ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল ও ওয়াল্টার বেঞ্জামিন

বিংশ শতাব্দীর সূচনায় প্রধান পাঁচটি বৌদ্ধিক ধারা মোটামুটি পরস্পর বিচ্ছিন্ন ভাবে অগ্রসর হচ্ছিলো। জার্মান ভাববাদ, মার্কসবাদ, প্রতিভাসবিজ্ঞান, মনঃসমীক্ষণ, কাঠামোবাদ (ভাষাতত্ত্ব নির্ভর)।

পঞ্চাশ কিংবা ষাটের দশক থেকে ইউরোপের দর্শন, সাহিত্য, চিন্তা চেতনা, শৃঙ্খলায় নতুব নতুন দার্শনিকতার উদ্ভব ঘটলো যার মধ্যে আছে অস্তিত্ববাদ, সাংস্কৃতিক বস্তুবাদ, উত্তরআধুনিকতাবাদ। তবে একটি বড় ফাক রয়ে গেছে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে কিছু চিন্তাবিদ ও দার্শনিকদের আবির্ভাব ঘটেছিলো যারা অন্যান্য সকল চিন্তকদের থেকে অনেক টা ভিন্ন। সেই সব চিন্তকদের আগমন সমগ্র ইউরোপীয় সমাজ ও চিন্তার জগতকে আরোও আলোকিত করে। অনেক তাত্ত্বিকেরা বলেন যে তারা নাকি ভবিষ্যৎ দেখতে পারতেন (ঐ অর্থে ভবিষ্যৎ দেখা নয়) এরকমই একজনের নাম ওয়াল্টার বেঞ্জামিন যার সম্পর্কে তার একটি বইয়ের সম্পাদকীয় ভূমিকাতে হান্নাহ্ আরেনডট বলেছিলেন, "Hardly I can find anything where Walter Benjamin is not the critc of critique"

ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, যার সম্পর্কে লিখতে বসলে প্রায় ১০০০ পাতার দুটো  বই রচনা সম্ভব। বোহেমিয়ান, বেকার এক অর্থে,তীব্র প্রেমিক,বার বার ধাক্কা খাওয়া, নির্বাসিত, নাজি ক্যাম্পে বন্দি,আত্মহত্যার চেষ্টা আর সব শেষে আত্মহত্যা ; অনেকেই হয়ত তার জীবনে এইসব উপাদান খুঁজে পাবেন। লিখেছেন আত্মজীবনী মূলক লেখা,লিখেছেন সমালোচনা,একাডিমেক থিসিস,কবিতা,ছোট গল্প,বাচ্চাদের জন্য রেডিও নাটক ।লিখেছেন মহারথি গ্যেটে কে নিয়ে Elective Affiniteis ,অনুবাদ করেছেন শার্ল বোদলেয়ার,মার্সেল প্রুস্তের মত মহারথিদের লেখা। সর্ব প্রথম The Beginning নামের স্কুল ম্যাগাজিনে Ardor ছদ্মনামে প্রকাশিত হয় তার কিছু কবিতা আর প্রবন্ধ।তখন তিনি সেকেন্ডারির শেষ বর্ষে। ফ্রেইবার্গে থাকা কালীন অবস্থায় কান্ট এর Critique of Judgement আর শিলারের Aesthetic এর উপর বক্তৃতা শুনতে যেতেন। ফ্রেইবার্গে যখন দ্বিতীয় সেমিস্টারে পড়ছেন তখন তিনি হাইনরিখ রিকার্ট নামের এক নব্য-কান্টীয় দার্শনিকের লেকচার শুনতে যান।তার মন ভরাতে পারেনি রিকার্ট। চিঠি থেকে জানা যায়, “সামনে গিয়ে আমি বসি আর রিকার্টের বক্তব্যের মধ্যে আমার নিজের ভাবনাগুলো অন্বেষণ করি।সেমিনার শেষে আমি আর কেলার মারিয়ানবাদে যাই।আর সবশেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে আমাদের চিন্তার তুলনায় রিকার্ট এর চিন্তা একেবারেই ভোঁতা।"

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের আবির্ভাব নতুন করে এক দার্শনিক চর্চার মঞ্চ তৈরি করে, যেই মঞ্চের রয়েছে বিবিধ পরিচয়। আঠারো শতকের শেষ ভাগ থেকে উনিশ শতকের একদম শেষ ভাগ পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় একশো বছরে দর্শন চর্চার শ্রেষ্ঠ ভূখণ্ড ছিলো জার্মান ভূমি, যেখানে সূচিত হয়েছিলো আঠারো শতকের একদম শেষ ভাগে ও উনিশ শতকের গোড়ার একদম শুরুর দিকে বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন৷ জার্মান দেশ তথা তৎকালীন প্রাশিয়ার রাজনৈতিক কলকব্জা ও ব্যবস্থাবিধি দেখলে বোঝা যায় যে প্রাশিয়ান রাজতন্ত্রের মধ্যে থাকলেও জ্ঞান বিজ্ঞান ও দার্শনিক চর্চায় ছিলো বিশাল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। আধুনিক গবেষণা ও বিশুদ্ধ জ্ঞান উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর জন্ম তখনই। জার্মান বিখ্যাত কবি হাইনরিখ হাইনের on the history of religion and philosophy in germany তে সেই নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন কে মানবচিন্তার একটি ঐতিহাসিক কাল হিসেবে গণ্য করেছেন, তাইতো তিনি ফরাসি বিপ্লবের সাথে তুলনা দিয়ে দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টকে বলেছেন "Our Robespierre", যিনি দর্শন ও জ্ঞানতাত্ত্বিক জগতে এক ধরণের কোপার্নিকান বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন।  সেই জার্মান বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন যার উদর থেকে জন্ম নিয়েছিলো তিনটি মহান চিন্তাধারা, এক হলো জার্মান ভাবাদর্শ (German Ideology), আরেকটি হলো জার্মান রোমান্টিকবাদ (German Romanticism) যার মহানায়ক ছিলেন মহাকবি গ্যোতে এবং তৃতীয়টি হলো জার্মান জাতীয়তাবাদ (German Nationalism), যা ছিল একশো বছর ধরে চলা এক বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন এবং যার শুরুটা হয়েছিলো দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের হাত ধরে এবং বলা যায় শেষ টা হয়েছিলো দার্শনিক ফ্রিডরিখ নীটশের কলমের কালির কাগজকে শেষ চুম্বনের মধ্যে দিয়ে।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া পৃথিবীতে কোনো জ্ঞান চর্চা সম্ভব না, অন্তত প্রাতিষ্ঠানিক এবং সাংস্কৃতিক পরিসরে, যার উৎকৃষ্ট প্রমাণ জার্মানি। ১৮৭১ এর প্যারি কমিউনের পর থেকে প্রায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ হওয়া পর্যন্ত ইউরোপের সবচাইতে সংকটময় অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছিলো জার্মান ভূমি। সংকট যে খুব একটা কেটেছিলো তাও নয়, কিন্তু ১৯৩০ এর দশকের প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ বছর বাদে নতুন করে ফ্রাঙ্কফুর্টে এক ঝাঁক বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাবিদদের সমাগম ঘটে। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের প্রাতিষ্ঠানিক নাম ছিলো Institute for social research। এর লক্ষ্য ছিলো বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার জটিল পর্যালোচনা। কিন্তু এই পর্যালোচনা নিতান্তই একপাক্ষিক এবং একরৈখিক ভাবে নয়, বরং সেই পর্যালোচনার মূল প্রেক্ষাপট ছিলো সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিক পরিসর। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল ছিলো আধুনিক চিন্তাধারার প্রথম এনসাইক্লোপিডিয়া এবং দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, সাংস্কৃতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক সকল চিন্তাধারার জটিল ও নিখুঁত পর্যালোচনা। নতুন করে সমস্ত চিন্তা ও চিন্তাবিদদের লেখা কে বিশ্লেষণ করা, সমালোচনা করা ও পর্যালোচনা করা, নতুন ভাবে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা কে উপলব্ধি করার এক তীব্র প্রয়াস ছিলো এই স্কুল অব থটের চিন্তাবিদদের। পৃথিবীর সমস্ত স্কুল অব থটের সাথে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল অব থটের একটি বিশেষ পার্থক্য হলো, এই স্কুল অব থট কোনো নতুন তত্ত্ব তৈরি করতে ব্যস্ত নয়, বরং এর প্রাথমিক কাজ ছিলো তত্ত্বজগতের সমস্ত কিছুকে নতুন ভাবে ব্যাখ্যা করা, জটিল ভাবে পর্যালোচনা করা৷ প্রাথমিকভাবে থিওডর এডোর্নো ও ম্যাক্স হরখেইমারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুল অব থটে পরবর্তীতে যুক্ত হোন আরো অনেক প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ও দার্শনিক। যদিও ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত ছিলো মার্কসবাদ দ্বারা, কেননা তাদের সকল তাত্ত্বিক ও চিন্তাগত চর্চা ছিলো মূলত দুইটা লক্ষ্যে, এক হলো বিদ্যমান সমাজ কে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমাজতত্ত্ব যথেষ্ট নয় এবং সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আধুনিক যে পুজিতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তার যে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তাকে অস্বীকার না করে, আরো যৌক্তিক ভাবে সেগুলোর সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ভিত্তি পর্যালোচনা করা। এক্ষেত্রে মার্কসবাদ একটা গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা দৃষ্টি হিসেবে এই স্কুল অব থটের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিলো, কিন্তু শুধুই মার্কসবাদ নয়, বরং আরো যেসকল প্রতিষ্ঠিত এবং প্রকাশিত তাত্ত্বিক ও দার্শনিক চিন্তাধারা ও মতবাদ ছিলো সেগুলোকেও তারা ব্যবহার করেছে বিভিন্ন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের স্বার্থে। 

ইতিহাসবিদ পেরি এন্ডারসনের মতে পাশ্চাত্য মার্কসবাদী ধারার মধ্যে একমাত্র ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল ই হলো প্রথম অরাজনৈতিক মার্কসীয় বুদ্ধিবৃত্তিক গবেষণা কেন্দ্র। এডোর্নো, হরখেইমার, পলোক, হার্বার্ট মারকিউজ, এরিখ ফ্রম, ফ্রাঞ্জ নিউমান, এরা প্রত্যেকেই ছিলেন প্রাথমিক তাত্ত্বিক। কিন্তু পুরানো কথা ভুলে গেলে চলবে না। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান চর্চা অসম্ভব, আর তাই তো হিটলারের ভয়ংকর আগ্রাসনের মুখে পড়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের স্থানান্তর ঘটলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।

ওয়াল্টার বেঞ্জামিন সরাসরি ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সদস্য ছিলেন না কিন্তু তার সঙ্গে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের সদস্যদের ভালে সম্পর্ক ছিলো। তার পিএইচডি থিসিস The origin of german tragic drama, যেটা উনি ১৯২৫ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদানের লক্ষ্যে উপস্থাপন করেছিলেন। এডোর্নো, হরখেইমার, ব্লখ, লুকাচ দের সাথে তার চিঠিপত্র আদানপ্রদান হতো প্রচুর, এমনকি ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের যখন মার্কিন দেশে স্থানান্তর ঘটে, তখনো বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের কাছ থেকে ফান্ড পেতেন এবং নিয়মিত চিঠি আদানপ্রদান করতেন।

ছাত্র অবস্থায় বেঞ্জামিন খুব কম বয়সে স্কুল রিফর্ম আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে যান। লেখেন School reform, a cultural movement নামে এক প্রবন্ধ। ১৯১২-১৩ এর দিকে Sprechaal নামের এক সংগঠন খোলেন যাদের উদ্দেশ্য ছিল বিকেলের সাক্ষাৎকারে নন্দনতত্ত্ব আর নৈতিকা বিষয়াদি নিয়ে তর্ক বিতর্ক করা। ১৯১৫ সালে বন্ধুত্ব হয় শোলেমের সাথে যা তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত টিকে ছিল। এই শোলেম তাকে নানান ভাবে সহযোগিতা করে গেছেন সেটা আর্থিক কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে হোক। ১৯১৭ সালে শুরু করেন বোদলেয়ার অনুবাদ। টুকটাক দু একটা করে কবিতা। শেষ করলে দেখা গেলো তার স্বীকৃতি না পাওয়ার বেদনা। শেষে এমনও হয়েছে যে বেঞ্জামিন এই সব কবিতার অনুবাদ বইয়ের দোকানে গিয়ে আবৃত্তি করেছেন আলোচনা করেছেন। সেসব হয়ত পরে উঠে আসবে আপনা আপনি। তরুণ বয়েসেই তিনি লেখেন শিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি নিয়ে। নেতাদের কাজ কী, কেন। কেন ছাত্রদের জটিল দৃষ্টিভঙ্গির দরকার এসব আরো অনেক প্রশ্ন। তিনি সেই সময়ের বিশ্ববিদ্যালয় ও তার শিক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করেন এভাবে - “বিশ্ববিদ্যালয় হলো এমন এক জায়গা যেখানে অর্জনের চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যর্থতাই এখানে বেশি দেখা যায়”। এই অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য তিনি বলেন, ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক অবস্থান নির্ধারন করতে প্রয়োজন তাদের এক দার্শনিক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যাওয়া। দর্শন তথা জ্ঞানতত্ত্ব সম্বন্ধে বেঞ্জামিনের ধারণা অনেকটাই ভিন্ন ও অনন্য। জ্ঞানতত্ত্ব এবং ধর্মতত্ত্বের মধ্যে আদি এবং ঐতিহাসিক অভিন্নতা আছে তা তিনি ব্যাখ্যা করেন "ভাষা" সম্পর্কিত তার On language in general and on the language of man প্রবন্ধে। তার কাছে ভাষা হল এমন এক নীতি যার উদ্দেশ্য হল আধ্যাত্তিক এবং বাস্তবিক বিষয়বস্তুর ভেতরকার আদান প্রদান। এমন কোন সত্ত্বা, ঘটনা কিংবা অবস্থান নেই যার প্রকৃতি জৈবিক আর অজৈবিক যাই হউক না কেনো যা ভাষার শরিকভুক্ত নয়। সমস্ত আধ্যাত্মিক বিষয়বস্তুর বিনিময়ের সার উপাদান হল ভাষা।তার মতে এর তিনটি স্তর আছে , প্রথমটি হলো স্বর্গীয় সৃষ্টিজাত ভাষা যেটা হলো মূলত "শব্দই বস্তুকে তৈরি করে তার নামের সাথে সম্পর্কিত হয়ে", দ্বিতীয় টি হলো হলো আদমের (মানব) ভাষা,যা মুলত বিশুদ্ধ চেতনা তৈরি করে নাম আরোপের মাধ্যমে, সর্বশেষ স্তরটি হলো বস্তুর অনুচ্চারিত ভাষা।

মার্কসবাদী নন্দনতাত্ত্বিক এবং যে কোনো ধরনের নন্দনতত্ত্বের বিষয়ে ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের নাম শুরুর দিকে আসবে, কারণ তার সেই বিখ্যাত প্রবন্ধ "The works of art in the age of technological reproducibility"। এখানে মানুষের শিল্পবোধ, শিল্পের বিভিন্ন মূল্য, শিল্পের উপযোগিতা, শিল্পের বিবর্তন, নতুন শিল্পের আগমন, সৌন্দর্য এই সমস্ত কিছুর এক প্রকার তাত্ত্বিক এবং জটিল আলোচনা করেছেন। বেঞ্জামিন মূলত ছিলেন একজন সাহিত্য সমালোচক, শিল্প সমালোচক এবং দার্শনিক।

"The works of art in the age of technological reproducibility" প্রবন্ধে তিনি নতুন এক নন্দনতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা এবং আগমনের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি সর্বপ্রথম কোন রাজনৈতিক পার্টির নিয়ন্ত্রণহীন মার্কসবাদী গবেষণা সংস্থা "ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল" এর সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলো, সেই স্কুল যে স্কুল বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সকল ক্রিটিকাল তাত্ত্বিকদের জন্ম দিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর তাত্ত্বিক ও দার্শনিক কাঠামো ও চর্চা তাদের দিয়েই শুরু বলা চলে, বেঞ্জামিন তাদেরই একজন ছিলেন। বেঞ্জামিন নানা প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন, লিখেছেন, তত্ত্ব দিয়েছেন তবে তার চিন্তার মধ্যে একটা বিরাট সামগ্রিকতা ছিলো। শিল্পকে অর্থাৎ নন্দনতত্ত্ব কে রাজনীতি থেকে আলাদা থাকতে হবে এই নীতি তিনি মানতে নারাজ, বরং তিনি এই নীতিকে এ ধর্মতত্ত্ব, অধিবিদ্যা, কুসংস্কার বলে খারিজ করে দেন। নন্দনতত্ত্বের সাথে রাজনীতির সরাসরি সম্পর্ক আছে এবং এটা একধরনের কালের চাহিদা সেটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। "আধুনিকতা" নামক যে এক বিরাট দার্শনিক চেতনামূলক প্রস্তাবনা মানবসভ্যতায় এসে হাজির হয়েছে এবং এটা যে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ সেটা তিনি জানতেন, তাই তিনি গেছেন ফরাসি মহাকবি বোদলেয়ারের কবিতার কাছে, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ঘেটেছেন, দেখেছেন, যে অর্থনীতি তে যদিও ইংল্যান্ড এগিয়ে ছিলো শিল্প বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে, কিন্তু সাহিত্য ও শিল্পকলায় সেই বিপ্লবের প্রভাব সবচেয়ে পড়েছিলো ফ্রান্সে।

বেঞ্জামিনের সবচেয়ে বিস্তীর্ণ রচনা "Arcades Project", বিশ শতকের বড় বড় নন্দনতাত্ত্বিক এবং শিল্প সমালোচক দের মতে নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতি ও শিল্প  সমালোচনার গ্রন্থ হিসেবে গণ্য হতে পারতো (কারণ সেটা অসমাপ্ত ছিলো) যদিও ইতোমধ্যে স্থপতিকলা এবং যেকোনো ধরণের নন্দনতাত্ত্বিক বিষয়ে এই গ্রন্থের গুরুত্ব অপরিসীম। বেঞ্জামিনের কাছে আধুনিক সময়ে "সংস্কৃতি" সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্যাটাগরি। অর্থাৎ Cultural Determinism বলতে কিছু না থাকলেও সংস্কৃতি ও নন্দনতত্ত্বের মাধ্যমে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা ও এর পরিবর্তনের বিপুল সম্ভাবনার বিশ্লেষণ করা অবশ্যকর্তব্য। মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ (Historical Materialism) বেঞ্জামিন কে প্রবল আকর্ষণ করেছিলো কিন্তু বেঞ্জামিনের কাছে এই আধুনিক সময়ের ইতিহাসের বস্তুগত উপাদানের(Materialist conception of History) মধ্যে আধুনিক মানুষের ফ্যাশন, রুচি, স্টাইল, নান্দনিকতা প্রবল ভাবে উপস্থিত। অর্থাৎ অর্থোডক্স মার্কসবাদীদের মতো অর্থনৈতিক নিয়তিবাদ (Economic Determinism) এর বিশ্বাস বেঞ্জামিনের ছিলো না, যার কারণে তার অন্তরঙ্গ বন্ধু বিখ্যাত কবি ও নাট্যকার বের্টোল্ট ব্রেখটের কাছে থেকে শোনা যায় যে বেঞ্জামিন মার্কসের "পুঁজি" (Capital) পড়েননি, কারণ তার কাছে আধুনিক সমাজব্যবস্থায় মার্কসীয় ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সবচাইতে উপযোগী হলো নন্দনতত্ত্ব এবং স্থাপত্যে ও জনমানসের ফ্যাশন, রুচি, স্টাইল অর্থাৎ এইখানটায় বেঞ্জামিনের উপর ফরাসি কবি বোদলেয়ারের প্রবল প্রভাব দেখা যায়। আধুনিকতা কি এই বিষয়ে বোদলেয়ারের বিখ্যাত প্রবন্ধ "The Painter of modern life" , ঠিক যেটার অনুকরণে বেঞ্জামিন লিখেছিলেন তার আরেকটি বিখ্যাত প্রবন্ধ " Baudelaire, writer of modern life" বোদলেয়ারের সব প্রবন্ধ ও বেশ কিছু কবিতা বেঞ্জামিন জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন৷ তার Arcade Project লিখার অন্যতম মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলো মূলত আধুনিক পুঁজিবাদী জামানায় বুর্জোয়া সংস্কৃতি, ফ্যাশন ও বুর্জোয়া রুচি-রীতিনীতির একটি ব্যাখ্যা যার প্রেক্ষাপট ঐতিহাসিক এবং ধর্মতাত্ত্বিক।

বোদলেয়ারের কবিতায় পাওয়া সেই অচেনা মানুষ (Flanuer) যিনি প্যারিসিয়ান আর্কেডের প্রতিফলিত রাস্তায় ভিড় জমানো, ছুটে চলা, গতিশীল মানুষের মাঝে ঘুরে বেড়ান, পর্যবেক্ষণ করেন এবং উপলব্ধি করেন তার নিজস্ব বিচ্ছিন্নতা (Alienation). অর্থাৎ উনিশ শতকে গড়া সেই প্যারিসিয়ান আর্কেড যার প্রতিফলনে দেখা যায় ইউরোপীয় সেই ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মর্মকথা। বোদলেয়ারের মতো করে বেঞ্জামিন ও সন্ধ্যান করেছেন ইতিহাসের বাস্তবতা জনমানসের রুচি ও ফ্যাশনের মধ্যে যা কিনা এক অভূতপূর্ব কাঠামোতে বন্দী হয়ে নিরন্তর ও অসীম সময়ের দিকে পরিচালিত হচ্ছে।

পুঁজিবাদ বেঞ্জামিনের মতে একটি ধর্ম। তার Capitalism as religion নামের ছোট্ট একটি প্রবন্ধে তিনি পুঁজিবাদ কে একটি ধর্ম হিসেবে চিহ্নিত করছেন। Capitalism as Religion এ উনি লিখেছেন,  "In the first place, capitalism is a purely cultic religion, perhaps  the most extreme ever existed....capitalism has no specific body of dogma, no theology.....capitalism is the celebration of cult...capitalism is probably the first instance of a cult that creates guilt, not atonement. A vast sense of guilt that is unable to find relief seizes on the cult, not to atone for this guilt but to make it universal, to hammer it into the conscious mind...capitalism is entirely without precedent, a religion which offers not the reform of existence but its complete destruction."

বিশ শতকের দার্শনিক চিন্তাধারায় ফরাসি অস্তিত্ববাদ, ফরাসি মনঃসমীক্ষণ এবং ফরাসি উত্তরাধুনিকবাদ বেশ প্রভাবশালী অবস্থা দখন করেছিলো এবং এর পেছনে ফরাসি দেশের কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক দের সরাসরি ভূমিকা ছিলো, অন্যদিকে জার্মানি তে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ দিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের স্থানচ্যুতি ঘটলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক দার্শনিক চিন্তাধারা গড়ে উঠেনি। কেনো গড়ে উঠেনি তা চূড়ান্ত ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক প্রশ্ন এবং ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের চিন্তা ও প্রস্তাবনা তার মৃত্যুর পরেও প্রায় ২০-২৫ বছর যাবত অপ্রকাশিতই ছিলো। হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার পাঁচ খণ্ডে নির্বাচিত রচনাবলি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯০ সালের পর, অর্থাৎ বেঞ্জামিন এখনো পর্যন্ত ইংরেজি ভাষার জগতে পুরোপুরি পরিচিত নন এবং তাকে নিয়েও তেমন দুর্দান্ত কোনো গবেষণা হচ্ছে না, হওয়ার কথাও না। তবে দার্শনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে তাকে নিয়ে আলাপ কম হয়নি।

বেঞ্জামিনের সমগ্র রচনাবলি কে মোটাদাগে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হলো নন্দনতত্ত্ব যা অনেকেই মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব বলে অভিহিত করেন, দ্বিতীয় ভাগ হলো তার অধিবিদ্যা (Metaphysics) সংক্রান্ত ধারণা যার, যা একদমই স্পষ্ট নয়। স্পষ্ট নয় এই অর্থে যে তিনি ঠিক কোনো বিশেষ অধিবিদ্যা তত্ত্ব হাজির করেননি বরং পুঁজিবাদী জামানায় মানুষের সত্ত্বাগত অবস্থা এবং এর নিয়তি ই তার অস্তিত্বতত্ত্বের (Ontological) অন্যতম কেন্দ্রীয় বিষয়। আর তৃতীয় যে ভাগটি, যা সবচাইতে আকর্ষণীয় ও মৌলিক চিন্তা দ্বারা বেষ্টিত, তা হলো রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্ব (Political Theology) যার আবির্ভাব বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় সূচিত হয়৷ জার্মান আইনজ্ঞ ও রাজনৈতিক তাত্ত্বিক কার্ল স্মিটের "Political theology : Four chapters on the concepts on sovereignty" বইটিতে স্মিট "সার্বভৌমত্বের" ধারণা কে নতুন করে ব্যাখ্যা করেন। স্মিটের কাছে পাশ্চাত্যে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক ইতিহাসে গড়ে উঠা "সার্বভৌমত্ব" কিংবা জনপ্রিয় সার্বভৌমত্ব (Popular Sovereignty) নেহাৎ ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছুই নয়, তার মতে সার্বভৌম সে ই যার দ্বারা জরুরি অবস্থায় "ক্ষমতার কাঠামোও ক্ষমতার চর্চা" নির্ধারিত ও পরিচালত। সার্বভৌমত্ব হলো কোন ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি, ঘটনা, অবস্থানের ক্ষেত্রে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তাকেই তিনি বলেছেন সার্বভৌমত্ব, সেই সিদ্ধান্ত কে নিচ্ছেন তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। অর্থাৎ একটি দেশে যে সাধারণ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আছে, সেগুলো সাধারণ ঘটনা, পরিস্থিতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।  সেখানে সার্বভৌমত্বে প্রয়োজন হয় না, দেশের সাধারণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রিত হয় সাধারণ রাষ্ট্রীয় নিয়ম কানুন, আইন দ্বারা, সংবিধান দ্বারা। কিন্তু যখন ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটে, যেমন যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, মহামারি রোগ, শেয়ার বাজার ধস অর্থাৎ ইমারজেন্সি এবং ব্যতিক্রম ঘটনা যেটা সবসময় হয়না সেই সব পরিস্থিতি, অবস্থা ও ঘটনার প্রেক্ষিতে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তাকেই সার্বভৌমত্ব বলে এবং সেই সব ঘটনার সমাধান ঐ বিদ্যমান সংবিধান, আইন, সাধারণ নিয়ম কানুন দিয়ে করা যায় না স্মিটের মতে।

দ্বিতীয়ত, কার্ল স্মিট এই যে শাসন ব্যবস্থা অর্থাৎ রাজনৈতিক ক্ষমতার যে বিবর্তন সেটাকে ঐতিহাসিক এবং দার্শনিক দৃষ্টিতে দেখেছেন, তার মতে একটা সময় মধ্যযুগে রাজাই ছিলো সকল "সার্বভৌমত্ব" এর অধিকারি, কিন্তু রাজা নিজে তা চর্চা করতে পারতো না বরং সে তার প্রতিনিধি রেখে দিতে, তাদের কে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করতো যেটাকে প্রশাসনিক দৃষ্টি তে বলে "Delegation of authority " সেটা করতো, ফলে প্রতিনিধি রা রাজার সার্বভৌমত্বের নামে যা ইচ্ছা তাই করতে পারতো। আধুনিক যুগে বিশেষ করে ফরাসি

বিপ্লবের পরবর্তী তে যখন গণতন্ত্রের বিকাশ হওয়া শুরু হলো, জায়গায় জায়গায় গণতান্ত্রিক আন্দোলন হওয়া শুরু করলো, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়া শুরু হলো, স্মিট দেখালেন যে আধুনিক রাষ্ট্রে সকল সার্বভৌমত্বের অধিকারি হলো জনগণ কিন্তু জনগণ সেই মধ্যযুগীয় রাজার মতো ক্ষমতার ব্যবহার করতে পারেনা বরং তাদের প্রতিনিধি রা অর্থাৎ যারা তাদের ভোটে নির্বাচিত তারা জনগণের নামে যা ইচ্ছে তাই করার সক্ষমতা রাখে।

এখানেই স্মিট এই দুই কালের সাপেক্ষে রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা ও ক্ষমতার একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য খুজে পেলেন। স্মিট জানতেন যে এক শাসনামলের পরে আরেক শাসনামল একটি বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু স্মিটের মৌলিক আবিষ্কার ঐখানটায়, যে একটি (সার্বভৌমত্ব) শাসনব্যবস্থা কে ভাঙার জন্য যারা বিপ্লব করবে তারা যখন সফল হবে তখন তাদের হাতেই শাসনব্যবস্থা বর্তাবে, তখন তারা ঐ জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে জনগণের সার্বভৌমত্ব নিজেরা চর্চা করবে কারণ তারা তো ঐ "জনগণের মুক্তির" জন্যই আন্দোলন করে বিপ্লব করে জনগণের সায় নিয়েই ক্ষমতায় এসেছে!

সুতরাং, তারা হলো "sovereign dictator" স্মিটের ভাষ্যমতে। স্মিট ছিলেন গণতন্ত্রের ঘোর সমালোচক, অর্থাৎ সংসদীয় গণতন্ত্রর। ১৯২৩ সালে তার বই "crisis in parliamentary democracy" এ তিনি বলেছেন উদারনৈতিক গণতন্ত্র সবকিছুর সমাধান দিতে পারেনা, তারা শুধু পার্লামেন্টেইই চিৎকার গলাবাজি করতে পারে! এই গণতন্ত্রেরর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, জনগণেরর সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে, জনস্বার্থ রক্ষার্থের নামে একদল মানুষ ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করে আর জনগণের দিকে একটুকুও তাকায় না! এই ধরনের সংসদীয় গণতন্ত্র কে অযৌক্তিক বলেছেন স্মিট।

স্মিট "রাজনীতি" কে তার নিজস্ব মৌলিক দৃষ্টি দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন। ১৯৩২ সালে তার সবচেয়ে বিখ্যাত এবং বিতর্কিত বই, "The concept of political" বই এ তিনি রাজনীতি কে তার মতো করে সংজ্ঞায়িত করেন। তার মতে রাজনৈতিক চেতন জন্ম তখনই হয় যখন একজন মানুষের মধ্যে "শত্রুমিত্র ভাবাপন্ন" তৈরি হয়, অর্থাৎ রাজনীতি করতে হলে শত্রু থাকতেই হবে। স্মিটের কাছে রাজনীতি বিষয়টি "on the basis of enemical sense" তার মতে কেউ যদি মনে করে তার শত্রু নাই বা তার শত্রু থাকা চলবেনা তাহলে তাকে দিয়ে রাজনীতি সম্ভব নয়!

উদারনৈতিক গণতন্ত্র (Liberal Democracy) কে তাই তিনি নাকচ করেন। তার মতে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য শত্রু কে ধ্বংস করতেই হবে এবং শত্রু যাতে আক্রমণ করলে তাকে প্রতিহত করা যায়, শত্রু আক্রমণ করতে "পারে" এই জরুরত কে ধরা ও বোঝা এবং এই ধরণের তীব্র বোধ-কেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কে তিনি রাজনীতির অংশ মনে করেন। ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের সাথে স্মিটের এক ধরণের বাহাসের কথা জানা যায়। স্মিট তার Political theology বইতে আইন, সার্বভৌমত্ব, সংবিধান এই বিষয়গুলোকে একেবারে নতুন করে ব্যাখ্যা করেছেন এবং এসকল ব্যাখ্যার ধর্মতাত্ত্বিক চরিত্র আছে, যে কারণে রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্ব মাত্রই রাজনৈতিক প্রস্তাবনা তথা "রাষ্ট্রীয়" "সার্বভৌম" "আইন" এই বিষয় গুলোকে ধর্মীয় তত্ত্বের আলোকে ব্যাখ্যা করা অর্থাৎ মূল সূত্র হলো রাজনৈতিক তত্ত্বচিন্তা এবং এর সকল প্রস্তাবনা আদৌ ধর্মীয় তত্ত্বচিন্তা ও ধর্মীয় প্রস্তাবনার ই সামিল কিন্তু ভিন্ন নামে, ভিন্ন আঙ্গিকে।  বেঞ্জামিন এই বিষেয় দ্বিমত করতেন না, বরং তিনি এই বিষয়ে আরো জোর দিয়েছেন কারণ ইহুদীয় রহস্যবাদ (Jewish Mysticism) এবং কাব্বালীয় ঐতিহ্যতে মেসিয়াকে আহবান করার যে ঐতিহাসিক জিকির তাতে বেঞ্জামিন শামিল ছিলেন এবং একই সাথে তিনি মার্কসবাদী ও। তার মতে মার্কস দুনিয়ার শুরু থেকে মাহদীবাদের যে চর্চা অর্থাৎ একজন মাহদীর আগমন ও একটি শ্রেণীহীন, বৈষম্যহীন এবং  সাম্যবাদী একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার যে কামনা (ইব্রাহিমী ধর্মীয় ধারায় ও আঙ্গিকে) শত শত বছর ধরে চলে এসেছে, মার্কস সেটাকেই একটা "ধর্মনিরপেক্ষ" রূপ দিয়েছেন অর্থাৎ "Secularized" করেছেন।

অর্থনৈতিক অভাবে দিনের পর দিনে এখানে সেখানে লেখালেখি করে কোনোরকমে চালিয়েছেন জীবন৷ ১৯২৫ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলে অর্থাৎ Institute for Social Research এ নির্দেশক তথা শিক্ষক হওয়ার জন্য তার দ্বিতীয় অভিসন্দর্ভ টি ( The Origin of German Tragic Drama) উপস্থাপন করেছিলেন কিন্তু কপাল এতোটাই মন্দ যে তার ঐ অভিসন্দর্ভ যারা নিরীক্ষা করেছেন তারা তা কিছুই বুঝতে পারেননি, বরং এটাকে অস্পষ্ট, দুর্বোধ্য, কাল্পনিক ও রহস্যময়তায় মিশ্র একটি থিসিস হিসেবে সেটা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। প্রচন্ড অভাব এবং রাজনৈতিক দুর্ভাগ্য বহন করার পরেও বেঞ্জামিন তার প্রিয় বন্ধু গের্শম শোলেমের কাছ থেকে পাওয়া বারংবার ফিলিস্তিনে যাওয়ার আহবানে রাজি হোননি। ১৯৩৮-১৯৪০ সালের মধ্যে শোলেমকে লেখা বেঞ্জামিনের চিঠি গুলো পড়লে বোঝা যায় যে সে পরোক্ষভাবে ফিলিস্তিনে যেতে ইচ্ছুক না, যেখানে সে ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স ঘুরছে, সেখানে ফিলিস্তিনে যাওয়া আর এমন কি। কিন্তু তার প্রিয় বন্ধু শোলেমকে সে নাকচ করতে পারছেনা এবং শেষ পর্যন্ত কিন্তু বেঞ্জামিন ফিলিস্তিনে যাননি। নাৎসিদের কাছ থেকে নিজেকে বাচানোর জন্য আমেরিকা যাওয়ার নিয়ত করেছিলেন, কিন্তু ফিলিস্তিনে নয়। বেঞ্জামিনের Critique of Violence পড়লে বোঝা যায় কেনো সে ফিলিস্তিনে যেতে চাননি৷ তার মতে  কোনো নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থা, সমাজ ব্যবস্থা কিংবা নৈতিক ব্যবস্থার সূচনা "আক্রমণ বা উৎপীড়ন" (Violence) ছাড়া সম্ভব নয়। আক্রমণ অনিবার্য ই। যেহেতু আক্রমণ বা Violence সর্বজনীন সেক্ষেত্রে বেঞ্জামিন আক্রমণ বা Violence কে দুই ভাবে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। একটি হলো আইন-প্রতিষ্টার উদ্দেশ্যে আক্রমণ (Law making violence), আরেকটি হলো আইন-রক্ষাকারর উদ্দেশ্যে আক্রমণ (Law Preserving Violence). বেঞ্জামিনের মতে মানবজাতির রাজনৈতিক ইতিহাসে ঘটা শ্রেষ্ঠ বিপ্লব গুলোকে আমরা এই দুই ধরণের আক্রমণের আলোকে দেখতে পারি৷ প্রতিটা আক্রমণ ই হয় সেটা আইন রক্ষার্থে (Law Preserving) কিংবা সেটা নব্য আইন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে (Law Making) বেঞ্জামিনের মতে প্রলেতারিয় বিপ্লব মাত্রই তা আইন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে (Law making violence)  বিপ্লব। আরেক ভাবে ভাগ করেছেন তিনি সেটা হলো Mythical violence and divine violence যেগুলো কিনা উক্ত দুইটি আক্রমণের মতোই অর্থাৎ এক ধরণের আইন রক্ষা ও আইন ধ্বংস করার মতো একটি সমীকরণ। সুতরাং, বেঞ্জামিনের মতে ফিলিস্তিনে ইহুদিদেী জন্য একটি নতুন রাষ্ট্র হবে এবং সেই রাষ্ট্র হবে ইহুদি জাতির মুক্তির সোপান, মাহদীয় ঐতিহ্যের একটি বড় প্রতিফলন এই মতাদর্শে বেঞ্জামিনের বিশ্বাস ছিলোনা। তাই তিনি চিঠিতে শোলেমকে ইনিয়ে বিনিয়ে এই কথা সেই কথা বলে বিষয়টা এড়িয়ে গেছেন বারংবার। কারণে বেঞ্জামিন বিশ্বাস করতেন যে Law making violence মানুষের মুক্তির প্রতীক হিসেবে আসলেও সেই বিপ্লব বেহাত হয়ে যায়।

বেঞ্জামিনের লেখার ধরণ চিরায়ত লেখকদের মতো, কিন্তু তিনি ভলিউম আকারে কখনই বই লেখেননি। ছোট ছোট চার পৃষ্ঠা-পাঁচ পৃষ্ঠা করে কয়েকশো শব্দের ভেতর দিয়ে চমৎকার সকল ধারণা ও প্রশ্ন হাজির করতেন তিনি। তার লেখা সম্বন্ধে তার জীবনীকার হাওয়ার্ড আইলান্ড বলেছেন "Reading him is therefore a sensory, no less than intellectual, experience". " Walter Benjamin ; A Critical life" নামে হাওয়ার্ড আইলান্ড প্রায় ৬৫০ পৃষ্টার একটা জীবনী লিখেছেন। সাহিত্য সমালোচনার প্রতি তার অধীর আগ্রহ ছিলো, তাই তার প্রথম অভিসন্দর্ভ ছিলো "The concept of criticism in German romanticism", যেখানে তিনি " সমালোচনা" কে এখনকার যেই অর্থে বোঝা হয় সেই অর্থে বোঝেননি, বরং তার মতে সমালোচনা মাত্রই তার বিষয়বস্তুর বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা, ত্রুটি ধরা, প্রশংসা করা মাত্র নয়, বরং তার মতে সমালোচনা বলতে যা বোঝায় তা উক্ত বিষয়বস্তুর অর্থাৎ উক্ত শিল্প-সাহিত্যের "সম্পূর্ণতা"। "Criticism as the fundamental discipline of literary history" নামে দুই পাতার একটা প্রবন্ধে এই কথা বলেছেন। সমালোচনার মধ্যে দিয়ে কোনো শিল্প বা সাহিত্য সম্পূর্ণ রূপে উপস্থাপিত হয়, কারণ বেঞ্জামিনের মতে শিল্প সাহিত্য জনপরিসরে আসা মাত্রই তা এক ধরণের নবরূপে পরিমার্জিত হয়, যা অদৃশ্য, এবং এই পরিমার্জনার ভিত্তি ইতিহাস ও রাজনৈতিক আকাঙ্খা এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট। সমালোচনা, অনুবাদ, সিনেমা, ফটোগ্রাফি, ইমেজ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ-নির্বন্ধ লিখেছেন যার মধ্যে কিছু কিছু প্রবন্ধ চিরায়ত রূপ ধারণ করেছে। বেঞ্জামিনের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক হলো, তার প্রত্যেকটি লেখায় নতুনত্ব আছে, অর্থাৎ লেখার জগতে বেঞ্জামিন মৌলিক লেখক হিসেবে প্রথম শ্রেণীর। তত্ত্ব জগত, নন্দনতত্ত্ব এবং ঐতিহাসিক বিভিন্ন প্রেক্ষাপট কে বেঞ্জামিনের লেখায় নতুন ভাবে, নতুন বিশ্লেষণে, নতুন আঙ্গিকে পাওয়া যায়, এর মধ্যে কিছু প্রবন্ধে সে একেবারেই মৌলিক প্রস্তাবনা হাজির করেছেন। যেমন তার The Task of a Translator প্রবন্ধে একটি পুরোনো বিতর্ককে নতুন ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। অনুবাদক কি কারণে অনুবাদ করে? কোন বোধ বা উপলব্ধি থেকে সে অনুবাদের কাজে হাত দেয় ? বেঞ্জামিনের মতে কোনো অনুবাদক সমাজে জন্য, জনমানসের জন্য এক কথায় পাঠকসমাজের জন্য অনুবাদের কাজে হাত দেয় না কারণ যে লেখার অনুবাদ তিনি করেন সেই লেখার লেখক ই তো পাঠকসমাজের জন্য তা লেখেননি, তাহলে অনুবাদক কেনোই বা তা করবে?   "No poem is intended for the reader, no picture for the beholder, no Symphony for the audience", সেক্ষেত্রে তাহলে প্রশ্ন উঠে যে লেখক কাদের উদ্দেশ্যে লেখেন ? বা আদৌ কারোর উদ্দেশ্যে লেখেন কিনা ? কিংবা লেখকের লেখার পেছনে আদৌ কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা ?  মূল লেখা যারা বুঝতে অপারগ এবং অসমর্থ তাদের জন্যই মূলত অনুবাদের কাজ এই কথার সাথে বেঞ্জামিনের দ্বিমত আছে, তার মতে "If it were intended for the reader, then original would also have to be intended for the reader. If the original is not created for reader's sake, then how can this relationship allow us to understand the translation?"

এই প্রশ্নের উত্তর না বের করে অনুবাদকের উদ্দেশ্য বা কাজ কি সেটা বোঝা সম্ভব না। বেঞ্জামিনের শেষ এবং সবচেয়ে দুর্বোধ্য, অতি মাত্রায় অধিবিদ্যক (metaphysical), দার্শনিক লেখা হলো On the concept of history যা সমগ্র মানব ইতিহাসের বিপ্লবী চেতনা ও সামাজিক পরিবর্তনের পেছনকার যে সাধারণ ঐতিহাসিক বস্তুগত ভিত্তি (materialist factor) তারই নিয়তি নির্ধারকের মর্মবাণী। বেঞ্জামিনের মতে আমরা যাকে বলি ইতিহাস তা মূলত ইতিহাসবাদ চর্চার ই নামান্তর যেখানে ইতিহাস কে ঘটনা বিবরণ, অতীত, ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা এভাবে দেখা হয়। বেঞ্জামিনের মতে এটা হলো ইতিহাসবাদ (Historicism) কিন্তু তিনি এর পক্ষে কম ই ছিলেন, বরং তিনি পক্ষ নিলেন ঐতিহাসিক বস্তুবাদের (Historical materialism)। ইতিহাসবাদ হলো খণ্ডিত ইতিহাস চর্চা কারণ বেঞ্জামিনের মতে ইতিহাস মাত্রই তা খণ্ডিত, অতীত এবং বর্তমানের ভেতরে তার ব্যবচ্ছেদ হয়ে যায়, এই খণ্ডিত অংশ গুলোকে ইতিহাসবাদের মাধ্যমে একত্র করা সম্ভব না, সম্ভব ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মধ্যে দিয়েই। তার মতে অতীত প্রজন্মের সাথে বর্তমান প্রজন্মের সবসময়ই একটি গোপন অদৃশ্য চুক্তি থাকে, অর্থাৎ ব্যর্থ বিপ্লবের মরা ফুল যার থেকে আবার জন্ম হয় প্রতিশ্রুত অধিকারের রূহানী, যখন ইতিহাসের ফেরেশতার বাধন খুলে যায় স্বর্গ থেকে আগত এক ঝড়ো হাওয়ায়, যে হাওয়ার নাম "প্রগতি"। বেঞ্জামিন ইতিহাস কে এভাবেই দেখেছেন। মহৎ চিন্তকরা পৃথিবীতে আসেন বিশেষ কার্যসিদ্ধির জন্য, বৃহৎ সময় বেচে থেকে জীবনকে উপভোগ করার জন্য নয়।  বেঞ্জামিন সেই মহৎদের কাতারেই পড়েন, যার ছিলো মাহদীয় বিপ্লবের তথা প্রলেতারিয় বিপ্লবের মর্মবাণী অনুধাবন করা ক্ষমতা এবং জিকির। বেঞ্জামিন ইহুদী ছিলেন, তাই হিটলারের নৃশংসতা তারও পিছু ছাড়েনি। বার বার নাৎসীদের তাড়া খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেন,  তবে পণ্ডিতরা বলেন বেঞ্জামিন যে এই কয়বছরে যেসব উল্লেখযোগ্য কর্ম করেছেন তা আগামি ১০০-১৫০ বছর পর্যন্ত চিন্তা ও জ্ঞানতাত্ত্বিক জগতকে এগিয়ে নিয়ে গেছে সুতরাং সে ততটুকুই বেচে ছিলো যতটুকু তার দরকার ছিলো এমন টাই বলা হয়। সব শেষে  পালাতে পারেনি বেঞ্জামিন। স্পেনের কালো নিষ্ঠুর সীমানা তাকে রুখে দিয়েছিলো,  অতঃপর তার কথিত স্বর্গের ঝড় তাকে নিয়ে গেছে মরফিনের কাছে আর তার সাথে তার পরবর্তী প্রজন্মের সাথে হয়ে যাওয়া সেই অদৃশ্য ঐতিহাসিক বিপ্লবের চুক্তি যা তার অমর রচনায় বারবার আমাদের সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে। প্রেম-ভালোবাসার যন্ত্রনায় ভুগেও স্বীকার বলে গেছেন  - "The only way to know a person is to love them without hope"।

আশা সবসময়ই অতীতের আগুনে জলে ভস্মীভূত হয়, কিন্তু ঐ সেই আশার পেছনে থাকা এক অমোঘ প্রতিশ্রুতি যার মৃত্যু হয়না, বারবার অতীতের আগুনে জ্বলে পুড়ে ভস্ম হওয়ার পরেও তা আবার নতুন করে নতুন সূর্যের মতো রক্তিম দিগন্তে ভেসে উঠে, যখন আহত এক সূর্যমুখী তাকিয়ে থাকো সেই সূর্যের দিকে, এক অনন্ত অসীমের বাসনায়।

 

আকর

 

১. Howard Eiland, "Walter Benjamin : A critical life"

 

২. A Companion to the works Walter Benjamin, Rolf. J Goebel.

 

৩. Walter Benjamin selected writings, volume 1,2,3,4, Belknap Press, Harvard University

 

৪. Walter Benjamin correspondence

 

৫. ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল আলোচনা চক্র, চিরঞ্জীব শূর

 

৬. Carl Schmitt, Political theology; four Chapters on sovereignty

 

৭. Walter Benjamin, the Arcades Project

 

৮. Heinrich Heine, on the History of religion and philosophy in Germany