"নগ্নতা কিংবা নিজস্ব জ্যামিতি" - রণজিৎ অধিকারীর কবিতার পাঠানুভূতি

কবিতার একটি রহস্যময় জগৎ আছে। তা জীবন বাস্তবতাকে কুহেলি আচ্ছন্ন করে উপস্থাপন করে। সেই জাল ভেদ করে কতিপয় সন্ধানী পাঠক পৌঁছাতে পারে কবিতার সীমানায়। তবুও প্রবেশাধিকার সবাই পায় না। সময় লাগে। কবিতার নিজস্ব ছন্দ, ভাষা, রূপকের আশ্রয়ে গড়ে ওঠা সে জগতের ঘন ঘোর ভালোলাগায় ভিজতে ভিজতে অভ্যস্ত হতে হয়‌‌। তবেই কবিতা কিছুটা প্রকাশিত হয় ‌। পাঠক কবিতাকে খুঁজে নেয়, না কবিতা পাঠককে তা জানা নেই তবে পূর্বে কবি রণজিৎ অধিকারীর কিছু কবিতা পড়ার অভিজ্ঞতায় অত্যন্ত আগ্রহ নিয়েই ' নগ্নতা কিংবা নিজস্ব জ্যামিতি ' বইটার পাতা সরাতেই চোখে পড়েছিল এক আশ্চর্য প্রবেশক : সময়, বাদামি পাতায় ঢাকা মাঠ।পাতা নেড়েচেড়ে মাঘরাত্রির চাঁদ খুঁজে চলেছি...প্রেমে আরও ভারহীন করে তোলো আমার শরীর।

 তারপর একে একে ঢুকে পড়া কবিতার অলিন্দে।

 সময়ের মতো নির্জন এই কবিতাগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে একান্তে...নির্ভার। তাদের কোনো গন্তব্য নেই অথচ কী অনন্ত তার দেখার জগৎ...চেনা পৃথিবীর বাইরে এক আশ্চর্য জগতের ঘোরে মগ্ন হয়ে পড়ে পাঠক...জীবনকে জ্যামিতির ছন্দে, মাপে ফেলে এমন বিশ্লেষণ ও নর নারীর দেহজ কামনার এমন উত্তরণের চিত্র বড় বিরল মনে হয়। কবি কখনও সম্পর্কের ভেতরে ডুবেও অসীম নিরাসক্তি নিয়ে বাইরে থেকে দেখান সেই কামনার স্বরূপ...

'কিন্তু বিন্দুরা ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন করে।

তুমি কোনো বিশেষ মুদ্রায় হাত মুঠো করো, তখনও

তোমার আঙুলের বাইরের অংশে তারা লেগে থাকে!

তোমাকে ভালোবাসতে বাসতেই অযুত রেখায়

আমি তাদের যোগ করতে থাকি ; এমনকী তুমি

যখন দূরে ঠেলতে থাকো আমাকে---

আমি সেই অদৃশ্য বিন্দুদু-টি দেখতে পাই আর

ক্রমে দীর্ঘ হতে থাকা একটা বিয়োগচিহ্ন !

(বিন্দুরা স্থান পরিবর্তন করে)

ইহজাগতিক সকল ভালোবাসার অন্তরালে অনন্ত বিরহ কিংবা বিচ্ছেদের যে সুর নিত্য বহমান আর কিছুতেই মিলতে না পারা দুটি হৃদয়ের টানাপোড়েন

'দুই বিপ্রতীপ কোণ -- তারা পরস্পরের মুখাপেক্ষী হয়েও স্বাধীনতা ভোগ করে অনন্তকাল,

একটা বিন্দুতে ঠেস দিয়েও তারা নির্বিকার !

সংলগ্ন বাহুগুলি একে - অপরকে অস্বীকার করেই ক্রমে ইহজাগতিকতা পেরিয়ে বহুদূর চলে যেতে থাকে...' (কোণ বিষয়ক)

বইয়ের একেবারে শেষ কবিতা ' শেষরেখা'তেও সেই অনুরণন...

' যখন আমরা প্রাণপণে মিলিয়ে দিতে চাইছি

দুই ভিন্ন তরঙ্গকে , তখন হঠাৎই রেখাটাকে

দুটো শরীরের মাঝখান দিয়ে চলে যেতে দেখি।

কিন্তু আমরা শেষপর্যন্ত থামি না,

তীর থেকে অনেকটা দূরে এসে আমরা শান্ত হই এবং

অবাক হয়ে দেখি রেখাটা মাস্তুলের রূপ ধরে

দিগন্তের কাছে সমুদ্রে গেঁথে আছে।'

দিগন্ত, মাটি ও আকাশের বিভেদ রেখা হলেও তাকেই ছুঁয়ে আছে তারা।তাই বিভেদ রেখা মাস্তুল হয়ে ভেসে যায় না অনির্দিষ্ট পথে বরং তা গেঁথে থাকে সমুদ্রে... আমাদের সম্পর্কগুলিও যেমন কোথাও আটকে থাকে। এই আটকে থাকাই হয়ত ভালোবাসা। কবির কথায় 'ভালোবাসা মানে অনেক জায়গা জুড়ে থাকা নয়, কোনো এক বিন্দুতে স্পর্শ করা' (আমার কবিতা)। কবিতাও প্রিয় নারীর মতো ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য...অতলস্পর্শ... ভালোবাসাই তো তাই। স্পর্শাতীত সেই অনুভূতির জগতকে শব্দে শব্দে প্রতীয়মান করে তুলতে কবিই পারেন। কী আশ্চর্য নিপুণতায় একের পর এক পেরিয়ে আসেন কবি প্রেমের প্রতিটি ধাপ...হৃদয়জাত ব্যক্তি নিরপেক্ষ ভালোবাসা মিলন পেরিয়ে তখন এগোয় বিরহের দিকে...সম্পর্ক বদলে যায় ,থমকে যায় প্রতিশ্রুতি। যে প্রণয়ীর জন্ম হয় ভালোবাসবার আগেই তার হৃদয় তো অনন্ত বিরহের আধার...বিচ্ছেদ তো অবশ্যম্ভাবী সেখানে। কেবল ব্যক্ততার ভাষাটুকু জুগিয়ে দেন কবি 

'ঝড় এসে যখন পরস্পরকে দূরে ঠেলে দেয়, তখনও

তাদের কাতর আত্মাগুলো অপেক্ষা করতে থাকে

বাসস্টপে,

ঘনিষ্ঠ হয়ে বসার সেই পাথরটায়,

এমনকী আদরের চিহ্ন লেগে থাকা বিছানায়...

সময় এসে একদিন অন্ধকার দিয়ে জায়গাগুলো

মুছে সাফ করে দেয়। ' (সময় ও আত্মা)

এই সময়ের হাত ধরেই দাঁড়িয়ে থাকেন কবি যে সময়ের কাছে প্রার্থনা ছিল তাঁর ' প্রেমে আরও ভারহীন করে তোলো আমার শরীর'। দিনযাপনের সহজ সতত সত্যের আদলে গড়ে ওঠা কবিতাগুলি সূচনার পরে পরেই এক উড়ান পায় চরাচরব্যাপী অন্যভুবনে।

' অবিশ্রান্ত বৃষ্টির পর মনোরম রৌদ্র ওঠে পৃথিবীতে;

ঢেউগুলো তোমার পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিতে দিতে

ক্লান্ত হয়ে সরে যায়।

কীভাবেই - বা তুমি আমার বুকের ওপর আছড়ে পড়বে আর

কীভাবেই-বা বুক শূন্য করে দূরে সরে যাবে তুমি?

বিরতি -- যা সবকিছুকেই সুন্দর করে তোলে আর প্রার্থনীয়।

কিন্তু তুমি-- যে সমুদ্রের চেয়েও প্রবল; তুমি--

যে রৌদ্রের চেয়েও তীব্র, তাকে হারানোর পর

আর কীভাবে খুঁজে পাব আমি ?'

অনিবার্য বিচ্ছেদের মতো এই খোঁজ তো চিরকালীন। আত্মমগ্ন চেতনা বিশ্বপ্রকৃতির এক কোণায় দাঁড়িয়ে দেখে জগতকে, জীবনকে। 'জগৎ', 'দ্রষ্টা' কবিতাগুলিতে ছড়িয়ে থাকে তেমনই কিছু দৃশ্যপট। নাতিদীর্ঘ কবিতাগুলি দীর্ঘ সময় স্তব্ধ করে রাখে পাঠককে। যে কবির কাছে 'ভালোবাসা' আসলে 'নিজেকেই চিনতে শুরু করা' তিনি স্বচ্ছন্দে পেরিয়ে যান কামনার একান্ত নিভৃত বিপজ্জনক বাঁক। গভীর আসক্তি ও আশ্লেষে ডুবে থাকা মানবসত্তার আত্মানুসন্ধান চলতে থাকে। কবির কলম আঁকড়ে থাকে সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের বহমানতা। কবিতাগুলি যেন সেই দীর্ঘ যাত্রাপথেরই এক এক অংশ যা নিরন্তর প্রবহমান । জীবনের সঙ্গে সমান্তরালে বাঁচে কবিতা‌। তার সত্যে ,মিথ্যায়, ত্রুটিতে, অসম্পূর্ণতায়। তাই কোনো সৃজনই স্বয়ম্ভু, সম্পূর্ণ নয়। নিজের সৃজনই স্রষ্টাকে স্বস্তি দিতে পারে না‌। এই অসম্পূর্ণতা আর অতৃপ্তিই আমাদের চিরকালীন নিয়তি। এমনই সব সহজ সত্যের উপর দাঁড়িয়ে আছে " নগ্নতা কিংবা নিজস্ব জ্যামিতি"। অবয়বহীন, আবরনহীন মনকে  বিশ্লিষ্ট করতে করতে এগিয়েছেন কবি। বিপন্ন 'আমি'র সে এক নিদারুণ যাত্রাপথ।অথচ সে পথের বাঁকে বাঁকে আছে জীবনকে আবিষ্কার করার , উপলব্ধি করার এক নিঃশব্দ আনন্দ। পাঠক মন মুক্তি পায় মহাশূন্যের ব্যপ্তিতে। চেনা প্রেম, যৌনতা ও সম্পর্কগুলির উপর নতুন পরিচয়ের আলো এসে পড়ে...জ্যামিতিক ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, বিন্দু থেকে নিঃসীম বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে পাঠক...

" মানুষ কেন কখনোই জ্যামিতির অর্থ বোঝেনি,

সে এই রহস্যভেদ করতে পারেনি কখনোই--কেন কিছু

জ্যামিতিক ধারণাই জগৎকে পালটে দেয় বারবার!

কিংবা ছিল এক মহাজাগতিক খেলা-- যা

সামান্য ক-টি ত্রিভুজ, চতুষ্কোণ,বহুভুজ...গোলকের

সমাহারেই ঘনিয়ে তোলা !

খসে পড়ার আগে মৃত্যুর কাছে দাঁড়াই,

ব্যক্ত হওয়ার আগে সৃষ্টির কাছে দাঁড়াই...

যা কিছু চলমান, যা কিছু ধ্বংসের পথে--

নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আগে আমি একটা শূন্যের থেকে

আরেকটা শূন্যের দিকে পা বাড়াই আর তখনও

একটা কুঞ্চিত রেখায় ঝুলতে থাকি।'

(জীর্ণ ত্রিভুজ কিংবা নিজস্ব জ্যামিতি)

কবিতার পাঠ ও তার আলোচনা কখনও শেষ হওয়ার নয় । তবুও কোথাও থামতে হয়। এই বইয়েরই পূর্বোল্লিখিত একটি কবিতা জানিয়ে দেয় 'সব কিছুকেই যা সুন্দর করে তোলে--তা হল বিরতি। 'যে কবিতাগুলির পাঠানুভূতি ব্যক্ত করলাম এখানে তা ব্যতিরেকেও আরও কিছু আশ্চর্য সুন্দর ভাবনা কবিতার বিন্দুতে মিলিত হয়ে বইটিকে অনন্য করে তুলেছে। পাঠক আবিষ্কার করুক সেগুলিকে...তবে' শেষ হয়ে হইল না শেষ' এর মতো দুটি কবিতার ভালোলাগা পংক্তি উদ্ধৃত করার মানবিক আসক্তিটুকুকে অগ্রাহ্য করতে পারলাম না...

"একবার নিজের জীর্ণ আঙুলের দিকে তাকাই, তারপর

আবারও এগোতে থাকি।

কখন যে পথটা ফুরিয়ে আসে! দেখি--

সামনে জ্বলজ্বল করছে একটা নক্ষত্র, আর তখনই

আমার জীর্ণতা দিয়ে স্পর্শ করি অসীমকে।

গাছেরাও বরফ সরিয়ে তাদের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে

আকাশের দিকে। (পথ)

 

'এই ব্রহ্মান্ডের যে-কোনো একটি পুব-পশ্চিম কিংবা

উত্তর-দক্ষিণ বরাবর লম্বা রাস্তা ;

আমি বেরিয়ে এসেছি একটা আয়না থেকে--

যা কেবল নিজের মনের কুঞ্চনরেখাগুলোই ধরিয়ে দেয়,

তোমার জন্য গোপন কান্নাকেও;

আমি বেরিয়ে এসেছি যে-কোনো উপেক্ষা থেকে।' (আমি বেরিয়ে এসেছি একটা রাস্তায়)

 

এইসব উপেক্ষা, অপমানের পথ আগলে দাঁড়িয়ে থাকে কবিতা, আমাদের আশ্রয় হয়ে...