হাঁসুলী বাঁকের উপকথা : আমার চোখে তারাশঙ্করের গল্পভুবন

(১)

‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ তারাশঙ্করের একটি বহুল চর্চিত মহৎ উপন্যাস। তাঁর প্রধান উপন্যাসগুলির মতো এই উপন্যাসটিও যে তাঁর আপন অভিজ্ঞতা প্রসূত কাহিনি সে কথা বাঙলা সাহিত্যের পাঠক মাত্রেই জানেন। উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৬ সালের শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকায়। কয়েক মাস আগে ‘মুসলিম লীগের’ প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাকে কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গার কারণে সেই বার পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল ডিসেম্বর মাস নাগাদ। ‘আমার সাহিত্য জীবন’এর দুটি পর্বে ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ প্রকাশের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে লেখক নিজেই স্মৃতিচারণ করেছেন। শুরুতে বইটির আকাশচুম্বী প্রশংসা হয়। কিন্তু বইটি নিয়ে পরে প্রচুর নিন্দাও হয়েছে। প্রশংসা ও নিন্দা মিলিয়ে সমালোচনা চলেছে বহুদিন। ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ পৃথিবীর বহু ভাষায় অনুদিত হয়েছে। তবে চেকোশ্লাভাকিয়ার সবচেয়ে নামীদামী প্রকাশনা থেকে অনুদিত হতে হতেও হয় নি তার কারণও যে আসলে নিন্দা-প্রশংসার টানাপোড়েনের ফল তার আভাস তারাশঙ্করের ‘আমার সাহিত্য জীবনে’র দ্বিতীয়পর্বে পাওয়া যায়।

অনুজ সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ প্রসঙ্গে একটি ভাষণে বলেছিলেন ‘তাঁর দৃষ্টির সামনে আর সেই আলোর দীপালিতে ঝলমল করে উঠেছে তাঁর আধুনিকতম সৃষ্টি এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘হাঁসুলী বাঁক’ এই হাঁসুলী বাঁকের উপকথা বলতে গিয়ে তারাশঙ্কর শুধু বাঁশবাঁদির কাহারদের ফুটিয়ে তোলেন নি- ব্রাত্য, মন্ত্রহীন ভারতবর্ষে যুগান্তরের দোলা যেন রূপকচ্ছলে এতে আত্মপ্রকাশ করেছে... চলমান যুগের তিনি সার্থক কাহিনিকার এবং গণসাহিত্যের নির্ভীক অগ্রদূত।’

পরবর্তী দিনে কেউ কেউ বললেন বইটি ‘অশ্লীল’। বলা হল, ‘লেখক উচ্চবর্ণের ধর্মানুযায়ী নিম্নবর্ণের অপমান করেছেন- উদ্দেশ্যমূলকভাবে। লেখক উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে রাগে ফেটে পড়লেন না কেন?’

হাওড়ায় একটি সাহিত্যসভায় ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ সম্পর্কে বলা হল, ‘এটা সাহিত্যই নয়, এটা অ্যাডভেঞ্চারাস রোম্যান্টিসিজম বা রোম্যান্টিক অ্যাডভেঞ্চারিজম- এমনি কিছু।’

সমালোচক অধ্যাপক শ্রী কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ সম্পর্কে বললেন, ‘গভীর সাংকেতিক তাৎপর্যমণ্ডিত ও মহাকাব্যের সংঘাতধর্মী উপন্যাস। কাহারকুলের জীবনকাহিনির মধ্য দিয়া লেখক একটি আমূল সংস্কৃতি বিপর্যয়ের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। ... গঠন ও বিষয়বস্তুর উপস্থাপন কৌশলের দিক দিয়া ইহা অনবদ্য, উপন্যাস রচনার চরম কৃতিত্বের দৃষ্টান্ত।’

‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ বই হয়ে বের হয় ১৯৪৭ সালে। পরের বছর আবার সংস্করণ হয়। পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করার ফলে বইটি আরও বড় হয়। কাহারদের জীবনকথাগুলি অধিকতর স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ উপন্যাসের জন্যে তারাশঙ্কর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘শরৎচন্দ্র পদক ও পুরস্কারে’ সম্মানিত হন।

(২)

আশির দশকের কথা। আমাদের গ্রামের সঙ্গে বহির্জগতের যোগাযোগের জন্যে যে সড়কপথটি ব্যবহার হতো, তা ছিল লাল মোড়ামের সরান। সে রাস্তায় মূলত গোরুর গাড়ি চলাচল করত তবে মাঝে মাঝে মোটর গাড়ি বা ট্রাকের শব্দও পাওয়া যেত। সরান ধরে সাত কিলোমিটার উত্তরে গেলে লাভপুর। থানা, হাসপাতাল, কলেজ, সাবরেজিস্ট্রি অফিস, সিনেমা হল এবং সপ্তাহে দুদিন হাট ইত্যাদি থাকার জন্যে লাভপুর আমাদের কাছে ছিল নিকটতম শহর। ডাক্তার দেখানো, ফুল্লরাতলার মেলা অথবা মা-কাকিমাদের সিনেমা দেখতে যাওয়া সবই ছিল লাভপুরে। যাওয়া হতো টপ্পরে ছাওয়া গোরুর গাড়িতে।

আমি তখন ফোর কি ফাইভে পড়ি। আমাদের খেলার সাথীদের মধ্যে একটি মেয়ের বাবা মারা গিয়েছিল খুব ছোটবেলায়। ওদের বাড়িতে পুরুষ অভিভাবক না থাকায় ওরা বোনেরা মিলে সংসার চালাত। সংসারে এই মেয়েটিরও অবদান কম ছিল না। ওই বয়সেই ওর প্রখর বাস্তব বুদ্ধি। স্বভাবে ডাকাবুকো, ভয়ডরহীন। সাঁতার কেটে পুকুরের এপাড় ওপাড় করতে পারে। খড়খড় করে গাছে চড়তে পারে। হাতজালি দিয়ে পুকুরে মাছ ধরতে পারে। কেউ আপত্তিকর কিছু বললে পিছিয়ে যায় না। কোমর বেঁধে প্রতিবাদ করে। উৎসব অনুষ্ঠানে একাই লাভপুরে যায় হাট করতে। সেই হাট যাওয়ার অভিজ্ঞতার গল্প সে আমাদের শোনায়। ঠিক যেন রূপকথা। যেতে যেতে নদী পেরোয়। ক্লান্ত হলে গাছতলায় বসে জিরিয়ে নেয়। থলে ভরতি হাট নিয়ে এ আল ও আল ধরে বাড়ি ফিরে আসে। এই রূপকথার পথটি ধরে আমাদের যাওয়ার অনুমতি ছিল না। ‘যাবে যাও, সোজা পথে যাও। সরান ধরে। সাপ-খোপ, খানা-খন্দ, ঝোপঝাড় ধরে যাবে, সে হবে না।’

একবার আমার জ্বর হয়েছে। বিছানায় শুয়ে আছি। বন্ধুরা বিকেলবেলা খবর নিয়ে খেলতে চলে যাচ্ছে। গ্রামে কারোর অসুখ বিসুখ হলে খবর করার খুব চল ছিল। আজও আছে। বড়দের জ্বর হলে বিকেলবেলা গ্রামের মহিলারা দল বেঁধে দেখতে আসতেন। খবর নিতেন আর নানারকম গল্প করতেন। তাতে সুখ দুঃখের কথার সঙ্গে যথেষ্ট পরিমানে পরনিন্দা পরচর্চাও যে হতো তা বলাই বাহুল্য। রোগী বেশি কাহিল হলে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হতো, মুখে রুচি আছে কিনা, কী খেতে ইচ্ছে করছে, ইত্যাদি। ঠাকুমার জ্বর হলে আমসত্ব খেলে তবে মুখের স্বাদ ফিরে আসত।

সেই বার আমার জ্বর। মুখের সঙ্গে দুনিয়াও বিস্বাদ। খাবার গলা দিয়ে নামছে না, কাজেই সকলের ভারি দুশ্চিন্তা। কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নটিও কেউ একজন করল, ‘কী খেতে ইচ্ছে করছে?’ কালবিলম্ব না করে আমি সুযোগের সদ্ব্যবহার করলাম, ‘মস্তলীর মাঠে বটগাছের গোড়ায় বসে চপ-মুড়ি খেতে ইচ্ছে করছে।’

বাড়িতে হাসির হুল্লোড় উঠল। আমি বিব্রত হলাম ঠিকই কিন্তু মেঠো পথে লাভপুরের হাটে যাবার অনুমতিটা আদায় করে ছাড়লাম।

হেমন্তের মাঝামাঝি। নবান্নের হাট করতে যাবে আমার সেই বন্ধু। সকাল সকাল ডাকতে এল। আমিও হাট করব। তাই আমার থলে, টাকা, মুড়ির কৌটো ইত্যাদি বুঝে নিল দায়িত্ব সহকারে। গ্রাম ছাড়িয়ে আমরা মাঠে নামলাম। আলের ঘাসের উপর শিশিরবিন্দুগুলো মুক্তোর মতো ঝিকমিক করছে। শিরশিরে হাওয়া দিলেও মিষ্টি রোদ এসে পড়ছে গায়ে। দুপাশের ধানের জমিগুলিতে ঝলমলে সোনালি রং। স্বর্ণ ধান পেকে উঠেছে। এইবার কাটা শুরু হবে। বড় বড় খড়ের আগা থেকে ঝুঁকে পড়ছে থোকা থোকা শীষ। মাঝখানের আলপথে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হারিয়ে যায়। ধানগাছের ফাঁকে বড়দের দেহের ঊর্ধ্বভাগ ঠাহর হয় শুধু।

ক্যানেল পার হলেই গ্রামের সীমানা শেষ। রাস্তার দুই পাশ চেনাতে চেনাতে নিয়ে চলল আমার সেই বন্ধু। পথ চেনাল, গ্রামগুলো চেনাল। কোন আলটা ছেড়ে কোন আল ধরে কোথায় দিক বদল করতে হবে বোঝাল। কিন্তু সে জটিল ব্যাপার, তাই বোঝার চেষ্টা না করে ওকে অনুসরণ করলাম। হাঁ হয়ে গেলাম ওর জ্ঞান দেখে। ডানপাশে সহুরাপুরকে রেখে মিলনপুর গ্রামে ঢুকলাম। গ্রাম ছাড়িয়ে সামান্য এগিয়ে যেতেই নদী। এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে। কিনারা বরাবর শর আর বেনার ঝোপ। জল আছে তবে হাঁটু ডুববে না। তবুও সে আমাকে ছেড়ে দিল না। হাতে ধরে নদী পার করিয়ে দিল। তারপর চিনিয়ে দিল কাদপুর আর মস্তলী নামে পরপর দুটো গ্রাম। সরান ধরে গেলেও কাদপুর পড়ে। কিন্তু সে কাদপুর অন্য। সে পূর্ব-কাদিপুর আর এ হল পশ্চিম-কাদিপুর। ‘ওর সঙ্গে না এলে পৃথিবীটা অচেনাই থেকে যেত!’ ভাবছি এমন সময় সে আমাকে আরও এক ধাপ বিস্মিত করে একটি বাড়ির বেড়ার ফাঁকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘পাথরকুচি গাছ। পাতা থেকে গাছ হয়, বাব্বা!’

হাটে ঢুকে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বন্ধুটি জানাল লাভপুরের দুটো হাটবার, সোমবার আর শুক্রবার। সোমবারের হাট হল বড় হাট, কারণ সোম থেকে শুক্র আসতে মাঝে তিনটে দিন। হাটে কী ভাবে সবজীর দরদাম করতে হয় দেখলাম। ভালাসের বেগুনই যে বেগুনকুলের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট সে জ্ঞান লাভ করলাম। শিখলাম কীভাবে বাজেট থেকে দুটো পয়সা বাঁচাতে হয়। এবং সেই বাঁচানো পয়সা নিজের ভোগে লাগাতে হয়। হাট থেকে বের হওয়ার মুখে চপ কেনা হল। ফেরার পথেও কত কথা! গ্রামের তুলনায় শহরে থাকার কত সুবিধা ব্যাখ্যা করল সে। হাট বাজার থাকলে সেখানে রোজগার করার যে কত রকমের উপায় তা ব্যাখ্যা করে বলল। মস্তলী পেরিয়ে এসে নদীর কাছাকাছি একটি বটগাছের গোড়ায় যাত্রা বিরতি হল। চপ-মুড়ি খেয়ে আবার হাঁটা। পথটা এক সময় ফুরিয়ে গেল।

আর কখনও ওই পথে গিয়েছি কিনা মনে পড়ে না। তবে মেঠো পথে যাওয়ার সুযোগটা চলে গিয়েছিল অল্পদিনের মধ্যেই। আমাদের গ্রামের সেই লাল মোড়ামের সরানটা পরিবর্তিত হয়েছিল পাকারাস্তায়। তখন বোলপুর থেকে বাস আসত বিপ্রটিকুরী পর্যন্ত। এরপর আমাদের গ্রামের উপর দিয়ে বাস চলল লাভপুর পর্যন্ত। নামমাত্র ভাড়ায় দ্রুত লাভপুরে পৌঁছে যাওয়া যায়। গোরুর গাড়ির হ্যাপা, পথ হাঁটার শ্রম থেকে মুক্তি পেল আমাদের গ্রামের মানুষ।  

(৩)

বোলপুর থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে যাদবপুরে পড়তে গেলাম। ক্লাসরুমে সবাই জানত আমি বোলপুরের মেয়ে। কলকাতার শহুরে বন্ধুদের কাছে বোলপুর, শান্তিনিকেতন আর পৌষমেলা সমার্থক। ক্লাসরুমের বাইরে আমার আরও একটি বন্ধুবৃত্ত গড়ে উঠেছিল। তাদের অনেকেই সাহিত্যের ছাত্রছাত্রী এবং মনেপ্রাণে সাহিত্য অনুরাগী। তারা জানত, আমার বেড়ে ওঠা লাভপুরের কাছে। তাদের কাছে লাভপুর, তারাশঙ্কর আর ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ ছিল সমার্থক।

ছোট থেকে আমার সাহিত্যে আকর্ষণ ছিল, তবে পড়াশোনা তেমন ছিল না। তারাশঙ্কর বলতে আমি তাঁর কিছু ছোটগল্প পড়েছি। বেশ কিছু গল্প বাবার মুখে শুনেছি। গল্প ছাড়াও তার প্রেক্ষাপট, চরিত্র ইত্যাদি সম্পর্কে কিছু তথ্য বাবা বলতেন। কারণ তারাশঙ্করের কাহিনির চরিত্রগুলির যে বিশেষ ধর্ম, সেই স্বভাবের মানুষ আমাদের আশপাশে প্রতিটি গ্রামেই দেখতে পাওয়া যেত। আজও যায়। তাঁর কাহিনির ঘটনাগুলিও অহরহ আমাদের চারিপাশে ঘটে। তবে সেসবের রস আস্বাদন করা বা মর্ম বোঝার আগেই চলে যেতে হয়েছিল লাভপুর থেকে দূরে। তারাশঙ্করের উপন্যাস পড়ার তেমন সুযোগ তখনও পাই নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীতে সে সুযোগ পেলাম। ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ পড়লাম। বাবার কাছে জানতে চাইলাম, এই উপন্যাসের পটভূমি সম্পর্কে। বাবা বোঝানোর চেষ্টা করলেন। বললেন মিলনপুর গ্রামের নাম। বক্রেশ্বর আর কোপাইয়ের সঙ্গম তাই নাম মিলনপুর। গ্রামখানি চেনা। বছর বছর ওই গ্রামের বন্যাকবলিত বহু মানুষ আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিত। নদী পেরিয়ে পশ্চিমকাদিপুর ঢোকার আগে নদীটা হাঁসুলী হারের আকারে বাঁক নিয়েছে। একথা বলে বাবা বললেন, ‘কিন্তু বুঝতে পারবি কি? হাঁটা পথে ওইদিকেই আগে লাভপুর যাওয়া হতো, এখন কেউ যায় না।’

বাবার দেওয়া বিবরণ শুনেই সেই পুরনো কথাটা মনে পড়ল। সেই হাটে যাওয়ার পথ। আবছা আবছা গ্রামগুলোর ছবি। দূর থেকে গ্রামের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় না। গাছপালা, বাঁশঝাড়ে ঢেকে থাকে। কাছে গিয়ে দেখতে পাওয়া যায় ছোট্ট পল্লী। হাতে গোনা কয়েক ঘর গরীব মানুষের বসবাস।

এরপর ২০১৬ নাগাদ যাওয়ার একটা সুযোগ হল। আগের পথ ধরে যাওয়া হল না, লাভপুর হয়ে গেলাম। পশ্চিমকাদিপুর গ্রামে পথের ধারে একজোড়া প্রাচীন মন্দির আছে। সেখানে ক’জনকে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটির সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে পারবে?’

‘কী ব্যাপার, কী বৃতান্ত’ সেসব নিষ্পত্তি হতে না হতেই পথে একজন বৃদ্ধ উদয় হলেন। ভদ্রলোক পুকুর থেকে স্নান সেরে ফিরছিলেন। ভাগ্যটা সেদিন প্রসন্ন ছিল। প্রাথমিক পরিচয় দিতে গিয়ে প্রকাশ পেল আমাদের গ্রামে ভদ্রলোকের শ্বশুরবাড়ি। ভদ্রলোকের নাম হাবল। শ্বশুরগাঁয়ের লোককে হাবলবাবু সসম্মানে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। মাদুর পেতে বসতে দিলেন। ইঙ্গিত পেলাম, যা জিজ্ঞেস করব, সাধ্য মতো উত্তর দেবেন। ভদ্রলোক সমাদর করেছেন দেখে আরও কিছু মানুষ জড়ো হল। যারা আমাকে এতক্ষণ সন্দেহের চোখে দেখছিল, তারাও আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজী।

১৯৬২ সালে তপন সিংহ ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ চলচিত্রায়িত করেছিলেন। কিছু কিছু দৃশ্যে গ্রামের সকলকেই থাকতে হয়েছিল। ছবির শুটিংয়ের স্মৃতি নিয়েই সবাই বলতে শুরু করল। বেশিরভাগেরই বড়দের থেকে শোনা অভিজ্ঞতা। তবে হাবলবাবু তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে চোখে দেখার স্মৃতিটুকু বললেন। বললেন, ‘আমার তো বয়স বেশি ছিল না মা। দেখেছি, বাবু আসতেন। গাড়িটো গাঁ পর্যন্ত আসত না। ওইখানে রেখে দিয়ে আসতেন। ঘুরে ঘুরে দেখতেন গাঁয়ের মাথার উপর। সব ঘর থেকে ধোঁয়া উঠছে কিনা, রান্না চেপেছে কিনা খোঁজ নিতেন। সুচাঁদবুড়ির বাড়িতে যেতেন। তার ঘরটো তো আর নাই। ওই দেখ ওই খানটোতে ছিল। বসনের ঘর ছিল...’

আরও একজন বয়স্কমানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। একজন বৃদ্ধা, কোমর ভেঙে শয্যাশায়ী। তাঁর নাম লালবৌ। বললেন, সেই কোন ছোটবেলায় বিয়ে হয়ে চলে এসেছি মনেও পড়ে না। আজন্ম এই গাঁয়েই আছি। তখনকার দিনে বিয়ে হয়ে এলেই শ্বশুরবাড়ি থেকে একটা নাম দিত। সেই নামেই লোকে ডাকত। সেই সূত্রে ভদ্রমহিলার নাম লালবৌ। মুচকি হেসে বললেন, ‘আমি সোন্দর ছেলাম তো, সেই জন্যে লালবৌ নাম দিয়েছিল।’ লালবৌয়ের বড় জা ছিল ‘কালোবৌ’। কেউ কেউ বলে, সেই কালোবৌয়ের কিছুটা ছাপ কালোশশী চরিত্রটির মধ্যে পাওয়া যায়। লালবৌ তাঁর কম বয়সে লাভপুরে বাবুপাড়ায় ঘটিতে করে দুধ বিক্রি করতে যাওয়া অথবা ঘুঁটে বিক্রি করতে যাওয়ার কথা বললেন।

(৪)

‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’র চরিত্রদের তারাশঙ্কর কীভাবে পেয়েছিলেন সে কথা তিনি লিখেছেন ‘আমার সাহিত্য জীবনে’। ১৯২৫-২৬ সালে লাভপুর সহ চতুর্দিকের গ্রামগুলি কলেরার কবলে বিপর্যস্ত হয়েছিল। তারাশঙ্কর সেই সময় লাভপুরের আশেপাশে ত্রিশ চল্লিশটি গ্রামে প্রায় ছয়মাস ধরে মহামারি মোকাবিলার জন্যে লড়াই করেছিলেন। আক্রান্ত মানুষদের সেবা করেছিলেন। গল্পে যেমন পাষাণের মূর্তি ভেদ করে দেবতার উদ্ভাসের কথা লেখা থাকে। সেই সময় তারাশঙ্কর পাপ-পুণ্যে ভরা রক্ত-মাংসের মানুষের ভেতরে দেবতার সন্ধান পেয়েছিলেন। তখনই তাঁর হাঁসুলী বাঁকের সুচাঁদের সঙ্গে পরিচয়। পরবর্তী দিনে তার সঙ্গে বসে বিড়ি টানতে টানতে তাদের সুখ দুঃখের কথা শুনেছেন তারাশঙ্কর।

কলকাতায় থিতু হওয়ার পরও লাভপুরে গেলে তারাশঙ্কর বেরিয়ে পড়তেন সকাল সকাল। পায়ে হেঁটে ঘুরতেন গ্রামগুলি। লাভপুর ষ্টেশনে ‘কবি’ উপন্যাসের মাতুল বণিকের (বেনে মামা) দোকানে চা খেতেন। নিতাই বাউড়ী, কুলি সতীশ ডোমেদের সঙ্গে দেখা হতো। পথে যেতে যেতে দেখা হতো নসুবালার সঙ্গে। মেয়ে সেজে থাকা বেটাছেলে নসুবালা। খোঁপা বাঁধা, নাকছাবি পরা নসুবালা মেয়েলি ঢঙে বলত, ‘হেঁই মা গো! কখন এলা? বলি মনে পড়ল আসতে?’

আর একটু বেলা বাড়লে দৃশ্য পালটে যেত। ঠিক যেমনটা দেখা যেত ‘কবি’ গল্পে। আশপাশের গ্রামগুলি থেকে মাজা ঘটি মাথায় মেয়েরা দুধ, ঘুঁটে নিয়ে লাভপুরের দিকে আসত। সেই দলে থাকত বসন, বসনের মেয়ে ময়না অথবা কুসুম। এরা সবাই ‘হাঁসুলী বাঁকের’ চরিত্র। তারাশঙ্করকে দেখে তারা থামত। ঘটি নামিয়ে প্রণাম করে তাঁর পরিবারের ভালমন্দ খবর নিত।

তারাশঙ্কর এই মানুষগুলিকে দেখেছিলেন আপাদমস্তক। তাদের ভালবেসেছিলেন। তাই তো তিনি বলেছেন ‘... ওদের আত্মীয় আমি। উপকারী নয়, কৃতজ্ঞতাভাজন নয়, ভালবাসার জন।’

শুধু যে মানুষগুলিকেই তিনি দেখেছিলেন বা ভালোবেসেছিলেন এমন নয়। ভালোবেসেছিলেন সেখানকার প্রকৃতি, গাছপালা এবং নদনদীকে। গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন, প্রকৃতি আর তার কোলে বেড়ে ওঠা মানুষের যোগাযোগ। তাই তিনি কোপাই নদীর বর্ণনা দিয়েছেন সেখানকার মানুষের অন্তরঙ্গ ভাষায়, ‘আষাঢ় থেকেই মা মরা ছোট মেয়ের বয়স বেড়ে ওঠে। যৌবনে ভরে যায় তার শরীর। তারপর হঠাৎ একদিন সে হয়ে ওঠে ডাকিনী। কাহারদের এক একটা ঝিউড়ি মেয়ে হঠাৎ যেমন এক –একদিন বাপ-মা-ভাই-ভাজের সঙ্গে ঝগড়া করে, পাড়াপড়শিকে শাপশাপান্ত করে, বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে গাঁয়ের পথে, চুল পড়ে এলিয়ে, গাঁয়ের কাপড় যায় খসে, চোখে ছোটে আগুন, যে ফিরিয়ে আনতে যায় তাকে ছুঁড়ে মারে ইট পাটকেল পাথর, দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে চলে কুলে কালী ছিটিয়ে দিয়ে, তেমনই ভাবেই সেদিন ওই ভরা নদী অকস্মাৎ ওঠে ভেসে। তখন একেবারে সাক্ষাৎ ডাকিনী।’

তারাশঙ্কর নির্দ্বিধায় বলেছেন, ওই মানুষগুলি তাঁর আপনজন। চোখের সামনে ঠিক উলটোদিকটা দেখেছিলাম সেদিন। দেখেছিলাম, তারাশঙ্করের মৃত্যুর পর এতগুলি দশক পেরিয়ে গিয়েছে কিন্তু ওই এলাকার মানুষগুলির কাছে তিনি আজও জীবন্ত। আপনজন!

আজও যে লাভপুরের আশেপাশে বহু গ্রামের মানুষ তারাশঙ্করের নির্মিত চরিত্রদের সম্পর্কে খোঁজ দেয়, বলতে পারে তাঁর গল্পের পটভূমিতে কোন গ্রামের কথা আছে, তাতেই বোঝা যায় তাদের ভালোবাসার গভীরতা। সাহিত্য না পড়া মাটির মানুষগুলি যে তাদের উত্তরসূরিদের কাছে তারাশঙ্করকে এভাবে বাঁচিয়ে রেখেছেন দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না।

তারাশঙ্কর বলেছিলেন, এদের সঙ্গে তাঁর যে আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল, প্রবাসে প্রতিষ্ঠা লাভ করেও সেই আত্মীয়তা ম্লান হয় নি। একই রকম ভাবে হাঁসুলী বাঁকের তীরে ছোট্ট গ্রামের মানুষগুলির তাঁর প্রতি ভক্তি বা ভালোবাসা আজও ম্লান হয় নি।

সেখানকার জলে মাটিতে অথবা নদীর বাঁকেও কোথাও যেন তার রেশ রয়ে গিয়েছে। আজও রসিকজনে বাতাসে কান পাতলে শুনতে পায় উদাসী বাউলের গান,

‘হাঁসুলী বাঁকের কথা বলব কারে হায়?

কোপাই নদীর জলে কথা ভেসে যায়।’      

---