সরকারের নেতাজি-মিশন বনাম নেতাজির নিজস্ব মিশন
- 22 January, 2021
- লেখক: শতাব্দী দাশ
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর একশ-পঁচিশতম জন্মজয়ন্তীর মুখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হাজির হলেন একগুচ্ছ চমকপ্রদ ঘোষণা নিয়ে। একদিকে সংস্কৃতি মন্ত্রক নেতাজির জন্মদিনকে 'পরাক্রম দিবস' হিসেবে পালন করার কথা ঘোষণা করল। অন্যদিকে একশ-পঁচিশতম জন্মদিবস ঘটা করে পালনের জন্য যে একটি উদ্যাপন কমিটি তৈরি করা হল, যার চেয়ারম্যান স্বয়ং মোদী। আছেন বাংলার বর্তমান ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীরাও, আছেন সংস্কৃতি ও ক্রীড়া জগতের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা। ওদিকে নেতাজির জন্মদিনকে জাতীয় ছুটি হিসেবে ঘোষণার দাবিতে বহুদিন ধরেই সরব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একশ-পঁচিশতম জন্মজয়ন্তীর মুখে ফের এই দাবিতে সরব হয়েছেন তিনি। অর্থাৎ কিনা আবারও একবার নেতাজিকে ঘিরে রাজনীতি জমে উঠেছে।
বস্তুত বিগত কয়েক বছরে নেতাজিকে নিয়ে উদ্দীপনা ফিরে এসেছে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনীতির কল্যাণে৷ রাজ্য সরকারের নেতাজি-কেন্দ্রিক রাজনীতি তার পালটা প্রতিক্রিয়া মাত্র। ২০১৬ সাল থেকে নেতাজি ফাইল প্রকাশ, ২০১৮ সালে ভারত জুড়ে আজাদ হিন্দ সরকারের পঁচাত্তরতম বৎসরপূর্তি পালন, সেই উপলক্ষ্যে চিরাচরিত প্রথার বাইরে গিয়ে বছরে দ্বিতীয়বার লালকেল্লায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন, তারপর ২০১৯ সালে লালকেল্লায় নেতাজি মিউজিয়াম উদ্বোধন- একের পর এক উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। কেন নেতাজি হঠাৎ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠলেন আবার? এভাবে প্রাসঙ্গিক হতে তিনি আদৌ চেয়েছিলেন কি?
২০১৯ সালের ২৩শে জানুয়ারি উড়িষ্যার কেন্দ্রপাড়ায় নেতাজির জন্মদিন পালন উপলক্ষ করে গণ্ডগোল বাধে বলে খবর৷ বিজেপি-আরএসএস নেতাজিকে তাদের ভাবাদর্শে দীক্ষিত দেশনায়ক বলে প্রচার করাতেই নাকি গোল বাধে৷ নেতাজি কি সত্যি ছিলেন বিজেপির নিজের লোক? বিভিন্ন দেশনায়ক, বিশেষত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের, 'কাছের মানুষ' বলে প্রচার করার একটা ঝোঁক আরএসএস-বিজেপির মধ্যে বেশ কয়েক বছর ধরেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ অনুমান করা যেতে পারে, এ'ভাবে তারা দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে নিজেদের দল/সংগঠনটির অবস্থান পোক্ত করতে চায়৷ ইতিহাস বরাবরই রচিত হয় ক্ষমতাবানের ভাষ্য মেনে। সে অনুসারে অদলবদল ঘটেই থাকে স্কুলপাঠ্য ইতিহাস থেকে শুরু করে নানা স্তরের ইতিহাসের পঠন-পাঠনে৷ নিজের দলের নেতাদের উপর উজ্জ্বলতর আলো ফেলে ইতিহাস লেখেন সব সরকারপক্ষই৷ তাই কংগ্রেসের আমলে কংগ্রেসের নেতারাই ইতিহাসে প্রাধান্য পেয়েছেন। কিন্তু বিজেপি/আরএসএস এই যে মনীষীদের 'আপন' করে নিতে চাইছে, তার জন্য তাদের সত্যের স্থূল অপলাপ করতে হচ্ছে না তো?
এমনিতে স্বাধীনতার যুদ্ধে বিজেপির 'সংগ্রামী' আইকন বলতে আছেন শুধু বিনায়ক দামোদর সাভারকর, যাঁর জীবনের বিপ্লবী অধ্যায় আন্দামানে নির্বাসিত হওয়ার পরই শেষ হয়ে যাচ্ছে। তারপর তিনি
আন্দামানের সেলুলার জেল থেকে(১৩/১১/১৯৩১) ব্রিটিশদের মুচলেকা দিচ্ছেন। এদিকে বিজেপি নেতা ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপায়ীও বলেছেন, 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলন-এর সময় তিনি 'ভুলক্রমে' ধরা পড়েন ও পরবর্তীকালে ক্ষমা চেয়ে ছাড়া পান। এমতাবস্থায়, স্বাধীনতার আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ না হোক, অন্তত পরোক্ষ সংযোগ তৈরি করার চেষ্টায় মরিয়া হয়েই কি বিজেপি কাছে টানতে চাইছে কোনো কোনো মনীষী-কে?
বিজেপি গান্ধীকে কিয়দংশে আপন করার চেষ্টা করেছে, যিনি ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রাণপুরুষ। নেহেরু-বিরোধী প্রচারে তারা ব্যবহার করছে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলকেও। প্যাটেল প্রধানমন্ত্রী হলে নাকি কাশ্মীর সমস্যাই তৈরি হতে দিতেন না। অথচ নেহেরুর ক্যাবিনেটের এক বিশ্বস্ত সহযোগী ছিলেন প্যাটেল এবং কাশ্মীর বিষয়ক সিদ্ধান্তে তাঁর কোনো 'নোট অফ ডিসেন্ট'-ও পাওয়া যায় না। তাঁর সঙ্গে নেহেরুর মতানৈক্য নিশ্চয় ছিল, কিন্তু তা ছিল নগণ্য। সম্প্রতি বল্লভভাই প্যাটেলের দানবাকার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের বল্লভপন্থী পরিচয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিজেপি, কিন্তু এই বল্লভভাই প্যাটেলই আরএসএস ও হিন্দু মহাসভাকে দেশের পক্ষে বিপদজ্জনক, সন্ত্রাসবাদী ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। অন্যদিকে, মার্ক্সীয় আদর্শে দীক্ষিত, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে চরমপন্থী ক্রান্তিকারী, ভগৎ সিং-কে 'অ্যাপ্রোপ্রিয়েট' করার চেষ্টাটি আরোই চমকপ্রদ, কারণ তিনি ছিলেন আপাদস্তক বামপন্থী।
এরকমই প্রাণন্তকর প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে নেতাজীর ক্ষেত্রেও। বিশেষত ২০২১ সালে দাঁড়িয়ে, বিজেপির নেতাজিকে আপন করে নেওয়ার চেষ্টা যে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ইলেকশন মাথায় রেখেই, তা বুঝতে বেগ পেতে হয় না। কংগ্রে-সবিরোধিতার ক্ষেত্রেও নেতাজি তুরুপের তাস, যেহেতু নেতাজি কংগ্রেস ত্যাগ করেছিলেন। এমনকি প্রচার করা হচ্ছে, হিন্দু মহাসভার বিনায়ক দামোদর সাভারকরই নাকি নেতাজিকে বলেছিলেন অক্ষশক্তির সঙ্গে আঁতাত গড়ে ইংরাজদের বিরুদ্ধে লড়তে৷ আরএসএস-এর সঙ্গে আবার ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা আজাদ হিন্দ ফৌজের তুলনা টানারও চেষ্টা চলছে৷ প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে যে নেতাজির জাতীয়বাদ ও সাভারকরের জাতীয়তাবাদ অনেকটা একই প্রকৃতির। এসব কি সঠিক তথ্য?
ইতিহাস কী বলে?
স্কুল-পাঠ্য ইতিহাসেও জানা যায়, নেতাজী জীবনের বেশির ভাগ সময়েই ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য হয়েছে। কংগ্রেস কমিটি যেখানে ভারতের অধিরাজ্য মর্যাদা বা ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের পক্ষে ছিল, সেখানে সুভাষচন্দ্রই প্রথম ভারতের পূর্ণ স্বরাজের পক্ষে সওয়াল করেন। জওহরলাল নেহরু সহ অন্যান্য যুবনেতারা তাঁকে সমর্থন করেন। শেষ পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের ঐতিহাসিক লাহোর অধিবেশনে কংগ্রেস দল পূর্ণ স্বরাজের অ্যাজেন্ডা গ্রহণে বাধ্য হয়।
সুভাষচন্দ্র এরপর পর পর দুবার কংগ্রেসের সভাপতিও নির্বাচিত হন। হরিপুরা কংগ্রেসের ভাষণে নেতাজি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে পূর্ণ স্বরাজের দাবিতে দেশজুড়ে ব্যাপক আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন।একদিকে দেশে শিল্পায়ন গড়ে তোলার পরিকল্পনা,অন্য দিকে জমিদারি প্রথা বিলোপের দাবি জানিয়ে শ্রমিক ও কৃষকদেরও কংগ্রেসের আন্দোলনে যুক্ত করার কথা বলেন তিনি। তাঁর চিন্তায় হয়ত সদ্য ঘটে যাওয়া রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ছাপ পড়েছিল।
কিন্তু কংগ্রেসের অতি-দক্ষিণপন্থী বুর্জোয়া নেতৃত্ব ভীত হয়ে নেতাজিকে কংগ্রেসের নেতৃত্ব থেকে হঠানোর তৎপর হন এবং পরের বছর ত্রিপুরী কংগ্রেসে নেতাজির কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়ানোর বিরোধিতা করেন৷ গান্ধীজির সমর্থন নিয়ে তাঁরা নেতাজির বিরুদ্ধে পট্টভি সীতারামাইয়াকে প্রার্থী করেন৷ তাসত্ত্বেও নেতাজি ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয়বার কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন৷ এরপরই মূলত মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে আদর্শগত সংঘাত এবং কংগ্রেসের বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ নীতির প্রকাশ্য সমালোচনার পর তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়। অহিংস পথে গান্ধির নেতৃত্বে কংগ্রেস ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু করে৷
সুভাষচন্দ্র ফরওয়ার্ড ব্লক নামে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রিটিশ শাসক তাঁকে এগারোবার কারারুদ্ধ করেছিল। তিনি সশস্ত্র সম্মুখ সমরের পথ অবলম্বন করার পক্ষপাতী ছিলেন৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পরেও তাঁর সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি; বরং ব্রিটিশদের দুর্বল সময়ের সদ্ব্যাবহার করে স্বাধীনতা অর্জন করা যাবে বলে তিনি ভাবেন । যুদ্ধের সূচনালগ্নেই তিনি লুকিয়ে ভারত ত্যাগ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মানি ও জাপান পাড়ি দ্যান তাদের সহযোগিতা লাভের উদ্দেশ্যে। জাপানিদের সহযোগিতায় তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ পুনর্গঠন করেন। এই বাহিনীর সৈনিকেরা ছিলেন মূলত ভারতীয় যুদ্ধবন্দি এবং ব্রিটিশ মালয়, সিঙ্গাপুর-সহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে কর্মরত মজুর।
নেতাজি দায়িত্ব গ্রহণ করার আগে এই ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি মূলত গড়ে উঠেছিল জাতীয়তাবাদী নেতা রাসবিহারী বসুর হাতে। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে রাসবিহারী বসু এই সেনাবাহিনীর দায়িত্ব সুভাষ চন্দ্র বসুকে হস্তান্তর করেন । একটি আলাদা নারী বাহিনী (রানি লক্ষ্মীবাঈ কমব্যাট)সহ এতে প্রায় ৮৫,০০০ (পঁচাশি হাজার) সৈন্য ছিল। এই বাহিনীর কর্তৃত্ব ছিল এক স্বাধীন সরকারের হাতে, যার নাম দেওয়া হয় "মুক্ত ভারতের সরকার" (আর্জি হুকুমত-এ-আজাদ হিন্দ)। এই সরকারের নিজস্ব মুদ্রা, আদালত ও আইন ছিল। অক্ষশক্তির ৯টি দেশ এই সরকারকে স্বীকৃতি দান করে। আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্বদান করে ব্রিটিশ মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে ইম্ফল ও ব্রহ্মদেশে নেতাজি যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
সুভাষচন্দ্র বসু আশা করেছিলেন, ব্রিটিশদের উপর আইএনএ-র হামলার খবর শুনে বিপুল সংখ্যক সৈন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে আইএনএ-তে যোগ দেবে। কিন্তু বাস্তবে তেমন ঘটল না। যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতির সঙ্গে সঙ্গে জাপান তার সৈন্যদের আইএনএ থেকে সরিয়ে নিতে থাকে। জাপান থেকে অর্থের সরবরাহ কমে যায়। অবশেষে, জাপানের আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে আইএনএ-ও আত্মসমর্পণ করে। মনে করা হয়, ১৯৪৫ সালের ১৮ অগস্ট তাইহোকুতে একটি বিমান দুর্ঘটনায় নেতজির মৃত্যু হয়। তবে এই তথাকথিত দুর্ঘটনা ও তাঁর মৃত্যুর বিরুদ্ধ-প্রমাণও আছে। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতো ঐতিহাসিকরাও মনে করেন বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়নি৷
গুমনামি বাবা
অন্তর্হিত নেতাজির সঙ্গে জনৈক গুমনামি বাবার সাদৃশ্যের গল্প অনেক প্রাচীন। হঠাৎ নতুন করে তা চাউর করা হচ্ছে সুপরিকল্পিত ভাবে। বাংলায় এই মর্মে সৃজিত মুখার্জি পরিচালিত একটি ছায়াছবিও নির্মিত হয়েছে। অথচ মুখার্জি কমিশনের মত অনুসারে গুমনামি বাবা বা ভগবানজি আদৌ নেতাজি নন। তিনি নিজেও কখনও তা দাবি করেননি। এই সাধুর জিনিষপত্র খানাতল্লাশি করেও এমন কিছুই পাওয়া যায়নি, যার কারণে তাঁকে নেতাজি বলে দাবি করা যায়। বসু পরিবারও তাঁকে নেতাজি বলে মানতে নারাজ। উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদের এই সাধু এমনই সুবিখ্যাত হয়েছিলেন যে অখিলেশ যাদব তাঁর নামে মিউজিয়ামও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নেতাজীর দৌহিত্রের পুত্র ও হাভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সুগত বসু স্বাভাবিক ভাবেই উক্ত ছায়াছবি নিয়ে আপত্তি তোলেন৷ নেতাজির আরেক দৌহিত্রের পুত্র চন্দ্র কুমার বসু বিজেপির নেতা হওয়া সত্ত্বেও এই ছবির বিরোধিতাই করেন সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে। ছবির আসল খুঁটি হল, দিল্লি-নিবাসী প্রাক্তন সাংবাদিক অনুজ ধর ও তাঁর সঙ্গী চন্দ্রচূড় ঘোষের ‘মিশন নেতাজি’ সংস্থার গবেষণা। তাঁদের দাবি, সে দিন আদৌ কোনও বিমান দুর্ঘটনাই হয়নি। না ঘটতেই পারে। তা বলে, গুমনামি বাবাকেই নেতাজি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সপক্ষেও কোনো প্রমাণ নেই।
এই গুমনামি বাবা ফৈজাবাদে ১৯৮৫ সালে মারা যান। তাঁকে ঘিরে এমন গুজব ছড়িয়েছিল যে সন্দেহ নিরসন করতে ২০১৩ এলাহাবাদ হাইকোর্টকে বিশেষ প্যানেল গঠন করতে হয়েছিল বাবার আসল পরিচয় খুঁজতে৷ তিনি যে নেতাজি ছিলেন না, সে ব্যাপারে প্যানেল নিশ্চিত হয়।
হঠাৎ করে বিগত বছরখানেক ধরে এই গুমনামি বাবা আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছেন। নতুন করে তাঁকে নিয়ে লেখালেখি, ছবি হচ্ছে৷ নেতাজিই গুমনামি বাবা, এই প্রচারে বিজেপি-আরএসএস-এর স্বার্থ কোথায়? এখানে আসল কথাটি বলে রাখা যাক। তথাকথিত এই গুমনামি বাবার জিনিষপত্রের মধ্যে আরএসএস-এর গোয়ালকরের একটি চিঠি পাওয়া গেছিল৷ সুতরাং নেতাজিকে গুমনামি বাবা প্রমাণ করতে পারলেই আরএসএস-এর সঙ্গে তাঁর যোগ প্রমাণ করা যায়৷
নেতাজির সমকালে আরএসএস-হিন্দু মহাসভা
এবার দেখা যাক নেতাজির সমকালে আরএসএস ও হিন্দু মহাসভার কার্যাবলী৷ আজকের বিজেপির বিবর্তিত হয়েছে তার পূর্বসরী হিন্দু মহাসভার আত্মা থেকে। অবশ্য, দুর্বল হিন্দু মহাসভাকে পুষ্টি দিয়েছে দিয়েছে কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িক মনস্ক গোষ্ঠী। তলায় তলায় ভাবাদর্শগত উস্কানি-দাতা হিসেবে আরএসএস তো ছিলই।
এম.এস গোলওয়ালকর আরএসএস সংগঠনের শাখায় শাখায় সেবকদের মধ্যে ব্রিটিশ-বিরোধিতা থেকে বিরত থাকার বাণী প্রচার করছিলেন। গোলওয়ালকর লিখেছিলেন ‘ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ এবং সাধারণ বিপদের তত্ত্বকে ভিত্তি করে আমাদের যে জাতিতত্ত্ব গঠিত হয়েছে সেটা কার্যত আমাদের হিন্দু জাতিতত্ত্বের সার্থক ও প্রেরণাদায়ক মর্মবস্তু থেকে বঞ্চিত করেছে এবং স্বাধীনতা আন্দোলনকে কার্যত ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে পর্যবসিত করেছে৷ ব্রিটিশ বিরোধিতার সাথে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদকে সমার্থক করা হয়েছে৷ এই প্রতিক্রিয়াশীল ধারণা সমগ্র স্বাধীনতা আন্দোলন, তার নেতৃবৃন্দ এবং সাধারণ মানুষের উপর সর্বনাশা প্রভাব ফেলেছে।' (উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড)৷ অর্থাৎ আরএসএসের দৃষ্টিতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা নয়, মুসলিম-বিরোধিতা ও হিন্দু-রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টাই ছিল জাতীয়তাবাদ৷ এই তত্ত্বের তীব্র বিরোধী ছিলেন নেতাজি৷ এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেছিলেন, ‘‘হিন্দুরা ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে হিন্দুরাজের ধ্বনি শোনা যায়৷ এগুলি সর্বৈব অলস চিন্তা৷ … শ্রমসিক্ত জনসাধারণ যে সব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন, সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি তার কোনওটির সমাধান করতে পারবে কি? কীভাবে বেকারত্ব, নিরক্ষরতা, দারিদ্র্য প্রভৃতি সমস্যার সমাধান হবে সে সম্বন্ধে তাহারা কোনও পথ নির্দেশ করিয়াছে কি?’’( স্পিচেস অফ নেতাজি)
সুভাষ ছিলেন মদনমোহন মালব্য প্রতিষ্ঠিত অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভারও তীব্র সমালোচক। সাভারকারেরও তীক্ষ্ম সমালোচনা তিনি করেছেন।
এই হিন্দু মহাসভা নেতাজির কর্মকালে কী করছিল? সাভারকর স্বয়ং যুদ্ধের সময় ব্রিটিশরাজ ও মিত্রশক্তির পক্ষে থাকতে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করছিলেন। তাহলে কী ভাবে এঁদের আর নেতাজির মতাদর্শ এক হওয়া সম্ভব? প্রকৃতপক্ষে, মুসলিম লিগ-হিন্দু মহাসভা-আরএসএস, এই সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি কেউই সরাসরি ব্রিটিশ বিরোধিতা করেনি৷ নিজের নিজের সম্প্রদায়ের সুবিধা আদায়ই তাদের লক্ষ্য ছিল৷
বিজেপির আইকন সাভারকর ব্রিটিশদের পূর্ণ সামরিক সহযোগিতা দেওয়ার কথা স্পষ্ট বলেছিলেন মাদুরাইতে হিন্দু মহাসভার ২২তম সেশনে ও ভাগলপুরে ২৩ তম সেশনে। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক শামসুল আলম 'সাভারকর সমগ্র' থেকে সাভারকরের উক্তি তুলে তুলে দেখিয়েছেন এই সত্য। ২২তম কংগ্রেসে সাভারকর বলছেন, নীতিবোধের কথা বাদ দিলেও, যেকোনো সুবিবেচকের উচিত ইংরেজদের সাহায্য করা, কারণ বিশ্বযুদ্ধে ইংরাজ মোটেও এমনভাবে পরাস্ত হবে না, যাতে তারা ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা প্রত্যর্পণ করে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। হিন্দুসভার কার্যনীতি তখনই স্থির হয়ে গেছিল৷ ২৩ তম কংগ্রেসে সাভারকর আবার বলেন-
'So far as India’s defence is concerned, Hindudom must ally unhesitatingly, in a spirit of responsive co-operation with the war effort of the Indian government in so far as it is consistent with the Hindu interests, by joining the Army, Navy and the Aerial forces in as large a number as possible and by securing an entry into all ordnance, ammunition and war craft factories…Again it must be noted that Japan’s entry into the war has exposed us directly and immediately to the attack by Britain’s enemies. Consequently, whether we like it or not, we shall have to defend our own hearth and home against the ravages of the war and this can only be done by intensifying the government’s war effort to defend India. Hindu Mahasabhaits must, therefore, rouse Hindus especially in the provinces of Bengal and Assam as effectively as possible to enter the military forces of all arms without losing a single minute.'
অর্থাৎ হিন্দুদের নিজ-স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য জাপানের বিরুদ্ধে ইংরাজদের সামরিক শক্তি বাড়াতে হবে। এ'ব্যাপারে অসম ও বাংলার হিন্দুদের উৎসাহিত করতে হবে৷
যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন নতুন নতুন সামরিক বাহিনী গঠনের প্রয়োজন পড়ল, তখনও সাভারকরের হিন্দু মহাসভাই হিন্দুদের সৈন্য হিসেবে নাম লেখানোর জন্য প্ররোচনা দিতে লাগল, যা নেতাজির কাজ ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। সাভারকর এই সময় সরাসরি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ভারতীয় সৈন্য নিয়োগের কর্মকাণ্ডের অংশ ছিলেন বলেও জানা যায়। এই সৈন্যবাহিনী পরবর্তীকালে নেতাজির আজাদ হিন্দ বাহিনীকে নির্মম ভাবে দমন করে। হিন্দু মহাসভার নেতৃত্বে একাধিক 'নিয়োগ কমিটি' গঠিত হয়। হিন্দুমহাসভার উদ্যোগেই 'কেন্দ্রীয় উত্তর-ভারতীয় হিন্দু মিলিটারাইজেশন বোর্ড' ও 'কেন্দ্রীয় দক্ষিণ-ভারতীয় হিন্দু মিলিটারিরাজেশন বোর্ড' গঠনের কথাও জানা যাচ্ছে, যারা হিন্দু সিপাহীদের নানাবিধ অভিযোগ শুনত৷ দুটি বোর্ডের মাথারাই ছিলেন হিন্দু মহাসভার নেতাবৃন্দ। এমনকী মুসলিম-লিগ, যারা ইংরাজদের সরাসরি বিরোধিতা কখনও করেনি, তারাও অন্তত এভাবে ইংরাজদের যুদ্ধে প্রত্যক্ষ সাহায্য করেনি।
সাভারকর যাদের হয়ে সুপারিশ করতেন, ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীতে তাদের চাকরি ছিল পাকা। এমনটাই বোঝা যায় তাঁর এক ধন্যবাদার্থক টেলিগ্রাম থেকে। কমান্ডর ইন চিফ ও ভারতের ভাইসরয়কে তিনি টেলিগ্রাম করছেন দুই পরিচিত ব্যক্তির নিয়োগের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে।
'YOUR EXCELLENCY’S ANNOUNCEMENT DEFENCE COMMITTEE WITH ITS PERSONNEL IS WELCOME. HINDUMAHASABHA VIEWS WITH SPECIAL SATISFACTION APPOINTMENT OF MESSERS KALIKAR AND JAMNADAS MEHTA.'
এই বাহিনীই পরবর্তীকালে নির্মমভাবে দমন করে আজাদ হিন্দ ফৌজকে। তাহলে সাভারকর মূলত নেতাজির স্বপ্নের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতাই করেন৷
নেতাজি ও শ্যামাপ্রসাদ
ফরোয়ার্ড ব্লকের সাপ্তাহিক কাগজে ৪ মে, ১৯৪০ সালে সুভাষ যা লিখছেন, তা এরকম -
‘That was a long time ago when prominent leaders of the congress could be members of the communal organisations like Hindu Mahasabha and Muslim League. But in recent times, the circumstances have changed. These communal organisations have become more communal than before. As a reaction to this, the Indian National Congress has put into its constitution a clause to the effect that no member of a communal organisation like Hindu Mahasabha and Muslim League can be a member of an elective committee of Congress.’
অর্থাৎ এককালে সাম্প্রয়ায়িক দলগুলির সদস্য হয়েও কংগ্রেসের সদস্য হওয়া যেত, কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে, এরা আরও সাম্প্রদায়িক হয়েছে, তাই কংগ্রেসের সংবিধান বদলেছে এবং এখন হিন্দু মহাসভা বা মুসলিম লিগের মতো সংগঠন করার সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেস করা যায় না৷ যতদিন নেতাজি কংগ্রেসে ছিলেন, ততদিন এ'বিষয়ে তাঁর সজাগ দৃষ্টি ছিল।
হিন্দু মহাসভায় যোগ দেওয়ার পর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি নিজের ডায়রিতে বলছেন, সুভাষচন্দ্র তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন। বলেছেন, বাংলায় হিন্দু মহাসভাকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করলে তিনি বাধা দেবেন।
“He ( Subhash Chandra Bose) would see to it, BY FORCE IF NEED BE, THAT IT WAS BROKEN BEFORE IT WAS REALLY BORN.”
কেন? কারণ তিনি মনে করতেন হিন্দু মহাসভার মতো সাম্প্রয়ায়িক শক্তির দ্বারা ভারতের কোনো মঙ্গল হতে পারে না৷ পরবর্তীকালে বলরাজ মাধক নামক হিন্দু মহাসভার আরেক নেতার বয়ানে জানা যাচ্ছে, ডঃ মুখার্জী কলকাতায় সভা আয়োজন করার চেষ্টা করলেই সুভাষচন্দ্র ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা নাকি বাধা দিচ্ছেন৷
এইসূত্রে নেতাজির সঙ্গে শ্যামাপ্রসাদের আদর্শগত সংঘাত নিয়েও দু'চার কথা বলা যাক। মোদীজিদের আরাধ্য পুরুষ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপ্যাধায় ছিলেন সামন্ততান্ত্রিক ও বর্ণবাদী রাজনীতির পোষক। কংগ্রেসের অপেক্ষাকৃত নরম সাম্প্রদায়িক নীতি তাঁকে তুষ্ট করতে পারেনি বলেই উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির স্বার্থে তিনি হিন্দু মহাসভায় যোগ দেন। তিনি দ্বিজাতি তত্ত্বে এতটা বিশ্বাসী ছিলেন যে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে যখন কাঙ্খিত দেশভাগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তখন উল্লসিত হয়ে বলেন – 'আজ হিন্দুদের মুক্তির দিন।'
অন্যদিকে নেতাজি সমস্ত ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে মিলন ও সৌহার্দের সম্পর্ক গভীরভাবে চাইতেন। হরিপুরা সম্মেলনের ভাষণকালে বলেন- “সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের বিশ্বাস, ধর্ম, সংস্কৃতির ব্যাপারে (স্বাধীন ভারতে) কোনরূপ হস্তক্ষেপ করা হবে না এবং বিভিন্ন ভাষা- গোষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চলের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা হবে।” ( নেতাজি দেশ ও জাতির সংহতি – নির্মল বসু)।
১২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৪ রেঙ্গুন আজাদ হিন্দ রেডিও থেকে নেতাজী বলেন – “বন্ধুগণ , আমরা এক ঐক্যবদ্ধ ও স্বাধীন ভারতের জন্য লড়াই করছি। সুতরাং, আমাদের দেশকে ভাগ করার এবং একে টুকরো টুকরো করার সর্বপ্রকার প্রচেষ্টার বিরোধিতা করব আমরা।’’( সিলেক্টেড স্পিচেস অফ সুভাষচন্দ্র বসু)। মোদী- যোগীরা এই ভাবনার সম্পূর্ণ বিপরীতে যাত্রা করছেন, অথচ বলছেন ২০২২ সালের মধ্যে নেতাজীর আদর্শ বাস্তবায়ন কথা!
চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাষচন্দ্র বসুরা অখন্ড বাঙলার মডেল দিয়েই অখন্ড ভারত গড়তে চেয়েছিলেন। এই মডেলের বাস্তব রুপ ছিল ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’(এপ্রিল – ১৯২৩)। এই প্যাক্টের মূলমন্ত্র ছিল হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ও সংখ্যানুপাতিক অধিকার। সংখ্যানুপাতে আইনসভা ও অন্যান্য প্রশাসনিক ক্ষেত্র এবং চাকুরিতে সংরক্ষণের সংবিধানিক অধিকার দেওয়ার কথা এখানে বলা হয়। কলকাতা কর্পোরেশন তার বড় বাস্তব দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে।কিছু গুরুপ্তপূর্ণ পদ ও চাকুরিতে মুসলিমদের সুযোগ দেওয়া হয় যার দরজা আগে প্রায় বন্ধই ছিল।
কিন্তু বর্ণবাদী হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসীদের একটা বড় অংশের মানসিকতা ছিল এর বিরুদ্ধে । দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন যখন ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’- কে স্বরাজ্য পার্টি এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটিতে পাশ করিয়ে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় বার্ষিক অধিবেশন ( কোকনাদ সম্মেলনে) পাশ করাতে প্রস্তাবাকারে উত্থাপন করেন তখন তাকে সাম্প্রদায়িক বর্ণবাদীরা রুখে দেয়। ভোটাভোটিতে ফল দাঁড়ায়: ৪৫৮- ৬৭৮। চিত্তরঞ্জন দাসের মৃত্যুর পরএই কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হাল ধরেন সুভাষচদ্রন্দ্র ও শরৎচন্দ্র ভ্রাতৃদ্বয়। কিন্তু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন , নেতাজি সুভাষচন্দ্র, শরৎচন্দ্র বসু, যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত, বীরেন্দ্র শাসমল, কিরণ শঙ্কর রায় প্রমুখদের অখন্ড বাংলা ও অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন ব্যর্থ করে দিয়ে দেশ ভাগের নেশায় বুঁদ থাকে একদিকে মুসলিম লিগ, অন্যদিকে হিন্দু মহাসভা ও তাদের অনুগামী কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী।
এই পর্বে বাংলাভাগ তথা দেশভাগে যিনি মূল নেতৃত্বে উঠে আসেন তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপ্যাধায় । তাঁর নেতৃত্বেই দেশভাগের দাবিতে প্রবলভাবে চিঠি- চাপাটি , স্মারকলিপি , প্রচারপত্র , জনসভা, প্রভৃতি শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত বাংলাভাগ তথা ভারতভাগে বিধানসভা পরিষদের সদস্যদের ভোটাভোটির ব্যবস্থা করা হয় এক অদ্ভুত নিয়মে। হিন্দু-মুসলমানদের উভয় সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নয় , কোন একটা ধর্ম সম্প্রদায়ের অধিকাংশ সদস্য যদি দেশ ভাগের পক্ষে রায় দেয় তবেই দেশভাগ কার্যকর করা হবে, এমন স্থির হয়। ফলে, হিন্দু- মুসলিম এর মিলিত মোট সদস্যের অধিকাংশ বাংলাভাগের( পক্ষান্তরে দেশ ভাগের ) বিপক্ষে রায় দেওয়া সত্ত্বেও দেশ ভাগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে যায় । ১৯৪৭ সালের ২০ জুন যে ভোট গ্রহণ করা হয় তাতে মোট সদস্যের (২২০) ১২৭ জন সদস্য দেশ ভাগের বিপক্ষে এবং ৯৩ জন সদস্য দেশ ভাগের পক্ষে রায় দিলেও দেশ ভাগের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়। কারণ ৭৯ জন হিন্দু সদস্যের মধ্যে ৫৮ জন দেশভাগের পক্ষে রায় দেন। অন্য দিকে ১৪১ জন মুসলিম সদস্যের মধ্যে ১০৬ জন দেশ ভাগের বিপক্ষে রায় দেন। এই রায়ের ভিত্তিতেই দেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যকে (বাংলা ও পাঞ্জাব) অথা গোটা দেশকে দ্বিখন্ডিত করা হয়।
ধর্মনিরপেক্ষ নেতাজি
বলা বাহুল্য, বিজেপির মূল বিরোধী যেহেতু নেহেরু পরিবার তথা কংগ্রেস, সুতরাং নেহেরু বনাম সুভাষ ন্যারেটিভটি তাদের প্রচারকার্যের জন্য উপযুক্ত। সুচারুভাবে নেহেরুর রাজ্যাভিষেক বনাম সুভাষের আত্মত্যাগের এক আখ্যান খাড়া করা হয়েছে৷ বিজেপি প্রচার করছে যে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেহরু ও গান্ধি পরিবারের কৃতিত্ব জাহির করতে গিয়ে নাকি সুভাষচন্দ্র বসুর অবদানকে খাটো করে এসেছে কংগ্রেস৷ নেহেরু কিন্তু আইএনএ/ আজাদ হিন্দ ফৌজ-এর বিচারকালে তাদের সপক্ষেই দাঁড়িয়েছিলেন, সওয়াল করেছিলেন। তবু তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া গেল, অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যে নয়। নেতাজির ফাইল ইত্যাদি জনসমক্ষে আনার প্রস্তাবও অতি সাধু। কিন্তু তার পিছনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। সুহাসিনী সায়গল (সিপিএম-এর পলিটবুরো মেম্বার ও আজাদ হিন্দ বাহিনীর লক্ষ্মী সায়গল-প্রেম সায়গলের কন্যা) নেতাজির ধর্মনিরপেক্ষ ভাবাদর্শে আলোকপাত করে তাই বারবার মনে করাচ্ছেন যে, নেতাজি কোনোমতেই 'বিজেপির লোক' নন৷
নেতাজি বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে জনগণ যখন একে অপরের সংগ্রামের সাথী (কমরেড ইন–আর্মস) হয়ে উঠবে, তখন সকলের জীবন একই লক্ষ্যে নতুন প্রেরণায় জাগ্রত হবে এবং এরই সঙ্গে গড়ে উঠবে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, উন্মোচিত হবে এক নতুন দিগন্ত, উন্মেষ ঘটবে এক নতুন দৃষ্টির৷ এই বিপ্লব যেদিন আসবে সেদিন ভারতীয় জনগণ এক পরিবর্তিত জনগণে পরিণত হবে৷ … দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতার ক্যানসার নির্মূল করা …বর্তমান অবস্থায় প্রায় অসম্ভব মনে হতে পারে৷ কিন্তু এই কাজই অনেক সহজ হয়ে যাবে যদি একটি বার আমরা সমগ্র জাতিকে জড়িয়ে বিপ্লবী মানসিকতার বিকাশ ঘটাতে পারি। '
তিনি বললেন, ‘গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়গত খণ্ড চিন্তা নয়, সমগ্র জাতিকে জড়িয়েই চিন্তা করতে ও অনুভব করতে আমাদের শিখতে হবে৷ সামাজিক ও আর্থিক ক্ষেত্রের যে সত্যটি সম্বন্ধে আমাদের নিরক্ষর দেশবাসীর চোখ আমাদেরই খুলে দিতে হবে, তা হল, ধর্ম, জাত ও ভাষার পার্থক্য থাকলেও আর্থিক সমস্যা ও অভিযোগগুলি আমাদের সকলেরই এক৷ … দারিদ্র ও বেকারি, অশিক্ষা ও রোগগ্রস্ততা, কর ও ঋণের বোঝা সব সমস্যাই হিন্দু ও মুসলমান সহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের জনগণকে একইভাবে আঘাত করে এবং এগুলির সমাধানও সর্বাগ্রে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের উপর নির্ভর করে৷’
সুভাষচন্দ্র স্বয়ং কংগ্রেসকে এই সেকুলারিজমের আদর্শে দীক্ষিত করতে চেয়েছিলেন৷ সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে গাঁধীজির যে নীতিগত ফারাক, ধর্ম সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি তার অন্যতম উপাদান। সুভাষ বলেছিলেন, ‘ধর্মকে রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণরূপে বাদ দেওয়া উচিত। ধর্ম ব্যক্তিবিশেষের বিষয় হওয়া উচিত, ব্যক্তি হিসাবে মানুষ যে ধর্ম পছন্দ করে তাহা অনুসরণ করার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকিবে। কিন্তু ধর্মীয় কিংবা অতীন্দ্রিয় বিষয়ের দ্বারা রাজনীতি পরিচালিত হওয়া উচিত নয়। ইহা পরিচালিত হওয়া উচিত শুধু অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক বিচারবুদ্ধির দ্বারা।’
স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দু মহাসভার ভূমিকায় অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে নেতাজি ঝাড়গ্রামের এক সভায় বলেছিলেন, 'সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের ত্রিশূল হাতে মহাসভা ভোটভিক্ষায় পাঠিয়েছেন। ত্রিশূল আর গেরুয়া বসন দেখলে হিন্দু মাত্রই শির নত করে । ধর্মের সুযোগ নিয়ে, ধর্মকে কলুষিত করে হিন্দু মহাসভা রাজনীতির ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে। এই বিশ্বাসঘাতকদের আপনারা রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে সরিয়ে দিন । তাদের কথা কেউ শুনবেন না । আমরা চাই দেশের স্বাধীনতা প্রেমী নর-নারী এক প্রাণ হয়ে দেশের সেবা করুক।'
নেতাজির অদম্য প্রয়াস সত্ত্বেও ভারত প্রকৃত অর্থে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারেনি, এ আমাদের দুর্ভাগ্য। নেতাজির মিশনকে সম্পূর্ণ করার মানে, বর্তমান লেখকের কাছে, একটি ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজবাদী আদর্শে দীক্ষিত গণতন্ত্র গড়ে তোলা, যে পথে মূল কাঁটা হল আরএসএস-বিজেপি প্রণীত অতিহিন্দুত্ববাদ। নেতাজিকে আরএসএস-বিজেপির ক্যাম্পেনিং-এর অংশ হতে দিতে বর্তমান লেখক তাই নারাজ। তার চেয়েও বড় কথা, যে বিজেপি আজ হিন্দু মহাসভার থেকেও বেশি উগ্রতার সঙ্গে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকেই হাতিয়ার করেছে, তাদের হাত থেকে থেকে নেতাজির ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করা কি কর্তব্য নয়?