আলালের ঘরের দুলাল : সিদ্ধি ও সীমা

টেকচাঁদ ঠাকুরের ছদ্মনাম ব্যবহার করে প্রকাশিত প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলালের কেন্দ্রে আছে উনিশ শতকের বাঙালি বাবু, ভদ্রলোক ও তাদের আত্মীয়, বন্ধু এবং সাকরেদরা। বাবু ও ভদ্রলোকদের সম্পর্কে একটি জরুরী ব্যবধান অধ্যাপক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের এই প্রসঙ্গে খেয়াল রাখতে বলেছেন। 'বাংলা উপন্যাসের কালান্তর' বইয়ের আলোক সম্পাতী আলোচনায় তিনি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে গ্রামীণ সমাজ জীবনের পুরনো বৃত্তটি ছেড়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনামলে নব্য জমিদার ও মুৎসুদ্দী শ্রেণির যে অংশটি নিজেদের কেউকেটা ভাবতে শুরু করেছিল ও নানা বেলেল্লাপণায় জড়িয়ে পড়েছিল তারাই বাবু। কিন্তু এই বাবু সমাজের যে আত্মসচেতন ও নিরীক্ষাশীল অংশটি নিজেদের সাংস্কৃতিক ও নৈতিকভাবে উন্নত করতে চাইল, তারাই হয়ে উঠতে পারল ভদ্রলোক।

বাবু সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে এই উপন্যাসে আছেন বাবুরামবাবু ও আলালের ঘরের বড় দুলাল মতিলাল। অন্যদিকে বাবু থেকে ভদ্রলোক হয়ে ওঠে সেই পরিবারেরই ছোট ছেলে রামলাল। একই পরিবারের সহোদরদের মধ্যেকার এই পার্থক্য স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয় যে বাবু ও ভদ্রলোকের পার্থক্যটি মৌলিক এবং তা মূলত আত্মজিজ্ঞাসা ও নীতি, সংস্কৃতিবোধের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

কলকাতা ও তার নিকট শহরতলী – বালি, ভদ্রেশ্বরের মধ্যেই এই উপন্যাস মূলত ঘোরাফেরা করেছে। কিন্তু মতিলালের সার্বিক বিপর্যয়ের সূত্র ধরে তার জমিদারি যশোরের গ্রামেও গিয়ে পৌঁছেছে আখ্যান। কলকাতার বাবু সমাজের ছবি আঁকতে গিয়ে যেখানে মূলত ব্যঙ্গনির্ভর বাহ্য জীবনের কথাই বলছিলেন প্যারীচাঁদ, যশোরের জমিদারী ও গ্রাম জীবনের প্রসঙ্গে গিয়ে তিনি কিন্তু জমিদারি ব্যবস্থা, নীলচাষ ও ঔপনিবেশিক শাসনের অনেক অন্দরমহলে প্রবেশ করলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আধুনিক বাংলা সমাজের ভিত্তি নির্মাণ করেছে – এই বঙ্কিমী মতটি অনেকটাই সর্বজনগ্রাহ্য। এখানে সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ঠিক আগের ভূমি রাজস্বগত পরীক্ষা নিরীক্ষা, দশ সালা বন্দোবস্তের কথা ব্যাপকভাবেই এসেছে। জমিদারী শাসন শোষণ এবং মহাজনী প্রথার জোড়া ফলা রায়তকে কীভাবে বিদ্ধ করে তার ব্যাপক ছবি না থাকলেও এই সংক্রান্ত আশঙ্কাবাণীগুলি বিবৃত হয়েছে। নীলকর সাহেবদের অত্যাচার ও সাহেব সাহেব আঁতাতে কোম্পানী শাসনের বিচার ব্যবস্থার একদেশদর্শী চেহারাটিও প্রত্যক্ষ করেন পাঠক। বিচার ব্যবস্থার মধ্যে বাসা বাঁধা দুর্নীতির ছবিও অন্য প্রসঙ্গে দেখা গেছে।

উনিশ শতকের প্রথম ভাগে কলকাতা শহরটি কেমন ছিল, বিশেষ করে তার বাবু সমাজের চেহারা চরিত্র কেমন ছিল তা ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নববাবুবিলাসের মতো বইতে দু দশক আগেই বিস্তৃতভাবে দেখিয়েছিলেন। প্যারীচাঁদের সমকালে হুতোম তার নকশাতেও সে ছবি এঁকেছেন। আলালের ঘরের দুলাল কিন্তু নকশা জাতীয় রচনাতে সীমাবদ্ধ না থেকে উপন্যাসের দিকে এগোতে চেয়েছে সচেতনভাবে। গ্রন্থের শুরুতে গ্রন্থকার সচেতনভাবেই নভেল রচনার অভিপ্রায়ের কথা জানিয়েছেন, এই সুনির্দিষ্ট শব্দটি ব্যবহার করেই।

এটা ঠিকই আলালের ঘরের দুলাল উপন্যাস হিসেবে সম্ভাবনাময় এবং বাংলায় সচেতনভাবে সম্ভবত প্রথম এই জাতীয় লেখার প্রচেষ্টা। এই হিসেবে গ্রন্থটি ইতিহাসের দিক থেকে অত্যন্ত বিশিষ্ট। পাশাপাশি এটাও মনে হয় নভেলের শিল্পসার্থকতার দিক থেকে এটি সেই উচ্চতায় পৌঁছতে পারে নি। এর অন্যতম প্রধান কারণ চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে প্যারীচাঁদের সীমাবদ্ধতা। উপন্যাসের একদিকে রয়েছে খল চরিত্রগুলি – মতিলাল ও ঠকচাচা যার অন্যতম। অন্যদিকে রয়েছে বরদাবাবু ও রামলালের মতো আদর্শ চরিত্র। কিন্তু খল বা আদর্শ – উভয় ধরনের চরিত্রই অত্যন্ত টাইপ ধরনের নির্মাণ। তাদের মধ্যে কোনও দ্বন্দ্ব বা ঘাত প্রতিঘাত সেভাবে নেই। মতিলালের বদল ও অনুশোচনাকে উপন্যাস নায়কের নীতিগত রূপান্তর বলেই আমাদের মনে হয়। তাতে কেবল আকস্মিকতাই আছে কিন্তু চরিত্রের ভেতরের কোনও দ্বন্দ্বর উপস্থিতি নেই। ঠকচাচা তার অন্তিম সাজার পর দ্বীপান্তরকালে যে হাহাকার করেন তার মধ্যে গোটা জীবনের জন্য আক্ষেপোক্তি আছে, কিন্তু চরিত্রটির নিজস্ব দ্বন্দ্ব ও রূপান্তর দেখানোর কোনও সুযোগ কাহিনীতে আর ছিল না। ফলে মুকুন্দ চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গলের ভাঁড়ুদত্তের আধুনিক সংস্করণ হিসেবেই এটি থেকে গেল।

আলালের ঘরের দুলাল উপন্যাসের নারী চরিত্ররাও মূলত টাইপ চরিত্র। কিন্তু তাদের যন্ত্রণাটি জীবন্ত ও মর্মস্পর্শী। তাঁরা অন্দরমহলে কোণঠাসা, পুরুষের মুখাপেক্ষী ও প্রায়শই অবহেলিত ও নিগৃহীত। জননী, জায়া, ভগিনী – সমস্ত পরিচয় নির্বিশেষেই তাঁদের যন্ত্রণাময় বাস্তবতাটি উঠে এসেছে। বাবুরামবাবু প্রথম স্ত্রী থাকতেও কেন বয়সকালে দ্বিতীয় বিবাহ করেন তার উত্তর তিনি নিজেও সমালোচক বন্ধুদের দিতে পারেন না। দ্বিতীয় বিবাহের অল্প পরেই তার মৃত্যু হয় ও দ্বিতীয়া স্ত্রী সারা জীবন সব দিক থেকে উপেক্ষিতা থেকে যান। প্রথম স্ত্রী স্বামীর থেকে মর্যাদা পান নি শুধু তাই না, যে পুত্রকে প্রাণ দিয়ে আগলে রেখেছিলেন সারা জীবন তার কাছ থেকেই চরম অসম্মান ও আঘাত পেয়ে মনের দুঃখে স্বামী পরিত্যক্তা কন্যাকে নিয়ে ঘর ছাড়তে বাধ্য হন। আরেক কন্যা তার আগেই বৈধব্যের যন্ত্রণা ও রোগশোক নিয়ে আগেই ইহলোক ত্যাগ করেছিল। দ্বাদশ শতকের কৌলীন্যপ্রথার রেশ উনিশ শতকের মধ্যভাগেও কতটা ছিল – প্যারীচাঁদের এই উপন্যাস থেকে তা বোঝা যায়।

বাবু ও ভদ্রলোকদের যে জরুরী ব্যবধান এই উপন্যাস আলোচনায় বারবার জরুরী হয়ে ওঠে তার অন্যতম দিক নারীদের প্রতি এই দুই গোত্রের মানুষের পৃথক দৃষ্টিকোণ ও আচরণ। বাবুরামবাবু ও তার বড় ছেলে মতিলাল যেখানে মহিলাদের যন্ত্রণার প্রত্যক্ষ কারণ সেখানে ছোট ছেলে রামলাল বা তাঁর প্রিয়জন বরদাবাবু মহিলাদের আগলে রাখেন যথাসম্ভব। সম্মান ও সেবায় তাঁদের ওপর সমাজ পরিবারের চাপানো ক্ষতে প্রলেপ দিতে চান। মৃত্যুর সময় তাই রামলালের দিদি ভাইয়ের হাতটি ধরে থাকেন আর বলে যান আগামী জন্মে এরকম ভাই তিনি পেতে চান। বরদাবাবুও আশ্রয়চ্যুত বাবুরামবাবুর দ্বিতীয়া স্ত্রী এবং মতিলালের স্ত্রীকে চূড়ান্ত বিপদে নিজের ঘরে আশ্রয় দেন।

নারীদের প্রতি দৃষ্টিকোণের পার্থক্যের স্পষ্ট দিকটি ছাড়াও বাবু ও ভদ্রলোকদের মধ্যেকার একটি পার্থক্য খানিকটা অলক্ষ্যেই যেন থেকে যায়। কেবল একটু তলিয়ে ভাবলে তবেই আমরা খেয়াল করি যে বাবু চরিত্রগুলি, বিশেষত মতিলাল যেখানে সব সময়েই সাকরেদ পরিবেষ্টিত হয়ে আনন্দ মোচ্ছবের মধ্যে রয়েছে, সেখানে ভদ্রলোকদের প্রতিভূ রামলাল বা বরদাবাবু অনেকটাই একক। আসলে ভদ্রলোকদের যে নিরীক্ষা ও আত্মানুসন্ধান বাবু শ্রেণির লোক হয়েও তাদের পৃথক করে তোলে, এ তারই খানিক প্রতিফলন। তারা চার দেওয়ালের গণ্ডীর বাইরে গিয়ে সমাজসেবায় ব্রতী হতে পারে, দীন দুঃখীর সহায় হতে পারে, কিন্তু ইয়ার দোস্ত নিয়ে মোচ্ছবে মেতে থাকা তাদের স্বভাব নয়।

আলালের ঘরের দুলালের ভাষা নিয়ে এই রচনার সাফল্য ও সীমাবদ্ধতার বিপ্রতীপ দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকেই আলোচনা করেছেন। এই প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ। আলালী ভাষাকে অনেকে ঈশ্বরচন্দ্র বা অক্ষয় কুমার দত্তের তৎসমবহুল শব্দের বিপরীতে স্বাভাবিক বাংলা ভাষার নিদর্শন হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। এরকমও অনেকে মনে করেছেন যে হুতোমি ভাষা বা আলালী ভাষার উত্তরাধিকার না মেনে বিদ্যাসাগরীয় রীতিকেই আরো সমৃদ্ধ করার দিকে বঙ্কিম এগনোর ফলে এই ভাষা উচ্চশিক্ষিত উচ্চবর্ণের আধিপত্যকেই সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা দিল, জনসাধারণ ও তার ভাষাকে শিষ্ট সাহিত্যের বাইরে নিয়ে গেল। সাম্প্রদায়িক সঙ্কটের কালে তরজা সংস্কৃত ও আরবী ফারসীর দ্বন্দ্বকে তীব্র করে তুলল ও এর মধ্যে ধর্মের অনুষঙ্গ ঢুকে পডল।

আলালী ভাষাকে একটা বিদ্রোহ হিসেবে দেখে কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য মন্তব্য করেছিলেন, “বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সংস্কৃত বহুল রচনার বিরুদ্ধে একটা revolt হইয়াছিল। বোধ হয় ১৮৫৪/৫৫ খৃষ্টাব্দে রাধানাথ সিকদার ‘মাসিক পত্রিকা’ নামে একখানি কাগজ বাহির করেন, তাহাতে অনেক চলিত কথা ব্যবহৃত হইত। … বিদ্যাসাগর হাসিতেন। মাসিক পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। তিনি তাঁহার আলালের ঘরের দুলালে সেই tendency র চূড়ান্ত করিয়া যান।” (পুরাতন প্রসঙ্গ, ১ম পর্যায় – কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য – পৃ ৮৮ -৮৯)।

একই রকম কথা পাওয়া যায় শিবনাথ শাস্ত্রীর লেখা বিখ্যাত ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ নামক বইতে। তিনি সেখানে লিখেছেন, “একদিকে পণ্ডিতপ্রবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অপরদিকে খ্যাতনামা অক্ষয়কুমার দত্ত, এই উভয় যুগপ্রবর্তক মহাপুরুষের প্রভাবে বঙ্গভাষা যখন নবজীবন লাভ করিল, তখন তাহা সংস্কৃত বহুল হইয়া দাঁড়াইল। … অনেকে এরূপ ভাষায় প্রীতিলাভ করিলেন বটে, কিন্তু অধিকাংশ লোকের নিকট, বিশেষত সংস্কৃত অনভিজ্ঞ শিক্ষিত ব্যক্তিদিগের নিকট ইহা অস্বাভাবিক, কঠিন ও দুর্ব্বোধ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। … যখন বিদ্যাসাগর মহাশয় ও অক্ষয় বাবুর সংস্কৃত বহুল বাঙ্গালার ভার দুর্ব্বহ বোধ হইতে লাগিল, তখন মাসিক পত্রিকা নামে এক ক্ষুদ্রকায়া পত্রিকা দেখা দিল। প্যারীচাঁদ মিত্র ও রাধানাথ শিকদার এই পত্র সম্পাদন করিতেন। ইহা লোকপ্রচলিত সহজ বাঙ্গালাতে লিখিত হইত। … আলালের ঘরের দুলাল বঙ্গসাহিত্যে এক নবযুগ আনয়ন করিল। এই পুস্তকের ভাষার নাম ‘আলালী ভাষা’ হইল। তখন আমরা কোনও লোকের ভাষাকে গাম্ভীর্যে হীন দেখিলেই তাহাকে আলালী ভাষা বলিতাম। এই আলালী ভাষার উৎকৃষ্ট নমুনা হুতমের নক্সা। … এই আলালী ভাষার সৃষ্টি হইতে বঙ্গ সাহিত্যের গতি ফিরিয়া গেল। ভাষা সম্পূর্ণ আলালী রহিল না বটে কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্রী রহিল না, বঙ্কিমী হইটা দাঁড়াইল।” (পৃষ্ঠা – ১৪০ – ১৪১)

শিবনাথ শাস্ত্রীর মন্তব্যের শেষাংশে একটা চমক আছে। সাধারণভাবে সংস্কৃত রীতির গদ্য নিয়ে যারা আপত্তি তুলেছেন তারা এবং সাধারণভাবে বাংলা গদ্য শৈলীর বিশ্লেষকরা বিদ্যাসাগরীয় ও বঙ্কিমী ভাষাকে এক বর্গে রাখেন ও বঙ্কিমী গদ্যকে বিদ্যাসাগরীয় গদ্যেরই পরিশীলিত রূপ বলে বিবেচনা করেন। এই বর্গের চেয়ে আলালী ও হুতোমী ভাষাকে আলাদা বর্গের ভাষা বলেই সাধারণভাবে মনে করা হয়। শিবনাথ শাস্ত্রী যে আলালী গদ্যেকে বিদ্যাসাগরীয় গদ্যের উল্টোদিকে দাঁড় করানোর পর সেই আলালী গদ্যের উত্তরাধিকার বঙ্কিমী গদ্যে খুঁজে পেলেন, তা খানিক আশ্চর্যের ব্যাপার। আমাদের মনে হয় এখানে গদ্যশৈলির বিচারে শিবনাথ শাস্ত্রীর মতো বিশিষ্ট মানুষের খানিক ভ্রান্তিই ঘটেছে।

বাংলা ভাষার স্বাভাবিক রীতিটি কী এবং তাতে তৎসম ও আরবী ফারসী শব্দের ব্যবহারের বিষয়টি কয়েক শতক ধরে কীরকম ছিল, তা মধ্যযুগের সাহিত্য বিশ্লেষণ করে আমরা আলোচনা করতে পারি। কিন্তু তা স্বতন্ত্র এক অনুসন্ধানের বিষয়। বর্তমান আলোচনায় কেবল এটুকুই বলা যায় যে আলালী ভাষা সকল সাধারণের বোধগম্য এবং এ কারণেই তা বিদ্যাসাগর বঙ্কিমের চেয়ে স্বাভাবিক - এই দাবি নানা কারণেই যুক্তিসঙ্গত নয়। এর প্রমাণ হিসেবে আমরা নজর দিতে পারি এই বইয়ের সাহিত্য পরিষৎ সংস্করণটির দিকে।

১৩৪৭ বঙ্গাব্দ বা ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ সংস্করণটিতে মূল উপন্যাসের শেষে দুটি বিশেষ অংশ যুক্ত করেছেন দুই সম্পাদক - ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস। প্রথম অংশটির শিরোনাম " দুরূহ ও অপ্রচলিত শব্দের অর্থ।" মূল উপন্যাসটি যেখানে ১ থেকে ১৩৫ পৃষ্ঠা জুড়ে ছাপা, যেখানে এই অংশটি ১৩৭ থেকে ১৫৭ অর্থাৎ ২১ পাতা জায়গা নিয়েছে। দ্বিতীয় অংশটির শিরোনাম "অবহুপ্রচলিত প্রবাদবাক্য ও শব্দ বিন্যাসের নিদর্শন"। এই অংশটি ১৫৮ পাতা থেকে ১৬৪ অর্থাৎ ৭ পাতা জায়গা নিয়েছে। সাহিত্য পরিষদের মতো বিশিষ্ট সাহিত্য প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত এক মান্য সংস্করণে বজেন্দ্রনাথ ও সজনীকান্তর মতো দুই প্রাজ্ঞ ও অভিজ্ঞ সম্পাদককে ১৩৭ পাতার একটি উপন্যাসের পরিশিষ্টে যখন দুরূহ ও কম প্রচলিত শব্দর তালিকা তৈরির জন্য ২৮ পাতা ব্যয় করতে হয়, তখন সেই উপন্যাসের ভাষাকে জনসাধারণের ভাষা বলে চিহ্নিত করার সারবত্তা কতটা, সেই প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। দৃষ্টান্ত হিসেবে কিছু শব্দকে যদি পরিশিষ্টে দেওয়া তালিকা থেকে আমরা এখানে হাজির করি তাহলেই বোঝা যাবে এই ভাষা কতটা জনসাধারণের কাছে সহজবোধ্য।

আণ্ডিল (বহু ধনশালী ), আতাই (বিনা বেতনে সখের বাদ্যকর), আন্‌খা (অনভ্যস্ত), আবতলক (এখনো পর্যন্ত), আমপক (পবিত্র), ফয়লা (আমলা সদৃশ কর্মচারী), আয়েব (দোষ), উটনোওয়ালা (ধারে রোজকার মালসরবরাহকারী দোকানদার), উটনো (ধারে বিক্রয়), একিদা (একাগ্রচিত্ত/ ঝোঁক), এততাহাম (সন্দেহ), ওক্ত (সময়), ওয়াজিব (ন্যায়সঙ্গত), ওলাব (ফেলে দেওয়া) – এরকম বহু শব্দ উপন্যাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যার তালিকা করেছেন সম্পাদকদ্বয় ও তাদের অর্থও পাঠকের সুবিধার জন্য দিয়ে দিতে হয়েছে।

এমন নয় যে ঠকচাচার কথাবার্তাতেই কেবল আরবী ফারসী বহুল অপ্রচলিত শব্দ শোনা গেছে। সম্প্রদায় নির্বিশেষে নানাজনের সংলাপে ও আখ্যানের বর্ণনা অংশে অজানা, অল্পজানা শব্দ প্রচুর। ফলে আলালের ঘরের দুলালের ভাষাকে জনগণের মুখের স্বাভাবিক ভাষা হিসেবে দেখানোর যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তবে সেকালের অনেক বিশিষ্ট পাঠক কেন আলালী ভাষাকে এরকম মুখের ভাষা বলে মনে করছিলেন ? এরকম হওয়া কী সম্ভব যে আজকের অচলিত বা অল্প প্রচলিত শব্দগুলি তখনকার দিনে ততটা অচলিত ছিল না ? যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে মানতে হবে দেড়শ বছর দূরে দাঁড়িয়ে সেকালের গদ্য সম্পর্কে বিচার নানাভাবে সমস্যাজনক হয়ে উঠতে পারে।

স্বয়ং বঙ্কিমও আলালী গদ্য নিয়ে মূল্যবান আলোচনা করেছেন এবং সেই আলোচনায় আলালী গদ্যের শক্তি ও দুর্বলতার উভয় দিক বিশ্লেষণ করেছেন। বঙ্কিম লিখেছেন, “দুইটি গুরুতর বিপদ হইতে প্যারীচাঁদ মিত্রই বাঙ্গালা সাহিত্যকে উদ্ধার করেন। যে ভাষা সকল বাঙালির বোধগম্য এবং সকল বাঙালি কর্তৃক ব্যবহৃত, প্রথম তিনিই সেই ভাষা গ্রন্থ প্রণয়ণে ব্যবহার করিলেন।” তবে এখান থেকে যদি কারো মনে হয় যে বঙ্কিম বিদ্যাসাগরীয় ভাষার বিরুদ্ধে কথা বলছেন তা ঠিক হবে না। কারণ এর আগেই বঙ্কিম লিখেছেন, “বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষা অতি সুমধুর ও মনোহর। তাঁহার পূর্বে কেহই এরকম সুমধুর বাঙ্গালা গদ্য লিখিতে পারে নাই এবং তাহার পরেও পারে নাই।” বঙ্কিম বলেন যে বিদ্যাসাগরের গদ্যে মুগ্ধ হয়ে সেই আদর্শেই এরপর কেবল বাংলা গদ্য লেখা হয়েছে। ফলে গদ্যরীতিতে বৈচিত্র্যের অভাব দেখা গেছেপ্যারীচাঁদ এসে গদ্যের একটা নতুন আদল আনলেন। যা বিদ্যাসাগরের ভাষার চেয়ে মুখের ভাষার অনেক নিকটবর্তী হল। এবং ভাষার বৈচিত্র্য এল। কিন্তু আলালী গদ্যের সীমাবদ্ধতার দিকটিও বঙ্কিমের চোখ এড়ায় নি। তিনি লিখেছেন, আমি এমন বলিতেছি না যে আলালের ঘরের দুলালের ভাষা আদর্শভাষা। উহাতে গাম্ভীর্যের এবং বিশুদ্ধির অভাব আছে এবং উহাতে অতি উন্নতভাব সকল, সকল সময়ে পরিস্ফুট করা যায় কিনা সন্দেহ।” (বাঙ্গালা সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্রের স্থান – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।)

হুতোমের ভাষা বা আলালী ভাষার নির্দিষ্ট আদলটি ব্যঙ্গ সৃষ্টির কাজে অনেকদূর সার্থক। হুতোম যেখানে নক্সা লিখেছেন সেখানে এই ভাষা যতটা কার্যকরী, প্যারীচাঁদ যেখানে নভেল রচনা প্রয়াসী সেখানে এই ভাষা ততটা কার্যকরী কীনা তা এই প্রসঙ্গে আলোচনাযোগ্য। আলালের ঘরের দুলালের আখ্যানকার রচিত মুখবন্ধ পড়লেই বোঝা যাবে তিনি সচেতনভাবেই নভেল লিখতে চেয়েছিলেন। হিন্দু কলেজের বিখ্যাত ছাত্র ও নানা বিদ্যায় পণ্ডিত প্যারীচাঁদ পশ্চিমী নভেলের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে পরিচিত ছিলেন, এই অনুমানের সঙ্গত কারণ আছে। উপন্যাস যে নকশা জাতীয় আখ্যান থেকে আলাদা সেকথাও নিশ্চিত প্যারীচাঁদ জানতেন। উপন্যাসের ব্যাপ্ত জীবনদর্শন, তার ডায়লজিক ও পলিফোনিক চরিত্রর জন্য যে ধরনের ভাষা জরুরী তা কেবল ব্যাঙ্গাত্মক হতে পারে না। নিহিলিস্টিক সার্বিক আক্রমণ নয়, জীবন ও আদর্শের নির্মাণ বা তার ভাঙনযন্ত্রণা উপন্যাসকল্পনার ভিত্তি। তার বাহন হবে যে ভাষা তার মধ্যে তাই বহুস্তরিকতাকে ধারণ ও বহন করার উপাদান থাকা চাই। হুতোমী বা আলালী ভাষার তা ততটা নেই। তাই নক্সা লিখিয়ে হিসেবে কালীপ্রসন্ন এই ভাষা নিয়ে সফল হলেও নভেল লিখিয়ে হিসেবে আলালী ভাষার নিরীক্ষক প্যারীচাঁদ সেভাবে সফল নন। চরিত্রনির্মাণের ক্ষেত্রে দুর্বলতার পাশাপাশি ভাষাগত বিষয়টিও আলালের উপন্যাস সিদ্ধির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার জন্য দায়ী বলে আমাদের মনে হয়।

উপন্যাসকল্পনার সিদ্ধির জন্য বাংলা উপন্যাসকে আরো এক দশক ও বঙ্কিমের আবির্ভাব পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। ১৮৫৫ তে আলালের পত্রিকাপাঠ প্রকাশের দশ বছরের মাথায় ১৮৬৫ তে বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনীর আবির্ভাব থেকেই বাংলা উপন্যাস শিল্পসার্থকতার দিকে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে হাঁটতে শুরু করে। অবশ্য ‘বিষবৃক্ষ’ প্রকাশের আগে উপন্যাসোচিত বাস্তবতাকে বঙ্কিমও খুঁজে পান নি, রোমান্সের পথেই তাঁকে হাঁটতে হচ্ছিল। তবে উপন্যাসের শিল্প সার্থকতার উপযুক্ত ভাষাটি রোমান্স পর্বের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ বা ‘কপালকুণ্ডলা’তেই তাঁর আয়ত্তাধীন হয়েছিল। এই ভাষাগত সিদ্ধি যখন আধুনিক জীবনের জ্বলন্ত প্রশ্নগুলিকে নিয়ে ‘বিষবৃক্ষ’র মতো রচনার জন্ম দিল তখনই বাংলা উপন্যাস তার প্রকৃত জয়যাত্রা শুরু করল।