বেকারত্ব : সমীক্ষা কি বলছে ?

দেশের সামগ্রিক জিডিপি কত বেশি বা কম সেটা পরিসংখ্যান, কিন্তু দেশের মানুষ সরাসরি অনুভব করে তাঁদের আয়, তাঁদের কাজের যোগান, কাজের গুণগত মান, কাজ চলে যাওয়ার ঝুঁকি, কাজের মজুরি এইসব। পরিসংখ্যান দিয়ে মানুষের অনুভূতিকে পাল্টানোর চেষ্টা এক্ষেত্রেও করার চেষ্টা শুরু হয়েছে। অতি সম্প্রতি ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্কের গবেষকরা একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে জাতীয় নমুনা সমীক্ষা অফিসের দ্বারা প্রকাশিত পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভের (পিএলএফএস) হিসেব অনুযায়ী দেশের বেকারির হার গত ৫ বছরে ৬.১% থেকে কমে ৩.২%এ নেমে আসার কথাকে প্রতিষ্ঠিত ও সত্য বলে ঘোষণা করেছে। যেহেতু সেন্টার ফর ইন্ডিয়ান ইকোনোমি (সিএমআইই) দ্বারা নিয়মিত কর্মসংস্থান ও বেকারি সংক্রান্ত পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়, এবং সেই পরিসংখ্যান অনুসারে দেশে বেকারির হার উপরোক্ত পিএলএফএস-এর হারের দ্বিগুণের বেশি তাই ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্কের গবেষকরা বলেছেন যে দেশে শ্রমক্ষেত্রে যে কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটেছে তা সিএমআইই সমীক্ষা ও পরিসংখ্যান ধরতে পারছে না। মুদ্রা যোজনা, স্বনিধি প্রকল্প এই সমস্ত কর্মসূচির মাধ্যমে দেশে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে তার ফলে দেশের মানুষ আর বসে নেই।

যদিও ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্কের গবেষকরা ‘রাজনৈতিক’ কোনো উদ্দেশ্যে গবেষনাপত্রটি লেখেননি, তবুও তাঁরা বলেছেন, বেকারি সবসময়ই একটি বিতর্কিত ও রাজনৈতিক বিষয়, বিশেষত উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে, তাই এটি কোনো আশ্চর্যের বিষয় নয় যে যদিও পিএলএফএস সমীক্ষার তথ্য অনুসারে গত ৫ বছরে বেকারির হারে উল্লেখযোগ্য হ্রাস ঘটেছে তবুও সাধারণের মধ্যে, পুরোনো ঘরানার বাগাড়ম্বর সমৃদ্ধ কিছু রাজনৈতিক, কিছু অর্থনৈতিক ভুল এবং অজ্ঞ তথ্য বিশ্লেষণের প্রবণতা রয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে যে বা যারা সরকারের ওই বেকারি হ্রাসের তথ্যকে মানতে চাইছে না তাঁরা সব বাগাড়ম্বর করছেন ও মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছেন।

তবে মানুষ কেমন বুঝছে? কাজের যোগান বাড়লে মজুরি বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। পিএলএফএস সমীক্ষা অনুসারে ২০১৭-১৮ সালে ক্যাজুয়াল শ্রমিকের গড় মজুরি ছিল দৈনিক ৩১৬ টাকা, ২০২২-২৩ সালে ছিল ৪০৩ টাকা। কিন্তু ভোগ্যপণ্য সূচক অনুসারে ২০১৭-১৮র ৩১৬ টাকা ২০২২-২৩ সালে বেড়ে দাঁড়াবে ৪০৮ টাকা। ফলে ওই মজুরি বাড়েনি, বরং একটু কমেছে। অপরদিকে স্থায়ী শ্রমিকের মাসিক গড় মজুরি ছিল ২০১৭-১৮ সালে ১৭,৪৭৩ টাকা ও ২০২২-২৩ সালে তা হয়েছে ২০০৩৯ টাকা। ভোগ্যপণ্য সূচক অনুসারে  ২০১৭-১৮ সালে৪ ১৭,৪৭৩ টাকা ২০২২-২৩ সালে বেড়ে দাঁড়াবে ২২,৫০৮ টাকা। এক্ষেত্রে বাস্তব মজুরি অনেকটাই কম। ফলে শ্রমচাহিদা বাড়ার ফলে কর্মসংস্থাম বেড়েছে বা বেকারি কমেছে এমনটা ধরা যাচ্ছে না।

অপরদিকে পিএলএফএস সমীক্ষা অনুসারে ২০১৭-১৮ সালে মোট কর্মসংস্থানে অনিয়মিত শ্রমিকের অনুপাত, নিয়মিত শ্রমিকের অনুপাত ও স্বনিযুক্তির অনুপাত ছিল যথাক্রমে ২৪.৯%, ২২.৮% ও ৫২.২%। যা ২০২২-২৩ সালে হয়েছে ২১.৮%, ২০.৯% ও ৫৭.৩%। দেখাই যাচ্ছে নিয়মিত শ্রমিকের অনুপাত হ্রাস পেয়েছে সর্বাধিক, আর স্বনিযুক্তির অনুপাত বেড়েছে যথেষ্ট। এই স্বনিযুক্তির মধ্যে ঘরোয়া সংস্থায় সাহায্যকারীদের অনুপাত ১৩,৬% থেকে বেড়ে ১৮.৩% হয়েছে। ফলে, বোঝাই যাচ্ছে সামগ্রিকে শ্রমনিয়োগের ক্ষেত্রে অসংগঠিত ও অনিয়মিত শ্রমিকের অনুপাত বাড়ছে। যা অবশ্যই কর্মসংস্থানের এক নেতিবাচক অবস্থানকেই প্রতিফলিত করে।

এসব গেল পরিসংখ্যান বিশ্লেষণের কথা। গবেষকরা তো বলেইছেন এসব বাগাড়ম্বরপূর্ণ অজ্ঞতা বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিশ্লেষণ। কিন্তু সাদা চোখে মানুষ কী বুঝছেন? এটা ঘটনা যে, দেশে সাক্ষরতা ও শিক্ষাগ্রহণের হার বেড়েছে। যে সমস্ত নিম্নআয় বর্গের মানুষদের সন্তানরা বিদ্যালয় শিক্ষার আঙিনায় ঢুকত না তারা এখন অনেকেই উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করছে। কর্মসংস্থানের কোন বন্দোবস্ত তাঁদের জন্য খোলা রেখেছে সরকার? অত্যন্ত অনিয়মিত ও অস্থায়ী কাজ বেসরকারি সংস্থাগুলিতে তো বটেই, সরকারি সংস্থা মায় সরকারি দফতরে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের নিত্যিদিনের কাজে যে গাড়ি ব্যবহৃত হয় তার চালক, দফতরের নিরাপত্তারক্ষী, ব্যাঙ্কের নিরাপত্তারক্ষী প্রায় সর্বত্রই অপর কোনো সংস্থা থেকে ভাড়া করা হয়; ক্রেতা পরিষেবার কাজ তো কবেই আউটসোর্স করা শুরু হয়েছে। ফলে নিরাপদ ও ভদ্রস্থ মাসিক বেতনের চাকুরি ক্রমাগত কমছে। এতদসত্বেও মাসিক বেতনের কাজ ওই নিম্নআয় বর্গের মানুষদের সন্তানদের স্মাতক মায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পরেও জুটছে না। এরকম কর্মপ্রার্থীরা স্বনিযুক্ত হচ্ছে। স্বনিযুক্তদের গড় মাসিক আয় কমছে। পিএলএফএস সমীক্ষা অনুসারেই ২০১৭-১৮ সালে স্বনিযুক্তির ক্ষেত্রে গড় মাসিক আয় ছিল ১৪,৮৭৮ টাকা তা ২০২২-২৩এ কমে দাঁড়িয়েছে ১৩,৩৪৭ টাকা; ২০১৭১-১৮র সমান গড় হতে গেলে, মূল্যসূচক অনুসারে তা হওয়া উচিত ১৯,১৬৩ টাকা। ফলে সে অর্থে স্বনিযুক্ত শ্রমের মাসিক গড় আয় কমেছে ৪৪%। কর্মসংস্থানের উচিত বন্দোবস্ত না থাকলে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক।

স্টেট ব্যাঙ্কের গবেষকগণ সরকারের কর্মসংস্থান সঙ্কোচনের ক্রিয়াকলাপের সমালোচনাকে বাগাড়ম্বরপূর্ণ বলেছেন। তাঁরা সম্ভবত উচ্চমার্গের  বাসিন্দা। রাত দুটোর সময় আকাঙ্খা হলেই এ্যাপে হুকুম জারি করে ২০ মিনিটের মধ্যে খাদ্য ও পানীয় পেতে অভ্যস্থ সেইসব মানুষজন ওই ডেলিভারি বয়দের, কোনো কোনো এ্যাপে যাদের নাম ডেলিভারি পার্টনার, কাজ পাওয়াকে কোন ধরণের কর্মসংস্থানের অন্তর্ভুক্ত করবেন, তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে, কিন্তু ওই যুবকদের কাজগুলি যে সুস্থ বিধিসম্মত নয় সে বিষয়ে দ্বিমত থাকতে পারে না। কোনো ন্যুনতম মজুরির আওতায় তাঁরা আসেন না। গাড়ি ভাড়ার এ্যাপে ডাকলেই গাড়ি চলে আসে কিন্তু কোনো পিএফ বা ইএসআই বা পেনশনের বন্দোবস্ত চালকের জন্য করা হয় না। নিয়মিত ও উচ্চ বেতনের নিরাপদ গবেষকরা পরিসংখ্যানে কর্মী হিসেবে সেই সমস্ত শ্রমিকদের নিজেদের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে নেবেন, কিন্তু সমাজের অন্যত্র সমাসনে বসাবেন না। ফলে পিএলএফএস  বা সিএমআইই সমীক্ষা কোনোটাই কর্মসংস্থানের গুণগত চরিত্রকে সামগ্রিকে ধরতে অপারগ।  যারা প্রথাগত সমীক্ষার বাইরে দৈনন্দিন রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ান, মানুষের কথা অল্পবিস্তর শোনেন, রাস্তার দুধারে, পাড়ায় পাড়ায় অবিরত খাবারের দোকান, চায়ের দোকান খুলতে ও বন্ধ হতে দেখেন, বাজারে সব্জি বা মাছ বিক্রেতা নিজের ছেলে বা মেয়েকে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর অবধি পড়ানোর পরে একটি চাকুরির বন্দোবস্ত করে দেওয়ার জন্য ক্রেতাবাবুর কাছে নিবেদন করতে দেখেন, চেষ্টা করলে তিনি অনুভব করতে পারেন দেশের বেকারি বা কর্মসংস্থানের হাল। গবেষকগণ অন্যরকম ভাবতে পারেন। কিন্তু অন্ধ হলে কি আর প্রলয় বন্ধ থাকে?