জেন অস্টেনের 'সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি' প্রসঙ্গে
- 07 January, 2025
- লেখক: সৌভিক ঘোষাল
জেন অস্টেনের প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৮১১ সালে, যখন তাঁর বয়েস প্রায় ছত্রিশ। উপন্যাসটি জেন লিখতে শুরু করেছিলেন ১৭৯৫ সালেই, মাত্র কুড়ি বছর বয়সে। তখন লেখিকা এর নাম দিয়েছিলেন ‘এলিয়নর অ্যান্ড ম্যারিয়ানে’, উপন্যাসের প্রধান দুই চরিত্র, দুই বোনের নামে। বড়জন এলিয়নর উপন্যাসের শুরুতে উনিশ বছরের, প্রায় লেখিকা জেনের প্রথম খসড়া কালের সমবয়সীই বলা যায়। আর দ্বিতীয়জন – ম্যারিয়ানে – উপন্যাসের শুরুতে যে ছিল এক ষোড়শী কিশোরী, উপন্যাসের শেষে এসে পৌঁছবে একুশে, যখন সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে প্রেমপর্বের নানা জটিলতা কাটিয়ে। পারিবারিক স্মৃতির সূত্রে জানা যায় প্রথম খসড়ায় জেন অস্টেন এলিয়নর আর ম্যারিয়ানের আখ্যানটি লিখেছিলেন চিঠির আকারে। দু বছরের মধ্যে আখ্যানটির সম্পূর্ণ রূপান্তর ঘটিয়ে ফেলেন অস্টেন। চিঠির বদলে সর্বগ ও সর্বজ্ঞ উপন্যাসকথকের হাতে তখন এসে যায় আখ্যান বর্ণনার নিয়ন্ত্রণ আর উপন্যাসের নামটিও ‘এলিয়নর অ্যান্ড ম্যারিয়ানে’ থেকে বদলে যায় আমাদের পরিচিত ‘সেন্স অ্যান্ড সেনসিবিলিটি’ তে। উপন্যাসটি এখন যে চেহারায় আমাদের সামনে আসে তার খুব কাছাকাছি একটা চেহারা এটা পেয়ে গিয়েছিল সেই ১৭৯৭ এর রূপান্তরেই। কিন্তু তখন বা তার এক দশকের মধ্যেও এটি প্রকাশভাগ্য লাভ করে নি। অবশেষে অস্টেন এটিকে থমাস ইগারটন নামের এক প্রকাশকের কাছে পাঠান ১৮১০ সালে। পরের বছর ১৮১১ সালের ৩০ অক্টোবর এটি ছাপার হরফে আত্মপ্রকাশ করে। প্রকাশকের কাছে পাঠানোর আগে ১৭৯৭ এর পাণ্ডুলিপিটি অস্টেন কিছুটা সংশোধন করেছিলেন। ১৮০১ সালে পোস্টাল চার্জ এক পেনি থেকে বেড়ে দু পেনি হয়েছিল। ম্যারিয়েনের চিঠি পাঠানোর পোস্টাল স্ট্যাম্পের খরচ সেই অনুযায়ী বদলে নেওয়া হয় চূড়ান্ত পাণ্ডুলিপিতে। স্যর ওয়াল্টার স্কটের The Lay of the Last Minstrel এর কথা আসে চূড়ান্ত পাণ্ডুলিপিতে, যেটি পূর্বতন খসড়া ও চূড়ান্ত পাণ্ডুলিপির মধ্যবর্তী পর্বে ১৮০৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।
অস্টেন অল্পবয়সেই লিখতে শুরু করেছিলেন কিন্তু পাঠকের সামনে ছত্রিশ বছর বয়সের আগে তিনি আত্মপ্রকাশে সমর্থ হন নি। অবশেষে ১৮১১ তে তাঁর উপন্যাস ‘সেনস অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’ প্রথম মুদ্রিত হল। তবে সেখানেও লেখক হিসেবে তাঁর নাম ছিল না। সেখানে লেখা ছিল ‘বাই এ লেডি’ – এরকম একটি কথা। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য অস্টেনের জীবদ্দশায় প্রকাশিত কোনও উপন্যাসেই লেখক হিসেবে তাঁর নাম মুদ্রিত হয় নি। অস্টেনের দ্বিতীয় মুদ্রিত ও সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এর লেখকের পরিচয় প্রসঙ্গে আখ্যাপত্রে বলা হয়েছিল এটি ‘সেনস অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’র লেখিকার দ্বারা রচিত।
১৮১১ সালে খানিকটা আর্থিক ঝুঁকি নিয়েই প্রকাশিত হয়েছিল সাহিত্য সমাজে তখনো অবধি একেবারেই অপরিচিত জেন অস্টেনের ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’। এর আগে বেশ কয়েক বছর অস্টেন পরিবার নানারকম সমস্যায় জর্জরিত থেকেছে। ১৮০৫ সালে জেন অস্টেনের বাবার মৃত্যু হয়। তার পরে কয়েক বছর টালমাটাল পরিস্থিতি গেছে তাদের পরিবারে। অবশেষে ১৮০৯ সালের জুলাই মাসে জেন অস্টেন তার মা ও তার মতোই সারাজীবন অবিবাহিত থাকা দিদির সঙ্গে চাওটনে আসেন ও খানিকটা স্থিতিশীল হন। এই স্থিতিশীল পরিস্থিতিতেই আবার নিজের উপন্যাস প্রকাশের ভাবনা তাঁর মাথায় আসে।
এর আগে প্রকাশকদের কাছে উপন্যাসের খসড়া পাঠিয়েও একাধিকবার প্রত্যাখ্যানের অভিজ্ঞতা হয়েছিল অস্টেনের। ফলে উপন্যাস প্রকাশের চারটি বাস্তব রাস্তা তখন ছিল তাঁর সামনে। প্রথমটি হল নিজের খরচে বই প্রকাশ করা ও বিক্রির মাধ্যমে সেই খরচ তুলে নেওয়া। দ্বিতীয়টি হল বই প্রকাশের আগেই গ্রাহক তৈরি করা ও গ্রাহকদের থেকে পাওয়া টাকায় বই ছাপা। তৃতীয়টি হল কপিরাইট প্রকাশকের হাতে তুলে দেওয়া। চতুর্থটি হল প্রকাশকের সঙ্গে কমিশন চুক্তি প্রথায় বই বের করা। জেন এই চতুর্থ রাস্তাটি নেন। তিনিই দেন মুদ্রণ খরচ। কমিশনের বিনিময়ে বিজ্ঞাপন ও বিপণনের ব্যবস্থা করেন প্রকাশক।
উপন্যাসটি প্রকাশের পরে বেশ সাড়া ফেলে। কিছুদিনের মধ্যেই এর প্রথম সংস্করণ নিঃশেষিত হয়ে যায়। প্রকাশকের কাছ থেকে কমিশন বাবদ জেন পান ১৪০ পাউন্ড।2
‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’র সাফল্য জেন অস্টেনকে যেমন আত্মবিশ্বাস জোগাল, তেমনি তার পরের উপন্যাস প্রকাশের পথকেও সুগম করে দিল। ১৮১১ সালের ৩০ অক্টোবর সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি প্রকাশিত হয়। তার পরেই ‘ফার্স্ট ইম্প্রেশন’ এর পুরনো পাণ্ডুলিপিটির পরিমার্জন শুরু করেন অস্টেন। এর নাম বদলে রাখেন ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ আর পাঠিয়ে দেন প্রকাশকের কাছে। ১৮১২ সালে প্রকাশক থমাস ইগার্টন ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এর কপিরাইট কিনে এটি প্রকাশে সম্মত হন। ১৮১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ প্রকাশিত হয়। ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ প্রকাশের পর অস্টেন তাঁর তৃতীয় উপন্যাস ‘ম্যানসফিল্ড পার্ক’ লেখার কাজ এগিয়ে নিয়ে যান। ১৮১৩ সালের নভেম্বরেই প্রকাশক ইগার্টন ‘ম্যানসফিল্ড পার্ক’ ছাপার বিষয়ে তাঁর আগ্রহ জানিয়ে দেন। ১৮১৪ সালের ৯ মে এটি প্রকাশিত হয়।
'ম্যান্সফিল্ড পার্ক' প্রকাশের আগেই জেন অস্টেন তাঁর চতুর্থ উপন্যাস ‘এমা’ লেখার কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। ১৮১৪ র জানুয়ারি মাসেই ‘এমা’ লেখার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল, আর তা শেষ হল ১৮১৫ সালের ২৯ মার্চ। ১৮১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে এমা প্রকাশিত হল। জেন অস্টেনের প্রকাশক বদলাল এইবার। ‘এমা’ প্রকাশ করলেন জন মারে। ‘এমা’ প্রকাশের আগেই একটি পুরনো পাণ্ডুলিপির রূপান্তরের কাজ শুরু করেন জেন অস্টেন। ১৭৯৮-৯৯ সালে ‘সুসান’ নামে যে আখ্যানটি তিনি লিখেছিলেন, ১৮১৫-১৬ সালের রূপান্তরে তা বর্তমানে পরিচিত ‘নরদ্যাঙ্গার অ্যাবে’র চেহারা নেয়। ১৮১৬ সালে একটি নতুন উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিও জেন অস্টেন সম্পূর্ণ করেন, যার নাম ‘পারসুয়েশন’। তবে ‘নরদ্যাঙ্গার অ্যাবে’ ও ‘পারসুয়েশন’ এর প্রকাশ তিনি দেখে যেতে পারেন নি। ১৮১৭ সালের ১৮ জুলাই জেন অস্টেন মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পরে ১৮১৭ সালের ডিসেম্বরে জেনের দাদা হেনরী অস্টেনের ভূমিকা সহ প্রকাশিত হয় এই দুটি উপন্যাস। এই উপন্যাস দুটিতেই লেখক হিসেবে প্রথম নাম ছাপা হল জেন অস্টেনের। সেইসঙ্গে জানিয়ে দেওয়া হল তিনিই ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’, ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ ইত্যাদি উপন্যাসের লেখিকা। জীবদ্দশায় প্রকাশিত উপন্যাস সমূহের ‘এ লেডি’ নামের আড়াল ভেঙে পাঠক জানতে পারল তাদের লেখকের প্রকৃত নাম।
‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’ উপন্যাসের শুরুতে আমরা দেখি মিস্টার ড্যাশউড তাঁর মৃত্যুশয্যায় চিন্তিত দ্বিতীয় স্ত্রী ও মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। কাকার সম্পত্তি কিছুদিন মাত্র ভোগ করার পরেই তিনি রোগাক্রান্ত হয়ে এখন মৃত্যুমুখে পতিত। উইল অনুযায়ী সম্পত্তি এবার চলে যাবে তার আগের পক্ষের মৃত স্ত্রীর সূত্রে জন্ম হওয়া বড় ছেলে জন ড্যাশউডের কাছে। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী মিসেস ড্যাশউড এবং তার তিন মেয়ে উনিশের এলিয়নর, ষোলর ম্যারিয়ানে ও তেরর মার্গারেটের ভবিষ্যৎ কী হবে সেটাই মিস্টার ড্যাশউডের উদ্বেগের কারণ। তিনি পুত্র জনের থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেন যে সে তার বোনেদের দেখবে। মিস্টার ড্যাশউডের মৃত্যুর পর সে প্রতিশ্রুতি অবশ্য জন রাখে নি। তার স্ত্রী ফ্যানি ড্যাশউডের প্ররোচনা ও নিজের সংকীর্ণ দোদুল্যমান মানসিকতা তাকে বোনেদের অর্থসাহায্য করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত থেকে সরিয়ে আনে। স্বামীর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নরল্যান্ড পার্কের সম্পত্তির ভোগদখল নিতে চলে আসেন ফ্যানি ড্যাশউড। সৎ শাশুড়ি ও ননদদের সঙ্গে যথেষ্ট শীতল ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া শুরু করেন এই বাড়িতে তারা আর কাঙ্ক্ষিত নন। ফ্যানির ভাই এডওয়ার্ড ফেরার অবশ্য বিপরীত মন মানসিকতার মানুষ। নরল্যান্ড পার্কে বোনের বাড়িতে আসার পর সে ড্যাশউড পরিবারের সবার সঙ্গেই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। বড় মেয়ে এলিয়নরের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব মন দেওয়া নেওয়ার পর্যায়তেও পৌঁছয়, যদিও মনের ভাব তারা মুখে অনুচ্চারিতই রাখে। এলিয়নর অপেক্ষা করেছিল এডওয়ার্ডের প্রেম প্রস্তাবের। কিন্তু এডওয়ার্ডের মধ্যে এই সম্পর্কে একটা অস্থিরতা দেখা যায়। পরে এলিয়নর ও উপন্যাস পাঠক জানতে পারেন যে লুসি স্টিল নামে একজনের প্রতি সে বাগদত্ত। উপন্যাসের চরিত্রপাত্ররা অবশ্য এ খবর জেনেছে অনেক পরে। এডওয়ার্ড ফেরার পরবর্তীকালে লুসি স্টিলকে পছন্দ না করলেও এই সম্পর্ক থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারছে না, পারছে না মনের মানুষ এলিয়নরের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে।
লুসির কথা ফ্যানি ড্যাশউড জানত না। এলিয়নরের সঙ্গে ভাই এডওয়ার্ডের সম্পর্ক সম্ভাবনা ফ্যানি ডাশউডকে ক্ষুব্ধ করে। সে অপমানসূচক আচরণ করলে মিসেস ড্যাশউড তার তিন মেয়েকে নিয়ে নরল্যান্ড পার্ক ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাদের আত্মীয় স্যার জন মিডলটন মিসেস ড্যাশউড ও তার কন্যাদের নিজের খামার এলাকার বার্টন কটেজে এসে থাকার আহ্বান আগেই জানিয়েছিলেন। এইবার সেই ডাকে ড্যাশউড পরিবার সাড়া দেয় ও চিরতরের জন্য সাসেক্সের নরল্যান্ড পার্ক ছেড়ে ডেভনশেয়ারের বার্টন কটেজে চলে আসে।
বার্টন কটেজে থাকাকালীন সময়েই ম্যারিয়ানে একদিন বেড়াতে বেরিয়ে তার পা মচকায় এবং তাকে বাড়ি পৌঁছে দেয় মিস্টার জন উইলোবি। জন উইলোবি নায়কের বেশেই উপন্যাসে প্রবেশ করেছিল এবং দ্রুতই জিতে নিয়েছিল ম্যারিয়ানের মন। তাদের প্রেমের উচ্ছ্বল পর্বটি অবশ্য দীর্ঘায়িত হয় নি। ম্যারিয়ানে যখন উইলোবির থেকে বাগদানের প্রস্তাব আশা করছে সেইসময় একদিন হঠাৎই উইলোবি জানায় তাকে কাজের জন্য লন্ডনে চলে যেতে হচ্ছে। উইলোবি বার্টন কটেজে আসা বন্ধ করে দেয় এবং তার আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায় না।
এরপর এলিয়নর এবং ম্যারিয়ানে মিসেস জেনিংসের সঙ্গে লন্ডনে আসে। মিসেস জেনিংস হলেন জন মিডলটনের শাশুড়ি, যিনি বছরের কিছু সময় নিজের লন্ডনের বাড়িতে আর কিছু সময় বার্টন কটেজে মেয়ে জামাইয়ের বাড়িতে কাটান। লন্ডনে এসে উইলোবির ঠিকানায় ম্যারিয়ানে একের পর এক চিঠি লেখে, কিন্তু সে সব চিঠির কোনও উত্তর আসে না। অনেক পরে এক তীব্র আক্রমণাত্মক চিঠিতে সে জানায় যে সে কোনওদিনই ম্যরিয়ানের প্রতি অনুরক্ত ছিল না। উইলোবি মিস গ্রে নামক একজনকে মূলত তার সম্পদের লোভে বাগদান করে। ক্রমশ উইলোবি চরিত্রের অন্যান্য অন্ধকার দিক ও ঘটনাবলী জানা যায়। জানা যায় কর্নেল ব্রান্ডনের পনেরো বছরের পালিতা কন্যাকে উইলোবি বশ করে ভোগ করেছে ও তারপর পরিত্যাগ করেছে। মিস গ্রের সঙ্গে সম্পর্ক উইলোবিকে খুশি করতে পারে নি। অনেক পরে ম্যারিয়ানের প্রতি তার ক্রুর ব্যবহারের জন্য উইলোবি অনুতাপ প্রকাশ করে।
এলিয়নর ও ম্যারিয়ানে যখন মিসেস জেনিংসের সঙ্গে লন্ডনে থাকছে, লুসি স্টিল ও তার বোনও সেইসময়ে লন্ডনে আসে। এলিয়নরকে সে আগেই জানিয়েছিল যে এডওয়ার্ড তাকে বাগদান করেছে। কিন্তু লুসির অনুরোধে এই কথা এলিয়নর সবার কাছেই গোপন রেখেছিল। এলিয়নরের কাছে অবশ্য স্পষ্ট হয়ে যায় এডওয়ার্ডের অস্থিরতার কারণ। সে বুঝতে পারে কেন তাকে ভালোবেসেও এডওয়ার্ড ফেরার তার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে পারছে না। এডওয়ার্ড আর লুসির সম্পর্ক এডওয়ার্ডের মা মিসেস ফেরার মেনে নিতে পারেন নি। তিনি এডওয়ার্ডকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে তার ভাই রবার্ট ফেরারকে সব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করে দেন। এর পরেই এডওয়ার্ডকে ত্যাগ করে লুসি রবার্ট ফেরারকে বিয়ে করে। লুসির এই প্রবঞ্চনা অবশ্য এডওয়ার্ড এলিয়নরের কাছে ইতিবাচক ব্যাপার হিসেবেই আসে। লুসি নিজেই সরে যাওয়ায় এডওয়ার্ডের পক্ষে এলিয়নরকে বাগদান করা সম্ভব হয়।
এলিয়নর আর এডওয়ার্ড ফেরারের পাশাপাশি সম্পর্ক তৈরি হয় কর্নেল ব্রান্ডন আর ম্যারিয়ানের মধ্যে। আগে কর্নেল ব্রান্ডনের ইশারা প্রস্তাব ম্যারিয়ানে ফিরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু নতুন পরিস্থিতিতে এই মধ্যবয়স্ক ধনী চরিত্রবান যুবকের প্রস্তাবকে তার আর অনভিপ্রেত বলে মনে হয় নি। দুই জোড়া নবদম্পতি, এলিয়নর – এডওয়ার্ড ফেরার এবং ম্যারিয়ানে – কর্নেল ব্রান্ডন ডেলাফোর্ডে পাশাপাশি থাকতে শুরু করেন। মিসেস ড্যাশউড বার্টন কটেজেই থেকে যান।
জেন অস্টেনের ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’ নামটির প্রথম শব্দটি এখনো আগের অর্থেই সুপরিচিত। কিন্তু সেন্সিবিলিটি কথাটি তখনকার দিনে যে ইমোশনাল অর্থে ব্যবহৃত হত, তা একালের পাঠককে আলাদা করে জেনে নিতে হয়। উপন্যাসের প্রথম খসড়ায় সরাসরি দুই বোনের নাম ব্যবহার করেই উপন্যাসের নামকরণ করেছিলেন জেন অস্টেন। কিন্তু তারপর তিনি নামকরণ বদলে সেখানে নিয়ে এলেন চরিত্র পরিচয়ের ইঙ্গিৎ। নয়া নামকরণের মধ্যে দিয়েই উপন্যাসের দুই প্রধান চরিত্র, দুই বোন সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা তৈরি করে দেন লেখিকা। উপন্যাসে দুই বোনের জীবনেই প্রেম আসে, আসে প্রেমের সঙ্কট। কিন্তু ইলিয়নর সেই সঙ্কটের সামনে অনেকটাই স্থিতধী, ভেতরের যন্ত্রণাকে সে ভেতরেই রেখে দিতে পারে। সে বোঝে এডওয়ার্ড ফেরার যে কোনও কারণেই হোক তাকে ভালোবেসেও সেই ভালোবাসাকে মূর্ত রূপ দিতে পারছে না। তার মনে দ্বিধা সংশয় অস্থিরতা তৈরি হয়, কিন্তু সেই দ্বিধা সংশয় অস্থিরতাকে সে তার বোন, পরিবার বা প্রেমিকের সামনে সরবে উন্মোচিত করে দেয় না। অন্যদিকে ম্যারিয়ানে উইলোবির প্রেমে একেবারে মাতোয়ারা হয়ে যায়। প্রেমের দিনগুলিতে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে সে প্রেমিককে আঁকড়ে ধরে, আর প্রেমিক অজানা কারণে শীতল হয়ে হারিয়ে গেলে ম্যারিয়ানে ভেঙে পড়ে অঝোর কান্নায়। উইলোবির প্রত্যাখ্যান তাকে এতই বিমর্ষ করে দেয় যে ম্যারিয়ানে নিজের স্বাভাবিক স্থিতিটুকুও হারিয়ে ফেলে। তার মানসিক যন্ত্রণা তীব্র শারীরিক ব্যাধির আকার নেয় এবং নিয়ে যায় মৃত্যুর কাছাকাছি। বহু আয়াস এবং দীর্ঘ সময়ের পরই কেবল সে সেই ব্যাধি এবং শরীর মনের যন্ত্রণা কাটিয়ে উঠতে পারে।
জেন অস্টেনের উপন্যাসে নারী চরিত্রদের ভিড় দেখা যায়। ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’ও তার ব্যতিক্রম নয়। ইলিয়নর আর ম্যারিয়ানের মা মিসেস ড্যাসউড অনেকটাই আবেগপ্রবণ। ফ্যানি ড্যাশউড স্বামী জন ড্যাশউডের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নরল্যান্ড পার্কের নয়া সম্পত্তিতে এসে পড়া মাত্র ভবিষ্যৎ ভাবনা বিন্দুমাত্র না ভেবে সে বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। বড় মেয়ে এলিয়নরের বিবেচক সিদ্ধান্ত অবশ্য সেবার তাকে প্রতিহত করে।
উপন্যাসে খল চরিত্র হিসেবেই ফ্যানি ড্যাশউডকে উপস্থাপন করেছেন জেন অস্টেন। স্বামী জন ড্যাশউড অনেকটাই তার হাতের পুতুল। পিতার মৃত্যুশয্যায় জন তার সৎ বোনেদের দেখভালের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। পিতার মৃত্যুর পর বোনেদের বাৎসরিক একটা মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে যাবার ভাবনাও সে প্রথমে ব্যক্ত করে। কিন্তু নিজেদের চার বছরের সন্তানের জন্য সম্পত্তি ও অর্থ রেখে যেতে হবে, বোনেদের বেশি টাকা দিলে তা নয়ছয় হবে এবং অত টাকা তাদের প্রয়োজনও নেই – এসব কথা ফ্যানি ড্যাশউড স্বামী জনকে বোঝান এবং জন অচিরেই সেসব মেনেও নেন। শেষমেষ মাঝেমধ্যে কিছু উপহার ছাড়া সৎ মা ও বোনেদের তিনি আর কিছুই দেবেন না বলে স্থির করেন। জন ড্যাশউডের মধ্যে একদিকে নিজস্ব দৃঢ়তার অভাব, অন্যদিকে মারাত্মক অর্থলোলুপতা ও দোদুল্যমানতার প্রকাশ রয়েছে। রয়েছে স্ত্রীর দ্বারা ভুলভাবে নিয়ন্ত্রিত হবার দৃষ্টান্ত। ফ্যানি ড্যাশউড ও তার মা মিসেস ফেরার চরিত্রের নানা নেতিবাচক দিক উপন্যাসের বিভিন্ন পর্বে আত্মপ্রকাশ করেছে। এডওয়ার্ড ফেরারের বাগদত্তা লুসির প্রতি যে নির্মম ও অভব্য আচরণ তারা করেন, তা তাদের চারিত্রিক নীচতাকে সবচেয়ে খোলাখুলিভাবে দেখিয়ে দেয়।
উপন্যাসের গৌণ নারী চরিত্রদের মধ্যে রয়েছেন লেডি মিডলটন, তার মা মিসেস জেনিংস, মিসেস জেনিংসের ছোট মেয়ে মিসেস পালমার এবং ড্যাশউড পরিবারের ছোট মেয়ে তথা এলিয়নর ও ম্যারিয়ানের বোন মার্গারেট।
লুসি স্টিল চরিত্রটি সংক্ষিপ্ত পরিসরে এই উপন্যাসে থাকলেও উপন্যাসের ঘটনাক্রমের ওপর তার প্রভাব যথেষ্ট। তার প্রতি এডওয়ার্ড ফেরারের প্রায় একটি কৈশোরকালীন প্রেম তৈরি হয়েছিল এবং সে সময়েই এডওয়ার্ড তাকে বাগদান করেন। পরবর্তীকালে লুসি চরিত্রের সংকীর্ণতা এডওয়ার্ডকে ক্রমশ বিব্রত করতে থাকে এবং তিনি মানসিকভাবে তার দিক থেকে সরতে থাকেন। ইলিয়নর ড্যাশউডের প্রতি মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লেও লুসিকে করা বাগদান থেকে তিনি সরে আসতে পারছিলেন না। এই সম্পর্ক অবশ্য মিসেস ফেরার মেনে নিতে পারেন নি এবং এডওয়ার্ড ফেরারকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে তার ভাই রবার্ট ফেরারকে তিনি সব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করে দেন। সম্পত্তির উত্তরাধিকার এডওয়ার্ডের থেকে তার ভাই রবার্ট ফেরারের কাছে যাবার পরেই লুসি স্টিল তার অনুরাগের পাত্রকেও বদলে ফেলে। সম্পত্তির নয়া উত্তরাধিকারী রবার্ট ফেরারকে বিয়ে করে লুসি নিজেই নিজ চরিত্রের প্রকৃত দিকটি সবার সামনে উন্মোচিত করে দেয়।
লুসি যেমন নিজের খল স্বভাবকে প্রকাশ করে, তেমনি করে উইলোবি। নায়ক হিসেবে সে উপন্যাসের রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করেছিল, কিন্তু ঘটনাক্রম তার চরিত্রের নেতিবাচক ও অন্ধকার দিকগুলিকেই একের পর এক উন্মোচিত করে দিয়েছে। শঠ, অর্থলোভী, প্রবঞ্চক ও প্রতারক হিসেবেই সে এই উপন্যাসে উপস্থাপিত। দুটি ক্ষেত্রে তার প্রতারক চরিত্রটি সামনে এসেছে। ম্যারিয়ানেকে সে উপন্যাসের ঘটনাকালের মধ্যেই প্রবঞ্চনা করে। তবে এই তার প্রথম প্রবঞ্চনা নয়। এর আগে ব্রান্ডনের পালিত কিশোরী কন্যা এলিজা উইলিয়ামসেরও সে সর্বনাশ করেছিল। অর্থলোভে এক ধনী রমণী মিস গ্রেকে সে বিয়ে করে, কিন্তু পোয়েটিক জাস্টিস হিসেবেই বোধহয় তাতেও তার সুখহীন ছবিটির কথা জানিয়ে দেন আখ্যানকার। পরিশেষে নিজের কৃতকর্মের জন্য যদিও সে ম্যারিয়ানের কাছে ক্ষমা চায়, কিন্তু তাতে তার কালিমা মোচন হয় না। জেন অস্টেনের বিভিন্ন উপন্যাসে এই ধরনের বেশ কিছু প্রতারক চরিত্রকে আমরা পাই। প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস এর জর্জ উইকহ্যাম, নরল্যান্ড পার্ক উপন্যাসের হেনরি ক্রফোর্ড, এমা উপন্যাসের ফ্রাঙ্ক চার্চিল, পারসুয়েশন উপন্যাসের উইলিয়াম ওয়াল্টার এলিয়ট প্রভৃতির সঙ্গেই তুলনীয় জেন অস্টেনের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাসের জন উইলোবি চরিত্রটি। এরা সবাই উপন্যাসে প্রবেশ করে আকর্ষণীয় উজ্জ্বলতা নিয়ে, কিন্তু পরে তাদের মুখোশ খসে যায়, বেরিয়ে পড়ে প্রবঞ্চক প্রতারক মুখটি।
কর্নেল ব্রান্ডন ধনী, খানিক চুপচাপ নিস্তরঙ্গ, খানিকটা অনাকর্ষণীয় মাঝ বয়সী এক মানুষ হিসেবে উপন্যাসে প্রথম হাজির হন। তিনি জন মিডলটনের বন্ধু, যার আমন্ত্রণে ড্যাশউড পরিবার বার্টন পার্কে এসেছে। কর্নেল ব্রান্ডনের বিরাট পারিবারিক সম্পত্তি রয়েছে ডর্সটের ডেলাফোর্ডে। বন্ধু মিডলটনের কাছে তিনি মাঝে মাঝে বেড়াতে আসেন। এমন এক আগমন সূত্রেই তার সঙ্গে ড্যাশউড বোনেদের আলাপ হয়। কিন্তু তার শান্ত, চুপচাপ স্বভাব বৈশিষ্ট্যের জন্য এলিয়নর বা মারিয়ানে – কারো কাছেই সে খুব বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারে নি। পরে এলিয়নর তার প্রাথমিক নিরাসক্তি কাটিয়ে ব্রান্ডনের গভীর ও চিন্তাশীল মনের পরিচয় পায় এবং অসম বয়সী হলেও তারা পরস্পরের ভালো বন্ধু হয়ে ওঠে। এলিয়নর বুঝতে পারে ব্রান্ডনের খানিক চুপচাপ অন্যমনস্ক থাকা তার চরিত্র বৈশিষ্ট্য নয়, কোনও সমস্যাজনক অবস্থার বহিঃপ্রকশ। ক্রমশ সে জানতে পারে কর্নেল ব্রান্ডনের জীবনের যন্ত্রণাদগ্ধ অধ্যায়ের কথা। তার দাদা তাদের তুতো বোন এলিজা উইলিয়ামকে বিয়ে করেছিল তার বিরাট সম্পত্তির লোভে। কিন্তু এলিজা ব্যাভিচারী জীবন শুরু করলে সে এলিজাকে ডিভোর্স দিতে বাধ্য হয়। এইসময় কর্নেল ব্রান্ডন ছিলেন ইস্ট ইন্ডিজে। তিনি যখন ফেরেন তখন তার তুতো বোন এলিজা মরণাপন্ন। এলিজা তার অবৈধ সম্পর্কজাত ছোট্ট সন্তান, যার নামও রাখা হয়েছিল এলিজা, তাকে কর্নেল ব্রান্ডনের হাতে দিয়ে যান। উপন্যাসের ঘটনাক্রম শুরুর বছর পাঁচেক আগে তার মৃত্যু হলে কর্নেল ব্রান্ডন ডেলাফোর্ডের বিরাট সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। তুতো বোন এলিজার সন্তানকে তিনি মানুষ করতে থাকেন। জন উইলোবির কুনজর পড়ে কর্নেল ব্রান্ডনের পালিতা কন্যা কিশোরী এলিজার ওপর। সে তাকে বশ করে ভোগ করে ও তারপর পরিত্যাগ করে। এই ঘটনার পর থেকেই কর্নেল ব্রান্ডন উইলোবির চিরশত্রু হয়ে যান। পঁয়ত্রিশ বছরের কর্নেল ব্রান্ডন প্রেমে পড়েন সতেরো বছরের ম্যারিয়ানের। সে প্রেমে তিনি প্রথমে সাড়া পান নি। বরং ম্যরিয়ানেকে চোখের সামনেই আসক্ত হতে দেখেন চিরশত্রু উইলোবির প্রতি। উইলোবি তার প্রতারক সত্তাকে পুনরায় সামনে এনে ম্যারিয়ানেকেও প্রত্যাখ্যান করে। এই প্রত্যাখ্যানের শারীরিক মানসিক আঘাত যখন ম্যারিয়ানেকে প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী করে তুলেছে, তখন উইলোবি ড্যাশউড পরিবারের পাশে এসে দাঁড়ান প্রকৃত বন্ধুর মতো। ধীরে ধীরে ম্যারিয়ানে সুস্থ হয় ও কর্নেল ব্রান্ডনের প্রতি কৃতজ্ঞতাভরা ভালোবাসা জাগে তার মনে। কর্নেল ব্রান্ডন ম্যারিয়ানেকে বিয়ে করে ডেলাফোর্ডে থাকতে শুরু করেন আর তার আহ্বানে তার নিকট প্রতিবেশী হয়ে সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে থাকতে শুরু করে আর এক সদ্য বিবাহিত দম্পতি এলিয়নর এবং এডওয়ার্ড ফেরার।
এডওয়ার্ড ফেরার এই উপন্যাসের অন্যতম নায়ক। সে বোন ফ্যানি ড্যাশউড এবং মা মিসেস ড্যাশউডের থেকে আলাদা ধাতুতে গড়া এক মানুষ। সে ধনী পিতার সন্তান, তবে উত্তরাধিকার সূত্রে কতটা সম্পত্তি সে পাবে বা দৌ কিছু পাবে কীনা, সেটা নির্ভর করছে তার মায়ের করা উইলের ওপর। এডওয়ার্ডের মা চান তাঁর ছেলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য হোক, নামজাদা লোকেদের সঙ্গে তার ওঠাবসা হোক। বিয়ে হোক সম্ভ্রান্ত ও ধনী পরিবারে। তবে এডওয়ার্ড নিজে ঘরোয়া, চুপচাপ, খানিকটা লাজুক ধরনের যুবক। মায়ের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণের দিকে এগোতে সে একেবারেই আগ্রহী হয় না। প্রথমে সে যাকে বাগদান করেছিল সেই লুসি এবং পরে ঘটনাচক্রে যে তার বাগদত্তা ও স্ত্রী হয় সেই এলিয়নর – দুজনেই অত্যন্ত সাধারণ পরিবারের মেয়ে। এই পছন্দের জন্য তার মা মিসেস ফেরার তাকে প্রথমে সব সম্পত্তি থেকেই বঞ্চিত করেছিলেন। এই ঘটনা পরম্পরা যে এডওয়ার্ডের অচিন্তনীয় ছিল, তা নয়। নিজের মা ও মায়ের মন্ত্রণাদাতা দিদিকে তার ভালোই জানা ছিল। সুযোগলোভী ভাইয়ের চরিত্র প্রকৃতিও তার অজানা থাকার কথা নয়। পরিবারের বিপরীতে গিয়ে বিপুল সম্পত্তি সে একার্থে সচেতনভাবেই হারিয়েছে বলা যায়। প্রেমের জন্য এই আত্মত্যাগই এডওয়ার্ডকে মহৎ ও উপন্যাস পাঠকের প্রিয় করে তোলে। প্রশ্ন হল এডওয়ার্ড কীভাবে তার পরিবারের অন্যদের থেকে এত আলাদা হল ? জেন অস্টেন ইঙ্গিৎ করেন তার মেধা ও বহুপঠনের দিকে। সে শুধু যে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাই নয়, বহুপাঠী মুক্তচিন্তক এমন এক যুবক যার পড়াশুনো তাঁকে শুধু জ্ঞান নয়, বোধ ও অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছে। জেন অস্টেন যখন এই উপন্যাস লিখছেন ও তার চরিত্রপাত্ররা যে সময়ের প্রতিনিধিত্ব করছে, সেই সময়টা ফরাসী বিপ্লবের। সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার উদার হাওয়া ফ্রান্স থেকে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ততদিনে ভালোভাবেই প্রবেশ করেছে ব্রিটেনের আকাশে বাতাসে। সেই নতুন সময়ের যুবক বলেই কি সামাজিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণে টানা বর্গের বেড়াজালকে এডওয়ার্ড এত সহজে ভাঙতে পারে? সরাসরি এমন কোনও ইঙ্গিৎ জেন অস্টেনের উপন্যাসে নেই, কিন্তু পারিবারিক রক্ষণশীলতাকে যেভাবে স্বার্থত্যাগ করে ভাঙে এডওয়ার্ড, তাতে এরকম ভাবনা পাঠকের মনে না এসে পারে না।
---
1. “Believing in her work and determined to be a published author, Jane Austen took a financial risk and published the novel on a commission basis. In this arrangement, she paid for the production and advertising of Sense and Sensibility, gave Egerton a commission for distributing and selling the book, and kept the remaining profit from the sales.”
- https://jasna.org/austen/works/sense-sensibility/
2. আর্থিক হিসেব নিকেশের কিছু তুলনামূলক আলোচনা করেছেন প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস উপন্যাসের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় সংস্করণের সম্পাদক এডওয়ার্ড কোপেল্যান্ড। উক্ত বইয়ের গ্রন্থ ভূমিকায় তিনি জানাচ্ছেন “The established novelist Charlotte Smith (1749–1806) regularly received around £150 for the copyright to her novels, or £50 a volume, though she complained bitterly that others got more. Susan Ferrier (1782–1854) was paid by the publisher John Blackwood £150 for the copyright to her first novel Marriage (1818), but that was after Walter Scott had altered the price structures for novels, and even then it was a previously unheard of price for a first novel.” ফলে জেন অস্টেনের মতো সাহিত্য দুনিয়ায় তখনো অবধি অপরিচিত একজন নবীন লেখকের জন্য ১৪০ পাউন্ড প্রাপ্তি বেশ উল্লেখযোগ্য অঙ্ক বলেই মানতে হবে।