ভারতে ফ্যাসিবাদের উত্থান ও প্রতিরোধের সম্ভাব্য পথ

এ নিয়ে বোধহয় দীর্ঘ পুনরালোচনার প্রয়োজন নেই যে ১৯৩০-এর দশকে ফ্যাসিবাদের জন্ম প্রথমে ইতালিতে, পরে জার্মানিতে। তা ছিল গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের "বাড়াবাড়ির" বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের হিংস্র প্রতিক্রিয়া। মুসোলিনি ও হিটলার দাবি করেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইতালি-জার্মানির পরাজয়ের জন্য এগুলিই নাকি দায়ী। তাই  ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তাঁরা জনগণের জীবনের সব দিকের ওপর চরম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন। মানে ফ্যাসিবাদের উত্থানই হয়েছিল গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকে রুখতে।

আজ এত বছর পরে সাম্রাজ্যবাদ আর পুঁজিবাদ উভয়েই নতুন অবতারে হাজির। সাম্রাজ্যবাদ বলতে এখন আমরা ভূখণ্ড নয়, বাজার ও সংস্কৃতিকে অধিগ্রহণ বুঝি। আধুনিক পুঁজিবাদের বিকাশের প্রেক্ষাপটও পরিবর্তিত হচ্ছে। আর এই পুঁজিপতি শ্রেণির আনুকূল্যে সমগ্র বিশ্বেই দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলির উত্থান শুরু হয়েছে৷ উগ্র জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, ধর্মীয় মৌলবাদ ইত্যাদিকে কাজে লাগিয়ে নব্য ফ্যাসিবাদের জন্ম হচ্ছে। ২০০৭-২০০৮ সাল থেকে উদ্ভূত বিশ্বজনীন আর্থিক সঙ্কট ( ফ্যাসিবাদের জন্ম কিন্তু ঐতিহাসিক ভাবেই হয়ে থাকে ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদ থেকে) এই প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। ভারতের মাটিতে আরএসএস-এর উত্থানকেও আমরা এই আলোতেই দেখব৷

১৯৯২ সাল পরবর্তী সময়ে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মাধ্যমে ভারতে আরএসএস-এর নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলনের এক নতুন পর্ব শুরু হয়। একই সময়ে কিন্তু নয়া-উদারনৈতিক অর্থনীতির পথে দেশকে ঠেলে দেওয়াও শুরু হয়েছিল। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে ভারতের শাসকশ্রেণি ও তাদের বেনিয়া অভিভাবকরা আপাতত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে ধর্মীয় বিভাজন ও উগ্র জাতীয়বাদের মডেলটিই তাঁদের বিকাশের জন্য সর্বাধিক কার্যকর। কেন? শাসকশ্রেণির মূল উদ্দেশ্য যখন পুঁজিপতিদের হাতে দেশের যাবতীয় সম্পদ তুলে দেওয়া, তখন দেশের সার্বিক অবনতির জন্য কাঠগড়ায় তোলা প্রয়োজন কোনো এক 'অপর'-কে৷ সেই 'অপর'-টিই এক্ষেত্রে মুসলমান বা দলিত। সার্বিক অবনতি ভুলিয়ে দিতে আরও দরকার অন্ধ জাত্যাভিমানের নেশা, এক্ষেত্রে সেই কাজটিই করছে 'হিন্দুরাষ্ট্রের' স্বপ্ন।

একথা অস্বীকার করে লাভ নেই যে ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে যে ইংরাজ-বিরোধী জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটেছিল, তার মধ্যেই হিন্দুত্ববাদের উপাদান ছিল।  ভারতের মাটিতে ধর্ম একটি সুপারস্ট্রাকচার, তাকে অস্বীকার করে বোধহয় তাকে অতিক্রম করা যায় না। দার্শনিক গভীরতার সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যবাদ, বর্ণাশ্রম, জাতিভেদও সেই ধর্মের উপাদানসমূহ৷ চার্বাক দর্শন, বৌদ্ধ বা জৈন ধর্ম থেকে শুরু করে ভক্তি-সুফী আন্দোলন প্রভৃতি নানা কিছুর বিকাশ সত্ত্বেও ভারতীয় সমাজ হিন্দুত্ববাদের উন্মেষের জন্য উর্বর জমি চিরকালই ছিল।

ঊনবিংশ শতকে আর্য সমাজ, প্রার্থনা সমাজ থেকে শুরু করে রামকৃষ্ণ মিশন, নানা সংগঠনই অখণ্ড হিন্দু চেতনার জাগরণের প্রচেষ্টা শুরু করে। দ্বাদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত মুসলমান আধিপত্যে থাকা ভারতের হিন্দুদের মধ্যে হয়ত মুসলিম-ভীতি সঞ্চার করাও সহজ হয়েছিল। বস্তুত হিন্দু-মুসলিম বৈরিতা দ্বাদশ শতক থেকেই ছিল খানিক সুপ্ত। ব্রিটিশদের 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' নীতি তা নিঃসন্দেহে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। অন্যদিকে ক্রিশ্চান মিশনারিদের ধর্মপ্রচারের ফলেও হিন্দু-অস্মিতা আহত হয়েছিল। কংগ্রেসের নেতারাই জাতীয়তাবাদ ও হিন্দুধর্মকে মেলানোর চেষ্টা করেছেন এক কালে। তিলক গণপতি উৎসব ও শিবাজী উৎসবের প্রচলন করেছেন। উল্টোদিকে খিলাফত আন্দোলন শুরু হয়েছে, পরবর্তীকালে মুসলিম লিগ মুসলিম জনগণকে সংগঠিত করেছে পৃথক রাষ্ট্রের দাবিতে ৷

সাভারকরের হিন্দু মহাসভা এক সময় কংগ্রেসের অংশ হিসেবেই কাজ করেছে। পরে অতি-সাম্প্রদায়িকতার জন্য কংগ্রেস থেকে তা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে৷ এরপর আরএসএস -এর উত্থান শ্রেণিচরিত্রের দিক থেকে পেটি বুর্জোয়াদের হাত ধরে। অবশ্য বেনেদলের সাহায্য তারা শুরু থেকেই পেয়েছিল৷ সেই ধারা অব্যাহত আছে আজও। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার আগে মোদী পেয়েছিলেন পুঁজিবাদীদের সমর্থন৷ আরএসএস-এর মোহন ভাগবতও তাঁকেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চেয়েছিলেন। আমরা যদি বিজেপির শেষ পাঁচ বছরের কার্যসূচী দেখি, তাহলে দেখব রামমন্দির, ঘরওয়াপসি, লাভজিহাদ, গৌ-রক্ষা...আরএসএস-এর যাবতীয় স্বপ্নকেই তা একে একে বাস্তবায়িত করেছে এবং ধর্মীয় ফ্যাসিবাদকে প্রতিষ্ঠা করেছে ভারতে৷ কিন্তু এই জয়যাত্রার পিছনে যে ইতিহাস, তা মোটেই মাত্র দশ বছর পুরোনো নয়। ১৯২৫ সাল থেকে সঙ্ঘপরিবারের উত্থান শুরু।  পশ্চিমবঙ্গের কথাও যদি বলা হয়, তবে সত্তরের দশকেও এখানে ছিল তাদের কার্যকলাপ। নব্বই-এর দশকেও এখানে সরস্বতী বিদ্যামন্দির স্থাপিত হয়েছে। এই দীর্ঘ অধ্যাবসায়ের ফসল তারা এখন ঘরে তুলছে। তাই 'তৃণমূলই বিজেপিকে এনেছে' বড্ড বেশি সরলীকরণ বা তৃণমূলের মতো লুম্পেন পার্টির ক্ষমতাকে বড় অতিকৃত করা।

ভারতের মতো দেশ, যার নাগরিক সমাজ সুগঠিত, যেখানে দীর্ঘ গণতন্ত্রের ধারা আছে, যেখানে শুধুমাত্র শাসন দিয়ে ফ্যাসিবাদী শক্তি কায়েম করা মুশকিল। তাই সুসংহত ভাবে আঘাত করা হচ্ছে সংস্কৃতিকে। মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক ও সংস্কৃতি মন্ত্রককে কাজে লাগানো হচ্ছে হিন্দুরাষ্ট্রের পক্ষে অনুকূল সংস্কৃতি গড়ে  তুলতে।

শুধু তাই নয়, অতিহিন্দু শক্তি নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে সৈন্যপ্রধানদের সঙ্গে। এমনকি জানা যায়, অবসরপ্রাপ্ত সেনাপ্রধানদের উপরেও তাদের যথেষ্ট প্রভাব। অন্যদিকে বিচারব্যবস্থার মাথাদেরও তারা প্রভাবিত করছে। বিদ্বজ্জন ও বুদ্ধিজীবীদের, সাংবাদিক ও শিক্ষকদের পোষ মানাতে না পারলে, তারা তাদের আটক করছে নির্বিচারে। সংবাদমাধ্যমও তাদের বশংবদ। শিক্ষাব্যবস্থা, পাঠ্যক্রম সবই বদলে যাচ্ছে।  এসবের অন্তিম লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট৷ আস্তে আস্তে নানা আইনে পরিবর্তন আনা। শেষপর্যন্ত সংবিধানকেও পরিবর্তিত করে তাকে হিন্দুরাষ্ট্রের অনুকূল করে তোলা। বৈচিত্র‍্য ভুলে সারা দেশে সংঘেরএকচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠা করা। তারা যখন 'এক দেশ এক ভোট'-এর কথা বলছে, তখন তারা আসলে আঘাত করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয়, যেখানে রাজ্যগুলির কিছু নিজস্ব ক্ষমতা আছে। সে কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে যায় রাজ্যগুলির বিধানসভা দখল করতে পারলে, কারণ তাহলে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় জায়গাতেই একই শাসন চলবে।

লুনা রুশদি ফ্যাসিবাদের চোদ্দটি লক্ষণ শনাক্ত করেছিলেন। ২০০৩ সালে ‘ফ্রি এনকোয়ারি’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল তাঁর লেখা। লক্ষণগুলি নিম্নরূপ-

১. পরাক্রমী  জাতীয়তাবাদ – ফ্যাসিবাদী শাসনকালে দেশভক্তিমূলক আদর্শ, শ্লোগান, গান, প্রতীক এবং অন্যান্য সাজসজ্জা ইত্যাদি ব্যবহার বেড়ে যায়। মিল পাচ্ছেন ভারতের সঙ্গে?

২. মানবাধিকারের প্রতি অবজ্ঞা বা ঘৃণার প্রকাশ – ফ্যাসিবাদী সমাজব্যবস্থায় জনসাধারণকে বিশ্বাস করানো হয় যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘প্রয়োজনের’ খাতিরে মানবাধিকার উপেক্ষা করা যায়। মিল পাচ্ছেন?

৩. শত্রু/বলির পাঁঠা শনাক্ত করা –  ফ্যাসিবাদ এক বলির পাঁঠা বা ছায়াশত্রু খুঁজে নেয়। এক্ষেত্রে ভারতের ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বলির পাঁঠা মুসলিম-দলিত-আদিবাসী। এছাড়া কমিউনিস্ট ও উদারমনস্করা। এঁরা সবাই 'অ্যান্টি-ন্যাশনাল'। মিল পেলেন?

অবশ্য প্রধানতম বলির পাঁঠা এক্ষেত্রে মুসলিমরাই। এন-আর-সি নামক মানুষকে না-মানুষ বানানোর প্রক্রিয়া সেই ছায়াশত্রুকে মাত দিতে চাইছে। যদিও অসমে এর ফলে মুসলিমদের চেয়ে হিন্দুরাই নাগরিকত্ব হারালেন বেশি এবং প্রমাণিত হল যে মুসলিমদের বহুল সংখ্যায় অবৈধ নাগরিকত্ব একটি মিথ মাত্র।

৪. সামরিক আধিপত্য – দেশের অভ্যন্তরীণ দুর্যোগ ও সমস্যা অবহেলা করেও সামরিক বাহিনীকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। চীন বা পাকিস্তানকে জব্দ করার মিথের উপর ভিত্তি করেই নির্বাচন জেতা যায়। মিল পাচ্ছেন?

৫. উৎকট লিঙ্গবৈষম্য – ফ্যাসিবাদী দেশগুলোতে প্রায় একচেটিয়া ভাবেই সরকার হয় পুরুষ-আধিপত্যাধীন। ফ্যাসিবাদী সমাজ-ব্যবস্থায় নারী-পুরুষের প্রথাগত ভূমিকা অনমনীয়ভাবে পালিত হয়। বিবাহ-বিচ্ছেদ, গর্ভপাত বা সমকামিতা নিষিদ্ধ হয়। রাষ্ট্রকে উপস্থাপন করা হয় পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানের চূড়ান্ত অভিভাবক হিসাবে। উত্তরপ্রদেশে নারীর অবস্থান দেখুন। সমকাম নিয়ে রাষ্ট্রের মনোভাব দেখুন। এখনও মিল পেলেন না?

৬. নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম – সাধে কি বিদ্রোহী চাষীদের নিজস্ব মিডিয়া খুলতে হয়? মিল পেলেন না? 

৭. জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে প্রচণ্ড ঔৎসুক্য – জনসাধারণকে বৈদেশিক শত্রুর ভয় দেখিয়ে উত্তেজিত রাখা হয়। চিন, পাকিস্তান...আবারও।

৮. ধর্ম ও রাষ্ট্র  অঙ্গাঙ্গী জড়িত থাকে

– হিন্দুরাষ্ট্রের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে চলেছে, অথচ আপনি এখনও মিল খুঁজে পাচ্ছেন না।

৯. বড় পুঁজির সঙ্গে দহরম-মহরম – ফ্যাসিবাদে দেশে অনেক সময়েই বনেদি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোই সরকারকে ক্ষমতায় আনে। সরকার ও এসব প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সুবিধাজনক লেনদেনের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আম্বানি হন দেশের রাজা। মিল পেলেন?

১০. শ্রমিক-কৃষকদের ক্ষমতা রোধ – যেহেতু খেটে খাওয়া মানুষের সাংগঠনিক শক্তি ফ্যাসিবাদী সরকারের জন্য হুমকি স্বরূপ,  তাই এখানেও এসে গেছে কৃষি আইন-শ্রমকোড। আরও মিল চাই?

১১. বুদ্ধিবৃত্তি ও শিল্পের প্রতি অবজ্ঞা – ফ্যাসিবাদী দেশগুলো প্রায় সময়েই উচ্চশিক্ষা ও শিক্ষায়তনের সঙ্গে খোলাখুলি বৈরিতা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের গ্রেফতার করা বা তাঁদের বক্তব্য সেন্সর করা বিরল নয়। শিল্প ও সাহিত্যাঙ্গনে স্বাধীনভাবে কথা বলতে গেলে সরাসরি আক্রমণ করা হয়। ভারতের সঙ্গে মিল পাওয়া গেল?

১২. অপরাধ ও শাস্তির বিষয়ে মাত্রাহীন আগ্রহ – ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থায় পুলিশকে আইন প্রয়োগের নামে প্রায় সীমাহীন ক্ষমতা দেওয়া হয়। দেশপ্রেমের নামে চলে পুলিশি নির্যাতন। লাঠির গুঁতো মেরে পুলিশ যাকে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়াচ্ছিল দিল্লিতে, সেই ছেলেকে মনে পড়ে?

১৩. অবাধ স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি– কর্পোরেট স্বজনদের প্রতি প্রীতি দেখতে পাচ্ছেন না নাকি দুর্নীতি করে তাদের বিদেশে পালানো দেখতে পাচ্ছেন না? RTI করে আপনি দুর্নীতির তল পাবেন, সে উপায়ও তো বন্ধ! মিল পাচ্ছেন?

১৪. নির্বাচনে কারচুপি – ফ্যাসিবাদী দেশে নির্বাচন মানেই সম্পূর্ণ ধোঁকাবাজি।

যুক্তরাষ্ট্রের হলোকাস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে ফ্যাসিবাদের প্রাথমিক সাত লক্ষণসমূহের এক তালিকা রয়েছে ( এটির কথা আবার মহুয়া মৈত্রর ভাষণে অনেকেই শুনেছেন)। তার সঙ্গেও বর্তমান ভারতের হুবহু মিল।

১। দেশে শক্তিশালী অংশের জাতীয়তাবাদ ক্রমে দেশের জাতীয় পরিচয়ে পরিণত হয়। সংখ্যালঘুদের তা অস্বীকার করে। মুসলমান নাগরিকদের বারংবার পিটিতে মারার পর ভারতে এই লক্ষণের উপস্থতি নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে না।

২। মানবাধিকারের প্রতি একটি ব্যাপক অবজ্ঞা দেখা দেয় ২০১৪ থেকে ২০১৯ এর মধ্যে এই প্রবণতা অন্তত ১০ গুণ বেড়েছে।

৩। গণমাধ্যমের ওপর কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ। ভারতের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো নিজেদের প্রাইমটাইমের বড় অংশ ক্ষমতাসীন দলের প্রচার-প্রোপাগান্ডায় ব্যয় করে, আগেই বলা হয়েছে।

৪। জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি অতিরিক্ত সচেতনতার জন্য, পাকিস্তান ও চীন নিয়েই সারাক্ষণ মাথাব্যথা। অথচ দেশের মানুষের অসন্তোষ নিয়ে আলোচনা নেই।  ৫। সরকার ও ধর্ম পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী সম্পপ্ররকে আবদ্ধ হওয়া। এ সম্পর্কে কী কিছুবলবার প্রয়োজন আছে?

৬। বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীদের প্রতি চরম অবজ্ঞা। শুধু অবজ্ঞা নয়, এ দেশে বিরাশি বছরের কবি ভারভারা রাও-এর উপর রীতিমতো নির্যাতন চলে।

৭। নির্বাচন ব্যবস্থার স্বাধীনতা নষ্ট হয়ে যাওয়া। নেতা, মন্ত্রী, এমপি কেনাবেচার ঘটনা স্মরণ করা যায় এ প্রসঙ্গে।

ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদী লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলেই মনে করছেন মার্কিন বিদেশনীতির কট্টর সমালোচক, প্রবীণ ভাষাবিদ ও লেখক নোম চমস্কি। ক’দিন আগে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেছিলেন, নাৎসি জার্মানির সঙ্গে ভারতের মিল দেখা যাচ্ছে

যুদ্ধ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী অ্যাকটিভিস্ট কার্তিক রামানাথানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে চমস্কি বলেছেন, ‘ভারতে আমরা যা দেখছি, তা হচ্ছে ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ ছাড়াই ফ্যাসিবাদের লক্ষণ। ফ্যাসিবাদের অর্থ হচ্ছে, একটি সর্বাত্মকবাদী সরকারের রাষ্ট্রের সর্বত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ, নাৎসি বা কোনো ফ্যাসিবাদী দলের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র, যা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে। নাৎসিরা কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যেও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল। অবশ্য ভারতে তা দেখা যাচ্ছে না। সেখানে রাষ্ট্র বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে না। কিন্তু ভারতে ফ্যাসিবাদের অন্যান্য লক্ষণ সুস্পষ্টভাবে দেখা দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থার ওপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দেশটির গণমাধ্যমও সেভাবে সরকারের সমালোচকের স্থান নিতে পারছে না।’ লাখ লাখ মুসলিম নাগরিককে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে শনাক্ত করে তাদের জন্য বন্দিশিবির তৈরির বিষয়টিরও উল্লেখ করেন নোম চমস্কি। ট্রাম্পের তুলন টেনে তিনি বলেন, যেমনভাবে ট্রাম্প হিস্পানিক আর কৃষ্ণাঙ্গদের উপর দেশের মানুষের দারিদ্রের সব দায় চাপাচ্ছিলেন, তেমনভাবেই মোদী মুসলিমদের অভিবাসী চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে ক্ষেপিয়ে তুলেছেন।

সুতরাং এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে আমরা এক ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের মধ্যে প্রবেশ করছি, তলিয়ে যাচ্ছি ধীরে ধীরে। যেখানে সাংবাদিক প্রকাশ্যে বলছেন, 'আম্বানির চ্যানেলে বসে আম্বানির বিরুদ্ধে কথা বলতে পারেন না।' যেখানে বিখ্যাত তারকারা সদলবলে তোতাবুলি আওড়ে বলছেন, চাষীদের উপর নির্যাতন দেশের 'অভ্যন্তরীণ ব্যাপার' মাত্র।  যেখানে সেলিব্রিটি সুইডিশ পরিবেশকর্মীর বিরুদ্ধে বারতে বসে এফআইআর করা হচ্ছে চাষীদের সহমর্মিতা জানানোর জন্য। যেখানে সাংবাদিক মনদীপ পুনিয়াকে আন্দোলন কভার করার জন্য তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যেখানে তিহার জেলে চাষীদের বন্দী রাখা হয়েছে এবং তাদের খবরও মিলছে না৷ সুসংগঠিত ফ্যাসিবাদ এ দেশে আজ ঘটমান বাস্তব। প্রশ্ন হল আমরা কীভাবে এর মোকাবিলা করব? বামপন্থীরা কি প্রতিরোধ গড়ে তোলার জায়গায় আদৌ আছে?

দেশজুড়ে বামপন্থীদের ক্ষমতা-হ্রাসের চিত্র খুব আশাব্যঞ্জক নয়৷ কিন্তু চেষ্টা যদি করতে হয়, তবে ফ্যাসিবাদী গণ-আন্দোলনের বিপরীত গণ-আন্দোলনই পথ। প্রথমত, ফ্যাসিবাদী জাতীয়তাবাদী ধারণাকে সজোরে আঘাত করতে হবে৷ যুক্তিপূর্ণ, বিশ্বাসযোগ্য ও আবেদনপূর্ণ সুরে সুপরিকল্পিত প্রচার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা মানেই দেশভক্তি ও জাতীয়তাবাদ-এটা যে ভ্রান্ত সমীকরণ তা বোঝাতে হবে মধ্যবিত্ত ও সর্বহারাকে। ফ্যাসিবিরোধী কর্মসূচীতে অবশ্যই শ্রমিক কৃষকদের সচেতনতার একটা ভূমিকা থাকবে। মিথ্যা জাত্যাভিমানের আড়ালে যে তাদেরই লুঠ করা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি, তা বোঝাতে হবে তাদের ভাষায়- কৃষিবিল, শিক্ষাবিল, শ্রমকোড ব্যাখ্যা করে করে। এ যদি এতই অসম্ভব হত, তাহলে পাঞ্জাবের চাষীরা কৃষিবিল পড়ে, বুঝে, আন্দোলনে নামলেন কী করে?

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কমিউনিস্ট পরিভাষায় 'জাতীয়তাবাদ' ধারণাটি 'আন্তর্জাতিকতাবাদের' সম্পূর্ণ বিপরীত৷ একজন কমিউনিস্টের কাছে 'জাতীয়তাবাদ'-এর  অর্থ হল, সাধারণ মেহনতি মানুষের ঐক্যবদ্ধ আন্তর্জাতিক স্বার্থের তুলনায় একটি দেশের স্বার্থের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা৷ তাই জাতীয়বাদকে কমিউনিস্টরা পরিহার করে চলেন। কিন্তু কমিউনিস্টদের মধ্যেও এই ভাবনার খণ্ডন শুরু হয়েছে৷ তাকে আরও বিকশিত হতে দিতে হবে৷ জাতিকে ভালোবাসার সঙ্গে নিপীড়নের বিরোধিতার দ্বৈরথ সবক্ষেত্রে না-ই থাকতে পারে। বিশেষত ভারতের মানুষ যখন কোনো এক জাতিসত্তাকে আঁকড়ে ধরতেই চাইছেন, তখন তাঁদের বোঝানোর ধারাটি এমনও হতে পারে যে ভারতীয় বৈচিত্র্যময় জাতিসত্তাকে রক্ষা করার জন্যই ফ্যাসিবাদী বিজেপির অন্ত ঘটানো দরকার। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের 'জাতীয়তাবাদী' ভাবনাকে অবজ্ঞা করে তাদের ফ্যাসিবাদী বা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই-এ পাশে পাওয়া যাবে না বলেই মনে হয়। বরং স্বাধীনতার লড়াই-এ আরএসএস যে ন্যক্কারজনক ভূমিকা রেখেছিল, সেকথাই বারবার প্রচার করা প্রয়োজন তাদের দেশপ্রেমের ভণ্ডামি রুখতে। ভাষা হতে হবে সাধারণ মানুষের বোধগম্য। কমিউনিস্ট ডিস্কোর্সের জারগনে ভরা ভাষা প্রচারের জন্য উপযুক্ত নয়। ফ্যাসিবাদী উগ্র জাতীয়তাবাদ-এর লক্ষ্য যে শুধুমাত্র পুঁজিপতিদের হাতে বেশি ধনসঞ্চয় নিশ্চিত করা, তা প্রচার করতে হবে৷

পুঁজিবিরোধী লড়াই-এ বামদল যতটা পটু, সাংস্কৃতিক সামাজিক লড়াই-এ সর্বদা ততটা নয়। অথচ আরএসএস-কে সাংস্কৃতিক ও আদর্শগত ভাবেও পরাজিত করা দরকার৷ তাই বিকল্প সংস্কৃতি নিয়ে হাজির হতে হবে৷ তা শুধুমাত্র সোভিয়েত থেকে আমদানি করলে চলবে না বলেই আমার ব্যক্তিগত মত। নিজের সংস্কৃতির মধ্যে সাম্য, মৈত্রী, বৈচিত্র্য ইত্যাদি উদযাপনকারী উপাদানগুলি খুঁজে বের করতে হবে৷ কমিউনিস্টরা দেশের ঐতিহ্যকে কখনই সমাজবাদী ভাবধারার সঙ্গে মেলাতে চেষ্টা করেননি৷ দেশীয় ঐতিহ্যের মধ্য থেকে খুঁজে বের করার চেষ্টাই করেননি এমন উপাদান, যা সাম্যবাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাঁরা দেশীয় ঐতিহ্যকে ফ্যাসিস্টদের হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন।তারাই তা প্রয়োজন মতো 'অ্যাপ্রোপ্রিয়েট' করেছে। এ ব্যবস্থা বন্ধ না হলে বিপদ আসন্ন।

ফ্যাসিবাদে আত্মসমর্পণ করা মানে যে শুধু সংখ্যালঘু, আদিবাসী, দলিত, নারী ও অন্যান্য প্রান্তিকের জীবন দুর্বিষহ করা নয়, সংখ্যাগুরুরাও যে অর্থনৈতিক ভাবে শোষিতই হবে, তা বোঝাতে হবে৷ সর্বহারাদের একত্রিত করতে হবে নব্য উদারনৈতিকতার বিরুদ্ধে৷ বোঝাতে হবে কীভাবে জল-জঙ্গল-জমি, গ্রাম-খনি-শহর সবই লুঠ হয়ে যাচ্ছে। যুক্তিবাদী ও বৈজ্ঞানিক চিন্তনের উন্মেষ ঘটাতে হবে।

নারী-আন্দোলনের কর্মীদের পাশে নিতে হবে। দলিত আন্দোলন, আদিবাসী আন্দোলনের কর্মীদের পাশে নিতে হবে৷ আইডেন্টিটি পলিটিক্সের বিষয়ে নাক সিঁটকোনো বন্ধ করতে হবে৷ অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদকে বাতিল করতে হবে না, কিন্তু তাকে অতিক্রম করেও ভাবতে হবে।

সেই সঙ্গে নির্বাচনী প্রক্রিয়াতেও ফ্যাসিস্টদের রুখে দিতে হবে। অসম ও ত্রিপুরা প্রমাণ, ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতায় এলে, পুলিশ-প্রশাসনের মাথায় এলে রাজ্যের অবস্থা কতটা সঙ্গীন হয়। তাই একটি সংসদীয় গণতন্ত্রে ভোটের বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেওয়াই ভালো। গণ-আন্দোলন এক ব্যাপক ধারণা, ভোটে বিজেপিকে আটকানো অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ ধারণা। কিন্তু ভেন চিত্রের ভাষায় বলতে গেলে ক্ষুদ্র বৃত্তটি পুরোপুরি বৃহৎ বৃত্তের মধ্যেই অবস্থান করছে। বিজেপি ও আরএসএসকে আটকাতে হবে ভোটে, সংস্কৃতিতে, সমাজে। সর্বত্র।