ডেনিশ ভালন্যুর অ্যারাইভাল চলচ্চিত্রের একটি পাঠ

জীবনকে যদি প্রথম থেকে শেষ অবধি একবার ফিরে পাওয়া যেত তাহলে কি কিছু পরিবর্তন করতে? কতবার এই প্রশ্ন আমার মনে ঘুরেফিরে গিয়েছে তা বলার নয়। কি অদ্ভুত না? জীবনে কি দ্বিতীয় বার ঘুরে আসা যায়? পালটে ফেলা যায় উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট? বদলে নেওয়া যায় মুঠোয় ভরা হাত? কিন্তু আমরা তো জানি এক নদীতেই দুবার স্নান করা যায়না। সেই জল তো কবেই বয়ে গেছে মোহনায়। 

তবে হ্যাঁ, যদি একটি বার ফিরে পেতাম সেই ছোটবেলা তবে কয়েকটা মুহুর্ত আরো ভালো ভাবে বাঁচতাম। আরো শক্ত করে ধরে থাকতাম ছেড়ে যাওয়া হাত। "Maybe I'd say what I felt more often" । হয়তো আরো বেঁধে বেঁধে থাকতাম; কি জানি!
না, আমরা কেউ জানিনা। তাই হয়তো বেঁচে থাকাটা এত সুন্দর।
 
"অতীত- বর্তমান- ভবিষ্যত আসলে একই সঙ্গে উপস্থিত, একই সঙ্গে তারা ঘটে চলেছে। অতীত- বর্তমান- ভবিষ্যত বস্তুত একই সমতলে অঙ্কিত পরস্পরচ্ছেদী তিন বৃত্তের মতন"
[ নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা]। 
 
অ্যারাইভাল Denis Villeneuve এর অষ্টম  ফিল্ম। তাঁর সিনেমা যারা দেখেছেন জানেন তিনি রঙ ও ওয়াইড ল্যান্ডস্কেপ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালোবাসেন। ডুন, ব্লেড রানার 2049, এনিমি, প্রিজনার অসাধারণ সব সিনেমা উপহার দিয়েছেন তিনি।
টেড চিয়াঙের Story of your life  নামক নভেল্লা ওপর নির্মিত এই ছবিটি। গল্পটি শুরু হয় মহাকাশ থেকে আসা বারোটি ভিনগ্রহী জাহাজকে ঘিরে। পৃথিবীতে বারোটি জায়গায় হঠাৎ একদিন অবতীর্ণ হয় তারা কিন্তু  কোনোভাবেই পৃথিবীর মানুষ তাদের ভাষা ধরতে পারেনা।তাদের আসার কারণ কি এটাই হয়ে ওঠে মানুষের কাছে সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন। আর এরই হাত ধরে পর্দায় অবতারণা লুইসের।
লুইস ভাষাবিদ। ভাষার রকমফেরে যে মানুষকে  বোকা বানানো যায় এটা আমরা সবাই জানি। তিনি মানেন কোনো নতুন ভাষা শিখতে গেলে খুব দরকার একটা প্রাথমিক ছোঁয়া। আমরা কেউ শিশুর ভাষা শিখতে যাই কি? বরং তাকে আমাদের ভাষা শেখাই। তাতেই সে দ্রুত নতুন ভাষা তরতর করে বুঝে যায়। এই বোধটা প্রয়োজন ভাষা শিখতে গেলে। আর তাই লুইস ভিনগ্রহী হেপ্টাপডদের শেখাতে থাকে এক বিচিত্র ভাষা।
 ঠিক এই ভাষার দ্বারা পরিচালক প্রথম থেকে অতি সঙ্গোপনে দর্শকের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন একটি গল্প। যেন ছবির গল্প লুইসের স্মৃতি থেকে আসছে। যেন সে গল্প বলছে তার কন্যাটিকে। দর্শক বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়, সময় একটি সরলরৈখিক ঘটনা। অতীত,বর্তমান, ভবিষ্যত। পরপর আসছে। সেখানেও সেই ভাষার মারপ্যাঁচ। ঘুণাক্ষরেও টের পাইনা আসলে বর্তমান ও ভবিষ্যত simultaneously এগিয়ে চলেছে।
ছবির চমৎকার সাদা-কালো আবছায়া রেখা  একটা গভীর নেশা ধরায় দর্শকের মনে। মাঝে মাঝে মনে হতে পারে, কোনোমতেই এটা science fiction নয়; কিন্তু ঠিক কোন জনরা তে যে একে ফেলা যায় তা তর্কসাপেক্ষ। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে জোহান জোহানসন অনবদ্য রহস্যময়তা সৃষ্টি করেছেন। যেটি একই সঙ্গে মিলে গিয়েছে লুইসের বিষন্নতার সাথে, কখনো বা আমেরিকার ল্যান্ডস্কেপে। 
 
কোনো সিনেমা দেখে বা বই পড়ে অবাক যে হইনি আগে তা নয়। কিন্তু Arrival অদ্ভুত একটা জগৎ সৃষ্টি করে যেটা আমার ধারণাতীত ছিল। 
সিনেমা শেষ হতে বুঝতে পারি কি ভীষণ বোকা বনে গিয়েছি। এই গল্প এখনও শেষ হয়নি। বরং বলা যায় শুরুই হয়নি। আসলে Arrival এর কোন শুরু বা শেষ নেই। পুরো গল্পটাই একটা সার্কেল। সময় যেখানে non-linear এনটিটি।
Linguistic relativity র অদ্ভুত সুন্দর জগৎ। আমাদের ভাষায় এক, দুই, তিন শব্দের মাধ্যমে অর্ডার বোঝাই। Sapir কলেজের Benjamin Whorf বলেন আদিবাসী ভাষা Hopi র কথা। যেখানে First, second,third এইভাবে তারা কথা বলে। প্রথমটিতে সময় একটি বিরাট ভূমিকা পালন করছে। দ্বিতীয়টিতে তিনটি বস্তু একসাথেই বিরাজমান।
Sapir-Whorf থিওরি ঘুরেফিরে আসে Arrival এর মধ্যে বারেবারে। এর মাধ্যমেই লুইস একসময় এলিয়েনদের ভাষা শিখে যায়। তারই সঙ্গে গিফট হিসেবে পায় তাদের অ্যাডভান্স টেকনোলজি। ভাষাই তাদের weapon অর্থাৎ গিফট্ অর্থাৎ টাইম ট্রাভেল।
ভাষা যে এভাবে বিজ্ঞানের এত বড়ো ভেসেল হয়ে উঠতে পারে এটা বুঝতে পেরে চমকে উঠি। ইশ কোনোদিন ভাবিনি তো এভাবে। কি চরম বোকা বনেছি। প্রথমবার দেখে যাকে সহজ সাই ফাই মনে হয়েছিল। দ্বিতীয়বার কিংবা তৃতীয় বার দেখতে গিয়ে আরো বিপাকে পড়ে যাই। 
 
"Despite knowing the journey and where it leads, I embrace it"
লুইস তার সারাটা জীবন প্রথম থেকে শেষ অবধি দেখে ফেলেছিল কিন্তু সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তটাই পাল্টাতে চায়নি। Arrival এর এন্ডিং দেখায় লুইসের চয়েজ তাকে অমানুষিক দুঃখ এর মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাবে, কিন্তু সে তার শিশুটির মধ্যে খুঁজে নেবে সমস্ত উত্তর। কোথায় যেন শুনেছিলাম,
"What is grief if not love persevering?"
চমৎকার না! বৃত্তটা সম্পূর্ণ হয় এখানেই।
 
 
সাধারণত যেসব গল্প ধোঁয়াশায় ভরা হয়, মন থেকে ইচ্ছে করেনা তার সবটুকু ঢাকনা খুলে ফেলে এক্সপ্লোর করতে। একদমই নিজস্ব একটা বিশ্বাস। মনে হয় এই রহস্যময়তা বেশ ভাল। এর পাশে বসে থাকা যায়। Arrival এর শুরু থেকে শেষ অবধি একটা সুন্দর সহজতা আছে। সাদা কালো heptapods দের অবয়বের মত। যেখানে ১২ টা দেশ একত্রে চলার স্বপ্ন দেখে, মরনাপন্ন স্ত্রী এর কথায় রাষ্ট্রনায়ক যুদ্ধ আটকে দেয়। এই বিশ্বাসটা রাখতে ইচ্ছে করে। এই যে মানব মনের রহস্যময়তা তাকে অতিক্রম করে বিশাল জ্ঞানী অথবা চালাক সাজার কোনো ইচ্ছা মনে আসেনা। কিছু কিছু সিনেমা তাই থ্রিলারের মত প্রেডিক্ট করা যায়না। সবাই যেটা বুঝতে পারেনি সেই কোড ব্রেকিং এ মজা আছে অবশ্যই। কিন্তু সবার সঙ্গে এই competition সাজে না। Arrival কে তাই সরিয়ে রাখা যায় সবার থেকে দূরে। এই বোকামোয় কোনো দুঃখ নেই। আরো বারবার যেন ফিরে আসি এই রহস্যময়তার কাছে।
কারণ, কে না জানে, লুইসের মতো আমরাও তো জীবনের সমস্ত দুঃখ কষ্টগুলোকে খুব কাছ থেকে চিনি, বুঝি, জানি।
তাও, কী ভীষণভাবে বাঁচতে চাই। 
তাই না?