তথ্যচিত্রের ইতিহাস : সত্তরের দশক

সত্যজিৎ রায়ের ‘Inner Eye'(1972) ছবির শেষ কয়েক মিনিট, তথ্যচিত্রে অনবদ্য সঙ্গীত প্রয়োগের এক অনন্য উদাহরণ। এ ছবির শেষ দৃশ্যে দেখা যায়,  চিত্রকর বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায় দৃষ্টিহীন অবস্থায় ছবি এঁকে চলেছেন, নেপথ্যে সেতারের ‘জোড়’ বাজছে। নিখিল ব্যানার্জির বিলাসখানি রাগের ‘জোড়’ অংশের সঙ্গে বিনোদ বাবুর ছবি আঁকার অংশে আর কোনও ধারাভাষ্য ব্যবহৃত হয়নি। সেতারের মূর্চ্ছনায় খন্ড খন্ড ভিস্যুয়াল মিশে অপূর্ব ব্যঞ্জনা তৈরি করেছে। সত্যজিৎ রায় তথ্যচিত্রে সঙ্গীত ব্যবহার করে যে সুরুচি ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তাতে সন্দেহ নেই। তাঁর ‘বালা’ (Bala-1976) তথ্যচিত্রেও ভরতনাট্যম শিল্পী বালা সরস্বতী স্বকণ্ঠে গান গেয়ে ভরতনাট্যমের বর্ণম অংশটি নৃত্য ভঙ্গিমায় প্রদর্শন করছেন। এর কিছু দিন আগের তৈরি তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ’(1961) তথ্যচিত্রে সঙ্গীতের অসাধারণ প্রয়োগ লক্ষ করা গেছে। এই ছবিতে সঙ্গীতের দায়িত্ব নিয়েছিলেন বিখ্যাত গীতিকার জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র। রবীন্দ্রনাথের শৈশব থেকে জীবনের সমাপ্তি পর্যন্ত সমগ্র কবি ব্যক্তিত্বটি ছবির সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। কোন ভিস্যুয়ালে কোন ধরনের সঙ্গীতানুষঙ্গ ও আবহসঙ্গীত অপরিহার্য তা বোঝার জন্য ছবিটি একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আবার এই সময় ভারতের প্রথম সারির একাধিক সঙ্গীত শিল্পীকে নিয়ে তথ্যচিত্রের ঢঙে অনেক গুলি ছবি তৈরি করা হয়। দিল্লি দূরদর্শনের প্রযোজনায় ‘সাধনা’ সিরিজে সেগুলো দেখানও হয়। পরিচালক  ঋত্বিক ঘটক ‘আমার লেনিন’(1970) ছবিতে সঙ্গীতকে সুনিপুণ ভাবে ব্যবহার করেন। এই ছবিতে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র সঙ্গীত পরিচালনা করেন। সঙ্গীতের প্রয়োগ সাধারনত দুইভাবে হয়ে থাকে- ভাবব্যঞ্জক সঙ্গীত ও অভিব্যাক্তি মূলক সঙ্গীত। তথ্যচিত্রে কীভাবে, কোন ধরনের সঙ্গীত ব্যবহার করা হবে তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে পরিচালকের দক্ষতা ও রুচির ওপর। রুচিমান দক্ষ পরিচালক পারেন সঠিক ভাবে শব্দ এবং সঙ্গীতকে ব্যবহার করে তথ্যচিত্রের মান উন্নত করতে। তবে তথ্যচিত্রে সঙ্গীতের অনবদ্য প্রয়োগই সত্তরের  দশকের তথ্যচিত্রের  একমাত্র  বৈশিষ্ট্য নয়, সত্তরের দশকে ভারতীয় তথ্যচিত্রের গতিপথের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য।  ষাটের দশকের শেষ দিক থেকেই তথ্যচিত্রের নির্মাণ -কৌশল ও বিষয় বস্তুর পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। বেশ কিছু পরিচালক ফিল্ম ডিভিশনের ছকের বাইরে বেরিয়ে এসে ছবি তৈরি করার সাহস দেখান। তথ্যচিত্রের মূল বিষয় বস্তু হয়ে ওঠে গণ আন্দোলন, সাধারণ মানুষের দুঃখ, দুর্দশা, দেশের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এই সময়ে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত দূরদর্শন ব্যবস্থা তথ্যচিত্র প্রদর্শনে বিশেষ ভুমিকা গ্রহণ করে। এই সত্তরের দশকেই ভারত ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিরতায় উত্তাল হয়ে ওঠে। স্বাভাবিক ভাবেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তথ্যচিত্র নির্মানের প্রবণতা বেড়ে যায়। জরুরি অবস্থা জারি হলে তথ্যচিত্র নির্মাণ ও তথ্যচিত্র প্রদর্শনের উপরেও তার প্রভাব পড়ে।
ষাটের দশকে দূরদর্শন ভারতে এলেও কলকাতায় আসে সত্তরের দশকে। যে কোনো রকম অনুষ্ঠান দর্শকের অন্দরমহলে পৌঁছে দিতে   সক্ষম  বলে এর জনপ্রিয়তা ছিল প্রথম থেকে বেশি। দূরদর্শনের এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়েছে বিশ্বের বেশির ভাগ রাষ্ট্র। আমেরিকা, ইউরোপ, রাশিয়া, কানাডায় দূরদর্শনের জন্য আলাদা করে তথ্যচিত্র তৈরিও হতে থাকে, যা নিয়মিত ভাবে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে দেখান হয়। সেখানে সুচিন্তিত পরিকল্পনায় জনগনের মানসিক চাহিদা মেটানোর চেষ্টা চলে। 1959 সালে ভারতে দূরদর্শনের সম্প্রচার শুরু হলেও তা নিয়মিত ছিল না। 1965 সালের 15ই আগস্ট  থেকে নিয়মিত সম্প্রচার করা সম্ভব হলেও পশ্চিমবঙ্গে আসতে সময় লাগে আরও দশ বছর। 1975 সালের 9ই আগস্ট থেকে কলকাতা দূরদর্শনের সম্প্রচার শুরু হয়। সুতরাং ষাটের দশকের শেষ এবং সত্তরের দশকে  তথ্যচিত্র প্রদর্শনে দূরদর্শনের একটা বড় ভূমিকা ছিল। যেহেতু দূরদর্শন সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত, সেহেতু সেখানে কোন ছবি দেখান হবে তাও নিয়ন্ত্রণ করত রাষ্ট্র। ফিল্ম ডিভিশনের ছকের বাইরে এসে যাঁরা ছবি করেছিলেন তাঁদেরকেও রাষ্ট্রীয় রোষের মুখে পড়তে হয়েছে। তাঁদেরকে হয় ছবি মুক্তির ছাড়পত্র দেওয়া হয় নি, না হয় ছাড়পত্র দিয়েও প্রদর্শনে বাধা দেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ভারতীয় ফিল্ম ডিভিশন সেগুলো সংরক্ষণের দায়িত্বও নেয় নি। সে কারণে ভালো ছবি নির্মাণ করলেও তা সাধারণ দর্শকের কাছে পৌঁছে দেওয়া সহজ ছিল না।আগের দশকে রবার্ট রোসোলিনি ‘India 59’ নামে  তথ্যচিত্র তৈরি করেন। ছবিতে ভারতের শ্রেণীভিত্তিক সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোয় লালিত পুঁজিবাদী সমাজের চেহারা তুলে ধরেন। এই ছবি সরকারি আমলাদের রক্তচক্ষু ছাড়া আর কিছুই উপহার পায় নি। ষাটের দশকের শেষ দিকে কে. এস. চারি  পরিচালিত ‘Face to Face’( 1967) ছবিতে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার  প্রকৃত চেহারা, সাধারণ দরিদ্র ভারতবাসীকে  গণতান্ত্রিক কাঠামো কি উপহার দিচ্ছে তার বাস্তব চেহারা দেখান হয়েছে। ছবিটিও  প্রদর্শনে বাধা পায়। ফেস টু ফেস’ এর শেষ দৃশ্যে বলতে বাধ্য করা হয়-
 “এই ছবি সবাই দেখতে পাচ্ছেন এতেই প্রমাণিত হয় ভারতে গণতন্ত্র সচল আর সজীব”
-অর্থাৎ সমস্ত ছবিতে যে বক্তব্য বলা হয়েছে তাকেই কার্যত বিরোধিতা করা হয় শেষ দৃশ্যে। এমনই করুন পরিনতি হয়েছিল ছবিটির। স্বাধীনতার কুড়ি বছর পর 1967 সালে এস এন এস শাস্ত্রী ‘I am 20‘ নামে একটি ছবি করেন। যারা স্বাধীনতার বছরে জন্মিয়েছিল তারা আশাহত হয়েছে, তাদের জীবনে স্বাধীনতার মূল্য কতটা -এই বিষয় বস্তু নিয়ে ছবিটি সাহসিকতার সঙ্গে তৈরি করেছিলেন। ঐ বছর জাতীয় পুরস্কার পায় ছবিটি। তবু এই ছবিটি  দূরদর্শনে সম্প্রচার করা হয় না। আটের দশকের দুটি পুরস্কার প্রাপ্ত তথ্যচিত্র ‘বোম্বে আওয়ার সিটি’ ও ‘ভূপাল : বিয়ন্ড জেনোসাইড’ আদলতে মামলা করে দূরদর্শনে প্রদর্শনের জন্য। আপিল গিয়ে পৌঁছায় সুপ্রিম কোর্টে। আদালতের আদেশে ছবি দুটি সম্পচার করতে বাধ্য হয় দূরদর্শন।
  এ প্রসঙ্গে পরিচালক শুকদেবের ‘India 67’ নামের ছবিটি উল্লেখযোগ্য। ছবিটিকে প্রথমে সরকারি আমলারা ছাড়পত্র দেয়নি। কিন্তু  এই সময় পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত সামন্ততন্ত্রের শক্তির সঙ্গে উঠতি পুঁজিবাদের   দ্বন্দ্বে পুঁজিবাদের হাতিয়ার হয়েছিল ভারতের সাধারণ মানুষ। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে সামনে রেখে ভারতীয় পুঁজিবাদীরা সামন্ত প্রভূদের বিরুদ্ধে একজোট হতে চেয়েছিল। সেই সমস্যা সঙ্কুল পরিস্থিতিতে শ্রীমতী গান্ধী ছবিটি দেখেন এবং ছাড়পত্র দেন। ছবিটি ছাড়পত্র পেলেও সাধারণ দর্শকের কাছে পৌঁছাতে পারে নি। বাধা পেয়েছে ঋত্বিক ঘটকের আমার লেনিন(1970), সত্যজিৎ রায়ের সিকিম, মৃণাল সেন এর  মনিপুর নিয়ে তথ্যচিত্রও। 
 ষাটের দশকের শেষ থেকেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা আসে। 1969এর গণ অভ্যুত্থান পেরিয়ে 1971এ শুরু হয় স্বাধীনতার যুদ্ধ। 1971 সালের 25শে মার্চ রাতে বাঙালি জাতির উপর আকস্মিক ভাবে শুরু হয় বাঙালির ওপর নজিরবিহীন বর্বরতা, নিষ্ঠুর গণহত্যা। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা   স্বাধিনতার দাবি তুললে, তা চির তরে নির্মূল করতে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী  দীর্ঘ আট মাস দু সপ্তাহ ও তিন দিন ধরে(26শে মার্চ থেকে 16ই ডিসেম্বর) প্রায় ত্রিশ লক্ষ বাঙালিকে নির্মম ভাবে হত্যা করে এবং অসংখ্য  বাঙালি মহিলাকে পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণ করে। সে দেশের বাঙালি জাতিকে চরম দুর্দশা, আর নৃশংস অত্যাচারের মুখে পড়তে হয়। বাঙালির এই দূরাবস্থাকে ক্যামেরা বন্দি করে রাখার কথা ভেবেছিলেন অনেকেই। বাংলাদেশের সংস্কৃতি এই সময় অভাব বোধ করছিল রসোলিনির মতো বিপ্লবী চলচ্চিত্রকারের। তবে রসোলিনি না হলেও অন্য একজন পরিচালক মুক্তিযুদ্ধের উপর তথ্যচিত্র তৈরি করতে সক্ষম হলেন। পরিচালক জহির রায়হান কিউবার কিছু বিপ্লবী রাজনৈতিক ডকুমেন্টারি এবং আদ্রে ভাইদার এর ‘Ashes and Diamond’ দেখেন কলকাতায় অবস্থানকালীন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থন শক্তি ভারতীয় বন্ধুদের আর্থিক সহায়তায় নির্মিত হয় একটি কালজয়ী তথ্যচিত্র, ‘Stop Genocide'(1971)। বাংলাদেশের বিপ্লবে হানাদার পাক বাহিনীর নৃশংস গণহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক নির্লজ্জ কাহিনীর প্রামাণ্য দলিল হয় উঠল এই তথ্যচিত্রটি। আর্থিক সমস্যা, অপর্যাপ্ত সরঞ্জাম নিয়ে, যুদ্ধের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে ছবি তুলে দক্ষ সম্পাদনায় ছবিটি তৈরি করা সম্ভব হল। এই ছবির বরাত ছিল অন্য রকম।  ভারতের তৎকালীন  প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ছবি দেখে প্রশংসা করেন এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করতে ভারতীয় চলচ্চিত্র বিভাগকে নির্দেশ দেন। বাংলাদেশের সরকার 1971এর যুদ্ধকালীন অবস্থায় আরও তিনটি ছবি তৈরি করার নির্দেশ দেয় পরিচালক জহির রায়হানকে। তিনি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি তৈরি করতে সক্ষম হন।  এক একটি ছবি ছিল কম বেশি উনিশ মিনিটের। ছবি তিনটি হল-
1)‘Liberation fighters'
2)‘Innocents Millions’
3)State is Born'।
 এই ছবিগুলির একটি জাহির রায়হান নিজে পরিচালনা  করেন, অন্য দুটি ছবি অন্য পরিচালকের ওপর দায়িত্ব দেন। প্রথম ছবিটি পরিচালনা করেন আলমগীর কবির। দ্বিতীয় ছবিটি বাবুল চৌধুরী পরিচালিত। তৃতীয়টি জাহির রায়হান নিজের পরিচালিত ছবি ‘A State is Born'। এই স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি গুলির নান্দনিক ও শৈল্পিক গুণাগুণ কম থাকলেও বিশ্বস্ত ভাবে চিত্রায়িত বিষয়বস্তুর বস্তুনিষ্ঠতায় প্রতিটি ছবিই ঐতিহাসিক মূল্যে দুর্লভ। 1975 সালে বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। পরবর্তী সরকার নিজেদের প্রচারের কাজে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা বিভাগকে সম্পূর্ণ রূপে  নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। ফলে সেখানকার চলচ্চিত্রের মানও কমতে থাকে। 
 ভারতীয়  তথ্যচিত্রে নবজাগরণের পথিকৃত, রাজনৈতিক তথ্যচিত্রকার আনন্দ পট্টবর্ধন ভারতে জরুরি অবস্থা চলাকালীন বেশ কয়েকটি ছবি করে তথ্যচিত্রের জগতে বিপ্লব আনেন। এই সময় শুধু আনন্দ পট্টবর্ধন নন, সমসাময়িক অধিকাংশ পরিচালক তথ্যচিত্রকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। তবে শুধুই রাজনৈতিক হাতিয়ার নয়, সমাজের উন্নতি কল্পে, কুসংস্কার আচ্ছন্ন সমাজ দূর করতে একে বিপ্লবাত্মক কাজেও ব্যবহার করেন।  তাঁর সবচেয়ে বিতর্কিত, উল্লেখযোগ্য তথ্যচিত্র হল ‘waves of Revolution’(ক্রান্তি কি তরঙ্গ)। ছবিটিতে 1974 সালের মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিহারের অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে তুলে ধরা হয়েছে। এই ছবিটিকে স্বয়ং পরিচালক ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ ছবি বলে অভিহিত করেছেন। বিহারের জয় প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে সর্বাত্মক বিপ্লবের কর্মসূচিকে ঘিরে ছবিটি তৈরি করেন। সেখানে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে ছবি তোলা হয়। গোপনে রেকর্ড করা  ভিখারি, রিক্সা চালক, পুলিশ সহ সাধারণ মানুষের সাক্ষাত্কারের ছবি দেখানো হয়েছে। ছবিটি ‘এইট মি মি’ ও ‘সুপার এইট’ ক্যামেরায় তোলা হিন্দী ডকুমেন্টারি। জরুরী অবস্থা চলাকালীন ছবিটি নির্বাসিত ছবি হিসেবে পরিগণিত হয়। 
1975 সালের 25শে জুন ভারতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হলে এই ছবির প্রদর্শন বন্ধ হয়ে যায়।পরিচালক আনন্দ পট্টবর্ধন বলেছেন-
 “এই ছবির প্রদর্শন খুব গোপনে করতে হত। আমাদের পরিচিত বন্ধু  ছাড়া অচেনা কাউকে অনুমতি দেওয়া হত না। কারণ যে কোনও  মুহূর্তে ছবি প্রদর্শনের সময় বিপদের সম্ভাবনা ছিল। ব্যাপারটা  এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে সরকারের কোনো পদস্থ কর্মচারীর দৃষ্টি গোচর হলেই এই ছবিকে তারা ক্ষমতাবলে বাজেয়াপ্ত করতেন এবং ছবি দেখতে উপস্থিত প্রত্যেককে জেলে ভরতেন।“-
ভারতে এই ছবির প্রদর্শনের নিষেধাজ্ঞা জারি হলে একটি প্রিন্ট বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।  আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়ার পর গোপনে ছবির দ্বিতীয়  প্রিন্ট করিয়ে  পরিচালক তাঁর বন্ধুর লাগেজে পুরে আলাদা আলাদা করে বিদেশে পাচার করেন। ছবিটি ইংরাজি ভাষায় অনুবাদ করার সামর্থ না থাকায় একটি ভিডিও কপিতে হিন্দির উপর ইংরেজি সংলাপ চাপিয়ে প্যারাডাব করা হয়। এভাবেই ছবিটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। পরে একদল সাংবাদিকদের সহযোগিতায় ভারতের আঞ্চলিক দূরদর্শনে দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। প্রতিটি প্রদর্শনের জন্য 500টাকা করে সম্মানিক পান পরিচালক। জরুরি অবস্থা কেটে গেলেও পরবর্তী সরকার এই ছবির শেষ অংশের কথাগুলি কেটে বাদ দিতে বলে। পরিচালক রাজি না হওয়ায় ফিল্ম পাবলিসিটি বিভাগের ডিরেক্টর ছবিটি কিনতে অস্বীকার করে। অবহেলিত ছবিটির এই করুন পরিনতি দেশের ও জাতির কাছে লজ্জার।
পশ্চিমবঙ্গের জরুরি অবস্থার ওপর নির্মিত এক ডকুমেন্টারি ‘দুঃস্বপ্নের  দিনগুলি’ পশ্চিমবঙ্গের তথ্য সংস্কৃতি বিভাগের ফিল্ম ডিভিশনে রাখা থাকলেও প্রদর্শনের অনুমতি দেওয়া হয় না। 
আনন্দ পট্টবর্ধনের আর একটি উল্লেখযোগ্য তথ্যচিত্র হল, ‘prisoners of conscience’। এই ছবিতে তিনি দেখিয়েছেন জেল বন্দি মানুষের ছবি। ভারতের নকশালপন্থী  আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে এক ব্রিটিশ স্কুল শিক্ষিকার পাঁচ বছর কারাদণ্ড হয়। শিক্ষিকার নাম মেরী টেলর। তাঁর ভারতীয় স্বামী একই কারনে হাজত বাস করেন। এ ছবিতে স্কুল শিক্ষিকার সাক্ষাত্কার দেখান হয়। সঙ্গে সদ্য মুক্তি প্রাপ্ত কিছু জেলবন্দির সাক্ষাত্কারও নেওয়া হয়। 1978 সালের ডিসেম্বরে এই ছবির কাজ শেষ হয়। প্রথমে সেন্সর বোর্ড ছাড়পত্র না দিলেও পরে বুদ্ধিজীবীদের সহযোগিতায় ছাড়পত্র পাওয়া যায়। কিন্তু  ছবিটি বানিজ্যিক চ্যানেলে প্রদর্শন করান সম্ভব হয় না। প্রথম দুটো প্রিন্ট নষ্ট হয়ে যায়। পরের দুটো প্রিন্ট বিক্রি করা হয়। অন্য চারটি প্রিন্ট একটি সংস্থাকে দান করা হয়। গণতান্ত্রিক সচেতনতা বাড়ানোর জন্য ‘দ্য পিপল ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিস অ্যান্ড ডেমোক্রেটিক রাইটস’ নামক সংস্থাকে প্রদান করা হয়। জরুরি অবস্থা কেটে যাবার পর  ছবিটি নতুন সরকার ছবিটিকে ছাড়পত্র দেয়।
এর আগেই আনন্দ পট্টবর্ধন আর একটি ছবি করেছিলেন তার নাম ‘A time to rise’ নামে। কানাডায় প্রবাসী ভারতীয়দের ইউনিয়ন করার প্রসঙ্গে তৈরি করেন ছবিটি। ছবিটির প্রদর্শনের ছাড়পত্র  নিয়ে বেশ সমস্যা তৈরি হয়েছিল। ভারত সরকার কানাডার সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার মূলক ছবি প্রদর্শন করতে রাজি হয়নি- যা এই ছবির বিষয় বস্তু ছিল। এছাড়া পরে আরও দুটি বিতর্কিত ছবি করেন। রামজন্মভূমি বাবরি মসজিদ নিয়ে আনন্দ পট্টবর্ধনের, ‘রামকে নাম লিয়ে’ নামে বিতর্কিত প্রেক্ষিতে ছবি করেন। পাঞ্জাবের সরকারি সন্ত্রাস নিয়ে আনন্দ পট্টবর্ধন ‘In memory of Friends ’ নামে একটি বিতর্কিত ছবি করেন। হয়ে ওঠেন বিতর্কিত রাজনৈতিক পরিচালক।
1977এ উৎপলেন্দু চক্রবর্তী তৈরি করেন ‘মুক্তি চাই’। নাগরিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে একটি প্রচারমূলক ছবি এটি। ছবিটি বিনা শর্তে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবি করে। তবে এই ছবিটি মুক্তি পায় সহজেই। কারণ জনতা দলের নেতৃত্ব যে সংযুক্ত সরকার গঠিত হয় তারা ছাড়পত্র দেয়।
 এই সময় ফিল্ম ডিভিশন সমাজিক সমস্যা নিয়ে কয়েকটি তথ্যচিত্র তৈরি করে।  সমাজের বর্ণবিদ্বেষ জন জীবনে কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে তা দেখানো হয় কয়েকটি ছবিতে। লোকসান লালওয়ানির ‘They call me chamar’ ছবিটি এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য। সত্তরের দশকের তথ্যচিত্রে এর অবদান অনস্বীকার্য। এ ছবিতে দেখানো হয় এক ব্রাহ্মণ সন্তান এক হরিজন মহিলাকে ভালোবেসে বিয়ে করে এবং সমাজ থেকে বিতাড়িত হয়ে মৃত জন্তুর গা থেকে চামড়া ছাড়িয়ে জীবন যাপনের পথ খুঁজে পায়। শেষে তাদের হরিজন বস্তিতে ঠাঁই হয়। 
 লালওয়ানির দ্বিতীয় ছবি, ‘Burning Stone’। এটি কয়লা খনির উপর তোলা ছবি। যে ভয়ঙ্কর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বিপদ শঙ্কুল অবস্থায় শ্রমিকেরা কাজ করে তা পুঙ্খাণুপুঙ্খ দেখানো হয়েছে এ ছবিতে। এই সময় তথ্যচিত্রের বিষয় বস্তুতেও পরিবর্তন আসতে থাকে।
ফিল্ম ডিভিশনের নির্দেশে পরিচালক  এস. শুকদেব বেশ কয়েকটি ছবি তৈরি করেন। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর ভারতে খাদ্যশস্যের ব্যবসা জাতীয়করণ  করলে তার ওপর ছবি তৈরি করলেন এস. শুকদেব । ছবিটির নাম –  ‘Behind the bread line’। এই ছবিকে মুক্তি দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করেনি রাষ্ট্র। বরং 1974 এ রেলশ্রমিকদের ধর্মঘটকে তিরস্কার করে একগুচ্ছ ছবি করার দায়িত্ব পান সুখদেব। জরুরি অবস্থা চলাকালীন ইন্দিরা গান্ধীর সরকারকে সমর্থন করে কয়েকটি ছবি তৈরি করেন শুকদেব। তিনি শেষ ছবি করেন বাঁধা-শ্রমিক প্রথার উচ্ছেদ নিয়ে। ছবির নাম ‘After the silence’। এই ছবিতে দেখান হয় বিহারে তেজারতি ব্যবসা করে কয়েকজন  কংগ্রেসের নেতা। বেআইনি ভাবে বেশ কিছু  বাঁধা-শ্রমিক কে আজীবন দাসত্ব আবদ্ধ রেখেছে তারা। পরিচালককে ছবি থেকে  ঐ বিশেষ অংশ বাদ দিতে বলা হয়। পরিচালক রাজি না হওয়ায় ছবিটি বাতিল করা হয়।
সত্তরের দশকে তথ্যচিত্র-নির্মাতারা এক নতুন ধারার জন্ম দেয়। যে ধারা আটের দশকেও বজায় থাকে। আনন্দ পট্টবর্ধন, তপনকুমার বসু, সুহাসিনী মুলে, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, গৌতম ঘোষ ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন প্রমুখ তথ্যচিত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেন। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তথ্যচিত্র নির্মানের প্রবণতা দেখা যায় এই সময়। রাজনৈতিক মন্তব্য সরাসরি জায়গা করে নেয়। কখনও কখনও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, প্রশাসনের বিরুদ্ধে তথ্যচিত্রের কণ্ঠস্বর গর্জে ওঠে। রিয়ালিটিকে পুনরাবিষ্কার করার চেষ্টা করে, ফিকশন ভেঙে, আখ্যান ধর্মকে ভেঙে তথ্যচিত্র তৈরি করেন তাঁরা। তপন কুমার বসু, সুহাসিনী মুলে তৈরি করেন ‘An Indian Story’। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার এক চাঞ্চল্যকর তথ্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল এই ছবির চিত্রনাট্য। চিত্রনাট্য সাজিয়েছিলেন পরিচালক তপন কুমার বসু নিজেই। সাংবাদিক  অরুন সিনহা মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে তদন্ত করেন- কীভাবে 34 জন বিচারাধীন বন্দির চোখে অ্যাসিড ঢালা হয়! এ ছবিতে সংবিধান সম্পর্কে বক্তব্য পেশ করেন PURD-এর সভাপতি প্রখ্যাত আইনজীবী গোবিন্দ মুখুটি।  এই নৃশংস ঘটনার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে জেহাদ ঘোষণা করতে অনুপ্রাণিত করে এই ছবিটি। ছবিটিতে সাসপেন্ডেড পুলিশ অফিসার ও ভাগলপুর চেম্বার অব কমার্সের প্রতিনিধিদলের নেতিবাচক সাক্ষাত্কার রাখা হয়।ছবি বোম্বে হাইকোর্টের নির্দেশে মুক্তি পায়। 
এভাবেই ভারতীয় সাংবাদিকতায় একটি নতুন শব্দও যোগ হয়, তা হল “Investigative Jurnalism”। সাংবাদিকতার এই প্রবনতা তথ্যচিত্র পরিচালকদের অনুপ্রাণিত করে। তপন কুমার  বসু ও সুহাসিনী মুলের পরবর্তী প্রযোজনা ‘Beyond Genocide’(1985)এ ইনভেস্টিগেশন জার্নালিজম এর মূর্ত প্রকাশ ঘটে। ভুপাল গ্যাস দুর্ঘটনার দুদিন পর তপন কুমার বসু পুরো টিম নিয়ে ভুপালে যান এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছ থেকে সত্যে উপনীত হন।  গ্যাস দুর্ঘটনা বিরোধী কমিটির সঙ্গে তপন বসুর টিমও সক্রিয় হয়ে ওঠে। খুব অল্প দিনের মধ্যেই তথ্যচিত্র তৈরি করতে সক্ষম হন তিনি।  ফলে এই তথ্যচিত্রের বিন্যাসেও পরিবর্তন আনতে হয়। ছবিতে  প্রথা বহির্ভূত ভাবে ভাষার ব্যবহার কম রাখতে হয়। পরবর্তীতে এই বিন্যাস বেশ জনপ্রিয় হয়। আনন্দ পট্টবর্ধনের বেশ কয়েকটি তথ্যচিত্রে ন্যারেশন বা ভাষ্য অনুপস্থিত। এই ধারা অনুসরণ করে তথ্যচিত্র তৈরি করেন উৎপলেন্দু চক্রবর্তী। তাঁর ‘দেবব্রত বিশ্বাস’ তথ্যচিত্রটি এই ধারা অনুসরণ করে তৈরি। রাহুল বসুর ‘সোমনাথ হোড়’ নামে তথ্যচিত্রটিও এই ধারার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই প্রসঙ্গে  Louis Marcorelles এর মন্তব্যটি মনে পরে-
“Young cinema was soon to mean the cinema of either Third World, of countries  without a film history at all, or of Countries alienated from the dominant film industries -The Uneted States in the first please, then France, Italy and Germany among the capitalist countries. The people began to free themselves from the paralysing influence of these models and try to create original, national cinemas which allowed them to discover their own national identity.”
 
এই সময় অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশকে কেন্দ্র করে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের দাঙ্গার ওপর বেশ কয়েকটি তথ্যচিত্র তৈরি হয়। প্রকাশ ঝা বিহারের নালন্দা জেলার দাঙ্গার প্রেক্ষিতে ‘Faces after the storm’ (1981)তৈরি করেন। পি সি শর্মা গুজরাটের বিভাণ্ডি দাঙ্গার প্রেক্ষিতে, ‘The people of Bivandi speak’, শেখর মুখার্জির ‘পুরস্কার’, হায়দ্রাবাদের দাঙ্গার প্রেক্ষিতে দীপাবলি ধনরাজ’, ‘what hapend to this city' তৈরি করেন। কলকাতার দাঙ্গার উপর তৈরি হয়, ‘চেনা শহর অচেনা সময়’। এই সময় ভারতের বিভিন্ন রাজ্য সরকারের তত্ত্বাবধানে কিছু তথ্যচিত্র তৈরি হয়।পশ্চিমবঙ্গের সরকারি প্রযোজনায় প্রথম তথ্যচিত্র হল ‘জয়যাত্রা’। জীবনানন্দ দাশের উপর তোলা তথ্যচিত্র ‘কবিতার অনন্ত যাত্রা’, শশী আনন্দ এর ‘আর কতদিন’ তৈরি হয়। পরিচালকের মুক্ত চিন্তা এতটাই প্রবল ছিল যে,  এই ছবিতে রাস্তার দুঃস্থ  শিশুদের নিদারুন দূরাবস্থার জন্য দায়ী করা হয়েছে রাজ্য সরকারকেও।  
আশির দশকে আনন্দ পট্টবর্ধন তৈরি করলেন ‘হামারা শহর’। বোম্বাই শহরের ফুটপাতবাসীদের সমস্যাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন ছবিতে।  সামাজিক সম্পদ গড়ে তোলার কাজে ওদের অবদানের কথা বলেছেন। বর্ষায় ফুটপাত বাসীর মর্মান্তিক অবস্থার কথা বিধৃত হয় ছবির পরতে পরতে। 
তবে এই দশকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ভারতে ফিল্ম ডিভিশন। এই সময় ফিল্ম ডিভিশনকে বেশ কিছু ফিল্ম কিনতে হয়, সেগুলি হল- ‘আজ্ঞা দো হুকুম করো’, ‘জমিদার ওয়ারিশ’, ‘এ নিউ এরা বিগিনস’, ‘গডমেন অফ গঙ্গা’। ফিল্ম পারচেজ কমিটি, ফিল্ম অ্যাডভাইজারি বোর্ড কার্যত কর্মহীন হয়ে পড়ে। ভারতের ফিল্ম ডিভিশনের 1981 সালের হিসাব অনুযায়ী সংবাদ চিত্র নিয়ে মোট 7,102টি ছবি তৈরি করা হয়, মোট 76,754টি প্রিন্ট ভারতের বিভিন্ন সার্কিটে দেখান হয়। তখনও পর্যন্ত ব্যয় হয়েছিল 13,90,28,074টাকা। আর  আয় হয়েছিল 7,78,26 000 টাকা।
এই দশকেই আবার ভিডিও ক্যামেরার বিশেষ বিবর্তন হয়। আমেরিকায় অসংখ্য তথ্যচিত্র এই দশকে তৈরি হয়েছিল এই ভিডিও ক্যামেরার মাধ্যমে। ভিডিও ক্যামেরায় 1/2ইঞ্চি টেপ ব্যবহার করে খুব সহজে সুন্দর ছবি তোলা যায়। এ ক্ষেত্রে কোনো ল্যাবরেটরি প্রসেসিং এর দরকার হয় না। সঙ্গে সঙ্গে ছবি যাচাই করা যায়। বিশেষ ধরনের আলোক সম্পাতেরও দরকার হয় না। শুধু তাই নয় ফিল্মের বৈপরীত্যও এই টেপ পুনরায় ব্যবহার করা যায়। এই কারণে ভিডিও টেপ এক স্বাধীন কর্ম কাণ্ডের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। আশির দশকে ক্যামেরার মধ্যেই মাইক্রোফোনের ব্যবস্থা থাকায় শব্দ গ্রহণে বেশ সুবিধা হয়। এই ক্যামেরা প্রায় নিঃশব্দে কাজ করে। এই ক্যামেরা পরবর্তীতে আরো সহজে চলচ্চিত্র নির্মাণে সহযোগী হয়ে ওঠে।
 ভারতে ইউ ম্যাটিক ক্যামেরা আসার সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীন তথ্যচিত্র আন্দোলনের সঞ্চার হয়। ছবি তৈরির খরচ ও কারিগরি জটিলতা কমে যায়। ফিল্ম ও ভিডিও এর ক্ষেত্রে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা ছাড়াই ফিল্ম তৈরি করা সম্ভব হয়।
সত্তরের দশক ও আশির দশকের প্রথমদিকে স্বাধীন তথ্যচিত্র অন্যের অর্থানুকূল্যে বা ঋনের অর্থে ছবি তৈরি হত। পরে কয়েকটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ফিল্ম বা ভিডিও তৈরির কাজে অর্থ সাহায্য করে। ক্রমশ এই ছবি গুলির ভি এইচ এস কপির বাজার তৈরি হয়। ভারতেই দুশো থেকে তিনশো কপি ছবি বিক্রি করতে সক্ষম হন নির্মাতারা। ভারতের স্বাধীন  চলচ্চিত্র আন্দোলন আশির দশকে বিশ্ব চলচ্চিত্র সংঘের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিদেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে বেশ কিছু ছবি দেখান হল। পাশ্চাত্য দূরদর্শনে কাজ পেলেন কয়েকজন পরিচালক। আবির্ভাব হয় নতুন ধরনের দূরদর্শন তথ্যচিত্রের। আঙ্গিক, বিন্যাস, নির্মাণ কৌশল সব কিছুই সত্তরের দশকের রাজনৈতিক তথ্যচিত্র থেকে একেবারে ভিন্ন।  সত্তরের দশকের স্বল্প ব্যয়ে নির্মিত ছবিগুলি ছিল একটি বিশেষ রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থায় গাঁথা এবং তা ছিল সংগ্রাম ও আন্দোলনের সঙ্গে গভীর ভাবে সম্পৃক্ত। কিন্তু পরের দিকের ছবি হল অত্যন্ত মসৃণ, অর্থাভাবের ছাপ হীন। শুরু হল ঝকঝকে ছবি তৈরির আর একটি নতুন যুগ। 
 
***************************
তথ্যসূত্র:
1) সিনেমা সপ্তম শিল্প কলা-বরুণ দাশ.
2)আর রেখোনা আঁধারে- সজল চট্যোপাধ্যায়
3)সোনার দাগ-(শতবর্ষের আলোয় বংলা চলচিত্র)-গৌরাঙ্গ প্রসাদ ঘোষ
4)The Mossion Picture.-The new York times.
5)The early year of culcatta-cinema in sukantochOudhuriy edited:-calcutta the leaving city.
6) তথ্যচিত্র কথকতা-ঋত্বিক সিনে সোসাইটি ।