নারীর শরীর : নারীর ভাষা

সমাজের প্রান্তিক মানুষদের কণ্ঠস্বর গিয়ে পৌঁছয় না ঊর্ধ্বতনদের কান পর্যন্ত। এক হিসেবে প্রান্তিক এ সমাজের মেয়েরাও। বহুযুগ ধরে সমাজ ‘অপর’ করে রেখেছে তাদের। নিজের কথাটুকু সোচ্চারে জানানোর জন্য তাদের প্রয়োজন হয়েছে অন্য এক ভাষার, ভিন্ন এক বাচনভঙ্গির। সেই ‘অন্য’ ভাষার মাধ্যম কখনও কখনও হয়ে উঠেছে তাদের শরীর। যে সমাজ তাদের দেখে কেবলমাত্র একটা ‘শরীর’ হিসেবে, সেই শরীরকেই তারা করেছে নিজেদের হাতিয়ার। পিতৃতন্ত্র মনে করে, এই শরীরটার ওপর আঘাত হানতে পারলেই, এই শরীরটাকে বেআব্রু করলেই বুঝি আক্রমণের চূড়ান্ত হবে। এই পিতৃতন্ত্রকেই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দোপদি মেঝেন-রা প্রতিবাদের আগুনে ঝলসে ওঠে। ‘সতীত্ব’ শব্দটার নির্মাণ যে শুধুমাত্র পিতৃতন্ত্রের সুবিধার্থে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই চরিত্ররাই। পাশাপাশি উঠে এসেছে আরও কিছু চরিত্র, যাদের মুখের ভাষার চেয়ে জোরালো হয়ে উঠেছে তাদের শরীরের বলতে চাওয়া কথাগুলি। 
গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের বিখ্যাত প্রবন্ধ সংকলন— ‘Can the subaltern speak?’ অনেকখানি পর্ব জুড়ে গড়ে উঠেছে। পরবর্তীকালে স্পিভাক সেটির একটি ভূমিকা লেখেন— ‘In response, looking back, looking forward’ নামে। সেখানে ‘Can the subaltern speak?’-এর ভাবনাটি গড়ে ওঠার প্রসঙ্গে তিনি কিছু কথা বলেন। প্রথমে এটি একটা প্রবন্ধকে ঘিরে গড়ে ওঠে— ‘Power and desire’, ১৮৮৩-তে এই বিষয় নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি মহাশ্বেতা দেবীর কিছু গল্প অনুবাদ করেন। স্পিভাক এর আগে দেরিদা, মার্ক্সের ওপরে কাজ করেছেন। তারপরে তাঁর কাছে ফেমিনিস্ট ভাবনা নিয়ে কিছু লেখার প্রস্তাব আসে। সেসময় দুটো বিষয় তাঁকে অনুপ্রাণিত করে— এক, মহাশ্বেতা দেবীর কিছু গল্প যা তিনি অনুবাদ করবেন বলে পড়তে শুরু করেন, দুই, তাঁদের নিজেদের পারিবারিক স্মৃতি, যা তিনি ছেলেবেলায় শুনেছিলেন, যার কেন্দ্রে রয়েছে ভুবনেশ্বরী ভাদুড়ী নামে এক মেয়ের আত্মহত্যার ঘটনা। Colonial period এর একটি প্রথা সতীদাহ-কে তুলে এনে তাঁর ভাবনাটা সাজাচ্ছেন তিনি। মহাশ্বেতা দেবীর গল্প অনুবাদ করতে গিয়ে স্পিভাক বিষয়টাকে নতুনভাবে দেখেন। 
 
 
১৯ শতকে সতীদাহ প্রথাটি রদ হয়। প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। বৃটিশ সরকারের সাহায্য নিয়ে এই নারকীয় কুপ্রথাটি তিনি বন্ধ করেন। এখানে গায়ত্রী বলছেন— সতীদাহ প্রথা রদটিকে কেন্দ্র করে একদিকে পিতৃতান্ত্রিক সদাচার, অন্যদিকে উপনিবেশের অন্তর্গত একটা সামাজিক সংস্কার— এই দুইয়ের জাঁতাকলে পড়ে যে মেয়েরা ‘সতী’ হতে বাধ্য হত, তারা মাঝখানে আটকে পড়ল। তিনি বলতে চাইছেন, ‘সতী’ ভারতীয় (কু)সংস্কার, বহুদিন ধরে সমাজে বিদ্যমান। মহাকাব্যে, পুরাণে, ইতিহাসে সর্বত্র এর উপস্থিতি। রাণী পদ্মিনীকে নিয়ে হাল আমলেও চলচ্চিত্র বানানো হচ্ছে, যা কোটিটাকার ব্যবসা করেছে বক্স অফিসে। একটি মেয়ে তার সতীত্ব বজায় রাখতে আগুনে পুড়ে আত্মহত্যা করছে— এই ঘৃণ্য, নারকীয় ঘটনাটিকে ‘glorify’ করা হচ্ছে। এই glorification-এর চেষ্টাটি ভারতীয় সমাজে ভীষণভাবে ছিল। এর পেছনে একাধিক উদ্দেশ্য ছিল— বিধবাটিকে সম্পত্তির অধিকার যাতে না দিতে হয়, সে যেন অন্য পুরুষ সঙ্গী বেছে না নেয়, তাই তাকে হত্যা করো! রামমোহন উদ্যোগ নিয়ে এই কুপ্রথা বন্ধ তো করলেন। কিন্তু আমরা যদি ভারতীয় সাহিত্য সংস্কৃতির দিকে দৃষ্টিপাত করি, তাহলে দেখবো রাজস্থানের মতো কিছুটা রক্ষণশীল সমাজে আজও ‘সতী’দের একটা অসম্ভব শ্রদ্ধার জায়গা রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন কেল্লায়, দুর্গে হাতের ছাপ থাকে। স্থানীয় মানুষ তাতে কপাল ঠেকান, সেগুলো ‘সতীমায়ের’ হাতের ছাপ! সাহিত্যে, দর্শনে এই নারকীয় হত্যালীলাটিকে নানাভাবে মহিমান্বিত করা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যেও নারীর সতীত্বের প্রতি সম্ভ্রম, শ্রদ্ধার স্থান রয়েছে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিতেও সতীপ্রথাকে মহান ব্যাপার বলে চালানোর চেষ্টা শৈল্পিক প্রকাশের মধ্যে বারবার ধ্বনিত হয়েছে। ইংরেজরা এই প্রথাটি বন্ধ করেছিল— তাদের উদ্দেশ্য ছিল প্রাচ্যের বর্বর, অসভ্য মানুষগুলোকে সভ্যতা শেখানো। তাদের ধারণা প্রাচ্য অন্ধকারে আচ্ছন্ন, পাশ্চাত্য অনেক বেশি আলোকপ্রাপ্ত। দুটো শব্দবন্ধ ব্যবহার করছেন গায়ত্রী; এই যে সতীপ্রথা, এটা কোনও ‘আত্মঘাত’ বা ‘হত্যা’ নয়, এটা ‘আত্মোৎসর্গ’— ভারতীয় ঐতিহ্য বলছে, ‘women wants to die’, তারা নিজেদের ‘উৎসর্গ’ করতে চায়। বিপরীতে আরেকটি বাক্যবন্ধ— ‘white men are saving brown women from brown men.’ এখানে গায়ের রংটি তাৎপর্যপূর্ণ। গায়ত্রী বলছেন— ‘These are two dialectically interlocking sentences.’ দ্বান্দ্বিকভাবে আটকে থাকা দুটো বাক্যবন্ধ— একটা দিকে মনে করা হচ্ছে, মেয়েরা আত্মোৎসর্গ করতে চায়, আরেকদিকে বলা হচ্ছে, মেয়েরা উদ্ধার পেতে চায় এই ভয়ংকর মৃত্যুর হাত থেকে। আত্মোৎসর্গের কথাটা ভাবছে প্রাচ্য পিতৃতন্ত্র, উদ্ধারের কথাটা ভাবছে পাশ্চাত্য পিতৃতন্ত্র। এর মাঝখানে মেয়েরা কী চাইছে, সেটাই উপেক্ষিত প্রবলভাবে। সেটাই গায়ত্রী বলার চেষ্টা করছেন। সেই সূত্রে একটা পুরনো স্মৃতি ফিরিয়ে আনছেন। মেয়েদের কথা বলতে দেওয়া হয় না, তাই তারা নতুন বয়ান খুঁজে নেয় তাদের শরীরকে দিয়ে। কীভাবে, তা বোঝাতে গিয়ে ‘Can the subaltern speak?’এর দ্বিতীয় ভাগে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতি থেকে একটা গল্প বলেন। তাঁর পরিবারের একটি মেয়ের গল্প। ১৯২৬ সালে উত্তর কলকাতার মধ্যবিত্ত পরিবারের অবিবাহিতা এক মেয়ে, নাম তার ভুবনেশ্বরী ভাদুড়ী। সে আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যার ঘটনা তো প্রচুরই ঘটে থাকে, কিন্তু এই আত্মহত্যাটি একটু আলাদা। ভুবনেশ্বরী নামে বছর সতেরোর অবিবাহিতা মেয়েটি আত্মহত্যার একটি বিশেষ সময় নির্বাচন করেছিল, যেখানে সে চেয়েছিল তার মৃত শরীর কথা বলুক। সেই সময়ে মেয়েটি রজঃস্বলা ছিল। স্পিভাক বলছেন, বহুদিন পর্যন্ত এই ঘটনাটির কথা পরিবারে অনুচ্চারিত ছিল। কমবেশি সকলেই এটা জানতো। কেউ আলোচনা করত না। স্পিভাক কারণগুলো খুঁজতে শুরু করেন— কেন মেয়েটি ওই বিশেষ সময় বেছে নিয়েছিল? একটি চরমপন্থী সন্ত্রাসবাদী দলের সঙ্গে মেয়েটি যুক্ত হয়। সেই দলের তরফ থেকে মেয়েটিকে একটি রাজনৈতিক হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয়, যেটি সেই মেয়েটি কিছুতেই করে উঠতে পারেনি। বিবেকের দংশন, দলের প্রতি কর্তব্যবোধ থেকে চ্যুত হওয়া— সব মিলিয়ে সে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। সে সময়ে কোনও অবিবাহিতা মেয়ে আত্মহত্যা করলে ধরেই নেওয়া হত, সে গর্ভবতী হয়ে পড়েছে, তাই তাকে আত্মহত্যা করতে হয়েছে। আত্মহত্যার সব ঘটনাই চাপা দিয়ে দেওয়া হত, লাশ মর্গে নিয়ে গিয়ে ময়নাতদন্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হত না। সুতরাং মেয়েটি যে গর্ভবতী নয়, সেটি বোঝার বা পরীক্ষা করানোর চিন্তা কারোর মাথাতেই আসতো না। ধরেই নেওয়া হত, সে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। মেয়েটি বলতে পারছে না, কোথাও লিখে যেতে পারছে না তার মৃত্যুর কারণ। অথচ তার মৃত্যুর পর সমাজ তার আত্মহত্যার কী অর্থ বের করবে, তা সে জানে। তাই সে তার মৃত শরীরকে ভাষা দেয় এটা বোঝানোর জন্য যে, সে গর্ভবতী ছিল না। রজঃস্বলা থাকার সময় কোনও সতীনারীকে চিতায় তোলা হত না। তাকে ‘স্নাত, শুদ্ধ, পবিত্র’ হতে হবে— এমনটাই ছিল নিয়ম। কারণ মনে করা হত, ঋতুকালীন সময়ে নারীদেহ ‘অপবিত্র’ থাকে। সেই অপবিত্রতাকে ব্যবহার করে ভুবনেশ্বরী ভাদুড়ী তার নিজের মৃত্যুর সত্যিটা তুলে ধরতে— ‘by turning her body into a text of women's right.’ ভুবনেশ্বরী যদি নিজের মুখে বলেও যেত কথাটা, কেউ বিশ্বাস করতো না। তাই সে এমন একটা পদ্ধতি বেছে নিল, যাতে সবাই নিশ্চিত হয় যে সে অন্তঃসত্ত্বা ছিল না। যে ক্ষমতায় নেই, তার কন্ঠ পৌঁছয় না অন্যদের কানে। তার জন্য প্রয়োজন অন্য ভাষা, অন্য অভিব্যক্তি।
 
এই জায়গা থেকে গুরুত্বপূর্ণ মহাশ্বেতা দেবীর উপন্যাস ‘হাজার চুরাশির মা’, তাঁর লেখা একটি বড়গল্প ‘স্তনদায়িনী’ এবং একটি ছোটগল্প ‘দ্রৌপদী’। ‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসে দেখি এক অভিজাত বনেদী পরিবার, যার কেন্দ্রীয় চরিত্র সুজাতা। সুজাতা ব্রতী চ্যাটার্জীর মা। পরিবারে ভয়ংকর পিতৃতন্ত্র। স্বামীর সঙ্গে সুজাতার মানসিক যোগ নেই। স্বামী পরনারীগমন করে ও এটাকে সে পৌরুষের পরিচয় বলে মনে করে। সুজাতা সব মেনে নিয়েছিলেন। ব্রতী যে নকশাল, সুজাতা জানতে পারেননি। ব্রতী ‘এনকাউন্টারে’ মারা যায়। তার বাবা পরিবারের ‘কলঙ্ক’ মুছতে তৎপর হয়। ব্রতী চ্যাটার্জী হারিয়ে যায়, সে শুধুই হাজার চুরাশি নম্বর লাশ। পরিবারের বাকিরাও আপত্তি জানায়নি। ভুলতে পারেননি শুধু সুজাতা। ছেলে কাদের সঙ্গে মিশত, জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোয় সে কোথায় ছিল— সুজাতা জানার চেষ্টা করতে শুরু করেন। একটু একটু করে চিনতে থাকেন তাঁর ছেলে ব্রতীকে। এই ব্রতী তাঁর একার। পরিবারের বাকি মানুষগুলোর সঙ্গে মানসিক দূরত্ব এতই বেশি ছিল, তিনি তাঁর মনের অভিব্যক্তিগুলো কোনওদিনই প্রকাশ করতে পারেননি, বা বলা ভালো, প্রকাশ করতে দেওয়া হয়নি। ক্ষোভ, অভিমানের পরত জমতে জমতে সুজাতা কবেই যেন নির্লিপ্ত হয়ে গিয়েছেন, হয়তো নিজেও তা বোঝেননি। ব্রতী হয়তো তার মা’কে বুঝতো। কিন্তু সেই ব্রতীও চলে গেল। জোর করে ব্রতীর বেঁচে থাকার চিহ্নগুলোও সরিয়ে দেওয়া হল। যেন ব্রতী বলে ও বাড়িতে কেউ কোনওকালে ছিলই না। সুজাতা প্রতিবাদ করতে পারেননি। অসহ্য কষ্টে নিঃশব্দে গুমরেছেন ভেতরে ভেতরে। এদিকে শরীরে তাঁর বাসা বেঁধেছে রোগ, অ্যাপেনডিক্স ফুলছে। সুজাতার মনে হয় তিনি যেন বহন করছেন এক নতুন ব্রতীর ভ্রুণ। উপন্যাসের শেষে সুজাতার অ্যাপেনডিক্স ফেটে যায়। “দীর্ঘ আর্ত হৃৎপিণ্ডচেরা বিলাপ বিস্ফোরণের মত, প্রশ্নের মত, ফেটে পড়ল, ছড়িয়ে গেল কলকাতার প্রতি বাড়ি— শহরের ভিতের নিচে ঢুকে গেল, আকাশপানে উঠে গেল।”— শরীর এখানে ভাষা পাচ্ছে। প্রতিবাদের মাধ্যম এখানে ‘গর্ভ’। 
 
‘স্তনদায়িনী’ গল্পে যশোদা পেশাদারী মা— হালদারবাড়ির দুধ-মা। দুধের যোগান দিতে তাকে সবসময় গর্ভবতী থাকতে হয়েছে। নিজের কুড়িটি সন্তান এবং হালদারবাড়ির জনা তিরিশেক বাচ্চাকে বুকের দুধ খাইয়েছে সে। একসময় তার গর্ভধারণের ক্ষমতা শেষ হল। যশোদার স্তনে ক্যানসার ধরা পড়ল। পঞ্চাশটা শিশুকে যে নিজের বুকের দুধ খাইয়েছে, তার পাশে কেউ থাকে না। ‘ক্রমে যশোদার বামস্তন ফেটে আগ্নেয়গিরির ক্রেটারসদৃশ হল’। যশোদাকে বেওয়ারিশ লাশ বানিয়ে দিল বিশ্বসংসার। ‘যশোদা ঈশ্বর-স্বরূপিনী’।  ‘এ সংসারে মানুষ ঈশ্বর সেজে বসলে তাকে সকলে ত্যাগ করে এবং তাকে সতত একলা মরতে হয়।’
 
 
মহাশ্বেতা দেবীর ছোটগল্প ‘দ্রৌপদী’তে প্রতিবাদের মাধ্যম হয়ে উঠেছে যোনি। যশোদা, সুজাতা-রা প্রতিবাদ করতে শেখেনি। তাদের শরীর তাদের হয়ে কথা বলেছে। কিন্তু এ গল্পের দোপদি মেঝেন প্রতিবাদটা করতে পেরেছে। কমরেড দোপদি মেঝেনকে ধরার পর সেনানায়কের হুকুম হয় ‘ওকে বানিয়ে নিয়ে এস।’ খুঁটোয় দুটো হাত, দুটো পা বেঁধে রেখে রাতভোর তাকে ধর্ষণ করে একাধিক মানুষরূপী জানোয়ার। আসলে পিতৃতন্ত্র ধরেই নেয়, একটি মেয়ের মনের জোর ভাঙতে হলে তার শরীরকে বেআব্রু করলেই যথেষ্ট। সকালে দ্রৌপদীর গায়ের ওপর ছুঁড়ে দেওয়া হয় তার কাপড়। মহাভারতের দ্রৌপদীর লজ্জা ঢাকতে প্রয়োজন হয়েছিল মধুসূদনের। মহাশ্বেতা দেবীর দ্রৌপদী বস্ত্র পরতেই অস্বীকার করে। তার প্রয়োজন নেই কোনও লজ্জাহর মধুসূদনের। উরু  যোনিকেশে চাপ চাপ রক্ত, ক্ষতবিক্ষত স্তন নিয়ে উলঙ্গ দ্রৌপদী মাথা সোজা রেখে হেঁটে এগিয়ে যায় সেনানায়কের দিকে। “চারদিকে চেয়ে দ্রৌপদী রক্তমাখা থুতু ফেলতে সেনানায়কের সাদা বুশ শার্টটি বেছে নেয় এবং সেখানে থুতু ফেলে বলে, হেথা কেও পুরুষ নাই যে লাজ করব। কাপড় মোরে পরাতে দিব না। আর কী করবি? লেঃ কাঁউটার কর্ লেঃ কাঁউটার কর্—?” এই নগ্ন, নগ্নিকার চেহারা দেখে কেঁপে ওঠে পুরুষেরা। “এই প্রথম সেনানায়ক নিরস্ত্র টার্গেটের সামনে দাঁড়াতে ভয় পান, ভীষণ ভয়।”
 
প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে, দুটি চলচ্চিত্রের কথা— ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত ‘Chitrangada : The crowning wish’ এবং অপর্ণা সেন পরিচালিত   ‘সতী’। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘চিত্রাঙ্গদা’-য় রুদ্র ভালোবাসে পার্থকে। সমলিঙ্গ দম্পতি বাচ্চা দত্তক নিতে পারবে না জেনে রুদ্র সিদ্ধান্ত নেয় সে তার শরীরটাকে ‘নারী’শরীরে রূপান্তরিত করবে। অপারেশনের দীর্ঘ প্রস্তুতিপর্ব চলে, রুদ্রর মনেও চলে নানা টানাপোড়েন। ছবির শেষে কিন্তু রুদ্র আর চায়নি তার শরীরটা নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে। সে যে মনেপ্রাণে একজন নারী, সমাজের কাছে তাকে নতুন করে নারীত্বের প্রমাণ দেওয়ার তো দরকার নেই। সমাজের টেনে দেওয়া গণ্ডীর মধ্যে কেন তাকে থাকতে হবে? সমাজের চোখে একটা আদর্শ নারীশরীর যা, তেমন করে তাকে কেন সাজতে হবে? নিজেকে রুদ্র ভালোবেসেছে, নিজের শরীররকে সে মান্যতা দিয়েছে। সে যেমন, তেমনটাই সমাজ গ্রহণ করুক— এটাই রুদ্র চেয়েছে। ছবিটি শেষ হয়েছে এই সুন্দর কথাটি দিয়ে— “Be What You Wish To Be.” আত্মপরিচয়, নিজের কথাটুকু সোচ্চারে বলা— এসবের চেয়েও জরুরি হয়ে উঠেছে নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া। আমি কি শুধুই চিৎকার করে আমার কথা বলতে চাই নাকি নিজের মধ্যে যে পরিচয় বহন করছি, যাপন করছি তাকে মান্যতা দিতে চাই?— এই প্রশ্নই এই চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। 
 
১৯৮৯ সালে নির্মিত ‘সতী’ চলচ্চিত্রে উনবিংশ শতকের প্রেক্ষাপট ব্যবহার করে ভীষণ আধুনিক বক্তব্য তুলে আনতে চেয়েছেন পরিচালক অপর্ণা সেন। এ ছবিতে পাশ্চাত্যের নারী আন্দোলনগুলোর প্রভাব অবশ্যই পড়েছে। এর আগে বাংলায় মহিলা পরিচালক সেভাবে পাই না। ১৮২৭ খ্রিঃ, ১২৩৪ বঙ্গাব্দ— এভাবে সময়টা title-এ দিয়েই সিনেমাটি শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে এক সতীর ঘটনা দিয়ে, শেষও হয়েছে আর এক সতীর ঘটনা দিয়ে। শুরুর ঘটনায় গ্রামের পুরোহিত বাচস্পতি মহাশয় ও আরও অন্যান্যরা মিছিল করে যাচ্ছে। সতী হতে যাওয়া মেয়েটির অর্ধসচেতন অবস্থা। শেষপর্যন্ত মিছিল পৌঁছল নদীর ঘাটে, মেয়েটিকে জীবন্ত চিতায় তুলে দেওয়া হল। সেখানেই দেখা যাচ্ছে, দূর থেকে আরেকটি মেয়ে অদ্ভুত ভীরু-কৌতূহলী দৃষ্টিতে গাছের আড়াল থেকে ঘটনাটা দেখছে। অন্য মেয়েরা যেমন দৌড়ে দৌড়ে এসে সতীমায়ের পায়ের ধুলো নিচ্ছে, কপালে সিঁদুর পরাচ্ছে, এই মেয়েটি তা করছে না। মেয়েটি উমা— কুলীন ব্রাহ্মণ গঙ্গাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের আশ্রিতা। গঙ্গাচরণের পরিবারে স্ত্রী, দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে বিবাহিত, তার স্ত্রী ছেলেমেয়ে আছে। ছোটছেলে অবিবাহিত, তার বিয়ে করার ইচ্ছা নেই, সে কীর্তনের দল চালায়। মেয়েটি অবিবাহিতা, তার বিয়ের জন্য উদ্বেগ রয়েছে। আর একটি মানুষ রয়েছে এই পরিবারে, যদিও তাকে মানুষ বলে গণ্য করা হয় না— সে উমা, অনাথা। গঙ্গাচরণের বোনের মেয়ে। উমা মূক, কিন্তু বধির নয়। সে শুনতে পায়, কিন্তু বলতে পারে না— এখানেই অপর্ণা সেন একটি অন্যরকম ভাবনা এনেছেন— স্পিভাকের ‘Can the subaltern speak?’-এর দৃষ্টিকোণ থেকে উমা-র কথা বলতে না পারা-টা গুরুত্বপূর্ণ। বোবা মেয়েদের যন্ত্রণা, নানাভাবে তাদের সুযোগ নেওয়া হয়— রবীন্দ্রনাথের ‘সুভা’ গল্পে দেখা গেছে। কিন্তু অপর্ণা সেন উমা-কে তৈরি করলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে। 
 
উমা অনাথা, পরগাছার মতো বড় হয়ে উঠেছে। মামীমা তাকে তিনমাসেরটি কোলে নিয়ে বড় করে তুলেছেন, এটা তিনি জোরগলায় সবসময় বললেও এটা বেশ বোঝা যায় তাঁর ব্যবহার থেকে যে তিনি তাকে বাড়িতে একটি বিনামাইনের কাজের দাসী ছাড়া আর কিছু মনে করেন না। এই ব্রাহ্মণ পরিবারটি মোটেই ধনী নয়, অর্থনৈতিকভাবে দুঃস্থ-ই বলা যেতে পারে। তাদের আলাদা কোনও পেশা নেই, তাদের কাজ হল বিয়ে করা ও শ্বশুরবাড়িতে সময়ে সময়ে দেখা দিয়ে অর্থ আদায় করা। তারা যেহেতু কুলীন ব্রাহ্মণ, তাই এই বিবাহ পেশাটিকে যথেষ্ট সম্মানজনক বলে মনে করে থাকে। গঙ্গাচরণের বয়স হয়েছে। বড় ছেলে বিবাহিত, তবে বোঝা যায় আবার বিয়ে করতে তার আপত্তি নেই, পিতার পথ-ই সে অনুসরণ করবে। অন্য ছেলেটি যে আলাদারকম বা প্রতিবাদী মনোভাবাপন্ন, এমনটি ভাবার কোনও কারণ নেই। সে বিয়ে করতে চায় না কারণ তার এখন বিয়ে করার মর্জি নেই। সে আপাতত কীর্তনের দল চালাচ্ছে। দাদা, বাবারাও তাকে বিয়ের জন্য জোর করে না। একসঙ্গে দুটো বিয়ের কথা বাড়িতে চলছে— এক, বড়ছেলে হরিচরণের দ্বিতীয় বিয়ে, আরেকটা বিয়ে হল গঙ্গাচরণের মেয়ে শশীর বিয়ে। শশীর বিয়েতে দেওয়া-থোওয়ার ব্যাপার আছে। হরিচরণের বিয়েতে যা আদায় হবে, তা দিয়ে শশীর বিয়ে হবে। কোথায় বেশি পাওয়া যাবে, কোথায় কম দিতে হবে, দিয়েথুয়েও লাভ বেশি থাকবে— তা নিয়ে দরদাম চলছে। দ্বিতীয় ছেলের বিয়ের কথা উঠলে ঘটক বলছে— ‘আপাতত ওকে বিরক্ত করবেন না। প্রথম বিয়ে! ভালো আদায় হবে!’ আমরা যেমন বিপদ-আপদের জন্য fixed deposit রেখে দিই, সেরকম কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারে অবিবাহিত পুত্র fixed deposit-এর মতো। আগে বিবাহ হয়নি, এমন কুলীন পাত্র পেলে কন্যার পিতারা আরও বেশি খরচা করতে আগ্রহী হবেন। গঙ্গাচরণের একটি খেরোর খাতা আছে, তাতে তিনি লিখে রাখেন তাঁর স্ত্রী-দের নাম, কবে কোথায় বিবাহ হয়েছে, একবার যাবার পর আবার কতদিন পর যাওয়া যায়, গেলে ঠিকমত আদায়পত্র হবে। তাঁকে এও বলতে শোনা যায়— ‘এখন আর ভালো আদায়পত্র নেই।’ কুলীন স্বামী এই যে স্ত্রী-দের কাছে গিয়ে গিয়ে ‘ভিজিট’ দেন, সহবাস করেন, এতে স্ত্রী-রা গর্ভবতী হন। তাঁদের কাছে তো সন্তানবতী হতে পারাটাই ইহজীবনের একমাত্র লক্ষ্য। গঙ্গাচরণের যেমন বয়েস হয়েছে, তাঁর স্ত্রীদেরও হয়তো নতুন করে সন্তানধারণের ক্ষমতা ফুরিয়েছে। সেই সন্তানদের সংসারেই হয়তো এখন তাঁরা রয়েছেন। সুতরাং কে-ই বা এখন গঙ্গাচরণ আদর করে বসাবে? কে-ই বা আদায়পত্র-র ব্যবস্থা করবে? এখন স্বাভাবিক ভাবেই ‘আদায়পত্র’ কমে গেছে। তাই গঙ্গাচরণের পরিবারটির ভরসা এ পরিবারের ছেলেদুটি। 
 
 
উমার স্থানটা এখানে কেমন? উমা এই বাড়ির মেয়ে হয়েও সে বিনে মাইনের ঝি। মামীমা ইচ্ছামতো তাকে মারেন, অকথ্য গালিগালাজ করেন। বোবা উমা কোনও উত্তর দিতে পারে না। তার বিয়েও কেউ ভাবে না। উমা যৌবনে পৌঁছেও মুক্ত। মুক্ত এই অর্থে, সে যখন তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে নদীর পাড়ে যেতে পারে। যখন তখন বটগাছের তলায় বসে থাকতে পারে। বাড়িতে থেকেও উমা যেন চৌকাঠের ওপর থাকা এক মানুষ। পরিবারে থেকেও সে পরিবারের কেউ নয়। সবাই শুয়ে পড়লে সে রান্নাঘরে ছেঁড়া মাদুর বিছিয়ে শোয়। নিজের জিনিসপত্র রাখার জায়গা বলতে বটগাছের কোটর। সমাজের ধার্য্য করে দেওয়া নারীসুলভ সুশীলতা তাকে শেখানোর প্রয়োজন কেউ বোধ করেনি, কারণ উমা-র তো বিয়ে হবে না, উমা তো বোবা। সে ‘বাইরের’ কাজগুলো করবে। বাসন মাজবে। গরু চড়াবে। ঘুঁটে দেবে। আর মার খাবে, গালিগালাজ শুনবে। এই নিয়েই বেশ ছিল উমা। কিন্তু শশীর বিয়ের সম্বন্ধ যে উমার জন্যই ভেঙে যাচ্ছে বারবার। যেই পাত্রপক্ষ শুনছে বাড়িতে একটি অবিবাহিতা মেয়ে আছে, তারা পিছিয়ে যাচ্ছে। কারণ শাস্ত্রে নাকি আছে, অবিবাহিতা মেয়ে থাকলে পরিবার পতিত হয়। তাই উমার বিয়ে দিতে হবে। সিনেমাটির শুরু হচ্ছে এই সময়টি থেকে। যে মেয়ে সতী হচ্ছে, তার বরের সাথেই উমার বিয়ে হবার কথা হয়েছিল। কোনও কারণে সেটি বানচাল হয়। তাই পরিবারস্থ মেয়েরা আফশোস করে, আজ উমাও সতী হতে পারতো ঐ বুড়োর সাথে বিয়ে হলে! উমার মামীমাকে বলতে শোনা যায়— “বুড়োরও বলিহারি, আর দুটো দিন সবুর সইল না! একেবারে মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে চিতায় উঠতিস। ওইতো মুখুজ্যিদের অমন জলজ্যান্ত মেয়েটা কেমন ড্যাং ড্যাং করে চলে গেল, আর তুই? মরেই তো আছিস মা, তবু সতী হয়ে বাঁচতিস! তবু বংশের একটা গতি হত।” উমার যেহেতু পুরুষ অভিভাবক নেই, পুরুষ অভিভাবকের অস্তিত্বের চিহ্নস্বরূপ মাথায় সিঁদুর ওঠেনি, তাই উমার বেঁচে থাকা যেন মরার-ই সামিল বলে মনে করছেন মামীমা। যদি সে সতী হতে পারতো, তার পরিবারকেও গৌরবান্বিত করতে পারতো। যার বেঁচে থাকাটা তার পরিবারের কাছে মূল্যহীন, সতী হয়ে মরলে তার জন্মটা কিছুটা হলেও নাকি তাৎপর্য পেত! এইসব কথা কে বলছে? না, সেই মামীমা যার স্বামী স্ত্রী বর্তমানে একাধিক বিয়ে করেন, দফায় দফায় তাদের কাছে গিয়ে সন্তান উৎপাদন করে টাকা নিয়ে এসেছেন! এতে মামীমার দুঃখ নেই! এসব স্বাভাবিক তাঁর চোখে! 
 
একটি কিশোর একদিন আসে। অমুক জায়গার নিস্তারিণী দেবীর ছেলে। তার মা মরেছে। গঙ্গাচরণকে খেরোর খাতা খুলে নাম মিলিয়ে চিনে নিতে হয়, এই কিশোর তাঁরই ঔরসজাত পুত্র! তাঁর ঝাপসা স্মৃতির মধ্যে ভেসে আসে পুরনো তথ্য, তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কি পটল?’ এই অদ্ভুত ঘটনাও তাদের কাছে নিতান্তই স্বাভাবিক! মামীমা তার হব্যিষ্যির বন্দোবস্ত করেন। ছেলেটিকে পরিবারে গ্রহণ করা হয়, কারণ সে যে ‘পুত্রসন্তান’— এই ছেলেও একদিন বিয়ে করা শুরু করবে, পরিবারে অর্থাগম হবে! কিন্তু তাদের এই আশা পূরণ হয় না। উমা-কে বেধড়ক মার খেতে দেখে ছেলেটি নিঃশব্দে সকলের কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায়। গোটা ছবিতে এটিই একমাত্র প্রতিবাদ পুরুষের তরফ থেকে উমার জন্য। উমা মার খায়, সবাই নীরবে দাঁড়িয়ে দেখে। কারণ উমা মার খাবে, এটাই তো দস্তুর। কারণ উমা যে উমা! সে তো পুরুষের কোনও কাজে লাগেনি। ওর আর কী মূল্য? এই কিশোরও একভাবে প্রান্তিক, সে জীবনের সতেরো আঠেরোটা বছর কাটিয়েছে পিতার অভিভাবকত্ব ছাড়াই। সে জানে অনাথ হবার যন্ত্রণা, আশ্রিত হবার যন্ত্রণা। তাই উমার সঙ্গে সে নিজেকে একাত্ম করতে পারে। 
 
বোবা উমার কুষ্ঠীতে বৈধব্যযোগ আছে। ফলে তার জন্য পাত্র পাওয়া আরও দুষ্কর। গ্রামের বাচস্পতি মহাশয় বিধান দেন, অবিবাহিতা কন্যার গাছের সঙ্গে বিবাহ দিতে হবে। তাতে তার আইবুড়ো নাম ঘুচবে। গাছের সাথে বিয়ে দেওয়া নিয়ে একটু কিন্তু কিন্তু ভাব দেখা যায় পরিবারের কারওর কারওর। কিন্তু মামীমা বলেন, ‘রাখো তো! ওই হাবা মেয়ের সাড় আছে নাকি? গাছ না মানুষ!’ বাচস্পতির বিধান অনুযায়ী রজঃস্বলা মেয়ের বিবাহ দিতেই হবে কারণ সে নাকি তখন তৈরি জমির মতো হয়ে যায়! কাকের মুখে বীজ এসে পড়লেও সে জমিতে তখন ফসল ফলতে পারে। তাই তার একটা ‘মালিক’ ঠিক করে দিতে হবে। তার যখন সন্তান জন্মাবে, সে যেন একটা পিতৃপরিচয় পায়। এই অবস্থান থেকেও উমা চ্যুত, সে যে ‘নারী’ এই কথাটাই মামীমা ভুলে গেছেন। উমা সময় পেলেই যে বটগাছের ছায়ায় বসে থাকতো, তাকেই উমার ভাবী বর হিসেবে নির্বাচন করা হল। উমাকে কেউ কখনও কিছু দেয়নি। উমার মৃতা মায়ের কিছু গয়না গচ্ছিত ছিল তার মামার কাছে। মামা তাকে ডেকে গয়নাগুলো দিতে গেলে সে প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারে না, এই জিনিসগুলো তাকেই দেওয়া হচ্ছে। উমা-র মামা গাছের শক্ত বাকল খুঁটে ফেলে দেন ‘বড় রুক্ষ’ বলে। গাছের বাকলে সিঁদুর লেপে উমা-র মাথাটা চেপে ধরে ঘষে দেওয়া হয়, ব্যথায় জ্বালায় উমা জান্তব চিৎকার করতে থাকে। এইভাবেই সাঙ্গ হয় উমার বিবাহপর্ব! কাকতালীয়ভাবে, এ গাছটাই তার ব্যক্তিগত মুহূর্তের একমাত্র সাক্ষী। এ গাছের কোটরেই উমার নিজস্ব দেরাজ। এ গাছের আড়ালে বসেই উমা লুকিয়ে সিঁদুরের টিপ পরে আয়নায় নিজেকে দেখে। বিয়ের সময়ে বিয়ের কোনও বোধ না থাকলেও পরে উমার মধ্যে যেন অল্প অল্প বদল লক্ষ্য করা যায়। 
 
ছবিতে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হয়েছে। গোয়ালঘরের পাশেই আঁতুড়ঘর। কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হলে মুখ বেঁকিয়ে ঘোষণা করা হয়, ‘আবার মেয়ে!’ হাতের শাঁখ হাতেই থেকে যায়, ‘সুখবর’এর প্রত্যাশায় বসে থাকা মামীমা হতাশ হয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে উঠে যান। বাড়ির গাভী গর্ভবতী হলে তার যত্ন নেওয়া থেকে শুরু করে প্রসব পর্যন্ত সমস্তটাই হয় সুষ্ঠুভাবে। বকনা-বাছুর ভূমিষ্ঠ হলে সকলে উল্লসিত হয়। স্পষ্টই বোঝা যায়, বকনা বাছুরের চেয়েও মেয়েরা হীন অবস্থায় রয়েছে। তাই তো হরিচরণ দ্বিতীয় বিয়ে করতে যাবার আগে মা’কে প্রণাম করে বলে, ‘মা তোমার জন্য দাসী আনতে যাচ্ছি।’ মা তাকে আশীর্বচন দেয়, ‘সাবধানে যেও। লক্ষ্মী স্ত্রী ঘরে আনো। বছর বছর পুত্রসন্তানের পিতা হও।’ ফ্রেমের আরেক পাশে দেখা যায়, হরিচরণের প্রথমা স্ত্রী অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখে সদ্যোজাত শিশুকন্যাটিকে দোলনায় দোল দিচ্ছেন। মামীমা নিজে ‘মেয়ে’ হয়েও এহেন বিসদৃশ ঘটনা স্বাভাবিক বলে মনে করেন। প্রতিটি নারীচরিত্র একই রূদ্ধমধ্যস্থ অবস্থানে ঘোরাফেরা করছে। গ্রামের নবীন মাস্টারের স্ত্রী বড়মানুষের আদুরে মেয়ে, স্বামীর কাছে মাঝে মাঝে বেড়াতে আসে, থাকে সে পিতৃগৃহেই। ঘোরা বেড়ানো, গয়নাগাঁটি— এই ঘিরেই তার জগৎ, সেখানেও অন্য আলো নেই। নবীন মাস্টার তাকে তোয়াজ করে চলে। বেশ বোঝা যায়, কারণটা পুরোপুরি অর্থনৈতিক, শ্বশুরের দেওয়া মাসোহারাটি তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এই নবীন মাস্টারের সাথেই উমার গড়ে ওঠে যৌনসম্পর্ক। বোবা মেয়ে কাউকে কিছু বলবে না জেনেই নবীন মাস্টার হাত বাড়িয়েছিল তার দিকে। উমা মুখে কিছু বলে না, কিন্তু তার শরীর কথা বলে। অনভিজ্ঞ উমা এতদিন দেখেছে লোকে তাকে মারার জন্যই হাত তোলে। নবীন মাস্টারের কাছে এগিয়ে আসা ও তার উদ্যত হাতের একটাই অর্থ উমা বুঝেছিল। এই বুঝি মারতে আসে, এই ভয়ে উমা মার ঠেকানোর ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে পড়েছিল। পরে উমা নিজে থেকেই গিয়ে দাঁড়িয়েছে নবীন মাস্টারের দরজায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই উমা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। বাড়ির মহিলাদের চোখে ধরা পড়ে সমস্ত লক্ষণ। কিছু সাংঘাতিক মন্তব্য শোনা যায়— “ওই হয়! কুলীন ঘরে অমন হয়। তা মিনসেটা কে জানতে পারলে? ভালো ভালো, না জানাই ভালো। শেষে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেইড়ে পড়বে। অত বড় সোমত্ত মেয়ে! বে দিলে গাছের সঙ্গে, মনিষ্যির সঙ্গে দিলে তবু রাখঢাক থাকতো। লোকে শুধুলি অন্তত বলতি পারতে রেতে জামাই এয়েচিল!” জড়িবুটি খাইয়ে উমার গর্ভপাত করানো হয়। জড়িবুটি দিতে আসা ক্যাওড়াবুড়িই কিছু নিয়মকানুন বাতলে গিয়েছিল। উমার সদ্য গর্ভপাত হয়েছে, তাই তাকে ছেলেপুলেদের কাছে ঘেঁষতে না দেওয়াই ভালো। ঝড়জলের রাতে উমার জায়গা হয় গোয়ালে। গোয়ালের চালা ভেঙে পড়লে উমা গিয়ে আশ্রয় নেয় তার বটগাছের কোটরে। এরপর আর কোনও সংলাপ নেই। সকাল হলে বাড়ির খুদে নদীর পাড়ে গিয়ে কিছু একটা দেখে এবং ছুটে এসে বাড়িতে খবর দেয়। এরপর দেখা যায় গ্রামসুদ্ধু লোক দল বেঁধে চলেছে নদীর পাড়ে। সেখানে তারা এমন ভয়ানক কিছু একটা দেখতে পাচ্ছে, তারা ভয়ে-বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ক্যামেরা ঘুরলে দেখা যায়, ঝড়ে বটগাছ ভেঙে পড়েছে। উমার মৃত শরীরের পাশে তার গয়না ছড়িয়ে। মাথাভর্তি রক্ত যেন সিঁদুরের মত লেপ্টে আছে। বিয়ে করা বটগাছের সঙ্গেই যেন সহমরণে গেছে উমা। নির্বাক হয়ে যায় পুরুষতন্ত্র তাদের বানানো মেকি নিদানের এই পরিণাম দেখে। এভাবেই কথা বলতে না পারা উমার নিথর শরীর হয়ে ওঠে একটা text, সে শরীর ভাষা পায়। 
 
সুজাতার গর্ভের বিস্ফোরণ, যশোদার পচন ধরে যাওয়া স্তন, দ্রৌপদীর রক্তাক্ত যোনি— সমাজ নারীর যে অঙ্গগুলিকে চিনিয়েছে ‘গোপনাঙ্গ’ হিসেবে, সেই গোপন অঙ্গগুলিই যেন ভাষা পেয়ে মুখর হয়ে উঠেছে মহাশ্বেতা দেবীর গল্পে। যে ভাষা তাঁর মৃত শরীরটাকে দিতে চেয়েছিলেন ভুবনেশ্বরী ভাদুড়ী, সে ভাষার খোঁজ কি আজও চলছে? আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় উচ্চশিক্ষার সুযোগ, আইনকানুনে একাধিক রদবদল বুঝি এনে দিয়েছে কাঙ্ক্ষিত মুক্তির যুগ। তবু মালুম হয়, প্রদীপের তলাটাই বড় বেশি অন্ধকার। যে অন্ধকার টেনে নিয়েছে দিল্লীর জ্যোতি সিং, কামদুনির শিপ্রা ঘোষেদের। উন্নাও, হাথরাস, কাঠুয়া-র নাম পরপর বললেই যে মর্মান্তিক ছবিগুলি স্মৃতিতে ভেসে ওঠে, তা একেবারেই কাম্য ছিল না। কিছুদিন মোমবাতি মিছিল, রাজনৈতিক চাপানউতোরের পর আবার সবকিছু থিতিয়ে পড়ে স্বাভাবিক হয়ে যায়। হাজার চুরাশি নম্বর লাশ ব্রতী চ্যাটার্জীর মতো যারা নিজেদের সাধ, আশা, আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ রেখে মর্গে চলে যেতে বাধ্য হয়, তাদের কেউ আর মনে রাখে না। তারা থেকে যায় স্রেফ কতকগুলো পরিসংখ্যান হয়ে। হয়তো তাদের কন্ঠস্বর পৌঁছে দিতে প্রয়োজন এখন অন্য এক ভাষার। অন্য এক প্রতিবাদের। 
 
 
তথ্যসূত্র :
 
১) ‘নারীর শরীর, শরীরের ভাষা : প্রান্তিকতার ভিন্ন বয়ান’, সুমনা দাস সুর, অধ্যাপিকা, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা বিভাগ। 
 
২) Can the Subaltern Speak?' appears as the closing section of a chapter entitled 'History' in Gaytri Chakraborty Spivak's A Critique of Postcolonial Reasons : Toward a History of the Vanishing Present, Cambridge: Havard University Press, 1999, pp. 244-311 
 
৩) হাজার চুরাশির মা, মহাশ্বেতা দেবী, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ আগস্ট ১৯৭৪, বিংশ মুদ্রণ জানুয়ারি ২০১৪, পুনর্মুদ্রণ ডিসেম্বর ২০২০
 
৪) গল্পসমগ্র ২, মহাশ্বেতা দেবী, দে’জ পাবলিশিং, প্রথম প্রকাশ এপ্রিল ২০১২, পুনর্মুদ্রণ ডিসেম্বর, ২০১৯
 
৫)  গল্পসমগ্র ৩, মহাশ্বেতা দেবী, দে’জ পাবলিশিং, প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০১৪, পুনর্মুদ্রণ সেপ্টেম্বর, ২০১৯