মুরাকামি, উইন্ড আপ বার্ড ক্রনিকল ও জীবনানন্দের ধূসর জগতে

And I, I know not if to pray/Still to be what I am, or yield, and be/Like all the other men I see.   - Matthew Arnold, A Summer Night

হারুকি মুরাকামির The Wind-up Bird Chronicle উপন্যাসটি নিয়ে বিশ্বজুড়ে মুগ্ধতার শেষ নেই। সম্পূর্ণ রচনাটি পড়ে শেষ করে ওঠার অভিজ্ঞতাটি  Journey Through Murakami’s Universe বললেও অত্যুক্তি হয় না। তাঁর উপন্যাসে মানব অস্তিত্বের রহস্যময়তা পাঠককে আকস্মিকভাবে জাদুবাস্তব জগতে নিয়ে যায়, কিছু অদ্ভুত পরিস্থিতিতে বিশেষ কিছু উপাদান দিয়ে তিনি একটু একটু করে গড়ে তোলেন এক সমান্তরাল পরাবাস্তব জগৎ যা পুরোটাই Gray scale-এ তৈরী। Walter Benjamin-এর ভাষায়, ‘Boredom is a warm gray fabric lined on the inside with the most lustrous and colorful silks. In this fabric we wrap ourselves when we dream.’ একাকী নিঃসঙ্গ যুবক, অপরিচিত ফোনকল, উধাও হয়ে যাওয়া পোষা বিড়াল, রহস্যময়ী অপরিচিতা নারী, প্রেমহীন যৌনতা, অতল অন্ধকারাচ্ছন্ন কূপ-এসব নিয়েই গড়ে ওঠে মুরাকামির আশ্চর্য পৃথিবী।   

টোকিও শহরতলীতে যুবক Toru Okada খুঁজে বেড়ায় তার স্ত্রীর হারিয়ে যাওয়া বিড়ালটিকে। একদিন ফিরে আসে না তার স্ত্রীও। বাস্তব ও পরাবাস্তবের সীমারেখা মুছে যেতে থাকে যখন অনুসন্ধানের মাধ্যমে পারিপার্শিক জগতের সমান্তরাল এক অধোজগতের অস্তিত্ব আসা যাওয়া করে Toru Okada-র জীবনযাপনে। সে কখনও মুখোমুখি হয় এক বিকারগ্রস্ত বেশ্যার, কখনও এক যুদ্ধ-ফেরত বৃদ্ধের, কখনও বা এক বিষাদময়ী তরুণীর, সমস্ত চরিত্রগুলি হয়ে ওঠে তারই অন্তর্গত অবদমিত গূঢৈ়ষার বহিঃপ্রকাশ। একসময় ধাঁধায় পড়ে পাঠক, প্রশ্ন জাগে মুরাকামিই উপন্যাসটি লিখছেন, না কি উপন্যাসটিই লিখে চলেছে লেখককে, নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে লেখকের অবচেতন জগৎকে? ‘Now the world had ceased to be the world, and I had ceased to be me.’ এই সমান্তরাল জগৎ - মনে হয় – প্রতিভাত হয় সকল ভাবুক মানুষের কাছেই, যা কখনও অলীক, কখনও স্বপ্ন, কখনও বা ঘোর বাস্তবের মাঝে আকস্মিকভাবে দেখা দিয়ে যায় মুহূর্তেরও ভগ্নাংশ সময়ে। কখনও ধরা পড়ে, কখনও বা অধরাই থেকে যায় অন্যমনস্কতা বা দৈনন্দিন ব্যস্ততার মাঝে।

দুঃখ বিষণ্ণতা নিঃসঙ্গতা৷ ফিরে ফিরে আসে মুরাকামির লেখায়। সাধারণ মানুষের দিনযাপন, তাদের ছোট ছোট সুখ-দুঃখ, মানসিক টানাপোড়েনকে মুরাকামি দেখেন যে অনুবীক্ষণের মধ্য দিয়ে, তাতে ধরা পড়ে মানুষের অন্ধকারাচ্ছন্ন মনোজগতও, যেখানে হঠাৎ আলো এসে পড়লে হয়তো শিউরে উঠতে হয়! কোথাও Psyche-কে Physical reality থেকে খুব সচেতনভাবে পৃথক করেছেন মুরাকামি, কোথাও মুছে দিয়েছেন এদের বিভেদ। ‘But now I could not even die. In my numbness, I lacked the strength to kill myself. I felt nothing: no pain, no joy. All feelings was gone. And I was not even me.’ কেন জানি না, এ লেখা পড়তে পড়তে মাঝে মাঝেই ভাবগত সাদৃশ্য খুঁজে পাই জীবনানন্দ দাশের নানা রচনার।

১৯৪৯ এ জন্ম মুরাকামির। ১৮৯৯ এ জীবনানন্দের জন্ম, মৃত্যু ১৯৫৪, অর্থাৎ কয়েকটি বছরের জন্য হলেও একই সময়ে একই পৃথিবীতে ছিলেন মুরাকামি ও জীবনানন্দ! বয়স ও ভৌগোলিক ব্যবধান দুস্তর হলেও surrealism, magical realism, postmodernism, realism ইত্যাদি শব্দগুলি এক বিন্দুতে সমাপতিত করে দুই লেখককে। চমকিত হই যখন দেখি মাটি খুঁড়ে ইতিহাসের পদচিহ্ন খুঁজে বার করার মতো অন্তর্মুখী দুই লেখকের রচনার সাদৃশ্যও তুলে আনা যায়। টোকিও শহরের উপকন্ঠে ঘুরে বেড়ানো যুবকটির মুখে অনায়াসে বসিয়ে দেওয়া যায় জীবনানন্দের কবিতার অংশ, মননের দিক থেকে একাকার হয়ে যায় Toru Okada ও মাল্যবান! উপরের উদ্ধৃতিতেই দেখি মুরাকামির উপন্যাসের চরিত্র Toru Okada এতটাই অসহায় যে কি না নিজেকে হত্যা করতেও অক্ষম, আনন্দ বা বিষাদ অনুভব করার শক্তিটিটুকু পর্যন্ত যার আর নেই, ‘All feelings was gone’ নিজের ‘আমি’টাকে পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে অনুভূতিহীন হয়ে গেছে সে। This person, this self, this me, was made somewhere else. Everything had come from somewhere else, and it would all go somewhere else. I was nothing but a pathway for the person known as me. তবু তার এই অসহায়তার ‘বোধ’ কিন্তু জেগে থাকে সমস্ত অসারতাকে ছাপিয়ে - ‘আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে/স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে;/স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,/হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!/আমি তারে পারি না এড়াতে,/সে আমার হাত রাখে হাতে;/সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়,/সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময়/শূন্য মনে হয়,/শূন্য মনে হয়!’ (বোধ, ধূসর পান্ডুলিপি)

অসুখী দাম্পত্যের বোঝা মাথায় নিয়ে পথ হাঁটে Toru Okada, ‘সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!’ তার নিঃসঙ্গতা, যন্ত্রণা বহে নিয়ে চলে তার চিন্তাস্রোত, ‘I examined each face as I walked by, and I wondered what kind of people these could be. What kind of houses did they live in? what kind of families did they have? What kind of lives did they lead? Did they sleep with women other than their wives, or men other then their husbands? Were they happy? Did they know how unnatural and artificial they looked?’ এই ‘unnatural’ ও ‘artificial’ লোকের ভীড়ে চিরটা কাল নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন জীবনানন্দও - অবসাদ, হতাশা, নৈরাশ্যের অন্ধকারে ডুবে গেছেন ক্রমশ। ২৬ জুলাই, ১৯৩২এ দিনলিপিতে লিখেছেন, ‘How spend a day; the Prison house feeling every moment.’ উপন্যাসে লিখছেন, ‘জীবনকে এমনি ক’রে শেষ দিন পর্যন্ত অনেক ছোটো ছোটো লোকের ছোটো ছোটো প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের সুবিধা বুঝে চলতে হবে শুধু। এই সব সুবিধা-অসুবিধার প্রয়োজনীয়তাকেই জীবন বলে বুঝতে হবে,....’ (নভেলের পান্ডুলিপি) ২৩ জানুয়ারী, ১৯৩২-এর দিনলিপিতে লিখছেন, ‘বসন্তের সন্ধ্যায় বাদামি পাতার সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার কুষ্ঠরোগীরা অকারণে মাঠে ভাসতে থাকে।’

গতানুগতিকতার Boredom কুরে কুরে খায় কিছু মানুষকে, একসময় মনে হয় নতুন করে শুরু করা যেত যদি! বদলে নেওয়া যেত নিজেকে! কক্ষপথ থেকে ছিটকে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছেও জাগে না কি? Toru Okadaও ভাবে, ‘Have you ever had that feeling – that you’d like to go to a whole different place and become a whole different self?’ জীবনানন্দতেও দেখি একই চিন্তার রূপভেদ, ‘- নিষ্ফলতা ও সমুদ্রের ভিতর ব’সে আছি শুধু; বুঝি যে, ইচ্ছে করলেই তীরের রোদ কোলাহল ও সর্ববাদিসম্মত আনন্দ উৎসব জয় ও সফলতার দিকে চ’লে যেতে পারা যায় হয়তো, - ইচ্ছাও হয়, কার না হয়? আমাদের সকলেরই হয় – কিন্তু, তবুও আমাদের সকলেই কে যেন এই নিরর্থকতা ও বেদনার ভিতর আটকে রাখে; আমাদের ইঞ্জিনিয়ার হ’তে দেয় না, ডাক্তার হ’তে দেয় না, উকিল হ’তে দেয় না, ব্যাবসায়ী হ’তে দেয় না, কোনও আপ্রাণ চাকরির মদের ভিতর কিম্বা কোনও নারীর ভালোবাসার সুরায়ও আমাদের ডুবিয়ে রাখতে দেয় না নিজেদের; স্বাধীন স্বাভাবিক মানুষ হ’তে দেয় না আমাদের।’ (নভেলের পান্ডুলিপি)

Kumiko ছেড়ে চলে যায় Toru Okada-কে। সোফা, ফোন, কিচেন, ইলেকট্রিক আয়রন, Spaghetti, Pasta, টি-শার্ট, কটন ট্রাউজারস, টেনিস-শু-র পুঁজিবাদী দুনিয়াকে পিছনে ফেলে একটা মানুষ অন্য একটি মানুষকে একা ফেলে চলে যায়, তার আগে অবশ্য অতিবাহিত হয় কত যন্ত্রণাদীর্ণ দিন, কত বিনিদ্র রাত! ‘That night, in our darkened bedroom, I lay beside Kumiko, staring at the ceiling and asking myself just how much I really knew about this woman. The clock said 2 a.m. She was sound asleep.’ দেখি দেশকালের সীমারেখা মুছে যায়, একই নিঃসঙ্গতা বিরাজ করে আমার ঘরেও, ‘ঘড়িতে প্রায় সাড়ে তিনটে বাজল: মাল্যবান দেখল। বিছানায় চিত কাত হয়ে ভেবেই চলেছে ক্রমাগত; এত ভাবায় হৃদয় শুকিয়ে যায় শুধু, কোনো তীরতট পাওয়া যায় না, আসে না চোখে এক পলক ঘুম।’(মাল্যবান)

চেতনার সৈকতে একের পর এক প্রশ্নের ঢেউ এসে আঘাত করে শুধু, উত্তর না পেয়ে ফিরে যায়, মিশে যায় রাতের আঁধারে, এমনই কত শত প্রশ্নের ঢেউ আমাদের মধ্যে প্রতিনিয়ত জন্ম নিয়েই লয়প্রাপ্ত হয়!   ‘…would I grow old and die without ever really knowing her? If that was all that lay in store for me, then what was the point of this married life I was leading? What was the point of my life at all if I was spending it in bed with an unknown companion?’ ‘নিজেরই মুদ্রাদোষে’ যে পুরুষ সত্যিই একা, সেই-তো ভাবে, ‘এই নারীকে নিয়ে কী সে করবে। উৎপলার এই সব ফাড়ন-ফোড়ন, শূন্যতা, দীর্ঘনিশ্বাস, আড়াআড়ি মাল্যবানের নিষ্ফলতা ও অব্যয় নিশ্বাস ঘরদোরের নিশ্চুপ বাতাসে ঘাই মেরে ফিরছে। কী হবে এই বাতাস ঘরদোর দিয়ে। এই নারী নিয়ে কী করবে সে।(মাল্যবান) বলাই বাহুল্য, জীবনানন্দ ও তাঁর স্ত্রী লাবণ্যের সম্পর্ক  তার অনেক লেখার সাব প্লট।

বিড়ালের প্রসঙ্গ ঘুরে ফিরে আসে মুরাকামির লেখায়। Kafka on the Shore হোক বা The Wind-up Bird Chronicle, বিড়াল একটি অন্যতম রূপক হয়ে ফিরে আসে মুরাকামির লেখায়। আলোচিত দ্বিতীয় উপন্যাসে Toru-র স্ত্রী Kumiko-র প্রিয় বিড়ালটির হারিয়ে যাওয়া অশুভ ইঙ্গিত নিয়ে আসে অসুখী জীবনের, বিড়ালটি যেন সেই পেলব তুলতুলে সুখী দাম্পত্যের মতো, সোহাগে-আদরে-আঁচড়ে-কামড়ে যার বহিঃপ্রকাশ।

জীবনানন্দের কবিতাতেও বিড়ালের প্রসঙ্গ বারে বারে আসে, যদিও সুখের প্রতীক হিসেবে নয়, নিজের alter-ego হিসেবেই, ‘সারাদিন একটা বেড়ালের সঙ্গে ঘুরে ফিরে কেবলই আমার দেখা হয়:/গাছের ছায়ায়, রোদের ভিতরে, বাদামি পাতার ভিড়ে;/কোথাও কয়েক টুকরো মাছের কাঁটার সফলতার পর/তারপর শাদা মাটির কঙ্কালের ভিতর/নিজের হৃদয়কে নিয়ে মৌমাছির মতো নিমগ্ন হয়ে আছে দেখি;/কিন্তু তবুও তারপর কৃষ্ণচূড়ার গায়ে নখ আঁচড়াচ্ছে,/সারাদিন সূর্যের পিছনে পিছনে চলছে সে।/একবার তাকে দেখা যায়,/একবার হারিয়ে যায় কোথায়।/হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান রঙের সূর্যের নরম শরীরে/শাদা থাবা বুলিয়ে বুলিয়ে খেলা করতে দেখলাম তাকে;/তারপর অন্ধকারকে ছোটো ছোটো বলের মতো থাবা দিয়ে লুফে আনল সে,/সমস্ত পৃথিবীর ভিতর ছড়িয়ে দিল।’ (বেড়াল, বনলতা সেন)

Surrealist-রা নিত্য অভ্যস্ত বস্তুর সত্য ও স্বপ্নবৎ মুহূর্তকে মেলাতে চেয়েছিলেন পরাবাস্তবের ম্যানিফেস্টো রচনা করে, জীবনানন্দ ছিলেন তার বলিষ্ঠ শিল্পী। ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যগ্রন্থের ‘সুবিনয় মুস্তাফী’ কবিতায় পাই: ‘সুবিনয় মুস্তাফীর কথা মনে পড়ে এই হেমন্তের রাতে।/এক সাথে বেড়াল ও বেড়ালের-মুখে –ধরা ইঁদুর হাসাতে/এমন আশ্চর্য শক্তি ছিল ভূয়োদর্শী যুবার।’

বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের ‘বিড়াল’ কবিতাটির আনুষঙ্গিক কবিতা ‘সিনেমার দেশে’র পাঠ ছিল এইরকম: ‘যখন উঠেছে চাঁদ মাঝরাতে – বনের বিড়াল/গোপন সোনালি চোখ তুলে দিয়ে একবার দেখে/অই চাঁদ অই বন – নরম বাদামি পাতাজাল/কখন গিয়েছে ভরে বনের বিড়ালে একে একে।/তাহারা চাঁদের তলে পশমের থাবা তুলে দিয়ে/রেশমে রেশম লেজ নাচায় লেজের মখমলে।/লুকোচুরি ছায়া চঁদে – চাঁদ আর ছায়া ভুলে গিয়ে –/অথবা তুলোর চাঁদই ভালো না কি চাঁদের বদলে?’ এর পাশাপাশি মুরাকামির লেখার অংশ তুলে ধরা যাক: ‘In the darkness, I saw the four legs of Noboru Wataya, four silent brown legs above four soft paws with swelling, rubberlike pads, legs that were treading the earth somewhere without a sound.’

জয়েসের লেখাতে যেমন ডাবলিন, মুরাকামির লেখাতে ফুটে ওঠে টোকিও শহর ও তার সংলগ্ন অঞ্চল, সাদামাটা, নিঃসঙ্গ মানুষ। পাশাপাশি জীবনানন্দের লেখাতে কলকাতা শহর বাস করে সন্ধ্যার বিষণ্ণতা নিয়ে, কাল্পনিক জনপদ জলপাইহাটি বা বাসমতীতেও ছায়া ফেলে যায় বরিশাল। Robert Musil তাঁর ‘The Man Without Qualities’ মহাগ্রন্থে বলেছিলেন, ‘Cities, like people, can be recognized by their walk.’ মুরাকামিও তাঁর আশ্চর্য গদ্যে ফুটিয়ে তোলেন শহুরে যান্ত্রিক জীবনের শূন্যতা, চিন্তার দৈন্য, ‘Looking up at [the sky], I think about the October evening world, where 'people' must be going about their lives. Beneath that pale autumn light, they must be walking down streets, going to the store for things, preparing dinner, boarding trains for home. And they think--if they think at all--that these things are too obvious to think about, just as I used to do (or not do).’

একই চেতনাপ্রবাহ খেলা করে জীবনানন্দের গদ্যেও - ‘বড়ো রাস্তার দিকেই ঘর নিয়েছি – তেতলায়। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ট্রাম-বাসের হুড়োহুড়ি দেখি; সন্ধ্যার সময় গ্যাসের আলো জ্ব’লে ওঠে সব; কোথায় পিলুবাঁরোয়ায় বাঁশি বাজে; দু’চারটে ছেলেকে পুলিসে ধ’রে নিয়ে যায়; চার টনের লরি বে-আইনিভাবে নীচের ময়রার দোকানের পঁচিশ টনের চিনির বস্তা নিয়ে হাওড়ার দিকে ছোটে; পশ্চিমে-মুসলমান এক পাল ভেড়া তাড়িয়ে নিয়ে যায়; ধুমসো মেটে মহিষগুলো ভিজে কালো হয়ে যায়; এক-আধটা মড়ার খাটিয়া নিমতলার দিকে নিশির-ডাকে ভেসে চলেছে ব’লে মনে হয় – চুরুট জ্বালিয়ে নিজের পৃথিবীতে ফিরে আসি।’ (নভেলের পান্ডুলিপি)

মুরাকামির উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলির একাকিত্ব ভীষণ রকম urban,  ‘Not one human being would have noticed that I was gone. I could disappear from the face of the earth, and the world would go on moving without the slightest hiccup. Things were tremendously complicated, to be sure, but one thing was clear: no one needed me.’ এতটাই অসহায় তারা যে তাদের মনের প্রবল নৈরাশ্য নিয়ে আসছে দৃঢ় প্রত্যয় যে সর্বত্র সম্পূর্ণ অনাকাঙ্খিত তারা! এই অবধারিত বিষাদের তিক্ততা নীলছায়া ফেলে না কি আমাদের জীবনেও? জীবনানন্দ যেখানে বলেন, ‘চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে/একগাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা একা;’। বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যাবেলায় অফিসফেরত হাঁটতে হাঁটতে এক একদিন বড় বাহুল্য মনে হয় না কি এ জীবনকে? এই ‘মাছের কাঁটার সফলতা’কে? মনে হয় না কি ‘এর থেকে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া ভালো।’ চলন্ত ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে বা বহুতলের শিখর থেকে এক পা বাড়িয়ে প্রবল বাতাসের ঝাপটায় চোখ বুজে ফেলতে হয় না কি কখনও কখনও? ‘লীন হয়ে গেলে তারা তখন তো – মৃত।/মৃতেরা এ পৃথিবীতে ফেরে না কখনও।’    

Toru Okada, Kumiko একবিংশ শতাব্দীর মর্মমূলে প্রোথিত নিঃসঙ্গতারই প্রতিফলন, যে ‘নিঃসঙ্গতা হাজার বছরের’ অবদমিত প্রতিক্রিয়ার ফসল। সমাজের সনাতন মূল্যবোধগুলো যখন একে একে ভেঙে পড়ছে, মানুষ ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, তখন অবচেতন মনের কোনো এক গূঢ়ৈষণা হয়ে উঠতে থাকে মানব-মনের মূল চালিকাশক্তি, হয়তো তার প্রভাবেই পকেটে পাথর ভরে জলে নেমে পড়েন ভার্জিনিয়া উলফ্, Rimbaud লেখা ছেড়ে দেন কুড়ির কোঠায়, ওভেনে মাথা ঢুকিয়ে দেন সিলভিয়া প্লাথ, চন্দ্রাহত শিল্পী ভ্যান গঘ রিভলভারের ট্রিগারে চাপ দেন কোনো এক রৌদ্রদগ্ধ দিনে, দিগ্ন্তবিস্তৃত সূর্যমুখীর ক্ষেতে ঝলসায় পরাজাগতিক রোদ্দুর।  বহুমাত্রিক এই উপন্যাসের পাঠও একসময় শেষ হয়, কিন্তু মনের মধ্যে আনাগোনা করে অমোঘ সেই প্রশ্ন: ‘...isn’t that just what life is? Aren’t we all trapped in the dark somewhere, and they’ve taken away our food and water, and we’re slowly dying, little by little…?’