লোকসভা নির্বাচন ২০২৪ : পশ্চিমবঙ্গের রায় ও বামেদের জন্য শিক্ষা

লোকসভা নির্বাচন ২০২৪ এর ভোটগণনা শেষ হবার পর যে পরিসংখ্যান সামনে এসেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের ৪২ টি আসনের মধ্যে তৃণমূল পেয়েছে ২৯ টি, বিজেপি ১২ টি এবং কংগ্রেস একটি। বিজেপির আসনগুলির বেশীরভাগ এসেছে উত্তরবঙ্গ থেকে। কংগ্রেসের একমাত্র আসনটিও উত্তরবঙ্গের। মালদা দক্ষিণ কেন্দ্র থেকে বিজয়ী হয়েছেন কংগ্রেস প্রার্থী ঈশা খান চৌধুরী। দক্ষিণবঙ্গে মেদিনীপুর থেকে বিজেপি দুটি আসন জিতেছে। কাঁথি ও তমলুক। এই জয়ের পেছনে বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সাংগঠনিক দক্ষতা রয়েছে। তবে মেদিনীপুর আসনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর বিজেপির অগ্নিমিত্রা পল তৃণমূলের প্রার্থী জুন মালিয়ার কাছে সাতাশ হাজার ভোটে পরাস্ত হয়েছেন। ঘাটাল থেকে দেব অবশ্য বিজেপির হিরণ চট্টোপাধ্যায়কে প্রায় এক লাখ তিরাশি হাজার ভোটে হারিয়ে দিয়েছেন। এছাড়া দক্ষিণবঙ্গে বিজেপি বাংলাদেশ সীমান্তে থাকা বনগাঁ ও রানাঘাট আসন দুটি জিততে পেরেছে। মূলত মতুয়া ভোট বিজেপির দিকে থাকায় বনগাঁ থেকে বিজেপির শান্তনু ঠাকুর প্রায় সাড়ে তিয়াত্তর হাজার ভোটে জিতেছেন। রানাঘাট থেকে বিজেপির জগন্নাথ সরকারের জয়ের মার্জিন আরো বেশি, প্রায় এক লক্ষ সাতাশি হাজার। দক্ষিণবঙ্গে বিজেপির বাকি দুটি আসন এসেছে পুরুলিয়া ও বিষ্ণুপুর থেকে। পুরুলিয়াতে জ্যোতির্ময় সিং মাহাতোর জয়ের মার্জিন এক লক্ষ সত্তর হাজার, বিষ্ণুপুরে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর বিজেপির সৌমিত্র খাঁ তৃণমূলের সুজাতা মন্ডলকে হারিয়েছেন সাড়ে পাঁচ হাজার ভোটে।

দক্ষিণবঙ্গে বাকি সমস্ত আসনে বিজেপিকে পরাস্ত করে তৃণমূল জিতেছে। অধিকাংশ আসনে তৃণমূলের জয়ের মার্জিন যথেষ্ট বেশি। ডায়মণ্ড হারবার থেকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জিতেছেন সাত লক্ষ দশ হাজারেরও বেশি ভোটে, যা বোধহয় এক সর্বকালীন রেকর্ড। টিকিট না পেয়ে ভোটের ঠিক আগে তৃণমূল থেকে বিধায়ক পদে ইস্তফা দিয়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া দুই প্রার্থী অর্জুন সিং ও তাপস রায় পরাস্ত হয়েছেন। ব্যারাকপুরে অর্জুন তৃণমূলের পার্থ ভৌমিকের কাছে হেরেছেন চৌষট্টি হাজারেরও বেশি ভোটে। কলকাতা উত্তরে তৃণমূলের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তাপস রায় হেরে গিয়েছেন বিরানব্বই হাজারেরও বেশি ভোটে।

মুর্শিদাবাদের দুটি কেন্দ্রে কংগ্রেস ও সি পি আই (এম) এর দুই সেনাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী ও মহম্মদ সেলিম এর নেতৃত্বে বাম ও কংগ্রেস কর্মীরা এই নির্বাচনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিলেন। তাঁরা অতীতের তিক্ততা ও জড়তা কাটিয়ে এবার পরস্পর পরস্পরকে ভোটও দিয়েছেন বলে মনে হয়েছে। তা সত্ত্বেও সি পি আই (এম) ও কংগ্রেস শিবিরের এই দুই সেনাপতির পরাজয় ঘটেছে। মুর্শিদাবাদে জয়ের আশা নিয়ে লড়াই করেও তৃণমূলের আবু তাহের খানের কাছে সি পি আই (এম) এর রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম হেরে গিয়েছেন এক লক্ষ চৌষট্টি হাজার মতো ভোটে। তৃণমূলের হয়ে ভোটে দাঁড়ানো, আক্ষরিক অর্থেই ক্রিকেটের পিচ থেকে উড়ে আসা ইউসুফ পাঠানের কাছে অধীর চৌধুরীকে হারতে হয়েছে প্রায় পঁচাশি হাজার ভোটে।

জঙ্গিপুরে তৃণমূলের খালিলুর রহমানের কাছে পরাস্ত হওয়া কংগ্রেস প্রার্থী মুর্তজা হোসেন বকুল দ্বিতীয় স্থান পেয়েছেন। মুর্শিদাবাদ, বহরমপুর, জঙ্গীপুরের বাইরে কংগ্রেস বা সি পি আই (এম) সহ বামপন্থীরা এই নির্বাচনে জেতা দূরে থাক, পশ্চিমবঙ্গের কোথাও দ্বিতীয় স্থানও পান নি।

যাদবপুর ও দমদমে সি পি আই (এম) সমর্থকরা ভালো ফলের আশা করেছিলেন। দমদম থেকে লড়াই করা সি পি আই (এম) এর অন্যতম প্রধান রাজ্যনেতা সুজন চক্রবর্তী বিজয়ী তৃণমূলের সৌগত রায় ও দ্বিতীয় বিজেপির শীলভদ্র দত্তর থেকে অনেকটা পিছিয়ে থেকে পেয়েছেন তৃতীয় স্থান। যাদবপুরে সি পি আই (এম) এর তরুণ প্রার্থী সৃজন ভট্টাচার্যও তৃতীয় স্থান পেয়েছেন তৃণমূলের সায়নী ঘোষ এবং বিজেপির ড অনির্বান গাঙ্গুলির পেছনে থেকে। সি পি আই (এম) এর আর এক তরুণ প্রার্থী দীপ্সিতা ধর প্রচার পর্বে সামাজিক মাধ্যমে বেশ সাড়া ফেলেছিলেন। তিনিও তৃণমূলের কল্যাণ ব্যানার্জী এবং বিজেপির কবীর শঙ্কর বোসের পেছনে থেকে তৃতীয় স্থান পেয়েছেন।

পরাজয়ের পর দিল্লির জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেত্রী দীপ্সিতা সংবাদ মাধ্যমের সামনে যা বলেছেন তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। সি পি আই (এম) এর নবীন মুখ স্বীকার করে নিয়েছেন পরিস্থিতির মূল্যায়নে তাঁদের বেশ বড়সড় ভুল হয়েছিল। তারা বুঝতে পারেন নি যে এই নির্বাচন গোটা দেশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও মূলত বিজেপিকে হারানোর প্রশ্নটিকে সামনে রেখেই হতে চলেছে। দুর্নীতি সহ অন্যান্য ইস্যু এই নির্বাচনে থাকলেও দেশের সরকার গঠনের প্রশ্নটিই এই নির্বাচনের প্রধান ও নির্ণায়ক ইস্যু ছিল। এই প্রধান ইস্যুর বিষয়টি যে তারা ধরতে পারেন নি, সেটা দীপ্সিতা অকপটে জানিয়েছেন। রাজ্য সরকারের তরফে চালানো লক্ষীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী ইত্যাদির মতো সামাজিক ন্যায়ের প্রকল্পগুলিরও তারা বিরোধী নন বলে দীপ্সিতা একই সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন। সামাজিক ন্যায় প্রকল্পের পাশাপাশিই স্থায়ী সম্মানজনক কাজ ও সেই কাজে দুর্নীতিহীনভাবে প্রবেশের সুযোগের কথাটা তারা তুলতে চান বলেই দীপ্সিতা জানিয়েছেন।

মানুষের পাশে থেকে তিনি ও তাঁর দল লড়াই চালিয়ে যাবেন, ভুলগুলি বিশ্লেষণ করবেন ও তা থেকে শিক্ষা নেবেন – বিরাট পরাজয়ের পরেও এই ধরনের কথা আশ্বাস দেয়। তবে আশঙ্কাও থেকে যায় অতীতের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা থেকে। অনেকেরই মনে থাকার কথা দু হাজার একুশ সালের বিধানসভা নির্বাচনে একই রকমের বড়সড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হওয়ার পরে সি পি আই (এম) এর সর্বোচ্চ নেতৃত্ব প্রকাশ্যে বিজেমূল তত্ত্বকে ভুল বলেছিলেন। কিন্তু আমরা দেখেছি সি পি আই (এম) এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শাখা ও তাদের প্রধান নেতৃত্ব সহ অধিকাংশ পার্টি নেতা কর্মী কার্যত এই বিজেমূল তত্ত্বকে সামনে রেখে এগিয়েছেন। বিজেপি এবং তৃণমূল কার্যত একই এবং একে অন্যকে সাহায্য করে, এই কথা যা বাস্তবের মাটিতে মিলমিশ খাচ্ছে না, এটা সি পি আই (এম) নেতৃত্ব কখনো কখনো মুখে স্বীকার করে ফেললেও অচিরেই ভুলে যাচ্ছেন এবং ভুল নীতিকৌশলের পুনরাবৃত্তি করে চলেছেন। এই রাজ্যে এই ভুলের মাশুল শুধু তাঁদেরই দিতে হয়েছে তাই নয়, কংগ্রেস তথা তাঁদের রাজ্য সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরীকেও দিতে হয়েছে। গত লোকসভায় কংগ্রেসের বিরোধী দলনেতা মনোনীত হওয়া অধীর দেশজুড়ে কংগ্রেসের ঘুরে দাঁড়ানোর এই নির্বাচনে সংসদের বাইরে চলে যেতে বাধ্য হলেন।

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বামপন্থীরা কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে সে নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা ও বিচার বিশ্লেষণ দরকার। কিন্তু সেই সবের প্রাকশর্ত খোলামেলাভাবে স্বীকার করে নেওয়া দেশের প্রধান শত্রুকে চেনা ও সেই নিরিখে তাকে নিশানা করার ক্ষেত্রে সি পি আই (এম) এর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টভুক্ত বামপন্থীদের ভুল হচ্ছে। জাতীয় কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট ঘনিষ্ট হয়ে পড়া রাজ্য কংগ্রেসের মধ্যেকার কিছু অস্বস্তিকর বার্তা আদানপ্রদানকেও এই নিরিখ থেকেই বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

পশ্চিমবঙ্গে বাম আন্দোলনের ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। সেই ঐতিহ্যে নানা ধরনের বাম শক্তি ঐক্য ও বিতর্কের মধ্যে দিয়ে কাজ করেছে। সাতাত্তর সালে বাম সরকার ক্ষমতায় আসার পর নানা ধরনের বাম শক্তির এক পুনর্বিন্যাস হয় এবং সি পি আই (এম) তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে। নকশালপন্থী শক্তিদের মধ্যে সামনের সারিতে থাকা সি পি আই (এম এল) লিবারেশন এর তরফে সোভিয়েতের পতন ও আন্তর্জাতিক বাম রাজনীতির নতুন পরিস্থিতিতে নব্বইয়ের দশকেই এসেছিল লেফট কনফেডারেশন এর ডাক। সেখানে কোনও দলের সাংগঠনিক বা সংসদীয় আধিপত্যের বাইরে বামপন্থীদের খোলামেলা মুক্ত পথে ঐক্য সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বাম সংহতির নতুন পুনর্বিন্যাসের কথা বলা হয়েছিল। সেই সময়ে সি পি আই (এম) এর তরফে প্রাকশর্ত থাকত বামফ্রন্ট সরকারকে মান্যতা দেওয়ার প্রশ্নটিকে ঘিরে। আজ নতুন পরিস্থিতি এসেছে, বামফ্রন্ট সরকারও এক দশক আগে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু সরকারের স্মৃতি আঁকড়ে ও সরকারে ফিরে আসার স্বপ্নকে উশকে দিয়ে সেই বামফ্রন্ট মডেলকে নিয়েই বামেদের যৌথ কার্যকলাপের কথা ভাবা হচ্ছে সি পি আই (এম) এর তরফে।

গোটা দেশের পরিস্থিতি গত এক দশকে আমূল বদলে গেছে। পাল্টেছে বামেদের শক্তি বিন্যাসের ভারসাম্যও। আজকে বাম ঐক্যকে বাস্তবে গড়ে তুলতে চাইলে এই নতুন পরিস্থিতির উপযুক্ত মতাদর্শ, রণনীতি, রণকৌশল যেমন দরকার, তেমনি দরকার বাম আন্দোলনের নতুন মঞ্চ, যার বিন্যাসটাই হতে হবে একেবারে নতুন রকমের। রাজস্থানে সি পি আই (এম) এর অমরা রামের সাংসদ হওয়া বা বিহার থেকে সি পি আই (এম এল) এর দুজন সাংসদ হওয়া দেশের বাম রাজনীতির সামগ্রিক সঙ্কটের মধ্যেও আশার আলো। এই আলো কীভাবে জ্বলল তার বিশ্লেষণ করে সেখান থেকে শিক্ষা নেওয়া খুবই দরকার। আলাদাভাবে কখনো এর সম্যক বিচার বিশ্লেষণের দিকে আমরা এগোতে চাইবো, কিন্তু আপাতত কেবল এটুকু মনে রাখতে হবে যে রাজস্থানে অমরা রাম জিতেছেন চলমান কৃষক আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে। অন্যদিকে বিহারে যে দুটি আসনে সি পি আই (এম এল) জয় পেয়েছে, সেই দুটি আসনই এসেছে ভোজপুর থেকে। এই ভোজপুরই ছিল সত্তর দশকের গোড়ায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার পর সাহসের সঙ্গে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে নতুন লড়াই গড়ে তোলার মূল ভিত্তিভূমি। সি পি আই (এম এল) লিবারেশন এর প্রথম সাধারণ সম্পাদক কমরেড জহর (সুব্রত দত্ত) এখানেই শহীদ হন। কমরেড জহর ও পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক কমরেড বিনোদ মিশ্রর কর্মকান্ডের মূল এলাকা ছিল এই ভোজপুর। শত সহস্র কমরেড এখানে রাষ্ট্রীয় ও সামন্তী শক্তির মোকাবিলা করতে দশকের পর দশক ধরে জীবনপণ করেছেন, জেল খেটেছেন, শহীদ হয়েছেন। এই আন্দোলনের ওপর তৈরি রিপোর্ট “বিহারের বহ্নিমান খেতখামার থেকে” (ফ্রম দ্য ফ্লেমিং ফিল্ডস অব বিহার) ভারতের বাম রাজনীতির অন্যতম উজ্জ্বল অধ্যায়ের এক দলিল। এই ইতিহাসের প্রেক্ষাপট বাদ দিয়ে ভোজপুরের আরা ও কারাকট থেকে সি পি আই (এম এল) এর দুই কৃষক নেতা সুদামা প্রসাদ ও রাজারাম সিং এর এবার বিজয়ী হয়ে সংসদে প্রবেশ করাকে বোঝা সম্ভব নয়। সেইসঙ্গে চলমান রাজনীতির দাবিতে বিজেপি বিরোধী জোটে শরিক হওয়ার নমনীয় রণকৌশলটিকেও ভুলে গেলে চলবে না।

বাম রাজনীতি আজকে কোথায়  কেন সফল বা ব্যর্থ হচ্ছে তা থেকে শিক্ষা নেবার কথাটা বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে কেবল কিছুদিনের জন্য মুখে বললেই চলবে না, তাকে প্রয়োগ করার ইচ্ছা ও সেজন্য পুরনো ভুলকে শুধরে নেবার নমনীয়তা দরকার। আশা করা যাক নতুন পরিস্থিতিতে সেই কাজ নতুনভাবে শুরু হবে।