ভারতের প্রত্নসভ্যতা

হোমো সেপিয়েন্সরা আজ থেকে তিন লক্ষ বছর আগেও আফ্রিকায় থাকত, এই তথ্য জানা গেল মরক্কোর জেবেল ইরহুড গুহা থেকে পাওয়া কিছু ফসিল বিশ্লেষণ করে। এর আগে আমাদের ধারণা ছিল হোমো সেপিয়েন্স এর বয়স দু লক্ষর কাছাকাছি হবে। জেবেল ইরহুড তাকে আরো একলক্ষ বছর বাড়িয়ে দিল।

এই তিন লক্ষ বছরের ইতিহাসের বেশিরভাগ সময়টাই সে আফ্রিকায় কাটিয়েছে। যাকে আফ্রিকা থেকে প্রথম সফল পরিযান বা মাইগ্রেশান বলা হয়, সেটা আজ থেকে সত্তর হাজার বছর আগেকার ঘটনা। এটি প্রথম সফল পরিযান, কিন্তু পরিযানের প্রথম চেষ্টা নয়। সেটা ঘটেছিল এরও প্রায় এক লাখ বছর আগে। আজ থেকে এক লাখ আশি হাজার বছরের পুরনো হোমো সেপিয়েন্স এর ফসিল পাওয়া গেছে ইজরায়েলের উত্তরাংশে। তবে এই পরিযানের চেষ্টা সফল ছিল না। সে যাত্রায় তারা আবিশ্ব ছড়িয়ে পড়তে পারে নি। আফ্রিকা সংলগ্ন অঞ্চলের থেকে খুব বেশি দূরে তারা যায় নি।

এর এক লাখ বছর পরে যে বিখ্যাত পরিযানটি ঘটল তা কিন্তু আবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। আজ থেকে সত্তর হাজার বছর আগের এই পরিযানটিকেই বলা হয় আউট অব আফ্রিকা।

আফ্রিকার এরিত্রিয়া এবং দিজিবৌতি অঞ্চল থেকেই যতদূর সম্ভব শুরু হয়েছিল সত্তর হাজার বছর আগের এই পরিযান। ইয়েমেনের মধ্যে দিয়ে, লোহিত সাগরের দক্ষিণ দিক দিয়ে তারা এগিয়ে চলল এবং ভারতে এসে পৌঁছাল সম্ভবত পঁয়ষট্টি হাজার বছর আগে। সমুদ্র তীর ধরেই তারা এগিয়েছিল এটাই জনপ্রিয় মত। কেউ কেউ মনে করেছেন সমুদ্র তীর ধরে এগনো ছাড়াও হিমালয়ের দিকে কোনও কোনও দল গিয়েছিল। ভারতে এসে এই হোমো সেপিয়েন্সরা মুখোমুখি হল অন্যান্য মানব প্রজাতির সাথে। মধ্য এবং দক্ষিণ ভারতে এই মানব প্রজাতিদের বসবাস ছিল। ভারত থেকে এই পরিযায়ীদের একটা অংশ আরো এগিয়ে গেল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, পূর্ব এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার দিকে।

ষাট থেকে চল্লিশ হাজার বছর আগের সময়সীমার মধ্যে হোমো সেপিয়েন্স মধ্য এশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ল। চল্লিশ হাজার বছর আগে নিয়ান্ডার্থালদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে গেল। তবে তার আগেই হোমো সেপিয়েন্স এর সাথে তাদের শারীরিক সংসর্গ হয়েছিল। আজকে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যেই অন্তত ২ শতাংশ নিয়ান্ডার্থাল জিন পাওয়া যায়। মেলানেশিয়, পাপুয়ান এবং আদিম অস্ট্রেলিয়দের মধ্যে এর পরিমাণ খানিকটা বেশি। ৩ থেকে ৬ শতাংশ। নিয়ান্ডার্থালদের শেষ অংশটি সম্ভবত স্পেন ও পর্তুগালের দক্ষিণ অংশে বসবাস করত।

হোমো সেপিয়েন্স আমেরিকায় গেছে সবচেয়ে শেষে। আজ থেকে ষোল হাজার থেকে চোদ্দ হাজার বছর আগে রাশিয়া থেকে তারা আমেরিকায় পৌঁছেছিল।

চলে আসা যাক ভারতের কথায়। পঁয়ষট্টি হাজার বছর আগে হোমো সেপিয়েন্স এর পরিযায়ী দলটি ভারতে ঢুকে পড়েছিল। আজ থেকে পঁয়তাল্লিশ হাজার থেকে কুড়ি হাজার বছর আগেকার সময়সীমার মধ্যে তাদের পাথরের ব্যবহার ক্রমশ উন্নত হতে থাকে, নানা ধরনের ক্ষুদ্র প্রস্তরের জিনিসপত্র তারা বানাতে থাকে এবং তাদের জনসংখ্যাও বাড়তে থাকে। মধ্য এবং পূর্ব ভারতেই জনসংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। গোটা পৃথিবীর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়াই তখন সবচেয়ে জনবহুল ছিল বলে মনে করা হয়।

আজ থেকে ন হাজার বছর আগে মেহেরগড়ে প্রথম চাষের প্রমাণ পাওয়া যায়। বার্লি আর গমের চাষের প্রমাণ পাওয়া গেছে। আগের চেয়ে পশুপালন যে বিস্তৃত হয়েছিল তারও প্রমাণ মিলেছে। মেহেরগড়ে যে চাষাবাদ ও গ্রামীণ সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল এই খবর পুরাতাত্ত্বিকরা অনেকদিন ই আমাদের জানিয়েছেন। যে খবরটি অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক ও চমকপ্রদ তা হল উত্তর প্রদেশের সন্ত কবীর নগর জেলার লহুরাদেওয়া অঞ্চলে আজ থেকে প্রায় ন হাজার বছর আগে ধানচাষের তথ্য। উত্তর গাঙ্গেয় সমভূমিতে বুনো ধান আর কর্ষিত ধান নিয়ে মতভেদ বিতর্ক আছে। তবে কৃষির প্রাথমিক পরীক্ষা নিরীক্ষা যে মেহেরগড় অঞ্চলটিতেই শুধু আবদ্ধ ছিল না, এমন অনুমান ক্রমশ জোরালো হচ্ছে।

আজ থেকে প্রায় নয়/ সাড়ে নয় হাজার বছর আগে যাযাবর শিকারী মানুষ মেহেরগড় অঞ্চলে কৃষিকাজ ও পশুপালন আরম্ভ করে ও স্থায়ী গ্রামীণ সভ্যতা গড়ে তোলে। বালুচিস্তানের বোলান উপত্যকায়, ইরান ও আফগানিস্তান সীমান্তের কিছুদূরে বোলান নদীর ধারে মেহেরগড় অবস্থিত। ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত দীর্ঘ বারো বছর ফরাসী প্রত্নতাত্ত্বিকদের একটি দল পাকিস্তানের মাটিতে এই খননকাজ চালিয়েছিলেন। পরে ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সাল অবধি আবার এখানে খননকাজ চালানো হয়।

মাটি খুঁড়ে এই এলাকায় সাতটি সভ্যতা স্তর পাওয়া গেছে। প্রথম বা সর্বপ্রাচীন স্তরটি সাড়ে নয় থেকে আট হাজার বছর আগেকার। দ্বিতীয় স্তরটি আট হাজার বছর ও তৃতীয় স্তরটি সাড়ে ছয় হাজার বছরের প্রাচীন। প্রথম স্তরে মাটির ইঁটের তৈরি বাড়ি পাওয়া গেছে। সে সময়ে তারা ছোট তীক্ষ্ণ পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার করত। এরকম অসংখ্য হাতিয়ার এই স্তরে পাওয়া গেছে। শস্য পেশাইয়ের পাথর থেকে অনুমান করা হয় তারা খাবার রান্না করে খেত। মৃতদেহ কবর দেওয়া হত। একধরনের বিশেষ মাটি তারা সেই কবরে দিত পারলৌকিক সংস্কারের অঙ্গ হিসেবে। কবরের মধ্যে পাথর, সামুদ্রিক ঝিনুকের নেকলেস পাওয়া গেছে। লাপিস লাজুলিও আবিষ্কৃত হয়েছে। এই লাপিস লাজুলি সম্ভবত আসত আফগানিস্থান বা উত্তর বালুচিস্থানের চাঘতাই পার্বত্য এলাকা থেকে। সামুদ্রিক ঝিনুকের জন্য তাদের নিশ্চয় দূর বাণিজ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল। সবচেয়ে কাছের সমুদ্রতট মাকরানের দূরত্ব এই এলাকা থেকে অন্তত ৫০০ কিলোমিটার। মেহেরগড়ের প্রাচীনতম স্তরটিকে ক ও খ দুটি উপস্তরে ভাগ করা হয়েছে। খ উপস্তরটি থেকে অনেক বড় আকারের কবরখানা পাওয়া গেছে যেখানে পাশাপাশি দেড়শটি কবরের অস্তিত্ব ছিল। তাদের পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মেও এই দ্বিতীয় উপস্তরে কিছু পরিবর্তন এসেছিল। প্রথমে খোলা প্রকৃতিতে মৃতদেহ রেখে দেওয়া হত। তারপর বেশ কিছু মৃতদেহের হাড় সংগ্রহ করে একত্রে কবর দেওয়া হত।

দ্বিতীয় প্রাচীন স্তরটি আট হাজার বছর আগে থেকে সাড়ে ছয় হাজার বছরের পুরনো। প্রাচীনতম স্তরটিতে মাটির তৈরি জিনিসপত্র পাওয়া যায় নি। কিন্তু এই দ্বিতীয় প্রাচীন স্তরের প্রথম উপস্তরটিতেই মাটির তৈরি জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। তৃতীয় উপস্তরটিতে কুমোরের চাকের তৈরি মাটির জিনিসের সন্ধান মিলেছে। দ্বিতীয় স্তরে তামার তৈরি কয়েকটি জিনিসেরও সন্ধান পাওয়া গেছে, তবে মেহেরগড়ের তৃতীয় স্তরটি থেকেই প্রকৃতপক্ষে তাম্র যুগের সূচনা। সাড়ে ছয় হাজার বছর আগে এই স্তরটির সূচনা হয়েছিল। কুমোরের চাকের তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার এই সময় শুধু অনেকটাই বেড়েছিল তাই নয়, সেগুলির মধ্যে নানা ধরনের বৈচিত্র্যও দেখা যায়। সেগুলির গায়ে নানা ধরনের অলংকরণও করা হয়েছিল। তিনটি উনুন সমৃদ্ধ মাটির জিনিস তৈরির একটি জায়গাও এই স্তর থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। মেহেরগড় সভ্যতার প্রাচীনতম স্তরটি থেকে শস্যাগারের সন্ধান পাওয়া গেছে। তৃতীয় স্তরে বহু কক্ষ বিশিষ্ট শস্যাগারের সন্ধান মিলেছে। চাষাবাদের যথেষ্ট প্রসারের প্রমাণ পাওয়া যায়। অসংখ্য ধরনের গাছপালা/ শস্যের সন্ধান মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে। প্রথম দুটি স্তরে প্রধান শস্য ছিল বার্লি। গমও ছিল গুরুত্বপূর্ণ শস্য। তৃতীয় স্তর থেকে গমই প্রধান শস্য হয়ে ওঠে। অনেক ধরনের গমের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে কুল ও খেজুর ফলের বীজ। অনেক ধরনের তুলোর বীজও পাওয়া গেছে। চাষের জন্য শীতকালীন বৃষ্টি এবং সেচের ওপর নির্ভর করতেন চাষীরা। কাঠের হাতলওয়ালা পাথরের তৈরি কাস্তে চাষের কাজে ব্যবহার করা হত।

মেহেরগড়ের প্রথম স্তরে হরিণ, সম্বর, নীল গাই, বুনো গাধা ইত্যাদি বন্য পশুর আধিক্য। পরের স্তরগুলি থেকে বন্য পশুর বদলে গৃহপালিত পশুর হাড়ের আধিক্য দেখা যায়। বোঝা যায় পশুপালন ক্রমশ বেড়েছিল। গৃহপালিত পশুর মধ্যে ছিল ভেড়া, ছাগল, গরু, মোষ। তৃতীয় স্তরের সময়কাল থেকে দাঁতের গঠনে পরিবর্তন আসে। সম্ভবত খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনই ছিল এর কারণ।

চতুর্থ স্তরে এসে যে সমস্ত ঘরবাড়ি পাওয়া গেছে সেগুলো অপেক্ষাকৃত বড় আকারের। বাড়ির মধ্যেকার এক একটি ঘর চওড়া দেওয়াল ও দরজা দিয়ে আলাদা করা। এই পর্বে যে মাটির তৈরি জিনিসপত্র পাওয়া গেছে সেগুলি বহুবর্ণ চিত্রিত। এই স্তরেই সন্ধান পাওয়া গেছে টেরাকোটার তৈরি উন্নত নাসা এক নারী মূর্তির। পঞ্চম স্তরে যে ধরনের মাটির জিনিসপত্র পাওয়া যায়, তা চতুর্থ স্তরের মতোই। কিন্তু ষষ্ঠ স্তরে এসে আবার নতুন ধরনের মাটির জিনিসের সন্ধান পাওয়া যায়। পিপল পাতা থেকে পাওয়া লাল রঙে এই পর্বের অনেক মাটির জিনিসকে রাঙানো হয়েছিল। এই স্তরে টেরাকোটার তৈরি অনেকগুলি নারী মূর্তি পাওয়া গেছে। তাদের কেশসজ্জা ও ভারী বক্ষ হল লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।

মেহেরগড়ের তৃতীয় স্তরটির সমকালীন সময়ে বোলান পাস এর অন্যদিকে কোয়েত্তা উপত্যকায় হানা নদীর ধারে কিলি গুল মহম্মদ অঞ্চলে গড়ে ওঠে আরেকটি সভ্যতা কেন্দ্র। ১৯৫০ সালে প্রত্নতত্ত্ববিদ ওয়াল্টার এ ফেয়ারসার্ভিস এই অঞ্চলে প্রথম খননকাজ চালিয়েছিলেন। এর প্রাচীন স্তরটি প্রায় সাড়ে ছয় হাজার বছরের পুরনো। তবে তারও কিছু আগে এখানে জনবসতি গড়ে উঠেছিল বলে অনুমান করা হয়। প্রথম দিকে এরা যাযাবর ই ছিল, পরে মাটির তৈরি বাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করে। চারটি স্তরে কিলি গুল মহম্মদ সভ্যতাকে ভাগ করা হয়। তৃতীয় স্তরে এসে পাওয়া যায় তামার তৈরি জিনিসপত্র। তৃতীয় স্তরেই কালো ও লাল রঙের জ্যামিতিক নক্সা আঁকা কুমোরের চাকের তৈরি জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। এর আগের দ্বিতীয় স্তর থেকে পাওয়া মাটির জিনিসপত্র ছিল হাতে তৈরি। কিলি গুল মহম্মদ সভ্যতার চতুর্থ স্তরটি ডাম্ব সাদাত সভ্যতার প্রাচীনতম স্তরটির সমসাময়িক। উভয় ক্ষেত্রেই উল্লিখিত স্তরে যে পোড়া মাটির কাজ পাওয়া গেছে তা পাতলা এবং খুব ভালো ভাবে পোড়ানো। মাটির পাত্রগুলো সাধারণভাবে কালো রঙের বিভিন্ন জ্যামিতিক আকারের চিত্রে চিত্রিত। কখনো কখনো লাল রঙও দেখা যায়। ডাম্ব সাদাত প্রত্নক্ষেত্রের দ্বিতীয় স্তরটি পাঁচ হাজার বছরের পুরনো এবং এটিই ছিল এই সভ্যতার মধ্যবিন্দু। এখানে এই স্তরে বহু কক্ষ বিশিষ্ট ঘর দেখা গেছে। এখানে প্রাপ্ত পোড়ামাটির জিনিসপত্রের মধ্যে রান্না ও গৃহস্থালির সরঞ্জাম ছাড়াও গৃহপালিত বিভিন্ন পশু এবং নারীমূর্তি পাওয়া গেছে। টেরাকোটার নারীমূর্তিগুলি মেহেরগড় সভ্যতার ষষ্ঠ স্তরে প্রাপ্ত নারীমূর্তিগুলির মতোই। বাড়িঘরের ছোট ছোট টেরাকোটার প্রতিরূপও এখানে পাওয়া গেছে। একটি ছুরি পাওয়া গেছে তার ধারটি তামার তৈরি।

১৯৪৮ থেকে ১৯৫৭ সালের মধ্যে কালাত মালভূমি অঞ্চলে বেত্রিস দ্য কার্দি তাঁর প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালান। এই অনুসন্ধান থেকে আঞ্জিরা এবং শিয়া দাম্ব অঞ্চলে প্রত্নক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। এখানে পাঁচটি স্তরে সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে। প্রাচীনতম স্তরটি কিলি গুল মুহম্মদ সভ্যতার দ্বিতীয় স্তরের সমসাময়িক। এছাড়াও ভারতীয় উপমহাদেশ ও তার নিকট পশ্চিমের প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নস্থলগুলির মধ্যে আছে দক্ষিণ পূর্ব আফগানিস্তানের মুণ্ডিগাক, বালুচিস্তানের ঝোব লোরালাই, আনাম্বার উপত্যকার সুর জঙ্গল, দাবার কোট, রানা ঘুনডাই। মুণ্ডিগাককে আজ থেকে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার বছরের পুরনো প্রত্নক্ষেত্র বলে মনে করা হয়। রানা ঘুনডাইকে আরো প্রাচীন, প্রায় সাড়ে ছয় হাজার বছরের পুরনো সভ্যতা বলে মনে করা হয়। রানা ঘুনডাইতে প্রাপ্ত এক পশুর দাঁতকে কেউ কেউ ঘোড়ার দাঁত বলে মনে করেছেন। অনেকে এটা মানতে চান নি, বলেছেন ঘোড়া নয়, এটা গাধার দাঁত। ডেরা ইসমাইল খান জেলায় সিন্ধুর উপনদী গোমালের ধারে বেশ কয়েকটি প্রত্নক্ষেত্র পাওয়া গেছে। গুমলা এবং রহমান ঢেরি এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এখানে যে সব মাটির জিনিস পাওয়া গেছে তার সাথে সেন্ট্রাল এশিয়ার তুর্কমেনিস্তানে প্রাপ্ত জিনিসপত্রের সাদৃশ্য রয়েছে।

আজ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে হরপ্পা সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্রগুলোতে যখন উন্নত নাগরিক সভ্যতার বিকাশ ঘটছিল, তা কোনও আকস্মিক সভ্যতা ছিল না। চারপাশের এক বিস্তৃত অঞ্চলে হরপ্পা সভ্যতারও চার হাজার থেকে দু হাজার বছর আগে থেকে প্রবহমান গ্রামীণ কৃষি সভ্যতার ভিত্তির ওপরেই এই নাগরিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।

পঁয়ষট্টি হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে হোমো সেপিয়েন্স এর দলগুলি ভারতে এসে ছড়িয়ে পড়া ও বংশবৃদ্ধি করার পর্বটা চলতে থাকে। প্রায় পঞ্চান্ন হাজার বছর ধরে আর সেরকম কোনও উল্লেখযোগ্য পরিযান এর মধ্যে ভারতে হয় নি। পরিযানের নতুন অধ্যায় শুরু হল আজ থেকে ন হাজার বছর আগে। খ্রীষ্টপূর্ব সাত হাজার বছর আগে থেকে একটানা কয়েক হাজার বছর ধরে ইরানের জাগরোস অঞ্চল থেকে একটি পরিযান শুরু হয় দক্ষিণ এশিয়ার দিকে। ভারতে প্রবেশ করে তারা অন্তত ৪৭০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে তাদের বংশধারা ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছিল বলে জিন গবেষকরা মনে করেছেন। এরা কৃষিকাজ জানতো। এদের সঙ্গে স্থানীয় অধিবাসীদের সংমিশ্রণে দ্রাবিড় জাতি তৈরি হয়েছে এবং তারাই সিন্ধু সভ্যতার পত্তনকারী – এরকম একটি অভিমত অনেকেই প্রকাশ করেছেন।

হরপ্পা অঞ্চলে জনবসতির প্রাথমিক বিকাশ ঘটছিল আজ থেকে প্রায় সাড়ে সাত হাজার বছর আগে। অবশ্য তাম্র ব্রোঞ্জ যুগের যে সিন্ধু সভ্যতার কথা আমরা জানি এটি সেই পর্যায়ের কথা নয়। এই পরিণত হরপ্পান সভ্যতা ২৬০০ খ্রিষ্টপূর্ব নাগাদ বিকশিত হয়েছিল এবং তা মোটামুটি ১৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ স্থায়ী ছিল। এর আগেই বর্তমান ভারতের অন্তর্গত কালিবঙ্গান ও রাখিগরি এবং পাকিস্তানের বানোয়ালি ও রহমান ডেহরিতে খানিকটা সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে ওঠার প্রমাণ ছিল। ক্রমশ নতুন নতুন শহরে সভ্যতার প্রসার ও বিকাশ ঘটে। ধাতুর ব্যবহার শুরু হয়। উন্নত নগর পরিকল্পনা দেখা যায়। হরপ্পা সভ্যতার সবকটি অঞ্চল একটি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অধীনে আসে। একই ধরনের সিল, লিপি, চিহ্ন ও পরিমাপক সব জায়গায় ব্যবহৃত হতে থাকে।

হরপ্পা সভ্যতার প্রধান শহরগুলোর মধ্যে ছিল হরপ্পা, মহেনঞ্জোদাড়ো, কালিবঙ্গান, ধোলাবীরা, লোথাল, রাখিগরি, সুক্তাজেনদার, আলমগীরপুর, কোট ডিজি, চানহুদারো, সুরকোতদা প্রভৃতি। সিন্ধু এবং পাঞ্জাব এই সভ্যতার কেন্দ্রস্থল হলেও এর চারপাশে এই সভ্যতা ছড়িয়েছিল। সিন্ধু এবং তার শাখানদী উপনদীগুলো ছাড়াও ঘর্ঘর হরকার মতো নদী এই সভ্যতার বিকাশে সহায়ক হয়েছিল।

হরপ্পা সভ্যতার প্রায় সমসাময়িক আমুদরিয়া নদীর ধারে গড়ে ওঠা বিখ্যাত ব্যাকট্রিয়া – মার্জিয়ানা প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকার সভ্যতা, যার সময়কাল ২৩০০ থেকে ১৭০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ বলে চিহ্নিত হয়েছে। হরপ্পা সভ্যতার সমসাময়িক এই প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকার সঙ্গে হরপ্পার ব্যবসা বাণিজ্যর অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে।

খ্রীষ্টপূর্ব ৩৭০০ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতের নানা জায়গায় কৃষিকাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। পূর্ব রাজস্থান, দক্ষিণ ভারত, মধ্য ভারতের বিন্ধ্য অঞ্চল, পূর্ব ভারত এবং কাশ্মীরের সোয়াত উপত্যকায় কৃষিকাজ ছড়িয়ে পড়ার অনেক প্রমাণ আছে।

২০০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দ থেকে ১০০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কাল জুড়ে কাজাখ তৃণভূমি অঞ্চল থেকে পশুপালকদের কয়েকটি দল মধ্য এশিয়ার তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কাজাকিস্তান হয়ে ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ায় চলে আসে। একই সময়ে কৃষ্ণসাগরের আশেপাশের তৃণভূমি অঞ্চল থেকেও শুরু হয় ধারাবাহিক পরিযান। তারাই ইন্দো ইউরোপীয় ভাষাটি বয়ে নিয়ে আসে, যার প্রচলিত নাম আর্য ভাষা।

খ্রীষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দ থেকে যখন উত্তর ও পশ্চিম ভারতে এই পরিযায়ীরা আসছিলেন সেই সময়েই চিনা উৎস থেকে জন্ম নেওয়া পরিযায়ীদের দুটি তরঙ্গ পূর্ব ও উত্তর পূর্ব ভারতে চলে আসে। এদের একটি ধারা নিয়ে আসে অস্ট্রো এশিয়াটিক ভাষাগুলির প্রত্নরূপ, বিশেষ কয়েক ধরনের গাছগাছালি ও ধানের এক নতুন প্রজাতি। এরা একধরনের কৃষিবিপ্লবের মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল এবং তার ফলে তাদের জনসংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। গোটা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার জনবিন্যাস তারা অনেকটা বদলে দেয়।

উত্তর, পশ্চিম ও পূর্ব ভারতে খ্রীষ্ট পূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে নানা উৎসের এই ধারাবাহিক পরিযানগুলি যখন চলছিল তখন হরপ্পা সভ্যতার অন্তিম পর্ব। যার পতনের শুরু ১৯০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে এবং ১৩০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দের মধ্যেই হরপ্পা সভ্যতা বিলুপ্ত হয়।