গার্সিয়া মার্কেস ও চিলিতে মিগুয়েল লিটিনের গোপন চলচ্চিত্রনির্মাণ অধ্যায়

১৯৬৭ তে গার্সিয়া মার্কেসের বিখ্যাত উপন্যাস “নিঃসঙ্গতার একশো বছর” বেরনোর পরই স্প্যানিশ ভাষাভাষী জগতে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। সত্তর দশকের শুরুতে এর ইংরাজী অনুবাদের হাত ধরে গার্সিয়া মার্কেস ইউরোপ, মার্কিন দুনিয়ার শিক্ষিত সংস্কৃতিবান মানুষের পাঠ্য তালিকায় ঢুকে পড়েন ও প্রবলভাবে সমাদৃত হন। ১৯৮২ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাকার হিসেবে পরিগণিত হতে থাকেন। তাঁর রচনারীতির পাশাপাশি চর্চিত হয় তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শও। গার্সিয়া মার্কেস ছিলেন উদার নৈতিক বামপন্থী। কিউবার রাষ্ট্রপ্রধান ফিদেল কাস্ত্রো বা চিলির মার্কসবাদী রাষ্ট্রপতি সালভাদোর আলেন্দে ছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধু। সেই সময়ে লাতিন আমেরিকার অল্প কিছু দেশে মার্কসবাদী বা বামপন্থী শাসকেরা ক্ষমতায় থাকলেও বেশীরভাগ দেশই ছিল দক্ষিণপন্থী শাসকদের অধীনে। এদের অনেকেই আবার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ছিলেন না, মিলিটারি প্রধান হিসেবে দেশের নিয়ন্ত্রক ছিলেন। বামপন্থী শাসকেরা কমবেশি সোভিয়েত প্রভাবাধীন ছিলেন, আর দক্ষিণপন্থী শাসকেরা চলতেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গুলি হেলনে। সোভিয়েত মার্কিন ঠান্ডা যুদ্ধের লড়াই লাতিন আমেরিকার দেশে দেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। সারা বছর, বিশেষ করে বিভিন্ন দেশের নির্বাচনের আগে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সি আই এ প্রচারাভিযানের মাধ্যমে মানুষের মন ও মননকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালাত। চিলির মার্কসবাদী রাজনীতিবিদ ও সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা সালভাদোর আলেন্দে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তিনবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হলেও পরাস্ত হয়েছিলেন। ১৯৭০ সালে আলেন্দে একটি বাম গণতান্ত্রিক জোটের মুখ হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হন। সি আই এ আলেন্দে বিরোধী প্রচারে সক্রিয় হয়ে ওঠে ও বহু কোটি ডলার ব্যয় করে। কিন্তু তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে দিয়ে আলেন্দে শেষপর্যন্ত বিজয়ী হন।

আলেন্দে বিজয়ী হবার দিন থেকেই তাঁকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরাতে সি আই এ র নেতৃত্বে চিলির ভেতরের মার্কিনী অক্ষ ও দক্ষিণপন্থী শিবির সক্রিয় হয়ে ওঠে। চিলিতে ধর্মঘট ও অন্য নানা কৌশলে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চলতে থাকে। সেনাপ্রধান বদল করে সেখানে বসানো হয় পিনোচেতকে। সেনাপ্রধান হবার পরেই ১৯৭৩ সালে পিনোচেত আলেন্দের বিরুদ্ধে একটি ক্যু সংগঠিত করেন। সেনাবাহিনী আলেন্দের রাষ্ট্রপতি ভবন ও রাজধানী সান্তিয়াগোর গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্রগুলির দখল নেয়। আলেন্দে আত্মসমর্পণ না করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। অনেককে হত্যা করা হয়। অনেকে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। নোবেল বিজয়ী বিখ্যাত বামপন্থী কবি পাবলো নেরুদার রহস্যজনক মৃত্যু হয় ্ক্যু সংগঠিত হওয়ার অব্যবহিত পরে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য তিনি ছিলেন আলেন্দে প্রশাসনের ঘনিষ্ট বন্ধু ও সমর্থক। আলেন্দের মৃত্যুর পর মার্কিন মদতে ক্ষমতায় বসেন চরম দক্ষিণপন্থী সেনাশাসক পিনোচেত। চিলিতে শুরু হয় স্বৈরতান্ত্রিক শাসন। আলেন্দে বিভিন্ন অর্থনৈতিক ক্ষেত্র ও পরিষেবার যে রাষ্ট্রীয়করণ কর্মসূচী এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তাকে উলটে দেওয়া হয় ও সমস্ত কিছুর বেসরকারীকরণ করা শুরু হয়। দীর্ঘদিন চিলি গণতন্ত্র ও নির্বাচনের আঙিনার বাইরে চলে যায়। পিনোচেত বলতেন তাঁর লক্ষ্য চিলির মানুষের মন ও স্মৃতি থেকে গণতন্ত্রের সমস্ত শিকড়কে উপড়ে ফেলা।

আলেন্দের স্বৈরশাসন শুরু হবার সময় চিলির সরকারী চলচ্চিত্র সংস্থার প্রধান ছিলেন বিখ্যাত চিত্রপরিচালক মিগুয়েল লিটিন। ক্যু সংগঠিত হবার সময় পিনোচেতের অনুগামীরা চলচ্চিত্র ভবনটিও ঘিরে ফেলেছিল। লিটিন একজনের সহায়তায় কোনওক্রমে সেখান থেকে ও তারপর দেশ থেকে পালাতে পারেন। মেক্সিকো ও স্পেনে দীর্ঘদিন তাঁকে অভিবাসীর জীবন কাটাতে হয়। পিনোচেতের স্বৈরশাসন শুরু হবার বারো বছর পরে দুটি তালিকা প্রকাশিত হয় চিলির সরকারী মহল থেকে। একটি তালিকা জানায় কারা স্বচ্ছন্দে চিলিতে ফিরতে পারেন। দ্বিতীয় তালিকাটি জানায় কারা চিলিতে প্রবেশাদিকার পাবেন না, কাদের চিলির সরকার রাষ্ট্রের পক্ষে, শাসকের পক্ষে বিপজ্জনক বলে মনে করছে। মিগুয়েল লিটিনের নাম এই দ্বিতীয় অর্থাৎ রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক ব্যক্তিদের তালিকায় ছিল।

এইসময়ে এক ব্যক্তিগত পরিসরের আড্ডায় লিটিন বলেন গোপনে ছদ্মবেশে চিলিতে ঢুকে যদি একটা ফিল্ম বানানো যেত, ধরা যেত পিনোচেতের এক দশক অতিক্রান্ত স্বৈরশাসনে চিলির মানুষ কেমন আছেন, কী ভাবছেন তা হলে ভালো হত। চিলিতে সে সময় পিনোচেত বিরোধী যে সমস্ত গোপন গেরিলা রাজনৈতিক সংগঠন সক্রিয় কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছিল তাঁদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের কথা বিশ্ববাসীকে শোনানোর ভাবনাও লিটিনের মাথায় ছিল। অনেকে এই সব ভাবনা খেয়াল বলে মনে করলেও কেউ কেউ একে গুরুত্ব দেন ও লিটিনের পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপদান করার জন্য সাহায্য সহযোগিতা শুরু করেন। লিটিন ছদ্মবেশে চিলিতে প্রবেশ করেন, ফিল্মের শ্যুটিং করেন নানা গোপন অ্যাডভেঞ্চারের মাধ্যমে অশেষ ঝুঁকি নিয়ে এবং ফিল্মের কাজ শেষ করে আবার চিলি থেকে পালাতে সক্ষম হন। মাদ্রিদে গিয়ে লিটিনের এই লোমহর্ষক অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী শোনেন গার্সিয়া মার্কেস। নোবেল পুরস্কার পাবার পর গার্সিয়া মার্কেস তখন বিশ্বখ্যাতির অধিকারী। তিনি লিটিনের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেন কয়েকদিন অনেক ঘন্টা ধরে। সেই আঠারো ঘন্টার রেকর্ডেড সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতেই লেখা হয় গার্সিয়া মার্কেসের বিখ্যাত নন ফিকশান La aventura de Miguel Littín clandestino en Chile। এই বইটি গোপনে চিলিতে পৌঁছয়। চিলির স্বৈরশাসকেরা বইয়ের সমস্ত কপি বাজেয়াপ্ত করে। ১৯৮৭ সালের ২৫ জানুয়ারির সংবাদপত্র রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে কিছুদিন আগে চিলির ভালপারাসিও নামক বন্দর শহরে এই বইয়ের ১৪,৮৪৬ টি কপি মিলিটারি জুন্টা পুড়িয়ে দিয়েছে। বইটির ইংরাজী অনুবাদ Clandestine in Chile: The Adventures of Miguel Littín বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে ও তা চিলির স্বৈরশাসনকে বেআব্রু করে দেবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। পিনোচেত বিরোধী যে আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক কন্ঠস্বর চিলির ভেতরে ও বাইরে প্রবল হয়ে ওঠে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মহলে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, তাতে এই বইটির বিশেষ ভূমিকা ছিল।

গার্সিয়া মার্কেস এই নন ফিকশান জাতীয় রচনাটি লিখেছেন মিগুয়েল লিটিনের নিজের জবানীতে। বইটির রচনারীতি সংক্রান্ত কিছু কথা তিনি নিজেই জানিয়েছেন বইয়ের ভূমিকায়। বইটি যখন লেখা ও প্রকাশিত হচ্ছে তখনো চিলিতে পিনোচেতের স্বৈরশাসন চলছে। ফলে চিলির ভেতরে থাকা বেশ কিছু ব্যক্তির নামধাম ও ঘটনাস্থলকে পরিবর্তিত করে নেন গার্সিয়া মার্কেস, খেয়াল রাখেন যেন স্বৈরশাসনের আঁচ এই গোপন চলচ্চিতনির্মাণে সাহায্যকারীদের ক্ষিতিবৃদ্ধির কারণ না হয়। ঘটনাধারা লিটিনের জবানীতে বলা হলেও কথকের বলা স্বরটি যে লেখক গার্সিয়া মার্কেসের সেকথা লেখক সরাসরি এই ভূমিকায় জানিয়ে দিয়েছেন। সাক্ষাৎকারের লিখিত বয়ান ছিল ছশো পাতার। সেখান থেকে দুশো পাতারও কম দৈর্ঘ্যে নিয়ে আসা বইটি স্বাভাবিকভাবেই লেখক গার্সিয়া মার্কেসের নির্দিষ্ট চয়ন ও কথন পদ্ধতিকে সামনে এনেছে। তবে সেইসঙ্গে গার্সিয়া মার্কেস এও অকপটে জানিয়ে দিয়েছেন যে মিগুয়েল লিটিনের দৃষ্টিকোণটিকে তিনি কোথাও বদল করেন নি। এমনকী যে সব প্রশ্নে ব্যক্তি হিসেবে তিনি ভিন্নমতের অধিকারী সেসব ক্ষেত্রেও লিটিনের মত ও দৃষ্টিকোণটিই তিনি রক্ষা করেছেন। কথক ও লেখকের দ্বিরালাপের এক দৃষ্টান্ত হিসেবে এই নন ফিকশানটিকে আমরা পড়তে পারি, যেখানে মতাদর্শের ক্ষেত্রে কথকের নিজস্বতা পুরোপুরি রক্ষিত, কিন্তু লেখার আঙ্গিক বা শৈলিগত দিকে রয়েছে লেখক গার্সিয়া মার্কেসের নিজস্বতার ছাপ।

এই নন ফিকশান বাস্তব থ্রিলারের মতোই লোমহর্ষক হয়ে ওঠার উপাদান সমৃদ্ধ। কিন্তু এর আলোচনা করার সময় খানিকটা অনুযোগের সুরেই অনেকে বলেছেন এটি যেন ততটা চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠতে পারে নি। এ কী লেখক হিসেবে গার্সিয়া মার্কেসের সীমাবদ্ধতা? জাদুবাস্তবতার জাদুকলমের শিল্পী কি থ্রিলার লিখতে পারঙ্গম ছিলেন না? আসলে বিষয়টি একদমই অন্যরকম বলে আমাদের মনে হয়। বিখ্যাত অনেক কলমচি যা বুঝতে পারেন নি। তাঁরা স্বাদু আখ্যানের নিরিখ থেকে এই বইটিকে দেখতে চেয়েছেন। কিন্তু গার্সিয়া মার্কেস এই বইয়ের উদ্দেশ্যমূলকতাকে গোপন করতে চান না। শুধুমাত্র একটি অ্যাডভেঞ্চার বর্ণনা তাঁর লক্ষ্য নয়। তিনি অ্যাডভেঞ্চারের পেছনের রাজনৈতিক কারণটিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। একটি রোমাঞ্চকর আখ্যান হিসেবে এই কাহিনী পাঠক না পড়ে দক্ষিণপন্থী স্বৈরশাসন বনাম বাম গণতান্ত্রিক আদর্শের জায়গাটি মাথায় রেখে যেন পড়েন, সেটা গার্সিয়া মার্কেস সবসময়েই মাথায় রাখেন।

তবে বেশ কিছু জায়গায় এই রচনা বিষয়বস্তুর কারণেই লোমহর্ষক ও রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা মুহূর্ত তৈরি করেছে। একেবারে শেষে বিমান বন্দরে আসার পথে রাস্তা ভুল করা, মিথ্যা পরিচয় ও কারণ সামনে রেখে পুলিশি গাড়ির এসকর্ট নিয়ে দ্রুতগতিতে বিমান বন্দরে পৌঁছানো, বিমান বন্দরে নানা জটিলতা ও প্লেনে সময়মত উঠতে না পারার পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কথা উদাহরণ হিসেবে বলা যায়।

মিগুয়েল লিটিনের পরিহাসপ্রিয় মন মানসিকতাটি চরম ঝুঁকিপূর্ণ এই সফরেও হারিয়ে যায় নি। সঙ্কটের মধ্যেও তা কীভাবে বজায় থেকেছে তা বোঝা যায় পুঁজিপতির পোশাকে ও পরিচয়ে নিজেকে মানিয়ে নেবার চেষ্টার প্রতি তির্যক মন্তব্যগুলি থেকে। চুল কাটার সময়ে যে বিড়ম্বনার উদ্ভব হয় এক সকালে, সেখানেও লিটিনের পরিহাসপ্রিয়তাকে গার্সিয়া মার্কেসের কলম ধরে রেখেছে।

মানবিক সম্পর্ক বিপ্লবী রাজনীতির ওতোপ্রোত অঙ্গ। এখানেও তার কোনও ব্যতিক্রম হয় নি। বিভিন্ন সহায়কের সঙ্গে লিটিনের বিচ্ছেদ মুহূর্তগুলির বেদনা বেশ আন্তরিক। কাজের সম্পর্ক প্রায়শই এখানে মানসিক সম্পর্কে পরিণত হয়েছে। লিটিন যখন ছদ্মবেশে মায়ের কাছে উপস্থিত হন, তখন মাও তাঁকে চিনতে পারেন না। চেনার পরে মা তাঁকে সেই ঘরটিতে নিয়ে আসেন যেটি লিটিনের ব্যবহৃত ঘরের আদলে তিনি তিল তিল করে পুনঃনির্মাণ করেছেন। ঘরটি লিটিনকে তাঁর অতীতে নিয়ে যায়, স্মৃতিমেদুর করে তোলে। বস্তুতপক্ষে রাজনৈতিক কারণে বাধ্য হয়ে দেশত্যাগ করা মানুষের যে যন্ত্রণা, তা লিটিনের সফরে তথা এই লেখার সর্বত্র পরিব্যাপ্ত।

মিগুয়েল লিটিন চেয়েছিলেন তাঁর দেশবাসীর স্মৃতি পরীক্ষা করতে, তাঁদের বর্তমান সত্তাকে জানতে, তাঁদের ভবিষ্যৎ স্বপ্নের খোঁজখবর নিতে। তিনি এক ধনী উরুগুয়ে ব্যবসায়ীর নামের আড়াল নিয়ে তাঁর পাসপোর্টে নিজের খানিক অদল বদল করা চেহারার ছবি বসিয়ে চিলিতে ঢোকেন। পিনোচেত বিরোধী গোপন আন্দোলনকারীদের সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে ছয় সপ্তাহ চিলিতে থেকে লিটিন তাঁর তথ্যচিত্রের উপাদান সংগ্রহ করেন। একজন ইউরোপবাসী চিলির নাগরিক তাঁর স্ত্রী পরিচয়ে প্রথম দিকে বেশ কিছুদিন তাঁর সঙ্গে থাকেন ও তাঁর হয়ে যোগাযোগ রক্ষার কাজটি করতে থাকেন। পরে লিটিন পরিস্থিতির সঙ্গে খানিকটা সড়গড় হয়ে উঠলে তিনি ফিরে যান। তিনটি ইউরোপীয় ফিল্ম নির্মাতা দল তথ্যচিত্রের শ্যুটিং এর কাজে লিটিনকে সহায়তা করেন। ইতালিয়ান দলটি সান্তিয়াগোকেকেন্দ্র করে শ্যুটিং এর কাজ চালায়। ফ্রান্সের দলটি কাজ চালায় চিলির উত্তরাংশে। দক্ষিণাংশের কাজ চালিয়ে যায় ডাচ দলটি। কোনও দলই নিরাপত্তার খাতিরে পুরো বিষয়টি জানত না। লিটিন একেক দলের জন্য প্রকাশ্যে এক এক ধরনের কাজ স্থির করে রাখেন ও তার আড়ালে নিজের পরিকল্পনামত শ্যুটিং করে নেন। গার্সিয়া মার্কেস নিজেও চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং চিত্রনাট্যের কর্মশালা নামে একটি জনপ্রিয় বইও তাঁর আছে। সেকারণেই লিটিনের চলচ্চিত্র নির্মাণের গোপন, আধা গোপন ও প্রকাশ্য দিকগুলিকে মিলিয়ে একটি উপস্থাপণা তাঁর পক্ষে সহজ হয়েছে।

গার্সিয়া মার্কেসের এই নন ফিকশানে চিলিতে পুনঃপ্রবেশের শুরুতে লিটিনের জবানীতে একসময় আমরা খানিক অস্বস্তির সুরই শুনেছিলাম। লিটিন স্বৈরশাসনের চিলিতে যে পরিমাণ অসন্তোষ ও দমনপীড়নের ছবি দেখবেন ভেবেছিলেন, এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল আসার পথে বা হোটেলে থাকার আপাত নিস্তরঙ্গ প্রথম দিনগুলিতে চিলিতে সেই ছবি তিনি দেখতে পান নি। লিটিনের মনে প্রশ্ন জেগেছিল তবে কি পিনোচেতের জমানায় মানুষ স্বস্তিতে আছে? সালভাদোর আলেন্দে ও গণতন্ত্রের স্মৃতি ও স্বপ্নকে কি পিনোচেত ভুলিয়ে দিতে পেরেছেন?

শ্যুটিং করতে করতে, রাজধানী ছাড়িয়ে বিভিন্ন বন্দর ও জনপদে গিয়ে, বিভিন্ন গেরিলা সংগঠন ও গোপন প্রতিরোধ বাহিনীর মানুষদের সঙ্গে কথা বলে, সাধারণ মানুষের মনের ভেতরের কথা শুনে লিটিন পিনোচেত জমানার বাস্তব ছবিটা ক্রমশ বুঝতে পারেন ও তথ্যচিত্রের ফ্রেমে তাকে বন্দী করতে থাকেন। সবসময়েই ধরা পড়ে যাওয়ার আতঙ্ক শ্যুটিং পর্বে তাঁকে ও তার সঙ্গীসাথীদের ঘিরে থেকেছে। তবুও তাঁরা সাহস ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই পুর কাজটি সুচারুভাবে পরিকল্পনামাফিক সম্পন্ন করতে সক্ষম হন। যখন লিটিনের কথা প্রায় জানাজানি হতে বসেছে ও তাঁকে ধরার জন্য স্বৈরশাসকেরা জাল গুটিয়ে আনার কাজ শুরু করেছে, সেই সময়ে তিনি চিলি থেকে আবার ইউরোপে ফিরে যেতে সমর্থ হন। ক্যানবন্দী ফিল্মগুলো তার আগেই সীমান্ত পেরিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। সেই সব উপাদান থেকে Acta General de Chile নামের ফিল্মটি তৈরি হয় ও বিশ্বের নানা প্রান্তে দেখানো শুরু হয়।