পেরিয়ার ও তাঁর সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলন

কয়েক দিন ধরে দেখছি একটু সময় পেলেই বসে বসে লিখিস। কি লিখছিস রে?' এক সহকর্মীর প্রশ্ন। 'ওই পেরিয়ারের ওপর একটা লেখা'। পেরিয়ার, গিয়েছিলি নাকি? উফ দারুণ জায়গা কিন্তু বল! আমি তো 89 এ.....।  'না না পেরিয়ার মানে ই ভি রামাস্বামী পেরিয়ার'। নামটা চেনা লাগছে না তো।  "জাত পাত বর্ণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তার একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাম ছিল"।  আম্বেদকার, সাবিত্রী বাই ফুলে, এদের কথা শুনেছি, বইয়ে পড়েছি আর শ্রীচৈতন্য লালন এদের কথা তো একদম ছোটবেলা থেকেই পড়ছি, কিন্তু পেরিয়ার…....।

এই অচেনার কারণ যত না ঐতিহাসিক তার থেকে অনেকটাই বেশি ভৌগোলিক। আমরা পূর্ব ভারতের মানুষেরা উত্তর ভারতের সঙ্গে যত বেশি নৈকট্য অনুভব করি দক্ষিণ ভারত আমাদের কাছে ততটাই দূরের। বিন্ধ পর্বত পেরিয়ে সেখানকার রাজনীতি সমাজ সেখানকার বিশিষ্ট মানুষজনের খবর আমাদের কাছে বিশেষ পৌঁছয় না। সেজন্যেই পেরিয়ার আমাদের কাছে  নিছকই কেরালার একটি টুরিস্ট স্পট। আসুন এবার একটু আলো ফেলা যাক ই ভি রামোস্বামী পেরিয়ার নামক আমাদের কাছে প্রায় অচেনা একটি মানুষের উপর।

বিংশ শতাব্দীতে যে কয়েকজন যুক্তিবাদী সমাজ সংস্কারক ও চিন্তক জন্মেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম এরোড ভেঙ্কাটাক্কা রামাসামী নায়কার। তার জন্ম ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ই সেপ্টেম্বর তামিলনাড়ুর এরোডে। শুধু সমাজ সংস্কারই নয় একইসঙ্গে তিনি ছিলেন সমস্ত রকম আর্থসামাজিক বৈষম্যের প্রবল বিরোধী একজন অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। প্রকৃত বিচারে সেই সময়ে অন্যান্য যে সমস্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের আমরা পাই তাদের মধ্যে সবথেকে স্পষ্ট এবং স্বচ্ছ চিন্তা ভাবনা ছিল রামাসামির। যেভাবে ওই সময় দাঁড়িয়ে তিনি ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যবাদ বর্ণ ব্যবস্থা এবং সরাসরি ধর্ম এবং ঈশ্বরের বিরুদ্ধে তার বক্তব্য রেখেছেন তা ভারতে যুক্তিবাদী বিশ্লেষণের ধারায় পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। পারিবারিক সূত্রে রামাসামীর পরিবার ছিল বৈষ্ণব হিন্দু পরিবার। তারা ছিলেন বালিয়া নাইডু সম্প্রদায়ের মানুষ। বালিয়া নাইডুরা বৈশ্য অথবা শূদ্রদের মধ্যে থাকা উচ্চ সম্প্রদায়। রানাসামির বাবার নাম ভেঙ্কটাপ্পা নায়কর মায়ের নাম চিন্নাতায়াম্মা। প্রথমদিকে পরিবারে যথেষ্ট দারিদ্র থাকলেও পরবর্তীকালে রামাসামীর বাবা নিজেকে একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন। প্রথাগত পড়াশুনায় তার একেবারেই মন ছিল না, বছর দুয়েক তিনি স্কুলে যান কিন্তু তার মধ্যেই তার সংবেদনশীল মন লক্ষ্য করেছিল স্কুলে হিন্দু এবং মুসলিম ছাত্রদের পৃথক জায়গায় জল খাওয়ার ব্যবস্থা। তবে এ বিষয়ে তখন থেকেই রামা স্বামী প্রচলিত কোন নিয়ম কানুন মানতেন না। বাড়িতেও তাকে রান্নাঘরে ঢুকতেই দেওয়া হতো না। এইসব নানা কারণে তার বাবা তাকে মাত্র বারো বছর বয়সেই ব্যবসার কাজে লাগিয়ে দেন সেখানে  কিন্তু তিনি নিজেকে সফল হিসেবেই প্রমাণ করেন। রামাসামী তার বাল্যকাল সম্পর্কে নিজেই বলেছেন, "শেষ পর্যন্ত আমার পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়া হলো ও আমাকে দোকানে বসিয়ে দেওয়া হল। সেখানে আমার কাজ ছিল ভর্তি বস্তায় ঠিকানা লেখা ও পণ্যের নিলাম ডাকা"। রামাসামীর পৈত্রিক বাড়িতে ধর্ম কর্মের যথেষ্ট চর্চা ছিল, এমনকি এরোডের বিভিন্ন মন্দিরেও তাদের পরিবার থেকে আর্থিক অনুদান দেওয়া হতো। তা সত্ত্বেও রামাসামির মনে প্রথম থেকেই ধর্মীয় আচার-আচরণ সম্পর্কে একটা বিরূপতা জন্মেছিল। তিনি নিজেই বলছেন," আমার ফাঁকা সময় পুরানের ওপর তর্ক করে কাটতো। আমাদের ঘরে সাধু সন্ন্যাসী পন্ডিত পুরোহিতদের অনেক সম্মান করা হতো। কিন্তু আমি তাদের একেবারেই পছন্দ করতাম না। এই জন্যেই তারা যা বলতেন আমি ইচ্ছাকৃতভাবে সেসবের বিরোধিতা ও উপহাস করতাম"। রামা সামির এই পরিবার বিরোধী এবং প্রতিষ্ঠান বিরোধী মনোভাবের কারণ খুঁজতে হলে আমাদের একটু দেখে নিতে হবে সেই সময়ের দক্ষিণ ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট। দক্ষিণ ভারতে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম এবং রামায়ণ-মহাভারত সহ হিন্দু পুরাণের একটি বিকল্প ব্যাখ্যা, সেই সময় দক্ষিণ ভারতের বুদ্ধিজীবী সমাজে ক্রিয়াশীল হয়ে উঠছিল । মাদ্রাজ সেকুলার সোসাইটির সদস্যরা ঘোষণা করলেন রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী প্রকৃতপক্ষে উত্তর ভারত থেকে আসা বহিরাগত আর্যদের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতে বসবাসকারী মূল নিবাসীদের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের কাহিনী উত্তর ভারতের মানুষেরা রাক্ষস অসুর ইত্যাদি নেতিবাচক শব্দের মধ্যে দিয়ে দ্রাবিড়দের হেয় করার পাশাপাশি নিজেদের উচ্চবর্ণজাত বলে দাবি করে এবং একইসঙ্গে তাদের ওপর সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং সর্বোপরি সাংস্কৃতিক আধিপত্য কায়েম করে। মাদ্রাজ সেকুলার সোসাইটি নামে একটি সংগঠন এই ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রায় ১০ বছর ধরে নিরন্তর লড়াই জারি রেখেছিল এই সময়কালে প্রকাশিত পত্রপত্রিকাগুলি ছিল সূর্যদয়ম, পঞ্চমা, সুগিরদোবসনি, দ্রাবিড় কোকিলাম, তামিল কলম ইত্যাদি। এই পত্রিকা গুলির লক্ষ্য ছিল শূদ্রাতিশূদ্রদের সচেতন করা, হিন্দু সমাজের বর্ণাশ্রম প্রথাকে নাকচ করা, ব্রাহ্মণ্যবাদের তীব্র সমালোচনা করা এবং মনুর অনুশাসন গুলিকে অস্বীকার করা।

এমনকি এই সময় শূদ্রাতিশূদ্র গবেষক ও আন্দোলনকারী আয়োদি থাস বৌদ্ধ ধর্মের দিকেও ঝুঁকে পড়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে আমরা বি আর আম্বেদকরের কথা স্মরণ করতে পারি। পয়লা ডিসেম্বর ১৮৯১ সালে আয়োদিথাস এবং জন রোটিনামের নেতৃত্বে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির উটোইয়ে তৈরি হয় দ্রাবিড় মহাজন সভা। নিপীড়িত শোষিত শ্রেণীর মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই সংগঠন যে যে সিদ্ধান্ত পাশ করে, তাদের মধ্যে প্রধান কয়েকটি ছিল নিম্ন বর্ণ ও অস্পৃশ্য পরিবারের সন্তানদের জন্য শিক্ষার সুযোগ, নিপীড়িত অংশের মানুষদের আর্থিক উন্নতি ঘটানো, দক্ষিণ ভারতের জেলগুলোতে যে জাতপাত কেন্দ্রিক বৈষম্য ছিল সেগুলিকে দূর করা প্রভৃতি। এই সংগঠন দক্ষিণ ভারতের শূদ্র এবং শুদ্রাতিশূদ্র মানুষের মনে আত্মমর্যাদা বোধের জন্ম দিয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য দ্রাবিড় মহাজন সমিতির এই সিদ্ধান্তের প্রতিলিপি পাঠানো হয় জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের কাছে কিন্তু কংগ্রেস এই সমস্ত সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। এর ফলে কংগ্রেস সম্পর্কে দ্রাবিড় জাতিসত্তার প্রচারকদের মোহ ভঙ্গ হয় এই প্রেক্ষাপটেই উত্থান হয় যুক্তিবাদী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব ই ভি রামাসামীস্বামী নায়করের। আবার ফিরে আসি রামাসামির ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের কথায়। চিদাম্বরমের লেখা পেরিয়ার রামাসামির জীবনী গ্রন্থ থেকে জানা যায় ১৯০৪ সালে একদিন তিনি বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। তারপর গঙ্গা নদীর তীরে তীর্থস্থান কাশিতে পৌঁছন। সেই সময় তার দারিদ্র্য এমন চরমে ছিল যে প্রায় অনাহারে তাকে দিন কাটাতে হচ্ছিল। একদিন  বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করা হয় এমন একটি ধর্মশালা খেতে গেলেন। কিন্তু শুধুমাত্র শূদ্র আর আব্রাহ্মণ বলে তাকে খেতে দেওয়া হল না। এই সময়ে শুধু জাতিগত কারণে এবং দ্রাবিড় বলে নানা রকম লাঞ্ছনা তার মনে ব্রাহ্মণদের প্রতি অত্যন্ত অসহিষ্ণুতার জন্ম দেয়। তিনি এর কারণ খুঁজতে থাকেন। কাশীর এই অভিজ্ঞতা তাকে পরবর্তী জীবনে চলার সঠিক দিশা দেখায়। তিনি এরোডে ফিরে আসেন এবং পারিবারিক ব্যবসার সমস্ত দায়িত্ব নেন। এই সময়েই এরোডের দুইজন যুক্তিবাদী ধর্ম ও রাজনীতি বিষয়ক গবেষক মারুথাইয়া পিরালাই এবং কৈবল্য সামিয়ার তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। প্রাবন্ধিক এ কে বালাসুব্রামানিয়াম তার সম্পর্কে লিখেছেন "এই সময়ে ই ভি রামা স্বামী প্রতিশোধ পরায়ণ উপযোগিতাবাদী থেকে হয়ে উঠলেন একজন যুক্তিবাদী নিরীশ্বরবাদী এবং সমাজতন্ত্রী। ডাক দিলেন হিন্দুত্ববাদী ও ব্রাহ্মণ্য বাদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের"।

১৯১৯ সালে ই ভি রামস্বামী কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হন। তার আগে থেকেই ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে তিনি অংশ নিতে শুরু করেন।১৯১৫ তে দ্রাবিড় অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে সি সংকরানের লেখা 'অব্রাহ্মণের চিঠি' নামে একটি বই প্রকাশকে কেন্দ্র করে এই কাগজের কর্মীদের ওপর ব্রিটিশ সরকারের আক্রমণ নেমে আসার তীব্র প্রতিবাদ করেন ই ভি রামা স্বামী। ১৯১৭ তে মন্টেগু চেমসফোর্ড কমিটি যখন ভারতে সাংবিধানিক শাসন কাঠামো সংস্কার করার জন্য বিভিন্ন অংশের ভারতীয় প্রতিনিধিদের কাছে বক্তব্য জানতে চাইলেন তখন জাস্টিন পার্টির এই কমিটির কাছে প্রশাসন ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অ ব্রাহ্মণদের জন্য সংরক্ষণ দাবি করে। ১৯১৭ সেপ্টেম্বর মাসে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কংগ্রেসের অব্রাহ্মণ দ্রাবিড় নেতারা 'মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি অ্যাসোসিয়েশন' তৈরি করলে তাতে সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন ই ভি রামাসামী। এরপর পর পর ঘটে যাওয়া রাওলাট আইন জালিয়ানওলাবাগ হত্যাকাণ্ড এসবের প্রতিবাদে এরোড পৌরসভার চেয়ারম্যানের পথ থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন শুরু করলে তিনি সেই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। সুচতুর কংগ্রেস নেতৃত্ব এই সময় মনে করে রামাস্বামীকে দলে নেতৃত্বের ভূমিকায় রাখলে তাদের পক্ষে তামিলদের উচ্চবর্ণ বিরোধী আন্দোলনের দিশা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যাবে। সেই জন্যেই অতিদ্রুত রামা সামির হাতে তামিলনাড়ু কংগ্রেসের নেতৃত্ব তুলে দেওয়া হলো। কিন্তু নানান ঘটনায় তিনি এই উপলব্ধিতে পৌঁছন, কংগ্রেস মূলত উত্তর ভারতীয় উচ্চ বর্ণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি রাজনৈতিক দল। যারা কখনো জাত পাত বিলোপের বিষয়ে এবং শূদ্র এবং শুদ্রাতিশূদ্রদের উন্নয়নের ব্যাপারে কিছু মাত্র ভূমিকা নেবে না। সেই জন্যেই তার সম্পাদিত কুদি আরাসু পত্রিকায় তিনি স্পষ্টভাবে বলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের আগে তিনটি ভয়ানক শত্রুকে নিকেশ করা দরকার। প্রথম কংগ্রেস দল যেটা একটা ব্রাহ্মণ ও বেনিয়া দল দ্বিতীয় জাতপাত যুক্ত হিন্দু ধর্ম আর তৃতীয় ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্য বাদীরা। গান্ধী সম্পর্কেও তিনি খুব তাড়াতাড়ি মোহমুক্ত হন। বুঝতে পারেন মহাত্মা গান্ধীও জাতীয়তাবাদের নামে উত্তর ভারতীয় হিন্দুত্ববাদকে তামিলদের ওপর চাপিয়ে দিতে চান। এবং আদৌ তিনি বর্ণাশ্রম প্রথাভিত্তিক ধর্মটি বিলুপ্ত হন এটা একেবারেই চান না। এরপরে রামা স্বামী রাজনৈতিক আন্দোলন ছেড়ে সমাজ সংস্কার আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতে থাকেন এখানে রামা স্বামীর চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে একটা একটা প্রশ্ন আমাদের মনে দানা বাঁধে এতটা স্পষ্ট রাজনৈতিক চিন্তা এবং দূরদর্শিতা থাকা সত্ত্বেও কোন রাজনৈতিক বীক্ষা ছাড়া যে সমাজ সংস্কার আন্দোলন সফল হতে পারেনা এটা কেন তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন না। তবে অতি  দ্রুতই এই সীমাবদ্ধতা তিনি কাটিয়ে ওঠেন।

১৯২৫ এর নভেম্বরে কংগ্রেস পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে এসে তিনি সংগঠিত করেন তার জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সমাজ সংস্কার আন্দোলন সুয়ামারিদাইকাম বা আত্মমর্যাদা আন্দোলন। এই আন্দোলনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য তিনি প্রচার করতে থাকেন তার সম্পাদিত কুদি আরাসু পত্রিকায়। রামাসএকটি সামাজিক সংগঠন তৈরীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন পাশে পান কংগ্রেসের আরেক নেতৃত্ব এস রামানাথানকে তিনিও গান্ধী সম্পর্কে ততদিনে বীতস্পৃহ রামা সামির সঙ্গে আলোচনার পর কুলি আরাসু পত্রিকা গোষ্ঠীর সদস্য ও আত্মমর্যাদা আন্দোলনকারীদের নিয়ে তিনি সক্রিয়ভাবে শুরু করলেন আত্মমর্যাদা আন্দোলন। কুদি আরাসুতে প্রকাশিত একের পর এক ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী রচনা সাধারণ মানুষের মধ্যেও যথেষ্ট প্রভাব ফেলল এবং তারা আত্মমর্যাদা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল দ্রাবিড় সমাজের উপর থেকে ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক হিন্দুত্ববাদী শোষণের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ সাধন। এই প্রসঙ্গে দ্রাবিড়দের হীন করে দেখানোর উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মণ্য ষড়যন্ত্রকে তিনি তামিল জনগণের সামনে তুলে ধরেন। ব্রাহ্মণদের দ্বারা রচিত রামায়ণ ও মহাভারতে ও পুরানে যেভাবে দ্রাবিড়দের অপমান করা হয়েছে সে সম্পর্কে দ্রাবিড়দের শুধু সচেতনই করেন না। প্রত্যেকটি পুরান ধরে ধরে তার ব্যাখ্যা করে দেখান এই হিন্দু শাস্ত্রগুলি অত্যন্ত অনৈতিক এবং সেখানে যাদের নায়কদের মর্যাদা দেওয়া হয় তারা আদপেই সেই মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য নয়। তারা মূলত লোভী এবং ইন্দ্রিয় পরায়ণ। সত্যনরামায়ণ নামে একটি গ্রন্থে তিনি রামায়ণ সম্পর্কে তার নিজস্ব ব্যাখ্যা প্রকাশ করেন। সাধারণ মানুষের মনে পুরান ইত্যাদি সম্পর্কে প্রজন্ম লালিত সংস্কার ও শ্রদ্ধা ভেঙে ফেলার জন্য তারা প্রকাশ্যে হিন্দু গ্রন্থ শাস্ত্র ও পুরাণগুলিকে পুড়িয়ে দিতে থাকেন। দ্রাবিড় জাতির অতীত গৌরবময় ইতিহাসের কথা তারা তাদের রচনার মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেন। যদিও রামা স্বামী ঘোষণা করেছিলেন তিনি মূলত সমাজ সংস্কার আন্দোলনের মধ্যেই আত্মমর্যাদা লীগের কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ রাখবেন কিন্তু দেখা যায় প্রায় এই সময় থেকেই তিনি কমিউনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। কুদি আরাসু পত্রিকায় আত্মমর্যাদা লীগের লেখকরা ভূমিহীন ক্ষেতমজুর ও জনমজুরদের  দৈনিক মজুরি বৃদ্ধির দাবি তুললেন। তাদের অর্থনৈতিক দাবী দাওয়া নিয়ে আন্দোলনের পাশে দাঁড়ালেন।

১৯৩১ এর ২৩ শে মার্চ বিপ্লবী ভগৎ সিং এর ফাঁসির পর তিনি ২৯ মার্চ কুদিআরাসু পত্রিকার সম্পাদকীয় কলমে লেখেন, "এমন কোন ব্যক্তি হয়তো নেই যিনি ভগত সিংয়ের ফাঁসিতে শোক ব্যক্ত করবেন না। ভগৎ সিং একজন সত্যিকারের বিপ্লবী ছিলেন তিনি সমধর্ম ও সাম্যের ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন "এরপর তিনি তুলে ধরেন ভকত সিং এর লেখা একটি বক্তব্য, "আমাদের সংগ্রাম ততদিন পর্যন্ত জারি থাকবে যতদিন না একটি কমিউনিস্ট দল ক্ষমতায় আসছে এবং জনগণের জীবন ও সমাজে অসাম্যের অবসান না হচ্ছে"। রামাসামী সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে যুক্ত না হলেও রাজনৈতিক চিন্তা ধারায় তিনি কমিউনিস্টদের খুব কাছেই ছিলেন। দক্ষিণ ভারতের তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতা এম সিঙ্গারাভ্যালু নিয়মিতভাবে আত্মমর্যাদা লীগের মুখপাত্র কুদি আরাসুতে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করতেন। এইসব নিবন্ধ পড়ে রামাস্বামী মার্কসের দ্বান্দিক  বস্তুবাদ, বিজ্ঞান, কমিউনিস্টদের লক্ষ্য ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে আগ্রহী হন এবং এর পরেই সোভিয়েত রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক কাজকর্ম নিজের চোখে দেখার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন। রামাসামির সোভিয়েত সফর তার মনে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে গভীর প্রভাব ফেলে। এরপর তিনি বার্লিনে যান এবং সেখানে সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট সংগঠনগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তার এইসব কার্যক্রম থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে তিনি তার আগেকার যে সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র সমাজ সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে আত্মমর্যাদা লিগকে সীমাবদ্ধ রাখার ধারণা থেকে সরে এসেছেন এবং উপলব্ধি করেছেন শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক বিপ্লব ছাড়া এবং সমাজের আমূল পরিবর্তন ছাড়া উপর উপর কিছু সংস্কার সাধনের মধ্যে দিয়ে জাতপাত ব্যবস্থার বিলোপ এবং শ্রমিক কৃষকের প্রকৃত শৃঙ্খল মুক্তি সম্ভব নয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ বিশ্ব ভ্রমণ থেকে ফিরে আসার পর রামা স্বামী একটি নতুন প্রগতিশীল কর্মসূচি হাজির করলেন যা এরোড কর্মসূচি হিসেবে বিখ্যাত। এখানেই তিনি সমাজ সংস্কার আন্দোলনের পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলেন এবং আত্মমর্যাদা লীগের একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি হয়।

রামাস্বামীর রাজনৈতিক জীবনে আমরা বারবার বাঁক বদল লক্ষ্য করি। যে ব্রিটিশ সরকারের শাসন নিয়ে এক সময় রামাসামির বিশেষ কোনো মাথাব্যথাই ছিল না, পরবর্তীকালে আমরা দেখি এই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তিনি জেলে গেছেন। আবার ১৯২৫ এর পর লক্ষ্য করা গেল এই সময় তিনি কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রচার কিছুটা হ্রাস করেন এবং আবার নিম্নবর্গীয়দের সংরক্ষণ এবং দ্রাবিড় জাতির উপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে মনোনিবেশ করেন। এর পরেই আত্মমর্যাদা লীগের মধ্যে ভাঙ্গন দেখা যায় এবং ১৯৩৫ এর নভেম্বরে যে জাস্টিস পার্টির সঙ্গে একসময় তার যথেষ্ট মতবিরোধ তৈরি হয়েছিল। সেই জাস্টিস পার্টির তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। জাস্টিস পার্টি সহায়তায় ১৯৩৫ এর পয়লা জুন তিনি প্রকাশ করলেন ভিদুথালাই বা স্বাধীনতা নামে একটি তামিল সাপ্তাহিক পত্রিকা, যা পরে দৈনিক সংবাদপত্র রূপে প্রকাশিত হতে থাকে। এই পত্রিকাই পরবর্তীকালে দ্রাবিড় জাতির মধ্যে পৃথক স্বাধীন দ্রাবিড় নাড়ুর বীজ রোপন করেছিল। ১৯৩৫ এই রামাস্বামী দ্রাবিড় জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের কথা সামনে নিয়ে আসতে লাগলেন। বিশ্লেষণ এর মধ্যে দিয়ে প্রমাণ করতে সচেষ্ট হলেন আর্য অপেক্ষা দ্রাবিড়রা অনেক পুরনো এবং সাংস্কৃতিকভাবে অনেক উন্নত একটি জাতিসত্তা এবং তামিল ভাষা ভারতীয় ভূখণ্ডের একটি প্রাচীন ভাষা। ১৯৩৭ এর জুলাইয়ে মাদ্রাজ প্রদেশে কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় আসে। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তামিল ব্রাহ্মণ শ্রী রাজাগোপালচারী। ক্ষমতায় এসেই তিনি প্রাথমিক স্তরের পাঠক্রমে হিন্দি ভাষাকে বাধ্যতামূলক করার সার্কুলার জারি করেন। সারা দক্ষিণ ভারত এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং এই ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করে রামাস্বামী তার বিরোধী শক্তি গুলো কেও তার আন্দোলনে শামিল করতে সমর্থ হন। এই আন্দোলনের তীব্রতা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় এবং সমস্ত তামিল জনগণ যেভাবে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে তাতে কংগ্রেস সরকার পিছু হটে হিন্দিকে একটি ঐচ্ছিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেন। এই আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। প্রসঙ্গত ১৯৩৮ ডিসেম্বরে রামা স্বামী জেলে থাকার সময়ই তামিলনাড়ুর প্রগ্রেসিভ ওমেন্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে তার প্রতি সম্মান জানিয়ে তাকে  "পেরিয়ার" বলে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। পেরিয়ার শব্দটির অর্থ মহামানব। হিন্দি ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিবাদ পৃথক দ্রাবিড় নাড়ুর বিষয়টিকেও সামনে এনে দেয়। ১৯৩৭ "তামিলনাড়ু তামিলদের জন্য" এই স্লোগান তামিলদের  জাত্যাভিমানকে জাগিয়ে তুলেছিল। ১৯৩৭ এ জাস্টিস পার্টির উদ্যোগে ভেলোরে অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে পৃথক অঞ্চল সংক্রান্ত একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। এই সময়ে পর থেকে আমরা দেখছি রামাস্বামী সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের থেকে জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের রাজনৈতিক আন্দোলনকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছিলেন। এই সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল রামাস্বামী মনে করেছিলেন ব্রিটিশদের পক্ষে থাকলে দ্রাবিড় নাড়ু আদায় করা সহজ হবে। এরপর যখন ক্রিপস মিশন ভারতে আসে তিনি কমিটির প্রধান স্ট্যান্ড ফর স্ট্যান্ডফোর্ড ক্রিপস এর কাছে পৃথক ও স্বাধীন দ্রাবিড় নাড়ুর দাবি পেশের জন্য প্রতিনিধি পাঠান। কিন্তু এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে জাস্টিস পার্টির সঙ্গে রামা সামির মতবিরোধ শুরু হয় এবং সিএন আন্নাদুরাই জাস্টিস পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হন।  এই বিতর্কিত পরিস্থিতিতেই ১৯৪৪ এর জুলাইয়ে রামাসামির নেতৃত্বে সালেমে জাস্টিস পার্টি ও আত্মমর্যাদা আন্দোলনের যৌথ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং জাস্টিস পার্টির নাম পরিবর্তন করে এর নাম রাখা হয় দ্রাবিড় কাজাগম বা দ্রাবিড় সমিতি। এই সময়টা রামা স্বামী এর পক্ষে একদমই অনুকূল ছিল না। নানান রকম অভিযোগে তিনি জর্জরিত হচ্ছিলেন। তার মধ্যেই তিনি পৃথক দাবির নাড়ুর দাবিতে এগিয়ে যান। এবং ভারত রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন একটি স্বাধীন সার্বভৌম দ্রাবিড় প্রজাতন্ত্রের দাবি তামিল জনগণের সামনে হাজির করেন। দ্রাবিড় জাতিসত্তার মুক্তি আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে রামাস্বামী দ্রাবিড় কাজাঘামের সকল সদস্যকে কালো জামা পড়তে উৎসাহিত করেন কিন্তু এটা নিয়েও শুরু হয় বিতর্ক এরপর তিনি ১৯৪৭ এর ১৫ ই আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনকে বয়কট করার ডাক দেন এবং বলেন এই স্বাধীনতা তামিলদের জন্য নয়। তামিলদের কাছে এটা একটা অশুভ দিবস। এই স্বাধীনতা আর কিছুই নয় আসলে ব্রিটিশদের হাত থেকে ব্রাহ্মণ ও বেনিয়াদের হাতে শাসন ক্ষমতার হস্তান্তর। তথাকথিত স্বাধীন ভারতে রামাস্বামী  তামিল আব্রাহ্মণদের মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। এই সময় মাদ্রাজ হাইকোর্ট একটি রায়ে তামিলনাড়ুতে তপশিলি জাত ও জাতির জন্য যে সংরক্ষণ চালু ছিল তা সংবিধানের পরিপন্থী বলে ঘোষণা করে। এর বিরুদ্ধে রামা স্বামী ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং কংগ্রেস ১৮ই জুন ১৯৫১ সালে সংবিধানে প্রথম সংশোধন করে তপশিলভূক্ত জাত জাতির জন্য সরকারি শিক্ষা চাকরি ও অন্যান্য পদে সংরক্ষণ পুনর্বহাল করে। এভাবে স্বাধীন ভারতের প্রথম রাজনৈতিক আন্দোলনে পেরিয়ার রামাস্বামী সফল হন। এই সময় ১৯৫৫ অক্টোবরে ভারতের রাজ্য গুলোর সীমানা নির্ধারণের জন্য বিচারপতি ফজল  আলীর নেতৃত্বে তৈরি হয় রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন। দক্ষিণের রাজ্য গুলো নিয়ে দক্ষিণ প্রদেশ গঠনের পরিকল্পনা নেয় কংগ্রেস। পেরিয়ার রামাস্বামী সরাসরি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন কিন্তু তার সেই দাবি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় না। এই সময়েই দ্রাবির কাজাগামের স্বাধীন দ্রাবিড় নাড়ুর দাবি  ভাষা ভিত্তিক রাজ্য তামিলনাড়ুর দিকে ঘুরে যায়। ১৯৫৭ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচন শেষ হওয়ার পর কংগ্রেস বিপুল ভোটে ক্ষমতায় আসে। এই সময় পেরিয়ার রামা স্বামীজাত পাত অস্পৃশ্যতা উৎখাতের লক্ষ্যে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রকাশ্যেই জাতপাত প্রকাশ করে এই ধরনের সমস্ত চিহ্ন বর্জন করার আহ্বান জানান। ব্রাহ্মণদের পৈতে পড়ার বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেন। প্রকাশ্য জনসমাবেশে বলতে থাকেন জাতপাতের বিনাশের প্রথম পদক্ষেপ হলো সেই সমস্ত চিহ্নগুলো ছুঁড়ে ফেলা যা একজনের জাত প্রকাশ করে। এই আন্দোলনের জন্য  সমস্ত রকম আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকতে হবে এবং একমাত্র তাহলেই আগামী প্রজন্ম জাতপাত ব্যবস্থার অশুভ কবল থেকে মুক্ত হতে পারবে। কংগ্রেস সেই সময় দ্রাবিড় কাজাগম কে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে। কংগ্রেসের এই বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে রামা স্বামী সারা রাজ্য জুড়ে গান্ধী মূর্তি ভাঙার ডাক দেন। উত্তেজনা বাড়তে থাকলে তামিলনাড়ু সরকার পেরিয়ার রামা স্বামীকে গ্রেফতার করে। জেল থেকে বেরোবার পরও আবার পেরিয়ার সমস্ত শক্তি দিয়ে কংগ্রেসের জাত ব্যবস্থা রক্ষার বিরুদ্ধে নানান কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এবং মনুস্মৃতি ও ভারত রাষ্ট্রের সংবিধান জ্বালানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং আবার গ্রেপ্তার হন। জীবনের শেষ দিকে এসেও আমরা দেখি পেরিয়ার রামাসামি তার যুক্তিবাদী নিরিশ্বরবাদী প্রচার কাজ চালিয়ে গেছেন। ১৯৭০ এ তার বয়স যখন ৯০ এর বেশি তখন তিনি তামিল ভাষায় একটি দ্বি-মাসিক পত্রিকা উন্ময় বা "সত্য" প্রকাশ করেন এবং তার সঙ্গে তৈরি করেন রেশনালিস্ট ফোরাম নামে একটি সামাজিক সংগঠন।

 যে কোনো যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ এই সংগঠনের সদস্য হতে পারতেন। ১৯শে ডিসেম্বর ১৯৭৩ এ চেন্নাইয়ের সমাজে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস দূরীকরণ নিয়ে একটি সভায় উপস্থিত ছিলেন ৯৪ বছরের পেরিয়ার ই ভি রামা স্বামী। এই সভায়ও তিনি স্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করেন আমাদের ব্রাহ্মণ্যবাদী রাষ্ট্রের পরিবর্তন করতে হবে। এটাই ছিল তার শেষ বক্তৃতা। এই সভায় মাত্র কয়েক মিনিট কথা বলার পরেই তার বুকে প্রচণ্ড যন্ত্রনা শুরু হয়। ২০ ডিসেম্বর ১৯৭৩ তাকে চেন্নাই মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। এবং তারপর ভেলোর সিএমসি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। চব্বিশে ডিসেম্বর সকাল সাতটা বেজে বাইশ মিনিটে ৯৪ বছর বয়সে রামাসামী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ চিন্তকদের মধ্যে পেরিয়ার ছিলেন এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম। তার সমসাময়িক সময়ে প্রায় কেউই  এভাবে জাত পাতের বৈষম্য, ভারতীয় সমাজের স্তরবিশিষ্ট  কাঠামো, সমস্ত রকম কুসংস্কার এর বিরুদ্ধে এত স্পষ্ট ভাষায় মতামত ব্যক্ত করেননি। পেরিয়ার তার সময় এর থেকে অনেকটাই এগিয়েছিলেন। নারী মুক্তি, নারী পুরুষ সম্পর্ক, দেবদাসী প্রথা ইত্যাদি সম্পর্কেও তার স্পষ্ট বৈপ্লবিক মতামত ছিল। সর্বোপরি ধর্মের বিরুদ্ধে নাস্তিকতার স্বপক্ষে এত স্পষ্ট অবস্থান এই সময়ে আমরা আর কোন রাজনৈতিক বা সামাজিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে খুব একটা দেখতে পাই না। এখানেই পেরিয়ার রামাসামির মৌলিকত্ব। তামিলনাড়ুতে বাল্যবিবাহ, বিধবা বিবাহ সম্পর্কে তার চিন্তাভাবনা আমাদের তার পূর্বসূরী বিদ্যাসাগরের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই সময়ে ভারতবর্ষের রাষ্ট্র ও সমাজ সবকিছুর হিন্দুত্ববাদী বিনির্মাণ চলছে। দলিত শিশুকে শুধুমাত্র জল ছোঁয়ার অপরাধে স্রেফ মরে যেতে হচ্ছে। ধর্মীয় বিভাজন দিন দিন প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। ফ্যাসিবাদী কায়দায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস জারি করে অন্যস্বর অবদমিত করা হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে পেরিয়ার এর মতামত শাসক শক্তির কাছে স্পষ্টতই একটা চ্যালেঞ্জ। সেই জন্যেই হিন্দুত্ববাদী শক্তির তাকে নিয়ে এত অস্বস্তি। মৃত্যুর ৫০ বছর পরেও তার স্ট্যাচুতে কালি লেপন করা হচ্ছে আর ঠিক এখানেই এরিয়ার এর প্রাসঙ্গিকতা। এই সর্বাত্মক নেতিবাচক শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের প্রয়োজন শক্তিশালী বৈপ্লবিক বিকল্প চিন্তা কাঠামো। সেই কাঠামো নির্মাণের জন্য রামা স্বামী পেরিয়ারের উপর নতুন করে আলোকপাত করা সারা দেশেই অত্যন্ত জরুরি। বিন্ধ্য পর্বতের বাধা টপকে তাকে ছড়িয়ে দিতে হবে সমগ্র দেশে।