দস্তয়েভস্কির প্রথম উপন্যাস 'অভাজন' প্রসঙ্গে
- 25 December, 2021
- লেখক: শ্রাবন্তী ঘোষাল
১৮৪৬ সালের জানুয়ারি মাসে ফিওদোর দস্তয়েভস্কির প্রথম উপন্যাস 'বেদনিয়ে লিয়ুদি ' (ননী ভৌমিকের বাংলা অনুবাদে " অভাজন") প্রকাশিত হয়।তার প্রথম মৌলিক রচনা এই নভেলা প্রকাশের আগেই তিনি বালজাকের "ইউজিন গ্র্যান্ডেট" অনুবাদ করেছেন। সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের নিম্ন মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষজন, তাদের রোজকার রোজগারের লড়াই, দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবন, সম্পর্কের টানাপোড়েন, মূল্যবোধের ওঠাপড়া নিয়ে বালজাক তার উপন্যাসে যে জগৎ তৈরী করেছিলেন, দস্তয়েভস্কি তার প্রভাবে পুষ্ট হয়েছিলেন। এমনকি মেঘে ঢাকা আকাশ, বরফ জমা খালপথ, পুরনো সাবেকী বাড়ির স্যাঁতসেঁতে, অস্বাস্থ্যকর, গুমোট ঘরভর্তি ভাড়াটের প্রতিদিনের হট্টগোল নিয়ে সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরটি তার রচনায় একটি চরিত্র হয়ে উঠেছে।
এই শহরেই থাকে ভারেনকা যে সেলাই করে তার পেট চালায় আর মাকার দেভুসকিন যে সরকারি অফিসে খুব সামান্য বেতনে অনুলিপিকারের কাজ করে। এই দুজনের মধ্যে চিঠির আদানপ্রদান এর মাধ্যমেই অভাজনের কাহিনী গড়ে ওঠে। এই কাহিনীর কোন কথক নেই, নেই কোন ভাষ্যকার। জীবন যেমন তেমনই গল্প ছুটে চলা। ৪ঠা এপ্রিল থেকে যে গল্প বলা শুরু হয় তা থেমে যায় ২৪শে অগাস্ট যখন বীকোভকে বিয়ে করার জন্য ভারভারা সেন্ট পিটার্সবার্গ শহর ছেড়ে চলে যায়। এই যে নদীর মতো সময়ের বয়ে চলা তার আশে পাশের ছোট ছোট নুড়ির মতো ছোট ছোট কাহিনী ঘিরে অভাজনের অবয়ব গড়ে ওঠে।
ভাবীকালে বিরোধী নায়কদের যে ধারা দস্তয়েভস্কির লেখায় বারবার উঠে আসবে তার প্রথম সফল রূপায়ণ মাকার দেভুসকিন। নিজের আর্থ সামাজিক অবস্থানে কোণঠাসা হয়ে যে নিজের অস্তিত্বই ভুলতে বসেছিল। ভারাভারার সাথে তার সম্পর্ক তাকে নতুন এক আত্মপরিচিতি দিয়েছে।
"তোমার সাথে পরিচয়ের আগে,আমি নিজের সাথে পরিচিত হতে পারি নি। ঘুমিয়ে থাকার মতো নিরুত্তাপ,নিশ্চিন্ত হয়ে আমি ছিলা।আমার জীবনে তুমি যখন এলে আমার সমস্ত অস্তিত্ব এমন আলোকিত হলো যেন আমার মন আর আত্মা জ্বলে উঠল"।
মাকার দেভুসকিন বিশাল এক ম্যানসনের রান্নাঘরের পর্দার পেছনে একচিলতে জায়গায় থাকেন।পেটচালানোর জন্য তিনি অফিসে "Copy" (অনুলিপি) করেন। ঘটনাচক্রে ভারভারা থাকেন ঠিক তার মুখোমুখি বাড়িতে। তার নিজস্ব মৌলিক রচনা ভারভারাকে লেখা এই চিঠির গোছা যেখানে তিনি নিজেকে তুলে ধরছেন, তুলে ধরছেন নিজের প্রাত্যহিক দিনযাপনের গ্লানি পেরিয়ে অন্যকে ভালোবাসার আনন্দের ছবি। কখনো আবেগতাড়িত হয়ে, কখনো ক্ষণিকের ক্রোধে, কখনো নেশাগ্রস্ত হয়ে, কখনো ভারেনকার জন্য ঋণগ্রস্ত হয়ে নিজের জীবনের একেকটা অধ্যায় তিনি পাঠকের কাছে মেলে ধরছেন।
তার "অভাজন" প্রকাশের আগে অব্দি দস্তয়েভস্কির ব্যক্তিগত জীবন, পড়াশোনা, জীবিকা নির্বাহের উদ্যোগ কোন কিছুই সম্ভাবনাময় ছিল না। ১৮৪৪ এ তার বয়স চব্বিশ, ততদিনে সেন্ট পিটার্সবার্গের মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে তার পাঁঁচবছরের পড়াশোনা শেষে তিনি সেনাবাহিনীতে দ্বিতীয় লেফট্যানান্ট এর কাজ করছেন। পদোন্নতির সুবাদে সেন্ট পিটার্সবার্গ ছেড়ে গহীন বন আর তুষার মরুভূমির শহর ক্রাসনোয়েতে যাবার প্রস্তাব সে সসম্মানে নাকচ করে চাকরিতে ইস্তফা দেয়। চারদিকে বিপুল ঋণ, দুর্বল শরীর, স্নায়বিক সমস্যা সব মিলিয়ে জেরবার হয়েও রুটিরুজির একমাত্র উপায় এই চাকরিটি ছেড়ে লেখার কাছেই তিনি আত্মসমর্পণ করেছেন। রাশিয়ার জার প্রথম নিকোলাসের শাসনাধীন ওই সময়কাল রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ বা ফরাসি সাহিত্যে পরমুখাপেক্ষীতার দিন পেরিয়ে রুশ সাহিত্যে নতুন করে এক নিজস্ব আন্তর্জাতিকতার উন্মেষ এ সময়েরই ফসল। দস্তয়েভস্কি তার পূর্বসূরি গোগোল আর পুশকিনের বা সমসাময়িক বেলিনস্কির বিপ্রতীপে একটি অবস্থানের অন্বেষ তিনি বারবার করে চলেছেন। তার এ সময়েরই অন্যতম দোসর ডি.ভি গ্রেগোরিভিচ, যে তার কলেজের বন্ধু আর সেই সময়ের এক কবিও বটে। তারা দুজনে মিলে সাহিত্যে এক নতুন সকালের স্বপ্ন দেখেছিলেন। অভাজনের কাহিনীতে দরিদ্র কেরানী দেভুসকিন তার বন্ধু-লেখক রাতাজ্যায়েভের কাছ থেকে বই ধার করে পড়ে। চাপল্যে ভরা সহজলভ্য সাহিত্যের বাইরে সত্যিকার সাহিত্যে সে আগ্রহ বোধ করে। সাহিত্য এবং সাহিত্যিকের প্রতি তার এক মুগ্ধতাবোধ কাজ করে। ভারেনকাকে লেখা চিঠিতে সে এ ব্যাপারে অভিমত জানায়।
"সাহিত্য জিনিসটা অপূর্ব ভারেনকা,সত্যি অপূর্ব।…… সাহিত্য হলো একটা ছবি,মানে এক ধরনের ছবি আর দর্পণের মতো।এতে আবেগ প্রকাশ পায়, সূক্ষ্ণ সমালোচনা আর উপদেশও তাতে থাকে এবং জীবনের ইতিবৃত্তও বটে।"
ব্যক্তিগত জীবনে দস্তয়েভস্কির বাবা মারা যাওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই তার ছোট বোনের মাত্র সতেরো বছর বয়সে বিয়ে হয় বিপত্নীক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী পিতর কারেপিনের, যার বয়স ছিল ছেচল্লিশ। এই অসম সম্পর্কে তিনি অত্যন্ত বিরক্ত ছিলেন কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া তাদের সম্পত্তির একজন অছি প্রয়োজন এই মর্মে তিনি এই বিয়ে মেনে নিয়েছিলেন। ১৮৪১ থেকে ১৮৪৪ এই তিন বছরে কারেপিনের মাধ্যমে তিনি অঢেল টাকা পেয়েছিলেন যা দুহাতে খরচ করেছিলেন এমন উদ্দেশ্যে যা তাকে আরো খরচের চক্রে আর দেনার দায়ে অজানা ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তিনি মনে প্রাণে এসব কাটিয়ে উঠতে চেয়েছেন।
১৮৩০ সাল থেকে রুশ সাহিত্যে এক নতুন ধারার সূত্রপাত হয়েছিল।সাধারণ মানুষের মধ্যে বই পড়ার ও বই কেনার আগ্রহ খুব বেড়ে যাচ্ছিল।ফলে বইয়ের ব্যবসার সূত্রে টাকা রোজগারের রাস্তা খুলে যাচ্ছিল।মৌলিক রচনার পাশাপাশি অনুবাদ সাহিত্যের বাজারও বেশ লাভের মুখ দেখছিল। (অভাজনের কাহিনীতে ভারেনকা হতদরিদ্র পক্রোভিচের ঘরেও অনেক বই দেখতে পায়।তাকে জন্মদিনে উপহার হিসেবে বই দেয়ার জন্য সেও বইয়ের বাজার যায় এবং বেশ সস্তায় সমসাময়িক সংস্করণের এক সেট পুশকিনের বই কিনে আনে।) দস্তয়েভস্কি এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে প্রকাশনার ব্যবসায় এলেন।কিন্তু অনভিজ্ঞতার কারণে তা থেকে উলটে ঋণগ্রস্ত হলেন। গ্রেগোরিভিচ আর দস্তয়েভস্কি এই সময় থেকে একসাথে কিছু করার পরিকল্পনা করেন। ততদিনে গ্রেগোরিভিচ এর দুইটি বই প্রকাশিত হয়েছে যার বিষয় দরিদ্র জনসাধারণ, "চাষি-মজুর-বেকার"। দস্তয়েভস্কির চোখের সামনে ভেসে উঠল তার কেরানি বন্ধু রাশমিরস্কির হতদরিদ্র জীবন আর পায়রার খুপরির মতো তার বাসস্থানের ছবি। গ্রেগোরিভিচ উঠে এলেন তার দু কামরার ফ্ল্যাটে। ঘরভাড়া বাকি পড়ে ছিল,শীতে ঘর গরম রাখার মত সংস্থান তাদের ছিল না।কারেপিনের দেয়া টাকায় রুটি, কফি, মোমবাতি আর কাগজ কেনা হত। এভাবেই ১৮৪৪ এর সেপ্টেম্বরে "বেদনিয়ে লিয়ুদি" (বাংলা অনুবাদে অভাজন) লেখা শেষ হয়। ১৮৪৫ এর মার্চ মাসে যাবতীয় কাটাকুটি শেষে তার পাকা খসড়া প্রস্তুত হয়। সে সময়ের তরুণ প্রভাবশালী কবি নেক্রাসফের হাতে এই পাণ্ডুলিপি পৌঁছে দেন বন্ধু গ্রেগোরিভিচ। তারপর বাকিটা ইতিহাস যা আগামী দিনে বিশ্বসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে নিজস্ব অনন্যতায়।
"অভাজন" একটি পত্রোপন্যাস। এই ধারায় দস্তয়েভস্কির আর একটি মাত্র লেখা," A Novel in nine letters" ১৮৪৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। সাহিত্যরীতির বিচারে "অভাজন" আঙ্গিক ও বিষয়গত উভয়দিকেই স্বাতন্ত্রের দাবি রাখে। দস্তয়েভস্কির কাহিনীতে কিছু অজানা রহস্য থেকে যায়।যেমন- অভাজনের শুরুতে পাঠক জানতে পারে, বাইকোভের প্ররোচনা ও প্রলোভন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যেই ভারেনকা সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে চলে আসে। সেই অভিযোগ সত্যি কিনা তা পাঠক জানে না। কারণ গল্পের শেষে তাকেই বিয়ে করার জন্য ভারেনকা শহর ছেড়ে যায়।মাকার দেভুসকিন যতটাই ভালোমানুষ, বাইকোভ ততটাই মন্দ। ভালো আর মন্দের এই লড়াই দস্তয়েভস্কির পরবর্তী লেখা "অন্যায় ও শাস্তি", "কারমাজোভ ভাইয়েরা", "মুর্খ" ইত্যাদি লেখার মুল বিষয় হিসেবে বারবার উঠে এসেছে। কিন্তু অভাজনের ক্ষেত্রে তার ব্যঞ্জনা ভিন্ন। এখানে ভালোর সাথে জীবনের নগ্ন বাস্তবতা সম্পৃক্ত যার কোন সুনির্ধারিত ভবিষ্যতের আশা নেই। বুড়িয়ে যাওয়া টাক-মাথা কেরানি দেভুসকিনকে বেছে নিলে ভারেনকার জীবনে কোন উন্নতির আশা নেই। নোংরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এক পুরনো বাড়ির পর্দা দিয়ে ভাগ করে নেয়া রান্নাঘরের এক চিলতে কুঠুরিতে সে বাস করে। আবার দেভুসকিনের দিক থেকেও ভারেনকাকে বিয়ে করা খুব কিছু আশাব্যঞ্জক নয়। দুর্বল স্বাস্থ্য এই মেয়েটির নিত্যসঙ্গী রোগ ব্যাধি।এপ্রিল মাসে তার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে,জুন মাসে ঠান্ডা লেগে এমন অবস্থা হয় যে তার মনে হয় তার মৃতদেহ কে কবর দেবে? অগাস্ট মাসে ইস্ত্রি লেগে তার হাত পুড়ে যায়। মৃত্যুভয় প্রতিমুহূর্তে তাকে তাড়া করে ফেরে। বাইকোভ নিজের সম্পত্তির উত্তরাধিকার তার ভাইপোকে দিতে চায় না।তাই সে বিয়ে করতে চায় ভারেনকাকে। এই প্রস্তাবে সম্মতি দেয়া ছাড়া এই কাহিনীর আর কোন উপসংহার টানা যায় না। তাই বিদায়দৃশ্যে দেভুসকিনের জন্য চোখের জল ফেলেছিলেন এই কাহিনীর প্রথম পাঠক গ্রেগোরিভিচ আর প্রকাশক নেক্রাসফ।
অভাজনের মাধ্যমে দস্তয়েভস্কি সাহিত্যে এক প্রতিস্পর্ধী ধারা গড়ে তুলতে পেরেছেন।এই সাহিত্য শুধুমাত্র সমাজের উঁচু তলার কাহিনী তুলে ধরে না বরং সমাজ যাদের নীচু চোখে দেখে যেমন-মাতাল, জুয়াড়ি, ঋণখেলাপী, স্বার্থপর, লোভী নিরুপায়, হেরে যাওয়া মানুষ তার কাহিনীর মূল চরিত্র। জীবনের যে রূঢ় বাস্তবতার আঘাতে বারবার স্বপ্নের ফানুস দুমড়ে যায়, সেই মাটিতে দাঁড়িয়ে তিনি পৃথিবী দেখেছেন। এই পৃথিবীতে পক্রোভিচ অকালে মারা যায়, ভারেনকা ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করার সাহস পায় না।
রুতুজা দেশমুখ ওয়াকঙ্কার ভাবতে চেয়েছেন দস্তয়েভস্কির সাথে সত্যজিৎ রায়ের যদি প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হত এবং তা যদি ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্রতিফলিত হত, তার ব্যঞ্জনা কী হত। উভয়ের সৃষ্টিতেই বারবার শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনের ওঠাপড়া, মূল্যবোধের প্রতি দায়বদ্ধতা, কখনো বা তা থেকে বিচ্যুতি, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন এসব ছাপিয়ে এক শিল্পী,এক প্রেমিক মাথা তুলে দাঁড়াতে চেয়েছে। যে বারবার নিজের প্রেমে পড়ে, জড়িয়ে পড়ে এক পৃথিবী ভালোবাসার টানে, আটকে থাকে জীবনের আবর্তে। সত্যজিৎ রায়ের অপু ট্রিলোজির শেষ ছবি "অপুর সংসার" এর অপু তার পিছুটানহীন জীবনে রুটিন মাফিক চাকরিতে বাঁধা পড়তে চায় না। সে গ্যেটে, লরেন্স, কীটস, ডিকেন্স,দস্তয়েভস্কির জীবনে তার লেখক হবার আদর্শ খুঁজে পায়। ৫০ এর দশকে মুক্তি পাওয়া এই ছবিতে উঠে এসেছে সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, শিক্ষিত বেকার সমস্যা, বাল্যবিবাহ সহ আরো অনেক সামাজিক চিত্র। যে সমাজ বাস্তবতা দস্তয়েভস্কির সময়কালের রুশ সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, ভারতীয় চলচ্চিত্রের সাপেক্ষে তাকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরছেন সত্যজিৎ রায়। অভাজনের ভ্যারেঙ্কা নিজের জীবনকে আর্থিক, সামাজিক সুরক্ষা দিতে পরিস্থিতির চাপে বাইকোভকে বিয়ে করতে রাজী হয়। দেভুসকিনের সাথে তার বিচ্ছেদ ঘটে। হতভাগ্য কেরানির জীবনে খুদকুঁড়ো উপার্জনের টাকায় প্রেমিকার জন্য উপহার কেনার জন্য আর তাকে কৃচ্ছতাসাধন করতে হবে না। বিচ্ছেদ কখনো মুক্তি নিয়ে আসে। "অপুর সংসার" এর নায়ক কেরানি না হয়ে লেখক হতে চেয়েছিল।কিন্তু ঘটনার পাকেচক্রে সে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। পঞ্চাশের দশকের কলকাতা শহরের ভাড়াবাড়ির এক কামরার ঘরে তারা সংসার পাতে। ছোট একটা চাকরি আর বিকেলে ছাত্র পড়ানোর রোজগারের নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনে তাদের কোন আফসোস ছিল না। আসন্নপ্রসবা অপর্ণা কলকাতা ছেড়ে,অপুকে ছেড়ে,বাবা মায়ের বাড়ি যায়। সেখানে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে তার অকালমৃত্যু অপুকে বিবাগী করে। সদ্যজাত ছেলেকে মামাবাড়িতে রেখে কলকাতা ছেড়ে চাকরি নিয়ে সে অনেক দূরে পাহাড় জঙ্গলের রাজ্যে পাড়ি দেয়।তারপর একদিন সযত্ন লালিত, নিজের হাতের লেখা প্রথম উপন্যাসের পাণ্ডুলিপির পাতাগুলো পর্বতচূড়া থেকে নিচে এক অতলস্পর্শী উপত্যকায় ছড়িয়ে দেয়। গোটা পর্দা জুড়ে সাদা কাগজের ছড়িয়ে পড়া নিমেষে এক ঝাঁক সাদা পায়রার উড়ে যাওয়া মনে হয়।সন্তানের টানে অপু আবার ফিরে আসে, কাজলকে কাঁধে বসিয়ে সে কলকাতায় রওনা দেয়। যে শহর থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেখানে সে ফিরে আসে। বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়। সব কাহিনীই আসলে এক অলীক যাত্রা। এভাবে সেন্ট পিটার্সবার্গ আর কলকাতা এক হয়ে যায়। না পাওয়ার রঙ আবহমান কাল ধরে জীবনকে বয়ে নিয়ে চলে। সুধীজনে অভাজনের দু:খের কথা শ্রবণ করেন।