রাষ্ট্রীয় নজরদারী - টেলিকম আইন ২০২৩

আমরা সবাই জানি, যে বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবারের ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে কী ভূমিকা ছিল। যখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে, তখন বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবার সেই আন্দোলনে অংশ না নিয়ে কী করে, তাঁদের সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, তা আজ অন্তত নতুন করে বলে দিতে হবে না। কিন্তু নতুন প্রজন্ম, যাঁদের বেশীরভাগের শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম, হোয়াটসঅ্যাপ এবং সামাজিক মাধ্যম, তাঁরা কি এই সারসত্যটা জানে? জানে না বলেই, আজকের কেন্দ্রের শাসকদল ঔপনিবেশিক আমলের যত আইন ছিল, সেগুলোরই নাম বদলে, নতুন করে আনার চেষ্টা করছে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে, আসলে একটা বড় কাজ তাঁরা করছে। একদিকে তাঁরা দেখাতে পারছে, তাঁরা ঔপনিবেশিক শাসনের কোনও চিহ্নই রাখতে চান না, তাঁরা ব্রিটিশ বিরোধী, অন্যদিকে, আজকের সময়ের মতো করে, নতুন আইনগুলোকে আরো শক্তিশালী, আরো ভয়ঙ্কর বানিয়ে তুলে দেশের নাগরিকদের জীবনে আরো নজরদারির আওতায় নিয়ে আসা যাবে। আরো একটা কথা এখানে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, যখন ভারতের সঙ্গে চীনের সীমান্ত নিয়ে বিরোধ বাধে, তখন বিজেপির তরফ থেকে মাঝেমধ্যেই চিনা পণ্য বয়কট করার ডাক দেওয়া হয়, পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ বা স্বদেশী পণ্য ব্যবহার করার কথা বলেন, অথচ যখন টেলিকম বিল বা পোষ্টাল বিল সংসদে পেশ হয়, তখন দেখা যায়, চীনের অনুকরণেই সেই সব বিল তৈরী হয়েছে। চীনে যেভাবে প্রতিটি নাগরিকের দৈনন্দিন প্রতিটি পদক্ষেপ নজরদারির আওতায়, সেভাবেই ভারতকেও ধীরে ধীরে নিয়ে যাওয়ার যে চেষ্টা চলছে, তা কি নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে?

যে সংসদের সিঁড়িতে প্রণাম করে, ২০১৪ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী সংসদে প্রবেশ করেছিলেন, সেই সংসদকেই কি বিরোধী মুক্ত করতে চাইছে দেশের শাসক দল? এই প্রশ্নটিই আপাতত ঘুরছে, সংসদে, যেখানে লোকসভা এবং রাজ্যসভা মিলিয়ে গত তিনদিনে বিরোধী দলের প্রায় ১৫০ জন সাংসদকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দেশজুড়ে যা নিয়ে চর্চাও শুরু হয়েছে। তাহলে কি সরকার কি সংসদে বিতর্ক চাইছে না? তাঁরা কি বিনা বিতর্কে, বেশ কিছু বিল পাশ করিয়ে নিতে চাইছে, যা দেশের নাগরিকদের জন্য আরো বিপজ্জনক? না হলে, এই ধরনের আচরণ কেন করছে শাসক দল? অনেকে বলছেন, নতুন যে টেলিকম রেগুলেটারি বিল এবং পোষ্টাল সংশোধনী বিল পাশ করানো হয়েছে তার মধ্যে দিয়ে ভারতকে আরো নজরদারি রাষ্ট্র বানানোর দিকে নিয়ে যেতে চাইছে এই সরকার, তাতে যাতে বিরোধীরা কোনও বাধা না সৃষ্টি করতে পারে, সেই জন্যেই কি সচেতন ভাবে, এই কাজটি করছে শাসক দল? প্রধানমন্ত্রীর বিরোধীদের উদ্দেশ্যে বক্রোক্তি শুনে অন্তত তাই মনে হচ্ছে। না হলে ১৩৮ বছরের পুরোনো টেলিগ্রাফ আইনকে কি শুধুমাত্র আধুনিক করার জন্যেই পাল্টানো হলো, না কি তার পিছনে অন্য কিছু আছে?

নতুন যে টেলিকম বিলটি আনা হয়েছে, তার মধ্যে দিয়ে সরকার বলছে, কিছু পদ্ধতিগত জটিলতার তাঁরা সমাধান করতে চায়। টেলিকম সংক্রান্ত পরিকাঠামো তৈরী করতে যা বাধা ছিল, আগের আইনের ফলে, নতুন আইন দিয়ে তাঁরা সেই বাধাগুলোকে সরিয়ে ফেলতে চায়। শুধু তাই নয়, নতুন আইন অনুযায়ী, সরকার জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থ দেখিয়ে, সাময়িকভাবে কিছু সময়ের জন্য হলেও সরকার এই টেলিকম পরিষেবাকে সম্পূর্ণ নিজেদের নিয়ান্ত্রনাধীন রাখতে চায় এবং কে বা কারা এই টেলিকম পরিষেবার স্যাটেলাইট স্পেকট্রামের বরাত পাবে, তা কোনও দরপত্র ছাড়াই করার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। যদিও কোন কোন ক্ষেত্রে সরকার এই দরপত্র ছাড়াই, বরাত পাবে, তা স্পষ্ট করেই বলা আছে, কিন্তু যে ২জি স্পেকট্রাম দুর্নীতি নিয়ে ২০১৪ সালের আগে এতো শোরগোল পড়েছিল, সেই পদ্ধতিই যদি আইন করে নিয়ে আসা হয়, তাহলে আর কি জন্য ‘দুর্নীতি দুর্নীতি’ বলে চিৎকার করা? যে কোনও সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার ক্ষেত্রে পরিকাঠামো দিতে, যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, সেই জন্যেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অবশ্য পাশাপাশি নাগরিকদের জন্যেও বেশ কিছু কথা বলা হয়েছে। ব্যবহারকারীরা, নানান সময়ে যাতে, বিভিন্ন মেসেজ এবং ফোনে বিরক্ত না হন, তার জন্যেও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু সরকারকে কি এই প্রশ্নটা করা উচিৎ নয়, যে ঐ সংস্থারা কী করে আমাদের ফোন নম্বর পাচ্ছেন? তথ্য সুরক্ষা বিল কি কার্যকরী হয়েছে, যদি হয়ে থাকে, তাহলে একজন ব্যক্তি নাগরিকের ফোন নম্বরটি কেন সুরক্ষিত নয়? আসলে আমাদের মতো দেশে, যেখানে বেশীরভাগ মানুষেরই তথ্য সংক্রান্ত সচেতনতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে, সেখানে টেলিকম আইনে কিছু পদক্ষেপ নিলেই কি এই সমস্যার সমাধান হবে?

আরো বেশ কিছু কথা বলা হয়েছে আইনে, যা পড়লে রীতিমত শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাবে। অনুমতি ছাড়া, কোনও ব্যক্তি বা সংস্থা, এই টেলিকম পরিষেবা দিতে পারবে না, এমনকি অঞ্চল স্তরে কোনও রেডিও পরিষেবা দিতে গেলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর কিংবা ব্যক্তির থেকে অনুমতি নিতে হবে। কোনও জরুরি অবস্থা তৈরী হলে, কিংবা কোনও আপতকালীন সমস্যার সৃষ্টি হলে, সরকার অনুমতি দিলে, তবেই কোনও ব্যক্তি বা সংস্থা টেলিকম পরিষেবা দিতে পারবেন। যে বিল পাশ হয়েছে, তাতে ইন্টারনেট নির্ভর ফোন এবং সাধারণ মেসেজকেও টেলিকমিউনিকেশনের আওতায় আনা হয়েছে। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিককে নজরবন্দী করতে চায়। কিছুদিন আগে পেগাসাস সফটওয়ারের কথা আমরা শুনেছি। ইজরায়েলের এই সফটওয়ার কীভাবে একজন ব্যক্তির ফোন কিংবা ল্যাপটপে বাইরে থেকে প্রবেশ করিয়ে, তাঁদের ওপর চোখ রাখা যায়, তা আমরা অনেকেই জানি। সেই বিষয়কে কেন্দ্র করে, দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মামলা অবধি হয়েছে, যাতে যথেষ্ট মুখ পুড়েছে সরকারের। কিন্তু নতুন টেলিকম আইনে, এইসব কিছুরই আর প্রয়োজন থাকবে না। কোনও মানুষের কোনও কিছুই আর ব্যক্তিগত থাকবে না, এমনকি রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক ব্যক্তিদের পরিষেবা বন্ধও করে দিতে পারে সরকার। এখন সরকার কাকে, মনে করবে, রাষ্ট্রের জন্য অসুবিধাজনক, তা তো রাষ্ট্রই ঠিক করবে। যেখানে বিরোধী সাংসদেরা সংসদে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করছেন বলে তাঁদের বহিষ্কার করতেও পিছপা হচ্ছে না সরকার, সেখানে একজন সাধারণ নাগরিক যদি সরকার বিরোধী কোনও কথা বলেন, তাহলে তাঁকে ‘বিপজ্জনক’ তকমা দিয়ে, তাঁর সমস্ত পরিষেবা বন্ধ করতে কি একবারও ভাববে আজকের শাসকেরা?