ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বৃহত্তম জোট গঠনের সপক্ষে

'বামপন্থী কমিউনিজম ও শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা' গ্রন্থে লেনিন বলছেন, কিছু কমিউনিস্ট মুখে বড় বড় বিপ্লবী কথা বলে। যেন তারাই হলো বিশুদ্ধ কমিউনিস্ট। এরা উন্নাসিক। অ-কমিউনিস্ট কারুর সাথে কাজ করলে তাদের জাত যাবে। তারা কোনো রকম নমনীয় রণকৌশল গ্রহণ করার বিরোধী। তারা ভুলে যায়, এটা একটা যুদ্ধ। এখানে বিশেষ মুহূর্তে বাস্তব পরিস্থিতি অনুসারে, নমনীয় রণকৌশল নিতে হতে পারে।

আপনার বাড়িতে ইতিমধ্যেই স্থানীয় কয়েকটি ছিঁচকে চোর ঢুকে পড়েছে। ওদিকে সশস্ত্র ডাকাত দল সদর দরজা ভেঙে ঢুকতে যাচ্ছে। সারা দেশ জুড়ে তাদের দাপট।  তারা আপনাদের বা চোরদের কাউকেই ছাড়বে না। কিছু চোর হয়তো ডাকাতদের সাথে আপোষ করে নেবে। কিন্তু আপনি এই মুহূর্তে কী করবেন?

ঘরে ঢুকে পড়েছে বলে আগে চোরদের আটকাবেন? এমনকি চোরদের আটকাতে ভয়ঙ্কর ডাকাতদের ডেকে আনবেন? না কি একই সঙ্গে চোরদের ও ডাকাতদের বিরুদ্ধে আপনি হাতা-খুন্তি নিয়ে লড়বেন ?

আমি মনে করি, এই মুহূর্তে ভয়ঙ্কর বিপদ হলো ঐ ডাকাতদল। আগে ওদের ঠেকাতে হবে সর্বশক্তি দিয়ে। ছিঁচকে চোরকে আপনি পরেও ঠেকাতে পারবেন। কিছু ছিঁচকে চোর ঐ ডাকাত দলের সাথে আপোষ করে নেবে নিশ্চয়ই। তাদের বর্জন করতে হবে। কিন্তু কিছু ছিঁচকে চোর ঐ ভয়ঙ্কর ডাকাত দলকে আটকাতে সাহায্য করতে পারে। কোনো ছুৎমার্গ না করে তাদের আপাতত কাজে লাগাতে হবে।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রগতিশীল চিন্তাবিদ ও দেশনায়কদের শিক্ষা সেটাই। রাশিয়ায় লেনিন, চিনে মাও জেদং, ভিয়েতনামে হো চি মিন কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে যে প্রধান শত্রু তার বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। এজন্য তাঁরা ব্যাপকতম জোট গড়ে তুলেছিলেন।

লেনিন একটা খুব মূল্যবান কথা বলেছিলেন। কিছু কমিউনিস্ট একধরনের আত্মম্ভরিতায় ভোগে ("কমিউনিস্ট ভেইনগ্লোরি")। 'বামপন্থী কমিউনিজম ও শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা' গ্রন্থে তিনি বলছেন, কিছু কমিউনিস্ট মুখে বড় বড় বিপ্লবী কথা বলে। যেন তারাই হলো বিশুদ্ধ কমিউনিস্ট। এরা উন্নাসিক। অ-কমিউনিস্ট কারুর সাথে কাজ করলে তাদের জাত যাবে। তারা কোনো রকম নমনীয় রণকৌশল গ্রহণ করার বিরোধী। তারা ভুলে যায়, এটা একটা যুদ্ধ। এখানে বিশেষ মুহূর্তে বাস্তব পরিস্থিতি অনুসারে, নমনীয় রণকৌশল নিতে হতে পারে। প্রধান শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, সাময়িক ভাবে, হাত মেলাতে হতে পারে অ-প্রধান শত্রুদের সাথে। এই সব কমিউনিস্টরা মুখে বিপ্লবী। কিন্তু কার্যত, এদের গোঁড়ামিপূর্ণ কার্যপদ্ধতি বাস্তবে প্রধান শত্রুকেই শক্তিশালী করে। এরা অবজেক্টিভ বাস্তবতাকে বুঝতে চায় না। এরা সাবজেক্টিভিজম বা আত্মমুখীনতায় ভোগে।

মাও জেদং লিখেছেন, একটি বিশেষ মুহূর্তে, একটি মাত্র প্রধান শত্রু থাকে। তাকে সঠিকভাবে চিনতে পারা ও চিন্হিত করতে পারা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রধান শত্রু ও অ-প্রধান শত্রু, এ দুটিকে সমান ভাবে আক্রমণ করার বাস্তব অর্থ দাঁড়ায়, প্রধান শত্রুকেই শক্তিশালী করা।

বিশেষ কোনো এক মুহূর্তে প্রধান শত্রু ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বৃহত্তম জোট গঠনের সপক্ষে বুলগেরিয়ার কমিউনিস্ট নেতা ও তাত্ত্বিক জর্জি ডিমিট্রভ চমৎকার বিশ্লেষণ ও যুক্তি দিয়ে প্রচুর লিখেছেন। তিনি বলেন, এমনকি যারা দোদুল্যমান, দ্বিধাগ্রস্ত, যারা যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য নয়, তাদেরকেও প্রধান বিপদ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জোটে টেনে আনতে হবে, অন্তত সাময়িকভাবে হলেও। তারা অনিচ্ছুক হলেও তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের বাধ্য করতে হবে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জোটে যোগ দিতে। এভাবেই সর্বশক্তি দিয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রামই যে মুখ্য তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এই সংগ্রামকে শক্তিশালী করে তুলতে সকল শক্তিকে নিয়ে ব্যাপকতম জোট গড়ে তুলতে হবে।

ডিমিট্রভ আর একটি দারুণ কথা বলেছেন। প্রধান শত্রু ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে পাঁচমেশালী জোট গঠন করা একটা ভীষণ কঠিন কাজ। তাই অনেক কমিউনিস্টই বড়ো বড়ো বিপ্লবী কথা বলে এই কঠিন কাজটিকে এড়িয়ে যেতে চায়। বরং বড়ো বড়ো বিপ্লবী বামপন্থী কথা বলাটা অনেক সহজ। কিন্তু ডিমিট্রভ-এর মতে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জোট গঠন কমিউনিস্টদেরই দায়। অন্য শক্তিগুলো দোদুল্যমান। তাদের ভূমিকা অনেকটাই দায় সারা। তাই এই কঠিন ও জটিল কাজটায় প্রকৃত বামপন্থীদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। ডিমিট্রভ-এর এই মত আজও প্রাসঙ্গিক কিনা সেটা গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখা প্রয়োজন।

আপনি যদি ভাবেন যে, এই মুহূর্তে অ-প্রধান শত্রুটি সামনে আছে, এটাকেই শেষ করি। তাই দরকার মতো প্রধান শত্রুর সাথে হাত মেলাই। তার থেকে দরকার মতো সাহায্য নিই। সেটা হবে মারাত্মক ভুল। কারণ প্রধান শত্রু এই ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের উদ্যোগে উগ্র সাম্প্রদায়িক মনোভাব ছড়িয়ে পড়েছে। এই ফ্যাসিবাদের পেছনে ইতিমধ্যেই বিপুল সংখ্যক ধর্মীয় সংখ্যাগুরু মানুষের সমর্থন আছে। ওদিকে বেড়ে উঠেছে মুসলিম মৌলবাদ।ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটে চলেছে। দলিত, নারী, LGBTQIA, সংখ্যালঘু, গরীব, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র ছাত্রী, বুদ্ধিজীবী, সেকুলার, বামপন্থী, অ-হিন্দু, অ-হিন্দী সমস্ত কিছুর দমনকারী শক্তি হলো এই হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ। এই ফ্যাসিবাদ আপনাকে ব্যবহার করে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে, ইতিমধ্যে আপনাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলবে। ভুলে যাবেন না আপনি আর দম নেবার সুযোগ পাবেন না। দেশের মানুষ কিন্তু আপনার এই ভুল সিদ্ধান্তের জন্য কোনো দিন আপনাকে ক্ষমা করবে না।