মণিপুর আলোড়িত করে, বিচার চায়

সময় একটা অদ্ভুত বস্তু, যেন নিজেই একটা ব্যক্তি।  কোনো কোনো ক্ষেত্রে সময় যেন খুব দ্রুত "চলে" অর্থাৎ প্রেক্ষিত এবং পটপরিবর্তন খুব দ্রুত হয়, আর অনেক বেশি সারা জাগানো ঘটনা খুব বেশি করে পরিলক্ষিত হয়। এমন কি দৈনিক হারেই পট একেবারে বদলে দেয়, সেটা এমনকি অধুনার মধ্যেও হয়। এতটাই দ্রুত হতে পারে বা হয়ে থাকে যে দু দিন আগের ঘটনাই যেন ইতিহাস হয়ে পড়ে।  সেরকমই একটি ঘটনা মনিপুর। দুই কুকি মহিলাকে উলঙ্গ করিয়ে ফুটবলের মতো লাথি  মারতে মারতে প্রদর্শন করিয়ে গণধর্ষণ করানো হয়েছিল ৮০ দিন আগে।  আজ জানা গেলো যে এই পুরো পর্যায়টাতে অজস্র এরকম ঘটনা হয়েছে , সে নাকি প্রায় হাজার খানেক।  অতিশয়োক্তিটা আমার নয়। পাশের রাজ্যের [আসাম] অত্যন্ত ঘৃণিত মুখ্যমন্ত্রী [বিজেপির] নিজেই বলেছে। মনিপুরের কতিপয় বিজেপি নেতাও এখন আস্তে আস্তে সব ব্যক্ত করছে। তারা এসব বলছে বর্তমানের সবচেয়ে সাড়া জাগানো (ভাইরাল হওয়া) বিষয়ের অভিঘাতকে লঘু করবার জন্যে। উত্তর পূর্বাঞ্চলে যতবারই বিজেপি এসেছে ততবারই দলিত বা ট্রাইবাল মহিলাদের বিজেপির কর্মীবাহিনী এই ভাবে নিপীড়ন করেছে।  আদিবাসী মহিলাদের উলঙ্গ করে হাঁটিয়ে ধর্ষণ করা তো আসামে প্রবাদপ্রতিম। অথচ আজ পর্যন্ত বিচার তো দূরে থাক কোনো ধরনের শাস্তিই হয় নি কারো বরং মালা দিয়ে অভিনন্দন জানানো হয়েছে কাউকে কাউকে। উত্তর প্রদেশ এবং অন্যান্য বিজেপি শাসিত রাজ্যে এগুলো সবই এখন অতি স্বাভাবিক ঘটনা।  মনুবাদী ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র এবং হিন্দুত্ববাদ এই ধর্ষণ করাকে পুরুষের অধিকার বলে মনে করে।  এই জাতিবিরোধ এখন তার স্বাভাবিক পরিণতির ভয়ঙ্কর মাত্রা ছুঁয়েছে, কোথায় যাবে শেষাবধি জানে কেডা।

 কী পদ্ধতিতে এই বিষয় টা  ভারতের প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ালো যা পৃথিবীতে সবচেয়ে ঘৃণিত ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হলো ? ঘটনার ক্রমকে একটু বোঝা যাক।

   ১) সরকারি "আইনরক্ষক" কুল, "অপর" জাতির মহিলাদের ঘর থেকে তুলে এনে পুরীষ সংস্কৃতির ধর্ষক পুরুষদের হাতে তুলে দিচ্ছে গণধর্ষণের জন্যে। এটি মনুষ্যসভ্যতায় অনন্য না হলেও অবশ্যই বিরল। 

   ২) প্রযুক্তির সাহায্যে সমস্ত খবরাখবর এবং মানুষ যাতায়াতের পথ বন্ধ করে, "সংবাদ মাধ্যম ও সংবাদ" কে "ছড়ানো" বন্ধ করে দীর্ঘসময় একটি অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে খবর বা সংবাদের গুরুত্ব কে প্রাক্তন বানিয়ে তার অভিঘাত কে একেবারে শূন্যে নিয়ে আনার ব্যবস্থা করার প্রশাসনিক পদ্ধতি সরকার যুদ্ধের একটা হাতিয়ার বানিয়ে মানুষকে সার্বজনীন ,সামুহিক নিপীড়ন করা, এটি করতে অস্ত্র লাগে না।  "গণতান্ত্রিক - প্রশাসনিক" কায়দাতেই এই যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া যায়। 

    ৩) জাতিদাঙ্গার মাধ্যমে "গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা্র ক্ষমতাকে" লঘু করে দেওয়া যায়, হাজারো ধরনের বিভাজন তৈরী করে।  আইনসভাগুলোকে কেটে কুটে ছেঁটে দিয়ে তাদের যৌথ ক্ষমতাকে অকেজো বানিয়ে কয়েকটি বিশেষ রাজ্যের ক্ষমতা বাড়িয়ে সেই সব রাজ্যের ক্ষমতাকে বর্ধিত করে দেশের ক্ষমতা তে সেই সব রাজ্য কে প্রায়  নিরংকুশতার দিকে নিয়ে যাওয়া।  যেমন উত্তরপ্রদেশ এবং গুজরাত এর তুলনামূলক আপেক্ষিক ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেশের অন্যান্য রাজ্যের কার্যকরী ক্ষমতাকে কমজোরি করে রাখা। 

    ৪) বিভিন্ন ধরনের গোষ্ঠীতে ভাগ করে জনগণকে কোনো না কোনো "পরিচিতি" চাপিয়ে স্বাভাবিক জনঐক্য কে ভেঙে দিয়ে এক রাজ্য র বাইরের [এই ক্ষেত্রে উত্তরপ্রদেশ এবং গুজরাত] এর উপনিবেশ বানিয়ে রাখা - একেবারে ঔপনিবেশিক বহিরাগত শক্তি যেমন ভাবে দেশ শাসন করতো। 

    ৫) ইসু বা বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতাকে সময়ের দীর্ঘসূত্রিতার যাঁতাকলে ফেলে অন্য ইসু গুলোকে সময়ের মানদন্ডে সামনে নিয়ে এসে প্রধান ইসু কে ঢেকে দিয়ে অপ্রধান ইস্যুগুলোকে প্রকট বা প্রভাসিত করে সেই গুলোর সাহায্যে মানুষের বিচারক্ষমতাকে বেপথু করে দেওয়া। 

ফ্যাসিবাদ অনেক বেশি সুচতুর এবং সপ্রতিভ হয়ে উঠেছে এই সব প্রশাসনিক প্রকরণগুলোর সাহায্যে। বাধ সেধেছে  সামাজিক মাধ্যমের গণতান্ত্রিকতা । এই একটা পদ্ধতি বা প্রকরণ কে একচ্ছত্র শাসকরা ঠিক এখনো করায়ত্ত করে উঠতে পারে নি, আর তারই ফাঁকফোঁকর দিয়ে গণউদ্যোগের ক্ষমতায়ন হয়ে চলেছে। এই একটি বিষয়ই মানুষকে অনেকটা গণঐক্য তৈরী করতে সাহায্য করছে।

অনেক বিভিন্ন কপটতা শাসক নিয়ে আসছে।  কান্নার নাটক একটা প্রধান প্রক্রিয়া। মহিলাইস্যু খুব স্পর্শকাতর বিষয়। দুর্ভাগ্য ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, হেনস্থাকে ঢাকবার জন্যই, কিছু বিশিষ্ট ভাড়া করা কাঁদুনে বা রুদালি মহিলা বাহিনী তৈরী করা হয়েছে। কেন্দ্রের এক "মন্ত্রী" [তার অন্য পরিচয়টি আর এখানে বলা গেলো না] আর এই রাজ্যের এক মহিলাকে নামিয়ে তাঁরা মণিপুরী মহিলাদের সমবেত কান্নাকে ঢেকে দিতে উদ্যোগী হয়েছে।  মূলত অভিনেত্রী মহিলাদের এই "উদ্যোগে" নামিয়ে এক শিল্প রূপ বা আর্ট ফর্ম বানাচ্ছে।  অপ্রাসঙ্গিক , অপ্রধান, অবান্তর কিছু বিষয় নিয়ে তাকে কান্নার রূপ চাপিয়ে এই ফর্ম নামানো হচ্ছে , কিছু ব্রাত্য কুশলতার জনত্যাজ্য অভিনেতাকে রাজনৈতিক আঙিনায় পুনর্বাসন দেওয়ায় কিছু রুদালিকে নতুন "উদ্যোগে" [ইন্ডাস্ট্রি] বসিয়ে দেওয়া গেলো।  এক ধরণের নয়া কর্মউদ্যোগ এর প্রজনন বলা যেতে পারে।

রাজনীতিতে সময় যেমন একটা বড়ো  নির্ধারক, তেমনি সেই সময়ে প্রধান/অপ্রধান শ্রেণীকরণ বা বিভাগকরণ বা বর্গায়ন  বোধহয় সবচেয়ে জরুরি। অপ্রধান বিষয়ের ভিড় বা ইসু দিয়ে প্রধান বিষয়কে অপ্রধান বানানো এক গণশত্রু প্রশাসনের বহু পুরোনো কায়দা।  এক চৈনিক বিপ্লবতাপস  আমাদের শিখিয়েছিলেন। প্রতিটি ইস্যুই গুরুত্বপূর্ণ , কিন্তু সমান মাত্রায় বা পরিমাণে বা সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়।  প্রধান বিষয়টিকে প্রয়োজন মতো পরিচালনা করার মধ্যে দিয়েই অপ্রধানগুলো সমাধান হয় বা সমাধানের পথে এগিয়ে যায়. আর্থিক দুর্নীতি বা রাজনৈতিক সন্ত্রাস যতই পীড়াদায়ক এবং ব্যক্তি বিশেষের ওপর বেদনাদায়ক হোক না কেন সভ্যতা বা সম্মিলিত সংস্কৃতিতে বিপর্যয় নিয়ে আসা এবং সামূহিক গোষ্ঠী-বিভাজন অনেক বেশি দূরপ্রসারী বিপর্যয়। মণিপুরে যা করানো হলো তাতে মধ্য ভারতের "হিন্দুত্ববাদ" মনে করেছিল চালাকি করে জয় হাসিল করবে।  কিন্তু পরিধির সুঠাম ঐক্যই ভারতকে টিঁকিয়ে রেখেছিলো এতদিন।  ভাঙ্গনটা পরিধিতে এলে কেন্দ্র ভেঙে পরে। ঠিক এই কারনেই  কোনো পরিধির রাজ্য আর কেন্দ্রকের আধিপত্য বা দাদাগিরিকে মানতে পারলো না।  এই অপারগতার দিকেই পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা , বলেছেন এই পথে এগোলো ভারত রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখা যাবে না।  ইউরোপিও ইউনিয়ন  মনিপুর নিয়ে ভারত রাষ্ট্র কে সাবধান করেছে।  এমনকি বিশ্বপুঁজির বিকাশেরও অন্তরায় এই শতধা বিভাজন। ঠিক এই অর্থেই বিরোধী ঐক্যের মঞ্চের মধ্যে "inclusive" শব্দটি যথার্থ ভাবেই নিজের স্থান করে নিয়েছে।  একটি ছোট্ট তাত্বিক লব্জ এক বিরাট সম্ভাবনার দরজা খুলে দিলো, রাজনৈতিক পালাবদলের শর্ত তৈরী করলো।  মানুষও তার মর্মটি বুঝে উৎসাহী হলো [সামাজিক মাধ্যমের আলোচনাগুলো থেকে মাপা গেলো] , তত্ব ঠিক এই ভাবেই potent force  হয়ে ওঠে মানুষের সহযোগিতায়।  কি অমোঘ শিক্ষা শিকিয়েছিলেন সেই দুশো বছর আগে এক দাড়িবাবা!   

আরো একটা বিড়ম্বনায় পড়েছে শাসক।  যে জাতিকে মণিপুরে উস্কে দিয়ে ["হিন্দু" বলে চালিয়ে] খৃষ্টানদের ওপর নিপীড়ন করেছিল সরকার আর খৃষ্ঠান কুকি ও নাগাদের পৃথক রাজ্যের গাজর ঝুলিয়ে প্রলুব্ধ করেছিল সেই কুকি , নাগা এবং "হিন্দু" [সদ্য আবিষ্কৃত ] মেইতেই রা সবাই আলাদা আলাদা করে [নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা সত্ত্বেও] বিজেপি বিরোধী হয়ে উঠলো।  এ যেন ঘরোয়া কোন্দলে তৃতীয় পক্ষ সামলাতে এলেই দু পক্ষই তৃতীয় পক্ষ কে তাড়া  করছে।  আমরা এক শিক্ষা পেলাম।  বিভাজন দিয়ে বেশিদিন  ঔপনিবেশিক [এ ক্ষেত্রে নয়া ঔপনিবেশিক] ক্ষমতাকে টিঁকিয়ে রাখা যায় না, মানুষ তার স্বাভাবিক উৎপাদন প্রক্রিয়াজনিত চাপেই ঐক্যবদ্ধ হবেই।  উৎপাদন প্রক্রিয়া আর যাপনক্রিয়া সমস্ত ছোট খাটো বিভাজনের প্রাচীর কে ভেঙে সমস্ত "পরিচিতি" বিভাজনের সাময়িক ফারাক কে অতিক্রম করে উৎপাদক শক্তিকে এক করবেই।  

মণিপুরের গণধর্ষণ আর নারীনির্যাতন এবং জাতিদাঙ্গাতে শাসক যতটা উৎফুল্লিত হয়েছিল তা খান খান হয়ে গেলো। এবার কিছু হাস্যকর নৌটঙ্কি দিয়ে সামনের আসন্ন ঢেউ কে আটকানোর ক্লীব প্রচেষ্টা করে চলেছে শাসক। কিন্তু  অন্য নানা ইসু দিয়ে প্রধান বিষয়কে ঢাকা দেওয়ার যে চেষ্টাই হোক না কেন - এই মুহূর্তে প্রধান বিষয়টি হল পীড়িত মণিপুর।