আনাল গোষ্ঠী এবং ইতিহাসবিদ্যার বাঁকবদল

মানুষের চিন্তা চর্চার ইতিহাসে বিংশ শতাব্দীর ফ্রান্স এক অপার বিস্ময়। আলেক্সান্দ্রে কোজেভের কাছে হেগেল পাঠ নিয়ে এবং হুসার্ল, হাইডেগার পড়ে অস্তিত্ববাদ, সস্যুরের কাছে ভাষাবিজ্ঞান পাঠ নিয়ে কাঠামোবাদ এবং তৎপরবর্তী উত্তর-কাঠামোবাদ, লেভি-স্ট্রসের নৃতাত্ত্বিক বাঁকবদল, লাঁকানীয় মনোবিশ্লেষণ সহ সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ কূলে এসে ধাক্কা লাগার মতো চিন্তার জগতে একের পর এক ধাক্কা দিয়ে গেছে। এর ব্যতিক্রম ঘটেনি ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রেও। লুসিয়েঁ ফেভর ও মার্ক ব্লখ প্রতিষ্ঠিত আনাল পত্রিকা ছিল এই বিপ্লবের গোড়ায়। তবে এটাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, শুধুমাত্র আনাল গোষ্ঠির ইতিহাস চর্চার মধ্যে বিংশ শতাব্দীর ফরাসী ইতিহাস চর্চা সীমাবদ্ধ ছিল না। আরো অনেক ধারা, উপ-ধারা এর মধ্যে প্রবাহিত ছিল। একই সাথে এটাও মনে রাখতে হবে, আনাল গোষ্ঠি একক এবং সম্পূর্ণ সমরূপ (homogeneous) কোনো গোষ্ঠি ছিল না। স্বাভাবিকভাবে এরও নানা দ্বন্ধ-সংকট ছিল।

এই গোষ্ঠীর সাথে সংযুক্ত হয়েছিলেন অনেকেই। তাদের মধ্যে সবাই না হলেও উল্লেখযোগ্য একটা অংশ বিদ্বান মহলে পরিচিত। কিন্তু স্থান সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের সকলের কর্মব্যাপ্তি এবং কর্মের প্রবণতা নিয়ে এই প্রবন্ধে আলোচনা করার সুযোগ নেই। এই প্রবন্ধে আমরা আনাল গোষ্ঠীর উৎপত্তির প্রেক্ষাপট, তার প্রধান ধারা এবং উপধারা, এবং সময়ের সাথে সাথে এ গোষ্ঠী তার মনোভঙ্গির যেসকল বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে তা গুরুত্ব দিয়ে দেখার চেষ্টা করবো।

 

প্রেক্ষাপট

প্রাচীন গ্রিসে হেরোডোটাস, থুকুদিদিসকে দিয়ে ইতিহাস চর্চার যে ধারা প্রবর্তিত হয়েছিল সেটা কালের পরিক্রমায় নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে ফরাসী দেশেও পৌছেছিল। ফরাসী দার্শনিক ভলতেয়ারকে ইতিহাস দর্শনের জনক নামে সম্বোধন, এরই দৃষ্টান্ত। এই ধারা পরবর্তীতে অগাস্ত কোঁৎ, জুল মিশলে, মিন্যে, থিয়ের, ত্যেন, ওলার হয়ে লুসিয়েঁ ফেভর ও মার্ক ব্লখে পৌঁছেছিল।

অগাস্ত কোঁৎ (১৭৯৮-১৮৫৭) ছিলেন দৃষ্টবাদী দর্শনের প্রবক্তা। সেন্ট সাইমনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনিও রাজনৈতিক ঘটনার মধ্যে থেকে সাধারণ সূত্র আবিষ্কারে আগ্রহী ছিলেন, যার ফল দেখা যায় তার সমাজতাত্ত্বিক লেখাপত্রে। তিনি মনে করতেন, ইতিহাস হলো জ্ঞানরাজ্যের অন্যান্য শাস্ত্রের মতোই স্বতন্ত্র একটি শাখা, যা সাধারণ কিছু বিধান মেনে চলে। রসায়ন, পদার্থবিদ্যা বা শরীরবিদ্যায় যেসব সাধারণ বিধান আছে তা মানব ইতিহাস চর্চায় প্রয়োগ করা যায় বলে মনে করতেন তিনি। এর মধ্যে দিয়ে তিনি সমাজের নিয়মবিধি বা গতিসূত্র (social dynamics) নির্ণয়ে প্রয়াসী হয়েছিলেন।

কোঁতের এই ধারার পাশাপাশি তৎকালীন ফ্রান্সে আরেকটি স্রোত প্রবাহিত হচ্ছিলো ঐতিহাসিক মিশলের (১৭৯৮-১৮৭৪) হাত ধরে। মিশলের লেখাগুলো মোটাদাগে দু’ভাগে বিভক্ত করা যায়, যার এক অংশ ফ্রান্সের ইতিহাস এবং অপর অংশ ফরাসী বিপ্লবের ইতিহাস। মিশলের রোমান্টিক ভাবধারার মাধ্যমে ‘জনগণ’ বা ফরাসী “le peuple” ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে উপনিত হয়। মিশলে বলেন তিনি ওসব মানুষের ইতিহাস লিখতে চেয়েছেন, ‘the history of those who have suffered, worked, declined and died without being able to describe their sufferings.’

মিন্যে, থিয়ের এবং ইপ্পোলিত ত্যেনের ফরাসী বিপ্লব সংক্রান্ত লেখাপত্রে তাদের পূর্বসূরিদের প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট। ত্যেনের L’ Ancien Regime (1876) এ আমরা দেখতে পাই ডারউইনের মতো তিনিও প্রাকৃতিক পরিবেশ ব্যক্তি ও জাতির ভাগ্য নির্ধারণে কিভাবে ভূমিকা রাখে তা খুঁজতে সচেষ্ট। তিনিও কোঁৎ বর্ণিত সমাজতাত্ত্বিক বিধান অন্বেষণে আগ্রহী।

এরপরে ১৮৮৬ সালে সরবোনে ওলারের ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হওয়াটা ফ্রান্সে ইতিহাস চর্চার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কেননা, এর পূর্বে বিপ্লবের ইতিহাস পাঠে এরকম প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের নজির নেই। ওলার তৃতীয় রিপাবলিকের সন্তান; ফলে তার মধ্যে কিছুটা জাতীয়তাবাদী মনোভাব লক্ষণীয়।  তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর পাশাপাশি যেসব পুস্তকাদি লিখেছেন এবং বিপ্লবের ইতিহাসের যেসব দলিলাদি সম্পাদনা করেছেন তাতে জার্মান ঐতিহাসিক লিওপল্ড ফন রাঙ্কের ইতিহাস দর্শনের প্রভাব সুস্পষ্ট। রাঙ্কে চাইতেন ঐতিহাসিক যেন সাবজেক্টিভ জাজমেন্ট না দেন। তার মতে, মহাফেজখানা হতে প্রাপ্ত তথ্য (fact) সাজিয়ে গেলে, তথ্য নিজেই কথা বলবে।

বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে উপরোক্ত মতবাদ গুলোর একটা সমন্বয় দেখা যায় ল্যাঙ্গলোয়া এবং সিনোঁব রচিত ‘ইতিহাসশাস্ত্র অধ্যয়নের ভূমিকা’ (L’Introduction aux études historiques (1897)’ গ্রন্থে। এটাও উল্লেখ্য যে, এতে রাঙ্কে প্রভাবিত পজিটিভিজমের প্রাধ্যান্য ছিল বেশি।

বিদ্রোহ এবং আনালের প্রতিষ্ঠা

ফরাসী ইতিহাসবিদ্যায় (historiography) এই যখন অবস্থা, তখন প্রথম সমালোচনাটা এলো রেভ্যু দ্য স্যাঁথেস ইস্তোরিকের সম্পাদক আঁরি বেরের কাছ থেকে, যিনি বর্তমানে দার্শনিক হিশেবে বিদ্বান মহলে অত্যধিক পরিচিত। একথা অজানা নয় যে, হেগেল পরবর্তী সকল দার্শনিকই কম-বেশি ইতিহাস নিয়ে ভেবেছেন, যার প্রতিফলন আমরা বেরের মধ্যেও দেখি। তৎকালীন প্রথাগত ঐতিহাসিকদের নিজেদের শাস্ত্রকে স্বতন্ত্র এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবার যে মনোভঙ্গি – ইতিহাসের সমাজতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, অর্থনীতি থেকে কিছু শেখার নেই – তার সমালোচনা করেছিলেন বের। বের বলতে চাইলেন অন্যান্য শাস্ত্রের সাথে আদান প্রদান ব্যতীত ইতিহাস শাস্ত্র হিশেবে সম্পূর্ণতা পেতে পারে না।  

এইসময়ে তার ডেরায় হাজিরা দিতে আরো অনেকের সাথে লুসিয়েঁ ফেভরও নিয়মিত যেতেন; মার্ক ব্লখও যোগ দেন শেষের দিকে। ফেভর এবং ব্লখের ১৯১৯ সালে নিজেদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হওয়ার পূর্বেই তাদের বেশকিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। এবং তখনকার লেখাপত্রে তাদের প্রথাগত চিন্তা থেকে বের হয়ে আসার একটা প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। এটা বলা নিশ্চয়ই অতিকথন হবে না যে, তাদের চিন্তা প্রায় সমান্তরালে আগাচ্ছিল। এবং এর কাঙ্খিত ফলাফল আসল ১৯১৯ সালে, যখন তারা দুজনই স্ত্রসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় আসলেন। তারা দুজনই বেরের রেভ্যু’র প্রতি অনুরক্ত ছিলেন, তারা এও মনে করতেন যে কোঁৎ প্রভাবিত ইতিহাসবিদ্যা (historiography) তাদের কাঙ্খিত ইতিহাস রচনায় সহযোগী নয়। আঁরি বের রেভ্যু’তে এসবেরই সমালোচনা করে যাচ্ছিলেন কিন্তু রেভ্যু’কে ফেভর এবং ব্লখ উভয়েই অনেক বেশি তাত্ত্বিক কচকচানি ভাবলেন। তারা বরং প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন প্রায়োগিক ইতিহাসবিদ্যা, যাতে তারা এমিল দুর্খেইম প্রবর্তিত সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগে সচেষ্ট হতে চাইলেন। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯২৯ সালে ১৫ই জানুয়ারি স্ত্রাসবুর্গে প্রকাশিত হলো Annales d'histoire économique et sociale এর প্রথম সংখ্যা। পরে এই নাম বেশ ক’বার পরিবর্তনও করা হয়। এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীতে গড়ে উঠে আনাল গোষ্ঠী। যাদের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় সামগ্রিক বা সার্বিক ইতিহাসের (Total History) ধারণা, মনোভঙ্গি কিংবা মেন্টালিটির (Mentalités) ইতিহাসের ধারণা, দেশ-কালের প্রথাগত ভেদরেখা ভেঙ্গে এক নতুন ইতিহাসের ধারণা।

আনালের প্রথম যুগ

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যুদ্ধবন্দী থাকা অবস্থায় রচিত ‘ইতিহাস লেখকের কাজ’ গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে ফেভরকে উৎসর্গ করে ব্লখ লিখছেন, “এই সৃষ্টি আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপ-আলোচনার ফলপ্রসূ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দিয়ে এর এতদিনকার মৌলিক মতৈক্যের সর্বক্ষণের ছন্দকে লোকসমক্ষে বাঁচিয়ে রাখবে। আমি যা প্রতিষ্ঠা করতে চাই এরকম একাধিক ধারণা অবশ্যই আমি সরাসরি আপনার কাছ থেকে নিয়েছি। আরও বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে , সেগুলি আপনার, আমার বা দুজনেরই কি না আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না। প্রায় সময়েই আপনার সম্মতি পাব বলে আমি আত্মতৃপ্তি অনুভব করছি।” এই পাণ্ডুলিপি প্রকাশকালীন মন্তব্য করতে গিয়ে ফেভরও ব্লখের কথায় সায় দিয়েছেন। উল্লেখিত গ্রন্থে আনালের প্রাথমিক যুগের মনোভঙ্গির সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটে। দূর্ভাগ্যজনকভাবে ব্লখ এই বই রচনা সম্পূর্ণ করার আগেই মারা যান, যদিওবা পরে ইতিহাসবিদ্যায় এই গ্রন্থ ধ্রুপদীর রচনার মর্যাদা অর্জন করেছে।

ফেভর জন্মেছিলেন উত্তর-পূর্ব ফ্রান্সে, ১৮৭৮ সালে। বিশ বছর বয়সে তিনি ফ্রান্সের বিখ্যাত শিক্ষায়তন একোল নর্মালে পড়তে যান। ‘স্পেনের দ্বিতীয় ফিলিপ এবং ফ্রান্স কোঁৎ’ শিরোনামে যে থিসিস তিনি লিখছিলেন তাতেই রাজা-রাজড়ার মহাকীর্তির প্রথাগত ইতিহাসের গণ্ডি ভাঙার প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। বিশেষত ভিদাল দ্য লা ব্লাঁশের ভূতাত্ত্বিক চিন্তার প্রতিফলন স্পষ্ট। যদিওবা অভিসন্দর্ভের শিরোনামে তা ধরা পড়ে না।  পরবর্তীতে মার্টিন লুথারের রিফরমেশন আন্দোলন এবং রাবলের সাহিত্যকে কেন্দ্র করে ষোড়শ শতকে অবিশ্বাসের সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তাদের পরিকল্পিত সার্বিক ইতিহাস বা Total History এর ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ফেভরে এসে আমরা দেখি ঘটনা (event) কেন্দ্রিক ইতিহাসকে এড়িয়ে গিয়ে তিনি সমস্যা কেন্দ্রিক (problem-oriented) ইতিহাসকে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি, যা পরবর্তীতে আনালের মৌলিক একটি বৈশিষ্ট্যে রূপ নেয়।  তার গুরু আঁরি বের আন্তঃশাস্ত্রীয় সহযোগিতার মাধ্যমে বিদ্যাচর্চার যে স্বপ্ন দেখতেন তার রূপায়ন করেন ফেভর, যাতে তার সহযোগী মার্ক ব্লখ। তাতে তাদের অনুপ্রেরণা হিশেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন বেলজিয়ামের ঐতিহাসিক আঁরি পিরেন, যার দ্বারা ব্লখ এবং ফেভর উভয়ই প্রভাবিত হয়েছিলেন।

আনালের প্রথম যুগের অন্য পুরোধা মার্ক ব্লখ। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৮৬ সালে, লিঁওতে। তার পিতা গুস্তাব ব্লখ সরবোনে রোমান ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। পিতার কাছে থেকে পেয়েছিলেন ইতিহাসের প্রতি অগাধ ভালোবাসা আর নিজের উদ্যমী চরিত্র সাহস যুগিয়েছিল ‘বিদ্রোহী’ হতে। ব্লখের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ‘Rois et Thaumaturges’ যা পরে The Royal Touch: Monarchy and Miracles in France and England নামে ইংরেজিতে অনুদিত হয়। মধ্যযুগের ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডে মানুষের মধ্যে এরকম একটা ধারণা ছিল যে, রাজার স্পর্শ পেলে গলগণ্ড রোগ ভালো হয়। রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক গণ্ডীর বাইরে গিয়ে ইতিহাসকে বুঝার অভিনব এ এক প্রচেষ্টা। যদিওবা ব্লখ একে অন্যরকম এক রাজনৈতিক ইতিহাস বিবেচনা করেছেন। এই রচনায় ব্লখ বুঝতে চাইলেন যূথ মনস্তত্ত্ব কিভাবে কাজ করে। এই রচনায় ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক এমিল দুর্খেইমের প্রভাব সুস্পষ্ট। এসময় ব্লখ লুসিয়েঁ লেভি-ভ্রুলের আদিম মানোভঙ্গি বা ‘primitive mentality’ এবং জেমস ফ্রেজারের ‘দ্যা গোল্ডেন বাউ’ নামক রচনা সম্পর্কে সমূহ অবহিত ছিলেন। হয়তো এ থেকে কিছুটা উদ্দীপনাও পেয়েছিলেন। মেন্টালিটির ইতিহাস নামে ১৯৬০ এর দশকে যে প্রবণতা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তার প্ররম্ভ বিন্দু ধরা যেতে পারে ব্লখের এই রচনাকে। ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয় ‘ফ্রান্সের গ্রামীণ সমাজের ইতিহাস’। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয় তার ধ্রুপদী রচনা “সামন্ত সমাজ” (La Société Féodale). সম্ভবত, সামন্ত সমাজ নিয়ে ২ খণ্ডে প্রকাশিত এই রচনাই ব্লখের সেরা কাজ। সামন্তবাদ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ব্লখ তার পূর্বসুরীদের মতো আইনি আর সামরিক কাঠামোর মধ্যে মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলেন না। ব্লখের মতে সামন্ততন্ত্র হলো – “A subject peasantry; widespread use of the service tenement instead of salary; supremacy of a class of specialised warriors; ties of obedience and protection  which bind man to man fragmentation of authority and, in the midst of all this, survival of other forms of association, family and state.” নবম থেকে ত্রয়োদশ শতকে অভিজাত শ্রেণি, নাইটহুড, সামন্ত-ভ্যাসাল, পরিবার, আধুনিক রাষ্ট্রের গঠনমূলক পর্ব, রাজনৈতিক এবং আইনগত কাঠামো সহ ইত্যকার বিষয়ে এমন অসাধারণ বিশ্লেষণের নজির আগে পরে আর তেমন পাওয়া যায় না।

নাৎসী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে নাৎসী বাহিনীর হাতে বন্দি হন ব্লখ। ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার আশঙ্কা যখন তৈরি হচ্ছিলো তখন আরো ২৪ জন ফরাসী নাগরিকের সাথে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে হত্যা করা হয় তাকে। বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস চর্চায় সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা সম্ভবত তখনই সংগঠিত হয়।

আনালের দ্বিতীয় অধ্যায় ব্রদেল যুগ

মার্ক ব্লখ আমরণ ‘আরও সার্বিক ও মানবিক একটি ইতিহাসের’ জন্য কাজ করে গেছেন। সেই কাজকে ১৯৪৬ সাল থেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নেন ফারনান্দ ব্রদেল। ব্রদেলের জন্ম আলসেসে, ১৯০২ সালে। তিনি পড়াশোনা করেন সরবোনে, এর পরে মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক হিশেবে পড়িয়েছেন আলজিয়ার্সে। ব্রাজিলের সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন স্বল্পকাল। তার ভাষ্যমতে ফ্রান্সের মাটি ছেড়ে বিদেশ বিভূইয়ে পড়াতে গিয়েই ইতিহাসের প্রতি সত্যিকার অর্থে আগ্রহী হয়ে ঊঠেন তিনি। আর তখনই ইতিহাস নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে শুরু করেন। এই সময় তার ত্রাতা হিশেবে আবির্ভূত হন লুসিয়েঁ ফেভর, যার প্রতি অনুরাগের কথা ব্রদেল প্রায়শই বলতেন। ১৯২৭ সালে ব্রদেল তার অভিসন্দর্ভ সম্পর্কে ফেভরের পরামর্শ চেয়ে চিঠি লিখেন, যদিওবা তখনো তাদের সরাসরি সাক্ষাৎ হয় নি। ব্রদেল তখন দ্বিতীয় ফিলিপ ও ভূমধ্যসাগর নিয়ে থিসিস লিখার পরিকল্পনা করছিলেন। চিঠির উত্তরে ফেভর লিখলেন, “although ‘Philip II and the Mediterranean’ was a good subject, ‘The Mediterranean and Philip II’ would be still better.”  দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষে ১৯৪৯ সালে ব্রদেল ‘ভূমধ্যসাগর এবং দ্বিতীয় ফিলিপের আমলে ভূমধ্যসাগরীয় দুনিয়া’ (La Mediterranee et le monde me'diterrane`en a l'epoque de Philippe II) শিরোনামে তার ডক্টরাল থিসিস উপস্থাপন করেন। এই অভিসন্দর্ভের প্রাথমিক ড্রাফট তিনি যুদ্ধবন্দি থাকা অবস্থায় সম্পন্ন করেন। ফলে এই রচনায় ইতিহাস শুধুমাত্র ঘটনা পরিক্রময়ায় পর্যবসিত না হয়ে অনুধ্যানমূলক পর্যালোচনার বিষয়বস্ত হয়ে উঠেছে। ১৯৪৯ সালে ব্রদেল কলেজ দ্য ফ্রান্সের অধ্যাপক পদে নিয়োজিত হন। ইতিহাসবিদ্যায় যেমন গভীর প্রভাব বিস্তার করেছেন তার গবেষণার দ্বারা, ঠিক একই রকমের দক্ষতার পরিচয় দিলেন বিদ্যায়তনিক রাজনীতির মোকাবেলায়।

ভূমধ্যসাগর রচনার তিনটি বৈশিষ্ট্য – নিশ্চল ইতিহাস, যাতে সময়রেখার ছাপ নেই বললেই চলে, তারপরে আসে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ইতিহাস, যার গতি কিছুটা পরিবর্তনশীল এবং সবশেষে দ্রুত পরিবর্তনশীল ঘটনার (event)  ইতিহাস – দিয়ে ব্রদেলের সামগ্রিক কাজের সার-সংক্ষেপ করা যায়। বলা বাহুল্য, এই ধ্রুপদি রচনা পরবর্তীতে ইতিহাসকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে বিস্তর প্রভাব বিস্তার করে।

ব্রদেলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ Civilization and Capitalism, 15th-18th Century (Civilisation matérielle, économie et capitalisme, XVe-XVIIIe). পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে মানুষের বস্তুগত জীবন, তার খাদ্যরীতি, পোশাক-আশাক, পরিবার কাঠামো ইত্যাদির প্রাত্যদিক যাপিত জীবনের বর্ণিত হয়েছে প্রথম খন্ডে। দ্বিতীয় খণ্ডে আলোচিত হয়েছে বাজার, বণিক, ব্যাংক, লগ্নিকারী কাঠামো এবং বাণিজ্যিক যোগাযোগের অবস্থা, যার পরিপূর্ণতা দেখা যায় বিশ্ব-অর্থনীতির ধারণার প্রবর্তনের মাধ্যমে নয়া বিশ্ব-ব্যবস্থার ধারণা প্রতিষ্ঠায়। ভূমধ্যসাগরের কাঠামোর আদলে সেসময়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ উপস্থাপিত হয়েছে এই গ্রন্থে। বলা বাহুল্য, পুঁজিবাদের উৎপত্তি এবং ব্যাখা বিশ্লেষণে ব্রদেলের অবস্থান মার্কসের চেয়ে ভিন্ন।

ব্রদেলের সময় সম্পর্কিত ধারণা এখন সুপরিচিত। ব্রদেল লিখেছেন, ‘My great problem, the only problem I had to resolve, was to show that time moves at different speeds.' সময়ের এই এরকম নিস্পৃহ অথচ চিত্তাকর্ষী বিভাজন বেশকিছু সম্ভাবনা এবং প্রতিবন্ধকের সৃষ্টি করে। সময়ের ধারণার এই মডেলের সফল প্রয়োগ দেখা যায় আনাল গোষ্ঠিরই আরেক সদস্য জ্যাক লে গফের “Church time and merchant time in the Middle Ages” নামক রচনায়। সময়কে দীর্ঘ পরিক্রমায় (longue durée) দেখতে গিয়ে ব্রদেল লিখেছেন, ‘When I think of the individual, I am always inclined to see him imprisoned within a destiny (enfermé dans un destin) in which he himself has little hand.’

মহাকালের সামনে মহাকাল গড়ার কর্তাসত্ত্বা (subject) মানুষকে এভাবে পুতুল বানিয়ে দেয়াটা মেনে নেওয়া কষ্টসাধ্য। এবং তার উত্তরসূরিরা তা মেনেও নেন নি। সে প্রসঙ্গে আমরা একটু পরেই আসছি।

ব্রদেলের সর্বশেষ বই L'identité de la France (The Identity of France). ব্রদেল এই বই সম্পূর্ণ করে যেতে পারেন নি, বইটি তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। এটা অনেকটা রোমান্টিক দেশপ্রেমিকের দেশকে প্রেমিকা হিশেবে দেখার বৃত্তান্ত। স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘকাল পরিক্রমার ব্রদেলীয় আইডিয়ার প্রয়োগ এখানেও রয়েছে। ব্রদেল জোর দিয়ে দাবি করেছেন, রাজনীতি কিংবা অর্থনীতি নয়, ভৌগলিক অবস্থা এবং সাংস্কৃতিক ঐক্যই ফ্রান্সকে তার বিশেষত্ব দিয়েছে।

 

তৃতীয় অধ্যায় লাদুরি, লে গফ এবং অন্যান্য

১৯৬৮ সালে ব্রদেল আনালের সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে অবসর নেন। তখন পত্রিকা দেখভালের দায়িত্ব অর্পিত হয় এমানুয়েল লে রোয়া লাদুরি এবং জ্যাঁক লে গফের উপর। লাদুরি আনাল গোষ্ঠির সাথে যোগদান করেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে, ঐ সময়ে তার মতো আরো অনেকেই আনালে যোগ দেন, যারা ইতিহাসচিন্তায় গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন করেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন।

ব্রদেল জামানার অবসানের পর আনালের মনোভঙ্গিতে মৌলিক পরিবর্তন লক্ষণীয়। ব্রদেল ভূমধ্যসাগরের মতো বিস্তৃত এলাকা এবং অত্যন্ত বিস্তৃত কাল পরিক্রমা কেন্দ্র করে কাজ করেছেন। কিন্তু লাদুরির পরবর্তীতে ব্রদেলের বিস্তৃত কাল পরিক্রমাকে অটুট রাখলেও গবেষণার স্থানকে অতটা বিস্তৃত রাখেন নি। আজকাল যাকে ‘Micro-history’ বলা হচ্ছে তার ভালো দৃষ্টান্ত আমরা লাদুরিতে দেখি।

১৯৬৬ সালে প্রকাশিত লাদুরির প্রথম কাজ, যা তার ডক্টরাল থিসিসও, ছিল লাঙ্গদকের কৃষকদের নিয়ে (Les paysans de Languedoc)। এই গ্রন্থে সাংখ্যিক উপাত্ত, খাজনার রসিদ, ভাড়ার রসিদ, মুনাফার দলিলের সাহায্য নিয়ে এবং ফুকো, লাব্রুস, রিকার্ডো, ম্যালথুস প্রভৃতি তাত্ত্বিকের তত্ত্বের সাহায্য নিয়ে দেখালেন ব্রদেল যাকে নিশ্চল ইতিহাস (l'histoire immobile) বলেন, তা সর্বাংশে সত্য নয়। এই গ্রন্থে লাদুরি যেন তার শিক্ষকের সঙ্গে তর্কে নেমেছেন। ব্রদেল ব্যক্তিমানুষকে মহাকালের ক্যানভাসে যেরকম অসহায় ও তুচ্ছ করে দেখেন তার বিরুদ্ধেই লাদুরির বিদ্রোহ। লাদুরি ব্রদেলের সাথে এই বিষয়ে একমত যে, জলবায়ু এবং ভৌগলিক অবস্থান মানুষের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু সংস্কৃতি এবং অর্থনীতি পূর্বোক্তের মতোই গুরুত্বপূর্ণ, যা ব্রদেল স্বীকার করেন না।

১৯৭৫ সালে লাদুরির Montaillou, village occitan de 1294 à 1324 শিরোনামে দক্ষিণ ফ্রান্সের মঁতায়ু গ্রাম নিয়ে গবেষণা প্রকাশিত হয়। যাতে তৎকালে ধর্ম-অবিশ্বাসকে কেন্দ্র করে অস্থির হয়ে উঠে এক গ্রামের অসাধারণ চিত্র ফুটে উঠে। একই বছর প্রকাশিত হয় লাদুরির আরেক বিখ্যাত গ্রন্থ, The Territory of Historian. তৎকালীন ইতিহাস চিন্তা, যাকে অনেক সময় নয়া ইতিহাস (Nouvelle histoire) বলা হয়ে থাকে তার সমূহ প্রস্তাবনা উপস্থাপিত হয়, সাথে যুক্ত হয় ইতিহাস নিয়ে লাদুরির নানান খণ্ড ভাবনা।

অন্যদিকে, এই সময়ের প্রভাবশালী আরেক ঐতিহাসিক লে গফের মধ্যে রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতি আগ্রহের উদ্ভব লক্ষণীয়। এছাড়াও গফ স্মৃতি, কল্পনা, ধর্মীয় বিশ্বাস কিভাবে ব্রদেল কথিত ‘স্ট্রাকচারের’ মধ্যে কাজ করে এবং তা ইউরোপের ইতিহাসে কি ভূমিকা রেখেছে তা অনুসন্ধানে সচেষ্ট হন।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে যে পত্রিকা ‘বিদ্রোহী’ শিবিরের অন্তর্ভুক্ত ছিল সেই পত্রিকা গোষ্ঠিই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে কাঠামোবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের জায়গা দখল করে নেয়। স্বাভাবিকভাবেই নয়া বিদ্রোহীদের দ্বারা আক্রান্ত হতে হলো আনাল গোষ্ঠিকে। নারীবাদীরা প্রশ্ন তুললেন, আনালের ইতিহাসে মহিলাদের স্থান কই? অথবা ইতিহাসে নারী সত্ত্বার যথাযথ মূল্যায়ন হয়েছে কি? তৃতীয় প্রজন্মের ঐতিহাসিকরা এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। তার সাথে রাজনৈতিক ইতিহাস এবং বর্ণনামূলক ইতিহাসের (Narrative History) পুনরাগমন লক্ষণীয়।

 

অবক্ষয় অথবা চতুর্থ অধ্যায় শেষের শুরু(?)

আনাল গোষ্ঠির চিন্তা ও চর্চার বহুমুখি প্রবণতা সম্পর্কে আমরা শুরুতেই সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছিলাম। এই গোষ্ঠির দ্বিতীয় যুগ অর্থাৎ ব্রদেলীয় জামানা পর্যন্ত তাদের কর্মের সাধারণ একটা থিম অথবা কাঠামো দাড় করানো কষ্টসাধ্য হলেও অসম্ভব নয়। কিন্তু তৃতীয় প্রজন্ম থেকে তাদের মধ্যে একক কোনো সাযুজ্য খুঁজে বের করা ক্রমশ জটিল হয়ে উঠে। হয়তো অবসানের বীজও তখন উপ্ত হয়।

চতুর্থ প্রজন্মের ঐতিহাসিকদের মধ্যে আমরা সামাজিক ইতিহাসের প্রতি আগ্রহের পুনরাগমন লক্ষ করি। একই সাথে মাইক্রো হিস্ট্রি, দেহের ইতিহাস, স্থিরচিত্রের ইতিহাস এবং স্মৃতির ইতিহাস সহ আরো নানান বিষয়ে তাদের চিন্তার প্রসারণশীলতা রীতিমতো বৈশিষ্ট্য হিশেবে দাঁড়িয়ে যায়। ব্রদেল জামানার শেষদিকে ইতিহাস অধ্যয়নে সংখ্যাতাত্ত্বিক ব্যাখা বিশ্লেষণের একটা নতুন জোয়ার দেখা যায়। এই জোয়ারের প্রভাব চতুর্থ প্রজন্মেও লক্ষণীয় ছিল। জ্যাঁ-ক্লদ স্মিট, জ্যাক রেবেল, রজার শার্তিয়ার এই প্রজন্মের নেতৃত্বে ছিলেন।

শুরু থেকেই আনালের ইতিহাস চর্চায় বিষয় হিশেবে আধুনিক যুগ তেমন গুরুত্ব পায় নি। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম যে একেবারেই ছিল না, তা নয়। আমরা দেখি রেবেল বিপ্লব পূর্ব প্যারিসে অন্তর্হিত হওয়া শিশুদের নিয়ে লিখছেন, যাতে তৎকালীন গণ-আতঙ্ক এবং অস্থিরতার চিত্র ফুটে উঠে। শার্তিয়ার মনোযোগ দিলেন সাংস্কৃতিক ইতিহাসের দিকে। স্মিট প্রধানত কাজ করলেন মধ্যযুগে মানুষের মধ্যে ভূত-প্রেত, পুরাণ বিশ্বাস নিয়ে।

আমাদের পাওয়া তথ্যমতে আনাল সর্বশেষ ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়। হতে পারে এখানেই আনাল গোষ্ঠি এবং তাদের ইতিহাস চর্চার সমাপ্তি।

যবনিকা

ফ্রান্সে জুল মিশলের হাত ধরে গণমানুষের ইতিহাস মহাপুরুষের মহাকীর্তির ইতিহাসকে টপকে মূলধারায় প্রতিষ্ঠিত হয়। নিজেদের সেই ধারার উত্তরাধিকারী মনে করতেন ব্লখ এবং ফেভর। প্রায় আট দশক বা তারও বেশি সময় ধরে আনালের যে পথচলা এবং তার নানাদিকে যে অভিমুখ, তাকে সাধারণ কিছু বর্গে খোপবন্ধ করতে চাওয়া হয়তো কিছুটা দুঃসাহসিক। এবং এতে অতি-সরলীকরণের ঝুঁকি তো থাকেই। তথাপি, একথা বলা যায় যে, ইতিহাসকে দেয়াল, কাঁটাতারে আবদ্ধ করার বিরুদ্ধে, ঐতিহাসিক সময়কে সরল রৈখিক রেখাতে আবদ্ধ করার বিরুদ্ধে, মহাপুরুষের মহাকীর্তিতে পর্যবসিত করার বিরুদ্ধে আনাল গোষ্ঠি যে বিদ্রোহ করেছিল, সেই বিদ্রোহের একমাত্র সাধারণ বৈশিষ্ট্য হয়তো তাদের সবসময় নতুন এবং কার্যকরী মৌলিক চিন্তাকে স্বাগত জানাতে পারার, নতুন চিন্তা করতে সদা সচেষ্ট থাকতে চাওয়াটাই মূল স্পিরিট। যা দুনিয়াজুড়ে ইতিহাসবিদ্যায় বাঁকবদল ঘটিয়ে দিয়েছিল। এই স্পিরিটই ছিল আনালের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা, একই সাথে দূর্বলতারও, যা শেষে এর অবসানে ভূমিকা রাখে।

আনালের মূল্যায়ন করতে গিয়ে ১৯৮৬ সালে ঐতিহাসিক লিন হান্ট লিখেছিলেন, “There is no one historical journal that is more influential in the world today than the Annales: Economies, Sociétés, Civilisations.”

অধ্যাপক হান্টের মন্তব্য থেকে সহজেই অনুমেয় বিশ শতকের ইতিহাসবিদ্যায় কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল আনাল গোষ্ঠি। আনালের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মার্ক ব্লখকে অনুকরণ করে আমরাও বলতে পারি, “আরও সার্বিক, আরও মানবিক একটি ইতিহাসের” আশায় আমরা আনাল গোষ্ঠির কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে কাজ করে যেতে পারি। একইসাথে এই প্রশ্ন তোলাও জরুরি; সার্বিক ইতিহাস কি সম্ভব?

আকর

1.     Peter Burke, The French Historical Revolution: The Annales School 1929 - 2014, 2nd Edition, Polity.

2.     Georg G. Iggers, Historiography in the Twentieth Century: From Scientific Objectivity to the Postmodern Challenge, 2005, Wesleyan University Press.

3.     The Annales School: Critical Assessments Vol. 1, 1999, Ed- Stuart Clark, Routledge.

4.     Andre Burguiere, The Annales School: An Intellectual History (2009), Trans- Jane Marie Todd, Cornell University Press.

5.     অমলেশ ত্রিপাঠী, ইতিহাস ও ঐতিহাসিক (১৯৬০), পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ।

6.     অমলেশ ত্রিপাঠী, স্বাধীনতার মুখ (২০১৯, ৬ষ্ঠ মুদ্রণ), আনন্দ পাবলিশার্স।

7.     সুবোধ কুমার মুখোপাধ্যায়, পশ্চিমের ইতিহাস ও ঐতিহাসিক (২০২১), মিত্রম, কলকাতা।

8.     Fernand Braudel, Personal Testimony, The Journal of Modern History, Vol. 44, No. 4 (Dec., 1972), pp. 448-467.

9.     J. H. Hexter, Fernand Braudel and the Monde Braudellien..., The Journal of Modern History, Vol. 44, No. 4 (Dec., 1972), pp. 480-539.

10. Traian Stoianovich, French Historical Method: The Annales Paradigm (1976), Cornell University Press, London.

11.  Michael S. Roth, Knowing and History: Appropriations of Hegel in Twentieth-Century France, 1st edition (September 1, 1988), NCROL.

12.  Carole Fink, Marc Bloch: A Life in History (1991), Cambridge University Press.