শতবর্ষে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : পিতৃপুরুষের একটি পাঠ

শতবর্ষে দাঁড়ানো নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বাংলা ভাষার একজন অগ্রগণ্য কবি ও সম্পাদক। তাঁর এই দুই পরিচয়ের আড়ালে খানিকটা ঢাকা পড়েছে তাঁর কথাকার পরিচয়টি। এই লেখাটিতে আমরা পাঠ করতে চাইলাম তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস - 'পিতৃপুরুষ'। 

“পিতৃপুরুষ” আত্মজৈবনিক উপন্যাস বা স্মৃতিচারণ নয়। বাংলা ১৩৭৯ সনে শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকায় উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ফেব্রুয়ারী, ১৯৭৩ এ। এর তিরিশ বছর পর ২০০২ সালের কলকাতা বইমেলার সময়ে আবার তা পুন:প্রকাশিত হয়। পাঠকের বারবার চাহিদার কারণ হয়তো গদ্য-উপন্যাসের সরল বিষয় নির্বাচন, স্বাভাবিক গতি এবং ফেলে আসা দেশ-ভিটের প্রতি টান। বাঙালি জীবনে দেশভাগ, পূর্ব-পশ্চিম দ্বন্দ্ব এক অনিবার্য,অবশ্যম্ভাবী অভিঘাত। আপাত পৃথক ভূ-খন্ডবাসী একই ভাষাভাষী মানুষের আড়িয়াল খাঁ-পদ্মা-গঙ্গা পেরিয়ে নিরন্তর যে যোগাযোগ তার কাহিনী বুনে চলে ‘পিতৃপিতামহের চরণে নিবেদিত’ উপন্যাস।

দুর্গাপুজোর আনুমানিক চার -পাঁচ মাস আগের কোন এক ঝড়ের দুপুরে কাহিনী আরম্ভ। পুববাংলার এক গ্রামে বসবাসকারী যৌথ পরিবারের ছোট্ট ছেলে অমুর বয়ানে কাহিনী আরম্ভ হয়। ছোট ছেলেটির নাম অমলেন্দু চট্টোপাধ্যায়। তার পিতামহ লোকেশ্বর অনেকটা গোষ্ঠীপতির মতো।বর্ধমান জেলার মানকর নিবাসী  অনাথ বালক লোকেশ্বর ভাগ্যান্বেষনে কলকাতায় গিয়ে সচ্ছল হয়েছিলেন। পুববাংলার সম্পন্ন গৃ্‌হস্থ রামজয় গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে চিত্তসুন্দরীকে বিয়ের সূত্রেই তার পুববাংলায় আসা। উদ্যমী লোকেশ্বর ঘরজামাই হতে চাননি, তার নিজের উপার্জনের টাকায় শ্বশুরবাড়ি খাবাসপুর থেকে দূরে মন্দারগ্রামে জমি কিনে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে কলকাতার সংসার ছেলে ইন্দ্রজিতের দায়িত্বে রেখে গ্রামে ফিরে চাষবাস শুরু করেন।অমলেন্দু ইন্দ্রজিতের একমাত্র পুত্রসন্তান। কলকাতায় ম্যালেরিয়ায় ভুগে পুকুর-কলাঝোপ-খাল-বিলের গ্রামে তার বেড়ে ওঠা। মেঘু-নেউল-বনোদিদির সখ্যে, আইনদ্দি কাকা-জাগিরদারের সাহচর্যে, বড় কাকিমা-ঠাকুমার স্নেহে তার বেড়ে ওঠা আর গল্প বলা ঘিরে আবর্তিত হয়েছে উপন্যাসের কাহিনী।

জার্মান ভাষায় যাকে বলা হয় Buildnsroman সেই ধারার সার্থক রূপায়ণ এই উপন্যাস আক্ষরিক অর্থেই অমলেন্দুর ‘innocence’ থেকে  ‘experience’’ এর যাত্রাপথ যার অভিমুখ লোকেশ্বর শুরু করেছিলেন বেলেঘাটার খাল বেয়ে আর পুত্র ইন্দ্রজিতের হাত ধরে তা পুরীর সমুদ্রতটের বঙ্গোপসাগর ছুঁয়ে আবার রসুলপুরের ঘাট ছেড়ে কলকাতায় বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসা বালক অমলেন্দুর জীবন অভিজ্ঞতার এক বৃত্ত সম্পূর্ণ করে। ঝড়ের পরে গ্রামের মাঝ বয়সী আর বালকদের বিপুর উৎসাহে সজারু ধরতে যাওয়ার উত্তেজনা বালক অমলেন্দুকে রোমাঞ্চিত করেছিল। দাদু বলেছিলেন বাবা বাড়ি ফিরলে জিজ্ঞাসা করতে শল্লকী শব্দের  অর্থ সে জানে কিনা। উপন্যাসের শেষে দাদু লোকেশ্বরের শ্রাদ্ধ শান্তির পর বাবার হাত ধরে কলকাতা যাওয়ার পথে সেই প্রশ্ন জিজ্ঞাসার অবসর অবশেষে মেলে।

উপন্যাস জুড়ে সে যুগে নারীর সামাজিক অবস্থানের এক অনুপুঙ্খ ছবি পাওয়া যায়। অসামান্য নৈর্ব্যক্তিকতায় নারীজীবনের যে ছবি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে ছুঁয়ে গেছে তা এই সমাজ-ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ পাঠ। সাত বছর বয়সে বিয়ে হয়ে তেরো বছরে কলকাতায় স্বামীর ঘর করতে আসা চিত্তসুন্দরীর মায়ের সাথে আর দেখা হয় নি। স্বামীর চাকরি থেকে অবসরের পর মন্দারগ্রামে যাওয়ার পথে খাবাসপুরে পিত্রালয়ে কিছুদিন কাটিয়ে যান। কলকাতার সংসারে ষোল বছরের পুত্রবধূর হাতে সঁপে দিয়ে তিনি গ্রামে ফেরেন। সুহাসিনী নাম্নী সেই মেয়েটি মাতৃহীনা তাই তেরো বছর বয়সেই হাত পা না পুড়িয়ে ভাতের হাঁড়ির মাড় গালতে পারেন। বিবাহযোগ্যতা বলতে এইটুকুই সম্বল। তার বিয়ের যৌতুকের গয়নায় তার ননদের বিয়ে হয়। মন্দারপুরের মেয়ে যমুনার স্বামী মহাদেব পুলিশের চাকরি খুইয়ে যাত্রাদলে কর্ণেট বাজিয়ে উপার্জন করে। যক্ষ্ণারোগগ্রস্ত স্বামীর যথাসাধ্য সেবা করা সত্ত্বেও তার সন্তানহীনতার দোহাই দিয়ে তার স্বামী মাঝরাতে আরেকটি বিয়ে করে  ঘরে ফেরে।চরম দুর্দিনে ছাড়াও সে ঘোমটা ছাড়া ঘুরে বেড়াতে পারে কারণ সে গ্রামের মেয়ে আর অমুর কাকীমা সবসময়ই এক গলা ঘোমটা টেনে থাকেন। স্বামীর কলকাতায় থাকা নিয়ে তার কোন অভিযোগ নেই। ভাসুরের ছেলেকে সন্তান স্নেহে তিনি পালন করেন।

 উপন্যাসের গৌণ চরিত্র হলেও জাগীরদারের জীবন কাহিনীতে আশ্চর্য এক সামাজিক ইতিহাস সম্পৃক্ত। বিহারের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কাজের আশায় মা,বাবা,ভাই বোনের সাথে ট্রেনে উঠে কলকাতা যাবার পথে কলকাতা ভেবে ভুল করে তারা বর্ধমানে নেমে পড়ে। তারপর মানকরের চাটুজ্জেদের আশ্রয়ে থেকে তাদের সাথেই যশোরে এসে রোগে ভুগে পরিবারের বাকি সবার মৃত্যুর পর জাগিরদার লোকেশ্বরের সাথেই থেকে যায় আজীবন। মনিবপুত্র এবং সে দুজনেই অনাথ। বিপুল এই পৃথিবীতে তারা প্রভু-ভৃত্যের বাইরে অন্য কোনো নাম-না-জানা সম্পর্কের টানে বেঁধে বেঁধে থেকেছে সারাজীবন। জ্ঞান হওয়া ইস্তক মাছ বাংলার ভাত-মাছ খাওয়া জাগির ছাড়তে পারেন নি জলন্ধর মুলুকের বোলচালের গল্প, লোকেশ্বরও ছাড়তে পারেন নি কলকাত্তাইয়া বাংলা ভাষা।দুজনের কারোরই পিতৃভূমে ফিরে যাওয়া হয় নি।

সমগ্র উপন্যাস জুড়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র কলকাতা শহর ও তার মানুষজন যারা সরাসরি কাহিনীর সাথে যুক্ত নন। লোকেশ্বর কলকাতায় এসে প্রকাশনা ব্যবসায় কাজ করে নিজের ভাগ্য সুনিশ্চিত করেন। তার সহপাঠী ঈশান ঘোষের হস্তক্ষেপে তার ছেলে ইন্দ্রজিতের জীবনের এক জটিল সমস্যার সমাধান হয়। বাঙাল বউ চিত্তেশ্বরীকে লুচি বেলতে,বড়ি দিতে শিখিয়েছিলেন নরেন্দ্রনাথ দত্তের মা ভুবনেশ্বরী দেবী। শিশু অমু কলকাতায় গেলে বাবা তাকে কিনে দেন পার্সিয়ুসের গল্প বই,ট্রাই সাইকেল। দেশজুড়ে লবণ সত্যগ্রহ শুরুর পর অমুর কাকা রণো গান্ধীজীর আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে কলেজের বি এ ক্লাসের পড়াশোনা ছেড়ে গ্রামে ফিরে চাষবাসের কাজ করতে আগ্রহী হয়।আন্দোলনে জেল খাটা ছাত্রদের সমর্থনে তাদের কলেজে ফিরিয়ে আনার পক্ষে জোর সওয়াল করেন অধ্যপক ইন্দ্রজিৎ। একদিন তিনি মুটের মাথায়  চারটে চরকা আর তুলোর পাঁজা নিয়ে বাড়ি ফেরেন। কলকাতায় অসহযোগ আন্দোলন, সুতো কাটা, চরকা বোনা নিয়ে যে বিপুল গনজাগরণের সূচনা হয় তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে ইন্দ্রজিৎ চরকায় বোনা একটি চাদর ছেলের হাত দিয়ে বাবার জন্য পাঠিয়ে দেন। 

উপন্যাসের শুরুতে লেখক জানাচ্ছেন লোকেশ্বর স্বামী বিবেকানন্দ বা নরেন্দ্রনাথ দত্তের সমসাময়িক। সেই হিসাব ধরলে তার জন্মসাল ১৮৬০-৬৫র কাছাকাছি, তার নাতি অমলেন্দুর জন্ম ১৯০৫ সালে। কিন্তু লবণ সত্যাগ্রহ ঘটে ১৯৩০ সালে যখন অমলেন্দুর বয়স হিসাব অনুযায়ী ২৫। কিন্তু কাহিনীতে তা ঘটে না। ঐতিহাসিক চরিত্র বা ঘটনাকে ছুঁয়ে গেলেও সালতামামির অনুপুঙ্খ অনুসরণ এই ধারার উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য নয়। পুকুরের জলে খুব বড় ঢিল পড়লেও তার আন্দোলন মিলিয়ে যেতে যেমন একটু বেশি সময় লাগে তেমনি এই উপন্যাসের কাহিনী মন্দারপুর গ্রামের ঘাটলার পাশে বসে বন্ধুদের নিয়ে মাছ ধরা বালক অমলেন্দু,বন্ধুদের পাশ করানোর জন্য হেডমাস্টারকে পুকুরের জলে ফেলে দেয়া মেধাবী, আবেগপ্রবণ কিশোর ইন্দ্রজিৎ আর নিজের উদ্যোগে আত্মপরিচয় নির্মাতা অনাথ কিশোর লোকেশ্বরের জীবন ঘিরে আবর্তিত।সময়ের ভূমিকা এখানে শুধু সরলরৈখিক নয় তা জীবনবৃত্তীয় ও সর্পিল।