গান্ধীদর্শনের সার 'হিন্দ-স্বরাজ' : একটি অন্তরঙ্গ পাঠ

কেন পড়বো ‘হিন্দ স্বরাজ’?
গান্ধীজির জীবনদর্শনকে জানতে হলে অবশ্যই পড়তে হবে ‘হিন্দ স্বরাজ’। ১৯০৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসকারী ভারতীয়দের প্রতি ইংরেজ শাসকদের বৈষম্যের প্রতিবাদের কথা জানাতে লন্ডন গিয়েছিলেন গান্ধীজি। ফেরার পথে জাহাজে বসে দ্রুততার সাথে লিখে ফেলেন এই বইটি। মূল লেখাটি ছিল গুজরাতিতে। ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন পত্রিকায় ওই বছরেই প্রকাশ করেন বিষয়বস্তু। ১৯১০ সালে বই আকারে হিন্দ স্বরাজের আত্মপ্রকাশ। ভারতে যখন গুজরাতি সংস্করণ পৌঁছোয় তখন বোম্বে সরকার বাজেয়াপ্ত করেন বইটি। গান্ধীজির কাছে খবর পৌঁছালে তিনি ইংরেজি পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বইটির সারানুবাদ করেন ও প্রকাশ করেন।
দ্রুততার সাথে লেখা হলেও বইটির বিষয়বস্তু গান্ধীজির দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা ভাবনার ফল। ১৯৩৮ সালে অর্থাৎ প্রকাশের প্রায় তিরিশ বছর পর কী ভাবছেন গান্ধীজি হিন্দ স্বরাজ সম্বন্ধে? “I might change the language here and there if I had to rewrite the booklet. But after the stormy thirty years through which I have since passed, I have seen nothing to make me alter the views expounded in it.” তাই হিন্দ স্বরাজকে ‘গান্ধী জীবনবেদ’ বা ‘গান্ধী ম্যানিফেস্টো’ নামে বিভিন্ন সময় সমালোচকরা যে উল্লেখ করেছেন তা যথার্থ।
হিন্দ স্বরাজ পাঠক ও সম্পাদকের (ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন) মধ্যে এক কথোপকথনের আঙ্গিকে লেখা। এতে গান্ধীজির যে চিন্তাভাবনার নিদর্শন মিলেছে তার উৎস নির্দেশ করেছেন প্রথম ইংরেজি সংস্করণে। “Whilst the views expressed in Hind Swaraj are held by me, I have endeavored humbly to follow Tolstoy, Ruskin, Thoreau, Emerson and other writers, besides the masters of Indian Philosophy. Tolstoy has been one of my teachers for a number of years.” বইয়ের পরিশিষ্টতে নির্দেশিত কুড়িটি উত্‍স বইয়ের মধ্যে আঠারোটিই পাশ্চাত্য দার্শনিকদের এবং দুটি ভারতের তত্কালীন অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কিত বই – একটি দাদাভাই নওরোজি ও অপরটি রমেশচন্দ্র দত্তের। বাকিগুলি তলস্তয়, রাসকিন, থেরো প্রমুখ পাশ্চাত্য চিন্তাবিদের যাঁরা আধুনিক তথা যন্ত্রসভ্যতার বিরুদ্ধে তাঁদের মতামত রেখেছিলেন।
কুড়িটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত বইটির মূল বক্তব্য কী? আত্মবিস্মৃতির অবসান ঘটিয়ে আত্মশক্তি জাগরণের আহ্বান।
হিন্দ স্বরাজ বইটি শুরু হচ্ছে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নরমপন্থী রাজনীতিকদের আবেদন নিবেদন নীতির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে। বঙ্গভঙ্গ উত্তর সময়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন যখন চরমপন্থা ও নরমপন্থার বিভেদে দীর্ণ, নরমপন্থীদের কার্যনীতি যখন তীব্র সমালোচিত, সেই পরিস্থিতিকে উপলব্ধি করে গান্ধীজি বলছেন, মতভেদ কখনোই পারস্পরিক সম্মানের হানি ঘটিয়ে হতে পারে না। জাতীয় কংগ্রেস ও নরমপন্থী রাজনীতিকদের হাত ধরে ভারতবাসীর স্বরাজ ভাবনার পথ চলা শুরু তাই তাঁদের প্রতি অসম্মান কখনোই বাঞ্ছনীয় নয়। “It is a bad habit to say that another man’s thoughts are bad and ours only are good and that those holding different views from ours are the enemies of the country.” এক শতকের অধিক সময় পেরিয়েও আজও কি কথাটি সমান প্রাসঙ্গিক নয়?
জাতীয় কংগ্রেস ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষের জন্ম দিয়েছিল কিন্তু এই শাসন থেকে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টা বঙ্গভঙ্গ পরবর্তী সময়েই হয়েছে। এই অসন্তোষের অন্যতম ফলশ্রুতি চরমপন্থার উত্থান। চরমপন্থী ভাবনায় যে কোনো প্রকারে ইংরেজের শাসনযন্ত্র দখলই স্বরাজ। গান্ধীজি এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে জানিয়েছেন, শাসকের পথ যদি শাসনযন্ত্র দখলের হাতিয়ার হয় তবে প্রকৃত স্বরাজ অর্জিত হয় না। “You want tiger’s nature, but not the tiger, …. You would make India English; it will be called not Hindustan but Englistan. That is not the Swaraj I want.” আজ স্বাধীনতার সিকি শতাব্দী বাকী সময়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন জাগে প্রকৃত স্বরাজ কি আমরা পেয়েছি? তাই স্বাধীনতা আমাদের করায়ত্ত হলেও শাসনযন্ত্রের নিষ্পেষণ থেকে কি আমাদের মুক্তি মিলেছে?
আধুনিক সভ্যতা বলতে আমরা বুঝি ক্ষমতাবানের জীবনচর্যা। জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য আর ভোগের প্রাচুর্য এই সভ্যতার সূচক। কিন্তু এই সভ্যতার বিষময় প্রভাব যা আমাদের আরাম স্বাচ্ছন্দ্যর বিনিময়ে নিয়েছে নৈতিকতা, শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্য – তা আমাদের নজরে পড়ে না। আধুনিক সভ্যতাকে তাই গান্ধীজি ভূষিত করেছেন ‘শয়তান’এর আখ্যায়। আজ যখন আমরা চোখে এই সভ্যতার ঠুলি পরে আরাম আর স্বাচ্ছন্দ্যর খোঁজে দিনেদিনে হয়ে চলেছি পরনির্ভরশীল তখন গান্ধীজির সতর্কবার্তা কানে বাজে, “That is not the Swaraj I want.”
পরাধীনতার প্রধান কারণ হিসেবে গান্ধীজি চিহ্নিত করেছেন পরানুকরণকে। যেদিন থেকে শাসকের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা নিজেদের যাচাই করতে শিখেছি সেদিন থেকেই পরাধীনতার শৃঙ্খল আরও দৃঢ় হয়ে উঠেছে আমাদের জীবনে। আইনব্যবসা, চিকিত্‍সা ব্যবস্থার উন্নতি আর রেলওয়ে স্থাপন যা আমাদের চোখে মনে হয় পাশ্চাত্যের আশীর্বাদ সেই বিষয়গুলি দিয়েই দেখিয়েছেন কিভাবে তা ভারতে ইংরেজ শাসনের ভিতকে আরো দৃঢ় করে তুলেছে। আধুনিকতার এই প্রলোভনের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
গান্ধীজি দেখেছেন ভারতের পরাধীনতা যদি একটি রোগ হয় তবে পাশ্চাত্য তথা আধুনিক সভ্যতার প্রতি ভারতবাসীর মোহ তার কারণ। ভারতের প্রাচীন সভ্যতা যা দীর্ঘসময় সত্যের পথে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে পরীক্ষিত তার প্রতি ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতাই পারবে দাসত্বশৃঙ্খল মুক্ত করতে – এনে দেবে স্বরাজ। তাই স্বরাজ শুধুমাত্র শাসনযন্ত্রের হস্তান্তর নয় বরং নিজেকে শাসন করার শিক্ষা অর্জন, নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী নির্মাণ।
আধুনিকতাকে যদি আমরা সভ্যতা না বলি তবে প্রকৃত সভ্যতার সংজ্ঞা কী? গান্ধীজি বলছেন, সভ্যতা শব্দের মধ্যেই রযেছে এর খোঁজ – সভ্যতা অর্থ ভাল ব্যবহার। সভ্যতাকে আমাদের অন্যভাবে ভাবা উচিত। সভ্যতার পরিমাপ হওয়া উচিত কর্তব্য সম্পাদন আর নীতির প্রতি দায়বদ্ধতা দিয়ে। সভ্য তাকেই বলব যে তার মনের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারে।
গান্ধীজির ইংল্যান্ডে থাকাকালীন সময়ে মদনলাল ধিংড়া হত্যা করেন কার্জন উইলিকে। পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগে শাসকের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী সশস্ত্র উত্থানই কি তবে ভারতের মুক্তির উপায়? সম্পাদকের কলমে গান্ধীজি উত্তর দিয়েছেন – “What is granted under fear can be retained only so long as the fear lasts.” আর যদি ইওরোপীয়দের সঙ্গে সশস্ত্র লড়াই করতে হয় তবে তা ঘোরা পথে ইওরোপীয় সভ্যতার কাছে নতিস্বীকার ভিন্ন কিছু নয় যা স্বরাজের পরিপন্থী।
আসলে আমরা প্রায়শই লক্ষ্য নিয়ে ভাবি, পথ নিয়ে নয়। ১৮৩৩ সালে হিংসার মাধ্যমে ইংল্যান্ডে ভোটাধিকার প্রাপ্তির প্রসঙ্গকে সামনে রেখে গান্ধীজি দেখিয়েছেন যে ইংল্যান্ডে মানুষ তার অধিকার বুঝে নিতে চেয়েছে কিন্তু কর্তব্য পালনের বিষয়টি থেকে গেছে অবহেলিত। তাই যেখানে সকলে কেবল অধিকার চায় কিন্তু কর্তব্য পালন করে না সেখানে কে দেবে তাদের অধিকার? প্রকৃত অধিকারের জন্ম হয় কর্তব্য পালনে। তাই সময় বয়ে যায় কিন্তু চিত্র কিছুই বদলায় না। আজকের ভারতের ছবি কি এর থেকে খুব আলাদা?
তবে মুক্তির উপায়? গান্ধীজি বলছেন ‘আত্মশক্তির জাগরণ’। ইতিহাসে আত্মশক্তির কথা লেখা থাকে না – লেখা থাকে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের কথা। আত্মশক্তির হানি হলেই মানুষের মধ্যে দেখা যায় ভালোবাসার ঘাটতি, জাগরণ হয় হিংসার – সশস্ত্র সংগ্রামের। আত্মবল অন্যায়ের বিরুদ্ধে সর্বোত্তম প্রতিরোধী বল কারণ অন্যায়ীর সামনে প্রতিস্পর্ধায় আত্মবলে বলীয়ান মানুষই বলতে পারেন –
ঐ যে তোমার চোখ রাঙানো
খোকাবাবুর ঘুম ভাঙানো
ভয় না পেলে ভয় দেখাবে কাকে?
যিনি সত্যকে ঈশ্বর বলে জানেন তিনিই যাবতীয় অন্যায়কে প্রতিরোধ করতে পারেন নিজের জীবনের বিনিময়ে।
শক্ত যা তাই সাধতে হবে, মাথা তুলে রইব ভবে –
সহজ পথে চলব ভেবে পড়ব না, পাঁকের পরে পডব না।
ধর্ম আমার মাথায় রেখে চলব সিধে রাস্তা দেখে
বিপদ যদি এসে পড়ে সরব না, ঘরের কোণে সরব না।
আমি ভয় করব না ভয় করব না।
প্রকৃতপক্ষে এই প্রতিরোধ যাকে গান্ধীজি বলেছেন Passive Resistance যাকে পরবর্তী সময়ে অভিহিত করবেন ‘সত্যাগ্রহ’ নামে তা প্রকৃতপক্ষে একটি জীবনচর্যা। সংযমের উপর স্থিত এই চর্যা যা মানুষকে সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ করে, শেখায় বিচার বিবেকের মাধ্যমে যাচাই করে নিতে সবকিছুকে। তাই স্বরাজের জন্য যে সংগ্রাম তা গান্ধীজির দৃষ্টিতে উত্তীর্ণ হয়েছে ব্যক্তির জীবনচর্যায় – নিবৃত্তিমার্গের এক সাধনায়।
পরবর্তী প্রসঙ্গে এসেছে শিক্ষার কথা। গান্ধীজির মতে ইচ্ছাশক্তিকে সৎপথে চালনা, পারস্পরিক সম্মানবোধ আর প্রকৃতির সাথে সহাবস্থান – এগুলিই হওয়া উচিত শিক্ষার লক্ষ্য। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান এর বিপরীত পথেই আমাদের চালনা করে। এই বিপদ থেকে বাঁচাতে পারে নীতি ও ধর্মীয় শিক্ষা – যার উপর গান্ধীজি জোর দিয়েছেন। এর সাথে এসেছে ভাষা শিক্ষার প্রসঙ্গ। দেশের সর্বত্র ইংরেজি ভাষার ব্যবহার, প্রধানত ভারতীয় শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে, ইংরেজ শাসনের ভিত্তি আরও দৃঢ় করেছে। মেকলের উদ্দেশ্য হযেছে সফল। তাই গান্ধীজি জোর দিয়েছেন ভারতের এক সার্বজনীন ভাষা প্রচলনের। তাঁর মতে হিন্দী হতে পারে এমন এক ভাষা যাকে নাগরী ও পার্সি উভয় লিপিতেই লেখা যাবে আর তা হবে হিন্দু মুসলমানের সমন্বয়ের প্রতীক।
আধুনিক সভ্যতার বাহন যন্ত্র। পাশ্চাত্যের অনুকরণে স্থাপিত বিদ্যুৎ চালিত যন্ত্র ভারতের অগণিত হস্তশিল্পকে বিনষ্ট করেছে, কর্মহীন হযেছেন বহু মানুষ। কারখানাগুলি পুঁজিপতিদের আরও সম্পদ বৃদ্ধি করেছে আর ভারতের অগণিত সাধারণ মানুষের ভাগ্যকে করেছে বিড়ম্বিত। ব্রিটিশ শাসনের এ অন্যতম ফলশ্রুতি। শুধু পুঁজির কেন্দ্রীকরণ নয়, যন্ত্রের এগিয়ে চলা গ্রাস করছে প্রকৃতিকে আর মানুষের জীবনকে যান্ত্রিকতায় পর্যবসিত করেছে। তাই গান্ধীজির আহ্বান যন্ত্রের প্রতি উন্মাদনা পরিত্যাগ করার; তবেই সার্থক হবে স্বরাজ।
শাসনতন্ত্রের নাম বদল হয় কিন্তু শাসকের প্রকৃতি বদলায় না। তাই শাসকের প্রতি গান্ধীজির সতর্কবার্তা “….but although you are the rulers, you will have to remain as servants of the people. It is not we who have to do as you wish, but it is you who have to do as we wish.” চিরপ্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবে। আবার শাসকের অন্যায়ের প্রতিরোধে গান্ধীজি যে পালনীয় আচরণবিধি উপস্থাপন করেছেন তা কিভাবে জনগণ অনুসরণ করবে? উত্তরে গান্ধীজি জানিয়েছেন নিজের কর্তব্য পালনই একমাত্র জনসেবা। “You and I have nothing to do with others. Let each do his duty. If I do my duty, that is, serve myself, I shall be able to serve others.” আজ আমরা বড় বেশি সশব্দ। বহির্মুখিনতা আমাদের প্রাণহীন করে তুলেছে। তাই আজ বড় বেশি প্রয়োজন গান্ধীজির ‘হিন্দ স্বরাজ’।