‘ডাকহরকরা’ - গ্রাম্য পোস্ট আপিস,বটতলা আর আমার চোখে তারাশঙ্করের গল্পভুবন

(১)

খুব ছোটবেলার কথা, যে বয়সের কথা স্মৃতিতে ধরা থাকে না, সেই দুই কি তিন বছর বয়সে আমার প্রায় সারাটা দিন কাটত বাবার সঙ্গে দোকানবাড়িতে। তখন বাবা ছিলেন মুদি। আমাদের দোকানবাড়িটা ছিল বসতবাড়ি থেকে সামান্য দূরে। বাড়িটা দাদুর কেনা। পূর্বে সেই বাড়ি একজন বৈষ্ণবের ছিল। ব্যাবসাদার বৈষ্ণব। তাঁর ব্যবসা ছিল মণ্ডা বাতাসা তৈরি করা এবং সেসবের সঙ্গে গুড় ও মুড়ি বিক্রি করা। সে অবশ্য অনেক পুরনো দিনের কথা। পরবর্তীদিনে রাস্তার ধারে বেশ খানিকটা জমির উপর দোতলা মাটির বাড়িটা আমার দাদু কিনেছিলেন।

বাবার শৈশব থেকে শুরু করে কলেজ জীবন পর্যন্ত কেটেছিল গ্রামের বাইরে। গ্রামে ফিরে এসেছিলেন বি এসসি পাশ করার পর। তারপর শুরু করেছিলেন গৃহশিক্ষকতা। চাকরির বাজার সুবিধাজনক নয় বুঝে পরে মুদি দোকান করেছিলেন। বাড়িটার ভেতর দিকে ছিল লম্বা টানা বারান্দা। সন্ধ্যেবেলা দোকান বন্ধ করে সেই বারান্দায় ছাত্র পড়াতেন। সেই সময় প্রতিদিন সকালে দোকান খোলার সময় বাবা আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। ব্যাপারটা আমার কাছে যেমন আনন্দের ছিল তেমনি আকর্ষণের। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়। দোকানের সামনে রাস্তার চলমান দৃশ্য আর মানুষ দেখে সময় কেটে যেত। রাস্তার ধারে গোরুর গাড়ি থামত, সাইকেল থামত, কতজন হেঁটে যেতে যেতেও দুদন্ড দাঁড়িয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলত। বহু বিচিত্র দৃশ্য ও মানুষ দেখার সে ছিল এক সুবর্ণ সুযোগ।

সকালের দিকে দোকানে ভিড় লাগত। কারণ ক্রেতারা বেশিরভাগই ছিল অভাবী মানুষজন। তারা প্রতিদিনের রসদ প্রতিদিন সকালে যোগাড় করত। বেশিরভাগই নিত নুন-হলুদ-তেল-আলু-পেঁয়াজ আর বিড়ি। বাজেট হয়ত এক টাকা বা তারও কম। কেউ কেউ চাল বা ধানের বিনিময়ে জিনিস নিত। কারও ছিল খাতা। ধারে নিত, মাস শেষ হলে পয়সা দিত। খুব কম লোকই নগদে জিনিস কিনত। ভিড় কেটে যেত একটু বেলা হতেই। তখন সেই মানুষগুলো খাটতে বেরিয়ে যেত। একটু বাদে বাবা বের হতেন দোকানে তালা দিয়ে। যথারীতি আমি তাঁর সঙ্গী। দোকানবাড়ি থেকে কয়েক কদম হাঁটলেই একদিকে ছিল প্রাথমিক স্কুল আর একদিকে পোস্টঅফিস। গ্রামে সরকারী কাজকর্মের স্থান বা আপিস বলতে ওই দুটিই। বাবা যেতেন পোস্টঅফিসের দিকে।

পোস্টঅফিসটা উৎপলকাকার। উৎপলকাকা আমাদের প্রতিবেশী এবং বাবার ছাত্র। আমাদের পাড়ার সকলেরই দুটো তিনটে করে বাড়ি ছিল। বাড়িগুলোর একটা করে নামও ছিল। ফলকে খোদাই করা নাম নয়, লোকের মুখে মুখে প্রচলিত নাম। যেমন ভিটেবাড়ি, খামারবাড়ি, দোকানবাড়ি, খোঁড়ার বাড়ি, সাধুর বাড়ি, বাংলাবাড়ি, বৌয়ের বাড়ি ইত্যাদি। পোস্টঅফিসটা সেরকমই উৎপলকাকাদের একটা উদ্বৃত্ত বাড়িতে। দোতলা মাটির ঘরের মাথায় খড়ের চাল। বাইরের দেওয়ালগুলো আলকাতরা দিয়ে কালো রং করা। একতলার একটা ঘরে অফিস। বাইরের দেওয়ালে টাঙানো একটা লাল রঙের লেটারবক্স। পোস্টঅফিসের যে আলাদা আলাদা কাউন্টার হয় এই পোস্টঅফিস দেখে তা ধারণা করা সম্ভব ছিল না। তাই দীর্ঘদিন পোস্টঅফিস বলতে ওই বাড়িটার ছবিই আমি মনে মনে কল্পনা করেছি। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পোস্ট-মাস্টার’ পড়ার সময় ঐ বাড়িটাকেই দেখেছি মনশ্চক্ষে।

পোস্টঅফিসে পৌঁছে দেখতাম আসর জমে উঠেছে। অনন্তকাকা লাভপুর থেকে ডাক এনেছে। মাথায় শোলার হ্যাট পরে, খাকি পোশাকে সাইকেল চালিয়ে আসে অনন্তকাকা। সাইকেলের ক্যারিয়ারে থাকে মুখ বাঁধা ডাকের ব্যাগ। পোস্টঅফিসের ভেতরে কাঠের চেয়ারে বসে উৎপলকাকা। সামনে কাঠের টেবিল। দরজার বাইরে বেশ কিছু মানুষজন ভিড় করে থাকে। কেউ পোস্টকার্ড, কেউ ডাকটিকিট নেয়। কেউ লেটারবক্সে চিঠি ফেলে।

অনন্তকাকা এসে ডাকের ব্যাগটা খুলে টেবিলের উপর উপুড় করে দেয়। অমনি দেবীপিওনের হাত চলতে শুরু করে দ্রুত তালে। ব্যাগ থেকে বেরিয়ে আসা পোস্টকার্ড, খাম, মানি অর্ডারের উপর দুমদাম শব্দে স্ট্যাম্প মারতে লাগে। স্ট্যাম্প মারা শেষ হলে একটা ব্যাগের মধ্যে চিঠিগুলো ভরে দেবীপিওন উঠে পড়ে তার সাইকেলে। শুধু আমাদের গ্রামেই না, প্রতিবেশী আরও কয়েকটি গ্রামে ঘুরে ঘুরে ওই চিঠিগুলো নির্দিষ্ট বাড়িতে পৌঁছে দেবে।

বাবার নামে যদি কোনোদিন চিঠি আসে, তা আর দেবীপিওনের ব্যাগে ঢোকে না। সেগুলো হয় বাবা তুলে নেন, নয় ওরাই বাবার হাতে ধরিয়ে দেয়। অমৃতবাজার পত্রিকা আসে বাবার নামে। আর মাঝে মাঝে আসে বাদামি লম্বা খাম। তারপরেই বাড়ির পরিবেশে খানিকটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পরে। বাবা দুএক দিনের জন্যে দোকান বন্ধ করে চলে যান ইন্টারভিউ দিতে।   

এভাবেই আরও দুএক বছর কেটে যায়। বাবার ইন্টারভিউ দিতে যাওয়া, খেপে খেপে চাকরি করা আবার চাকরি ফুরিয়ে যাওয়া এই বিষয়ে কৌতূহল জাগে। তাই প্রশ্ন করি। তারই ফলে একদিন জানতে পারি, এই পোস্টঅফিসটা আমাদেরও হতে পারত এবং বাবা হতে পারতেন পোস্টমাস্টার। যিনি পোস্টমাস্টার হতে পারতেন তিনি নুন-তেল-বিড়ি বিক্রি করছেন এমন দুঃখের কাহিনি না শুনে বাবাকে যে ছাড়ি নি, তা বলাই বাহুল্য।

সালটা ১৯৭৯। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য কয়েকটি গ্রামের জন্যে একটি করে পোস্টঅফিস স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে সরকার। গ্রামীণ এই পোস্টঅফিসগুলোর নাম ‘এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল পোস্টঅফিস’। সেই সময় আমাদের গ্রামেও একটি ‘এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল পোস্টঅফিস’ মঞ্জুর হয়। গ্রামে একটা পোস্টঅফিস হওয়া মানে তিনজনের চাকরি। একজন পোস্টমাস্টার, একজন ডাকপিওন ও একজন ডাকহরকরা অর্থাৎ রানার। পোস্টমাস্টার হওয়ার জন্যে যোগ্যতা মাধ্যমিক পাশ এবং বাকি দুইটি পদের জন্যে এইট পাশ। অফিস স্থাপনের জন্য ঘর দিতে হবে পোস্টমাস্টারকেই। তিনটে পদের জন্যেই মাইনে অতি সামান্য। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল, ‘যেমন তেমন চাকরি ‘ঘি ভাত’’। তাই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে গ্রামের শিক্ষিত বেকার ছেলেদের হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। এদিকে অপেক্ষা করতে করতে আর চাকরির ইন্টারভিউ দিতে দিতে হতোদ্যম বাবাও একটি দরখাস্ত ঠুকে দিলেন। তাতে পাড়ার লোকে বিশেষ প্রীত হল না। যে চাকরিতে ন্যূনতম যোগ্যতা মাধ্যমিক সেখানে একজন অনার্স গ্রাজুয়েট দরখাস্ত করবে এ কেমন কথা! উপরন্তু যারা ওই পদে দরখাস্ত করছে তারা সবাই লোকটার ছাত্র। বাইরে থেকে পড়াশুনো শেষ করে এসে কবছর আগে এই লোকটাই প্রবল উৎসাহে একদল বই-বিমুখ ছেলেকে ধরে বসিয়ে, অঙ্ক শিখিয়ে মাধ্যমিকের চৌকাঠ পার করিয়েছিল। এখন সেই যাবে ছাত্রদের প্রতিযোগী হিসেবে ইন্টারভিউ দিতে? সেটা দেখতে কতখানি খারাপ লাগবে?

তো দেখতে যত খারাপই লাগুক না কেন বাবা ইন্টারভিউ দিতে গেলেন। শেষে ইন্টারভিউ বোর্ডের লোকজনই বাবাকে বিরত করলেন। অনুরোধ করলেন এই চাকরির প্রত্যাশা না করতে। পরামর্শ দিলেন, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে এবং বিএড করতে। শেষে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করে, শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় দিলেন। বাবার ছাত্র উৎপলকাকা ঢুকে পড়ল চাকরিতে। 

(২)

আমাদের দেশে ডাক ব্যবস্থার ইতিহাস প্রাচীন। কালে কালে বিবর্তিত হওয়া সেই চলমান ইতিহাসের ফাঁকে ফাঁকে এমনই অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অকিঞ্চিৎকর এবং বিচিত্র সব কাহিনি ছড়িয়ে আছে। অনেক কাহিনি কালের স্রোতে হারিয়েও গিয়েছে। সেরকম চিরতরে বিলীন হয়ে গিয়েছে এক কালের জীবন্ত কিছু সামাজিক ছবি। আজকের দিনে ‘রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে’ দৃশ্য কি বাস্তবে কেউ কল্পনা করতে পারে? অথচ একটা সময় ডাকহরকরার পেশাটা কতখানি জরুরী ছিল! সারারাত দৌড়তে হয়েছে কিছু মানুষকে। এক জায়গার খবর অন্য জায়গায় সময়মতো পৌঁছে দিতে হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের জীবনের সংকট ও সংগ্রাম আর পাঁচজনের চেয়ে অন্যরকম হতো।

সেই অন্যরকম মানুষের কথাই লিপিবদ্ধ হয়েছে তাঁরাশঙ্করের কাহিনি ‘ডাকহরকরা’য়। গল্পটি যদিও ব্রিটিশ আমলের পোস্টঅফিসের, তবুও স্বাধীনতা উত্তরকালে ১৯৭৯ সালে গ্রামে নতুন পোস্টঅফিস প্রতিষ্ঠার কথা শুনে গল্পটিকে আর সুদূর অতীতের বলে মনে হয় না। বরং ‘ডাকহরকরা’র মূলচরিত্রকে কেন্দ্রে রেখে তৎকালীন সমাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ জীবিকার স্পষ্ট ছবি চাক্ষুষ করা সহজ হয়ে যায়। 

১৯৩৬ সালের প্রবাসীর কার্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল তারাশঙ্করের ছোটগল্প ‘ডাকহরকরা’। পরের বছর ‘জলসাঘর’ নামের গল্পগ্রন্থে গল্পটি সংকলিত হয়। গল্পটি সমালোচক মহলে প্রশংসিত হয়। এরপর ‘ডাকহরকরা’ চলচ্চিত্রায়িত হয়। তেইশ বছর পর, ১৯৫৯ সালে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য অবলম্বন করে গল্পটিকে উপন্যাসে রূপ দেন তারাশঙ্কর। রাঢ়ের গ্রামাঞ্চলে স্বছন্দ পদচারণে অপ্রতিদ্বন্দ্বী তারাশঙ্করের যে ব্রাত্য সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল সেই অভিজ্ঞতা তাঁর আরও পাঁচটি কাহিনির মতো ‘ডাকহরকরা’তেও ফুটে ওঠে। তৎকালীন সমালোচকরা মনে করেছিলেন বাস্তব ঘটনার উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছিল গল্পটি এবং যাকে নিয়ে গল্প, সেও তারাশঙ্করের চোখে দেখা মানুষ।

অন্ত্যজশ্রেণীর সমাজ জীবন যেমন তারাশঙ্করের লেখায় স্থান পেয়েছে, তেমনি তাঁর কাহিনিতে স্থান পেয়েছে নানা বিচিত্র পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের কথা। চৌকিদার, দফাদার, স্টেশনের কুলি, মোটরগাড়ির ড্রাইভার অথবা ক্লিনার, লাঠিয়াল কিংবা খেয়াঘাটের মাঝিদের কথা সাহিত্যে তেমনভাবে যখন চোখে পড়ত না, তখন তাদের কথা তারাশঙ্কর সহানুভূতি ও আন্তরিকতার সঙ্গে লিখেছেন। ‘ডাকহরকরা’ সেই ধরণের আর একটি সৃষ্টি।

‘ডাকহরকরা’ যে সময়ের প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছে, সেই সময় এই পেশার জন্যে কোনও শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন হতো না। প্রয়োজন হতো শারীরিক শক্তি অর্থাৎ দৌড়নোর ক্ষমতা, মনের সাহস আর কাজে নিষ্ঠা। লাঠি খেলায় দক্ষতা এবং সততার কারণেই এই পদের জন্যে কাহিনির নায়ক দীনুকে হাজির করা হয়েছিল। দীনু জাতিতে ডোম। এই জনজাতির পূর্বসূরিরা নবাবী আমলে নবাবের পল্টনে কাজ করত। পরে হয়েছিল জমিদারের লাঠিয়াল। দীর্ঘদিন পর্যন্ত চুরি ডাকাতি ছিল এদের কাছে গর্বের পেশা। স্বাভাবিকভাবেই এদের ছিল অদম্য সাহস, শারীরিক ক্ষমতা আর সহ্যশক্তি। কালের বিবর্তনে এরা চুরিডাকাতি ছেড়ে চাষবাসের কাজে মন দিয়েছিল। এই শ্রেণির বাস্তব চরিত্র সতীশ ডোম কিংবা শশী ডোমকে নিয়ে তারাশঙ্কর অনেকগুলি গল্প লিখেছিলেন। তেমনই একজন কর্মনিষ্ঠ সৎ মানুষ ছিল মস্তলি গ্রামের সোনু ডোম। তারই আদলেই গড়ে উঠেছিল ‘ডাকহরকরা’র দীনু।  

দীনুর স্মৃতিতে, ফ্ল্যাশব্যাকে পনেরো বছর আগে তার চাকরি পাওয়ার ঘটনা দিয়ে শুরু হয় গল্পটি।  ‘নবগ্রামের খড়োচাল মাটির ব্রাঞ্চ পোস্টাপিস। কাঠের খুঁটি দেওয়া মেটে বারান্দা। সেই বারান্দায় বসে আছেন গ্রামের চার-পাঁচজন ভদ্রলোক, পোস্টাল ইন্সপেক্টর, দাঁড়িয়ে আছেন পোস্টমাস্টার, ওভারসিয়ার, পিওন এবং বারান্দার নীচে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে পনেরো বছর কম বয়সের দীনু। দেওয়ালে একটা নোটিশবোর্ড, একটা নোটিশের মাথায় লেখা – 1928 March’।

প্রবীন দাশরথিবাবু দীনুর জন্য সুপারিশ করছেন। সে দাশরথিবাবুর কৃষাণের ছেলে। ভালো লাঠিয়াল এবং স্বভাবে ধার্মিক। ঘন্টায় পাঁচ মাইল গতিতে টানা চার পাঁচঘণ্টা অনায়াসে চলতে পারে। এ কাজে তাকে নিলে যথা সময়ে ডাক পৌঁছনো নিয়ে ভাবতে হবে না। কারণ ডাক নিয়ে আসা যাওয়ার পথটির এমন বদনাম যে, কেউই রাতে সে পথ মাড়াতে চায় না। ফলে ডাক পৌঁছতে একদিন দেরি হয়ে যায়। পোস্টাল ইন্সপেক্টর দীনুকে যাচাই করে দেখেন। ডাক নিয়ে যাওয়ার পথে পড়ে কুখ্যাত সুঁদীপুরের বটতলা। সেই পথে রাতের বেলা সে যেতে পারবে কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন।

প্রশ্নোত্তর চলুক। সেই ফাঁকে আমরা বরং সুঁদীপুরের বটতলা সম্পর্কে অনুসন্ধান করে আসি।

(৩)

লাভপুর থেকে সিউড়ির দিকে আট কিলোমিটার মতো অতিক্রম করলে পথে পড়বে সুঁদীপুর গ্রাম। দেড়শ দুশো বছর আগে নির্জন জায়গাটি কুখ্যাত হয়েছিল একটি বৃহৎ বটবৃক্ষের জন্য। চারিপাশে ঝুরি নামিয়ে নিজের পরিধিকে বাড়িয়ে নিয়ে আজও গাছটি দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ডানদিকে। গাছটির আসল কাণ্ড হারিয়ে গিয়েছে অজস্র ঝুরির ভিড়ে। তাই গাছটি একাই একটা ক্ষুদ্র অরণ্যভূমি।

আজকের দিনে রাস্তা জনহীন শুনশান নয়। রাস্তার ধারে ধারে গ্রামগুলির আকার, আয়তন, জনবসতি সবই বৃদ্ধি পেয়েছে। কাটোয়া-সিউড়ী পাকা সড়কের ধারে সুঁদীপুর গ্রামও হয়েছে সেদিনের তুলনায় উন্নত। কেবল ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বৃদ্ধ বটবৃক্ষখানি। এই গাছের ইতিহাস না জানলে অতখানি চত্ত্বর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বটতলাকে ছায়াসুনিবিড় মনোরম স্থান বলেই মনে হবে। দুদন্ড তার তলায় বসে জিরিয়ে নিতে ইচ্ছেও হবে। আর তখনই চোখে পড়বে গাছটিতে কে যেন কবে দেবত্ত্ব আরোপ করে দিয়েছে। গাছের ফাঁকে গড়ে উঠেছে ছোটখাটো একটি আশ্রম।

‘ডাকহরকরা’ ছাড়াও গাছটির উল্লেখ পাওয়া যায় তারাশঙ্করের ‘কলিকাতার দাঙ্গা ও আমি’ গল্পে এবং ‘আমার কালের কথা’ নামক আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে। লাভপুরের অদূরে বামনিগ্রাম এক সময় কুখ্যাত ছিল মানষুড়ে (ঠ্যাঙারে ডাকাত) মুসলমানদের জন্যে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেও তারা গোপনে আপরাধমূলক কাজগুলির সঙ্গে যুক্ত ছিল। তখনও কাটোয়া-আমোদপুর ছোটলাইনের রেল চালু হয় নি। দূরদূরান্ত থেকে লাভপুর আসার সময় নিকটবর্তী স্টেশন ছিল আমোদপুর। আমোদপুর থেকে লাভপুর সাত মাইল পথ। সেই পথটুকু আসতে হত গোরুর গাড়িতে। স্টেশনের বাইরে গোরুর গাড়ি ভাড়া পাওয়া যেত। অনেক সময় গোরুর গাড়ির গাড়োয়ানও হতো ছদ্মবেশী ডাকাত। এই পথেই পড়ত আগয়া নদীর ব্রীজ। তারপরেই তিন মাইল জুড়ে খাঁ খাঁ প্রান্তর। তারই মাঝে সুঁদীপুরের বটতলা। ‘আমার কালের কথা’য় তারাশঙ্কর গাছটির এবং গাছের ফাঁকে আশ্রয় নেওয়া ঠ্যাঙাড়েদের বর্ণনা দিয়েছেন, ‘ঝুরি-নামা শিকড়ে বিশ পঁচিশটি কান্ড সৃষ্টি হয়েছে, সে এক ঘন জঙ্গলে ঘেরা ঠাঁই। দিনে সূর্যের আলো পড়ত না, এখানেই শতাব্দীকাল ধরে ঘটে গিয়েছে নিষ্ঠুর নরহত্যা।

... এই বটতলায় তারা রাত্রে পথিকের প্রতীক্ষা করত। বাঁশের খাটো লাঠি- মাটি ঘেঁষে সুকৌশল নিক্ষেপে প্রচণ্ড বেগে ছুটে পথিকের পায়ে আঘাত করত, পথিক পড়ে যেত। এরা ছুটে এসেই একটা লাঠি তার গলায় বা ঘাড়ে দিয়ে দুই প্রান্তে পা দিয়ে চেপে ধরত, অন্য একজন দুজন পায়ে ধরে মানুষটাকে উলটে দিত, মট্ শব্দ করে ভেঙে যেত ঘাড়ের মেরুদন্ডটা। তারপর অনুসন্ধান করত, তার কাছে কী আছে! এমনও শোনা গেছে যে, একজন মানুষকে হত্যা করে পেয়েছে হয়ত চারটে পয়সা আর তার পরনের জীর্ণ কাপড়খানা।’  

১৯৪৬ সালের লেখা ‘কলিকাতার দাঙ্গা ও আমি’ গল্পে তারাশঙ্কর লিখেছেন ‘হত্যাকান্ডের কথা ইতিহাসের পর্যায়ভুক্ত; আজকের কথা না। আগে- চল্লিশবছর আগে ঘটত এমন কান্ড। তারপর এই চল্লিশ বছরের মধ্যে এমন কান্ড ঘটে নাই।’

আজও এই বটতলা সম্পর্কে বহু অলৌকিক কাহিনি শোনা যায়। তবে এই রহস্যময় স্থানটি নিয়ে চমৎকার একটি আলোচনা পাওয়া যায় ‘কলিকাতার দাঙ্গা ও আমি’ গল্পে তিনজনের কথোপকথনের মধ্যে। লেখক, মুসলমান গাড়োয়ান এবং একজন বাউল রাস্তা অতিক্রম করছিলেন বর্ষার রাতে। বাউল গাছটির নিচ দিয়ে যেতে যখন বারণ করছেন তখন যুক্তিবাদী লেখক প্রশ্ন করছেন, ‘কী আছে সাপ?’

গাড়োয়ান বলছে, ‘সাপ না বাবু পাপ।’

এই পাপের ব্যাখ্যা করেন বাউল বাবাজী।

‘... অন্ধকার রাতে মানুষ এখানে এসে বসলে প্রথমে হয় ভয়, তারপর ধীরে ধীরে ভয় কেটে গিয়ে মন নিঃশঙ্ক হয়, ওইসব নিষ্ঠুর ইতিহাস মনে পড়ে প্রবৃত্তিগুলি সজাগ হয়ে ওঠে, তারপর তারা নাচতে থাকে। চোখের দৃষ্টিতে জেগে ওঠে সেই সকল কামনা; তখন পাশে নারী থাকলে ব্যাভিচার করতে চায় মানুষ, পুরুষ থাকলে সর্বস্ব অপহরণ করতে চায়। দাহ্য কিছু সামনে থাকলে তাতে আগুন দেবার প্রবৃত্তি নিষ্ঠুর উল্লাসে সংকল্পে সম্বন্ধ হয়; এতে বিস্ময়ের কিছু নাই। যতক্ষণ তুমি পথিক এই সুঁদীপুরের বটতলাকে পাশে রেখে অতিক্রম করে যাবে, ততক্ষণ তোমাকে অভিভূত করবে, আতঙ্কে আকুল করবে নিহত পথিকের মর্মান্তিক ভয়যন্ত্রণা, কিন্তু ওখানে আশ্রয় নিয়ে ওখানকার আক্রমণ-আশঙ্কা থেকে মুক্ত হলেই মন বিপরীত উল্লাসে উল্লসিত হয়ে উঠবে।’         

(৪)

দীনু ইন্সপেক্টরকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, সে ভূতে বিশ্বাস করে না। ডাকাতেও ভয় করে না। তাছাড়া ডাকাত ঠ্যাঙাড়েরা আর নেই। তারা নির্বংশ হয়ে গিয়েছে। ইন্সপেক্টর দীনুকে কাজে বহাল করেন। কাজের দায়বদ্ধতা ও গুরুত্ব বুঝিয়ে দেন। সন্ধ্যেবেলা ডাক নিয়ে বেরিয়ে বোলপুরে পৌঁছতে হবে এগারোটার মধ্যে আবার বোলপুর থেকে ডাক নিয়ে ফিরতে হবে সকাল ছটার মধ্যে।

‘সরকার বাহাদুরের ডাক। টাকা পয়সা ইনসিওর, রেজিস্ট্রি। কত লোকের চিঠি।’ কাজেই জল ঝড়েও দেরি করা চলবে না। কারও সঙ্গে এক মিনিট দাঁড়িয়ে কথা বলা চলবে না। বসা চলবে না। চোর ডাকাতে ধরলে জান দিয়ে সরকার বাহাদুরের ডাক রক্ষা করতে হবে।

দীনু সম্মতি দিয়ে, আঙুলের ছাপ দিয়ে যোগ দেয় কাজে। সরকারী ইউনিফর্ম গায়ে, মাথায় পাগড়ি বেঁধে, কাঁধে ঘুঙুর-ঘণ্টা-বল্লম পরানো লাঠি নিয়ে সগর্বে বেরিয়ে আসে পোস্টঅফিস থেকে।        

একটা নির্দিষ্ট ছন্দে দীনুর জীবনযাত্রা শুরু হয়। গভীর রাতে নির্জন পথ পার হয়ে যায় সে। কত অমাবস্যা পূর্ণিমা পেরিয়ে যায়। গ্রীষ্ম যায়, বর্ষা আসে। শরত-হেমন্ত পেরিয়ে আসে শীত। সুঁদীপুরের বটতলা পার হয়ে যাওয়ার সময় খরখর শব্দ হয়। মাথার উপর কিছু যেন ঝরে পড়ে। কোনোদিন শেয়াল ডাকে। কোনোদিন কুকুর। এভাবেই বছরের পর বছর ঘোরে। একদিন মাথার উপর কিছু পড়তেই দীনু থামে। উপরে তাকিয়ে দেখে ডালপালা নড়ছে। কাঁধ থেকে লাঠিটা নামিয়ে ছুঁড়ে মারে ঝুঁকে পরা একটা ডালে। নিশানা ব্যর্থ হয় না। উপর থেকে ধপ করে যা পড়ে তা একটি বন্য জন্তু ‘খটাস’। ওরা গাছেই বাস করে। বটের ফল খায়। গাছের নিচে কারও পায়ের শব্দ পেলে এক ডাল থেকে অন্যডালে লাফ মারে। অমনি পাকা ফল ঝরে পড়ে ঝুরঝুর করে।

সেদিন সেই বল্লম বিদ্ধ মৃত জন্তুটাকেও মেল-ব্যাগের সঙ্গে কাঁধে বয়ে নিয়ে বোলপুরে যায় দীনু। পোস্টমাস্টারকে দেখায় যে, সে সুঁদীপুরের বটতলার ভূতকে মেরেছে। পোস্টমাস্টারের ইচ্ছে মতো খটাসের চামড়াখানি দেওয়ালে টাঙ্গানোর উপযুক্ত করে দিয়ে ধন্য হয়। 

এ হেন নিষ্ঠাবান দীনুর একমাত্র ছেলে নিতাই বাপের আদর্শ মানে না। সে লোভী এবং অপরাধপ্রবণ। একদিন এই বটতলাতে নিতাই বাবাকে আক্রমণ করে। কেড়ে নিতে চায় মেল-ব্যাগ কারণ সে জানে এক মাড়োয়ারির ইন্সিওরের দুহাজার টাকা আছে ওই ব্যাগে। বিদ্যুতের আলোয় ছেলেকে চিনতে পারলেও দীনু ব্যাগ ছাড়ে না। ব্যর্থ মনোরথ নিতাই বাপের মাথায় লাঠির বাড়ি মেরে পালিয়ে যায়।

অফিসাররা যখন নিঃসন্দেহ যে এই কাজ কোনও স্বদেশীবাবুর তখন আহত দীনু জানায় অপরাধী তার ছেলে। একদিকে কর্তব্যপরায়ণতার জন্যে সরকারের কাছ থেকে পুরস্কার পায় দীনু, অন্যদিকে তার একমাত্র সন্তান নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। আরও কয়েক বছর বাদে একদিন নিতাইয়ের খবর আসে। সে খবর দীনুই বহন করে আনে। দীর্ঘ কর্মজীবনে সেই প্রথম রেজিস্ট্রি পার্সেল আসে দীনুর নামে। পোস্টঅফিসে সবাই কৌতূহলী। ডাক কাটা হয়। চিঠি খোলা হয়। জাহাজ কোম্পানির চিঠি, সঙ্গে কিছু টাকা আর মেডেল। নিতাইয়ের বীরত্বের পুরস্কার। পোস্টমাস্টার চিঠি পড়েন। শেষ পর্যন্ত নিতাই একটি জাহাজ কোম্পানিতে কাজ জুটিয়েছিল। যুদ্ধের সময় তাদের জাহাজ একটি মাইনের সঙ্গে সংঘর্ষে জলমগ্ন হলে সেই জাহাজের যাত্রীদের নিরাপদে নৌকায় তুলে আত্মবিসর্জন দিয়েছে নিতাই। দিনুর চারিপাশের জটলা গুঞ্জনে মুখরিত হয়। প্রশংসা আর নিন্দার গুঞ্জন। দীনুর আর সহ্য হয় না। তীব্র আবেগে সে চাকরিতে ইস্তফা দেয়। তারপর শুরু হয় তার অপেক্ষা। ঈশ্বরের বিচারের অপেক্ষা।

মানব জীবনের অসহায়তা, দীনুর সারল্য ও মাধুর্যের এমন নির্মাণ পাঠককে মুগ্ধ করে। আর মুগ্ধ করে এই গল্পের জন্যে লেখা তারাশঙ্করের গানগুলি। আঞ্চলিক পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে মানব হৃদয়ের বেদনাকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন বাউলের কন্ঠে। উপন্যাসের পাঠ অন্তে শেষ গানখানির রেশ মস্তিকে ঘুরে বেড়ায় অনেকক্ষণ,  

‘খেয়া ঘাটের পারাপারে...

মাশুল দিয়ে বারে বারে...

শেষ খেয়ারই ঘাটের ধারে এলেম দেউলে দশায়...

পাওনা কিছু থাকলে এবার দাও হে রাজামশায়

তোমার শেষ বিচারের আশায়।

... তোমার শেষ বিচারের আশায় বসে আছি।’

---

তথ্যঋণঃ বেণুকর মণ্ডল ও সুভাষ আচার্য।