রাধা ও বৈষ্ণব সম্প্রদায় : আমার চোখে তারাশঙ্করের গল্পভুবন

(১)

ছোটবেলায় দেখেছি পৌষ সংক্রান্তির সময়  সাধারণভাবে নিস্তরঙ্গ পল্লিজীবনে একটা অন্যরকম ঢেউ এসে পড়ত। গ্রামের বৃদ্ধবৃদ্ধাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ত চাঞ্চল্য। তাঁরা তীর্থে যাবেন। অন্যদিকে নিত্যদিনের কাজকর্মের জন্য মানুষ স্থানান্তরে যাবে কিন্তু বাসগুলো নির্দিষ্ট স্টপেজে দাঁড়ায় না। কন্ডাকটর চেঁচিয়ে ঘোষণা করে, ‘রিজাপ, মেলার জন্যে রিজাপ’। অর্থাৎ রিজার্ভড এবং মেলা হল জয়দেব কেঁদুলির মেলা। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কাছে যা মহাতীর্থ।

বীরভূমে জনজাতির মধ্যে অন্যতম হল বৈষ্ণব। আজও তাই প্রায় প্রতিটি বড় গ্রামেই বরিগপাড়া বা বরিগ্যির আখড়া দেখতে পাওয়া যায়। সন্ধ্যেবেলা গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে খোল-করতালের আওয়াজের সঙ্গে কীর্তনের সুর শুনতে পাওয়া যায়। নিত্য জীবনযাপনে আজও বৈষ্ণবরা বিশেষ কিছু রীতিনীতি মেনে চলে। তারা প্রায় সকলেই সেই সময় বেরিয়ে পড়ত। কিসের টানে যেত বোঝা যেত না কিন্তু তীব্র আকর্ষণের যে একটা কিছু আছে তা আন্দাজ করা যেত।  

আমার বাবা শিক্ষকতা করতেন কেঁদুলির কাছাকাছি শীর্ষা গ্রামে। আমাদের গ্রাম থেকে বেশ দূর। প্রায় ৬০ কিলোমিটার। তাই ওখানেই মেসে থাকতে শুরু করেছিলেন বাবা। আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীরা বিশেষভাবে খুশি হয়েছিলেন এই ভেবে যে, কেঁদুলি দর্শনটা বেশ সহজ হয়ে গেল। যেবার চাকরিতে যোগ দিলেন, সেবারেই আমাদের মেলা দেখাতে নিয়ে গেলেন বাবা। সেটা ১৯৮৫ সাল। পৌষ মাসের হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় আমাদের তুলে দেওয়া হল ভোরবেলা। সকাল হবার আগে জয়দেবে পৌঁছতে হবে। যাওয়ার জন্যে একটা গোরুর গাড়ির ব্যবস্থা হয়েছে। আমরা যাব বাবার প্রতিবেশী ও সহকর্মী পণ্ডিতমশায়ের পরিবারের সঙ্গে। পণ্ডিতমশায়ের স্ত্রী (জেঠিমা) আমাদের গাইড। উনি কদমখণ্ডির ঘাটে পুণ্যস্নান করবেন। ওইদিন গঙ্গা অজয়ের ধারার সঙ্গে মিশে উজানে চলে আসে কেঁদুলি পর্যন্ত।

কুয়াশা ভেদ করে সূর্য তখনও ওঠে নি। দেখলাম নদীর ধারে মানুষ গিজগিজ করছে। পায়ের নিচে ভেজা বালি। মধ্যে মধ্যে পাঁকের মতো। বলে না দিলে বোঝা মুশকিল ওটা নদী। জেঠিমা সঙ্গে মগ নিয়ে গিয়েছিলেন। বললেন আরও ভেতরে গিয়ে বালি খুঁড়লেই জল উঠবে। সেই জল মাথায় দুএক মগ ঢাললেই পুণ্যস্নান সমাপ্ত। জেঠিমা কেন, দেখলাম হাজার হাজার মানুষ তাই করছে। স্নান শেষে রাধাবিনোদের মন্দির যাওয়া হল। তখন লোকের ভিড়ে হারিয়ে যাবার ভয়েই আমরা অস্থির। তাই বড়ো কারও হাত ধরে জনস্রোতে ভাসতে ভাসতে চললাম, অনেকটা বন্যার জলে যেমন খড়কুটো ভেসে যায়। যেতে যেতে কানে এল বিচিত্র শব্দ। মেলায় যেমন সারি সারি দোকান আছে তেমনি আছে আখড়া। বৈষ্ণবের আখড়া। বাউলের আখড়া। আখড়াগুলোর এদিকে ওদিকে বড় বড় চোঙ বাঁধা। সেখানে থেকেই বাউল ও কীর্তন গান ভেসে আসছে।

দুপুরে একটা আখড়ায় উঠলাম। আখড়াটা বাবার একজন সহকর্মীর। বেশ আরাম ও খাতিরযত্নের ব্যবস্থা সেখানে। আশপাশের গ্রামের অনেক বনেদী বা অর্থবান পরিবারের এই রকম আখড়া আছে কেঁদুলিতে। এগুলো স্থায়ী আখড়া। সংক্রান্তির সময় এরা দর্শনার্থীদের অন্নদান করে। তিন ধরে অন্নমহোৎসব হয়। এরকম অসংখ্য আখড়ায় রান্না হচ্ছে। এই মেলার বিশেষত্ব খালি হাতে এসেও দু-তিনদিন ঘুরে বেড়ানো যায়। চতুর্দিকে দুবেলা খাবার বিলি হয়। রাত্রে যে কোনও আখড়ায় গান শুনতে শুনতে কাটিয়ে দেওয়া যায়। অথবা ওই আসরের এক কোণে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়া যায়। শীতের কারণে বসার শতরঞ্চের নীচে পুরু করে খড়ের গদি বিছানো থাকে। কাজেই দর্শনার্থীদের একটা বিপুল অংশ যে ভবঘুরে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।  

সেইবার মেলা দেখার পর আরও কয়েকবার গিয়েছি। প্রতি বছরই কাউকে না কাউকে জয়দেবমেলা দেখানোর কর্তব্য বাবাকে পালন করতে হতো। বায়না করে সেই দলে জুটে গেলেই কাজ হয়ে যেত। সেই বয়সে মেলা দেখা ছিল নিছকই হুজুগ। প্রচুর লোক দেখা, কিছু উপহার আর কিছু খাওয়াদাওয়ার আনন্দ। পরে পরিচিত হবার চেষ্টা করেছি কেঁদুলির ইতিহাস বা সংস্কৃতির সঙ্গে।

(২)

বীরভূম আর বর্ধমান জেলার সীমারেখা হল অজয়নদ। অজয়ের উত্তর কিনারে বীরভূম জেলায় অবস্থিত ‘গীতগোবিন্দে’র কবি জয়দেবের জন্মস্থান কেঁদুলি। এই কেঁদুলি পূর্বে পরিচিত ছিল কেন্দুবিল্ব হিসেবে। যার উল্লেখ গীতগোবিন্দে পাওয়া যায়। জয়দেবের জন্মগ্রাম হিসেবে কেউ কেউ জায়গাটিকে জয়দেব-কেঁদুলিও বলে। কখনও আবার কেঁদুলি বাদ দিয়ে শুধু জয়দেবও বলা হয়। দ্বাদশ খ্রিষ্টাব্দে সেন বংশীয় রাজাদের পূর্বপুরুষেরা উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন কেঁদুলির অদূরে অজয়ের অপর তীরে সেনপাহাড়ী অঞ্চলে। সেখানে সেন রাজাদের গড়-প্রাসাদের নিদর্শন পরবর্তীদিনে পাওয়া গিয়েছে। এছাড়াও জয়দেব ছিলেন লক্ষণ সেনের সভাকবি।

মেলার সূচনাকাল নিয়ে বহু বিতর্ক থাকলেও সাধারণভাবে মনে করা হয় জয়দেব-মেলা আসলে জয়দেব কবির স্মৃতি বিজড়িত মেলা। পৌষ সংক্রান্তির দিনে বার্ষিক উৎসব উপলক্ষে এই মেলা বসে। সেইদিন বিপুল জনসমাগম হয়। এই মেলা ঠিক কত বছরের পুরনো তার হদিস পাওয়া যায় না। আন্দাজ করা হয় সাত-আটশ বছরের পুরনো তো হবেই। দূরদূরান্ত থেকে হাজার হাজার পুণ্যার্থী, কৌতূহলী, ব্যবসায়ী, বাউল, বৈষ্ণব, ভবঘুরে ছুটে আসেন মেলায়।

এক শ্রেণির দর্শনার্থীদের কাছে সংক্রান্তির দিনে পুণ্যস্নান এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ। সেই সময় অজয় বিসর্পিল বালির ধারা। কোথাও কোথাও বড়জোর ক্ষীণ জলের রেখা। সেই সময় বাতাসে কান পাতলে শুনতে পাওয়া যায় বাউল কন্ঠের গান,

‘ডুব দে রে মা-গঙ্গা বলে কেঁদুলির অজয়ের কূলে

সেথায় মা গঙ্গা এসেছেন রে

জয়দেব-পদ্মার ভক্তিবলে।’

কদমখণ্ডি প্রধান স্নানঘাট হলেও আরও কয়েকটি স্নানঘাট এখানে রয়েছে। সেগুলি কুশেশ্বরঘাট, জয়দেব-পদ্মাবতীর ঘাট এবং কালীঘাট।

এখানকার পুণ্যস্নানের কথা তারাশঙ্করের ‘রাধা’ উপন্যাসের গোড়াতেই পাওয়া যায়, ‘স্নান। স্নান। অক্ষয় স্নান। ইলামবাজারের প্রান্তদেশে অজয়; ক্রোশ তিনেক দূরে শ্রীমন জয়দেব গোস্বামীর শ্রীপাট কেন্দুলী। কেন্দুলী পর্যন্ত অজয়নদ গঙ্গা মহিমায় মহিমান্বিত; পৌষ সংক্রান্তিতে মকরবাহিনী নাকি উজান বেয়ে কাটোয়া থেকে কেন্দুলী ঘাট পর্যন্ত আসেন; এই ঘাট পর্যন্ত অজয়-স্নানে গঙ্গাস্নানের পুণ্য হয়; সেই বিশ্বাসে দলে দলে স্নানার্থীরা স্নানপুণ্য সঞ্চয়ের জন্য জেগে উঠেছে সেদিন।’

মেলার মধ্যে খড়ের চাল অথবা শামিয়ানা খাটানো সারি সারি দোকান। মিষ্টি-তেলেভাজার দোকান, জামাকাপড়, মনিহারি, পাথর-মাটি-কাঠ-ধাতব জিনিসপত্র, বাদ্যযন্ত্র, শাল-সোয়েটার ছাড়াও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব নেই। এমনকি চাল ডাল আটা তেল মশলাগুড় ফলমূলও বিক্রি হয়।

আগমন হয় ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের সাধুসন্তদের। পঞ্চোপাসক সাধু সম্প্রদায় শ্মশানে, নদীর ধারে নিরাশ্রয় হয়েই যোগসাধন করে। বৈষ্ণব সম্প্রদায় আপন আপন সম্প্রদায় ও বিগ্রহ সেবা নিয়ে তিন দিন ধরে আখড়া বেঁধে হরি গুণগান করে। মহোৎসব করে। রাধাকৃষ্ণ উপাসক, বাউল ও দরবেশ সম্প্রদায়ের মানুষ নিজ নিজ প্রথা অনুযায়ী সাধনা করে। কেউ একতারা, কেউ আনন্দলহরী অথবা মন্দিরা বাজিয়ে নাচ গান করতে করতে মেলাতেই মাধুকরী করে। সেবা পূজা সাধন ভজনে জমে ওঠে স্থানটি। বহু শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতেরও সমাবেশ হয়। তাঁরা গীতগোবিন্দের আলোচনা করেন। রাধাবিনোদ মন্দিরের সামনে হয় কীর্তন।

(৩)

বীরভূম জেলা একই সঙ্গে শাক্ত ও বৈষ্ণবদের পীঠস্থান। শ্যামা ও শ্যামের ভক্তের সাধনপীঠ। তারই মধ্যে অন্যতম এবং প্রাচীনতম হল জয়দেব-কেঁদুলি। অজয়ের তট ধরে এগিয়ে গেলে প্রবল বৈষ্ণব সাধনার চিহ্ন আজও দেখতে পাওয়া যায়। যুগে যুগে কত বৈষ্ণব পদকর্তা, বৈষ্ণব সাধক, সহজিয়া, ন্যাড়ানেড়ি বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মানুষ এসেছে গিয়েছে তার বোধ হয় হিসাব নেই।  

বৈষ্ণব সম্প্রদায়কে উপজীব্য করে লেখা ছোটগল্প রসকলি (১৩৩৪ বঙ্গাব্দ) দিয়েই একরকম তারাশঙ্করের সাহিত্য জীবন শুরু বলা চলে। পরে লিখেছিলেন রাইকমল (১৩৩৬ বঙ্গাব্দ)। যা পাঠ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘তোমার ‘রাইকমল’ আমার মনোহরণ করিয়াছে।’ ‘রাইকমল’ প্রথমে ছোটগল্প হলেও পরে উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। কেবল বৈষ্ণব সম্প্রদায় নয়, বৈষ্ণবদের সাধনপীঠ কেঁদুলিকেও তুলে ধরেছিলেন ‘রাইকমলে’।

এই কেঁদুলিকে পরবর্তীকালে আবার পাওয়া যায় ‘রাধা’ উপন্যাসে। ১৯৫৭ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবার আগে রাধা প্রকাশিত হয়েছিল শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকায়। ‘রাধা’য় কেঁদুলি ছাড়িয়ে পটভূমি বিস্তার লাভ করেছে অজয়ের তীরবর্তী শ্যামারূপার গড় ও ইছাই ঘোষের দেউল সমৃদ্ধ রহস্যময় গড়জঙ্গল অর্থাৎ সেনপাহাড়ী পর্যন্ত। তারই সঙ্গে এই উপন্যাসে স্থান পেয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দীর নাগরিক জীবন, ‘জিলা বীরভূমে অজয় নদীর ধারে ইলামবাজার গঞ্জ। বড় জমজমাট গঞ্জ তখন ইলামবাজার। ইলামবাজার থেকে পশ্চিমে জনুবাজার, উত্তরে সুখবাজার পর্যন্ত নিয়ে একনাগাড় এক মস্ত জমজমাট গঞ্জ।’    

অষ্টাদশ শতাব্দীর রাঢ় বাংলার ইতিহাস উঠে এসেছে রাধায়। নবাবী আমলের মুসলমান সমাজের কিছু ছবি যেমন এখানে পাওয়া যায় তেমনি পাওয়া যায় বৈষ্ণব এবং তন্ত্র সাধনার বিকৃত ও ব্যাভিচারী দিক। পরকীয়া রসের সাধনার আড়ালে বিকৃত ধর্ম সাধনার একটা ছবি ফুটে ওঠে কৃষ্ণদাসী ও রাধারমণ দাসসরকারের জীবন যাপন প্রনালীর মধ্যে। কৃষ্ণদাসী এই কাহিনির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। বিকৃত বৈষ্ণবসাধনা, নিম্নতন্ত্র ও ডাকিনীমন্ত্রের সাধিকা কৃষ্ণদাসীর জীবন আগাগোড়া অভিশপ্ত। বিশেষ করে দাস-সরকারের কুঞ্জে তার অভিসার পাঠকমনকে ভারাক্রান্ত করে। তার কন্যা মোহিনী যেন অনাঘ্রাতা পুষ্প। রাধারমণ দাসসরকারের ব্যাভিচারী ও কামুক পুত্র অক্রূরের হাতে নির্ধারিত হয়ে আছে তার ভবিষ্যৎ। এর সঙ্গে আরও একটি চরিত্রকে উল্লেখ না করলে চলে না সে ‘কয়ো’। কয়ো শব্দটি আসলে কাকের প্রতিশব্দ। কদাকার দর্শন এই মানুষটির মধ্যে একজন দয়াশীল কর্তব্যনিষ্ঠ মানুষকেই শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার করেন পাঠক।

সেই সময়ের ইলামবাজার, জয়দেব-কেঁদুলি অঞ্চলে বয়ে চলা ব্যভিচার ও অত্যাচারের নির্মূল করার জন্যে শ্যামারূপার গড়ে হঠাৎ এসে পড়েন এক নবীন সন্ন্যাসী, মাধবানন্দ। এই মাধবানন্দকে প্রথমবার দেখেই মুগ্ধ হয় কিশোরী মোহিনী। কিন্তু মাধবানন্দ অন্য ধাতুতে গড়া। তাঁর উপাস্য দেবতা ননীচোরা বা কানাই নন, তিনি কংসারি কৃষ্ণ বাসুদেব। বিলাসবহুল জীবনযাপনের বিপ্রতীপে শৌর্য ও বীর্যের প্রতীক সন্ন্যাসী মাধবানন্দ। তাঁর অন্তরের গভীরে ছিল ধর্মরাজ্য স্থাপনের বাসনা। তাই তাঁর দল পরিকল্পিত পদ্ধতিতে সন্ন্যাসী ভেকধারী মারাঠা দস্যুদের দমন করেছে। নারীলোলুপ অত্যাচারী অক্রূর দাস-সরকারের বিনাশ করেছে। তবে মাধবানন্দের পরিণতি হয়েছে করুণ। তাঁর সঙ্গী কেশবানন্দের কর্মফলের বলি হয়েছেন তিনি। উপন্যাসের এবং মাধবানন্দের জীবনের শেষ পর্বে মোহিনী আবার এসেছে মাধবানন্দের সামনে। তখন মোহিনীর মুখমণ্ডলে মাধবানন্দ রাধার মুখ দর্শন করেছেন এবং শেষপর্যন্ত একটা জীবন সত্যে উপনীত হয়েছেন তিনি। উপলব্ধি করেছেন, নারী পুরুষের জীবনের প্রতিবন্ধক নয় বরং সে সহচরী ও সাধনার সঙ্গিনী। তাই এই উপন্যাস কেবলমাত্র ঘটনাপ্রবাহের সমষ্টি হয়ে থেকে যায় না, বহন করে চলে মানবপ্রকৃতির এক বিচিত্র ও গূঢ় ধারা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দীর্ঘ কুড়ি বছর সময়কালে অগণিত লেখক অসংখ্য ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস রচনা করেছিলেন। সেই সময়ে যতগুলি ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখা হয়েছিল ‘রাধা’ তার মধ্যে অন্যতম। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রেক্ষাপটে লেখা ‘রাধা’র সমাপ্তি ঘটেছে রাঢ় বাংলায় বর্গী হামলার ঘটনার মধ্যে দিয়ে। এই সমাপ্তির বিন্দুটিই যেন চিহ্নিত হয়ে উঠেছে তাঁর বিশিষ্ট সাহিত্যকীর্তি ‘কীর্তিহাটের কড়চা’র বীজরূপে। যে মহাকাব্যিক উপন্যাসে তারাশঙ্কর ধরে রেখেছেন প্রায় দুই শতাব্দীর ইতিহাস। শতাধিক চরিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু বাস্তব চরিত্র, যেমন রাজা রামমোহন রায় অথবা দ্বারকানাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে ডঃ বিধানচন্দ্র রায় পর্যন্ত উপস্থিত হয়েছেন। এই ‘কীর্তিহাটের কড়চা’র প্রাক পর্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে উঠে তাঁর ‘রাধা’ উপন্যাস। যেখানে ‘রাধা’ শেষ হয়, সেই বর্গী হামলা পরবর্তী চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের অনুষঙ্গে শুরু হয় ‘কীর্তিহাটের কড়চা’।

 

তথ্যসুত্রঃ

১। মিত্র ও ঘোষ প্রকাশিত তারাশঙ্কর রচনাবলী (১৫ খন্ড); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।

২। জয়দেব-মেলা সেকালের ও একালের - ডঃ অজিত কুমার দাস।