কি?”
আমি বিস্ময়ে স্তন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম চিঠিখানি পড়ে। মানসীর মানস প্রতিমা ঈশ্বরের প্রথম অসম্পূর্ণ প্রতিমা! সত্যিই তাই। আমি যখন মানসী পড়ছি, দেখছি কীরকমভাবে কবিমানসে মানবপ্রেম ধীরে ধীরে ঘটনাবহুল জীবনের মধ্যে দিয়ে ঈশ্বরপ্রেমে রূপ পাওয়ার চেষ্টা করছে। “নিত্য তোমায় চিত্ত ভরিয়া স্মরণ করি, / বিশ্ববিহীন বিজনে বসিয়া বরণ করি; / তুমি আছ মোর জীবন-মরণ হরণ করি।”
মানসীর মতন এমন এলোমেলো কাব্যগ্রন্থ আমি আগে দেখিনি। আমি যখন প্রথম মানসী পড়ি তখন এভাবে এত খুঁটিয়ে পড়ি নি। খেলাচ্ছলে পড়েছিলাম, “কেহ ভোলে, কেউ ভোলে না যে, তাই এসেছি ভুলে’, কখনও পড়েছিলাম, “সবার মাঝে আমি ফিরি একেলা। / কেমন করে কাটে সারাটা বেলা! / ইঁটের 'পরে ইঁট, মাঝে মানুষ-কীট-- / নাইকো ভালোবাসা, নাইকো খেলা।” পড়েছিলাম, “তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি / শত রূপে শত বার / জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।”
মানসী’র যাত্রা শুরু হয়েছিল ৪৯ পার্ক স্ট্রীট থেকে। শেষ হয়েছিল রেড সী-তে। স্বদেশ থেকে বিদেশের এই যাত্রাপথের সময়কাল সাড়ে তিন বছর। ১২৯৪-এর বৈশাখ থেকে শুরু করে ১২৯৭ পর্যন্ত-এর পৌষ। এই সময়ের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের অন্তর্জগত আর বহির্জগত ওলোট পালোট হয়েছে কতবার! কতরকম পরীক্ষা নিরীক্ষা, কতবার কবিতা লেখার বিরতি, কত ভিন্ন ভিন্ন স্থান-কালের মধ্যে দিয়ে মানসী-র যাত্রা। বাইরে থেকে সে যাত্রার যেন কোন উদ্দেশ্য ছিল না। কেবল ছিল চলার বেগে পথ করে নেওয়া। বাইরে থেকে ভিতরে।
“এই কাব্যখানি যে কেবল রবীন্দ্রনাথের কাব্যজীবনে নূতন পন্থার প্রবর্তক তাহা নহে --- উহা সমসাময়িক বাংলা কাব্যের পক্ষেও রীতির দিক দিয়া নূতন আদর্শ স্থাপন করিল।” লিখছেন প্রিয়নাথ সেন। “এ কথা নিশ্চিত যে বাংলা ছন্দের নূতন মুক্তির পথ মানসীই সর্বপ্রথম বাঙালী কবিদের কাছে ধরিয়াছিল। তাঁহার রচনার এই পর্বেই যুক্ত অক্ষরকে পূর্ণ মূল্য দিয়া ছন্দকে নূতন শক্তি দিতে তিনি সক্ষম হইয়াছিলেন। মানসীতে কবির ছন্দেরও নানা খেয়াল দেখা দিতে আরম্ভ করে।” লিখছেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। “আমার রচনার এই পর্বেই যুক্ত অক্ষরকে পূর্ণ মূল্য দিয়ে ছন্দকে নূতন শক্তি দিতে পেরেছি। ‘মানসী’তেই ছন্দের নানা খেয়াল দেখা দিতে আরম্ভ করেছে। কবির সঙ্গে যেন একজন শিল্পী এসে যোগ দিল।” লিখছেন রবীন্দ্রনাথ।
‘কড়ি ও কোমল’ পর্যন্ত ছন্দের যে বাঁধ ছিল, এখানে যেন তা ভেঙে গেল। মানসীর কবিতাগুলো উচ্চৈষ্বরে পড়বার সময় একটা অন্যরকম অনুভূতি হয়। যেন কবিতা আপন ছন্দের আনন্দে ভেসে যেতে চাইছে। পূর্ববর্তী কবিতাগুলো ছন্দের বাঁধনে বেঁধে এগোতে চাইছিল। এ যেন রেললাইনের বাধা পথ ছেড়ে এরোপ্লেনের উড়ান আকাশে অসীমের যাত্রাপথে। কবিতা পাঠের অন্যরকম আনন্দ টের পাওয়া যায়।
মানসীর কবিতাগুলো শুরু হয়েছে বিষাদ দিয়ে। তারপর যেন ‘কি থেকে কি হইয়া গেল’! কবিতার ভাব আর ভঙ্গিমা যেন উড়াল দিল ব্যাঙের মতন। কোথা থেকে যে কোথায় লাফ দিচ্ছেন? ঠাহর করা যাচ্ছে না। খেয়াল করলাম, তারিখের নিকুচি করেছেন রবীন্দ্রনাথ। ১৮৮৭ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসের পর ১৮৮৯ সালের ভাদ্র মাসের কবিতা! পার্ক স্ট্রীট থেকে সোজা ল্যান্ড করেছেন জোড়াসাকোঁতে। কিন্তু এর মধ্যে যে তার আইফেল টাওয়ারে চড়ে প্যারিসের মোহিনীমোহন ভুবনকে নিরীক্ষণ করা হয়ে গেছে তার কোন খবর নেই। খবর নেই বেণু এবং রথীন্দ্রনাথের আগমনের। খবর নেই শান্তিনিকেতন পত্তনের। এতকিছুর মধ্যেও বাইরে থেকে ভেতরের খোঁজ ফল্গুধারার মতো বইছে।
“বক্তৃতাটা লেগেছে বেশ, / রয়েছে রেশ কানে-- / কী যেন করা উচিত ছিল, / কী করি কে তা জানে!”–র মতো স্বদেশি লেখা। “ফেটেছে তরণীতল, / সবেগে উঠিছে জল, / সিন্ধু মেলে গ্রাস। / নাই তুমি, ভগবান, / নাই দয়া, নাই প্রাণ-- / জড়ের বিলাস।” -এর মতন নৌকাডুবি’র ঘটনা। বন্ধুবরেষুকে লেখা পত্রকাব্য। কিচ্ছু বাদ যায় নি। পিওর হযবরল। এতএব মোহিতচন্দ্র সেন মানসী-র কবিতাগুলোকে সাজালেন ভাবানুসারে। বহির্জগত থেকে অন্তর্জগতের দিকে।
কিন্তু আমার রবীন্দ্র‘মানসী’ যাত্রা সময় অনুসারে। আমি দেখলাম রবীন্দ্রনাথকে। তিনি পার্ক স্ট্রীট থেকে উড়াল দিয়ে পৌছলেন গাজীপুরের গোলাপবাগানে; তারপর সোলাপুর থেকে টার্ন নিয়ে নবনির্মিত শান্তিনিকেতনের একমাত্র দোতলা বাড়িটায়; অবশেষে জোড়াসাঁকোর গঙ্গায় এক ডুব দিলেন, পরক্ষণেই উঠলেন লন্ডনের টেমসের ঘাটে। এই সময়পর্বের সাথে সাথে গড়ে উঠল রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী’। বিবিধবহুলতা নিয়ে এমন সামঞ্জস্যপূর্ণ উচ্ছৃঙ্খল সহাবস্থান মনে হয় না তিনি আর কোনও কাব্যগ্রন্থের ক্ষেত্রে সফলভাবে নির্মাণ করতে পেরেছেন। তাই আমার মানসী রবীন্দ্রনাথের মরমী ভাববাদী ‘মানসী’ নয়, রবীন্দ্রনাথের পঁচিশ থেকে আঠাশ বছর বয়সের উত্তোরণের ধাপে ধাপে তৈরী আনন্দ-বেদনার ‘মানসী’।
আমার ‘মানসী’ রবীন্দ্রোক্ত দুই স্তরের নয়; কিম্বা প্রভাতকুমার লেখা তিন স্তরের ‘মানসী’ও নয়।
আমার মানসী সাতটি স্তরে বিভক্ত সপ্তপর্যায়ের পূর্ণ আলেখ্য...
মানসী’র যাত্রা শুরু হয়েছিল ৪৯ পার্ক স্ট্রীট থেকে, শেষ হয়েছিল লন্ডনে। ফিরে আসার পর মানসী প্রকাশিত হয়। ‘উপহার’ নামক কবিতা, যা পত্নী মৃণালিনী দেবীকে উৎসর্গ করা হয়েছিল, সেটা লেখা হয় সবশেষে – “সেই আনন্দমুহূর্তগুলি / তব করে দিনু তুলি / সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণের প্রকাশ।” এবং এই কবিতাতেই মানসী-র মূলভাব পূর্ণভাবে প্রকাশিত --- “আশা দিয়ে, ভাষা দিয়ে, / তাহে ভালোবাসা দিয়ে / গড়ে তুলি মানসী-প্রতিমা।”
আগের পর্বে বলেছি, আমার চোখে মানসী সাত পর্বে বিভক্ত। আমি নিজের মতো করে এই পর্বগুলিকে নির্মাণ করেছি, এবং তার মধ্যে কবিতাগুলোর শ্রেণীবিভাগ করেছি। পুরোটাই কাল অনুসারে। আর কেউ এমন করেছেন কি না জানি না। কেউ জানলে আমায় জানিয়ে বাধিত করবেন।
পর্বগুলি হল ---
১। ৪৯ পার্ক স্ট্রীট পর্ব – এই পর্বের কবিতাগুলো হল – ভুলে, ভুল-ভাঙা, বিরহানন্দ, সিন্ধু তরঙ্গ, শূন্য হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা, পত্র, শ্রাবণের পত্র।
২। দার্জিলিং পর্ব – নিস্ফল কামনা, সংশয়ের আবেগ, বিচ্ছেদের শান্তি, তবু, নিস্ফল প্রয়াস, হৃদয়ের ধন, নিভৃত আশ্রম, নারীর উক্তি, পুরুষের উক্তি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই কবিতাগুলি দার্জিলিং থেকে কলকাতায় ফিরে এসে লেখা। কিন্তু বীজ সুপ্ত ছিল দার্জিলিং-এই।
৩। গাজীপুর পর্ব – মানসী-র কেন্দ্রগত সমস্ত কবিতা এই পর্বে লেখা হয়। এবং এত পরিমাণে লেখা হয় যে এরও তিনটি পর্যায় বানিয়েছি ---
a) প্রথম পর্যায় – শূন্যগৃহে, জীবনমধ্যাহ্ন, শ্রান্তি, বিচ্ছেদ, মানসিক অভিসার, পত্রের প্রত্যাশা, একাল ও সেকাল, আকাঙ্ক্ষা, নিষ্ঠুর সৃষ্টি, প্রকৃতির প্রতি, মরণস্বপ্ন, কুহুধ্বনি।
b) দ্বিতীয় পর্যায় – বধূ, ব্যক্ত প্রেম, গুপ্ত প্রেম, অপেক্ষা, সুরদাসের প্রার্থনা।
c) তৃতীয় পর্যায় – দুরন্ত আশা, দেশের উন্নতি, বঙ্গবীর, নিন্দুকের প্রতি নিবেদন, কবির প্রতি নিবেদন, পরিত্যক্ত, ভৈরবী গান, ধর্মপ্রচার, নববঙ্গদম্পতির প্রেমালাপ।
৪। সোলাপুর পর্ব – প্রকাশ বেদনা, মায়া, বর্ষার দিনে, মেঘের খেলা।
৫। জোড়াসাঁকো পর্ব – ধ্যান, পূর্বকালে, অনন্ত প্রেম, আশঙ্কা, ক্ষণিক মিলন, আত্মসমর্পণ।
৬। শান্তিনিকেতন পর্ব – ভাল করে বলে যাও, মেঘদূত, অহল্যার প্রতি।
৭। বিলাতযাত্রা পর্ব – গোধূলি, উচ্ছৃঙ্খল, আগন্তুক, বিদায়, সন্ধ্যায়, শেষ উপহার, মৌনভাষা, আমার সুখ।
১। ৪৯ পার্ক স্ট্রীট পর্ব –
রবীন্দ্রনাথের মতে, “কবির চিত্তের দুটি পর্ব থাকে। এক অধ্যায়ে সে তার জীবনের গভীর বেদনাকে প্রকাশ করে বলতে চায়, সেই বলা জন্যে তার মন অস্থির হয়ে পড়ে।” রবীন্দ্রনাথ বেদনাকে বিষাদ বা শূন্যতা অর্থে দেখেন নি। এ এক এমন এমন অভাববোধ, যা পার্থিব থেকে অপার্থিবের দিকে নিয়ে যায়। এখান থেকেই শুরু হয় সাধক রবীন্দ্রনাথের যাত্রা। যদিও অনেক আগে, ’নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ থেকেই তা আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন, প্রতি মুহূর্তে তার আভাস আছে। সেটাই বেদনা। এই আভাসের তীব্রতা আপনজনের ছেড়ে যাওয়ার অভাব বোধ কিম্বা আপন জন থেকেও না থাকার যন্ত্রণাবোধ থেকে জন্ম নিতে পারে। মনে রাখতে হবে, ১৮৮৪ সালে কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যা রবীন্দ্রনাথের পক্ষে এতই মর্মান্তিক ছিল, যা পরবর্তীকালে পুত্র শমীর মৃত্যুর সাথে তুলনীয়। রবীন্দ্রনাথ কি তাই বারবার স্বপনে-জাগরণে চাইতেন কাদম্বরী দেবীর সান্নিধ্য? “শুধু মনে পড়ে হাসিমুখখানি, / লাজে বাধো-বাধো সোহাগের বাণী, / সেদিন যে গেছে ভুলে গেছি, তাই এসেছি ভুলে।” এই শূন্যতা তাকে বেদনার পথে নিয়ে গেছে, কারণ, তার পাশের মানুষটিও যেন সহধর্মিনী হয়ে উঠতে পারছেন না। ঠাকুর পরিবারের বধূ আর রবীন্দ্রনাথের পত্নী হওয়া তো এক কথা নয়। “বাঁশি বেজেছিল, ধরা দিনু যেই / থামিল বাঁশি-- /এখন কেবল চরণে শিকল / কঠিন ফাঁসি। / ... সুখ গেছে, আছে সুখের ছলনা / হৃদয়ে তোর। / প্রেম গেছে, শুধু আছে প্রাণপণ / মিছে আদর।” দম্পতির ভালোবাসা একটা সময় পর যখন অভ্যাসে পরিণত হয়, সেই সম্পর্ক বয়ে নিয়ে চলার ক্লান্তির সাথে এই লাইনগুলোর কি নিদারুণ মিল! ‘ভুলে’ আর ‘ভুল-ভাঙা’ কবিতা কোথাও যেন ঈশ্বরীয় বেদনার তীব্রতা বৃদ্ধির কারণ। ‘বিরহানন্দ’ কবিতায় এই প্রেমের বিরহ দেখা দিল আরোও বড়ো হয়ে। বেদনার আবেগের ধাক্কা বৈষ্ণব পদাবলীর সুর ধরে নেমে এল কবিতার ছত্রে --- বিরহ সুমধুর হল দূর কেন রে? / মিলন দাবানলে গেল জ্বলে যেন রে।
পাশাপাশি বাস্তব ঘটনার বীভৎসতায় কবি দগ্ধ হচ্ছেন। ঘটনার কারণ খুঁজছেন। কার কাছে? পরমেশ্বর। দুটি স্টিমার। নাম ‘Retriever’ এবং ‘Sir John Lawrence’। ২৫শে মে ১৮৮৭ সাল। গন্তব্যস্থল পুরী। ঝড়ের কারণে দুটো স্টীমারই ডুবে যায়। মারা যায় ৭৩৫ জন যাত্রী। রবীন্দ্রনাথের মনে এর তীব্র প্রভাব পড়ে। লেখেন ‘সিন্ধুতরঙ্গ’। দয়া আর দয়াহীনতার দোলাচলে প্রশ্ন করেন, “অধ ঊর্ধ্ব এক হয়ে / ক্ষুদ্র এ খেলনা লয়ে / খেলিবারে চায়। / দাঁড়াইয়া কর্ণধার তরীর মাথায়।” কাকে এই প্রশ্ন? কর্ণধারকেই কি?
রবীন্দ্রনাথের বন্ধু প্রিয়নাথ সেন। রয়েছে বন্ধুকে লেখা কাব্যপত্র। দুটি। ‘পত্র’ এবং ‘শ্রাবণের পত্র’। বাসস্থান পরিবর্তন করেছেন। লিখছেন, “দক্ষিণে বেঁধেছি নীড়, / চুকেছে লোকের ভিড়; / বকুনির বিড় বিড় গেছে থেমে-থুমে।” থামছেন, “সাঙ্গ করি এইখানে-- / শেষে বলি কানে কানে,/ পুরানো বন্ধুর পানে মুখ তুলে চেয়ো।” রবীন্দ্রনাথ তাকে ডাকছেন শ্রাবণের পত্রে, “পরিপূর্ণ বরষায় / আছি তব ভরসায়, / কাজকর্ম করো সায়, এস চট্পট্! / ... ছুটি লয়ে কোনোমতে / পোট্মাণ্টো তুলি রথে / সেজেগুজে রেলপথে করো অভিসার।“
অলস প্রিয়নাথ সেন-কে তার মথুর সেনের সংকীর্ণ গলির পুরোনো বাড়ী থেকে একচুলও নড়ানো সম্ভব হয় নি। কবির সে ক্ষমতা যাবজ্জীবনেও সম্ভবপর হয় নি। প্রিয়নাথ সেন-ই তার জন্যে গলির মোড়ে অপেক্ষা করেছেন, চিরকাল, চিরজীবন...
২। দার্জিলিং পর্ব –
১৮৮৭ সালের অক্টোবর মাস। রবীন্দ্রনাথ দার্জিলিং চললেন। সঙ্গী মৃণালিনী দেবী, সৌদামিনী দেবী, স্বর্ণকুমারী দেবী, হিরন্ময়ী দেবী এবং সরলা দেবী। সর্বকনিষ্ঠা সদস্যা বেলা ওরফে মাধুরীলতা। তার বয়স মাত্র এক বৎসর। যাত্রাপথ বড়ো সরল। প্রথমে ট্রেনে করে দামুকদিয়া। স্টীমারে করে পদ্মা পেরিয়ে সরাঘাটে পৌছন রাত্রি দশটায়। তারপর মিটার গেজের ট্রেন। ট্রেনে করে শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি থেকে বিখ্যাত টয়ট্রেন, যা এখন শুধুমাত্র কিছুদুর পর্যন্ত চালানো হয় পর্যটকদের জন্যে, সেটায় করে পরদিন দার্জিলিং। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় – “এই দুদিনে আমি এত বাক্স খুলেছি এবং বন্ধ করেছি এবং বেঞ্চির নীচে ঠেলে গুঁজেছি এবং উক্ত স্থান থেকে টেনে বের করেছি, এত বাক্স এবং পুঁটুলি আমার পিছনে অভিশাপের মতো ফিরেছে, এত হারিয়েছে এবং এত ফের পাওয়া গেছে এবং এত পাওয়া যায় নি এবং পাওয়ার জন্য এত চেষ্টা করা গেছে এবং যাচ্ছে যে, কোন ছাব্বিশ বৎসর বয়সের ভদ্র সন্তানের অদৃষ্টে এমনটা ঘটে নি।”
একুশ বছর বয়েসে রবীন্দ্রনাথ দার্জিলিং-এ এসে মহাচেতনবোধকে অন্তরের অচেতনে হারিয়েছিলেন, এবারে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তার উঠেছিলেন কাসলটন্ হাউসে। কিন্তু অধিকাংশ সময়েই শীত এবং কোমরের বাত তাকে কাবু করে রেখেছিল। Rush Tox 6th dilution এও কাজ হয় নি --- “থেকে থেকে নড়তে চড়তে এমন চীৎকার করছি যে তাকে ঠিক নীরব বলা যায় না।” এই সময়ে সন্ধ্যাবেলা টেনিসন থেকে শুরু করে ব্রাউনিং পাঠ হত। আর ‘মায়ার খেলা’ গীতিনাট্যের খসড়া শুরু হয়। সরলা দেবীর অনুরোধে সখীসমিতির জন্য এই ‘মায়ার খেলা’ লেখা শুরু করেন। লেখা শেষ হয় কলকাতায়। পরবর্তীকালে এই গীতিনাট্য ঠাকুরবাড়ীর মেয়েরা মিলে মঞ্চস্থ করেন ১২৯৫ সালের ১৫ই পৌষ বেথুন স্কুলে। দর্শকেরা সকলেই নারী ছিলেন। বিশিষ্ট দর্শক বড়লাট পত্নী লেডি ল্যান্সডাউন এবং ছোটলাট-পত্নী লেডি বেলী। সমসাময়িক কালে এমন ঘটনা বৈপ্লবিক বললে অত্যুক্তি হয় না।
যাই হোক, একমাস পর কবি ফেরত আসেন পার্ক স্ট্রীটের বাড়ীতে, একা। যে প্রেমকে পার্ক স্ট্রীটের বাড়ীতেই খুঁজছিলেন, তার বাস্তবতার কোন পরিণাম খুঁজে না পেয়ে লেখা হয় এই পর্যায়ের প্রথম কবিতা ‘নিস্ফল কামনা’। এই সময়টা যেন এক পরিবর্তনের সময়। প্রেমকে বুঝতে চাওয়ার জন্য তিনি অন্ধকারে যেন পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছেন, বিফল হচ্ছেন --- “বৃথা এ ক্রন্দন। / হায় রে দুরাশা, / এ রহস্য এ আনন্দ তোর তরে নয়। / যাহা পাস তাই ভালো…”। তার যেন মনে হয়, “আছে কি অনন্ত প্রেম?/ পারিবি মিটাতে / জীবনের অনন্ত অভাব?” কার অভাব বোধ করেন? যে অনন্ত প্রেম সংসারের ছোট-খাটো সুখ-দুঃখের মধ্যে নয়? সেই প্রেম? এ যেন সংশয়ের দোলাচল --- “ভালোবাস কি না বাস বুঝিতে পারি নে, / তাই কাছে থাকি। / তাই তব মুখপানে রাখিয়াছি মেলি / সর্বগ্রাসী আঁখি।” যেন ছুঁয়েও ছোঁয়া যাচ্ছে না? আর তাই কি সাংসারিক প্রেমকে চান বিদায় দিতে? --- “মোহ আনে বিদায়ের বাণী।” তবুও মোহ চ্ছিন্ন হওয়ারও যন্ত্রণা আছে --- “তবু মনে রেখো, যদি মনে প'ড়ে আর / আঁখিপ্রান্তে দেখা নাহি দেয় অশ্রুধার।”
এই পর্যায় যেন এক খোঁজ। দৈহিক সৌন্দর্যে প্রেমকে খোঁজার এক প্রয়াস চলছে --- “আপনার প্রস্ফুটিত তনুর উল্লাস / আপনারে করেছে কি মোহ-নিমগন?” পরক্ষণেই নিজেকে সংযত করছেন --- “কাছে গেলে রূপ কোথা করে পলায়ন, / দেহ শুধু হাতে আসে-- শ্রান্ত করে হিয়া।” অতঃপর স্থির হতে চান। বাইরের সে রূপকে দেখতে চান অন্তরে --- “অনুপম জ্যোতির্ময়ী মাধুরীমুরতি / স্থাপনা করিব যত্নে হৃদয়-আসনে।”
এই পর্যায়ের সবচেয়ে বিস্ময়কর জোড়া কবিতা --- ‘নারীর উক্তি’ ও ‘পুরুষের উক্তি’। কান্না এবং প্রেম-অপ্রেমকে কেন্দ্র করে দুই লিঙ্গের চেতন মনের দ্বন্দ্ব। নারীমনকে এমনভাবে বুঝলেন কি করে? কখন? জোড়াসাঁকোর ঘেরাটোপে কখন জানলেন নারীকে, তার একনিষ্ঠ প্রেমের বাসনাকে? --- “কেন কাঁদি বুঝিতে পার না? / তর্কেতে বুঝিবে তা কি? / এই মুছিলাম আঁখি--/ এ শুধু চোখের জল, এ নহে ভর্ৎসনা।” আর পুরুষকে দেখেছেন কোন আয়নায়? --- “কেন হেরি অশ্রুজল / হৃদয়ের হলাহল, / রূপ কেন রাহুগ্রস্ত মানে অভিমানে।” এবং এখান থেকেই সেই যথার্থ উপলব্ধি, বাসনার শেষেই আছে প্রেমের যথার্থ স্বরূপ।
অতঃপর এই পর্যায়ের বোধের অনুভূতির উত্তরণের সাথে সাথে মানসীর কাব্যধারায় আবার একটা বড়ো ছেদ পড়ল।
৩। গাজীপুর পর্ব –
বাসনামুক্ত প্রেমকে নিবিড়ভাবে জানতে চাইছেন সঙ্গিনী সহযোগে, তাকে পেতে চাইছেন নিবিড় অখন্ড নিরালায়। স্থির করলেন গাজীপুর যাবেন। বলা ভাল এই পর্বই সবচেয়ে নিবিড়, গভীর এক উত্তোরণের পর্ব। কবির মানসলোকের একান্ত কবিতার পর্ব।
দুর সম্পর্কের আত্মীয় গগনচন্দ্র রায়, থাকেন উত্তরপ্রদেশের গাজীপুরে। আমন্ত্রন জানালেন। বিস্তীর্ণ গোলাপক্ষেতের খ্যাতি আগেই শুনেছিলেন। এতএব, ১২৯৪ বঙ্গাব্দে উঠলেন স্ত্রী-কন্যাসহ ট্রেনে। নামলেন দিলদারনগর। সেখান থেকে ট্রেন পালটে তাড়িঘাট। তাড়িঘাতের গঙ্গা পেরোলেন স্টীমারে। ওপারে গাজীপুরঘাট। ঘোড়ার গাড়ি অনেক গলিঘুজি পেরিয়ে পৌছে দিল বাংলো বাড়ীতে। রবীন্দ্রনাথ হতাশ হলেন --- “শুনেছিলুম গাজিপুরে আছে গোলাপের খেত। আমি যেন মনের মধ্যে গোলাপবিলাসী সিরাজের ছবি এঁকে নিয়েছিলুম। তারি মোহ আমাকে প্রবলভাবে টেনেছিল। সেখানে গিয়ে দেখলুম ব্যাবসাদারের গোলাপের খেত, এখানে বুলবুলের আমন্ত্রণ নেই, কবিরও নেই; হারিয়ে গেল সেই ছবি।”
এই পর্বে কিন্তু স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছিল। কোন স্ত্রী না পেতে চায় স্বামীকে একান্তে? বিশেষত ঠাকুর পরিবারের ভয়ঙ্কর একান্নবর্তী পরিবারের থেকে? নিবিড় করে সংসারকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নিতে চেয়েছিলেন মৃণালিনী দেবীও। এই সময়টা তার কেমন কেটেছিল? তার স্বামী তো আর যে সে মানুষ নন, একজন সফল নাট্যকার, কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক এবং আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক।
অপর দিকে রবীন্দ্রনাথ অখন্ড একাকীত্বকে ব্যবহার করলেন মনের একান্ত গভীর গোপনের খোঁজে। ১২৯৫ বঙ্গাব্দের ১১ই বৈশাখ থেকে ২৩শে আষাঢ়। এর মধ্যে লিখলেন আঠাশটা কবিতা। এইপর্বে, আমার মত, তিনটে স্তরে ভাগ করা যায়। প্রথম স্তরের লেখাগুলো বৈশাখ মাসেই। আবেগপ্রবণ কল্পনাকে সংযত করছেন, কার কাছে? “কাল ছিল প্রাণ জুড়ে, আজ কাছে নাই-- / নিতান্ত সামান্য এ কি নাথ? / তোমার বিচিত্র ভবে / কত আছে কত হবে, / কোথাও কি আছে প্রভু, হেন বজ্রপাত?” কার অভাব এখনও তাড়িয়ে বেড়ালেও কোথাও যেন সেই অভাবকে সমর্পণ করতে চাইছেন? কাদম্বরী দেবী? ঠিক চার বছর আগে যিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে? --- “মানস-মুরতিখানি আকুল আমায় / বাঁধিতেছে দেহহীন স্বপ্ন-আলিঙ্গনে।” তার বেদনার মূল্য পৃথিবীতে কতটা? --- “কেহ নাহি চেয়ে দেখে কার কোথা বাজিছে বেদনা।” জীবনটাকে কি একবার ফিরে দেখা উচিৎ? --- “কুটিল হইল পথ, জটিল জীবন,/ বেড়ে গেল জীবনের ভার--” উপায়? উপায় তুমি। --- “তাই আজ বার বার ধাই তব পানে, / ওহে তুমি নিখিলনির্ভর-- / অনন্ত এ দেশকাল আচ্ছন্ন করিয়া / আছ তুমি আপনার 'পর।” আমি এবার যেন প্রচ্ছন্নভাবে নৈবেদ্য-র রবীন্দ্রনাথকে দেখতে পাচ্ছি --- “তখন তোমার পানে দেখি নাই চেয়ে, / জানি নাই তোমার প্রতাপ-- / তোমার অগাধ শান্তি, রহস্য অপার, / সৌন্দর্য অসীম অতুলন--”।
মরণস্বপ্ন, বিচ্ছেদ, কুহুধ্বনি কিম্বা শ্রান্তি --- বৈশাখের প্রায় সমস্ত কবিতাতেই সংযত করার এক চেষ্টা দেখি আমি। কোন কিছুকেই অস্বীকার করছেন না। কোন আবেগকে বাধা দিচ্ছেন না। যেতে দিচ্ছেন মনের ওপর দিয়ে, শান্তভাবে। তারপর তার অবশিষ্ট চেতনবোধকে রূপদান করছেন কাব্যে। সৃষ্টি হচ্ছে একের পর এক বৈশাখী কবিতা।
এরপর পনেরো দিন রবীন্দ্রনাথ একটাও কবিতা লেখেন নি।
“একদিন শুনিলাম কবিবর রবীন্দ্রনাথ গাজীপুর আসিয়াছেন। রবিবাবু আমার ‘ফুলবালা’ এবং ‘ঊর্মিলা’ কাব্যের পক্ষপাতী ছিলেন ও আমার ‘নির্ঝরিণী’ কাব্যের ‘আঁখির মিলন’ কবিতাটি তাঁহার বড়ই ভালো লাগিয়াছিল।” কবি দেবেন্দ্রনাথ মিত্র লিখছেন ‘স্মৃতি’ প্রবন্ধে। ফলত দুই কবিতে বন্ধুত্ব হল। অনেক নির্জন বেলা কাটল কাব্যচর্চায়। কেটে গেল পনেরো দিন। এল জ্যৈষ্ঠ মাস। ১২৯৫ বঙ্গাব্দ।
প্রথম যে কবিতাটা লিখলেন, বাংলা কাব্যজগতের স্মরণীয় কবিতা। বধূ --- “বেলা যে পড়ে এল, জলকে চল্!-- / পুরানো সেই সুরে কে যেন ডাকে দূরে, / কোথা সে ছায়া সখী, কোথা সে জল! / কোথা সে বাঁধা ঘাট, অশথ-তল!” এক নির্মম নারীবোধের সংযমিত বহিঃপ্রকাশ। পড়তে পড়তে কতবার আমার মনে হয়েছে, আমিই সেই ‘বধূ’। আমাকেই যেন আটকে দেওয়া হয়েছে এ মহাপৃথিবীতে। সমাজ যেন কীটের মতো। ভালোবাসা নেই, স্নেহ নেই --- “বিরাট মুঠিতলে চাপিছে দৃঢ়বলে, / ব্যাকুল বালিকারে নাহিকো মায়া!” মুক্তি চাই আমার, মুক্তি... মরণেই কি সেই মুক্তি? “দেবে না ভালোবাসা, দেবে না আলো। / সদাই মনে হয় আঁধার ছায়াময় / দিঘির সেই জল শীতল কালো,”…
এই কবিতার মধ্যে দিয়ে যে নারীর জন্ম হল, মনে হয় যেন, প্রথম রবীন্দ্রমানসকন্যার জন্ম হল। যে মুক্তি চায় এই পাষাণ ভালোবাসা থেকে, রবীন্দ্রনাথের মতো। বাস্তবের রূঢ়তা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়, প্রতিষ্ঠা করতে চায় নীরব প্রেম। বৈষ্ণবী রাধাময়তার মমতাধারায় নির্মিত অজ্ঞাতকুলশীলা বালিকা রূপ নিল একে একে ‘ব্যক্ত প্রেম’, ‘গুপ্ত প্রেম’ এবং ‘অপেক্ষা’ কবিতাত্রয়ের মধ্যে দিয়ে, হল নারী --- “মনে গোপনে থাকে প্রেম, যায় না দেখা, / কুসুম দেয় তাই দেবতায়।” নারীকে প্রেমময়ীরূপে দেখতে চাওয়ার প্রথম সোপান এই তিন কবিতা। “সুখদুঃখ ভাগ লয়ে প্রতিদিন যায় বয়ে, / গোপন স্বপন লয়ে কাটে বিভাবরী। / লুকানো প্রাণের প্রেম পবিত্র সে কত!” মানসসুন্দরীর নির্মাণ কি এখান থেকেই শুরু হয়? অতঃপর ‘সুরদাসের প্রার্থনা’, এ পর্যায়ের এক বিচ্ছিন্ন কবিতা। মানসীতে রাখার প্রয়োজন ছিল না। রইল অন্যান্য খাপছাড়া কবিতার মতো। আপন চেতনার দ্যোতনায়।
তৃতীয় পর্যায় শুরু হয় ‘সুরদাসের প্রার্থনা’ লেখার ঠিক চারদিন পরেই। এই পর্যায় আবার সমস্ত কাব্যিক সুষমার পথ ভেঙে একেবারে সমাজের মাঝখানে ঝাঁপিয়ে পড়া। “অন্নপায়ী বঙ্গবাসী / স্তন্যপায়ী জীব / জন-দশেকে জটলা করি / তক্তপোষে ব'সে।” --- বাঙালীর এমন মোক্ষম পরিচয় আর কে দিয়েছে? আজও বাঙালী এমনই। “কাগজ নেড়ে উচ্চ স্বরে / পোলিটিকাল তর্ক করে, / জানলা দিয়ে পশিছে ঘরে / বাতাস ঝুরুঝুর।” শুনেছি, লোকাল ট্রেনের নিত্যযাত্রীরা জানলার ধারে বসে এমন তর্ক করেন। তারা না কি এমন রাজনৈতিক বোদ্ধা, যে এক মিনিট তাদের আলোচনা শুনলে মনে হয়, তারা জাস্ট পার্লামেন্ট থেকে ট্রেনে এসে উঠেছেন। আর এও শুনেছি, তারা না কি জানেন না এমন কোন বিষয়ই নেই। সব বিষয়ে এমন চাকুরে বোদ্ধা অফিস টাইমে পথে-ঘাটে বিনা পয়সায় দেখা যায় --- “আয় রে ভাই, সবাই মাতি / যতটা পারি ফুলাই ছাতি, / নহিলে গেল আর্যজাতি / রসাতলের পানে।” অবশ্য সোশাল মিডিয়াতেও কম দেখছি না ইদানীং। সবাই সব কিছু জানে --- এমনকি প্রধন্যা মিত্র-ও --- “আমি দেখো ঘরে চৌকি টানিয়ে / লাইব্রেরি (পড়ুন গুগ্ল) হতে হিস্ট্রি আনিয়ে / কত পড়ি, লিখি বানিয়ে বানিয়ে / শানিয়ে শানিয়ে ভাষা।” বাঙালীর ফাঁকা মদমত্ততা কিছুতেই যায় না। তারা সবজান্তা। আর সেই কারণেই বাঙালী কখনও আবিস্কারক হতে পারে নি। আবিস্কারকে তুলোধনা করেও তার সার্থক ব্যবহার করতে জানে। রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন, লিখেছিলেন। আর এইভাবেই কবিতার পর্যায় এগিয়ে চলে একে একে ‘ধর্মপ্রচার’ পর্যন্ত। সামাজিক অভিঘাতের চিহ্ন এই পর্যায়ের কবিতাগুলির মধ্যে স্পষ্ট।
পরের তেইশ দিন আর কোন কবিতা নেই। এর মধ্যে তিনি কলকাতা ফিরেছেন। ইন্দিরা ও সুরেন্দ্রনাথকে নিয়ে এসেছেন। তারা কিছুদিন কাটিয়ে ফিরে গেছেন। এসেছেন স্বর্ণকুমারী দেবী। তারা সেখান থেকে কাশী গেছেন। আবার ফিরে এসেছেন গাজীপুরে। এবং তারপরেই এই পর্যায়ের শেষ কবিতা, হাস্যরসের পেছনের এক করুণ উপাখ্যান – নববঙ্গদম্পতির প্রেমালাপ। আগে হাসতাম কবিতাটা পড়ে। এবার বড়ো কষ্ট হল। ‘পিরালী’ সম্প্রদায়ের সামাজিক অবস্থান এতটাই নীচে যে, রবীন্দ্রনাথ বিবাহ করতে একরকম বাধ্য হন মৃণালিনী দেবীকে। ঠাকুরবাড়ীর সংস্কৃতির সাথে তার নিজেকে খাপ খাওয়াতে যেমন বেগ পেতে হয়েছিল, তেমনই রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার সাথে তার পরিচয় ছিল, কিন্তু বোধ ছিল না। আর ছিল না বলেই রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরী দেবীর অভাব কোনদিন ভুলতে পারেন নি। ফলে সেই সময় বারবার তাকে ফিরে আসতে হয়েছে ইন্দিরার কাছে। সেই আক্ষেপেই কি এই কবিতার রচনা? বাসরশয়ানে বিদ্বান বর এবং ছেলেমানুষ বউ কি নিয়ে আলাপ করবে? দুজনের মধ্যেই যে মানসিকতার আকাশ-পাতাল ফারাক। সাংসারিক দিক থেকে মৃণালিনী দেবী লা জবাব। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কি সংসারের জন্যেই নিবেদিতপ্রাণ? তা তো নয়! ফলে রবীন্দ্রনাথের অভাববোধ থেকে উঠে আসা একাকীত্বের ব্যঙ্গ এই কবিতার বিষমাল্য। যা তাকে ফিরিয়ে আনে আবার --- গাজীপুর থেকে কলকাতায়।
৪। সোলাপুর পর্ব –
রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম হয় ২৭শে নভেম্বর ১৮৮৮। রবীন্দ্রনাথের এখন এক পুত্র, এক কন্যা। দুজনকে একসাথে সামলাতে অপারগ মৃণালিনী দেবী। তার ফলে কি কোন মন কষাকষি হয়েছিল? অসম্ভব নয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এই কারণটিকে কেন্দ্র করেই রবীন্দ্রনাথ বেলাকে নিয়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সোলাপুরে, মেজদাদার কাছে। কলকাতায় থেকে যান রথীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী দেবী।
কেমন কাটত সোলাপুর? চারিদিক মরুভূমির মতো ধূ ধূ। শুকনো গরম --- “শরীরের ঘর্ম সজলাবস্থা প্রাপ্তির পূর্বেই শুকিয়ে যায়।” রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখতেন, নিয়মিত টেনিস খেলতেন। বন্ধু প্রিয়নাথকে লেখা চিঠি থেকে জানা যায়, খেলতে গিয়ে পড়ে তার পা-ও ভেঙেছিল। বন্ধু বিহারীলাল গুপ্তের কন্যার বিবাহের জন্য গান লেখেন – সুখে থাকো আর সুখী করো সবে। একমাস পরে সেখান থেকে যান পুণার খিড়কি নামক শহরতলীতে। আর এখানেই আবার রচিত হয় মানসী’র চতুর্থ অধ্যায়।
এইসময় ‘রাজা ও রাণী’র নির্মাণ চলছে। ফলে তার দুঃখবাদ এই পর্যায়ের কবিতাগুলোর মধ্যেও দেখা যায় --- “বৃথা এ বিড়ম্বনা! / কিসের লাগিয়া / এতই তিয়াষ, / কেন এত যন্ত্রণা!” বিরহ এবং বিরহজনিত কষ্ট --- চিরকালীন কাব্যচেতনার এই চেনা আবেগ এই পর্যায়ের প্রায় সব কবিতাতেই ধরা দিয়েছে। এর সাথে ‘রাজা ও রাণী’ যুক্ত হওয়াতে সে এক ক্যাটাভ্যারাস কান্ড --- “দূরে শুধু ধ্বনিছে সতত / অবিশ্রাম মর্মরের মতো, / হৃদয়ের হত আশা যত / অন্ধকারে কাঁদিয়া বেড়ায়।” “এমন দিনে তারে বলা যায়” ... সেই বিখ্যাত গানের কাব্যরূপ ‘বর্ষার দিনে’ এইসময়েই লেখা হয়। রবীন্দ্রনাথের শূন্যতা যেন কলকাতা থেকে পূণাতেও তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
১২৯৬ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসে আবার সোলাপুরে ফিরে আসেন। কয়েকদিন থাকেন। ওই মাসেরই শেষের দিকে বেলাকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। ট্রেনে লিও তলস্তয়ের ‘আনা কারেনিনা’ কিছুটা পড়ে হতাশ হয়ে বন্ধ করে দেন। ইন্দিরাকে লেখেন --- “Anna Karenina পড়তে গেলুম, এমনি বিশ্রী লাগল যে পড়তে পারলুম না --- এ রকম সব Sickly বই পড়ে কী সুখ বুঝতে পারি নে। আমি চাই বেশ সরল সুন্দর মধুর উদার লেখা --- কূটকচালে অদ্ভুত গোলমেলে কাণ্ড আমার বেশিক্ষণ পোষায় না।”
হায় তলস্তয়, হায় রবীন্দ্রনাথ!
৫। জোড়াসাঁকো পর্ব –
কলকাতায় ফিরেই মহর্ষির আদেশে তাকে যেতে হয় জমিদারী দেখাশোনার কাজে, শিলাইদহে। একমাস পরে ফিরে আসেন। এ নিয়ে ইন্দিরা দেবীকে লেখা অনেক চিঠি আছে।
এই সময়ে ইন্দিরা দেবীর সাথে তার চিঠি-চাপাটির পরিমাণ বেড়ে যায়। মনজগতে একাকী রবীন্দ্রনাথ তার মনের কথা বলার মানুষ খুঁজে পান তার ষোলো বৎসরের বুদ্ধিদীপ্তা ভ্রাতুস্পুত্রীর মধ্যে --- “তোকে আমি যে-সব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্র ভাব যে রকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার আর কোন লেখায় হয় নি।” প্রসঙ্গত, সবচেয়ে বেশি চিঠি তিনি লিখেছিলেন রানী মহলানবীশকে। এছাড়াও হেমন্তবালা দেবীকে লিখেছিলেন পাঁচ শতাধিক চিঠি। সেগুলোর পরেও কি রবীন্দ্রনাথ একই কথা বলবেন? বলা কঠিন। কারণ, তখন তিনি যে বয়সে এসে পৌছেছেন, তিনি আর তরুণ-তুর্কী গোত্রের নেই। তিনি বেশ জানেন, কিভাবে সম্পর্ককে একটু দুরত্ব রেখে পরিচালনা করতে হয়। কীভাবে আপন একাকীত্বকে সামলাতে হয়।
“... দেখি, রবীন্দ্রনাথকে দুই জগতে ভ্রমণ করতে, একটি অতীতলোকে প্রেমের আলেয়াকে ধ্রুবতারকা প্রভাবে অনুধাবন ও কবিতারচনার দ্বারা আত্মসুখ সন্ধান; অপরটি হইতেছে জীবন্তপ্রাণের সঙ্গে পত্র লিখিয়া মনের কথা বলিবার পরিবেশ রচনা।” লিখছেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। বলা বাহুল্য, মৃণালিনী দেবীর স্থান এখানে নেই। মৃণালিনী দেবী কোনদিনই তেমন পত্রকুশলী ছিলেন না। ফলে শূন্যতা পূরনের স্থান অর্ধাঙ্গিনী নিতে পারেন নি। এই পর্বে পড়ছেন Animal Magnetism নামক সন্মোহনবিদ্যা-র দুর্বোধ্য একটি বই এবং রচিত হচ্ছে মানসীর পঞ্চম পর্ব। সেগুলো লেখা হচ্ছে জোড়াসাঁকো ফিরে।
সাজাদপুর কি তাকে এক অখন্ড সত্ত্বার আভাস দিয়েছিল? --- “তুমি প্রশান্ত চিরনিশিদিন, / আমি অশান্ত বিরামবিহীন / চঞ্চল অনিবার-- / যত দূর হেরি দিক্দিগন্তে / তুমি আমি একাকার।” তিনি কি পেলেন তার ধ্যানের ধনখানিকে? “আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি / যুগল প্রেমের স্রোতে / অনাদিকালের হৃদয়-উৎস হতে।” কে তুমি? যাকে খুঁজতে চেয়েছিলেন বাস্তবে, নারীস্নেহে, তারই পরম রূপ কি তিনি পেলেন প্রকৃতির অনন্ত নীরব সৌন্দর্যের ওপারে? --- “তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি / শত রূপে শত বার / জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।” এ প্রেমেও আশঙ্কা আছে, ক্ষণিকের মিলন আছে, আর আছে পূর্ণ আত্মসমর্পণ, আর আছে বাস্তব ও কল্পনায় মিলে মিশে একাকার হয়ে যাওয়া --- “বাঁচিলাম প্রাণে তেয়াগিয়া লাজ, / বদ্ধ বেদনা ছাড়া পেল আজ, / আশা-নিরাশায় তোমারি যে আমি / জানাইনু শত বার।”
৬। শান্তিনিকেতন পর্ব –
১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে মহর্ষি নিভৃতে ঈশ্বরচিন্তা ও ধর্মালোচনার উদ্দেশ্যে বোলপুর শহরের উত্তর-পশ্চিমাংশে শান্তিনিকেতন নামক স্থানে এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮৮ সালের অক্টোবরে দোতলা গৃহ নির্মাণ হয় এবং আশ্রম স্থায়িত্ব লাভ করে। --- “… মধ্যেকার এই মরুক্ষেত্র অনশনশীর্ণ পাণ্ডুবর্ণ তৃণে আচ্ছন্ন, মাঝে মাঝে একএকটা নিতান্ত খর্ব্বাকার খেজুরের ঝোপ --- মাঝে মাঝে মাটি দগ্ধ হয়ে কালো হয়ে কঠিন হয়ে পৃথিবীর কঙ্কালের মতো বেরিয়ে এসেছে।” প্রমথ চৌধুরীকে লেখা এই চিঠিই বোঝবার জন্য যথেষ্ট তৎকালীন শান্তিনিকেতনের হালত।
এই পর্যায়ে তিনি জার্মান ভাষায় গ্যেটের ‘ফাউস্ট’ পড়ছেন আর গোটা তিনেক কবিতা লিখছেন, যা মানসী’র পরের পর্ব। তিনটি কবিতা --- ‘ভালো করে বলে যাও’, ‘মেঘদূত’ আর ‘অহল্যার প্রতি’। শেষ দুটি কবিতা মানসীর আরেক ধারার কবিতা। রবীন্দ্রনাথ এবার তার ব্যক্তিগত পরিসর থেকে যেন সরে আসছেন। তার চোখ পড়েছে পুরাকালের মহাকাব্যে। লেখার ধারাও বদলে গেছে, ছন্দ হয়েছে আমিত্রাক্ষর --- “কবিবর, কবে কোন্ বিস্মৃত বরষে / কোন্ পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে / লিখেছিলে মেঘদূত!” পৌরাণিক কাহিনী ছুঁচ্ছেন, কিন্তু তা রূপান্তরিত হচ্ছে আদিলীলা’র মহাছন্দের গাঁথা –--- “জীবধাত্রী জননীর বিপুল বেদনা, / মাতৃধৈর্যে মৌন মূক সুখদুঃখ যত / অনুভব করেছিলে স্বপনের মতো / সুপ্ত আত্মা-মাঝে?” অহল্যার প্রতি এই উক্তি কোথাও যেন শান্তিনিকেতনের ধূ ধূ রুক্ষতা হয়ে মিশে যায় সমগ্র পৃথিবীর কালপ্রবাহের মধ্যে –--- “সুপ্ত ছিলে এতকাল ধরণীর বক্ষে / চিররাত্রিসুশীতল বিস্মৃতি-আলয়ে; / যেথায় অনন্তকাল ঘুমায় নির্ভয়ে / লক্ষ জীবনের ক্লান্তি ধূলির শয্যায়;”
৭। বিলাতযাত্রা পর্ব –
১৮৯০ সালের আগস্ট মাস। রবীন্দ্রনাথ এলেন সোলাপুরে। সঙ্গী লোকেন পালিত। সোলাপুরে থাকাকালীন রচিত হল তিনটে কবিতা --- ‘গোধূলি’, ‘উচ্ছৃঙ্খল’ এবং ‘আগন্তুক’ --- “দুরন্ত সাধ কাতর বেদনা / ফুকারিয়া উভরায় / আঁধার হইতে আঁধারে ছুটিয়া যায়।” আবার সেই শূন্যতা, কিন্তু এবারে যেন তা অনেক সংযত। এবারে শুধুই তাকে নিরীক্ষণ করা – “কোথা হতে এত বেদনা বহিয়া / এসেছে পরান মম। / বিধাতার এক অর্থবিহীন / প্রলাপবচন-সম। / প্রতিদিন যারা আছে সুখে দুখে / আমি তাহাদের নই--”
মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের সাথে দুজনে চললেন বোম্বাই। Siam নামক জাহাজে চাপলেন। এলেন এডেনে। সী সিকনেসে ভয়ানক কষ্ট পেলেন --- “তিনদিন ধরে যা’ একটু কিছু মুখে দিয়েছি অম্নি তখনি বমি করে ফেলেচি --- মাথা ঘুরে গা ঘুরে অস্থির --- বিছানা ছেড়ে উঠিনি। কি করে বেঁচেছিলুম তাই ভাবি।” লিখছেন স্ত্রীকে ‘ভাই ছোটবউ’ সম্বোধনে। এডেন থেকে চড়লেন ‘ম্যাসালিয়া’ নামক এক অস্ট্রেলিয়ান যাত্রী জাহাজে। রবীন্দ্রনাথের আঙ্গুল কেটে দুটো গর্ত হয়েছে, ভয়ানক কষ্ট পেয়েছেন। অইওনিয়া দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে দিয়ে পৌছলেন ব্রিসিন্দি। সেখান থেকে ইতালী। ইতালী থেকে প্যারিস।
প্যারিসে ছিলেন একটি মাত্র দিন। চড়েছিলেন আইফেল টাওয়ারে। বিশ্বকে কেমন লেগেছিল তার অমন ৯৮৪ ফুট উঁচু যান্ত্রিক অট্টালিকায় চড়ে? প্যারিস থেকে লন্ডনে। এই সময়ে কিন্তু যথার্থই ‘মিস’ করছেন তার পত্নীকে। লিখেছেন বেশ কয়েকটা চিঠি। কবিতা, যা মানসী-র শেষ পর্যায়। লিখছেন --- “অকূল সাগর-মাঝে চলেছে ভাসিয়া / জীবনতরণী। ধীরে লাগিছে আসিয়া / তোমার বাতাস, বহি আনি কোন্ দূর / পরিচিত তীর হতে কত সুমধুর / পুষ্পগন্ধ, কত সুখস্মৃতি, কত ব্যথা, / আশাহীন কত সাধ, ভাষাহীন কথা।”
লন্ডন থেকে ফেরত আসছেন যখন, রেড সী-তে লিখছেন চারটি কবিতা --- ‘সন্ধ্যায়’, ‘শেষ উপহার’, ‘মৌনভাষা’ এবং ‘আমার সুখ’। এবং মানসীর এই শেষ চারটে কবিতার মধ্যে সে একই বিষাদ্গাঁথা আবার ফিরে আসে --- একাকীত্ব, যন্ত্রণা, বেদনা এবং তা থেকে বেরিয়ে আসা অভিযোগ --- “পাশাপাশি কাছাকাছি তৃষাতুর চেয়ে আছি, / চিনিতেছি চিরযুগ, চিনি নাকো কেহ কারে। / দিবসের কোলাহলে প্রতিদিন যাই চলে, / ফিরে আসি রজনীর ভাষাহীন অন্ধকারে--”
বিলেত থেকে ফিরে আসার পর শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপনের উৎসবে যোগদান করেন। এবং অতঃপর অল্পকালের মধ্যেই ‘মানসী’ প্রকাশিত হয়। ১০ই পৌষ ১২৯৭। সাড়ে তিন বছর ধরে তিলে তিলে বিভিন্ন স্ময়ের বাঁকে কবিতার যে অজস্র ছন্দধার গাঁথা হল, তার মুদ্রিত নির্মাণ এবং প্রকাশ হল। হল, তবে সময়ানুযায়ী নয়। তার অনুভূতির দুটি স্তরকে মাথায় রেখে। ফলে এই বৈচিত্রতা তার মধ্যে পাওয়া গেল যে পাঠক সমাজে সমাদর এবং বিস্ময় দুটোই যুগপৎ হল --- “মানশী পাঠ করিতে করিতে চোখের সন্মুখে যে একখানি স্বপ্নরাজ্য ভাসিয়া আসে ... ইহাতে যেন আধ-আলো আধ-ছায়া, আধ-স্বর্গ আধ-মর্ত্য দেখিতেছি।” লিখছেন গিরীন্দ্রমোহিনী দেবী। “এ কথা নিশ্চিত যে বাংলা ছন্দের নূতন মুক্তির পথ মানসীই সর্বপ্রথম বাঙালি কবিদের কাছে ধরিয়াছিল।” লিখছেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়।
কিন্তু অন্তর্জগতের যে ঘুর্ণীতে তিনি ডুবে গিয়েছিলেন, এবং পরবর্তীকালে তা থেকে উত্তোরণ করেছিলেন, যা তার একান্ত মনের ভাষা, প্রাণের ছন্দ --- তার খবর কে রাখে?