বিষবৃক্ষ ও মাদাম বোভারি - একটি তুলনামূলক পাঠ

ত্রিকোণ প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম সামাজিক উপন্যাস ‘বিষবৃক্ষ’ লেখা হল ১৮৭২ – ৭৩ সালে। সাত বছর আগে লেখা আগে নিজের প্রথম বাংলা উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’তেও ত্রিকোণ সম্পর্ক এনেছিলেন বঙ্কিম। আয়েষা, তিলোত্তমা, জগৎসিংহ এবং আয়েষা, ওসমান, জগৎসিংহের দুটি ত্রিকোণ সেখানে ছিল। মোগল পাঠান দ্বন্দ্বের ইতিহাস, যুদ্ধবিগ্রহর চেয়ে সম্পর্কের টানাপোড়েন দুর্গেশনন্দিনীর ঐতিহাসিক রোমান্সে বড় হয়ে উঠেছিল। হিন্দু রাজপুত্রের প্রতি মুসলিম রাজকন্যার প্রেম, বিশেষ করে যখন তারা পরস্পর শত্রুশিবিরে এবং যুযুধান গোষ্ঠী - অবশ্যই এক আলোড়নতোলা ব্যাপার ছিল। কিন্তু সেখানে সম্পর্ক আবেশগুলি সবই প্রাক বিবাহ পর্বের ব্যাপার। বিবাহ উত্তর নৈতিকতা বা পরিবার ভাঙনের প্রশ্ন ‘দুর্গেশনন্দিনী’তে আসে নি। অন্যদিকে ‘বিষবৃক্ষ’তে ত্রিকোণ প্রেম এল পরিবারের মধ্যে, বিবাহ সম্পর্কের মধ্যে তা আলোড়ন তুলল।

বিষবৃক্ষ উপন্যাসের শুরুতে অরক্ষিত বালিকা কুন্দনন্দিনীর প্রতি স্নেহ মায়া মমতার টানই ছিল নগেন্দ্রর। তিনি কুন্দনন্দিনীকে তার বোন কমলমণির কাছে নিয়ে আসেন। পরে নগেন্দ্রর স্ত্রী সূর্যমুখী তার দূর সম্পর্কের ভাই তারাচরণের সঙ্গে কুন্দর বিয়ে দেন। তারাচরণ মারা গেলে বিধবা কুন্দ এসে পড়ে নগেন্দ্র সূর্যমুখীর আশ্রয়ে। এর পরেই বিধবা কুন্দর প্রতি নগেন্দ্রর টানের শুরু। শুধু যে নগেন্দ্রই আকৃষ্ট হয়েছিলেন তা নয়, কুন্দও মদনজালে বশীভূত হয়। উপন্যাসের এই ঘটনাবলীর সমকালে শুরু হয়ে গেছে বিধবা বিবাহ। এর পক্ষে বিদ্যাসাগর প্রমুখের যুক্তি প্রমাণ করেছে এটি অশাস্ত্রীয় নয়, বিধবা বিবাহ হিন্দু স্মৃতি শাস্ত্র সম্মতই এক ব্যাপার। বিদ্যাসাগরের এই সমস্ত যুক্তিকে নগেন্দ্র ঢাল করেন। অন্যদিকে বিদ্যাসাগর যে বহুবিবাহ রদ বিষয়ে প্রচার চালাচ্ছেন সে বিষয়ে নগেন্দ্র নীরব। বরং নিজের সামন্তসত্তার গর্বে জাঁক করে বলেন, তিনি জমিদার, তার কাজে বাধা দেবার ক্ষমতা কার আছে।

নগেন্দ্র প্রথমদিকে অবশ্য এই ঔদ্ধত্যকে আড়াল করে রেখে নিজের চিত্তচাঞ্চল্যকে দমন করতেই চেয়েছিল। কুন্দও চায় নি সূর্যমুখীর ঘর ভাঙতে। কিন্তু সূর্যমুখীই স্বামীর চিত্তচাঞ্চল্য ও অস্থিরতা বুঝে কুন্দের সঙ্গে নগেন্দ্রর বিধবা বিবাহ দেন। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের বাইরে থেকে নগেন্দ্র সূর্যমুখী কুন্দনন্দিনীর ত্রিকোণটি এসে পড়ে পরিবারের মধ্যে। বঙ্কিমের কাছে সুযোগ ছিল এই তিনজনের সম্পর্কের চিত্তবৃত্তি ও অবস্থান পালাবদলগুলি ধীরে ধীরে উন্মোচন করে দেখানোর। কিন্তু বঙ্কিম অন্য পথে এগোলেন। একই পরিবারে দুই স্ত্রীকে তিনি রাখতে প্রস্তুত হলেন না। বিয়ের পরদিনই সূর্যমুখী গৃহত্যাগ করল। অনেক নাটকীয় ঘটনাধারা ও নানা দেশ পেরিয়ে আবার সূর্যমুখী যখন ঘরে ফিরল তার পরেই এল কুন্দনন্দিনীর বিষপান ও মৃত্যুর চরম নাটকীয় ঘটনাটি।

উপন্যাসের নামকরণ থেকে কাহিনীবিন্যাস, মূল কাহিনীর পাশে দেবেন্দ্র হীরা উপকাহিনীর আয়োজন – সবের মধ্যে দিয়েই বঙ্কিম তাঁর নীতিবাদি অবস্থানটি প্রকাশ করেন। বঙ্কিম ত্রিকোণ সম্পর্ককে বাস্তব বলে স্বীকৃতি দিচ্ছেন কিন্তু তাকে বিষবৃক্ষ বলে আখ্যায়িত করতেও ভুলছেন না। বঙ্কিমের আপত্তিটি ঠিক কোথায় – বিধবা বিবাহে না বহুবিবাহে তা স্পষ্ট নয়। এখানে বিধবা বিবাহ নিয়ে অনেক তির্যক কথাবার্তা আছে। আবার হীরা, দেবেন্দ্রর যে উপকাহিনী – যাকে বঙ্কিম রীতিমতো পাপ বলে মনে করেন ও পাপাত্মা দুজনের একজনকে উন্মাদ ও অন্যজনকে দীর্ঘকালীন ব্যধিযন্ত্রণায় ভুগে মৃত্যুর নিদান দেন – সেখানে বিধবা বিবাহের কোনও ব্যাপার ছিল না। অসংযত চিত্তবৃত্তি এবং প্রেমের জন্য অনৈতিক পথ গ্রহণকে বঙ্কিম মেনে নিতে প্রস্তুত নন। দেবেন্দ্র এবং হীরার শঠতাকে না হয় আমরা অনৈতিক বলে মেনে নিতে পারি। নগেন্দ্রর সূর্যমুখী থাকতেও কেন কুন্দর প্রতি চিত্তচাঞ্চল্য থাকবে, এ প্রশ্নকেও না হয় সমাজ ও পরিবারধর্মের নিরিখে মাথায় রাখা গেল। কিন্তু কুন্দনন্দিনীর জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং সংসার ও শরীরী যৌবনের স্বাদ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ‘বিষবৃক্ষ’ রোপণ বলে ভাবা দূরে থাকুক, অনৈতিক বলেই বা আমরা ভাবতে যাব কেন ? কুন্দনন্দিনীর সঙ্গে নগেন্দ্রর বিবাহ তো বিধবা বিবাহ প্রচলনের নিরিখ ও বহুবিবাহের প্রচলিত নিয়মের সূত্র – উভয়দিক থেকেই একটি বাস্তব বিষয়।

সূর্যমুখীই এই উপন্যাসের নায়িকা। সে সংসারের কর্ত্রী। স্বামীকে ভালোবাসা ও যত্নে ভরিয়ে রাখা, সংসার সামলানো তো বটেই, জমিদারী সামলানো ও প্রজাশাসনের নানা ভালোমন্দ নিয়েও তার সক্রিয়তার প্রমাণ আছে। স্বামীর চিত্তচাঞ্চল্য ও মনোঃকষ্ট দেখে সে কুন্দের সঙ্গে স্বামী নগেন্দ্রর বিধবা বিবাহ দেয়। কিন্তু এর অনতি পরেই গৃহত্যাগ করে বুঝিয়ে দেয় এই বিবাহ সংগঠনে তার মর্মপীড়ার গভীর অনুভবটি। নিজের জীবনকে সে বিসর্জন দেবার পথেই চলে গিয়েছিল। প্রাণঘাতী অসুখ থেকে সুস্থ হয়ে নানা ঘটনার ঘনঘটা পেরিয়ে সে আবার যখন ঘরে ফিরল, তখনো স্বামীর প্রতি তার ভালোবাসা প্রবল। স্বামী তার বিরহে ঘর সংসার সম্পত্তি ছেড়েছে, তার জন্য ঘুমে জাগরণে, চেতনায় আধা চেতনে বিলাপ করছে – এই ছবি দেখে সে মনে মনে তৃপ্তিই পেয়েছে। স্বামী নগেন্দ্র কুন্দকে বিয়ে করলেও সংসারে তার আসনটি অটুট – এই অনুভব থেকেই জীবনের দ্বিতীয় পর্বটি সূর্যমুখী শুরু করতে চেয়েছিল। কুন্দকেও এবার সে শুধু স্বামীর ছোটবউ হিসেবে নয়, নিজের বোন হিসেবেই আগের মতো গ্রহণ করতে প্রস্তুত হচ্ছিল বলে মনে হয়। কমলকে নিয়ে কুন্দের সমীপে যাবার মধ্যে তার প্রমাণ রয়েছে।

অন্যদিকে কুন্দ প্রথমাবধিই জানতো সে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে স্বামী নগেন্দ্রর সংসারে প্রবেশ করছে। সেই সংসারে সূর্যমুখীর কর্ত্রীর আসনটি যে প্রতিষ্ঠিত তা সে জানত। সে আসন থেকে সূর্যমুখীকে সরিয়ে নিজে অধিষ্ঠিত হবার কোনও বাসনা তার ছিল, এমন কোনও আভাস কোথাও নেই। সে চেয়েছিল সংসারে আশ্রয় এবং অবশ্যই পুরুষের ভালোবাসা। অতৃপ্ত যৌবনের দেহবাসনা পূরণের কথা বঙ্কিম লেখেন নি, কিন্তু কুন্দনন্দিনীর আকুতি থেকে তা বুঝে নিতে আমাদের অসুবিধে হয় না। কুন্দের এই আকাঙ্ক্ষার পূরণ হল না। তার প্রথম বিবাহের সুখ স্বামীর মৃত্যুতে দ্রুতই থেমে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিবাহের পরদিনই সূর্যমুখীর গৃহত্যাগ এবং স্বামী নগেন্দ্রর সূর্যমুখী বিহনে অস্থিরতা ও অনুসন্ধান কার্যে দেশত্যাগ তাকে আবারো একাকী করে দিল। সে না পেল স্বামীর সঙ্গসুখ, না সংসারের নিয়ন্ত্রণ। দ্বিতীয়টি তার আকাঙ্ক্ষার বস্তু ছিলও না, সেজন্য তার দুঃখ নেই। কিন্তু এই প্রশ্ন কুন্দর মনে ওঠা অস্বাভাবিক নয় যে কোন দোষে বিবাহের পরেই স্বামী তাকে পরিত্যাগ করলেন। শুধু তাই নয় সূর্যমুখীর গৃহত্যাগ ও পারিবারিক অস্থিরতার যাবতীয় দায়ভার তার ওপরেই চাপিয়ে দিলেন। কুন্দনন্দিনী গোটা উপন্যাসে অন্তরালে ছায়ার মতো থেকেছে, তার বাকস্ফূর্তি আমরা সেভাবে দেখি না। কিন্তু তার মনের মধ্যে যে কথা ও ক্ষোভ জমে ছিল, জীবন ও জগৎ ত্যাগের মুহূর্তে সে তা উন্মোচন করে দিয়েছে।

নগেন্দ্র এই উপন্যাসের নায়ক। তিনি বিবাহ করতে পারেন যাকে খুশি, কেউ কিছু তাকে বলতে পারবে না, কারণ তিনি জমিদার – এই সামন্তী ঔদ্ধত্য তার আছে। এর পাশাপাশিই আছে সূর্যমুখী ঘর ছাড়ার পর যে চিত্তচাঞ্চল্যের পরিণতিতে এই বিপর্যয়, তার জন্য আন্তরিক অনুতাপ ও কৃচ্ছসাধনের বাস্তব দৃষ্টান্ত। কিন্তু এই অনুতাপপর্বে সদ্য যাকে তিনি বিবাহ করলেন ভালোবেসে, সেই কুন্দনন্দিনীর কথা ভুলে গেলেন। শুধু তাই নয় তাকে মানসিকভাবে কঠোর আঘাত করলেন। নগেন্দ্র একবার কুন্দনন্দিনীর প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে সূর্যমুখীর যন্ত্রণাকে বুঝতে অপরাগ হন, আবার সূর্যমুখীর বিরহে অধীর হয়ে কুন্দের জীবনতৃষ্ণাকে পদদলিত করেন। সূর্যমুখীর বেদনা ও মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাবার ঘটনাটির পেছনে নগেন্দ্রর দায় ও সূর্যমুখীর অভিমান দুই-ই ভূমিকা নিয়েছিল। কুন্দনন্দিনীকে কিন্তু মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলেন মূলত নগেন্দ্রই। তার কৃচ্ছসাধনে আত্মধিক্কার যতই থাকুক, আবারো এক দায়দায়িত্বহীনতা থেকে গেছে। সংসারে পুরুষের স্বাধিকারপ্রমত্ত এই অবস্থানটিকে বঙ্কিম যথেষ্ট ভালোভাবেই উন্মোচন করতে পারেন। নৈতিক বঙ্কিম যতই বিষবৃক্ষ স্থাপণ বিষয়ে পাঠককে সতর্ক করুন, কুন্দর মৃত্যুদৃশ্যে তার ভাগ্যবিড়ম্বনার জন্য পাঠকের মনে যে বেদনা ও যন্ত্রণার বোধ সঞ্চারিত হয়, তা নৈতিক বঙ্কিমের আড়াল ভেঙে শিল্পী বঙ্কিমকে আমাদের সামনে হাজির করে। কুন্দর আকাঙ্ক্ষা ও জীবনতৃষ্ণা যে বাস্তব ও তার ফলে সংগঠিত সমস্যাপটটি যে শুধু নৈতিকতার নীতিবাক্য দিয়ে মোকাবিলা করা যাবে না, তা কথক বঙ্কিমের সতর্কবাক্য পেরিয়েই পাঠক উপলব্ধি করে নেন।

‘বিষবৃক্ষ’র দেড়দশক আগে এক বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস এই ত্রিকোণ প্রেমের বিষয়টিকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছিল। ফরাসী ঔপন্যাসিক গুস্তাভ ফ্লবেয়রের লেখা ‘মাদাম বোভারি’ (১৮৫৭) উপন্যাসের নায়িকা এমা বোভারির জীবনতৃষ্ণার গল্প। ফরাসী সমাজ ও বাংলার সমাজ এক নয়। বঙ্কিম যে ফ্লবেয়রের মতো করে ভাববেন না বা লিখবেন না, তাতেও অবাক হবার কিছু নেই। এও ঠিক যে সেকালের ফরাসী সমাজও মাদাম বোভারির জীবনতৃষ্ণা ও স্বেচ্ছাবিহারিণী ছবিটিকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারে নি। ফ্লবেয়রের এই উপন্যাসের বিরুদ্ধে নিন্দামন্দের ঝড় উঠেছিল।

উপন্যাসের নায়ক চার্লস বোভারিকে তার মায়ের ইচ্ছেয় প্রথম বিয়েটি করতে হয়েছিল এক বিধবা ধনবতী মহিলাকে। চার্লস বোভারি ছিলেন এক ডাক্তার। একবার একজনের ভাঙা পায়ের চিকিৎসা করতে গিয়ে তিনি পরিচিত হন রোগীর কন্যা এমার সঙ্গে। দুজনের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রথম স্ত্রী হেলোইক ডুবুস মারা গেলে চার্লস বিয়ে করেন এমাকে। বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই এমার মনে হতে থাকে তার বিবাহিত জীবনটি পানসে। চার্লস মনে করেন একটু শহরের দিকে চলে এলে তার স্ত্রীর ভালো লাগবে। সেই ভাবনা থেকে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে চলে আসেন জমজমাট বাণিজ্যিক শহর ইয়নভিলে। এখানে এমার এক কন্যা সন্তান জন্মায়। কিন্তু এমা তার মাতৃত্বকে উপভোগ করেন নি। ইয়নভিলে থাকার সময় এমা ভালোবেসে ফেলেন আইন নিয়ে পড়াশুনো করা এক তরুণ ছাত্র লিওকে। সাহিত্য ও সঙ্গীত নিয়ে লিওর সঙ্গে আলাপচারিতা এমার জীবনকে উপভোগ্য করে তোলে। এরপর লিও উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যান প্যারিসে। লিওর বিদায়ের পর এমার জীবনে আসেন আর এক পুরুষ। তার নাম ছিল রোদোলফে। তিনি যথেষ্ট বিত্তশালী। প্রায় বছর চারেক চলে তাদের প্রণয় সম্পর্ক। এমা রোদলফকে জানান তিনি পরিবার ছেড়ে তার সঙ্গে পালিয়ে যেতে চান। পলায়ন পরিকল্পনা যখন ঠিকঠাক তখন হঠাৎই এক চিঠি লিখে এই পরিকল্পনা ও এমার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে দেন রোদোলফে। এমা শোকে দুঃখে প্রবল অসুস্থ হয়ে পড়েন। খানিকটা সুস্থ হবার পর তার চিকিৎসক স্বামী চার্লস বোভারি তাকে নিয়ে রাওয়েনে যেতে থাকেন থিয়েটার দেখতে। উদ্দেশ্য ছিল স্ত্রীকে ক্রমশ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা। থিয়েটারের আসরে এমার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় পুরনো বন্ধু লিওর সঙ্গে। লিও তখন আইন ব্যবসার কাজে ওখানেই থাকেন। লিওর সঙ্গে নতুন এক প্রেমের অধ্যায় শুরু হয় এমার। এমা বিলাসবহুলভাবে থাকা শুরু করেন, ধারে দামী দামী পোশাক ও জিনিসপত্র কিনতে থাকেন ও এর ফলে বড়সড় ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েন। যখন ঋণশোধের জন্য চাপ আসে এমা অনেকের কাছে টাকা ধার চান, কিন্তু কেউই কিছু তাকে দেয় না। চার্লস স্ত্রীর কার্যকলাপে হতাশ হয়ে পড়েন, কাজকর্ম ছেড়ে দেন এবং সম্পত্তি বেচে দিয়ে সেই টাকায় দিন চালাতে থাকেন। অল্প কিছুদিন পরেই চার্লসের মৃত্যু হয়। তাদের মেয়ে বার্থে এক পোশাক কারখানায় উদয়াস্ত কাজ করে উপার্জন করতে থাকেন।

ফ্লবেয়র তার আখ্যানে যেভাবে মাদাম বোভারির একাধিক বিবাহোত্তর প্রেম সম্পর্ক দেখিয়েছেন, বাস্তবিক পক্ষেই তা সেকালের সমাজনীতির পক্ষে গুরুপাক হয়েছিল। ফ্লবেয়ারের এই উপন্যাস লেখার প্রায় এক শতাব্দী আগে ইংলিশ চ্যানেলের অন্য প্রান্তে রিচার্ডসন যখন তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস পামেলা লিখেছিলেন, সেখানে বড় হয়ে উঠেছিল নায়িকার বিবাহ পূর্ববর্তী যৌন শুচিতার প্রশ্ন। দরিদ্র পরিবার থেকে মনিবের বাড়িতে কাজ করতে আসা কিশোরী পামেলা বাবা মার কাছ থেকে যেসব চিঠি পায় সেখানে তাঁরা পামেলাকে নৈতিক আচরণ ও শুচিতা সম্পর্কে বারবার সতর্ক করেন। জীবন রক্ষার থেকেও কৌমার্য রক্ষার সম্মানই হবে পামেলার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ – তাঁদের চেতাবনীকে পামেলার বাবা মা এই পর্যায়ে পর্যন্ত নিয়ে যান। আমাদের এখনকার পাঠে এই ধরনের যৌন শুচিতাবোধ আশ্চর্য ও অমানবিক ঠেকলেও অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগের ইংলণ্ডের সমাজের একাংশের মধ্যে খ্রিস্টিয় পাপবোধ কেমন ছিল, তার পরিচয় এখানে পাওয়া যাবে। মজার বিষয় হল পামেলার ঠিক সমকালে লেখা আর একটি বিখ্যাত উপন্যাস হেনরি ফিল্ডিং এর টম জোনস এ আমরা দেখি সেখানে নায়ক টম জোনস তার প্রাক বিবাহ জীবনে একের পর এক যৌন সম্পর্কে জড়াচ্ছে, যদিও তার এক সুনির্দিষ্ট প্রেমিকা বর্তমান। যৌন শুচিতা সংক্রান্ত নৈতিকতার প্রশ্নটি যে নারী পুরুষের ক্ষেত্রে পশ্চিম দুনিয়াতেও একেবারেই আলাদা ধরনের ছিল তা পামেলা ও টম জোনসের মতো একেবারে পিঠোপিঠি সময়ে রচিত দুটি উপন্যাস থেকে বোঝা সম্ভব। তার একশো বছরেরও বেশি সময় পরে সবচেয়ে প্রগতিশীল সমাজের দেশ বলে পরিচিত ফ্রান্সেই যখন ফ্লবেয়রের মাদাম বোভারির বিরুদ্ধে অনৈতিকতাকে উৎসাহ দেবার অভিযোগ ওঠে, তখন উনিশ শতকের মধ্যকালে সামন্ততান্ত্রিকতা দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে ঢাকা বাঙলার সমাজমন কীভাবে ভাবত, তা সহজেই অনুমেয়। শুধু বিষবৃক্ষেই নয়, পরবর্তী ‘চন্দ্রশেখর’ ও ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’এও বঙ্কিমের নীতিবাদী অবস্থানটি বজায় থেকেছে একইভাবে।

বিশ শতকের গোড়ায় রবীন্দ্রনাথ যখন ‘চোখের বালি’ লিখলেন, তখন তার সমাপ্তির অতৃপ্তি সত্ত্বেও বিনোদিনীর জীবনতৃষ্ণা এবং শরীরী সংরাগের আকাঙ্ক্ষাকে যেভাবে মর্যাদা দেওয়া হল – তা বাংলা উপন্যাসে এই সংক্রান্ত দৃষ্টিকোণ বদলে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিল। শরৎচন্দ্রর ‘গৃহদাহ’ বা ‘চরিত্রহীন’ এর মতো উপন্যাসের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার পথও প্রস্তুত করল। এই বিষয়গুলি নিয়ে আমরা পরে আলাদাভাবে আলোচনা করব।