লোকসভা নির্বাচনে বিকল্প গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রসঙ্গে

সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির অশ্বমেধের ঘোড়াকে সাময়িক ভাবে যে রুখে দেওয়া গেছে, তার পিছনে কার বা কাদের ভূমিকা বেশী, এই নিয়ে নানান আলোচনা চলছে। একটা কথা এবারের নির্বাচনে স্পষ্ট হয়েছে বিভাজন, মেরুকরণের রাজনীতির বিরুদ্ধে এ বারের লোকসভা ভোটে জনতার একটা বড় অংশ রায় দিয়েছে। সেই সঙ্গেই এ বারের নির্বাচন আর একটি বিভাজন স্পষ্ট করে দিয়েছে— প্রথাগত, প্রাতিষ্ঠানিক, বহুল প্রচারিত সংবাদমাধ্যমের বিপরীতে দাঁড়িয়ে, ছোট ছোট সংবাদমাধ্যম যাঁদের দর্শকশ্রোতা মূলত সমাজমাধ্যম, তাদের মধ্যে দিয়েও খবর এবং ধারণা তৈরী করা সম্ভব।  ইউটিউব-নির্ভর ছোট মাপের সংবাদমাধ্যমের মধ্যে দিয়েও যে বড় প্রাতিষ্ঠানিক সাংবাদিকতাকে পরাজিত করা যায়, তা এবারের নির্বাচন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কোনও প্রতিষ্ঠানে কাজ না করে বহু সাংবাদিক স্বাধীন ভাবে এই ভোটের খবর করেছেন। কেন করেছেন? শুধুমাত্র কি তাঁরা নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপির আদর্শের বিরোধী, না অন্য কোনও কারণ আছে?

যদি খেয়াল করা যায়, ২০১৪ সালের পরের থেকে ধীরে ধীরে ভারতের মূল ধারার সংবাদমাধ্যমগুলোর মালিকানা চলে গেছে মূলত আদানি আম্বানির হাতে। যার ফলে খবর যা সম্প্রচারিত হয়েছে, তা মূলত সরকারের তাবেদারি ছাড়া কিছু হয়নি। ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে, এই গণমাধ্যমগুলো যেভাবে উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং হিন্দুত্বের প্রচার করেছিল, যে বহু সাংবাদিক মনস্থির করে ফেলেছিলেন, তাঁরা হয় ছোট ছোট খবরের সংস্থা নিজেরা তৈরী করবেন, নয় নিজেরাই ইউটিউব চ্যানেল খুলবেন। শুধুমাত্র সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করার একটা বড় কারণ, বেশ কিছু ‘সাংবাদিক’ বুঝতে পারছিলেন যে  জনসাধারণের কাছে, প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা কমছে। গত ২০১৯ সালের  লোকসভা নির্বাচনে ঐ রকম সাফল্য পাওয়া বিজেপির বিরুদ্ধে যে এ বার ২০২৪ সালে দেশের নানা জায়গায়, নানা বিষয়ে ব্যাপক ক্ষোভ জমেছে, প্রথাগত টিভি চ্যানেল বা অন্য মাধ্যমে প্রচারিত খবর দেখলে তার আন্দাজ পাওয়া যায়নি। এ বার সংসদে বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়িয়ে বহু দূর চলে যাওয়ার যে ঘোষণা প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন, তা প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের দ্বারা সাধারণ মানুষের কাছে পৌছেছে। সেই ঘোষণা এক বার নয়, বার বার সম্প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু প্রচলিত গণমাধ্যম যে প্রশ্ন করেনি, তা হল এই দাবির যৌক্তিকতা কতটা, বা এই দাবীর বাস্তবতা কতটা?  

প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের বাইরে দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা, স্থানীয় ভাবে, মাটিতে নেমে কাজ করা বহু সামাজিক মাধ্যম নির্ভর সংবাদমাধ্যম থেকে অবশ্য জানা যাচ্ছিল যে, ‘চারশো পার’-এই বাতাবরণের বাইরে বাস্তবে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে একটা ক্ষোভের স্রোত আছে। সেই স্রোত কিন্তু গোপন ছিল না, যথেষ্ট প্রকট ছিল। কিন্তু কেউ যদি দেখতে না চান, তাহলে তিনি দেখতে পাবেন না, যে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে একটা ক্ষোভ আছে। আসলে সেইভাবেই চিত্রনাট্য সাজানো হয়, যাতে সাধারণ মানুষের চোখে না পড়ে মুল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব ইত্যাদি দৈনন্দিন অসুবিধা। কিন্তু সেই বাস্তব ২৪ ঘণ্টার খবরের চ্যানেলের পর্দায় তেমন ভাবে উঠে আসেনি। তাই একটা বড় অংশের দর্শক প্রথাগত সংবাদমাধ্যম থেকে সরে গিয়ে ইউটিউব-নির্ভর সাংবাদিকদের কথা শুনেছেন।  আসলে ক্ষেত্রটা প্রস্তুত ছিলই, বিকল্প জায়গা ফাঁকাই ছিল। ইউটিউবে পরিচিত সাংবাদিকদের আপলোড করা ভিডিয়োগুলির দর্শকের বিপুল সংখ্যা থেকেই বুঝতে পারা যাচ্ছিল, মানুষ বিকল্প কথা শুনতে চাইছেন।

প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের সম্প্রচারের বেশির ভাগটা এ ভাবে শাসককেন্দ্রিক হওয়ায় বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারাও পাল্টা কৌশল নেন। দীর্ঘ ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’য় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী কোনও প্রথাগত সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেননি। দিয়েছেন ইউটিউবারদের। প্রচলিত সংবাদমাধ্যম বাধ্য হয়েছে, সেই ইউটিউব থেকে ছবি এবং ভিডিও নিয়ে খবর করতে। ব্রাজিলে লুলা ডি সিলভা, এই একই কাজ করেছিলেন। সেখানকার প্রচলিত সংবাদমাধ্যম যখন লুলা’কে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁর কর্মসূচীর খবর বয়কট করছিল, তিনিও বিকল্প সংবাদমাধ্যমকে বেছে নেন। আমাদের দেশের ফল বেরোনোর ঠিক আগে সম্প্রচারিত বুথফেরত সমীক্ষার হিসাবও প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার জমি তৈরি করে দিয়েছে। কারণ, ইউটিউব-নির্ভর বহু সাংবাদিকই যে সমীক্ষা করেছিলেন, সেগুলি ছিল বিখ্যাত সংস্থাগুলির করা সমীক্ষার উল্টো। তার না ছিল, কোনও যুক্তি, না ছিল কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি। ফল বেরোনোর পর দেখা গেছে প্রচলিত গণমাধ্যমের বাইরে থাকা ইউটিউব এবং সামাজিক মাধ্যমে কাজ করা ছোট ছোট স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের করা বুথ ফেরত সমীক্ষাগুলোই বাস্তবের সবচেয়ে কাছাকাছি। বাংলার ক্ষেত্রে তো এই বিষয়টা সবচেয়ে বেশী প্রযোজ্য।

বহু মানুষ নিজের মতো করে এই কাজটা করেছেন। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী উল্লেখ করতে হয়, ম্যাগসাইসাই পুরষ্কার প্রাপ্ত রভীশ কুমারের কথা। আরো বহু নামী সাংবাদিক ছিলেন, অভিসার শর্মা, অজিত আঞ্জুম, দীপক শর্মারা দিনের পর দিন, মাটির কাছাকাছি থেকেছেন, শাসককে প্রশ্ন করেছেন। যে প্রশ্ন করার দরকার ছিল দেশের প্রচলিত গণমাধ্যমের বিখ্যাত সাংবাদিকদের, তাঁদের বদলে সেই প্রশ্ন করেছেন এই স্বাধীন সাংবাদিকেরা এবং অন্যান্য ইউটিউবাররা। বেশ কিছু স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান, অর্থাৎ কৌতুক শিল্পীরা এই কাজটা করেছেন। তবে বিশেষ করে নাম করতে হয়, ধ্রুব রাঠীর। একজন একা মানুষ যে কত শক্তিশালী, তা তিনি প্রমাণ করলেন। ধ্রুব রাঠী মাস তিনেক আগে একটি ভিডিয়ো আপলোড করেন, যার বিষয় ছিল, ‘ভারত কি একনায়কতন্ত্রে পরিণত হচ্ছে?’ ভোট শেষ হওয়ার মুখে  দেখা গেছে, প্রায় আড়াই কোটি মানুষ এই ভিডিও দেখেছেন। ধ্রুব রাঠীকে সাংবাদিক বলা যাবে না। কিন্তু যে কারণে ধ্রুবের ভিডিয়ো এমন প্রবল ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, সেই কারণ ইউটিউব-নির্ভর জনপ্রিয় সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেও সত্যি। তা হল, প্রশ্ন করার অভ্যাস। শাসকের দাবিকে প্রশ্ন না করে, যুক্তিজালে বিশ্লেষণ না করে কেবল বারংবার সম্প্রচারের কারণেই হয়তো প্রচলিত সংবাদমাধ্যম থেকে মুখ ফিরিয়েছেন বহু দর্শক। তাঁরা ভিড় জমিয়েছেন, ভিউ বাড়িয়েছেন স্বাধীন সাংবাদিকদের ইউটিউব চ্যানেলে।

আরো একটি উদাহরণ অবশ্যই দিতে হবে, এই লেখা সম্পূর্ণ করতে। ভুয়ো এবং মিথ্যা তথ্যকে যাঁরা নিয়মিত ফাঁস করেছেন, সেই অল্ট নিউজের কথা না বললে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। যে অল্ট নিউজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ জুবেইরকে, এই কাজ করতে গিয়ে জেলও খাটতে হয়েছে। এখনো তাঁর পাশপোর্ট বাজেয়াপ্ত করে রেখেছে দিল্লি পুলিশ। এই সমস্ত মানুষদের হার না মানা লড়াই, গত দশ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আজকে নরেন্দ্র মোদীর দর্প কিছুটা চূর্ণ করা গেছে। কিন্তু কাজটা শেষ হয়ে যায়নি। এখন মাথা নীচু করে থাকলেও অচিরেই নিজের আসল রূপ দেখাতে শুরু করবে নরেন্দ্র মোদী অমিত শাহ এবং তাঁদের পেটোয়া সংবাদমাধ্যমগুলো। সেই কথা মাথায় রেখেই, আরো সজাগ থাকতে হবে এই ছোট ছোট সংবাদ মাধ্যম এবং ইউটিউবারদের। সামনে আরো কঠিন লড়াই। বিকল্প কথা তো প্রচলিত গণমাধ্যম বলবে না, তাই সেই দায়িত্বটা বর্তায় মানুষের ওপর। মানুষ যদি বিকল্পের কথা না প্রচার করে, তাহলে বিকল্প আসবে কী করে? গোদী মিডিয়াকে বয়কট করার শিক্ষা প্রথম দিয়েছিলেন কৃষকেরা, আগামী দিনে সেই কাজটাকেই একটা আন্দোলনের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াটা এখন সময়ের দাবী।