‘ইডিয়ট’ : এক ঈশ্বর ও প্রেমিকের আখ্যান

নভেম্বরের শেষের দিকে সকাল ৯টায় ওয়ারস-র ট্রেন পূর্ণ গতিতে ছুটে আসছে পিটার্সবার্গের দিকে। বাইরে বরফ গলছে, চারদিক এত স্যাঁৎসেঁতে আর কুয়াশাচ্ছন্ন যে, ট্রেনের ডান বা বাঁদিকে দশ পা দূরেও কিছু দেখা যাচ্ছে না। কয়েকজন যাত্রী বিদেশ থেকে ফিরছে , কিন্তু তৃতীয়শ্রেণীর কামরাগুলো অধিকাংশই নিম্নশ্রেণীর লোকে ভর্তি , তারা নিজেদের কাজে কাছাকাছি জায়গা থেকে এসেছে। তারা সকলে ক্লান্ত, শীতে কাঁপছে , সারারাত ট্রেনে ভ্রমণ করে তাদের চোখের পাতা ভারী হয়ে এসেছে ; বাইরের কুয়াশার মতই মুখ ফ্যাকাশে, হলদেটে।

রাশিয়ার নতুন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১৮২১ সালের এমন এক নভেম্বরের ১১ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক ফিয়োদোর মিখাইলোভিচ দস্তয়েভস্কি। জীবিত অবস্থায় রাশিয়ায় 'প্রফেট' হয়ে ওঠা বিস্ময়কর এই প্রতিভা তাঁর জন্মের দু'শো বছরেও তরুণ পাঠকের মননকে মুগ্ধ করে চলেছেন। তার অন্যতম প্রধান কারণ তিনি লেখার মধ্যে দিয়ে পাঠকের মনোরঞ্জন করতে চাননি বরং মনের গভীরে ডুব দিয়ে তুলে এনেছেন আলো, অন্ধকার, পাপ, পূণ্য , স্খলন উত্তরণসহ যা কিছু মানবিক। কলেজে পড়ার সময় তিনি দাদা মিখাইলকে এক চিঠিতে লিখছেন , "জীবনের অর্থ খুঁজছি আমি...কেন না আমি 'মানুষ' হয়ে উঠতে চাই। " তাই জীবনকে নিয়ত কাটাছেঁড়া করে যা পেয়েছেন সবটুকুকে উজাড় করে দিলেন সৃষ্টির মধ্যে আর আমরা তাঁর সমস্ত রচনা তন্ন তন্ন করে খুঁজে আবিষ্কার করে চলেছি এক মহান স্রষ্টা ও তাঁর সৃজন ভাবনার নেপথ্যের ইতিহাস। বর্তমানের সংকট ও সংশয়ের কষ্টি পাথরে যাচাই করে দেখছি তাঁর রচনাগুলিকে। তেমনিই একটি উপন্যাস "ইডিয়ট" এর সূচনার অংশটুকু উদ্ধৃত করেই শুরু হল আমাদের যাত্রা।উপন্যাসটি লেখা শুরু হয়েছিল ১৮৬৭ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর জেনিভায় এবং শেষ হয় ১৮৬৯ সালে ফ্লোরেন্সে। সেই সঙ্গে মানুষটির অন্তর্জগত-বহির্জগতে ঘটে গেছে কত উত্থান-পতন, প্রত্যাশা ও স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস। আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসের জনক নামে পরিচিত যে মানুষটিকে রাশিয়া প্রথম চিনেছিল 'অভাজন'(১৮৪৬) উপন্যাসটি দিয়ে এবং তারপর ভুলেও গিয়েছিল তাঁকে এবং তারপর তাঁর জীবনের অসম্ভব অসহ্য অভিজ্ঞতারা কীভাবে আমূল বদলে দিয়েছিল মানুষটিকে যিনি লিখলেন 'ইডিয়ট'(১৮৬৭-৬৯) তা জানতে গেলে ফিরতে হবে দুশো বছরের ধুলো সরিয়ে জার শাসিত রাশিয়ায়। তবে সেই বিবরণ বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে "ইডিয়ট" উপন্যাসটিকে পড়ে ফেলতে হবে কেননা এই উপন্যাসটিই হবে অতীত প্রবেশক পাশাপাশি বর্তমানের দিকনির্দেশক। উপন্যাসের নামটাই শ্লেষাত্মক। যে উপন্যাসে আপাদমস্তক একটি 'ভালোমানুষ' চরিত্রকে উপস্থাপন করলেন তার নাম দিলেন 'ইডিয়ট'!  বর্তমান পৃথিবীতে ভালোমানুষই যে নির্বোধ আজ থেকে সার্ধশতবর্ষ আগে বলে গেলেন তিনি। উনিশ শতকের পিটার্সবার্গে তিনি যেন ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার জন্য ছদ্মবেশে হাজির করলেন যীশুকে; দেখতে চাইলেন সমাজ সংসার এই ভালোত্বকে কীভাবে গ্রহণ করে। সঙ্গে দিলেন নিজের মৃগী রোগ এবং আরো কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য । নিজের অন্তঃস্থিত উদারতা, দয়া ও কোমলতার ঐশ্বর্যকেই জুয়ার বাজি ধরলেন ভাগ্যবিড়ম্বিত এই বিখ্যাত জুয়াড়ি আর জীবনের ক্ষমাহীনতার নিরিখে  দেখে নিতে চাইলেন তার পরিণতি। Joseph Frank 'ইডিয়ট' উপন্যাসকে বলেছেন , " the most personal of all Dostoevsky's major works, the book in which he embodies his most intimate cherished and sacred convictions."

পাঠকরা সকলেই এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন এক্ষেত্রে আমরা লেখকের মতোই বিচার বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে অনুসন্ধান করব সত্যের। উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রের বক্তব্যে উঠে এসেছে সমসাময়িক রাজনৈতিক নানা আদর্শ, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, আধ্যাত্মিকতার প্রসঙ্গ। এমনও হতে পারে  পারিপার্শ্বিক জীবনের অবনমন, স্বৈরাচার, পাপচক্র, ব্যক্তিস্বার্থের নির্লজ্জ পরিপূরণে ক্ষতবিক্ষত শিল্পী মন প্রিন্স মিশকিনের পাশে দাঁড়িয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের দিকে আঙুল তুলে বললেন  'ইডিয়ট'!

সেই যে কুয়াশার মধ্যে দিয়ে ছুটে চলা ট্রেন আর ভোরের জানলায় মুখোমুখি দুই যাত্রী বসে আছে তাদের দিকে এবার মন দেওয়া যাক। জীবনের পথ তাদের এক করেছে সূচনায় ও উপন্যাসের মর্মান্তিক পরিণতির শেষ দৃশ্যে। দু'জনের বয়স সাতাশ। চেহারার বর্ণনায় কোথাও ফেয়ারি টেলের সাদা কালোর বিভাজন।

একজন বেঁটেখাটো, মাথায় প্রায় কালো কোঁকড়ানো চুল, চোখ দুটো ছোট, ধূসর ও জ্বলন্ত । নাকটা চওড়া , চ্যাপ্টা , গালের হাড় উঁচু। পাতলা ঠোঁট দুটো সর্বদা যেন উদ্ধত, বিদ্রুপাত্মক, এমনকি কুটিল হাসিতে বেঁকে আছে। তার গায়ে দীর্ঘ , কালো ভেড়ার চামড়ার পটি দেওয়া ওভারকোট। নাম পার্ফিয়ন রোগোজিন।       

 মুখোমুখি বসে থাকা সমবয়সী তরুণটির পরনে লম্বা ক্লোক যা ওই শীতের পক্ষে যথেষ্ট নয়। উচ্চতায় সাধারণের চেয়ে বেশি দীর্ঘ, মাথায় সুন্দর, ঘন চুল , গাল দুটো বসা, মুখে শীর্ণ, ছুঁচোলো , প্রায় সাদা দাড়ি। চোখ দুটো বড় , নীল, স্বপ্নালু ; চোখের দৃষ্টিতে শান্ত অথচ বিষণ্ণ এমন এক চাহনি যাতে প্রথম নজরেই কিছু লোক তাকে মৃগী রোগী বলে বুঝতে পারবে।

এই ব্যক্তি আমাদের উপন্যাসের নায়ক প্রিন্স মিশকিন।

সুইজারল্যান্ড থেকে পিটার্সবার্গে আসছেন তিনি দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়া মাদাম এপানচিনের কাছে। এই মুহূর্তে তার একটা কাজ দরকার। প্রয়োজন অর্থের। পার্ফিয়ন রোগোজিন এবং তাঁর কথার মধ্যে যোগ দেন একজন সবজান্তা অফিসার । তাদের কথাবার্তায় উঠে আসে নাস্তাসিয়াসহ এমন সব চরিত্রের নাম যাদের পরবর্তীকালের ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে ‌‌। সুন্দরী নাস্তাসিয়ার প্রতি পার্ফিয়নের গভীর আকর্ষণের কথা শুনতে শুনতে এসে এপানচিনদের অফিসে তার ছবি দেখতে পান। সেখানে গ্যাভ্রিল আর্দালিয়োনোভিচ ও জেনারেল এপানচিনকে আলোচনা করতে শোনা যায় তাকে নিয়ে। নাস্তাসিয়া গ্যাভ্রিলকে বিয়ে করলে টটস্কির পথ খুলে যাবে এবং পঞ্চাশোর্ধ এই ব্যক্তি এপানচিনদের তিনমেয়ের (আলেকজান্দ্রা, আদেলেদা, আগলাইয়া) মধ্যে পঁচিশ বছরের আলেকজান্দ্রাকে বিয়ে করতে পারবেন। প্রতিবেশীর মৃত্যুর পর তাদের অনাথ কন্যা নাস্তাসিয়াকে টটস্কি জীবনের যাবতীয় সুখ সুবিধা দিয়ে বড় করলেন এবং তার সঙ্গে থাকতে শুরু করলেন। অথচ তার কয়েকবছর পর তিনি ঠিক করলেন পিটার্সবার্গের কোনো এক সৎ বংশের সুন্দরী উত্তরাধিকারিণীকে বিয়ে করবেন । এই খবর শুনে নিজের বিদ্বেষ আর ক্ষোভ চেপে রাখতে পারেনি নাস্তাসিয়া। যদিও শোনা যায় এখন সে মেনে নিয়েছে এবং উইলে টটস্কি তাকে পঁচাত্তর হাজার রুবল দিয়েছেন। গ্যাভ্রিল এসব শুনে রাজি হয়েছে অথচ সে এপানচিনদের ছোট মেয়ে আগলেয়াকে চিঠি পাঠিয়ে সম্মতি জানতে চায়। মিশকিন এপানচিনের কাছে কাজ পায় এবং গ্যাভ্রিলের বাড়িতে অর্থের বিনিময়ে থাকার সুযোগ পায়। মাদাম এপানচিন ও তার মেয়েদের সঙ্গে আলাপ হয়। ওদের মধ্যে আগলেয়াকে তার ভালো লাগে। ও বুঝতে পারে নাস্তাসিয়াকে নিয়ে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে চাপা আশঙ্কা, উদ্বেগ ও বিরক্তি কাজ করে । গ্যাভ্রিলের বা গানিয়ার বাড়িতে তার বাবা জেনারেল ইভোলজিন, মা নিনা আলেকজান্দ্রোভনা , বোন ভারভারা ও ভাই কোলিয়ার সঙ্গে আলাপ হয়। ওকে সাদরে গ্রহণ করে ওরা। কোলিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। নাস্তাসিয়াকে নিয়ে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে অশান্তি হয়। হঠাৎই নাস্তাসিয়া ওদের বাড়িতে আসে এবং বুঝতে পারে তারা ওকে গ্রহণ করতে চায় না।  একটু পরে রোগোজিন ও তার বন্ধুরা আসে। হই হট্টগোলের মধ্যে সবাই বেরিয়ে যায়।

মিশকিন গানিয়ার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারে নাস্তাসিয়ার প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা তার নেই। সেদিন সন্ধ্যায় নাস্তাসিয়ার জন্মদিনের পার্টিতে নাস্তাসিয়া পঁচাত্তর হাজার রুবল ও গানিয়াকে প্রত্যাখ্যান করে। সে বুঝতে পারে টাকার জন্যই গানিয়া তাকে বিয়ে করতে চায়।

খুব অদ্ভুতভাবে স্বল্প আলাপেই মিশকিনকে তার কাছের বন্ধু মনে হয়। রোগোজিন একলক্ষ রুবল নিয়ে আসে। সে নাস্তাসিয়াকে ভালোবাসে। নাস্তাসিয়া লক্ষ টাকার বান্ডিল আগুনে ফেলে গানিয়াকে তুলে নিতে বলে। গানিয়া পারে না। অজ্ঞান হয়ে যায়। রোগোজিনদের সঙ্গে বেরিয়ে যায় নাস্তাসিয়া। চারটি পর্বে বিধৃত উপন্যাসটির প্রথম পর্ব এখানেই শেষ হয়।

দস্তয়েভস্কি যে অপাপবিদ্ধ নায়ক চরিত্র উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন তা সার্থক হয়। ট্রেনের আলাপে রোগোজিন যখন জানতে চায়:

-"প্রিন্স, মেয়েদের ব্যাপারে কি আপনি খুব আগ্রহী?"

-"আমি ...না ! মানে... বোধহয় আপনি জানেন না, আমার অসুখের জন্য আমি মেয়েদের বিষয়ে কিছুই জানি না।"

-" সত্যিই যদি তাই হয়, তা হলে তো আপনি একেবারে ব্রহ্মচারী ; ভগবান আপনার মত লোকদের ভালোবাসেন।"

অফিসারটি আবার বলল, " আপনার মত লোককে ঈশ্বর ভালোবাসেন।"

সেই ঈশ্বরই যেন নেমে এলেন বাইবেল বর্ণিত পতিতা রমণী মারি মাগদালেনের মতো নাস্তাসিয়াকে উদ্ধার করতে...

 মিশকিন নাস্তাসিয়ার জীবনের করুণ পরিণতি দেখে সকলের সামনে তাকে বিয়ে করতে চায়।

-" তুমি আমাকে এভাবেই নেবে যেভাবে আছি? নিঃস্ব ।"

-'' হ্যাঁ তাই, নাস্তাসিয়া ফিলিপ্পোভনা।"

-" তাহলে এই একজনকে পাওয়া গেল ! আর নিতান্ত ভালোমানুষিতা থেকে ; আমি অন্তত ওকে যতটুকু চিনি । আমার একজন হিতকারী জুটল !... তোমার চলবেটা কীভাবে যে এতই প্রেমে পড়লে রোগোজিনের স্ত্রীলোকটার যে তাকে বিয়ে করতে চাইলে?"

মিশকিন বলল, ''আমি একজন সৎ স্ত্রীলোককে বিয়ে করব নাস্তাসিয়া , রোগোজিনের স্ত্রীলোককে নয়।"

-" বলতে চান, আমি সৎ?"

-"হ্যাঁ।"

-"তোমার লজ্জা করবে না, যখন পরে তোমায় সবাই বলবে যে তোমার বৌ টটস্কির রক্ষিতা ছিল।"

-" না লজ্জা করবে না... তুমি স্বেচ্ছায় টটস্কির সঙ্গে ছিলে না।"

-" কখনো এ জন্য আমার ওপরে রাগ করবে না?"

-"কখনো না।"

সত্যিকারের হৃদয়বান মানুষের যে পরিচয় প্রকাশ হল তা গোটা উপন্যাসের স্থানে স্থানে বিস্ময় উদ্রেক করে । নাস্তাসিয়ার দ্বিধাদীর্ণ হৃদয়ও মিশকিনের বিশ্বাস ও সিদ্ধান্তকে বদলাতে পারে না । এমনকি মিশকিন নিজের ভালোবাসাকে বলি দিয়েও নাস্তাসিয়াকে আগলে রাখতে চায়। 

দস্তয়েভস্কি তাঁর ভাগ্নি সোনেচকাকে উপন্যাসের প্রথম পর্ব লেখার সময় চিঠিতে বলেন, " My only wish is that it (part I) will awaken some degree of curiosity in the reader , so that he will go on to the second part"

বলা বাহুল্য তাঁর এই ইচ্ছা অচিরেই পূরণ হয় কারণ নাস্তাসিয়ার পার্টির ওই নাটকীয়তার পরবর্তী ঘটনাগুলো জানার জন্য পাঠক উন্মুখ হয়ে থাকে।

 

দ্বিতীয় পর্বের সূচনায় দূরসম্পর্কের আত্মীয় সূত্রে মিশকিনের সম্পত্তি প্রাপ্তির সংবাদ শোনা যায়। আলেকজান্দ্রার সঙ্গে টটস্কির বিয়ের ব্যাপার এগোয় না তবে আদেলেদার প্রতি প্রিন্স নামের এক ব্যক্তির আগ্রহ জন্মায় এবং আগলেয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেখাতে শুরু করে ইয়েভগনি পাভলোভিচ। মিশকিনের সঙ্গে রোগোজিনের দেখা হয়। সে জানতে পারে  নাস্তাসিয়া তাকে ছেড়ে চলে গেছে। মিশকিন বলে ও তাদের সম্পর্কের মধ্যে আসবে না। তবে নাস্তাসিয়া নিজে থেকে তার কাছে এলে সে ফেরাতে পারবেনা। সেইসঙ্গে এও বলে নাস্তাসিয়ার সঙ্গে রোগোজিনের বিয়ে হওয়াটা তাদের দুজনের পক্ষেই ভালো হবে না। মিশকিন স্বীকার করে সে করুণাবশত নাস্তাসিয়াকে ভালোবাসে এবং রোগোজিনকেও পছন্দ করে। মিশকিন জানতে পারে রোগোজিনকে প্রতারণা করার জন্য সে নাস্তাসিয়ার গায়ে হাত তোলে এবং তারপর সে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেয় যতক্ষণ না নাস্তাসিয়া তাকে ক্ষমা করে। মিশকিনের মনে হয় রোগোজিনের ভালোবাসা আর ঘৃণা খুব কাছাকাছি। রোগোজিন জানায় নাস্তাসিয়া মিশকিনকে ভালোবাসে কিন্তু বিয়ে করে মিশকিনের জীবন নষ্ট করতে চায়না। রোগোজিনের বাড়িতে মিশকিন হলবেইনের আঁকা যীশুকে ক্রুশ থেকে নামিয়ে আনার ছবিটি দেখে। রোগোজিন ওকে নিজের মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয় এবং নিজেদের মধ্যে ক্রশ বদল করে।

রোগোজিনকে কথা দিলেও মিশকিন নাস্তাসিয়ার খোঁজে যায়। সেখানে নাস্তাসিয়াকে পায় না কিন্তু রোগোজিন তাকে দেখতে পায়। হোটেলের সিঁড়িতে রোগোজিন তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করতে যায়। ঠিক সেই সময় মৃগীরোগের প্রকোপে মিশকিন জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কোলিয়া তাকে উদ্ধার করে লেভেদিয়েভের বাড়িতে নিয়ে যায়। তিনদিনের মধ্যে উপন্যাসের প্রায় সব চরিত্ররাই পাবলোভস্কে পৌঁছায়। এপানচিনরা এবং ইভোলজিনের পরিবার সবাই মিশকিনকে দেখতে আসে। আগলেয়া পুশকিনের 'দ্য পুওর নাইট' কবিতাটা আবৃত্তি করে। নাস্তাসিয়ার ব্যাপারে ইঙ্গিত করে। ওখানে কেলার, অন্তিপ বারডোভস্কি, ইপ্পোলিট আর লেভেদিয়েভের ভাগ্নে আসে। তারা মিথ্যে দোষারোপ করে মিশকিনকে হেনস্থা করতে চায়। তারা সফল না হলেও মিশকিনের উদারতায় মাদাম এপানচিন রেগে যান। মিশকিনের সঙ্গে আগলেয়ার সম্পর্কটা এগোয় । যদিও দু'জনের প্রকৃত মনোভাব বোঝা যায় না। 

ফ্রয়েড তাঁর বন্ধু থিওডোর রাইখকে লিখেছিলেন , " ভালবাসার ব্যাপারে দস্তয়েভস্কির অসহায় অবস্থাটা লক্ষ্য করেছ ত?

ভদ্রলোক এ ব্যাপারে বুঝতেন মাত্র দুটো জিনিস, হয় পশুর মতন নিকৃষ্ট উপায়ে ভোগ অথবা মর্ষকামীর মতন কেবল দুঃখ পাওয়ার জন্য আত্মসমর্পণ। " এখানে মিশকিনের মধ্যে দ্বিতীয় মনোভাবটিকেই প্রকট হয়ে উঠতে দেখি। তাই কখনও আগলেয়ার ঠাট্টা তামাশা অপমান কখনও নাস্তাসিয়ার দ্বিধাদীর্ণ অস্থিরতায় আঘাত পেয়েও তাদের ভালোবেসে গেল শেষ পর্যন্ত।

দ্বিতীয় পর্বের শুরুতে আগলেয়াকে লেখা চিঠিটা উল্লেখ করা যায়,

' একসময়ে তুমি আমায় বিশ্বাস করে সম্মান দেখিয়েছিলে। হয়ত এখন আমায় একেবারে ভুলে গেছ। তাহলে হঠাৎ তোমায় চিঠি লিখছি কেন? তা জানি না; কিন্তু আমার অস্তিত্বের কথা তোমায় , শুধু  তোমায় মনে করিয়ে দেওয়ার একটা অদম্য ইচ্ছে হল। কতবার তোমাদের তিনজনকে দেখতে চেয়েছি কিন্তু দেখেছি শুধু তোমায়। তোমাকে আমার দরকার... খুব দরকার। নিজের কথা তোমায় লেখার বা বলার কিছু নেই। সে আমি করতে চাই না ; তুমি সুখী হও , এ আমার একান্ত ইচ্ছা। তুমি কি সুখী হয়েছ? এটাই শুধু বলতে চেয়েছিলাম । '

 

 দ্বিতীয় পর্বে চরিত্রগুলো ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। উপন্যাসের পাতায় তাদের শ্বাস প্রশ্বাস শোনা যায়। উপন্যাসের শুরুর কথক চলে যাচ্ছেন অন্তরালে। চরিত্ররা নিজেদের বক্তব্যে স্বচ্ছন্দ । জগৎ ও জীবন সম্পর্কে লেখকের নিজস্ব ভাবনা কখনও চরিত্রদের কন্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে না। তাদের কথাবার্তায় ও নানা চিঠিপত্র এবং বিভিন্ন উৎস থেকে আসা খবরের মাধ্যমে এগিয়ে চলছে উপন্যাস। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা আদর্শ ও সংকট উঁকি দিয়ে যায়। উনিশ শতকের ষাটের দশকে রাশিয়ায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠা নিহিলিজম যখন জীবনে প্রচলিত মূল্যবোধ ও আদর্শকে অস্বীকার করে এবং এর সপক্ষে কলম ধরেন তুর্গেনিভের মতো লেখক তখন দস্তয়েভস্কি তাঁর 'positively good man ' উপস্থিত করলেন একেবারে বিপ্রতীপ ভাবনার অভিমুখে...পার্ফিয়ানকে মিশকিন বলে,

" আধ্যাত্মিক অনুভূতির নির্যাস কোনো যুক্তি বা নাস্তিকতায় ধরা যায় না। এবং এর সঙ্গে কোনো অপরাধ বা অন্যায়ের সম্পর্ক নেই। এ একটা অন্য কিছু, সর্বদা তাই...যাকে নাস্তিকরা অবজ্ঞা করে , সব সময়ে অন্য কথা বলে।'

পার্ফিয়নের বাড়ির বর্ণনায় অন্ধকার ছেয়ে থাকে। দরজার উপরে থাকা হল বেনের যীশুকে ক্রশ থেকে মুক্ত করার ছবিটা ঈশ্বর বিশ্বাসের বদলে অবিশ্বাস জাগায়। শোনা যায় দস্তয়েভস্কি বাসেলের মিউজিয়ামে এই বিখ্যাত ছবিটি দেখেই অমন অপাপবিদ্ধ একটি চরিত্র সৃষ্টির কথা ভাবেন। শৈশবে কোয়ার্টারের জানলাহীন একটি ঘরে দিনযাপন করায় দস্তয়েভস্কির উপন্যাসে কখনই প্রকৃতির প্রাণখোলা উদারতার ছবি দেখা যায় না। 'ইডিয়ট' উপন্যাসটির মধ্যেও সেই চাপা দমবন্ধ করা পরিবেশ গড়ে ওঠে। চরিত্ররা স্থান পরিবর্তন করে কিন্তু পাঠকের মনে হবে সব ঘটনা বুঝি এক জায়গাতেই ঘটছে। বহির্জগত রুদ্ধ থাকায় তিনি বারবার ছুটে গিয়েছেন অন্তরমহলে।

 

তৃতীয় পর্বের সূচনায় কথক দৃপ্ত কণ্ঠে তৎকালীন রাশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠের গড়পড়তা মনোভাব ও নিজস্বতার অভাবের প্রসঙ্গ তোলেন। এপানচিনদের তিন মেয়ে , গানিয়া, লিজাভেটার মনোভাব , তাদের সংকট ও সমস্যার কথা শোনা যায়। নাস্তাসিয়ার সঙ্গে আগলেয়ার চিঠির আদান প্রদানের খবর পাওয়া যায়। নাস্তাসিয়া তাকে মিশকিনকে বিয়ে করতে বলে। মিশকিনের প্রতি আগলেয়ার পক্ষপাত, আগ্রহ সবই সম্পর্কটির ভবিষ্যত সার্থকতার কথা মনে করালেও কোথাও একটা অস্বস্তি রয়ে যায়। নাস্তাসিয়া যেন দুজনের মধ্যবর্তিনী হয়ে থাকে। আগলেয়া মিশকিন পার্কে দেখা করে। এমনকি মিশকিনের সঙ্গে নাস্তাসিয়ারও পার্কে দেখা হয়। তবুও কোনো সহজ সত্যে এসে পৌঁছায় না সম্পর্কগুলো। এক নিরন্তর অস্থিরতা ও দ্বিধা দ্বন্দ্বের অবসান হয়না। ভারিয়ার হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও গানিয়ার প্রতি আগলেয়ার কোনো আগ্রহ জাগে না এবং ইয়েভগনিকেও সে প্রত্যাখ্যান করে। আগলেয়া বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে চায় । পড়াশোনা করে নিজের পরিচয়ে বাঁচতে চায়। পৃথিবীকে সে জানতে চায়। আপাত অর্থে বয়ঃসন্ধিকালীন আবেগের প্রকাশ মনে হলেও রাশিয়ায় সদ্য জাগ্রত নারীবাদ ও নিহিলিজিমের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না...

"... আমি আমার সামাজিক পরিস্থিতির সম্পূর্ণ পরিবর্তন চাই... কখনো কোথাও যাইনি। বরাবর বাড়িতেই বসে থেকেছি , যেন আমাকে একটা শিশিতে বন্দী করে রাখা হয়েছে , এবং এখান থেকে বের করেই সোজা বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে..."

তৎকালীন রাশিয়ায় মেয়েদের সামাজিক অবস্থান কোন জায়গায় ছিল তা নাস্তাসিয়ার পরিণতিতে প্রকট হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয় পঞ্চাশের টটস্কি বিয়ের প্রস্তাব দেয় পঁচিশ বছরের আলেকজান্দ্রাকে যেটা তার পরিবার আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করে। উপপত্নী বা মিসট্রেস হিসেবে থাকা মেয়েদের সমাজ ভালো চোখে না দেখলেও যথারীতি তাদের পুরুষ সঙ্গীর সামাজিক সম্মানের কোনো হেরফের হত না। নাস্তাসিয়া নিজেই তার সামাজিক অবস্থান জানতো বলে মিশকিনকে বিয়ে করতে চায় নি। 

আগলেয়াকে সে চিঠিতে লেখে,

"আমরা দুজনে এত বিপরীত এবং আমি তোমার থেকে এত নীচে যে , ইচ্ছে করলেও তোমাকে অপমান করতে পারব না... আমার গোপনতম চিন্তাতেও তোমাকে আমি নিজের সমান আসনে বসাইনি... তুমি তার কাছে 'আলোই'..."

নাস্তাসিয়ার এই ব্যথা, হাহাকার নিজেকে পতিত ভাবার অসহায়তাই মিশকিনকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তার দোদুল্যমান সত্তা নিয়ত এই দুই নারীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে।

প্রথম স্ত্রী মারিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক যখন তলানিতে এসে পৌঁছেছে তখন দস্তয়েভস্কির জীবনে আসে পলিনা সুসলোভা। কম বয়সী এই নারীর প্রেমে আচ্ছন্ন হয়ে ছিলেন তিনি বহুবছর। যদিও দস্তয়েভস্কির সঙ্গে তার সম্পর্কটা ভালোবাসা আর ঘৃণার সূক্ষ্ম পার্থক্যকে মুছে দিয়েছে মাঝে মাঝেই । 'এপোখা' কাগজের সূত্রে আলাপ হয়েছিল সাংবাদিক গর্সকির মিসট্রেস মার্থা ব্রাউনের সঙ্গে। মারিয়ার প্রতি যে প্রবল ভালোবাসা নিদারুণ আহত হয় বিবাহিত জীবনের শুরুতেই তা কেবলই খুঁজে বেড়ায় সত্যিকারের হৃদয়। মারিয়া তখন নেই। দস্তয়েভস্কি মার্থাকে তাঁর সঙ্গে থাকতে বলেন। একপ্রকার করুণামিশ্রিত ভালোবাসা তিনি অনুভব করতেন মার্থার প্রতি। 'ইডিয়ট' এর নাস্তাসিয়ার মধ্যে পলিনা ও মার্থাকে কেউ কেউ খুঁজে পান... যদিও উপন্যাস বিশ্লেষণ করে লেখকের আত্মজীবনীর অনুসন্ধান আমাদের কাজ নয় তবুও উপন্যাসের মনোজগৎ গঠনে বাস্তব জীবনের ছায়াপাত অনুসন্ধিৎসু পাঠক এবং পাঠক থেকে লেখক হয়ে উঠতে চাওয়া কতিপয় ভাবনাকে পথ দেখায় নিশ্চয়ই। ঠিক যেমন তাঁর ডায়েরির পাতা বলছে কীভাবে সমসাময়িক সংবাদপত্র থেকে তিনি সংগ্রহ করছেন তাঁর উপন্যাসের উপাদান। যেমন Olga Umetskaya  যে তার বাবা মা'র অবহেলা ও অত্যাচারের প্রতিবাদে ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় নাস্তাসিয়ার চরিত্রে তার ছাপ পাওয়া যায়। এমনকি রোগোজিনের চরিত্রটি মস্কোর এক বিচারাধীন খুনী V.E. Mazurin এর সঙ্গে সম্পর্কিত। নিহিলিজম কীভাবে সমাজে নৈতিকতা ও বিবেকবোধকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে নতুন প্রজন্মকে দিয়ে হত্যার মতো চরম অপরাধও করিয়ে নিচ্ছে অনায়াসে তার ছবি দেখতে পাওয়া যায় লেবেদিয়েভের ভাগ্নের বিরুদ্ধে ওঠা ছ'টার খুনের অভিযোগের ভিত্তিতে। মিশকিন, ইয়েভগেনি ও প্রিন্স এসের আলোচনায় রাশিয়ার সমাজতন্ত্র ও রক্ষণশীলতার কথা আসে। চল্লিশের দশকে  জারের শাসনের বিরুদ্ধে সমাজবাদী ভাবনার বিপ্লবীদের সঙ্গে দস্তয়েভস্কির যোগাযোগ হয়। কেননা তিনি সর্বদাই ছিলেন বঞ্চিত ও নিপীড়িতের পক্ষে।তাই বাবা মিখাইল দস্তয়েভস্কির অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ভূমিদাসরা যখন তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে তখন 'ক্ষমা' না 'শাস্তি' এই দ্বন্দ্বে ভুগলেও শেষমেশ অত্যাচারিতের যন্ত্রণার অনুভব তাকে ক্ষমার পথ বেছে নিতে বলে... সেই ব্যক্তি যে বেলিনস্কি ও পেট্রোশেভস্কির বিপ্লববাদ ও প্রগতিশীল গোষ্ঠীর জড়িয়ে পড়বেন এটাই স্বাভাবিক। এর পরিণতিতে তিনি গ্রেপ্তার হন এবং দীর্ঘ আটমাস বন্দী থাকার পর ১৮৪৯ এর ২২ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যদন্ড কার্যকর করার জন্য বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয় । মৃত্যুর জন্য প্রতিটা মুহূর্ত অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎই খবর আসে মৃত্যু দন্ড রদের এবং পাঠানো হয় চারবছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়ে সাইবেরিয়ার কুখ্যাত জেলে। এই অসহনীয় অত্যাচারের দুঃসহ স্মৃতি তিনি এঁকে রেখেছিলেন "দ্য হাউস অব ডেড " উপন্যাসের পাতায় পাতায়... ভয়ঙ্কর সব অপরাধীদের সঙ্গে পায়ে শিকল পরে দূর্বিষহ দিন কাটাতে কাটাতে তৈরি হয়ে উঠল পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখকের মনোজগৎ, মন বিশ্লেষণের আশ্চর্য ক্ষমতা। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে কিংবা নিয়ত মৃত্যুর অধিক যন্ত্রণা সহ্য করেও মনকে মরে যেতে দিলেন না তিনি। বরং জীবন সত্যের সন্ধানে মগ্ন হলেন ।

 

চতুর্থ পর্বের শুরুতে কথক দাবি করেন এই পৃথিবীটা সাধারণ মানুষে ভর্তি যারা দু'ভাগে বিভক্ত। একদল বুদ্ধিমান এবং নিজেদের সাধারণ বলে জানে আর একদল অল্প বুদ্ধির তাই তারা নিজেদের বোঝে না। গানিয়া তার নিজের সাধারণত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এটাই তার কষ্টের কারণ। বাবা জেনারেল ইভোলজিনের সঙ্গে তার ঝামেলা চলতে থাকে এবং একসময় মাতাল হয়ে থাকা মানুষটি লেভেদিয়েভের টাকা চুরি করে। কিন্তু শত অধঃপতনেও তার প্রতি মিশকিনের সহানুভূতি নষ্ট হয় না। শুধু ইভোলজিন নয়, গানিয়া, ইপ্পোলিট এমনকি রোগোজিনকেও সাহায্য করতে গিয়ে মিশকিন নিজের সমস্যা বাড়িয়ে তোলে। যে সাধারণত্ব সম্পর্কে কথক পাঠককে সচেতন করে দেন তাকে ছাপিয়ে যায় আগলেয়া ও মিশকিন যারা সাধারণের মধ্যেও অসাধারণ হয়ে ওঠে। তবে এদের দুজনের সম্পর্ক এক জটিল আবর্তে পথ হারিয়ে ফেলে। প্রবল আকর্ষণ ও একই সঙ্গে বিকর্ষণে এদের দূরত্ব বেড়ে যায়। এপানচিনরা সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে মিশকিনের আলাপ করিয়ে দিতে চায়। পার্টির আয়োজন করে আগলেয়ার ও মিশকিনের সম্পর্ককে সামাজিকভাবে ঘোষণা করতে চায়। যদিও শেষ পর্যন্ত মিশকিন অসুস্থ হয়ে পড়লে পার্টি ভেঙে যায়। তবে তার আগে মিশকিনের সঙ্গে রাশিয়ার অভিজাত সমাজের সাক্ষাৎ হয়। মিশকিন বলে,

-" আপনাদের সম্বন্ধে অনেক খারাপ কথা শুনেছি। শুনেছি আপনাদের নীচতা, স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা , অগভীর জ্ঞান , বিশ্রী স্বভাবের কথা... দেখলাম এরা মার্জিত, সরল , চতুর । এরা রুশ , এরা সহৃদয়...অসংখ্যবার শুনে বিশ্বাস করতাম যে সমাজ শুধু আচরণ আর প্রথার সমষ্টি , সব বাস্তবতাই তার বিলুপ্ত । কিন্তু এখন দেখছি তা নয়... আমার বক্তৃতার কোনো ক্ষমতা নেই। আমার ভাবভঙ্গী কখনো ঠিক হয় না, লোকে হাসে , আমার চিন্তাকে তারা ছোট করে দেখে। আমার সামঞ্জস্যবোধও নেই , অথচ ঐটাই আসল । আমি জানি , আমার পক্ষে চুপ করে বসে থাকাই ভালো। চুপ করে থাকলে আমায় খুব বুদ্ধিমান বলে মনে হয় , উপরন্তু আমি কিছু কিছু ভাবতেও পারি। তবে এখন আমার দিকে কথা বলাই ভালো। আমি কথা বলছি , কারণ আপনারা আমার দিকে এত সুন্দর দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন , আপনাদের মুখমন্ডল এত সুন্দর..."

মিশকিনের বুঝতে পারেনি , কিন্তু পাঠক বোঝে পরিশীলিত, মার্জিত ব্যবহারের আড়ালে অন্তঃসারশূন্যতা। এসবই আসলে ছলনা , মুখোশ যাতে আন্তরিকতার ছিটেফোঁটাও নেই। মিশকিনের সহজ সরল সহৃদয়তার সাপেক্ষে এই ফাঁকি বড় প্রকট হয়ে ওঠে।

আগলেয়া মিশকিনকে নিয়ে নাস্তাসিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যায় এবং তাদের কথাবার্তায় তিক্ততা বেড়ে ওঠে। আগলেয়ার অপমানের উত্তরে একসময় নাস্তাসিয়া বলে সে চাইলে মিশকিন আগলেয়াকে ছেড়ে দেবে আর তাকেই বিয়ে করবে।এই কথা শুনে আগলেয়া দৌড়ে চলে যায়। মিশকিনও তার সঙ্গে যেতে গেলে নাস্তাসিয়া তাকে বাধা দেয় এবং তার দু'হাতের মধ্যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। পরের দু'সপ্তাহ নাস্তাসিয়ার সঙ্গে ভালোভাবে কেটে যায় মিশকিনের। ইভেয়গেনি আগলেয়াকে আঘাত করার জন্য মিশকিনকে দায়ি করে । মিশকিন জানে তার মনের প্রকৃত অবস্থা কেউ বুঝতে পারবে না। আগলেয়ার প্রতি তার প্রেম নাস্তাসিয়ার মতো বঞ্চিত এক দুর্ভাগার প্রতি করুণা ও মায়ার কাছে আত্মসমর্পণ করে... কিন্তু বিয়ের দিন নাস্তাসিয়া আবার রোগোজিনের সঙ্গে চলে যায় পিটার্সবার্গে। পরের দিন সকালে মিশকিনও যাত্রা করে । ওখানে গিয়ে প্রথমে নাস্তাসিয়ার দেখা না পেলেও পরে রোগোজিন যখন তাকে নিজের অন্ধকার ঘরের মধ্যে নিয়ে যায় নাস্তাসিয়াকে রোগোজিনের ছুরির আঘাতে চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে থাকতে দেখে সে।

' ...যখন দরজা খুলে লোক ঢুকল , তখন তারা দেখল , খুনী একেবারে অপ্রকৃতিস্থ উন্মাদ। মিশকিন পাশে মেঝেতে স্থির হয়ে বসে রয়েছে ; যতবার পাগল চেঁচাচ্ছে বা বকবক করছে , ততবার সে তার কম্পিত হাত দুটো আস্তে আস্তে তার চুলে , গালে বুলিয়ে দিচ্ছে , যেন তাকে সে আদর করছে , সান্ত্বনা দিচ্ছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে মিশকিনকে কেউ কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে সে তা বুঝতে পারছে না , চারদিকের লোকজনকেও চিনতে পারছে না । যদি ডাক্তার শ্নিডার এখন নিজে সুইজারল্যান্ড থেকে এসে তার প্রাক্তন ছাত্র ও রোগীকে দেখতেন এবং সুইজারল্যান্ডে প্রথম বছর মিশকিনের যা অবস্থা ছিল সে কথা যদি মনে করতেন , তাহলে তিনি আগের মতই আবার হতাশ হয়ে হাতের চেটো উল্টে বলতেন 'একটা নির্বোধ ।'

'জুয়ারী' উপন্যাসের নায়িকার নাম সরাসরি পলিনা আলেকসানদ্রভনা রাখলেও বাস্তবের পলিনা সুসলোভার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায় 'ইডিয়ট' উপন্যাসের নাস্তাসিয়ার মধ্যে। রোগোজিনের সঙ্গে তার দুর্ব্যবহার সব সীমা ছাড়িয়ে ছিল। অথচ সে মিশকিনকে এড়িয়ে বারবার ছুটে গিয়েছে রোগোজিনের কাছে। 'জুয়ারী'র নায়ক পলিনা আলেকসানদ্রভনার ব্যবহার মনে করে এক জায়গায় বলছেন,

'... আমি শপথ করে বলছি ওইসব মুহূর্তে আমি যদি হাতের কাছে একটা চাকু পেতাম নির্ঘাৎ ওর বুকে বসিয়ে দিতাম। কিন্তু এও স্বীকার করি আমার ভালোবাসা পরীক্ষার জন্য ও যদি বলত সমুদ্রে ঝাঁপ দাও আমি হয়ত তাও দিতাম... হ্যাঁ পলিনা আলেকসানদ্রভনা কখনো কখনো আমাকে মনুষ্যেতর কিছু মনে করত...'

'ইডিয়ট' উপন্যাসের নায়িকার এই পরিণতিই হল।

শুধু পলিনা নয়, পলিনা , মারিয়া দু'জনের সঙ্গেই দস্তয়েভস্কির সম্পর্ক ভালোবাসা আর ঘৃণার খুব কাছাকাছি ছিল। 'তিনি তাঁর দ্বিখণ্ডিত অন্তঃপ্রকৃতির দুই বিপরীত মেরুতে সব সময় দুলতেন। কি স্ত্রীর সঙ্গে , কি প্রণয়িনীর সঙ্গে'।

আলোচনা সুবিধার্থে 'ইডিয়ট' উপন্যাসটির কাহিনীর কাঠামোটুকু এখানে বলা হল মাত্র। তার আসল সৌন্দর্য্য রয়েছে চরিত্রদের নিরন্তর মানসিক টানাপোড়েন ও অন্তর্দ্বন্দ্বের রহস্যময় জগতে। দস্তয়েভস্কিকে যারা কেবল একজন লেখক বলে নয় বরং চিন্তা-নায়ক বলে মনে রাখতে চান তাঁরা 'ইডিয়ট'কে তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনাগুলোর প্রথমে রাখেন। সৎ অসৎ পাপ পূণ্যের ধারণাকে নতুন করে ভাবতে শেখান তিনি। উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্রদের সঙ্গে পাঠকও মিশকিন সম্পর্কে যত জানতে থাকে ততই বিস্ময় জাগে। তার আত্মীয় হয়ে উঠতে চায় সকলেই অথচ কোথাও তারা বোঝে এই মানুষটির ঘনিষ্ঠ হওয়া যায় না। এ যেন কেমন নিঃসঙ্গ , একলা । সাধারণ ভাবনায় যাকে ছোঁয়া যায় না কাছে থেকেও যে সুদূরব্যাপী , অগম্য অথচ এক নাছোড় শুদ্ধতা যাকে ঘিরে রাখে তাকে ঈশ্বরের নিকটতম বলেই মনে হয়... এবং সে দাঁড়িয়ে থাকে অলঙ্ঘ্য দূরত্বে। 

মূলত মানুষের নৈতিক ও আদর্শগত প্রশ্ন নিয়ে লেখা 'ইডিয়ট' উপন্যাসটিতে  খ্রীষ্টানুরক্তি ও পবিত্র ভালোবাসার সঙ্গে কাম ও আত্মপরায়নতার সংঘাতের সঙ্গে মিশে গিয়েছে সাম্প্রতিক সামাজিক ও রাজনৈতিক ও ব্যক্তি জীবনের নানা সংকট। উপন্যাসের সকলেই সংকটের শিকার। সকলেই ক্ষতবিক্ষত । তাই অন্ধকার এখানে ঘন হয়েছে। শুধু মিশকিন যেন আলোর ইশারা। তার হাত ধরেই যেন বাকিরা উত্তরণ পেতে চায়... সহানুভূতি আর প্রেমের মন্ত্রে সে জয় করে নিয়েছে সবাইকেই...অথচ নিজেই রক্তাক্ত হয়েছে আঘাতে আঘাতে।

১৮৬৫ র ২ রা জুলাই ধনী প্রকাশক  স্তেলফ্ স্কি তিনহাজার রুবল অ্যাডভান্স দিলেন সেখানে অনেক শর্তের মধ্যে স্ট্যাম্প আঁটা কাগজে লিখিয়ে নিলেন অন্তত ৬০০০০ শব্দের একটা নতুন উপন্যাস লিখে দিতে হবে ১৮৬৬ র ১লা নভেম্বরের মধ্যে । যদি না লিখে দিতে পারেন তাহলে তিনি অতীতে যত লেখা লিখেছেন এবং ভবিষ্যতে যত লিখবেন তার সমস্তরই আইনসম্মত প্রকাশক হবেন স্তেলফ্স্কি এবং দস্তয়েভস্কি আর একটা কোপেকও পাবেন না। এই অ্যাডভান্সের টাকা নিজের ধার দেনা, দাদার পরিবার , রুলেত -টেবিল ও পলিনা সব মিলিয়ে শেষ হয়ে গেল। পলিনা বিয়ে করতে অস্বীকার করল। সেইসময় দীর্ঘ উপবাসে কেটেছে তাঁর।ইজিচেয়ারে বসে বই পড়তেন কেবল। উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও ছিল না। বন্ধু ভ্রাঙ্গেলের টাকায় কোপেনহেগেন থেকে পিটার্সবার্গে ফেরার পথে ' অপরাধ ও শাস্তি ' র পরিকল্পনা করলেন। লেখা এগোতে লাগলো কিন্তু সেই লেখা তো কাৎকফের আগাম তিনশ রুবলের বিনিময়ে 'রাশিয়ান মেসেঞ্জার' এ ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছিল। এদিকে স্তেলফ্ স্কির সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে। বন্ধুরা বারবার তাকে মনে করিয়ে দেয়... এমনকি প্লটটাকে তিনভাগ করে তিনবন্ধু লিখবেন এমন প্রস্তাবও আসে বন্ধুদের কাছ থেকে। কোনো পরিকল্পনাই যখন কাজে পরিণত হল না তখন বন্ধুরা স্টেনোগ্রাফার রাখার পরামর্শ দিলেন আর সেই সূত্রেই ১৯৬৬ র ৪ঠা অক্টোবর এলেন কুড়ি বছরের আন্না গ্রিগোরয়েভনা । নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হল "জুয়াড়ী " উপন্যাস আর সূচনা হল এক আশ্চর্য সম্পর্কের, সমর্পণের ... আজীবন ভালোবাসার পিছনে পাগলের মতো ছুটে চলা অস্থির অশান্ত মানুষটিকে শান্ত সুন্দর জীবন উপহার দিলেন এই প্রতিভাময়ী অসম সাহসী নারী। নিজেকে প্রায় বিলিয়েই দিয়েছিলেন দস্তয়েভস্কির প্রবল ব্যক্তিত্ব আর সর্বগ্রাসী জীবন তৃষ্ণার কাছে।

 ১৮৬৭ র ১৫ই ফেব্রুয়ারি বিয়ে হল তাদের। আন্নার বিবাহিত জীবনের সূচনা সুখের হয়নি। মারিয়ার ছেলে পাশা এবং দাদা মিখাইলের স্ত্রী এমিলি তাদের জীবনকে বিষময় করে তোলে। আন্না বুঝলেন পরিবারের এই চক্রান্ত তাদের ধ্বংস করবে সেইসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মানুষটির সৃজন ভাবনা। নিজের গয়না বন্ধক রাখলেন। কিছু জিনিসপত্র বিক্রি করে কিছু মটগেজ রেখে সেই টাকা নিয়ে বিদেশ পাড়ি দিলেন... ভিলনা , বেরিলিন , দ্রেসদেন , বাদেন হয়ে জেনিভায় । আন্নার গভীর প্রেমও চঞ্চলমতি মানুষটিকে বেঁধে রাখতে পারে না। পলিনার সঙ্গে তখনও তাঁর চিঠি বিনিময় চলত। পলিনা তাঁকে আন্নাকে ছেড়ে তার কাছে যেতে বলে। এবার আন্নাই পলিনাকে চিঠি লিখে বোঝাপড়া করেন। এই চিঠিপত্র বিনিময় 'ইডিয়ট' উপন্যাসের আগলেয়া নাস্তাসিয়ার চিঠিপত্রের আদান-প্রদানে স্মরণীয় হয়ে রইল যা উপন্যাসের পরিণতিকে নিয়তি নির্দিষ্ট পথেই যেন পরিচালিত করে। পলিনার সঙ্গে প্রেমের সমাপ্তি ঘটলেও রুলেত-টেবিলের প্রবল আকর্ষণ তাঁকে সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে হোটেলে একলা রেখে নিয়ে গেল হামবুর্গ, বাদেন- বাদেন আর সর্বস্বান্ত হয়ে স্ত্রীকে বললেন টাকা পাঠাতে। কথা দিলেন ফিরে গিয়ে নতুন উপন্যাসে হাত দেবেন। এসে যখন জানলেন আন্না অন্তঃসত্ত্বা এই অবস্থায় তাঁকে একলা ফেলে যাওয়ায় অনুতপ্ত হলেন তিনি। কিন্তু নেশার প্রাবল্যের কাছে হার মানতে হল তাঁকে। সুইজারল্যান্ড যাত্রাকালে বাদেন- বাদেন এ এসে আবারও নিঃস্ব হলেন। সেখানে গোনচারেফের সঙ্গে দেখা হল। তিনি দস্তয়েভস্কির হাতে সুইজারল্যান্ডে গিয়ে মাসখানেক থাকার মতো টাকা দিয়ে বললেন তুর্গেনিভের সঙ্গে দেখা করতে। জুলাই মাসে তাঁদের সাক্ষাৎ হয়। দু'জন সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর মানুষ যখন মুখোমুখি হল দস্তয়েভস্কির মনোজগতে এক দারুণ আলোড়ন দেখা দিল। একে তো অভিজাত সমাজের বাসিন্দা তুর্গেনিভের অপমানজনক ব্যবহারে আহত হয়েছিলেন তিনি। তার উপর তুর্গেনিভ তাঁর সদ্য প্রকাশিত উপন্যাস 'ধোঁয়া' র প্রসঙ্গে নিজের দেশ ও ঈশ্বর সম্পর্কে এমনসব মন্তব্য করতে থাকলেন যে অসহ্য হয়ে উঠলেন দস্তয়েভস্কি। বন্ধু মাইকফকে এই সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে লিখেছেন , " দেবতাবাদ যে খৃষ্টের মতন অমন একজন অপাপবিদ্ধ মানুষ উপহার দিয়েছে বিশ্বজনকে সে তা মানতেই চায় না।... কিন্তু ঈশ্বর না মেনে এরা মানুষকে কী দিল? নির্লজ্জ আত্মপ্রীতি আর জঘন্য ব্যক্তি-কেন্দ্রিকতা ছাড়া আর কী পেয়েছে ওদের কাছে রাশিয়া । খৃষ্টকে এরা থু - থু দেয় আর রাশিয়াকে প্রাণভরে গালপাড়ে..."

আজীবন ঈশ্বর নিয়ে সংশয় ও বিশ্বাসের দোলাচলতায় থাকা মানুষটি মেনে নিতে পারেনি তুর্গেনিভের উপেক্ষা, অপমান...তবে এই ঘটনা জুয়ার টেবিল থেকে লেখায় নিয়ে এল সমস্ত মনোযোগ। তুর্গেনিভের বিরোধিতা করতে গিয়েই জেনিভাতে ১৮৬৭ -র আগস্টে তিনি লিখতে শুরু করলেন 'ইডিয়ট', যেখানে খৃষ্ট তুল্য এক মানুষকে উপস্থাপন করলেন তিনি। শিশুর মতো সরল , পবিত্র , সৎ অথচ মানবিক  দুর্বলতায় খুব চেনা একজন মানুষ। অথচ সে আমাদের প্রাত্যহিক জগতের কেউ নয় , এমনকি দেশ কালের সীমায় তাকে বাঁধা যায় না কখনও। সে এক 'দেখা না দেখায় মেশা' অধরা আদর্শ। তাই সে যেখান থেকে এসেছিল সেখানেই ফিরে যায় আর ক্ষণকালের অস্তিত্বে চিরকালের চিহ্ন রয়ে যায়। লিখতে লিখতে ভাবতে ভাবতে রাতের পর রাত কেটে যায়। আন্না ভয় পেলেন। এত চিন্তা এত শ্রম। একটু বিশ্রাম দরকার । এবার নিজেই পাঠালেন স্বামীকে রুলেত টেবিলে। প্রথমে জিতেই আশার সঞ্চার হল তারপরই আবার সব হারিয়ে বন্ধক রাখলেন ঘড়ি, আংটি , বোতাম। আন্নার পাঠানো টাকায় বাড়ি ফিরলেন। আবারও ডুব দিলেন লেখায়। এইসময় নতুন শারীরিক সমস্যায় পড়লেন... হৃদকম্প... ভাবলেন আর বাঁচবেন না। হতাশায় আক্রান্ত মানুষটিকে উৎসাহ দিতে থাকেন আন্না। অবশেষে আশঙ্কার মেঘ কাটে। ১৮৬৮ র ফেব্রুয়ারিতে ছোট্ট সোনিয়া এল তাঁদের জীবনে। ৪৬ বছর বয়সে এসে পেলেন পিতৃত্বের স্বাদ। মেয়েকে নিয়ে মেতে রইলেন তিনি। উপন্যাসের প্রথম ভাগ সবে শেষ হয়েছে। লেখা আর এগোচ্ছে না। রুলেত টেবিল আবারও হাতছানি দেয়। ট্রেনে উঠে বসেন তিনি। কিন্তু সেখানে গিয়েও মেয়ের কথা মনে পড়ে। প্রতিবারের মতো এবারও সর্বস্ব হারিয়ে আন্নার পাঠানো টাকায় ফিরে আসেন বাড়িতে। মেয়ে শীর্ণ ও রুগ্ন হয়ে পড়েছে। ২৪ শে মে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চলে গেল সোনিয়া। চরম আঘাত পেলেন মানুষটি। সন্তানশোক ভুলে আন্না তাঁকে বাঁচাতে চাইলেন। জেনিভায় থাকা অসম্ভব অথচ হাতে যতটুকু অর্থ আছে তা দিয়ে একমাত্র ভিভে- তে পৌঁছলেন। বারংবার মৃগীর আক্রমণ আর শোকে মূহ্যমান দস্তয়েভস্কিকে দেখে আন্না ভয় পেতেন। মনে হত এইবার মূর্চ্ছা গেলে আর উঠবেন না মানুষটা। এই পরিস্থিতিতেও একটু বসতে পারলে তিনি লিখতেন। অবশেষে আন্নার মায়ের সাহায্য ও বন্ধু মাইকফের পাঠানো টাকা এসে পৌঁছালে তাঁরা ফ্লোরেন্সে এলেন। এখানেই ১৮৬৯ এর জানুয়ারিতে শেষ হল 'ইডিয়ট' উপন্যাস। নায়ক মিশকিনের মতোই ক্ষত বিক্ষত হয়েছেন তার স্রষ্টা আদ্যন্ত প্রেমিক সত্তার অন্তহীন টানাপোড়েন ও আত্মানুসন্ধানের অনলস প্রয়াসে। জীবন প্রেমিক এই লেখক কেবল সুখের সন্ধানে ফেরেননি বরং দুঃখকেও নিঃশেষে গ্রহণ করেছেন। ভোগ করেছেন একেবারে তলানিটুকুও। শুধু নিয়তি নয় কিংবা ভাগ্য নয়,  বহুক্ষেত্রে নিজের হাতেই খনন করা সর্বনাশের অতলে তলিয়েও একটিবারের জন্যও ডুবে গিয়ে নিষ্কৃতি পেতে চাননি । বরং প্রাণের আতিশয্যে ভেসে থাকার জন্য খড়কুটোকেও আঁকড়ে ধরেছেন। আর এই সর্বনাশের কিনারায় দাঁড়িয়েই খুলে গেছে সৃজনের মুখ। এ এক অলৌকিক স্রষ্টার লৌকিক জীবনের বিস্ময়। তিনি ও তাঁর সৃজন ভিন্নতা ও অভিন্নতার মাপকাঠিতে নিয়ত ভাস্বর...

উপন্যাস শেষ করে এক অদ্ভুত নিরাসক্তিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে মন। তিনি দর্শন ও মনস্তত্ত্বের জটিলতার পথে খুঁজেছেন অস্তিত্বের মূল্য। তাঁর উপন্যাস কখনও শেষ কথা বলে না। সত্য যেন প্রত্যেকের কাছে স্বতন্ত্র। তাঁর প্রত্যেকটি নায়কই বেনামীতে তিনি । নিজেকে নানা অভিজ্ঞতায় যন্ত্রণায় ফেলে জীবনকে যেভাবে যাচাই করেছেন প্রতি মুহূর্তে তাই হয়ে উঠেছে জীবন দর্শন। 'ইডিয়ট' এ মিশকিন রোগোজিন এদের কেউই তিনি নন আবার এদের মধ্যে দিয়েই তিনি যেন নিজের দুই বিপরীতমুখী ভাবনাকে তাদের নিরন্তর টানাপোড়েনকে উপস্থিত করে নিজে দাঁড়িয়ে থাকলেন দূরে। কিয়ের্কেগাদ কিংবা নীৎসের থেকে অনেক দূরে বসেও তিনি জীবনের নির্যাস থেকে যে দার্শনিক ভাবনায় উপনীত হলেন সেখানে মানুষ একা। আজ যাকে ঠিক বলে মনে করে কালই তার চরম বিরোধী হয়ে দাঁড়ায়। এ কথা নিজের ক্ষেত্রেও চরম সত্য। তাই মানুষ নিরাশ্রয়, নিঃস্ব। পাপের প্রতি তার স্বাভাবিক আকর্ষণ ও দুঃখ ভোগের আকাঙ্ক্ষাই যেন মানুষের নিয়তি। সেই দ্বিধা দীর্ণ মানবাত্মার কান্নাই যেন 'ইডিয়ট' উপন্যাসের চরিত্রগুলিকে অস্থির করে তুলেছে। তারা বারবার ছুটে এসেছে মিশকিনের কাছে ভালোবাসায়, বিস্ময়ে এমনকি ঘৃণায়...সতত জীবন সত্যের সন্ধানে ব্যাপৃত দস্তয়েভস্কি নেতি ও ইতির সংশয়ে ক্রমাগত পুড়েছেন । ১৮৬৯ সালে 'ইডিয়ট' শেষ হল যা কোথাও বিশ্বাস রাখে 'positive good man ' এর ধারণায়। অথচ ১৮৭০ সালে বন্ধু মাইকফকে লিখেছিলেন ,

'' যে মূল প্রশ্নটি আমাকে সারাজীবন নিদ্রায় জাগরণে অনুক্ষণ দগ্ধ করেছে  সে হল, ঈশ্বর আছে কি নেই ..."

'শয়তান' উপন্যাসে কিরিলফ বলছে , " যদি ঈশ্বর বলে কেউ না থাকে ত আমিই ঈশ্বর ।"

 তিনি খুলে দেন মানুষের ভাবনার পথ। সাদা ,কালো থেকে অনেকটা দূরে এক ধূসর জায়গাতেই যে মানুষের অবস্থান তা বারবার প্রমাণ করে তার উপন্যাস। এই মেরুকরণের দুনিয়ায় জন্মের দু'শো বছর পরেও আরো বেশি করে প্রাসঙ্গিক তিনি। নীতি -দুর্নীতি ,পাপ- পূণ্যের নতুন ভাষ্য রচনার আগে নিজের দিকে তাকাতে শেখালেন পাপে ও পূণ্যে সমানভাবে নিমজ্জিত সেই জাদুকর। বিস্ময় বিমূঢ় এই পৃথিবীকে অনায়াসে 'নির্বোধ' বলতে তিনিই পারেন একমাত্র। নিত্য জায়মান ও অপসৃয়মান এই বিশ্বে শেষ কথা যে কেউ বলতে পারে না তা বলে গেলেন এই 'প্রফেট'...বিশ্ব-সাহিত্য ও জীবনের দিকদর্শনের একছত্র সম্রাট ও 'ঈশ্বর'।

তথ্য ঋণ :

* লেখকের লেখক দস্তয়েফ্স্কি : যজ্ঞেশ্বর রায়।

* Dostoevsky , A Writer in His Time : Joseph Frank

*Dostoevsky and the Idiot : Robin Feuer Miller