কমলকুমার মজুমদার : তাঁর সাহিত্য ও সময়চেতনা

১ লা জানুয়ারি। ইংরাজি নববর্ষের পাশাপাশি বাংলার কল্পতরু উৎসব। লেখাটা এই দিন কাকতালীয়ভাবে শুরু করার পরেই ভেবে দেখলাম, কমলকুমার নিয়ে লিখতে এমন মাহেন্দ্রযোগ বিরল। কেন না ধরুন, একে তো ইংরাজি নববর্ষের হিড়িকে ফিরিঙ্গি পাড়ায় মোচ্ছব চলছে কোভিডের দিনেও, মানে কমলকুমার-কথিত ‘সেই ফেরেঙ্গ-মোহিত চটকের সময়’ আজও বহতা, অন্যদিকে বাঙালির নিজস্ব ‘কল্পতরু’- আমি কোনো বিশেষ ধর্মের বিশেষ গোষ্ঠীর আবেগকে বাঙালির জাতীয় আবেগ বলে দেগে দিতে চাইছি না। কিন্তু কমলকুমার পড়তে গেলে রামকৃষ্ণ অবধারিতভাবে আসবেন। কেন? রামকৃষ্ণকে কমলকুমার যতোটা না ধর্মীয় গুরুরূপে দেখেছেন, তার চেয়ে বেশি দেখেছেন বাঙালির শুদ্ধ চেতনের উদ্ধারকর্তা রূপে। ‘তোমাদের চৈতন্য হোক’- আজকের দিনে তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী। সে চৈতন্য বাঙালির তথা মানুষের আত্মানুসন্ধানের। এই সন্ধানের সঙ্গে অধ্যাত্ম জড়িয়ে আছে, জড়িয়ে আছে বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতি। কমলকুমার পড়তে গেলে বাঙালির আধ্যাত্মিকতা বাদ দিলে চলবে না। কেন? চলুন দেখে নিই বাঙালির আইডেন্টিটি বলতে তিনি কী বুঝেছেন এবং সেই আইডেন্টিটি বা আত্মপরিচয়ের সংকট কখন কীভাবে ঘটল, কারণ এর উত্তর না জানলে কমলসাহিত্যকে আমাদের সকলেরই অকারণ দুর্বোধ্য বলে মনে হবে, যেমনটা অনেক সমালোচকেরই হয়েছে।

বাংলার উপর বৈদেশিক আক্রমণ নতুন কথা নয়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ভারততীর্থে শক,হুন,পাঠান, মোগল যেভাবে লীন হয়েছে, ব্রিটিশরা তার চেয়ে কিছু আলাদা। মধ্যযুগেঅত্যাচার, করবৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির কদর করেছেন, এমন শাসকও ছিলেন। রামায়ণ মহাভারতের অনুবাদ মুসলমান রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই হয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশরা এদেশে থাকতে আসে নি, এসেছিল আখের গোছাতে। ব্যবসার প্রয়োজনে তাদের যেটুকু পরিকাঠামো দরকার, যেমন রাস্তাঘাট অট্টালিকা থেকে কেরানি তৈরির জন্য নেটিভদের ন্যূনতম ইংরাজি শেখানো, সেটুকুই তারা করেছিল। পার্লামেন্টের হাতে প্রত্যক্ষ শাসন যাবার পরেও প্রজাকল্যাণের বিশেষ ছিটেফোঁটা তাতে ছিল না। এর একটা কারণ, রানি এবং উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা ইংল্যান্ড থেকে শাসন করছিলেন, সাধারণত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় ও পদোন্নতির আশায় নিচুতলার কর্মীরাই এই ম্যালেরিয়া আর কলেরার দেশে আসতে রাজি হতেন। নিজেদের লভ্যাংশ বুঝে নিয়ে তাড়াতাড়ি দেশে ফেরত যাওয়াই ছিল তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য। এদেশের ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা নিয়ে মাথা ঘামানোর ইচ্ছা তাদের ছিল না। বাংলার তথাকথিত নবজাগরণ এল কেরানি বানানোর পথটুকু ধরে। ইংরেজের ‘কৃপণ অঞ্জলি চুঁইয়ে’ পাওয়া নবজাগরণকে পরবর্তী কালে অনেক ঐতিহাসিকই নবজাগরণ বলতে চান নি। কারণ এই নবজাগরণ স্বাভাবিক বিবর্তনের পথে আসে নি, বরং ভাষা, সমাজ ও সংস্কৃতিতে ইংরেজিয়ানাকে বহন করে চলার ইচ্ছা থেকে বাঙালি চিরকালের মতো ভুলতে বসল তার নিজস্বতাকে। এর পিছনে অন্য কারণও ছিল। যেমন, ইংরাজি শিখলে চটপট চাকরি পাওয়া যাবে- এই আশায় দলে দলে বাঙালি সন্তান ইংরাজি স্কুলে ভর্তি হতে শুরু করল। নদীয়া-নবদ্বীপকেন্দ্রিক গৌড়ের সংস্কৃতি রাতারাতি স্থানান্তরিত হল শহর কলকাতাকে ঘিরে। ইংরেজের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কবলে পড়ে যেমন কেউ কেউ জমি হারাল, তেমন কেউ কেউ নতুন জমি পেতেও লাগল। নতুন জমিদাররা শহরেই থাকতেন, গ্রামে যেতেন শুধু ইংরেজকে দেয় খাজনা আর নিজের বিলাসব্যসনের জন্য আদায় করতে। এতে গ্রামগুলি হয়ে গেল শ্মশান, কৃষক পরিণত হলেন ভাগচাষি বা খেতমজুরে, অনেকে গ্রাম ছাড়তে লাগলেন। পুঁজিবাদ আধুনিকতার নাম নিয়ে বাঙালির সমাজ-সংস্কৃতিতে জাঁকিয়ে বসল। ফলে বাঙালির এতকালের গ্রামকেন্দ্রিক সমাজ ছিন্ন হয়ে গেল, বদল ঘটল সংস্কৃতিতে।

                      সংক্ষেপে এই হল বাঙালির পরিচয় হস্তান্তরের ইতিহাস। কমলকুমার বাংলার সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেন স্বাধীনতার পর পরই, তখন কারো কারো চোখ থেকে চাপিয়ে দেওয়া আধুনিকতার মোহ কাটতে শুরু করেছে। উনিশ শতকের হঠাৎ করে পাওয়া আধুনিকতাকে স্বাভাবিক কারণেই অসম্পূর্ণ মনে হয়েছে তাঁদের, কারণ তা সর্বাঙ্গীণ ছিল না। আধুনিকতার প্রসাদ পেয়েছিল শুধুমাত্র কলকাতা শহর, বাংলার গ্রামে গঞ্জে কৃষক প্রজারা সর্বস্বান্ত হয়েছিল। এই সর্বস্বান্ততা শুধু অর্থনৈতিক নয়, বৃহদর্থে সাংস্কৃতিক। ইংরাজি শিক্ষা ও সংস্কৃতির দিকে ঝোঁকার ফলে গ্রামের চিরাচরিত সংস্কৃত শিক্ষার কেন্দ্র টোল চতুষ্পাঠীগুলি বন্ধ হয়ে গেল, সাথে সাথে ন্যায়, স্মৃতিশাস্ত্রাদি দর্শনের চর্চা, আরবি ফার্সির চর্চাও গেল বন্ধ হয়ে। আরো একটা জিনিস গেল বন্ধ হয়ে- গ্রামের পুরাণাদি কথকতার আসর। উনিশ শতকের শুরুতে ছাপাখানার রমরমায় বই পড়া শুরু হল, বন্ধ হল গল্পকাহিনি শোনার অভ্যাস। এখান থেকেই বাংলা আখ্যানের নতুন যাত্রা সূচিত হল। এ বিষয়টা একটু বিশদ করা দরকার, তাহলেই আমরা জানতে পারব, কেন কমলকুমার স্বেচ্ছায় পুরনো আখ্যানের রীতিকে গ্রহণ করলেন।

                  ছাপাখানার আবিষ্কার ও বাংলা গদ্যযুগের সূচনা বাংলার ইতিহাসে নবযুগ এনে দিয়েছিল উনিশ শতকের প্রথমার্ধে। ছাপাখানা থেকে বেরলো প্রথম সংবাদপত্র, ছাপা হতে লাগল খ্রিস্টধর্ম ও সংগীতের উপর বাংলা বই। এছাড়াও কৃত্তিবাসের রামায়ণ, কাশীদাসী মহাভারত ছাপার আকারে পাওয়া গেল। মুশকিল হল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ছাত্রদের জন্য নতুন নতুন বই অনুবাদ করতে গিয়ে। রামরাম বসু, কেরি সাহেব, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার প্রমুখ পণ্ডিতদের তত্ত্বাবধানে বাংলা গদ্যের একটা চেহারা তৈরি হল। মনে রাখতে হবে, এই বাংলা গদ্য প্রাগাধুনিক কালের বাংলা গদ্যের চেয়ে আলাদা—মূলত সংস্কৃত শব্দ ও ইংরাজি অন্বয়রীতির উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা। আশ্চর্যের বিষয়, মাত্র ছয় দশকের মধ্যে এই গদ্যেই বঙ্কিমচন্দ্র লিখে ফেললেন দুর্গেশনন্দিনী, সে গদ্যের ভাষা যেমন অলংকৃত, তেমনই সুদূর ইতিহাসের আবছায়া রোমান্স। বাঙালি একবাক্যে নতিস্বীকার করে ফেলল এই ভাষার কাছে, একেই মেনে নিল স্ট্যান্ডার্ড বলে। নভেল পড়ার চল শুরু হল মধ্যবিত্ত বাঙালির। পাঠকের সঙ্গে লেখকের দেখা হল না, যেমনটা হত কথকঠাকুরের সঙ্গে তাঁর শ্রোতাদের। এই যোগাযোগটা হারিয়ে গেল চিরকালের মতো, হারিয়ে গেল লোকশিক্ষা ও নীতিশিক্ষার সনাতন উপায়গুলি, জাঁকিয়ে বসল ইংরাজের শিখিয়ে দেওয়া বুলি, নোটবুক আর তৈরি করে দেওয়া ভারতের ইতিহাস, ছাপাখানা ঘটিয়ে দিল সাক্ষর আর নিরক্ষরের ভেদ, যাত্রা ছেড়ে ধীরে ধীরে থিয়েটারে মজল বাঙালি, আধুনিকতাকে রপ্ত করতে তার বেশি সময় লাগল না। তবে সবটাই হল কলকাতায়।

                      আখ্যান থেকে উপন্যাসে যেতে বাঙালি পেরিয়ে এল আত্মসংস্কৃতি রক্ষার দায়। সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গে ভাষার বদল লক্ষ করার মতো। বঙ্কিমচন্দ্র যে উপন্যাসের ভাষা তৈরি করে দিয়ে গেলেন তাকেই মান্য ধরে নিয়ে পরবর্তী সাহিত্যিকরা এগোলেন। আজ পর্যন্ত আমরাও সেই ভাষাতেই সাহিত্য পড়তে ও লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। জানতে চেষ্টা করি না আধুনিকতাপূর্ব বাংলা গদ্যের চাল কেমন ছিল, কিংবা বঙ্কিমেতর ভাষায়, তথাকথিত লজিকহীন গদ্যে তাঁরই সমসময়ে অন্য কিছু লেখা হয়েছে কি না। লজিক আধুনিকতার দান, ওরিয়েন্টালিস্ট ঐতিহাসিকদের চোখে প্রাচ্যদেশ কলেরা-ম্যালেরিয়ায় পূর্ণ, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, ইতিহাসহীন, অনর্থক আবেগপূর্ণ ভক্তিস্বর্বস্ব এক ভূমি। ইংরেজ শিক্ষিত বাঙালিকেও এভাবেই ভাবাল। ফলত, নিজের ভালোমন্দ যা কিছু, তাকে অস্বীকার করে প্রভু ব্রিটিশের দেখিয়ে দেওয়া পথে চলতে আমরা দ্বিধা করলাম না।

                  কমলকুমার লিখতে এসে ভক্তিকেই বাঙালির অন্যতম আইডেন্টিটি বলে ধরলেন। লিখতে শুরু করলেন কথকঠাকুরের ফেলে যাওয়া প্রাচীন দেববন্দনার রীতি দিয়ে। ছাড়া ছাড়া বাক্যে, দূর অন্বয়ে, অন্তর্বাক্যে ভেঙে দিতে চাইলেন প্রথাগত রীতির লজিককে। দুশো বছরের পাঠাভ্যাসে আমাদের তা দুর্বোধ্য মনে হল। বাঙালির অন্তর্গত আবেগকে তিনি প্রাধান্য দিলেন বলেই প্লটের জায়গায় আঁকা হল ছবি। কলিযুগে ভক্তিই সেরা- রামকৃষ্ণের এই বাণীকে নিলেন, কারণ তাঁর সামনে বাঙালির শুদ্ধাত্মার প্রতিভূ হিসাবে এই মানুষটিই ছিলেন। গ্রাম থেকে আসা তিনি প্রাগাধুনিক গ্রামসংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করেছেন যেমন, চূর্ণ করেছেন ইংরাজি শিক্ষা ও তথাকথিত আধুনিকতার অহংকারকে। তাই তো রামপ্রসাদের ভাষাবিগ্রহ আর রামকৃষ্ণের ভাববিগ্রহে নির্মিত হয়েছে কমলকুমারের প্রথম উপন্যাস অন্তর্জলী যাত্রা