সমরেশ বসুর জগদ্দল : পুঁজির গ্রাসে বিপর্যস্ত জীবন ও জীবিকার জলছবি

"ভারতের অাধুনিক শিল্পের মধ্যে চটকল সর্বাপেক্ষা প্রাচীন বললে অত্যুক্তি হবে না।তাকে কেন্দ্র করে অনেক মানুষের কথা,সমাজের কথা বলাই উদ্দেশ্য। সে মানুষ নিরন্তর গতিশীল।পরিবর্তনের ধারায় নানান পরিণতি; অর্থনৈতিক রাজনৈতিক এবং সব শেষে মানুষেরই দিকচিহ্ণগুলি চেনার চেষ্টা করা"
"জগদ্দল" এর ভূমিকায় এমন দাবি সমরেশ  নিজেই করেছিলেন। প্রথম উপন্যাস "উত্তরঙ্গে" চিত্রিত হয়েছিল যন্ত্র সভ্যতার দাপটে ধ্বংস হয়ে যাওয়া গোষ্ঠী জীবনের করুণ কাহিনি।  কৃষক,তাঁতি,হস্তশিল্পী জাত ব্যবসা ছেড়ে  যৌথ জীবনের রুচি সংস্কৃতি জলাঞ্জলি  দিয়ে  কিভাবে চটকের শ্রমিকে রূপান্তর হতে বাধ্য হয়েছিল তার সামগ্রিক ছবি হল "উত্তরঙ্গ"। এর জের টেনে শুরু হয় "জগদ্দল"।  "উত্তরঙ্গে"র কাহিনি যেখানে শেষ হয়েছিল সেখানেই 'জগদ্দল'এর কাহিনির সূত্রপাত।চরিত্ররা এক।দু-একটি চরিত্র নতুন আগমন ঘটেছে।
     বই আকারে প্রকাশিত হওয়ার আগে, ১৩৭৩ সালে "বিংশ শতাব্দী" পত্রিকার পূজো সংখ্যায়   "জগদ্দলে"র কাহিনীর সংক্ষিপ্ত রূপ " কালের লিখনে একদিন" নামে প্রকাশিত হয়।তারও আগে ১৩৬৪র সালের বৈশাখ সংখ্যা থেকে  "বিংশ শতাব্দী" প্রত্রিকায় 'জগদ্দল ' ধারাবাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়। 
    শিল্প বিপ্লবের পর বনিক ইংরেজ ভারতীয় কাঁচামাল এবং সস্তার শ্রমকে কাজে লাগিয়ে গঙ্গার দুই পাড়ের গ্রামীণ জনজীবন এবং জীবিকাকে ধ্বংস করে পুঁজির বিকাশ সাধনে তৎপর হয়।প্রকৃত পক্ষে এপারের জগদ্দল, আতপুর ওপারের চন্দননগরের  গোঁদল পাড়া অর্থাৎ ভাগীরথীর দুই তীরে  চটকল প্রতিষ্ঠার বাস্তব ঘটনা এবং এই অঞ্চলের মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে তার প্রভাব বিশ্লেষণ করে লেখক ঔপনিবেশিক শিল্প বিস্তারের ছবি ইতিহাস সম্মতভাবে উপস্থিত করেছেন এই উপন্যাসে।
              উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের শুরু থেকেই  উপন্যাসের কাহিনির   সূত্রপাত।সমকালীন অবিভক্ত বাংলার ইতিহাস তথা চটকল তৈরির ঐতিহাসিক তথ্য এবং গ্রামীন জনগোষ্ঠীর জীবন সত্যের দ্বান্দ্বিকতায় গড়ে উঠেছে জগদ্দলের কাহিনির মেরুদণ্ড। চটকল এখানে কাহিনির কাঠামো নির্মাণে কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছে মাত্র।এই কাঠামোর গায়ে মানুষের বিচিত্র জীবনকথার  প্রলেপ দেওয়া হয়েছে ।তাই শেষমেশ "জগদ্দল" হয়ে উঠেছে " অনেক মানুষের কথা, সমাজের কথা।"
 
    বনিকতন্ত্রের শোষণ ও সংস্কৃতি  এদেশের  যূথবদ্ধ গ্রামীণ জনজীবন  আমূল পাল্টে দিয়েছিল। ভেঙে পড়া গ্রামের মধ্যে জেগে উঠছে কারখানা।চারাপাশে ছড়িয়ে আছে খেত খামার। লেখকের ভাষায় --" গারুলিয়ার গ্রাম জাগছে।এখনও গ্রাম।ছন্নছাড়া ভাঙা ভাঙা।গ্রাম নয়,তবু গ্রাম। চারপাশে খেত খামার। মধ্যখানে খারখানা।যন্ত্রের শোঁশোঁ আওয়াজ,আর মাঠে লাঙল টানা বদলের ফোঁস ফোঁস শব্দ।" বিদেশি মুনাফাখোরদের সর্বগ্রাসী লোভের স্বীকার হয়েছে কৃষিভিত্তিক গ্রামীন সমাজ।গ্রাম সংস্কৃতি চুরমার হয়েছে।তার অর্থনৈতিক ভিতটিকে দুর্বল করে দিয়েছে।একই সঙ্গে ধ্বংস করা হয়েছে তার আন্তরিক বিশ্বাস এবং জীবনদর্শনের ভিত্তিভূমিকে।বর্তমান সময়েও আমাদের দেশের এই ছবি বিন্দুমাত্র পাল্টায় নি।আজও করপোরেট পুঁজি থাবা বসাচ্ছে মানুষের কৌম জীবনে।চিরায়ত জীবন থেকে মানুষকে উৎখাত করে দখল করে নেওয়া  হচ্ছে জল জঙ্গল জমি।প্রথাগত জীবন চর্চা এবং চর্যা হারিয়ে মানুষ শিল্পনগরীর আনাচে-কানাচে শুধুমাত্র টিকে থাকার জন্য আপ্রাণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।যূথবদ্ধ  গ্রামীণ জীবন থেকে উৎখাত হওয়া মানুষকে শিল্পনগরী সমাজ যে সুষ্ঠু পুনর্বাসন দিয়ে পরিচ্ছন্ন কোনো জীবন দর্শন সৃষ্টি করতে যে পারেনি সমরেশ তা নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখেছেন।কারখানার মজুরপল্লীর নিখুঁত বর্ণনায় এই ছবি ফুটে উঠেছে।আর্থ-সামাজিক শোষণ নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় গ্রামের কৃষক,কামার,কুমোর, তাঁতি চটকলের মুক্ত জীবনে পা বাড়িয়ে ছিল।কিন্তু গ্রাম জীবনে ফেলে আসা ভাঙা সংসার,ভাঙা সমাজ তারা আর ফিরে পাইনি।একদা কৃষক বৃদ্ধ নারান আজ মজুরপল্লীর বাসিন্দা। সে উপলব্ধি করেছে"এ যুগে তাদের মত মানুষের আর সংসার পাতা সম্ভব নয়।" এখানে গ্রামীণ সমাজ- সংস্কার- বন্ধন সব এলোমেলো হয়ে গেছে।" ডাকাতে বিমলির রংখানায়" যে সমস্ত মজুরনীরা থাকে তারা সারাদিন কারখানায় কাজ করার পরে রাতের বেলায় দেহ ব্যবসায় নেমে পড়ে। স্বামীর অত্যাচার নীরবে সহ্য করা গাঁয়ের কাঠুরে বউ মজুর  বারবার ধর্ষিত হতে হতে নির্বিকার চিত্তে কারখানার বৃদ্ধ মজুর ত্রিলোচনকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে বাধ্য হয়।গোটা উপন্যাস জুড়ে এরকম অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যায় যেখানে গ্রামের মানুষ পুরনো সামাজিক সংস্কার বিসর্জন দিয়ে মজুর পল্লীর  পরিবর্তিত জীবন ধারায় গা ভাসাতে বাধ্য হয়েছে।গ্রামজীবনের কৃষিভিত্তিক জীবনবোধ হারিয়ে, নিজস্ব পরিচিতকে বিসর্জন দিয়ে মজুরপল্লীর ধ্বস্ত জীবন মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।গ্রামের স্বাধীন জীবন হারিয়ে, পরিচিত খুঁইয়ে দৈনিক মজুরে পরিণত হওয়ার করুণ কাহিনি আজও বহমান।নারানরা আজও মজুরপল্লীর অন্ধকার ঘুপচি ঘরে শুয়ে  জীবনে ফিরে যেতে না পারার জন্য আপশোস করে।
 
 
    যন্ত্রশিল্পের বিকাশের ফলে  উনিশ শতকের গ্রামীণ মানুষের আর্থ-সামাজিক জীবনে বড়োসড়ো পরিবর্তন ঘটে যায়।নতুন খাজনা আইনের বোঝা কাঁধে নিয়ে ঝু্ঁকিপূর্ণ,অনিশ্চয়তায়ভরা চাষের কাজ করে বাংলার কৃষকের জীবন ধারণ দূর্বিষহ হয়ে ওঠে-" ধানে খাজনা মেটে না,বাবুরা কাঁচা পয়সা চায়।সে পয়সার হিসাব বোঝা দায়।খোঁজ নিতে হলে বারাসতের যম-- ঘুঘুদের কোর্ট- কারখানায় যেতে হয়।" কৃষক নিপীড়নের সেই ট্রেডিশন সমানে চলেছে।একবিংশ শতাব্দীতেও কৃষকের দুরবস্থার সেই ছবিটি বিন্দুমাত্র পাল্টায় নি। তাই আজও "বাংলার লক্ষ গ্রাম আলোহীনতায় ডুবে  নিস্তেজ,নিস্তেল"।এই অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতার জন্য সেকালে একদল মানুষ কৃষিকাজ বা জাত ব্যবসা ছেড়ে কারখানার পথে পা বাড়িয়েছে -- " ছেড়েছে, তারা মাঠের জীবনের মায়া।সেদিকে তাদের কোনো টান নেই,মায়া নেই।যন্ত্র তার বিচিত্র কৌশল ও কৃতিত্ব নিয়ে তাদের ডাক দিয়েছে।" " মাঠের জীবনের মায়া " ত্যাগ করে শিল্প মজুরের জীবনে যাত্রার যে সূচনা শরৎচন্দ্রের গফুর করেছিল তারই উত্তরসূরী "জগদ্দল" এর মধু,শ্যাম বাগদীর ছেলে।তবে গফুরের মত মধু ভূমি থেকে উচ্ছিন্ন নয়; সে গতির প্রতি তীব্র নেশার টানেই কারখানার মিস্ত্রী হতে চায়।গ্রামের  মাটির কুটিরে নীড় বাঁধার স্বপ্ন সে দেখে না।" তার পাকা ঘরের মেঝেয়,মোহ আলতা পায়ে ঘুরে বেড়াবে।তাই সে দেখতে চায়"।
      বিট্রিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবে বাংলাদেশের সমাজ জীবন এবং ব্যক্তি মানুষের অবস্থান পাল্টে যাওয়ার বাস্তব  ছবিকে সমরেশ এই উপন্যাসে ধরতে চেয়েছেন।মূলত যন্ত্রযুগের সূচনা পর্বে দাঁড়িয়ে গ্রামীন সমাজের ভাঙনের ছবি এবং নতুন ধরনের সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টির কাহিনি হল 'জগদ্দল'।