সান্তাড়দের পরম্পরাগত বিচার ব্যবস্থার গঠন কাঠামো

লিখেছেন - সুব্রত টুডু (অতিথি অধ্যাপক,সাঁওতালি মাধ্যম দর্শন বিভাগ, বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়)।

সান্তাড়রা নিজস্ব এবং স্বতন্ত্র এক পরম্পরাগত শাসন ব্যবস্থার দ্বারা ব্যক্তিজীবন ও সমষ্টিজীবন পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হন। এই পরম্পরাগত শাসন ব্যবস্থার নাম হল মাঁঝি ব্যবস্থা বা পঞ্চজন ব্যবস্থা। ব্যাপক অর্থে মাঁঝি ব্যবস্থারই অপর নাম হল রাষ্ট্রব্যবস্থা। তাঁদের এই শাসন ব্যবস্থাকে নিজস্ব ও স্বতন্ত্র বলা হয়েছে এই জন্য যে, এটি সারিধরমের ধর্মগ্রন্থ জমসিম বিন্তি ভিত্তিক যে সকল অলিখিত বিধি বিধান নির্দিষ্ট রয়েছে সেই বিধি বিধান বা অনুশাসন অনুসারে পরিচালতি ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ জমসিম বিন্তি ভিত্তিক সান্তাড়দের শাসনব্যবস্থায় নিজস্ব পরম্পরাগত সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় বিধান ও প্রতিবিধান রয়েছে। তাঁদের এই পরম্পরাগত মাঁঝিব্যবস্থা তথা রাষ্ট্রব্যবস্থায় একদিকে যেমন প্রশাসনিক বিভাগ রয়েছে, অন্যদিকে তেমনি বিচার বিভাগও রয়েছে।

সান্তাড়দের যে পঞ্চজন গ্রামীণ ব্যবস্থার কথা আমরা জেনেছি সেই মড়ে হড় বা পঞ্চজন শাসন ব্যবস্থার বহুবিচিত্র কার্যাবলীর মধ্যে অন্যতম একটি কাজ হল বিচারকার্য। তাঁরা একদিকে ধর্মীয়-সামাজিক-সাংস্কৃতিক দায়িত্ব ও কার্যাবলী পালন করেন ও অপরদিকে প্রশাসনিক এবং বিচার বিভাগীয় কার্য পরিচালনা করেন। বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁদের পরম্পরাগত ত্রিস্তরবিশিষ্ট বিচারালয় বা পরিষদ রয়েছে। তাঁদের ত্রিস্তরবিশিষ্ট বিচার ব্যবস্থার প্রথম পর্যায়ের বিচার ব্যবস্থা হল পঞ্চজন বিচার ব্যবস্থা এবং এর জন্য একটি পরিষদ রয়েছে যার নাম হল মাঁঝি বাইসি বা মাঁঝি পরিষদ। সান্তাড়রা বিচারালয় বা পরিষদকে বাইসি বলেন। মাঁঝিব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা অপর দুটি অর্থাৎ দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের বিচারালয় হল পারগানা বাইসি বা পারগানা পরিষদ এবং ল-বির বাইসি বা ল-বির পরিষদ।  মাঁঝিবাইসি এবং মাঁঝি বিচারালয় হল সকল পরিষদের আদি, মৌল এবং ভিত্তিস্বরূপ। মাঁঝি বাইসিতে গ্রামের মাঁঝি তথা মাঁঝিহাড়াম, পারগানা বাইসিতে পারগানা এবং ল-বির বাইসিতে সেঁন্দরা নায়কে সভাপতিত্ব করেন। মাঁঝি বিচারালয় বা পরিষদটি প্রতিটি সান্তাড় গ্রামে বিদ্যমান এবং এটি প্রত্যেক গ্রামের মাঁঝি হাড়ামের সভাপতিত্বে গ্রামের মাঁঝিথানে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এখানে উক্ত পাঁচজন পদাধিকারী ব্যক্তিগণ এবং গ্রামের প্রতিটি পরিবারের প্রধান অথবা প্রাপ্ত বয়ষ্ক পুরুষ অংশগ্রহণ করে থাকেন। পারগানা বাইসির ক্ষেত্রে কতকগুলি গ্রামের মাঁঝিদের নিয়ে পারগানা একটি পারগানা বাইসি বা পরিষদ গড়ে তোলেন এবং তাঁর সহকারী হিসেবে একজন দেশ-মাঁঝিকে নিযুক্ত করেন। ডব্লিউ. জি. আর্চার তাঁর ট্রাইবাল ল অ্যান্ড জাস্টিস গ্রন্থে বলেছেন যে, পাঁচজন মাঁঝি তথা পাঁচটি গ্রাম নিয়ে একটি পারগানা পরিষদ গঠিত হয়ে থাকে। যদিও পাঁচটির অধিক গ্রামের মাঁঝি নিয়েও পারগানা পরিষদ গঠিত হতে পারে। পারগানা বাইসিতে পারগানার অধিনে থাকা সমস্ত গ্রামের জনসাধারণ পরিষদের বিচারকার্যে অংশগ্রহণ করেন এবং সহযোগিতা করেন। এই দুটি পরিষদের ঊর্ধ্বে আরও একটি সর্বোচ্চ, চূড়ান্ত বিচারালয় বা পরিষদ রয়েছে যেটি হল ল-বির পরিষদ। এই ল-বির পরিষদ বিভিন্ন নামে পরিচিত যথা – ল-মহল, ল-বির সেঁন্দরা, সেঁন্দরা বাইসি ইত্যাদি।  

সান্তাড়রা বিচারকার্য শুরু করার প্রারম্ভে সম্মিলিত ও উপবিষ্ট সকলের মাঝখানে একটি জলপূর্ণ ঘটি স্থাপন করেন। জলপূর্ণ ঘটি স্থাপনের প্রতিকী অর্থ হল বিচার সর্বদাই শান্তিমূলক হবে। অর্থাৎ বিচার কার্যের প্রধান লক্ষ্য হবে সমস্যার বা ঘটনার শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসা করা। কখনই কারোর ধ্বংস বা বিনাশ কাম্য নয়, বরং শান্তি প্রতিষ্ঠাই হল প্রধান লক্ষ্য। বিচার বিভাগীয় অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল সকলেই মাটিতে বসবেন অথবা যদি চাটাই থাকে তাহলে সকলেই চাটাইয়ের উপরে বসবেন। এখানে সকলেই সমান বলে গণ্য হন এবং একজন ব্যক্তির বক্তব্যকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। মাঁঝি, পারগানা বা সেঁন্দরা নায়কে সভাপতিত্ব করেন ঠিকই, কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সকলের মতামতই গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয়ে থাকে।

মাঁঝি বাইসিতে মাঁঝির সভাপতিত্বে উক্ত পাঁচজন পদাধিকারী এবং গ্রামের প্রতি পরিারের প্রবীণ অথবা প্রাপ্ত বয়ষ্ক পুরুষদেরা বিচারকার্যে অংশগ্রহণ করে গ্রামীণ ও সামাজিক সমস্ত ধরণের সমস্যা ও বিষয়ের আলোচনা ও তার মীমাংসা দ্বারা তাঁরা একটি সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হন। বিশেষতঃ তাঁরা মূল্যবোধ, নৈতিক দায়-দায়িত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা পরম্পরাগত বিধান ও প্রতিবিধানের সাহায্যে বিচার কার্য সম্পাদন করে থাকেন। এই মাঁঝি বাইসি গ্রাম প্রশাসনের জন্য বিধি প্রণয়ন থেকে শুরু করে সাধারণের কল্যাণের স্বার্থে প্রথাগত বিধি প্রয়োগ করে থাকে। যদি কেউ আচরণবিধি ভঙ্গ করে বা প্রথাগত নিয়ম লঙ্ঘন করে তাহলে তার বিরুদ্ধে মাঁঝি পরিষদ আইনি ব্যবস্থার প্রয়োগ করে থাকে।

মাঁঝি পরিষদে যে সকল সমস্যা বা বিষয়ের সমাধান হয় না, সেগুলি উচ্চ পরিষদ তথা পারগানা পরিষদে উত্থাপিত হয়। এখানেও উপরি উক্ত বিধান প্রতিবিধানের নিরিখে পারগানা পরিষদ অধীনস্ত গ্রামগুলির সর্বসাধারণের কল্যাণের স্বার্থেই বিচার করা হয়। এখানে পরিষদে অংশগ্রহণকারী সকল ব্যক্তির সম্মতি থেকে একটি সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

পারগানা পরিষদে যে সকল সমস্যার সমাধান হয় না, সেগুলি সর্বোচ্চ পরিষদ তথা ল-বির পরিষদে উত্থাপিত হয়। এখানে পদাধিকারী ব্যক্তিবর্গ ও জনসাধারণ সকলেই সমমর্যাদার সাথে একই ভূমিতে উপবিষ্ট হন। তবে, এখানে পদাধিকারী ব্যক্তিবর্গের তুলনায় সাধারণ ব্যক্তিগণই সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের অধিকারী বলে পরিগণিত হন এবং তাঁদের গুরুত্বই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এখানে পদাধিকারী ব্যক্তিবর্গ কেবলমাত্র সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে জনসাধারণকে সাহায্য করেন।    

(কৃতজ্ঞতা - দেশব্রতী পত্রিকা।)