লোকসভা নির্বাচনের রায় ২০২৪ : একটি প্রাথমিক পর্যালোচনা

সমস্ত এক্সিট পোলের ভবিষ্যৎবাণীকে ধূলিস্যাৎ করে ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনের রায় সামনে এল। যে বিজেপি বলেছিল তারা নিজেরাই ৩৫০+ আসন পাচ্ছে আর জোটসঙ্গীদের নিয়ে চারশো পার করে যাবে, সেই বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনেক দূরে, ২৪০ আসনেই থেমে গেল।

এবারেও তার জোটসঙ্গীদের সহায়তায় হয়ত সে এন ডি এ সরকার গড়ে ফেলবে, তবে তার ধার ও ভার যে অনেক কমবে, সে সম্পর্কে কোনও সন্দেহ নেই। নীতীশ কুমারের জনতা দল ইউনাইটেড আর অন্ধ্রপ্রদেশের চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলেগু দেশম পার্টির ওপর তাদের পদে পদে নির্ভর করতে হবে, যে নেতাদের বারবার ডিগবাজী খাওয়ার কথা সর্বজনবিদিত। অন্তরঙ্গ বিশ্লেষণের আগে এক কথায় বলা যায় এই লোকসভা নির্বাচন ২০২৪ এর রায় এক অর্থে বিজেপির বিরুদ্ধেই গেছে।

বিজেপির বিপর্যয়ের প্রধান কারণ বড় ও গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলির প্রায় সবকটিতে – যার মধ্যে আছে উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ প্রভৃতি - তাদের ভরাডুবি হয়েছে। তামিলনাড়ুতে বিজেপি জোটের পরাজয় ও ইন্ডিয়া জোটের একাধিপত্য নিয়ে কারোরই কোনও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু উত্তরপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্রে যে বিজেপির এই পরিমাণ ধাক্কা আসবে, তা খুব কম লোকই ভাবতে পেরেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপির বানিয়ে তোলা ফানুসটি চুপসে গেছে এবং তারা কোনওরকমে ডবল ডিজিটে পৌঁছেছে। তিরিশটি আসন পাবে দাবি করে মাত্র দশে আটকে যাওয়া দেখিয়ে দেয় যে মিডিয়া, এজেন্সি, আদালতের রায় ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীলতার বাইরে তারা এখনো এখানে স্থায়ী জমি তৈরি করতে পারে নি।

ভোটের ঠিক আগেই দেশের সবচেয়ে বড় রাজ্য আশি আসনের উত্তরপ্রদেশে রাম মন্দিরের সাড়ম্বর উদ্বোধনের মধ্যে দিয়ে যে হিন্দুত্বের হাওয়াকে গোটা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল বিজেপি, মোদি যে উত্তরপ্রদেশ থেকে ভোটে লড়েন এবং তাদের আগামীদিনের সম্ভাব্য প্রধান মুখ আদিত্যনাথ যোগী যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, সেখানে বিজেপির আসন এই পরিমাণে কমে যাওয়া নি:সন্দেহে এই নির্বাচনের সবচেয়ে বড় ঘটনা৷ উত্তরপ্রদেশে বিজেপি পেয়েছে মাত্র তেত্রিশটি আসন ও তার সহযোগীরা আরো গোটা চারেক। ইন্ডিয়া জোট উত্তরপ্রদেশে নিজেদের প্রত্যাশাকেও ছাপিয়ে গেছে এবং এর মূল কাণ্ডারী সমাজবাদী পার্টির প্রধান অখিলেশ সিংহ যাদব। সমাজবাদী পার্টি নিজেরা ছত্রিশটি আসন পেয়েছে এবং কংগ্রেসকেও সাতটি আসনে জিততে সাহায্য করেছে। সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশে ইন্ডিয়া জোটের তেতাল্লিশটি আসন জেতা ভারতীয় রাজনীতিতে সম্ভাবনার অনেক দুয়ার উন্মুক্ত করে দিল। এই ঘটনার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া যে আগামীদিনে ভারতীয় রাজনীতিকে বিরাটভাবে প্রভাবিত করবে, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। উত্তরপ্রদেশে বিজেপিকে কীভাবে এই পরিমাণ ধাক্কা দেওয়া গেল, তার বিশ্লেষণ দরকার। যে সব রাজ্যে এখনো বিজেপির একাধিপত্য – যেমন গুজরাট বা মধ্যপ্রদেশ সেখানে বিরোধীদের এই সংক্রান্ত বিশ্লেষণের শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে।

এই নির্বাচনের দ্বিতীয় বড় ঘটনা মহারাষ্ট্রে বিজেপি জোটের বিরাট পরিমাণে ধাক্কা। মহারাষ্ট্রে যে বিজেপি বেকায়দায় পড়তে চলেছে সেই বিষয়ে পূর্বাভাষ ছিল। মারাঠী অস্মিতা বনাম গুজরাটি অস্মিতা মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মহারাষ্ট্রের বিজনেস লবি অনেকদিন ধরেই গুজরাটি ক্রোনি পুঁজিপতিদের দ্বারা কোণঠাসা হচ্ছিল এবং ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজছিল। রাহুল গান্ধীর লাগাতার আম্বানি আদানিকে আক্রমণ এই লড়াইতেই মারাঠী অস্মিতার পাশে দাঁড়ানোর বার্তাবাহী ছিল। এই বার্তা ইন্ডিয়া জোটকে অনেকটা সাহায্য করেছে৷ শিবসেনা এবং এন সি পিকে ভেঙে মহারাষ্ট্রে ক্ষমতা দখল মারাঠী জনতা যে ভালোভাবে নেয় নি, এই নির্বাচনের ফলাফল থেকে সেটাও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী যেখানে এবং অর্থনৈতিকভাবে যে রাজ্যটি সবচেয়ে এগিয়ে থাকা, সেই রাজ্যে বিজেপির নির্ণায়ক পরাজয়ও আগামী দিনের ভারতীয় রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করবে৷

কর্ণাটকেও বিজেপি তাদের প্রত্যাশিত সাফল্য পায় নি, তবে তার চেয়েও বড় ধাক্কা এসেছে রাজস্থানে। ২০১৯ সালে রাজস্থানের পঁচিশটি আসনের মধ্যে চব্বিশটিতেই তারা জিতেছিল। এইবার তাদের আসন সংখ্যা নেমে এসেছে চোদ্দতে। কংগ্রেস রাজস্থানে পেয়েছে আটটি আসন। বামেদের জন্য আনন্দের খবর কৃষক আন্দোলনের অন্যতম কাণ্ডারী সি পি আই (এম) এর অমরা রাম রাজস্থানের শিকর লোকসভা আসন থেকে প্রায় তিয়াত্তর হাজার ভোটে জিতেছেন।

 

পশ্চিমবঙ্গে সি পি আই (এম) ও বামেদের মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা বেশ কিছু কেন্দ্রে উৎসাহব্যঞ্জক প্রচার সত্ত্বেও আরো একবার ভয়াবহভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে। কোনও আসনেই তারা জিততে পারল না এবং ভোট শতাংশও আটকে রইলো ছয় শতাংশের মধ্যে। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয় কেরালাতেও সি পি আই (এম) এর পরাজয় ঘটেছে বিরাট মাত্রায়। তারা যেখানে রাজ্য সরকার চালাচ্ছে, সেখানেও কুড়িটির মধ্যে সি পি আই (এম) মাত্র একটি ও সি পি আই একটি আসনে বিজয়ী হয়েছে। তামিলনাড়ু থেকে আগের বারের মতোই সি পি আই ও সি পি আই (এম) দুটি করে আসনে বিজয়ী হয়েছে। তবে পশ্চিমবঙ্গের মতো ত্রিপুরাতেও ক্ষমতা থেকে চলে যাবার পর তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ত্রিপুরাতে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে দুটি আসনের একটিতে তারা লড়েছিল। ত্রিপুরা পূর্বের সেই আসনটিতে তারা শুধু বিজেপির কাছে হেরেছে তাই নয়, হারের ব্যবধান চার লক্ষ আশি হাজার ভোট।

তামিলনাড়ু ও রাজস্থান ব্যতীত অন্যত্র সি পি আই (এম) বা সি পি আই এর ব্যর্থতার চিন্তাজনক পুনরাবৃত্তির অপরদিকে বামেদের জন্য আশাব্যঞ্জক খবর এসেছে বিহার থেকে। সেখানে ইন্ডিয়া জোট খুব একটা ভালো ফল করতে পারে নি। আরজেডি মাত্র চারটি আসনে ও কংগ্রেস তিনটি আসনে জিতেছে। কিন্তু বিহারে মাত্র তিনটি আসনে লড়েই দুটি আসনে বিরাট জয় ছিনিয়ে আনতে পেরেছে সি পি আই (এম এল) লিবারেশন। আরাতে সি পি আই (এম এল) লিবারেশন প্রার্থী সুদামা প্রসাদ ও কারাকাটে লিবারেশন প্রার্থী রাজারাম সিং এর বড় ব্যবধানে জয় শুধু সি পি আই (এম এল) এর জন্যই নয়, গোটা ভারতেই ক্রমশ প্রান্তিক হতে বসা বামেদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিহারে এবার বিজেপি, জেডিইউ, এলজেপি জোট এর সামনে আরজেডি বা কংগ্রেস প্রত্যাশা অনুযায়ী সাফল্য পায় নি। সেই কঠিন জমিতে তিনটি কেন্দ্রে লড়ার সুযোগ পেয়ে দুটি কেন্দ্রে লিবারেশন এর জয় খুবই ইতিবাচক সাফল্য।

ভারতে বামেদের পুনর্জাগরণ কীভাবে সম্ভব তা নতুনভাবে ভাবার সময় এসেছে। সি পি আই (এম) এর ভয়াবহ ফলাফলের বিপরীতে সি পি আই (এম এল) লিবারেশন এর চমকপ্রদ উত্থানকে শুধু দলীয় রাজনীতির দিক থেকে না দেখে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার। পশ্চিমবঙ্গে যদি বামেদের ঘুরে দাঁড়াতে হয় তাহলে বামফ্রন্টের মডেলে আটকে থাকলে চলবে না। অন্য বামপন্থীদের দিকে ট্রোলবাহিনীকে এগিয়ে দিয়ে আখেরে যে লাভ হয় না, সেটা সি পি আই (এম) কে বুঝতে হবে। বামপন্থার মধ্যেকার বিতর্কগুলিকেও খোলামনে বোঝার ও আত্মস্থ করার চেষ্টা দরকার। সামাজিক মাধ্যমের আত্মমুখী জগৎসুখী মনোভাবের বাইরে এসে রাজ্য রাজনীতি ও দেশের স্বার্থে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থার পুনর্জাগরণের সমস্যা ও সম্ভাবনার সমস্ত দিকগুলিকে নিয়ে খোলা মনে বিচার বিশ্লেষণ করাটা এখন খুবই জরুরী।