
বঙ্কিমের বিষবৃক্ষ : তুলনামূলক পাঠ
- 07 October, 2024
- লেখক: সৌভিক ঘোষাল
‘বিষবৃক্ষ’, ‘মাদাম বোভারি’, ‘আনা কারেনিনা’ : তুলনামূলক পাঠ
১
বিষবৃক্ষ
বঙ্কিম তাঁর প্রথম সামাজিক উপন্যাস ‘‘বিষবৃক্ষ’’ লেখেন ১৮৭২ – ৭৩ সালে। লেখার পরেই এটি ঝড় তোলে এর ত্রিকোণ প্রেমের সম্পর্ক ও বিধবার পরপুরুষাসক্তির মতো নৈতিকতার প্রশ্নকে ঘিরে। যে উপন্যাস দিয়ে বাংলা আখ্যানে বঙ্কিমের পদচারণা শুরু, সাত আট বছর আগে লেখা সেই ‘দুর্গেশনন্দিনী’তেও ত্রিকোণ প্রেমের সম্পর্কর কথা এনেছিলেন বঙ্কিম। আয়েষা, জগৎসিংহ, তিলোত্তমা, এবং ওসমান, আয়েষা, জগৎসিংহের দুটি ত্রিকোণ সেখানে ছিল। মোগল পাঠান দ্বন্দ্বের ইতিহাস, যুদ্ধবিগ্রহর চেয়ে সম্পর্কের টানাপোড়েন দুর্গেশনন্দিনীর ঐতিহাসিক রোমান্সে বড় হয়ে উঠেছিল। হিন্দু রাজপুত্রের প্রতি মুসলিম রাজকন্যার প্রেম, বিশেষ করে যখন তারা পরস্পর শত্রুশিবিরে এবং যুযুধান গোষ্ঠী - অবশ্যই এক আলোড়নতোলা ব্যাপার ছিল। কিন্তু দুর্গেশনন্দিনীর সম্পর্ক আবেশগুলি সবই প্রাক বিবাহ পর্বের ব্যাপার। বিবাহ উত্তর নৈতিকতা বা পরিবার ভাঙনের প্রশ্ন ‘দুর্গেশনন্দিনী’তে আসে নি। অন্যদিকে ‘‘বিষবৃক্ষ’’তে ত্রিকোণ প্রেম এল পরিবার ও দাম্পত্যে তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশের প্রশ্নটিকে ঘিরে, সমকালে তীব্র বিতর্কিত হয়ে ওঠা বিধবা বিবাহের বিষয়টি তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে উপন্যাসটি বঙ্গসমাজে প্রবল আলোড়ন তুলল।
‘‘বিষবৃক্ষ’’ উপন্যাসের শুরুতে অরক্ষিত বালিকা কুন্দনন্দিনীর প্রতি স্নেহ মায়া মমতার টানই ছিল নগেন্দ্রর। তিনি কুন্দনন্দিনীকে তার বোন কমলমণির কাছে নিয়ে আসেন। পরে নগেন্দ্রর স্ত্রী সূর্যমুখী তার দূর সম্পর্কের ভাই তারাচরণের সঙ্গে কুন্দর বিয়ে দেন। তারাচরণ মারা গেলে বিধবা কুন্দ এসে পড়ে নগেন্দ্র সূর্যমুখীর আশ্রয়ে। এর পরেই বিধবা কুন্দর প্রতি নগেন্দ্রর টানের শুরু। শুধু যে নগেন্দ্রই আকৃষ্ট হয়েছিলেন তা নয়, কুন্দও মদনজালে বশীভূত হয়। উপন্যাসের এই ঘটনাবলীর সমকালে শুরু হয়ে গেছে বিধবা বিবাহ। এর পক্ষে বিদ্যাসাগর প্রমুখের যুক্তি প্রমাণ করেছে এটি অশাস্ত্রীয় নয়, বিধবা বিবাহ হিন্দু স্মৃতি শাস্ত্র সম্মতই এক ব্যাপার। বিদ্যাসাগরের এই সমস্ত যুক্তিকে নগেন্দ্র ঢাল করেন। অন্যদিকে বিদ্যাসাগর যে বহুবিবাহ রদ বিষয়ে প্রচার চালাচ্ছেন সে বিষয়ে নগেন্দ্র নীরব। বরং নিজের সামন্তসত্তার গর্বে জাঁক করে বলেন, তিনি জমিদার, তার কাজে বাধা দেবার ক্ষমতা কার আছে।
নগেন্দ্র প্রথমদিকে অবশ্য এই ঔদ্ধত্যকে আড়াল করে রেখে নিজের চিত্তচাঞ্চল্যকে দমন করতেই চেয়েছিল। কুন্দও চায় নি সূর্যমুখীর ঘর ভাঙতে। কিন্তু সূর্যমুখীই স্বামীর চিত্তচাঞ্চল্য ও অস্থিরতা বুঝে কুন্দের সঙ্গে নগেন্দ্রর বিধবা বিবাহ দেন। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের বাইরে থেকে নগেন্দ্র সূর্যমুখী কুন্দনন্দিনীর ত্রিকোণটি এসে পড়ে পরিবারের মধ্যে। বঙ্কিমের কাছে সুযোগ ছিল এই তিনজনের সম্পর্কের চিত্তবৃত্তি ও অবস্থান পালাবদলগুলি ধীরে ধীরে উন্মোচন করে দেখানোর। কিন্তু বঙ্কিম অন্য পথে এগোলেন। একই পরিবারে দুই স্ত্রীকে তিনি রাখতে প্রস্তুত হলেন না। বিয়ের পরদিনই সূর্যমুখী গৃহত্যাগ করল। অনেক নাটকীয় ঘটনাধারা ও নানা দেশ পেরিয়ে আবার সূর্যমুখী যখন ঘরে ফিরল তার পরেই এল কুন্দনন্দিনীর বিষপান ও মৃত্যুর চরম নাটকীয় ঘটনাটি।
উপন্যাসের নামকরণ থেকে কাহিনীবিন্যাস, মূল কাহিনীর পাশে দেবেন্দ্র হীরা উপকাহিনীর আয়োজন – সবের মধ্যে দিয়েই বঙ্কিম তাঁর নীতিবাদি অবস্থানটি প্রকাশ করেন। বঙ্কিম ত্রিকোণ সম্পর্ককে বাস্তব বলে স্বীকৃতি দিচ্ছেন কিন্তু তাকে ‘বিষবৃক্ষ’ বলে আখ্যায়িত করতেও ভুলছেন না। বঙ্কিমের আপত্তিটি ঠিক কোথায় – বিধবা বিবাহে না বহুবিবাহে তা স্পষ্ট নয়। এখানে বিধবা বিবাহ নিয়ে অনেক তির্যক কথাবার্তা আছে। আবার হীরা, দেবেন্দ্রর যে উপকাহিনী – যাকে বঙ্কিম রীতিমতো পাপ বলে মনে করেন ও পাপাত্মা দুজনের একজনকে উন্মাদ ও অন্যজনকে দীর্ঘকালীন ব্যধিযন্ত্রণায় ভুগে মৃত্যুর নিদান দেন – সেখানে বিধবা বিবাহের কোনও ব্যাপার ছিল না। অসংযত চিত্তবৃত্তি এবং প্রেমের জন্য অনৈতিক পথ গ্রহণকে বঙ্কিম মেনে নিতে প্রস্তুত নন। দেবেন্দ্র এবং হীরার শঠতাকে না হয় আমরা অনৈতিক বলে মেনে নিতে পারি। নগেন্দ্রর সূর্যমুখী থাকতেও কেন কুন্দর প্রতি চিত্তচাঞ্চল্য থাকবে, এ প্রশ্নকেও না হয় সমাজ ও পরিবারধর্মের নিরিখে মাথায় রাখা গেল। কিন্তু কুন্দনন্দিনীর জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং সংসার ও শরীরী যৌবনের স্বাদ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ‘‘বিষবৃক্ষ’’ রোপণ বলে ভাবা দূরে থাকুক, অনৈতিক বলেই বা আমরা ভাবতে যাব কেন ? কুন্দনন্দিনীর সঙ্গে নগেন্দ্রর বিবাহ তো বিধবা বিবাহ প্রচলনের নিরিখ ও বহুবিবাহের প্রচলিত নিয়মের সূত্র – উভয়দিক থেকেই একটি বাস্তব বিষয়।
সূর্যমুখীই এই উপন্যাসের নায়িকা। সে সংসারের কর্ত্রী। স্বামীকে ভালোবাসা ও যত্নে ভরিয়ে রাখা, সংসার সামলানো তো বটেই, জমিদারী সামলানো ও প্রজাশাসনের নানা ভালোমন্দ নিয়েও তার সক্রিয়তার প্রমাণ আছে। স্বামীর চিত্তচাঞ্চল্য ও মনোঃকষ্ট দেখে সে কুন্দের সঙ্গে স্বামী নগেন্দ্রর বিধবা বিবাহ দেয়। কিন্তু এর অনতি পরেই গৃহত্যাগ করে বুঝিয়ে দেয় এই বিবাহ সংগঠনে তার মর্মপীড়ার গভীর অনুভবটি। নিজের জীবনকে সে বিসর্জন দেবার পথেই চলে গিয়েছিল। প্রাণঘাতী অসুখ থেকে সুস্থ হয়ে নানা ঘটনার ঘনঘটা পেরিয়ে সে আবার যখন ঘরে ফিরল, তখনো স্বামীর প্রতি তার ভালোবাসা প্রবল। স্বামী তার বিরহে ঘর সংসার সম্পত্তি ছেড়েছে, তার জন্য ঘুমে জাগরণে, চেতনায় আধা চেতনে বিলাপ করছে – এই ছবি দেখে সে মনে মনে তৃপ্তিই পেয়েছে। স্বামী নগেন্দ্র কুন্দকে বিয়ে করলেও সংসারে তার আসনটি অটুট – এই অনুভব থেকেই জীবনের দ্বিতীয় পর্বটি সূর্যমুখী শুরু করতে চেয়েছিল। কুন্দকেও এবার সে শুধু স্বামীর ছোটবউ হিসেবে নয়, নিজের বোন হিসেবেই আগের মতো গ্রহণ করতে প্রস্তুত হচ্ছিল বলে মনে হয়। কমলকে নিয়ে কুন্দের সমীপে যাবার মধ্যে তার প্রমাণ রয়েছে।
অন্যদিকে কুন্দ প্রথমাবধিই জানতো সে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে স্বামী নগেন্দ্রর সংসারে প্রবেশ করছে। সেই সংসারে সূর্যমুখীর কর্ত্রীর আসনটি যে প্রতিষ্ঠিত তা সে জানত। সে আসন থেকে সূর্যমুখীকে সরিয়ে নিজে অধিষ্ঠিত হবার কোনও বাসনা তার ছিল, এমন কোনও আভাস কোথাও নেই। সে চেয়েছিল সংসারে আশ্রয় এবং অবশ্যই পুরুষের ভালোবাসা। অতৃপ্ত যৌবনের দেহবাসনা পূরণের কথা বঙ্কিম লেখেন নি, কিন্তু কুন্দনন্দিনীর আকুতি থেকে তা বুঝে নিতে আমাদের অসুবিধে হয় না। কুন্দের এই আকাঙ্ক্ষার পূরণ হল না। তার প্রথম বিবাহের সুখ স্বামীর মৃত্যুতে দ্রুতই থেমে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিবাহের পরদিনই সূর্যমুখীর গৃহত্যাগ এবং স্বামী নগেন্দ্রর সূর্যমুখী বিহনে অস্থিরতা ও অনুসন্ধান কার্যে দেশত্যাগ তাকে আবারো একাকী করে দিল। সে না পেল স্বামীর সঙ্গসুখ, না সংসারের নিয়ন্ত্রণ। দ্বিতীয়টি তার আকাঙ্ক্ষার বস্তু ছিলও না, সেজন্য তার দুঃখ নেই। কিন্তু এই প্রশ্ন কুন্দর মনে ওঠা অস্বাভাবিক নয় যে কোন দোষে বিবাহের পরেই স্বামী তাকে পরিত্যাগ করলেন। শুধু তাই নয় সূর্যমুখীর গৃহত্যাগ ও পারিবারিক অস্থিরতার যাবতীয় দায়ভার তার ওপরেই চাপিয়ে দিলেন। কুন্দনন্দিনী গোটা উপন্যাসে অন্তরালে ছায়ার মতো থেকেছে, তার বাকস্ফূর্তি আমরা সেভাবে দেখি না। কিন্তু তার মনের মধ্যে যে কথা ও ক্ষোভ জমে ছিল, জীবন ও জগৎ ত্যাগের মুহূর্তে সে তা উন্মোচন করে দিয়েছে।
নগেন্দ্র এই উপন্যাসের নায়ক। তিনি বিবাহ করতে পারেন যাকে খুশি, কেউ কিছু তাকে বলতে পারবে না, কারণ তিনি জমিদার – এই সামন্তী ঔদ্ধত্য তার আছে। এর পাশাপাশিই আছে সূর্যমুখী ঘর ছাড়ার পর যে চিত্তচাঞ্চল্যের পরিণতিতে এই বিপর্যয়, তার জন্য আন্তরিক অনুতাপ ও কৃচ্ছসাধনের বাস্তব দৃষ্টান্ত। কিন্তু এই অনুতাপপর্বে সদ্য যাকে তিনি বিবাহ করলেন ভালোবেসে, সেই কুন্দনন্দিনীর কথা ভুলে গেলেন। শুধু তাই নয় তাকে মানসিকভাবে কঠোর আঘাত করলেন। নগেন্দ্র একবার কুন্দনন্দিনীর প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে সূর্যমুখীর যন্ত্রণাকে বুঝতে অপরাগ হন, আবার সূর্যমুখীর বিরহে অধীর হয়ে কুন্দের জীবনতৃষ্ণাকে পদদলিত করেন। সূর্যমুখীর বেদনা ও মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাবার ঘটনাটির পেছনে নগেন্দ্রর দায় ও সূর্যমুখীর অভিমান দুই-ই ভূমিকা নিয়েছিল। কুন্দনন্দিনীকে কিন্তু মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলেন মূলত নগেন্দ্রই। তার কৃচ্ছসাধনে আত্মধিক্কার যতই থাকুক, আবারো এক দায়দায়িত্বহীনতা থেকে গেছে। সংসারে পুরুষের স্বাধিকারপ্রমত্ত এই অবস্থানটিকে বঙ্কিম যথেষ্ট ভালোভাবেই উন্মোচন করতে পারেন। নৈতিক বঙ্কিম যতই ‘বিষবৃক্ষ’ স্থাপণ বিষয়ে পাঠককে সতর্ক করুন, কুন্দর মৃত্যুদৃশ্যে তার ভাগ্যবিড়ম্বনার জন্য পাঠকের মনে যে বেদনা ও যন্ত্রণার বোধ সঞ্চারিত হয়, তা নৈতিক বঙ্কিমের আড়াল ভেঙে শিল্পী বঙ্কিমকে আমাদের সামনে হাজির করে। কুন্দর আকাঙ্ক্ষা ও জীবনতৃষ্ণা যে বাস্তব ও তার ফলে সংগঠিত সমস্যাপটটি যে শুধু নৈতিকতার নীতিবাক্য দিয়ে মোকাবিলা করা যাবে না, তা কথক বঙ্কিমের সতর্কবাক্য পেরিয়েই পাঠক উপলব্ধি করে নেন।
‘বিষবৃক্ষ’ ছাড়াও ত্রিকোণ প্রেম নিয়ে লেখা বঙ্কিমের অন্যান্য সামাজিক উপন্যাসও প্রবল আলোড়ন তুলেছিল, বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। একদিকে উঠেছিল সমাজ সংসার নীতি রক্ষার প্রশ্ন, অন্যদিকে ছিল নারীর জীবনতৃষ্ণার প্রশ্ন। বিধবা নারীর সমাজে, জীবনে ও যৌনতায় অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটি সমাজ ও আইনের জগৎ পেরিয়ে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে ধরা দিল পেশায় বিচারক নেশায় লেখক বঙ্কিমের হাত ধরেই। বিষবৃক্ষের পরে লেখা ‘চন্দ্রশেখর’ ও ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’এর মতো উপন্যাসগুলিতেও বঙ্কিম নারীর জীবনতৃষ্ণাকে অনেকদূর অবধি মর্যাদা দিয়েছেন। তবে বিষবৃক্ষের পরিণতির মতো এগুলিতেও শেষমেষ বঙ্কিম পিছুটান দিয়েছেন বলে তাঁর সমালোচনা হয়েছে। বলা হয়েছে শিল্পী বঙ্কিমকে আড়ালে পাঠিয়ে জাজ্বল্যমান হয়ে উঠলেন নীতিবাদী বঙ্কিম। গোবিন্দলাল নন, বঙ্কিমের নীতিবাদী গুলিই রোহিণীকে হত্যা করেছিল, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ প্রসঙ্গে এমন কথা অনেক সমালোচকই নাটকীয় ভঙ্গীতে বলেছেন।
২
তুলনামূলক পাঠ
বঙ্কিমের সমকালে লেখা বিশ্বসাহিত্যের যে সব উপন্যাস নারীর জীবনতৃষ্ণা ও ত্রিকোণ প্রেমকে ধরতে চেয়েছে এবং ক্লাসিক সাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে ‘‘বিষবৃক্ষ’’র দেড়দশক আগে লেখা ফরাসী ঔপন্যাসিক গুস্তাভ ফ্লবেয়রের ‘মাদাম বোভারি’ (১৮৫৭)। উপন্যাসটি তার নায়িকা এমার জীবনতৃষ্ণার গল্প। উপন্যাসের নায়ক চার্লস বোভারি তার মায়ের ইচ্ছেয় এক বিধবা ধনবতী মহিলার সঙ্গে প্রথমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। খেয়াল করা দরকার বাংলার সমাজে যেখানে আইনত চালু হলেও বিধবা বিবাহ উনিশ শতকের মধ্যভাগে এর বিরাট ট্যাবু, সেখানে সমকালীন এক ফরাসী উপন্যাসে এক অবিবাহিত চিকিৎসক প্রথম বিবাহ করছেন এক বিধবা মহিলাকে কারণ তিনি ধনবতী। ইউরোপে মেয়েদের নিজস্ব ধনসম্পত্তি থাকার বিপরীতে বাংলার মেয়েদের অরক্ষণীয়া চেহারাটি আমরা সমাজ সাহিত্যে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে দেখেছি। বঙ্কিমের রাধারানী উপন্যাসের নায়িকা অবশ্য প্রথম জীবনের ভাগ্যবিড়ম্বনার পর্ব পেরিয়ে মামলা মোকদ্দমা জিতে পরবর্তীকালে বিপুল সম্পত্তির অধিকারিণী হয়েছিলেন, তবে সে সব ছিল বিরল ব্যতিক্রমী ব্যাপার। ফেরৎ আসা যাক ফ্লবেয়রের আখ্যানে।
ডাক্তার চার্লস বোভারি একবার একজনের ভাঙা পায়ের চিকিৎসা করতে গিয়ে পরিচিত হন রোগীর কন্যা এমার সঙ্গে। দুজনের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রথম স্ত্রী হেলোইক ডুবুস মারা গেলে চার্লস বিয়ে করেন এমাকে। বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই এমার মনে হতে থাকে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে তার বিবাহিত জীবনটি নেহাৎ পানসে। ডাক্তারবাবুর মনে হয় একটু শহরের দিকে চলে এলে তার স্ত্রীর ভালো লাগবে। সেই ভাবনা থেকে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে চলে আসেন জমজমাট বাণিজ্যিক শহর ইয়নভিলে। এখানে এমার এক কন্যা সন্তান জন্মায়। কিন্তু এমা তার মাতৃত্বকে উপভোগ করেন নি। ইয়নভিলে থাকার সময় এমা ভালোবেসে ফেলেন আইন নিয়ে পড়াশুনো করা এক তরুণ ছাত্র লিওকে। সাহিত্য ও সঙ্গীত নিয়ে লিওর সঙ্গে আলাপচারিতা এমার জীবনকে উপভোগ্য করে তোলে। আমরা বুঝতে পারি এমার একজন বন্ধুর অভার ছিল। স্বামী চার্লস বোভারির মধ্যে তিনি সেই বন্ধুকে খুঁজে পানি নি,যা পেলেন লিওর মধ্যে। এরপর লিও উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যান প্যারিসে। লিওর বিদায়ের পর এমার জীবনে আবার এলো শূন্যতা। সেই শূন্যতা পূরণের খোঁজ চলতে লাগলো এমার। এবার তাঁর জীবনে এলেন আর এক পুরুষ। তার নাম ছিল রোদোলফে। এই রোদেলফে ছিলেন যথেষ্ট বিত্তশালী। প্রায় বছর চারেক চলে তাদের প্রণয় সম্পর্ক। এমা রোদলফকে জানান তিনি পরিবার ছেড়ে তার সঙ্গে পালিয়ে যেতে চান। পলায়ন পরিকল্পনা যখন ঠিকঠাক তখন হঠাৎই এক চিঠি লিখে এই পরিকল্পনা ও এমার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে দেন রোদোলফে। এমা শোকে দুঃখে প্রবল অসুস্থ হয়ে পড়েন।
স্ত্রী এমা খানিকটা সুস্থ হবার পর তার চিকিৎসক স্বামী চার্লস বোভারি তাকে নিয়ে রাওয়েনে যেতে থাকেন থিয়েটার দেখতে। উদ্দেশ্য ছিল স্ত্রীকে ক্রমশ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা। বঙ্কিমের ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে আমরা নগেন্দ্রকে দেখেছিলাম তিনি সূর্যমুখীর মনোজগৎ বিষয়ে উদাসীন। কুন্দনন্দিনীতে মেতে ওঠার পর যখন বিধবা বিবাহ করার সখ জাগলো তাঁর, তখন কেবল সমাজের কথা ভেবে তার কিছু সংশয় হয়েছিল। তবে অচিরেই নিজের জমিদারিত্বের দাপটে সব প্রশ্ন তিনি থামিয়ে দিতে পারবেন এই ঔদ্ধত্য তাঁর তৈরি হয়। সূর্যমুখীর যন্ত্রণাকাতর মনটিকে তিনি প্রথম অনুভব করেন কুন্দকে বিয়ে করার পর সূর্যমুখী অন্তর্হিতা হলে। তখন তীব্র গ্লানি নিয়ে সংসার ছেড়ে তিনি সূর্যমুখী অন্বেষণে বেরোলেন বটে, তবে নব বিবাহিতা কিশোরী কুন্দর মনের অবস্থা কেমন হবে তাতে, সে বিষয়টিকে বিন্দুবিসর্গ আমল দিলেন না। কুন্দ বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করার আগে কুন্দর একাকিত্বের যন্ত্রণাকে নগেন্দ্র বুঝতেই পারেন নি। অর্থাৎ উভয় ক্ষেত্রেই বঙ্কিমী উপন্যাসে পুরুষের দরকার পড়েছে বাইরের এক তীব্র ঘটনার অভিঘাত। সেই ঘটনার সূত্র ধরেই কেবল নারীর একাকিত্ব ও যন্ত্রণাকে নায়ক বুঝতে পারেন। অন্যদিকে ফ্লবেয়ারের ফরাসী উপন্যাসের পুরুষ চরিত্রটি স্ত্রীর যন্ত্রণার কথা শুধু অনুভব করেন তাই নয়, এর প্রতিষেধক খুঁজে বের করারও আন্তরিক চেষ্টা করেন। বাসা বদলে শহরে আসা বা থিয়েটার দেখতে স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়া এরই প্রকাশ। সেই সঙ্গে এতাও লক্ষ করার যে স্বামীর এই প্রচেষ্টার সূত্র ধরেই ফ্লবেয়ারের উপন্যাসে স্ত্রী এমার নতুন নতুন প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। থিয়েটারের আসরে এমার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় পুরনো বন্ধু লিওর সঙ্গে। লিও তখন আইন ব্যবসার কাজে ওখানেই থাকেন। লিওর সঙ্গে নতুন এক প্রেমের অধ্যায় শুরু হয় এমার। এমা বিলাসবহুলভাবে থাকা শুরু করেন, ধারে দামী দামী পোশাক ও জিনিসপত্র কিনতে থাকেন ও এর ফলে বড়সড় ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েন। যখন ঋণশোধের জন্য চাপ আসে এমা অনেকের কাছে টাকা ধার চান, কিন্তু কেউই কিছু তাকে দেয় না। চার্লস স্ত্রীর কার্যকলাপে হতাশ হয়ে পড়েন, কাজকর্ম ছেড়ে দেন এবং সম্পত্তি বেচে দিয়ে সেই টাকায় দিন চালাতে থাকেন। অল্প কিছুদিন পরেই চার্লসের মৃত্যু হয়। তাদের মেয়ে বার্থে এক পোশাক কারখানায় উদয়াস্ত কাজ করে উপার্জন করতে থাকেন।
ফ্লবেয়র তার আখ্যানে যেভাবে মাদাম বোভারির একাধিক বিবাহোত্তর প্রেম সম্পর্ক দেখিয়েছেন, বাস্তবিক পক্ষেই তা সেকালের সমাজনীতির পক্ষে গুরুপাক হয়েছিল। ফ্লবেয়ারের এই উপন্যাস লেখার প্রায় এক শতাব্দী আগে ইংলিশ চ্যানেলের অন্য প্রান্তে রিচার্ডসন যখন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস পামেলা লিখেছিলেন, সেখানে বড় হয়ে উঠেছিল নায়িকার বিবাহ পূর্ববর্তী যৌন শুচিতার প্রশ্ন। দরিদ্র পরিবার থেকে মনিবের বাড়িতে কাজ করতে আসা কিশোরী পামেলা বাবা মার কাছ থেকে যেসব চিঠি পায় সেখানে তাঁরা পামেলাকে নৈতিক আচরণ ও শুচিতা সম্পর্কে বারবার সতর্ক করেন। জীবন রক্ষার থেকেও কৌমার্য রক্ষার সম্মানই হবে পামেলার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ – তাঁদের চেতাবনীকে পামেলার বাবা মা এই পর্যায়ে পর্যন্ত নিয়ে যান। আমাদের এখনকার পাঠে এই ধরনের যৌন শুচিতাবোধ আশ্চর্য ও অমানবিক ঠেকলেও অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগের ইংলণ্ডের সমাজের একাংশের মধ্যে খ্রিস্টিয় পাপবোধ কেমন ছিল, তার পরিচয় এখানে পাওয়া যাবে। মজার বিষয় হল পামেলার ঠিক সমকালে লেখা আর একটি বিখ্যাত উপন্যাস হেনরি ফিল্ডিং এর টম জোনস এ আমরা দেখি সেখানে নায়ক টম জোনস তার প্রাক বিবাহ জীবনে একের পর এক যৌন সম্পর্কে জড়াচ্ছে, যদিও তার এক সুনির্দিষ্ট প্রেমিকা বর্তমান। যৌন শুচিতা সংক্রান্ত নৈতিকতার প্রশ্নটি যে নারী পুরুষের ক্ষেত্রে পশ্চিম দুনিয়াতেও একেবারেই আলাদা ধরনের ছিল তা পামেলা ও টম জোনসের মতো একেবারে পিঠোপিঠি সময়ে রচিত দুটি উপন্যাস থেকে বোঝা সম্ভব। তার একশো বছরেরও বেশি সময় পরে সবচেয়ে প্রগতিশীল সমাজের দেশ বলে পরিচিত ফ্রান্সেই যখন ফ্লবেয়রের মাদাম বোভারির বিরুদ্ধে অনৈতিকতাকে উৎসাহ দেবার অভিযোগ ওঠে, তখন উনিশ শতকের মধ্যকালে সামন্ততান্ত্রিকতা দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে ঢাকা বাঙলার সমাজমন কীভাবে ভাবত, তা সহজেই অনুমেয়।
ফ্লবেয়রের নারী চরিত্র আর বঙ্কিমের নারীরা একেবারেই আলাদা। আমরা বিধবা কুন্দর জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার আকুতিটি খুব অস্ফুটভাবে শুনি দু একবার। সূর্যমুখীর যন্ত্রণাকাতর মনটিও সেভাবে বিশ্লেষিত হয় না, ঘটনাসূত্র ধরে তা আমাদের বুঝে নিতে হয়। বঙ্কিম যে প্রণয় ও কামনাচিত্র সবিস্তারে দেখান তা দেবেন্দ্র হীরা উপকাহিনী। তাকে প্রেম নয়, অনৈতিক শরীরী টান ও বিষবৎ বলে পরিত্যায্য হিসেবেই উপন্যাসে আনা হয়। ফ্লবেয়ার কিন্তু এমার একাধিক পুরুষ সম্পর্ককে তাঁর একাকিত্ব ও যন্ত্রণার সঙ্গে যুক্ত করেই দেখান। দেখান বিবাহ বহির্ভূত প্রেম ও ভোগ্যপণ্যের দিকে নায়িকার তীব্র রতিকে। এমার যৌনরতি ও পণ্যরতি ডাক্তার বোভারির জীবনকে কীভাবে তছনছ করে দিল তা ভাবলে তার জন্য আমাদের বেদনাই হয়। বঙ্কিম তাঁর ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে নগেন্দ্রর মাসের পর মাস সূর্যমুখী অন্বেষণের পর্বটিতে নায়কের শারীরিক মানসিক যন্ত্রণার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন, কিন্তু শেষপর্যন্ত নগেন্দ্রর জন্য পাঠক করুণা অনুভব করেন না। কিছুটা সূর্যমুখী আর মূলত সব হারা কুন্দনন্দিনীই পাঠকের সহানুভূতি অর্জন করেন। ফ্লবেয়ার কিন্তু মাদাম বোভারি উপন্যাসে নায়ক চার্লস বোভারিকেও এমনভাবে আঁকেন যে তাঁর জন্যও পাঠকচিত্ত বিবশ হয়। চেষ্টা করেও, সংবেদনশীল থেকেও তার দাম্পত্য ও সংসার ব্যর্থ হয়ে গেল। শুধু তাই নয় তীব্র ঋণজাল মানসিক ও ব্যবহারিক জীবনকেও তছনছ করে দেয়, যার পরিণতিতে তার মৃত্যু পর্যন্ত হয়।
‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে সন্তান বা পরবর্তী প্রজন্মের দিকে আখ্যানকে টানেন নি বঙ্কিম। ফ্লবেয়র কিন্তু মাদাম বোভারিতে সেদিকে এগোন। চার্লস ও এমার কন্যা বার্থে দিন চালানোর জন্য পোশাক কারখানায় সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে বাধ্য হন। ফ্লবেয়র দেখান সঙ্কট ব্যক্তির ট্রাজেডি শুধু নয়। চার্লস বোভারির মৃত্যুতেই বোভারি পরিবারের ট্রাজেডি শেষ হচ্ছে না। তা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে সঞ্চারিত হচ্ছে এবং মেয়ের গোটা জীবনকে দূর্বিষহ করে তুলছে। বঙ্কিমের নায়িকার মাতৃত্বগত সঙ্কট প্রশ্নগুলি কোনও উপন্যাসেই নেই। ‘বিষবৃক্ষ’, চন্দ্রশেখর, কৃষ্ণকান্তের উইল – কোথাও নায়িকারা জননী নয়। একই ব্যাপার দেখতে পাব পরবর্তীকালে এই ধরনের সঙ্কট নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি, ঘরে বাইরে বা শরৎচন্দ্রের গৃহদাহতেও। বাংলা উপন্যাসে সঙ্কটের প্রশ্নটি যেখানে প্রায় সর্বত্র স্ত্রী বা প্রেয়সী পরিচিতির ভিত্তিকে কেন্দ্র করে এগোয়, সেখানে ফ্লবেয়ারের মাদাম বোভারি একইসঙ্গে নায়িকার স্ত্রী ও জননী পরিচিতিকে সামনে আনে, পরবর্তী প্রজন্মসহ পরিবারের বৃহত্তর ছবিকে সামনে আনে।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য নায়িকার দাম্পত্য বহির্ভূত প্রেম ও সঙ্কট নিয়ে ফ্লবেয়ার ও বঙ্কিমের আর এক সমকালীন ঔপন্যাসিক তলস্তয়ের যে বিশ্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাসটি রয়েছে সেই আনা কারেনিনাতেও (১৮৭৫-৭৭) আনার কেবল স্ত্রী পরিচিতিটিই নেই, তিনি জননীও। এক সন্তান, আনার পুত্র সেরিওঝার জন্ম তাঁর স্বামী আলেক্সি আলেক্সান্দ্রোভিচ কারেনিনের ঔরসে এবং অন্যজন, কন্যা আন্নির জন্ম তার প্রেমিক ভ্রনস্কির ঔরসে। ভ্রনস্কির প্রতি প্রেমকে আনা প্রথমে গোপন রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ঘোড়দৌড়ের সেই বিখ্যাত দৃশ্যে যখন ভ্রনস্কি ঘোড়া থেকে পড়ে আহত হল, সে আর নিজের আবেগকে আটকে রাখতে পারে নি। আহত প্রেমিককে জড়িয়ে ধরে সমাজ সংসারের কাছে প্রকাশ করে দেয় তার ভালোবাসা। মিস্টার কারেনিনকে ছেড়ে ভ্রনস্কির দিকে আনার ঝুঁকে পড়ার মধ্যে রুশ আমলাতান্ত্রিক সমাজ ও জীবনের দমবন্ধকরা পরিবেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও তা থেকে মুক্তি আকাঙ্ক্ষাও ছিল। সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নটির সমাধান তুলনামূলকভাবে সহজে করতে পেরেছিল আনা। কিন্তু তার জননী সত্তা যখন প্রবল হয়ে উঠল, মা হিসেবে সন্তান সেরিওঝার প্রতি তার দায়িত্ব কর্তব্য পালনে খামতি যখন তার গ্লানির কারণ হল তখন তার সঙ্কট সামাজিক নয়, হয়ে উঠল আত্মিক। তলস্তয় আনাকে উপন্যাসের শুরুতে সন্তান বৎসল জননী হিসেবে দেখিয়েছিলেন। পরে তিনি এখানেই আনার জীবনের নীতি নৈতিকতার প্রশ্নটিকে বেধে দিলেন। প্রেমের চেয়েও মাতৃত্বের প্রশ্নটি আনার কাছে বড় হয়ে উঠল। আনার আত্মহত্যা লোকলজ্জাজাত ছিল না, জননীর গ্লানি থেকে উদ্ভূত সঙ্কটে তার বীজ ছিল, এরকম মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।
স্ত্রী ও জননী এই দুই সত্তা মাদাম বোভারি বা আনার সঙ্কটকে জটিলতর করেছে এবং উপন্যাসের অঙ্গনকেও প্রসারিত করেছে। বঙ্কিমের বিষবৃক্ষ উপন্যাসে ঘটনাগতি ও কাহিনী বর্ণনা কৌশল আকর্ষণীয় হলেও স্বীকার করতে হবে ফ্লবেয়ারের মাদাম বোভারি বা তলস্তয়ের আনা কারেনিনার মতো বিস্তার এখানে নেই। যন্ত্রণাকে শুধু বর্ণনা করা নয়, মেলে দেখানোর যে বিস্তারিত দৃষ্টান্ত ‘মাদাম বোভারি’ ও ‘আনা কারেনিনা’তে আছে তাও বিষবৃক্ষে অনুপস্থিত। ‘বিষবৃক্ষ’ বঙ্কিম তথা বাংলা সাহিত্যের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক নভেল হিসেবে নিঃসন্দেহে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী, তবে বিস্তার ও গভীরতার দিক থেকে ফ্লবেয়ারের মাদাম বোভারি বা তলস্তয়ের আনা কারেনিনা সমগ্র বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে যেরকম বিরাট মাইলস্টোন, সেই উচ্চতার দাবি বিষবৃক্ষের নেই।