শতবর্ষে নেরুদার প্রেম

বাঙালি পাঠকের কাছে যে পাবলো নেরুদার নাম সুপরিচিত সেই নেরুদা সংগ্রামী, কম্যুনিস্ট নেরুদা। প্রেমের কবি নেরুদার ভালোবাসার কবিতার চেয়েও তাঁর বিপ্লবী কবিতা বাঙালিকে বেশি নাড়া দিয়েছিল। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো মহান কবি তাঁর কবিতার বাংলা ভাষান্তর করেন এবং তা ঘরে ঘরে ছড়িয়ে যায়। তার সঙ্গে পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত হয় ইংরাজি অনুবাদে তাঁর একটি কাব্য সংকলন। সেই ১৯৭৫ সালের কথা। গার্সিয়া মার্কেস আজ যেমন কাছের, নেরুদাও তখন বাঙালির নিজস্ব কবি হয়ে উঠেছিলেন। সেই নেরুদার যে কবিতার বই জনমানসে প্রথম সাড়া জাগিয়েছিল, যে কবিতার বইয়ে ছিল নোবেলজয়ী নেরুদার অঙ্কুরোদগম, সেই ‘কুড়িটি প্রেমের কবিতা ও একটি হতাশার গান’ (Veinte poemas de amor y una canción desesperada) এ বছর প্রকাশের শতবর্ষ পূরণ করল। ১৯২৪ সালের জুন মাসে চিলের নাসিমেন্তো প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয় এই বই। তারপর গোটা একটি শতাব্দী চলে গেছে, কিন্তু বইটি এখনও সমান জনপ্রিয়, সমতুল প্রাসঙ্গিক। প্রেম তো পুরনো হয় না; প্রমের কবিতাও দীর্ণ হয়না; বহু ব্যবহারেও নয়। চিরন্তন ‘বেস্ট সেলার’ এই বই শুধু স্প্যানিশ ভাষাতেই বিক্রি হয়েছে সম্ভবত ১ কোটি ৫০ লাখেরও অধিক। চিলের প্রতিটি ঘরে বাইবেল না থাকলেও একখানি ‘কুড়িটি প্রেমের কবিতা...’ থাকবেই।

‘কুড়িটি প্রেমের কবিতা...’ নেরুদার দ্বিতীয় কবিতাপুস্তক। প্রথমটির নাম ‘গোধূলি’ (Crepusculario), প্রকাশিত ১৯২৩ সালে। কিন্তু এই কাব্যগ্রন্থটিকেই নেরুদার নিজস্ব ঘরাণার সূচনা হিসাবে ধরা হয়। তাঁর কবিতায় বুদ্ধিমত্তার থেকে সংবেদনশীলতার প্রভাব অনেক বেশি আর তাঁর সমস্ত চিত্রকল্প প্রোথিত নিজের দেশের অসাধারণ প্রকৃতির মাটিতে। তিনি দৈহিক প্রেমের সঙ্গে জুড়ে দেন পার্থিব ও প্রাকৃতিক শক্তি। তাই তাঁর প্রেমাষ্পদা হয়ে ওঠে পৃথিবীর শঙ্খ, যার মধ্যে গান গায় পৃথিবী নিজেই। ভোরের শুকতারা চুম্বন করে আমাদের চোখ। কখনও কখনও কবিতারা আবৃত হয় আবেগের ঘন কুয়াশায়। বিচ্ছেদ আর স্মৃতি সেখানে দুটি প্রধান চরিত্র হয়ে জীবনকে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যায় তার পূর্ণ প্রকাশের দিকে। তাঁর কবিতায় রয়েছে ইন্দ্রিয়জ ও প্রাকৃতিক সত্তা, বিষয়নিষ্ঠা ও চিরন্তনতা, সহজাত বোধের সঙ্গে বুদ্ধিগত বিচারের প্রবল বিরোধিতার আশ্চর্য ঐক্য। তিনি সাধারণ্যে মাহাত্ম্য খুঁজে পান এবং তাঁর অসাধারণ কাব্যশৈলী সেই তুচ্ছাতিতুচ্ছকে রাজাধীরাজে পরিণত করে অনায়াসে। এখানেই নেরুদা সমকালীন অন্যান্য কবিদের থেকে স্বতন্ত্র। এমনকি বিশ্বসাহিত্যেও তিনি আজও তুলনারহিত ও অনন্য।

‘কুড়িটি প্রেমের কবিতা...’ গ্রন্থের প্রথম কবিতাটি নেরুদা একটি পত্রিকায় ছাপতে দিয়েছিলেন। বিশ্বখ্যাত নেরুদা বিশেষজ্ঞ, চিলের নেরুদা ফাউন্ডেশন’-এর প্রাক্তন অধিকর্তা এরনান লোইয়োলা এই শতবর্ষ উপলক্ষে যে বই লিখছেন তার ভূমিকা থেকে জানতে পারা যায় যে সমালোচক এরনান দিয়াস আররিয়েতাকে লেখা একটি চিঠিতে নেরুদা বলছেন, ‘Zig-Zag’ পত্রিকার সম্পাদক কবিতাটি প্রকাশ করতে রাজি হননি, তাই তিনি যদি কবিতাটি ছাপার জন্য অনুরোধ করেন। কী রয়েছে কবিতাটিতে? এর প্রথম চার পঙক্তি এইরূপঃ

“রমণীর দেহ, শুভ্র শৈল, শুভ্র উরু,

সমর্পণের সময় তুমি হয়ে ওঠো ধরিত্রীসমান।

আমার বন্য কারিগরের দেহ তোমায় খুঁড়ে চলে

আর গহন মৃত্তিকা বিদীর্ণ করে উঠে আসে সন্তান।”

শরীরি প্রেমের অবারিত বাহুল্য এখানে সুস্পষ্ট আর এই কারণেই সমকালীন কিছু সমালোচক ও ন্যায়পরায়ণ তাত্ত্বিকরা আক্রমণ করেছিলেন গোটা কাব্যগ্রন্থটিকেই। কিন্তু তরুণ পাঠকরা স্বাগত জানালেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁরা তখন খুঁজছিলেন একান্ত ব্যক্তিগত, একেবারে অন্তরঙ্গ এক শিল্প যাতে তাঁদের আপন সত্তার সংগ্রাম, প্রেম ও ব্যর্থতার প্রতিলিপি পাওয়া যাবে। নেরুদার এই বইতে তাঁরা নিজেদের কবির কন্ঠ শুনতে পেলেন। আর সবচেয়ে বড় কথা এই কবিতার পরতে পরতে রয়েছে চিলের অনন্যসাধারণ প্রকৃতি ও সেই প্রকৃতিরই মেয়েরা। ইউরোপের দূরায়ত কোনও ভেনাস নয়, পাশের বাড়ির প্রতিদিনের চেনা মেয়েটির মধ্যেই নেরুদা আবিষ্কার করেছিলেন আশ্চর্য সৌন্দর্য ও প্রেম-মাধুর্য –

“মনে পড়ে কেমন ছিলে তুমি গত শরতে।

তুমি ছিলে ধূসর টুপি আর শান্ত হৃদয়।

তোমার চোখে লড়াই করত গোধূলির শিখারা।

আর পাতা খসে পড়ত তোমার অন্তরের হ্রদে।” (কবিতা – ৬)

এরনান দিয়াসকে লেখা অন্য একটি চিঠি থেকে আরও জানতে পারা যায় এই কাব্যগ্রন্থের প্রথম নাম দিয়েছিলেন ‘একটি মানব ও একটি মানবীর জন্য কবিতা’। তারপরে নিজের জন্মদিন (১২ জুলাই, ১৯০৪) উপলক্ষ্যে নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘বারোটি প্রেমের কবিতা ও একটি হতাশার গান’। তারও পরে আবার একবার পালটে রাখেন ‘কুড়িটি প্রেমের কবিতা ও একটি হতাশার গান’, নিজের কুড়ি বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার উদযাপনে। এও এক বিস্ময়। এই অসাধারণ কাব্যগ্রন্থের কবিতা যে কবি লিখছেন তাঁর তখনও কুড়ি বছর বয়স পূর্ণ হয়নি।

১৯২২-’২৪-এর মধ্যে এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি লিখেছিলেন তিনি প্রধাণত তিনটি নারীকে উদ্দেশ্য করে – আলবেরতিনা রোসা, মারিয়া পারোদি ও তেরেসা বাস্কেস। আলবেরতিনার সঙ্গে কবির পরিচয় হয় সান্তিয়াগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসী ভাষা পড়ার সময়। কখনও কখনও তাঁরা ফোরেস্তাল পার্কে হাতে হাত রেখে দীর্ঘক্ষণ হাঁটতেন, কেউ কোনও কথা বলতেন না। এই নৈঃশব্দকে কবি ধরে রেখেছেন তাঁর ১৫ নং কবিতায়ঃ

“তোমাকে ভালো লাগে যখন তুমি নিশ্চুপ থাকো, যেন মনে হয় তুমি নেই,

দূর থেকে শুনতে পাও আমার কথা, আর সে কথারা তোমায় স্পর্শ করে না।

মনে হয় যেন তোমার দু’চোখ কোথায় উড়ে চলে গেছে

আর মনে হয় যেন একটা চুম্বন বেঁধে দিল তোমার ওষ্ঠ।”

আরেক প্রেমিকা তেরেসার নাম দিয়েছিলেন ‘আন্দালুসা’, যাতে অন্য কেউ বুঝতে না পারে। আলবেরতিনার আগে তেরেসার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, কিন্তু তাঁদের প্রেম হয় পরে, যখন ছুটিতে কবি যেতেন পুয়ের্তো সাভেদ্রার অপরূপ প্রকৃতির আঙিনায়, তখন। তেরেসার পরিবারও গরমের ছুটি কাটাতে সেখানে ছিলেন এক বিরাট বড় বাগান-বাড়িতে। ফলে এই দুটি প্রেম-পাগল ছেলে-মেয়ে দেখা করতে লাগল অরণ্যের ছায়ায় কিংবা রোদ্দুরে ভাসা সমুদ্রোপকূলে। এই বন্য প্রেমই আলবেরতিনার সঙ্গে শহুরে প্রেমের বিপ্রতীপে তাঁর কবিতায় নিয়ে এল প্রকৃতির প্রেক্ষাপটে প্রেমের এক অন্য উদ্ভাস। এখানে উল্লেখ্য, এই পুয়ের্তো সাভেদ্রাই তাঁর কল্পনার জনপদ ‘কান্তালাও’, যেমন গার্সিয়া মার্কেসের ‘মাকোন্দো’। তেরেসাকে মনে করেই তিনি লিখেছিলেনঃ

“পুরনো পথের মতো তুমি জমিয়ে রেখেছ।

তোমার মধ্যে বাস করে প্রতিধ্বনি আর স্মৃতিবিধুর স্বর।

আমি জেগে উঠেছিলাম আর মাঝে মাঝে অন্য দেশে চলে যায় পাখির দল

যারা ঘুমিয়ে ছিল তোমার অন্তঃস্থলে।” (কবিতা – ১২)

১৯২২ সাল জুড়ে নেরুদার জীবন আবর্তীত হয় সান্তিয়াগো ইউনিভার্সিটিতে আলবের্তিনাকে ঘিরে আর গরমের ছুটিতে তেমুকো ও পুয়ের্তো সাভাদ্রায় তেরেসার প্রেমে। ডিসেম্বর মাসে ইউনিভার্সিটি শেষ করে আলবের্তিনা চলে যায় অনেক দূরে, লোতা আলতোয়। আর নেরুদা ফিরে আসেন তেমুকোয়, তাঁর বাবা-মায়ের ডাকে, যেখানে অপেক্ষা করে আছে তেরেসা।

মারিয়া পারোদির বয়স তখন মাত্র ষোল, যখন নেরুদার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। যদিও এই প্রেম খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, কিন্তু ১৯ নং কবিতায় কবি তাঁকে অমরত্ব দিয়ে গেছেনঃ

“নমনীয় ও কৃষ্ণকায় মেয়ে, যে সূর্য গড়ে তোলে ফল,

পরিপুষ্ট করে বীজ, সমুদ্র শৈবালকে করে কুঞ্চিত,

তোমার দেহ পূর্ণ করে আনন্দে, তোমার দুই উজ্জ্বল চোখ

আর অধরোষ্ঠ যার আছে জলের মতো হাসি।”

এই কাব্যগ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য – বিস্মরণ। ক্ষণস্থায়ী প্রেম আর অনন্ত বিস্মরণের মধ্যে কবি আস্বাদন করেছেন অমরত্ব। ২০নং কবিতায় লিখছেনঃ

“আজ রাতেই লিখতে পারি বিষন্নতার গাথা

আমি তাকে ভালোবেসেছিলান, আর মাঝে মাঝে সেও আমাকে।”

কবির তখন একমাত্র আশ্রয় একাকীত্বঃ

“সেখানে প্রজ্জ্বলিত শিখায় বিস্তৃত ও দগ্ধ আমার একাকীত্ব

যার হাত মুচড়ে ওঠে ডুবো জাহাজের নাবিকের মতো।” (কবিতা – ৭)

এই একাকীত্বের অবধারিত অনুষঙ্গ নিঃস্তব্ধতা, যা এই গ্রন্থের বেশ কিছু কবিতায় অসামান্য কাব্যময়তায় বিধৃত। ৮নং কবিতায় নৈঃশব্দ এসেছে প্রত্যক্ষভাবে। নেরুদা লিখছেনঃ

“আমিই সেই যে হতাশ, প্রতিধ্বনিহীন শব্দ,

সেই পুরুষ যে সব হারিয়েছে, সেই পুরুষ যার সব ছিল।

...

আঃ নিঃশব্দ তুমি!”

এই কবিতাটি শুরু হচ্ছে এইভাবে, “সাদা মৌমাছি তুমি মধুর নেশায় মাতাল হয়ে গুঞ্জন কর আমার অন্তরে।” মৌমাছির গুঞ্জনের এই রূপক বলে দেয় কবি স্মৃতির সরণী ধরে অক্লান্তভাবে সন্ধান করছেন সেই প্রেম, যাকে পরের স্তবকে দেখব যে কবি হারিয়ে ফেলেছেনঃ “সেই পুরুষ যে সব হারিয়েছে”।

চিলের যে প্রকৃতি নেরুদার কাব্যে লাতিন আমেরিকার আত্মানুসন্ধানের মাত্রায় উন্নীত তার শুরু প্রাথমিক কাব্যগ্রন্থগুলো থেকেই। ‘কুড়িটি প্রেমের কবিতা...’-য় এর উদাহরণ অপ্রতুল নয়। সেখানে প্রেম ও প্রকৃতি একে অন্যের প্রতি নিবেদিত। কী অসাধারণ শুরু ১৮নং কবিতাঃ

“এখানে তোমায় ভালোবাসি।

পাইনের অন্ধকারে বাতাস তার জট খুলে ফেলে।

ভবঘুরে জলের উপর ফসফরাসের মতো উজ্জ্বল চাঁদ।”

দুটি স্তবক পরে এই প্রকৃতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়ে যাচ্ছে কবির প্রেমাষ্পদঃ

“এখানে তোমায় ভালোবাসি আর দিগন্ত বৃথাই তোমাকে ঢেকে রাখছে।

চারপাশের শীতল সবকিছুর মধ্যে আমি তোমাকে ভালোবাসছি।”

তারপর সব শেষে কবি আবার সেই অনন্ত বিচ্ছেদের সুর শুনতে পাচ্ছেন আর তা পাচ্ছেন প্রকৃতিরই মধ্যে থেকেঃ

“...। তুমি কত দূরে।

মন্থর গোধূলির সঙ্গে লড়াই করছে আমার ক্লান্তি।

কিন্তু রাত আসবে ও আমাকে তার গান শোনাবে।”

        তারপরেই তো আসে হতাশা। নেরুদাও লিখলেন এই গ্রন্থের একুশতম কবিতা যার শিরোনাম ‘একটি হতাশার গান’। কবিতাটির শুরু গভীর স্মৃতিকাতরতায়ঃ

“যে নিশার অন্ধকারে আমার বাস সেই রাত্রি থেকে উত্থিত তোমার স্মৃতি।

নদী তার একগুঁয়ে বিলাপ নিয়ে মিশে যাচ্ছে সমুদ্রের সঙ্গে।

 

ভোরবেলার ঘাটের মতো পরিত্যক্ত আমি।

এখন সময় হল ছেড়ে যাওয়ার, ওঃ পরিত্যক্ত আমি!”

এক প্রেমিক পুরুষের চিরন্তন বিলাপের প্রতিচ্ছবি – অনৈচ্ছিক স্মৃতির উদ্ভাস। এই স্মৃতির উচ্চারণেও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে অনন্ত প্রকৃতির গভীরতা, বিশেষভাবে সমুদ্র। তবে কবিতার পুরো দেহ জুরে রয়েছে শুধুই বিচ্ছেদের বেদনাঃ

“সেখানে ছিল অন্ধকার, দ্বীপের একাকী অন্ধকার,

আর সেখানে, আমার ভালোবাসার নারী, আমাকে জড়িয়ে নিল বাহুবন্ধনে।

 

ছিল তৃষ্ণা আর ক্ষুদা, আর তুমি ছিলে সরস ফল।

ছিল বেদনা আর ধ্বংস, আর তুমি ছিলে শক্তি অলৌকিক।”

এই প্রেম যতই মধুর হোক তা ছিল ক্ষণস্থায়ী, তাই প্রতিটি ক্রিয়াপদ এখানে অতীত কালের। কবি নিশ্চিত ভাবে জানেনঃ

“ভোরবেলার ঘাটের মতো পরিত্যক্ত আমি।

শুধু কম্পিত ছায়া পাক খায় আমার হাতে।

 

ওঃ সবকিছুর থেকে দূরে। ওঃ সবকিছুর থেকে দূরে।

 

এখন সময় হল ছেড়ে যাওয়ার, ওঃ পরিত্যক্ত আমি!”

এখানে উল্লেখ্য, ‘একটি হতাশার গান’ শিরোনামে আছে ‘দোন কিহোতে’-র প্রভাব। এই উপন্যাসের প্রথম খন্ডের ১৩ ও ১৪ অধ্যায়ে তরুণ ছাত্র-প্যাস্টর গ্রিসোসতোমো প্রেমিকার উদ্দেশ্যে যে গান লিখেছেন তার নামও ‘একটি হতাশার গান’।

        ১৯২৪ সালে এই কবিতা পুস্তকের প্রকাশ হতেই অনেকে বুঝতে পেরেছিলেন এমন এক প্রতিভার জন্ম হয়েছে যে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নেতৃত্ব দেবে। মনে রাখতে হবে এই প্রকাশকাল কিন্তু বিশ্ব ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণ। সদ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। মানুষ এক ব্যপ্ত ধ্বংসের সামনে দাঁড়িয়ে দিশাহারা। সাহিত্যের সময় হিসাবেও এই কালখন্ড বিশেষ উল্লেখযোগ্য। দু’বছর আগে ১৯২২-এ প্রকাশিত হয়েছে জয়েসের ‘ইউলিসিস’, এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ আর সেসার বাইয়েহোর ‘ত্রিলসে’। আট বছর বাদে প্রকাশিত হবে লোরকার ভুবনবিজয়ী ‘রোমান্সেরো হিতানো’। এরই মাঝখানে নেরুদার কাব্যস্বর অতীত শাসকের মায়াজাল থেকে বেরিয়ে পঞ্চেন্দ্রিয়ের উপলব্ধিতে ও ব্যবহারে লিখছে লাতিন আমেরিকার নিজস্ব কবিতা। চিলের রাজনৈতিক পটভূমিও তখন পরিবর্তনের সন্ধানে উন্মুখ। বিশ্ব যুদ্ধোত্তর পর্বে চিলের শাসন ব্যবস্থা পার্লামেন্টারি রিপাবলিক (১৮৯১ - ১৯২৫) থেকে ধীরে ধীরে নতুন সংবিধান তৈরির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যা শুধু ক্যাথলিক চার্চের ক্ষমতা হ্রাস করবে তাই নয়, গুরুত্ব দেবে নাগরিক অধিকার ও সামাজিক বিচারকে সুরক্ষিত করে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তায়। চিলের মানুষের তখন একটাই দাবি – সামাজিক পরিবর্তন। এলিট ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনেকেই ঐতিহ্যগতভাবে এই সংস্কারের পথপ্রদর্শক হিসাবে ইউরোপ, বিশেষত ফ্রান্সের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কিন্তু নেরুদা তাঁদের বিপরীতে জাগিয়ে তুললেন জাতীয় গৌরবের আকাঙ্খা। তিনি বললেন চিলের পর্বতের কথা, নদীর সৌন্দর্য ও রাতের ফুলেদের সৌরভের কথা; তিনি যেন সমস্ত চিলেবাসীর সামনে একটা আয়না ধরলেন যার মধ্যে তাঁরা নিজস্ব স্বপ্নের প্রতিফলন দেখতে পেলেন ও তৃপ্ত হলেন। নেরুদার কবিতায় তাঁরা খুঁজে পেলেন বিচ্ছিন্নতার উর্দ্ধে এক যুথবদ্ধ জীবনের পরিচয়, বৈশিষ্ট্য ও গন্ধ যা একান্তই তাঁদের নিজস্ব। তাই ‘কুড়িটি প্রেমের কবিতা...’ প্রকাশের পর সান্তিয়াগোর বোহেমিয়ান বন্ধুদের বাইরেও তিনি বিখ্যাত হয়ে উঠলেন এবং চিলের সরকার তাঁকে তাঁর প্রথম কূটনৈতিক পদ দিয়ে পুরস্কৃত করলেন।

        সেই সময়ে চিলের সাহিত্যজগতে যে দুই প্রতিভা রাজত্ব করছেন তাঁরা হলেন গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল ও বিসেন্তে উইদোব্রো। নেরুদা যখন স্কুলের বাচ্চা তখন থেকেই মিস্ত্রাল তাঁকে চিনতেন। চিলের প্রথম নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত সাহিত্যিকও তিনি। তাঁর প্রথম প্রেমের কবিতার বই প্রকাশিত হয় ১৯১৪ সালে। তাঁর অন্য দুটি কাব্যগ্রন্থ ‘ক্ষয়’ (Desolación - ১৯২২) এবং ‘মমতা’ (Ternura - ১৯২৪) নেরুদার কবিতার চেয়েও অনেক বেশি অন্তরঙ্গ। অন্যদিকে উইদোব্রো ভ্যানগুয়ার্দিয়ার প্রভাবে ফরাসী আধুনিক কাব্যতত্ত্বের দিকে ঝুঁকেছিলেন। কবি হিসাবে বিশেষ পরিচিতি লাভ করলেও পাঠক নেরুদার কবিতায় নিজেকে যেভাবে খুঁজে পেলেন তা উইদোব্রোর কবিতায় পাননি। সেদিক থেকে নেরুদা অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন মেহিকোর কবি রামোন লোপেস বেলার্দে ও পেরুর কবি সেসার বাইয়েহোর, যাঁরা সাহিত্যের স্বাভাবিক উত্তরাধিকার ছেড়ে এমন একটি জগতে প্রবেশ করেছিলেন যা তখনও পর্যন্ত আবিষ্কারের জন্য উন্মুক্ত ও যা সম্পূর্ণভাবে দক্ষিণ আমেরিকায় জাত। বহু বছর বাদে নেরুদা লিখেছিলেন তিনি এমন একটি কবিতা সৃষ্টি করতে চান যা “অ্যাসিড দ্বারা জারিত, হাতের কঠিন পরিশ্রমে উদ্ভূত, ঘাম ও ধোঁয়ায় পূর্ণ আর প্রস্রাব ও লিলিফুলের গন্ধে আকীর্ণ।”

মেহিকোয় কর্মরত চিলের অধ্যাপক ও লেখক ফেলিপে রিয়োস বায়েসাকে প্রশ্ন করেছিলাম, নেরুদার এই দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের মধ্যে কি ভবিষ্যতের নোবেলজয়ীকে দেখতে পাওয়া যায়? উত্তরে তিনি বলেন, “এই কাব্যগ্রন্থে এমন এক কাব্যিক কন্ঠ, অলঙ্করণ ও চিত্রকল্পের গঠন আছে যা নিঃসন্দেহে কবির বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘পৃথিবীর বাসভূমি’ (Residencia en la tierra)-র ভিত্তিভূমি বলা যেতে পারে। যদিও এই কবিতা পুস্তক একান্ত ব্যক্তিগত প্রেম ও বিচ্ছেদের অনুভূতি নির্ভর, কিন্তু তার মধ্যেও এমন কিছু পঙক্তি আছে যা ভবিষ্যতের নোবেলজয়ীকে চিনিয়ে দেয়। যেমন প্রথম কবিতাতেই আছে স্পষ্ট ইঙ্গিতঃ ‘আমি যেন সুড়ঙ্গের মতো একা। আমার মধ্যে থেকে উড়ে যায় পাখি/আর আমার ভিতরে ঢুকে রাত্রি জারি করে তার প্রমত্ত অধিকার।’ অথবা ৯নং কবিতার এই স্তবকেঃ ‘আবেগে কঠিন আমি আমার একমাত্র ঢেউয়ে চেপে যাই/ চন্দ্রাকার, সূর্যজাত, উত্তপ্ত ও শীতল, বারংবার,’।” অধ্যাপক ফেলিপের কাছ থেকে আরও জানতে পারি চিলেতে নেরুদার এই কাব্যগ্রন্থ কতখানি জনপ্রিয়। নয়ের দশকে তিনি যখন সেকেন্ডারি স্কুলে পড়ছেন, তখন তাঁর কিছু বন্ধু যাঁরা সাহিত্য-সংস্কৃতির ধার-কাছ দিয়েও যেতেন না, তাঁরাও অবলীলায় মুখস্থ বলে যেতেন ১৫ বা ২০নং কবিতা।

একথা সবাই জানেন যে ‘পাবলো নেরুদা’ কবির ছদ্মনাম। তিনি ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন বাবার ভয়ে। ট্রেনচালক বাবা হোসে মোরালেস ছেলের সাহিত্যকর্মের ঘোরতর বিরোধী। তাই ছেলে রিকার্দো এলিয়েসের নেফতালি রেইয়েস বাসোয়ালতো হয়ে গেল পাবলো নেরুদা। এমন একটা নাম নিলেন যে একটা ঢিল ছুঁড়লে পাঁচটা পাবলোর গায়ে গিয়ে লাগবে। যাতে বাবা কোনোভাবেই বুঝতে না পারেন। কিন্তু এখন আর একে ছদ্মনাম বলা যাবে না। কারণ, এরনান লোইয়োলা জানাচ্ছেন যে ১৯৪৬ সালের পর থেকে শুধু বইতেই নয়, আইনানুগ ভাবে অন্য সমস্ত কাজেও ছদ্মনামকেই তাঁর মূল নাম হিসাবে ব্যবহার করতে শুরু করেন। এই ছদ্মনামের উৎস নিয়েও নেরুদা-গবেষক লোইয়োলা সাধারণ্যে প্রচলিত এক ভ্রান্তি দূর করেন। চেক লেখক ইয়াক নেরুদার নাম থেকে তিনি এই নাম গ্রহণ করেছিলেন বলে মনে করা হয়। কিন্তু তা নয়। সেই সময়ের একটি জার্মান বইয়ের মলাটে দেখা ‘পাবলো দে সারাসাতে’ ও ‘নরম্যান নেরুদা’ – এই দুটি নামের প্রথম ও শেষ শব্দ দিয়ে নিজের নাম নির্দিষ্ট করেন।

এবারে বলা যাক সেই বিখ্যাত ও বিতর্কিত কবিতাটির কথা – ২০ নং কবিতা – যার সূত্রে দুই দক্ষিণ এক অঙ্গনে মিলিত হয়। কোস্তা রিকার লেখক আলফোন্সো চাকোন ১৯৯৯ সালে লিখেছিলেন, ‘Who can tell, when throwing a stone into a pond, where do the ripples created go? When weeks ago, in the middle of an electronic discussion about the connections between Latin American and Indian literature, I ventured to mention Rabindranath Tagore’s high standing among current Latin American readers, many were surprised. And I have to confess that I myself was also surprised, because it never occurred to me Tagore’s presence in Latin America would sound odd to anybody, least of all to a Bengali’। এই বিস্ময় হয়তো আজও কিছুটা সত্যি। হুয়ান রামোন হিমেনেস ও সেনোবিয়া কাম্প্রুবি কৃত রবীন্দ্রকবিতার স্প্যানিশ ভাষান্তর প্রকাশকাল শুরু হয় ১৯১৩ থেকে। এই অনুবাদ লাতিন আমেরিকার কিছু দেশে নিশ্চয়ই জনপ্রিয় হয়েছিল, তাই তো ভিক্তোরিয়া ওকাম্পো লিখেছিলেন, ‘১৯১৪ সাল থেকেই আমার জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠা।’ এই জনপ্রিয়তার প্রমাণ, বিশেষ করে আর্হেন্তিনায়, লিপিবদ্ধ আছে ওকাম্পো ও এলমহার্স্টের লেখায়। চিলেতেও যে তিনি যথেষ্ঠ সমাদৃত ছিলেন তার প্রমাণ গাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের অনুবাদ। ইংরাজি থেকে বেশ কয়েকটি কবিতার অনুবাদ করেছিলেন ও একটি গ্রন্থ সংকলনে তা স্থান পায়। নেরুদার বয়স তখন বেশি নয়। তিনিও গভীরভাবে প্রভাবিত হলেন। ‘কুড়িটি প্রেমের কবিতা...’-র শিকড়ে অন্যতম একটি বীজ তাঁর পড়া রবীন্দ্রকবিতা। দেখা যাবে প্রেমিকা তেরেসাকে যে ডায়েরি উপহার দিয়েছিলেন তারই পাতায় লিখে রাখছেন স্প্যানিশ অনুবাদে ‘Fruit gathering’-এর ১ ও ৪ নং কবিতা। তবে রবীন্দ্রনাথের সরাসরি অনুসরণ রয়ে গিয়েছে ১৬নং কবিতায়। ‘মানসপ্রতিমা’ কবিতার অবয়বে গড়ে উঠছে এই কবিতার কাব্যসুষমা। নেরুদা শুরু করছেন এইভাবেঃ

“আমার গোধূলি-আকাশে তুমি যেন একটি মেঘ

আর তোমার রঙ ও অবয়ব ঠিক আমার মনের মতন।

তুমি আমারই, তুমি আমারই, মধুর অধরের মেয়ে

তোমার জীবনেই বেঁচে থাকে আমার অনন্ত স্বপ্নেরা।”

রবীন্দ্রকবিতার প্রথম স্তবকটি একবার পড়া যাকঃ

        “তুমি   সন্ধ্যার মেঘ শান্তসুদূর

                                আমার সাধের সাধনা

মম শূণ্য-গগন-বিহারী।

আমি            আপন মনের মাধুরী মিশায়ে

তোমারে করেছি রচনা –

তুমি আমারি যে তুমি আমারি,

মম অসীম-গগন-বিহারী।”

কবিতাটির শুরু থেকেই নেরুদার উপর রবীন্দ্র-প্রভাব স্পষ্ট লক্ষণীয়। পরবর্তী অংশেও পাশাপাশি রেখে পড়লে এরকম অনেক সাদৃশ্য চোখে পড়বে। প্রথম প্রকাশে নেরুদা কোনও ঋণ স্বীকার করেননি। কিন্তু বিতর্ক দেখা দিলে পরবর্তী সংস্করণ থেকে এই কবিতাকে রবীন্দ্রকবিতার ‘paraphrase’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তবে এই প্রভাব অন্য এক দিশার সন্ধান দেয়। যে কবিকে রবীন্দ্রনাথ এতখানি প্রভাবিত করতে পারেন, তিনি যে বাঙালিরও প্রাণের মানুষ হয়ে উঠবেন এটাই যেন অবধারিত। এখানে খেয়াল রাখতে হবে রবীন্দ্রকাব্য নেরুদা পড়েছিলেন স্প্যানিশ অনুবাদে আর বাঙালিও নেরুদা পড়েছেন বাংলা অথবা ইংরাজি অনুবাদে। অর্থাৎ অনুবাদের কী অসীম গুরুত্ব ও সম্ভাবনা! যাই হোক, এই দুই দক্ষিণ ভূখন্ড এভাবে কবিতায় মিলে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ নিঃসন্দেহে উভয়েরই ঔপনিবেশিক যন্ত্রণার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার সাযুজ্য এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইউরোপ থেকে বেরিয়ে আসার মরীয়া প্রচেষ্টার সম মানসিকতা। তাই তো ওকাম্পো একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, ‘Ambos somos huérfanos. Y Europa es la causa de ese sentimiento. Nos sentimos sus huérfanos.’ অর্থাৎ ‘আমরা দুজনেই অনাথ। ইউরোপ হল এই মানসিকতার কারণ। আমাদের দুজনকেই ইউরোপ অনাথ করেছে।’   

যাই হোক, এক সদ্য তরুণের লেখা কবিতাগুচ্ছ যখন একশো বছর পরেও আলোচনার অবকাশ রাখে তখন সহজেই বোঝা যায় সেই সব কবিতার অনন্যতা ও সর্বজনীনতা। এই কবিতাপুস্তকে যে প্রেমের উচ্চারণ তা বিচ্ছেদ-বেদনা ও স্মৃতিবিধুরতায় আশ্রয় নেয় এমন এক একাকীত্বে যা প্রতিটি প্রেম-বিদ্ধ মানুষেরই নিঃসঙ্গতাকে স্পর্শ করে ও কবিতাগুলিকে অমরত্বের আশীর্বাদে আরও একশো বছর বেঁচে থাকার আশ্বাস দেয়।