ইভানস চাইল্ডহুড : সাহিত্য ও সিনেমা

যুদ্ধের চিহ্ন সম্বলিত এক ডিস্টোপিয়ান ধ্বংসস্তুপ। তার মধ্যে দিয়ে রাশিয়ান ফ্রন্ট লাইনের আর্মির গাড়ি এগিয়ে চলেছে। পিছনে বসে একটি অল্পবয়সী ছেলে, ছেঁড়াছুটো জামা পরা, থেকে থেকে চোখের জল মুচ্ছে। গাড়ীতে বসা অন্য সৈনিকরা যতই তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে যুদ্ধ করা প্রাপ্তবয়স্কদের কাজ, সেও ততই তাদেরকে পাল্টা যুক্তি দেখাচ্ছে, বলছে সেই একমাত্র এই স্কাউটিংয়ের কাজ বা গুপ্তচরবৃত্তি করার পক্ষে উপযুক্ত, কারণ সে এই যুদ্ধ বিধ্বস্ত পৃথিবীতে একা - "I have no family left".
         দৃশ্যটি সোভিয়েত চিত্রনির্মাতা আন্দ্রেই তারকোভস্কির সিনেমা 'Ivan's Childhood'-এর, যা ভ্লাদিমির বগমোলভের নভেলা 'Ivan' থেকে অনুপ্রাণিত। নভেলাটির মুখ্য চরিত্র এগারো বছর বয়সী রুশ বালক ইভান বুসলভ, রুশ সেনাবাহিনীর গুপ্তচর বাহিনীতে খাতায় কলমে যার নাম 'বন্দারেভ'। সে হয়তো নিজেও জানে যে ইতিহাসের প্রাক্কাল থেকেই যুদ্ধ করা প্রাপ্তবয়স্কদেরই কাজ। শাসনতন্ত্রের মাথায় বসে থাকা বোধসম্পন্ন "প্রাপ্তবয়স্ক" রাষ্ট্রনায়করা আর তাদের নীতিনির্ধারকরা মিলেই তো যুদ্ধের রীতি-নীতি-প্রণালী-উপকরণ স্থির করেন, 'শত্রুপক্ষ' বলে চিহ্নিত করেন কিছু অচেনা মানুষকে, তারপর আরো কিছু মানুষকে রণসজ্জায় সজ্জিত করে পাঠিয়ে দেন তাদের চিহ্নিত করা শত্রুর প্রাণ কেড়ে নেওয়ার জন্যে, আবার তাদেরকেই কখনো কখনো উল্টোদিক থেকে কেউ 'শত্রুপক্ষ' বলে চিহ্নিত করে প্রাণে মেরে ফেলে। এই তো যুদ্ধ। এই তো খেলা। এগারো বছরের ইভান সেসব জানে। তার সাথে সে এও জানে, এই অস্ত্রসর্বস্ব সভ্যতায় একে অপরের উপর অন্যায্য অধিকার বিস্তারের যুদ্ধে শুধু প্রাপ্তবয়স্করা সামনে থেকে লড়লেও, সেই যুদ্ধের বলি হয় আরো অনেকেই। এই সাম্রাজ্যবাদী দখলদারির যুদ্ধের লেলিহান শিখা সর্বগ্রাসী, তার আঁচে জ্বলে পুড়ে যায় সবাই, শুধু কেউ আগে, আর কেউ পরে, তবু রেহাই পায়না কেউই। ঠিক যেমন জার্মানদের গুলির সামনে সে নেতিয়ে পড়তে দেখেছে তার দেড় বছর বয়সী ছোট বোনকে। এই বয়সেই সে বুঝে নিয়েছে যে যুদ্ধ শিশুদের ক্ষমা করেনা, তাই সেই মারণ যুদ্ধের নীল নকশা যারা বানিয়েছে, শিশুর সারল্যে সেও তাদেরকে ক্ষমা করবে না কিছুতেই। যে জার্মান সেনার গুলিতে যুদ্ধের প্রথম দিনেই নিহত হয়েছে তার সীমান্ত রক্ষী বাবা, গুলি খেয়ে তারই কোলে মারা গেছে তার বোন, ইভান প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সেই জার্মান সেনাদের সে শাস্তি দেবেই। এই বয়সেই নিজের কর্তব্য সে বুঝে নিয়েছে - তাই আর্মির অন্যেরা তাকে স্কুলে পাঠাতে চাইলে উত্তর আসে - "যুদ্ধের পরে!" রুশ আর্মিতে স্কাউটিংয়ের কাজ না পেলে সে গেরিলাদের দলে যোগ দেবে, তবু যুদ্ধ সে করবেই, প্রতিশোধ সে নেবেই। তারপর একদিন যুদ্ধ শেষ হয়, তবু ইভানের আর স্কুলে যাওয়া হয়না। কারণ ততদিনে সে নাৎসীদের গেস্টাপো বাহিনীর হাতে বন্দি। যদিও তাকে জেরা করে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে সে গুপ্তচরবৃত্তির সাথে যুক্ত, তবুও যেহেতু সে জেরার মুখে জার্মান সাম্রাজ্যের প্রতি তার অন্তর্নিহিত বিদ্বেষ লোকানোর কোনো চেষ্টাই করেনি, বরং উগড়ে দিয়েছে তীব্র ক্ষোভ আর ঘৃনা, অতএব সেই 'অপরাধ'ই যথেষ্ট তাকে গুলি করে মারার জন্যে। 
             যুদ্ধ শিশুদের আর যুদ্ধপূর্ববর্তী সারল্য নিয়ে বেঁচে থাকতে দেয়না। যুদ্ধের আবর্তে প্রতিনিয়ত প্রাণভয়ে বেঁচে থাকতে থাকতে তারা অজান্তেই শিশুসুলভ উদাসীনতা পরিত্যাগ করে পরিণত হতে শেখে, সহিষ্ণু হতে শেখে, শত্রুদের চিনতে শেখে, গুলি ছুঁড়তে শেখে, আর শেখে ঘৃনা করতে। যে বয়সে তাদের পিঠে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাবার কথা, সহপাঠীদের সাথে খেলাধুলো করার কথা, বাবা মার স্নেহে শাসনে বড়ো হওয়ার কথা, সেই বয়সে ওরা মাটিতে ধ্বংসস্তুপ আর আকাশে কালো ধোঁয়া ছাড়া কিছুই দেখতে পায়নি। সাধারণ গৃহস্থের রোজকার আটপৌরে জীবনে হঠাৎই যুদ্ধের ঘনঘটা এসে পড়লে তখন আশেপাশে সমস্ত কিছুই অর্থহীন। আর সেইভাবেই বোধহয় রিলে বা ফিকশনে ইভানের জন্ম হয়, আর বাস্তবের যুদ্ধভূমিতে জন্ম নেয় ভলোদিয়া দুবিনিন, গুলিয়া করলিওভা বা জোইয়া কসমদেমিয়ানস্কায়ার মতন যোদ্ধারা। যে ইভান যুদ্ধের আগে আর পাঁচটা শিশুর মতোই খোলা আকাশের নিচে প্রজাপতির পিছনে ছুটে বেড়াতো, বন্ধুদের সাথে খেলে বেড়াতো নদীর পাশ দিয়ে, মায়ের সাথে ঘুরে ঘুরে চিনে নিত তার চারপাশ, তার বাস্তবে তখন শুধুই মৃত্যুভয়। সে নিজেও জানে এই বিধ্বংসী যুদ্ধ তাকে পরিবর্তন করেছে অনেক, ঘুমের মধ্যে সে বিড়বিড় করে কোনো অজানা আশঙ্কায়, চোখ বুজলেই তার চোখের সামনে দুঃস্বপ্নের মতন ভেসে ওঠে মায়ের নিথর দেহ, তার গোটা শরীরে যেন স্থবির পাথরের মতন চেপে বসেছে ফ্যাসিস্ট জার্মানির স্বস্তিকা চিহ্ন। হিংস্র জানোয়ারের মতন ওই চিহ্ন যেন ছিঁড়ে খাচ্ছে তার শৈশব। তবুও এখনও সে বন্ধুত্বে বিশ্বাসী। প্রিয় কাতাসনভের মৃত্যু সংবাদ তার অজানা, তাই শত্রুপক্ষের ব্যুহ ভেদ করে অপারেশনে যাবার আগে তাকে দেখতে না পেয়ে অভিমানে তার মুখ ভার।
             ধ্বংসের বিপরীতে শিশুমনের এই নিষ্পাপ সরলতা ঠিক এখানেই স্বার্থক প্রমাণিত হয়। হিংসা, হানাহানি আর লোভের নৃশংসতম রূপ যে যুদ্ধ, যা মানুষকে তার মনুষ্যত্ব ভুলে যেতে শেখায়, ভুলতে শেখায় কোমলতা, দয়াপরায়নতা, ক্ষমাশীলতার মতন মানবিক গুণগুলোকে, সেই যুদ্ধ পরিবেশের মধ্যে বেড়ে উঠেও ইভান এখনও মানুষের উপর বিশ্বাস হারায়নি, আশ্বাস হারায়নি বন্ধুত্বের উপর থেকে। সে বিশ্বাস করে ন্যায় একদিন প্রতিষ্ঠা হবেই। আসলে ইভান চরিত্রটি যুদ্ধ পরিবেশের গোলকধাঁধায় দিগভ্রষ্ট হাজার হাজার মানুষের মূর্তরূপ, যারা এই ঘোলাটে অমানবিক পরিবেশে তারা মনুষ্যত্বকে বাঁচিয়ে রাখা আর গলা টিপে মেরে ফেলার মধ্যের যাঁতাকলে পিষে যায়। আর পাঁচটা শিশুর মতোই ইভানও তার পছন্দের জিনিসের জন্যে বায়না করে, একগুঁয়েমি দেখিয়ে ফেলে, তবু সে প্রতিশোধের লক্ষ্যে অনড়। এই প্রসঙ্গে মনে পরে ফ্রানজ ফানোর "দ্য রেচেড অফ দি আর্থ" বইটার কথা। আলজেরিয়ায় যখন ফরাসি ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে, তখন ফানো সেখানে একটি মানসিক হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন আর সেই সঙ্গে তার পরিচিত কিছু রোগীর কেস হিস্টরি লিপিবদ্ধ করছেন বইটির "কলোনিয়াল ওয়ার অ্যান্ড মেন্টাল ডিসঅর্ডার" অংশে। তার কাছে নিয়ে আসা হলো দুজন বয়ঃসন্ধির ছেলেকে, তারা আলজেরিয়ান, কুপিয়ে খুন করেছে তাদের সহপাঠী ও বন্ধু একজন ইউরোপীয় ছেলেকে। নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নয় তারা, ফানো ও তার সহকর্মীরা তাদের জিজ্ঞাসাবদ করলে তারা উত্তর দেয় যে তারা শুনেছে সমস্ত ইউরোপীয়রা আফ্রিকানদের মেরে ফেলতে চায়, তাই তারা হাতের কাছে যে ইউরোপীয়কে পেয়েছে, আত্মরক্ষার উপায় হিসেবে তাকেই নিকেশ করেছে সবার আগে। এই অমানবিক তীব্র ঘৃনা, শুভ অশুভে ভেদাভেদ করতে না পারার অক্ষমতা তো যুদ্ধেরই দান! সে যুদ্ধের ফলাফল বা উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, মানুষের মনস্তত্ত্বের ওপর এর প্রভাব যাবে কোথায়? 
           শিশুদের মনস্তত্ত্বের ওপর যুদ্ধ পরিবেশের প্রভাব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ফানো তার বইতে আরো এক ধরনের শিশুদের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন সেই সব শিশুদের কথা, যারা অভিভাবকহীন অবস্থায় রিফিউজি ক্যাম্পে থাকে। বেশিরভাগেরই বাবা মাকে তুলে নিয়ে গেছে ফরাসি সেনাবাহিনী, গুলি করে মেরে ফেলেছে, বা গুম করেছে কোথাও। এই বাচ্চাগুলো বাস্তব জীবনে প্রথম দুজনের চেয়ে একেবারে আলাদা, এরা যুদ্ধবিমানের আওয়াজে ভয় পায়, নিজেদের মধ্যে মিলেমিশে থাকে, বাবা মার বয়সী কাউকে দেখলে আদর ভালোবাসা দিয়ে আপন করে নেয়। আলোচ্য উপন্যাসের নায়ক ইভানের চরিত্রায়ন আসলে ঠিক এমনই দুই বৈপরীত্যের মিশেল। যুদ্ধ যাদের জীবনের চরম সত্য, শৈশব, পরিবার, প্রেম তাদের কাছে স্বপ্নের মতন সুন্দর ও মায়াময়, অথচ অলীক ও অস্তিত্বহীন। সেই জন্যেই বোধহয় তারকোভস্কির চিত্রায়নে মেডিক্যাল অফিসার মাশার সঙ্গে গুপ্তচর বাহিনীর প্রধান খলিনের প্রেম, আলিঙ্গন, ভালোবাসার আশ্বাস কি নিদারুণ কাব্যিক মূর্ছনাময়, তবুও যেন কি বেখাপ্পা, দৃষ্টিকটু। খলিন হয়তো নিজেও জানে যুদ্ধক্ষেত্রে ঘৃনা আর মৃত্যুই সত্য ও স্বাভাবিক - প্রেমে বাঁচা আর বেঁচে থাকাই বরং বিস্ময়কর। 
            "There is no peace without war"। বিশ্বময় চিরশান্তি আনার জন্যেই মানুষ ইতিহাসে যুদ্ধ করেছে বটে! সেই জন্যেই হয়তো উপন্যাসের কথক, তথা বেলারুশিয়া ফ্রন্টিয়ারের প্রধান গালৎসেভ আশাবাদী, "won't this be the last war on earth?" গেস্টাপো বাহিনীর হাতে ইভানের মৃত্যু গালৎসেভের এই প্রশ্নকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। জার্মান বাহিনীর ফাইল ঘেঁটে বের করা ইভানের মৃত্যুর আগের সেই ছবি যুদ্ধের গোটা রাজনীতিকে নগ্ন সত্যির মুখে এনে হাজির করে। ইভান যেন চিৎকার করে বলে, সুবিচার আসবেই, সে নিজে যুদ্ধ করে আনবে ন্যায়বিচারকে, সে যুদ্ধের মুখের শিকার নয়, তার বয়স, তার অকৃত্রিম সরলতা তার দুর্বলতা নয়, বরং সে এক জীবন্ত প্রতিরোধের দলিল।  
           দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কেটে গেছে প্রায় সত্তর বছরেরও বেশি সময়। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরকারী বাস্তবের যুদ্ধব্যবসায়ীরা ফিকশনের ইভান-দের থেকে তবু কিছু শিখলেন না।