কমলকুমার মজুমদার সম্পর্কে শুরুর দু একটি কথা

যেহেতু অন্যস্বরের জন্য লিখছি, সেহেতু এই পত্রিকার ফেসবুক পেজের ট্যাগলাইনটা বেশ ভাবালো -তৃতীয় বিশ্বের মার্কসবাদ। তো কমলকুমার কেন?

কমলকুমার মজুমদার, যিনি কি না ‘মাসে’র জন্য কোনোদিন লেখেন নি, ‘ক্লাসে’র জন্য লিখেছেন, ব্রাহ্মণ্য, এলিটিজমের আস্ফালন করেছেন? দুর্বোধ্যতার আড়ালে সেই এলিটিজম সংরক্ষণ করেছেন? অন্তত তাঁর লেখালেখি সম্পর্কে অভিযোগ তো এগুলোই। আজ লিখতে বসে এই প্রবন্ধের অদেখা পাঠকদের এই সম্ভাব্য প্রশ্নগুলো মাথায় এল, একটা থিসিসের পরিসরে যার উত্তর খোঁজা সম্ভব নয়। এই দীর্ঘ প্রবন্ধে ভাগে ভাগে তাঁর সাহিত্যের সঙ্গে জীবনকে মিলিয়ে পড়ার একটা চেষ্টা করব। উক্ত অভিযোগগুলোর সঙ্গে নৈর্ব্যক্তিকভাবে চিন্তা করতে চাইব, সেকালের আর এক মার্কসপন্থী পত্রিকা এক্ষণ কেন তাঁর লেখাগুলোকে পরমাদরে ছাপিয়ে যাচ্ছিল। পাঠক এবং সময় সহযোগিতা করলে আশা করছি, রহস্যময় এই লেখক সম্পর্কে জটিল ধাঁধাঁগুলোর সমাধান করতে পারব।

           আপাতত, খুব প্রাথমিকভাবে কমলকুমার মজুমদারের জীবন এবং লেখালেখি সম্পর্কে পাঠককে পরিচয় করাব। আমার ধারণা, অনেকেই তাঁর জীবন সম্পর্কে নানা গল্প শুনেছেন, কিন্তু তাঁর লেখাকে সভয়ে এড়িয়ে গেছেন। তাঁর লেখা একে তো দুর্বোধ্য, তার উপর নিজেই নিজের সম্পর্কে হাজারো রটনা রটিয়ে, মজা করে, ঠাট্টা করে, খালাসিটোলা ইত্যাদি জড়িয়ে এমন এক মিথিকাল বলয় তৈরি করেছেন নিজের চারপাশে, সমকালীন লেখক-পাঠকেরা তাতে তাঁকে সমীহ বা অন্ধ ভক্তি ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেন নি, নয়তো যুক্তিহীন সমালোচনা করেছেন। সেইসব সরিয়ে আসুন তাঁর জীবন ও সাহিত্যকে একটু পড়বার চেষ্টা করি।

১৯১৪ সালে ১৭ নভেম্বর তারিখে কমলকুমার মজুমদারের জন্ম কলকাতার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বাবা প্রফুল্লচন্দ্র মজুমদার, মা রেণুকাময়ী। তিনি প্রথম সন্তান, বাকি ভাই বোনেদের মধ্যে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নীরদ মজুমদার ও শানু লাহিড়ি, আর এক বোন বাণী চৌধুরী ছিলেন সেকালের প্রতিষ্ঠিত নৃত্যশিল্পী। উত্তর চব্বিশ পরগণার টাকিতে এই পরিবারের আদিনিবাস।

            প্রথমে বিষ্টুপুর শিক্ষাসংঘ ও পরে কলকাতার ক্যাথিড্রাল মিশনারি স্কুলে তাঁর ছাত্রজীবন শুরু হয়। কিন্তু পরে কমলকুমার ও নীরদ ভবানীপুরে সংস্কৃত টোলে ভর্তি হন। ব্লকমন স্ট্রিটে থাকাকালীন একই বাড়িতে সিন্ধুবালা দেবীর কাছে আসতেন অনুরূপা দেবী, নিরুপমা দেবী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দিলীপকুমার রায় প্রমুখ সাহিত্যিক। এই সময় তিনি তাঁদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পান। শিখতে থাকেন সেতার ও ফরাসি ভাষা।

              কমলকুমারের জীবনে বাসাবদলের বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কখনো কাজের সূত্রে,কখনো অর্থকষ্টে কখনো বা শুধু ভালো লাগছে না বলে অজস্র বার ঠিকানা বদল করেছেন তিনি। কখনো কখনো তিনি কাউকে ঠিকানাই জানাতেন না- সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাক্ষ্য থেকে তা জানা যায়। ১৯৩৪ সালে মুঙ্গের ভূমিকম্পের সময়ে তিনি রিলিফ দলের সঙ্গে যান, সেখান থেকে লক্ষ্‌নৌ আর মূলতান। লক্ষনৌতে মামার বাড়িতে ছিলেন প্রায় এক বছর। এরপর রাজশাহীতে যান খেতুরির মেলা দেখতে।

                 কমলকুমারের সাহিত্যচর্চার প্রথম প্রামাণ্য নিদর্শন উষ্ণীষ পত্রিকা। ভবানীপুরের বাড়িতে চার বন্ধু- বরেন্দ্রনাথ বসু, নীরদ ও কমল মজুমদার আর নরেন্দ্রনাথ মল্লিক বনীকন নামে এক সাহিত্যগোষ্ঠী তৈরি করেন, তাঁরাই প্রকাশ করেন উষ্ণীষ। এই পত্রিকার প্রথম সংখ্যা বেরোয় ১৩৪৪ বাংলা সনের ভাদ্র মাসে। এই বন্ধুগোষ্ঠীর তরফে শরৎচন্দ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়, যা কমলকুমারের লেখনীতে এই সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকার তিনটে সংখ্যা বেরিয়েছিল। কমলকুমারের প্রথম দিকের গল্পগুলো উষ্ণীষেই প্রকাশিত হয়েছিল- লাল জুতো, প্রিন্‌সেস আর মধু।১৯৩৯-এআবার বাসাবদল, চলে আসেন সীতারাম রোডে। দুই ভাই মিলে নাচ, গান, ছবি আঁকার স্কুল খোলেন, কিন্তু সেটি বেশিদিন চলেনি। এরপরে বিভিন্ন আড্ডায় তাঁর যাতায়াত শুরু হয়, পরিচয় হয় কবি বিষ্ণু দে’র সঙ্গে।

১৯৪৩-৪৪ সাল নাগাদ জাপানি বোমার ভয়ে সপরিবারে রিখিয়া যাত্রা করেন কমলকুমার। তাঁর সাহিত্যজীবনের ক্ষেত্রে এই ঘটনাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। যত বারই বাসা বদল করুন, রিখিয়ার প্রাকৃতিক পরিবেশ তাঁর স্মৃতিতে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে। তাঁর গল্পে-উপন্যাসে রিখিয়ার কথা। অনুষঙ্গ এসেছে, রিখিয়ার পাখির ডাক রূপকাকারে এসেছে পিঞ্জরে বসিয়া শুক উপন্যাসে। তবে আর্থিক টানাটানির জন্য তাঁকে কলকাতায় ফিরে আসতে হয় জীবিকার খোঁজে। মহীশূর রোডে একা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন।

                    কমলকুমার কখনোই নির্জনবাসী সাহিত্যিক ছিলেন না। আমাদের মনে রাখতে হবে, দুর্বোধ্যতার প্রাচীর গড়ে তিনি যতই আম পাঠকের সঙ্গে নিজের দূরত্ব বজায় রাখুন না কেন, মুঙ্গের-ভূমিকম্পে আর্ত মানুষের জন্য রিলিফ নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে কলকাতার দাঙ্গাদুর্গতদের সাহায্যেও তিনি হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। মহীশূর রোডের বাড়িতে থাকাকালীন ১৯৪৬-এর দাঙ্গায় যে সকল মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছিলেন, সীমিত সাধ্যের মধ্যে তিনি তাঁদের সহায়তা করেছিলেন। এই বছরে অবশ্য তিনি কিছু ব্যবসায়ে উপার্জন করা শুরু করেন। ডিডিটি, মাছের ভেড়ি, জাহাজের আমদানি-রফতানির কাজে তিনি বেশ কিছু রোজগার করেছিলেন। এই সময়ে তাঁর জীবনে বিলাসিতা শুরু হয়, সাহেবি পোষাক, বিলিতি আদবকায়দা রপ্ত করেন। বিশেষ আকর্ষণ ছিল ফরাসি সুগন্ধির প্রতি, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত-র লেখা থেকে সেই কথা জানা যায়। স্বাধীনতার বছরে বিবাহ করেন দয়াময়ী রায়কে, ১৯৪৮-এর বছরটির শুরুতে প্রথমে রিখিয়ায় সস্ত্রীক বাস করেছিলেন। তারপর সংসার উঠে আসে কলকাতার আনন্দ পালিত লেনে।

                      এই বছরটিতে কমলকুমারের জীবনে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। চলচ্চিত্র পরিচালক রেনোয়াঁ কলকাতায় দ্য রিভার ছবির শ্যুটিং-এর জন্য আসেন। সত্যজিৎ রায় এবং কমলকুমারের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। কমলকুমার লোকেশন দেখার কাজে রেনোয়াঁকে সাহায্য করেন। রেনোয়াঁ তাঁকে স্নেহ করতেন, ডাকতেন ‘কোমাল’ বলে। এই সময়ে ফ্রি ল্যান্সিং ছাড়া তাঁর বিশেষ উপার্জন ছিল না। সচিত্র ভারত পত্রিকায় বেশ কিছু লেখা লেখেন এই সময়ে।

                      উষ্ণীষ পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাবার পর বিজ্ঞাপনী লেখা, টুকটাক বাজারচলতি লেখা ছাড়া কমলকুমারকে দীর্ঘ এক দশক সাহিত্যে পাওয়া যায় না। বরং তিনি উৎসাহী ছিলেন সিনেমায়। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে এই সময়ে। ১৯৪৯ সাল নাগাদ শরৎচন্দ্রের অভাগীর স্বর্গ এবং রবীন্দ্রনাথের দেবতার গ্রাস-এর চলচ্চিত্রায়ণের জন্য বেশ কিছু স্কেচ করেন বলে জানা যায়। তবে সে পরিকল্পনা বাতিল হয় এবং স্কেচগুলিও আর পাওয়া যায় না। এরপর তাঁকে আবার লেখালেখিতে ফিরে আসতে দেখা যায়। ঐ বছরের মাঝামাঝিসাহিত্যপত্র পত্রিকায় তাঁর জল গল্পটি প্রকাশিত হয়।

                  আবারো বাসাবদল, উঠে আসেন গ্রে স্ট্রিটের ভাড়াবাড়িতে। সিগনেট প্রেসের সঙ্গে যুক্ত হন এই সময়ে, পরিচয় হয় ডি কে বা দিলীপকুমার গুপ্ত-র সঙ্গে। ডি কে-র সঙ্গে আলাপ তাঁর জীবনের মোড়-ঘোরানো আর এক ঘটনা। অনেক অনেক আড্ডার গল্প জড়িয়ে আছে এই সূত্রে।

                   ১৯৫০-এ চিদানন্দ দাশগুপ্ত, সত্যজিৎ রায় ও সুভাষ রায়ের সঙ্গে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তাঁর চলচ্চিত্রে গানের ব্যবহার প্রবন্ধটি এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সচিত্র ভারত পত্রিকায় বের হয় আত্মহত্যা গল্প। পরের বছরই ঐ পত্রিকায় প্রতিমা পয়জার নামে একটি লেখা বেরোয় এবং চতুরঙ্গ পত্রিকায় বেরোয় ব্যতিক্রমী মল্লিকা বাহার গল্পটি। ভারত সরকারের অধীনে জনগণনা বিভাগে আই এ এস অশোক মিত্রের অধীনে তিনি কাজ করতে থাকেন এই সময়ে। এই সুবাদে গ্রামবাংলার সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ পরিচয় হয়, লোকভাষা, সাঁওতাল-মুন্ডারি ভাষা, লোকশিল্প- যেমন ডোকরা, টেরাকোটা, বাংলার মন্দিরস্থাপত্য, লোকসঙ্গীত ইত্যাদি বিষয়ে দলিলের মতো লিখে রাখতে থাকেন খাতায়। পরে তাঁর শিল্পবিষয়ক প্রবন্ধগুলিতে এইগুলি উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হয়, শবরীমঙ্গল উপন্যাসে পাওয়া যায় মুন্ডারি ভাষার শব্দ ও সংস্কৃতি।

১৯৫২ সালে কমলকুমার তদন্ত পত্রিকার সম্পাদনার কাজে হাত দেন, এই পত্রিকার ১৪টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। এই বছরেই যুক্ত হন West Bengal Rural Arts and Crafts ও ললিত কলা একাডেমির সঙ্গে। ১৯৫৩-র উল্লেখযোগ্য ঘটনা হরবোলা নাট্যদলের জন্য লক্ষ্মণের শক্তিশেল নাটকের পরিচালনা, পরিচয় ও হৃদ্যতা হয় হরবোলার প্রতিষ্ঠাতা দিলীপকুমার গুপ্ত-র সঙ্গে। এই প্রসঙ্গে পরের বছরের শুরুতে তাঁর পরিচালনায় মুক্তধারা নাটকের অভিনয়ের কথা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ঈশ্বর গুপ্তঃ ছড়া ও ছবি সংকলনটিও এই সময়ে কাহিনী থেকে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৫-তে চিত্রকলার শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন সাউথ পয়েন্ট স্কুলে, ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৭-র মধ্যে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় অবনীন্দ্রনাথের শেষের কাজ, মতিলাল পাদরীতাহাদের কথা

                                                          ১৯৫৯ সালের নহবৎ শারদ সংখ্যায় বাংলা কথাসাহিত্যের যুগান্তকারী ঘটনাটি ঘটে, প্রকাশিত হয় অন্তর্জলী যাত্রা উপন্যাস। বাংলা সাহিত্য পায় আঙ্গিক ও গদ্যনিরীক্ষার নবতর ধারা। এছাড়া ঐ বছরেই পরিচয় পত্রিকায় কয়েদখানা গল্পটি প্রকাশিত হয়।পরের বছর বেরোয় নিম অন্নপূর্ণা (বক্তব্য) ও ফৌজ-ই বন্দুক(কৃত্তিবাস)। এই সময়ে স্কুলে পড়ানো ও লেখালেখির পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের নাট্যশিক্ষাও দিয়েছেন।

                    ১৯৬১সালে এক্ষণে বেরোয় গোলাপসুন্দরী, জনসেবক পত্রিকায় লিখতে থাকেন ধারাবাহিক ফিচার রোজনামা, বই আকারে কথাশিল্প থেকে বেরোয় অন্তর্জলীযাত্রা।১৯৫২ থেকে ১৯৬১-র মধ্যে তিনবার বাড়ি বদল করেছেন।শান্তিপ্রসাদ চৌধুরীর সঙ্গে যুগ্মভাবে ডাকাতের হাতে বুলু সিনেমার চিত্রনাট্য লেখেন ১৯৬১-তে। পরের বছর বাংলার টেরাকোটার উপর দুটি ও বাংলারসাধক নামে একটি তথ্যচিত্রের চিত্রনাট্য রচনা ও পরিচালনা করেন, শুরু করেন আলিবাবা নাটকের মহড়া। মার্কিন কবি এলেন গিন্সবার্গের সঙ্গে সখ্য তৈরি হয় এই সময়ে।

গল্পসংকলন হিসাবে নিম অন্নপূর্ণা ও ছড়ার সংকলন আইকম বাইকম প্রকাশিত হয় (কথাশিল্প) ১৯৬৩ সালে। সুন্দরম পত্রিকায় প্রকাশ পায় ঢোকরা কামার প্রবন্ধ। ১৯৬৪-র দর্পণ শারদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় অনিলাস্মরণে, এক্ষণে বেরোয় শ্যামনৌকা। এই বছরেই মঞ্চস্থ হয় তাঁর পরিচালনায় নাটক আলমগীর। অক্টোবর মাসে মঞ্চস্থ করেন এম্পারার জোন্স।পরের বছর প্রকাশিত হয় সুহাসিনীর পমেটম(কৃত্তিবাস),পানকৌড়ি(সুবর্ণরেখা) ও বাংলার মৃৎশিল্প(সমকালীন)।এই বছরেই সহকর্মী আনন্দমোহন ঘোষের সঙ্গে যুগ্মভাবে ত্রৈমাসিক অঙ্কভাবনা পত্রিকার প্রকাশ।একই বছরে বিচিত্র বিষয়ে ও মাধ্যমে সফল কৃতিত্বের এমন অধিকার দুর্লভ।

                ১৯৬৬-তে দর্পণ পত্রিকায় বেরোয় পরিপ্রেক্ষিত প্রবন্ধ।এই বছর সস্ত্রীক দুবরাজপুর ভ্রমণ করেন, স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে মহিষাদল যান শিক্ষামূলক ভ্রমণে। ১৯৬৭ -তে দেশ পত্রিকার শিল্প-সমালোচকের কাজটি হারান। ভগিনীপতি হীরেন্দ্রনাথ চৌধুরীর মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েন, এই বছরে তাঁর হাঁপানি রোগ ধরা পড়ে। ১৪ জুলাই নিউ এম্পায়ারে অভিনীত হয় তাঁর নির্দেশিত এম্পারার জোনস। অক্টোবরেমঞ্চস্থ হয় লক্ষ্মণের শক্তিশেলরামায়ণগাথা। এক্ষণে রকাশিত হয় বঙ্গীয় শিল্পধারা

১৯৬৮-তে পুনরায় মঞ্চস্থ হয় এম্পারার জোনস। এই বছর তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়। অন্বীক্ষণ শারদ সংখ্যায় কঙ্কালেরটংকার এবং এক্ষণ শারদ সংখ্যায় রুক্মিণীকুমার গল্প প্রকাশিত হয়। ১৯৬৯-এর প্রকাশিত রচনাগুলি হল বাংলার টেরাকোটা (উত্তরকাল), পিঞ্জরে বসিয়া শুক(এক্ষণ)।

১৯৭০-এর উল্লেখযোগ্য ঘটনা নাতালি সারোতের সঙ্গে যোগাযোগ।  কলামন্দিরে এম্পারার জোনস অভিনীত হয় অক্টোবর মাসে। ডিসেম্বর মাসে হাজরা রোডের বাড়িতে উঠে আসেন, মৃত্যু পর্যন্ত এই বাড়িতেই বসবাস করেছেন।

১৯৭১ সালে দর্পণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় পূর্ব্ববঙ্গ সংগ্রাম বিষয়ে। নিষাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় নাতুরালিসম, পদক্ষেপ পত্রিকায় মার্সেল প্রুস্ত বিষয়েকিছু। সুব্রত চক্রবর্তীর কবিতা নিয়ে আলোচনা করেন এক্ষণ পত্রিকার শারদ সংখ্যায়। এই বছরের শেষে মা রেণুকাময়ীর মৃত্যু হয়।

             ১৯৭২ সালে কৃত্তিবাস পত্রিকার দুটি সংখ্যায় লুপ্ত পূজাবিধিফাৎনামনস্কতা প্রকাশিত হয়। এপ্রিলে একাডেমি অফ ফাইন আর্টসে ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী মেলায় গত পঁচিশ বছরের বাংলা সাহিত্য শীর্ষক আলোচনায় অংশ নেন। বস্তির ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, নাচ, গান, আবৃত্তি, অভিনয় ইত্যাদি শেখানোর জন্য স্কুল খোলেন। কিন্তু অর্থাভাব ও অসুস্থতার কারণে সেটি বেশিদিন চালাতে পারেন নি। সমতট পত্রিকায় প্রকাশিত হয় কথা ইসারা বটে ভগবান রামকৃষ্ণবলিয়াছেন এবং সুবর্ণরেখা প্রকাশ করে গল্প সংগ্রহ

.১৯৭৩-এ বঙ্গীয় গ্রন্থাগার পরিষদ ভবনে কমলকুমার বক্তৃতা দেন বাংলা গ্রন্থে চিত্রের বিবর্তন শিরোনামে। সেটি বঙ্গীয় গ্রন্থচিত্রণ নামে এক্ষণ প্রকাশ করে। দর্পণ ও আবহ এবং কালি ও কলম যথাক্রমে প্রকাশ করে তাঁর ক্যালকাটাপেইন্টার্স, অজ্ঞাতনামার নিবাসইদানীন্তন শিক্ষাপ্রসঙ্গে। গণিত বিষয়ে বক্তৃতা দেন ক্যালকাটা ম্যাথেমেটিকাল সোসাইটির আমন্ত্রণে।১৯৭৪-এর প্রকাশিত রচনাগুলি হল- রেখো মা দাসেরেমনে (কৃত্তিবাস), দ্বাদশ মৃত্তিকা (এক্ষণ), অনিত্যের দায়ভাগ (আবর্ত), স্বাতী নক্ষত্রে জল (কালি ও কলম)।

১৯৭৫ সালে তাঁর রচনার তালিকা বেশ দীর্ঘ। সেগুলি হল—নির্বাচিত বই(কস্তুরী), ভাবপ্রকাশ(শাব্দ), আর চোখে জাগে (অমলতাস), শরৎবাবুও ব্রাহ্মণ্য( আতুঁ), বাগান লেখা(জার্নাল সত্তর), খেলার দৃশাবলী(গাঙ্গেয় পত্র) ও দানসা ফকির(সুবর্ণরেখা)।

জার্নাল সত্তর পত্রিকায় লেখা বিষয়ক প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে। ওই বছরেই উপেন্দ্রকিশোরের কাহিনি অবলম্বনে ঘোড়াচোর-এর মহড়া চলে, কিন্তু নাটকটি অর্থাভাবে মঞ্চস্থ হয় নি। এই বছর শাব্দ পত্রিকায় প্রতীক জিজ্ঞাসা, গোলকধাঁধাঁ পত্রিকায় বাগান দৈববাণী, আনন্দবাজার পত্রিকায় কলকাতার গঙ্গাপ্রকাশিত হয়। বালিগঞ্জ শিক্ষাসদন মঞ্চে ভীমবধদানসা ফকির অভিনীত হয় তাঁর পরিচালনায়।

              ১৯৭৭ সালে ১৯ জানুয়ারি বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনে দানসা ফকিরকঙ্কালের টংকার মঞ্চস্থ হতে গেলে কিছু দর্শকের অসহযোগিতা ও বিক্ষোভে তা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। এই ঘটনায় কমলকুমার খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। জার্নাল সত্তর পত্রিকায় খেলার প্রতিভা, সত্তর দশক পত্রিকায় শরৎবাবু বিষয়ক নোট প্রকাশিত হয়।আশা প্রকাশনী (মতান্তরে কথাশিল্প) থেকে প্রকাশিত হয় ঈশ্বরকোটির রঙ্গকৌতুক

 ১৯৭৮ সালে তাঁর রচনাবলি—

ছাপাখানা ও আমাদের বাস্তবতা(দেশ)

খেলার বিচার (কৌরব)

খেলার আরম্ভ (এক্ষণ)

বাগান কেয়ারি (বারোমাস)

              বাগান পরিধি বাগান (শিরোনাম)

              গঙ্গানারায়ণ ব্রহ্ম (সংস্কৃতি পরিক্রমা)

              সাক্ষাৎ ভগবৎ দর্শন (বিভাব)

এছাড়া তাম্রলিপি থেকে খেলার প্রতিভা এই বছর গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।১৪ সেপ্টেম্বর দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায়তাঁর আঁকার স্কুল খোলার বিজ্ঞাপন বেরোলেও স্কুলটি শেষ পর্যন্ত খোলে নি।সুবর্ণরেখা থেকে পিঞ্জরে বসিয়া শুক গ্রন্থাকারে প্রকাশের প্রস্তুতি শুরু হয়, কমলকুমার তার প্রুফ দেখা, প্রচ্ছদ আঁকার কাজ করে গেলেও তাঁর জীবৎকালে বইটি আর প্রকাশের মুখ দেখে নি। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৯-এ ৯ ফেব্রুয়ারি হাজরা রোডের বাড়িতে নিঃসন্তান কমলকুমার প্রয়াত হন কার্ডিয়াক আক্রমণে। রেখে যান স্ত্রী দয়াময়ী এবং তাঁর গোপালকে।

             কমলকুমারের অনেক লেখা এখনো অপ্রকাশিত, অনেক লেখা নিখোঁজ। যা পাওয়া গেছে, তাতেই তাঁর বহুমুখী প্রতিভা ও চিন্তাচর্চার পরিচয় পাওয়া যায়। সাহিত্যের অঙ্গনেই যদিও তিনি লব্ধপ্রতিষ্ঠ, তবু নাট্যশিল্প, চলচ্চিত্র, ছবি ও গানের জগৎ, গণিতবিদ্যা ইত্যাদি বিবিধ বিষয় ও মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্য ও বিশ্বশিল্পের অমিত জ্ঞানের অধিকারী এই বিস্ময়কর প্রতিভার অবাধ বিচরণ লক্ষ করা যায়।

 

তথ্যঋণ

অনিন্দ্য সৌরভ, সংক্ষিপ্ত জীবন, প্রতিবিম্ব পত্রিকা, বৈশাখ ১৪২১।