জেন অস্টেনের উপন্যাস 'পারসুয়েশন' প্রসঙ্গে

জেন অস্টেনের সর্বশেষ উপন্যাস ‘পারসুয়েশনে’র নায়িকা অ্যানে এলিয়ট যখন উনিশ বছরের সদ্য যুবতী, তখন ফ্রেডরিক ওয়েন্টওর্থের সঙ্গে তার প্রেম সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফ্রেডরিক ওয়েন্টওর্থ সেসময়ে ছিলেন নৌবাহিনীর তলার দিকের অফিসার, তখন তাঁর অল্প আয়, কম সামাজিক প্রতিপত্তি। অন্যদিকে কেলিঞ্চ হল নিবাসী এলিয়টদের রয়েছে বিরাট পারিবারিক এস্টেট ও সম্পত্তি। এলিয়টরা বিত্তবান, সামাজিক মর্যাদাতেও অনেক এগিয়ে। বিত্ত আর সামাজিক মর্যাদা নিয়ে অ্যানের বাবা স্যর ওয়াল্টার এলিয়ট, দিদি এলিজাবেথ এলিয়ট আর বোন ম্যারি - সবারই খুব দেমাক। বাড়ির মেয়ে অ্যানের সঙ্গে কম বিত্তর মানুষ ফ্রেডরিক ওয়েন্টওর্থ এর সম্পর্ক বাড়ির কারোরই পছন্দ হল না। এলিয়টদের পারিবারিক বন্ধু, অ্যানের অভিভাবিকাসম লেডি রাসেলও এলিয়ট পরিবারের মেয়ে অ্যানের সঙ্গে ওয়েন্টওর্থের সম্পর্ককে মানলেন না। সম্মিলিত চাপের মুখে অ্যানেকে সে সম্পর্ক ভেঙে দিতে হল।

এলিয়টদের প্রতিবেশী মুসগ্রোভ পরিবারের ছেলে চার্লস মুসগ্রোভ এরপর অ্যানেকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু অ্যানে মনে মনে তখনো ওয়েন্টওর্থকেই ভালোবাসে। সে এই বিবাহ প্রস্তাব স্বীকার করল না। এরপর চার্লসের বিবাহ প্রস্তাব গেল এলিয়ট পরিবারের ছোট মেয়ে, অ্যানের বোন ম্যারির কাছে এবং তা স্বীকৃতি পেল। দুই দিদি এলিজাবেথ ও অ্যানে অবিবাহিত থাকা অবস্থাতেই সবচেয়ে ছোট বোন ম্যারির বিয়ে হয়ে গেল মুসগ্রোভ পরিবারে। মুসগ্রোভ দম্পতির বেশ কয়েকটি ছেলে মেয়েও হল পরপর কয়েক বছরে। স্বামী, শাশুড়ি, ছেলে মেয়ে ছাড়া দুই ননদিনী – হেনরিয়েত্তা ও লাউসিয়াকে নিয়ে ম্যারির বড়সড় সংসার। সে অবশ্য খুব গুছনো গৃহিণী নয়। দুই দিদি এলিজাবেথ বা অ্যানে প্রায়ই বোনের বাড়িতে যায় ও অনেকগুলি ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে বিব্রত ম্যারিকে সমস্যা থেকে উদ্ধার করে।

জেন অস্টেনের উপন্যাসে সাধারণভাবে অতীতের দিকে কাহিনীর টান থাকে না। অতীত প্রসঙ্গ এলেও তা একটি পার্শ্বিক বিষয় বা সমস্যা হিসেবে আসে, যেমন এসেছিল ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’তে এডওয়ার্ড ও লুসি প্রসঙ্গে বা ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিসে’ ডার্সির বোন ও উইকহ্যাম সম্পর্কে। ‘পারসুয়েশান’ উপন্যাসে কিন্তু অতীত বর্তমানের ওপর আক্ষরিকভাবেই ছায়া বিস্তার করে রেখেছে। আট বছর আগে ভেঙে যাওয়া প্রেম ও প্রেমিকের স্মৃতি উপন্যাসের ঘটনাকালে অ্যানে এলিয়ট ভুলতে পারেন নি।

আট বছরে অ্যানের মনের মেঘ না কাটলেও অন্যান্য নানা বদল হয়েছে। এলিয়টদের পারিবারিক পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে, তাদের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়ে গেছে। তাই তাদের পারিবারিক বন্ধু লেডি রাসেল ও উকিল মিস্টার শেফার্ড স্যর ওয়াল্টার এলিয়টকে পরামর্শ দেন কেলিঞ্চ হল ভাড়া দিয়ে বাথ এ গিয়ে পরিবার নিয়ে থাকতে। নিমরাজি হলেও এই পরামর্শ তিনি মেনে নেন ও বাড়ি ভাড়া দিয়ে বাথে চলে যান। বড় মেয়ে এলিজাবেথ তাঁর সঙ্গী হন। তাঁদের উকিল মিস্টার শেফার্ডের মেয়ে মিসেস ক্লেও বাথে যান। মনে করা হচ্ছিল মিসেস ক্লে বিপত্নীক স্যর ওয়াল্টার এলিয়টের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে ও বিবাহে আগ্রহী।

অ্যানে থেকে যান লেডি রাসেলের বাড়িতে। সেখান থেকে অনতিদূরের কেলিঞ্চ হলের নয়া বাসিন্দা অ্যাডমিরাল ক্রফট ও মিসেস ক্রফটের সঙ্গে দেখা করতে অ্যানে মাঝে মাঝেই চলে আসতেন। জানা গেল মিস্টার ওয়েন্টওর্থ, অ্যানের কিশোরীবেলার প্রেমিক, হলেন মিসেস ক্রফটের ভাই। ওয়েন্টওর্থ ক্রফটদের বাড়িতে আসার পর তাঁকে দেখে অ্যানের মনে ঝড় উঠল, জেগে উঠল পুরনো প্রেমের স্মৃতি। অবশ্য অ্যানে বা ওয়েন্টওর্থের দেখা হলেও খুব বেশি কথাবার্তা বা মেলামেশা হল না।  মাঝের আট বছরে ওয়েন্টওর্থের জীবনে এসেছে অনেক বদল। তিনি এখন নৌ বাহিনীর ক্যাপ্টেন। শুধু যে তাঁর আয়-ই বেড়েছে তাই নয়, সামাজিক মর্যাদাও বেড়েছে অনেক গুণ। ওয়েন্টওয়র্থ এখন বিবাহের জন্য প্রস্তুত। অ্যানা তাকে এখনো ভালোবাসে। তবে সে বুঝতে পারে ওয়েন্টওর্থ একদা সম্পর্ক ভেঙে দেবার রাগ এখনো ভুলতে পারে নি। সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার জন্য ফ্রেডরিক এখনো অ্যানাকে ক্ষমা করে নি, এখনো সে তার ওপর ক্রুদ্ধ, এটা ফ্রেডরিক ওয়েন্টওর্থের শীতল আচরণ থেকেই অ্যান বুঝে নেয়।

ক্রফট দম্পতি, মিস্টার ওয়েন্টওর্থ এবং মুসগ্রোভ পরিবারের সঙ্গে অ্যানে বেড়াতে যায় লাইম রেজিসে। ফ্রেডরিক ওয়েন্টফোর্থ এর লাইম রেজিস যাত্রার কারণ ক্যাপ্টেন বেনউইক ও ক্যাপ্টেন হারভিলের সঙ্গে দেখা করা। তরুণ ক্যাপ্টেন বেনউউইক তার বাগদত্তার অকস্মাৎ মৃত্যুতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এই বাগদত্তা ছিলেন ক্যাপ্টেন হারভিলের বোন। ফলে বিষণ্নতা তাঁকেও ঘিরে আছে। পুরনো প্রেমিকের স্মৃতি নিয়ে বিষণ্ণ অ্যানেও। বিষণ্ণতার উপশম বিষয়ে ক্যাপ্টেন বেনউইল ও অ্যানের মধ্যে অনেক কথাবার্তাও হয় লাইম রেজিসে থাকাকালীন সময়ে। অন্যদিকে সমুদ্রতীরের এই প্রমোদ শহরে সময় কাটানোর সময় মেরী মুসগ্রোভের দুই ননদিনী হেনরিয়েত্তা ও লাউসিয়া ক্যাপ্টেন ফ্রেডরিক ওয়েন্টওর্থের প্রতি আগ্রহী হয়। হেনরিয়েত্তা এর আগেই চার্লস আয়তারের বাগদত্তা থাকায় সে অবশ্য এই দিকে খুব বেশি এগোয় নি। তবে লাউসিয়া মিস্টার ওয়েন্টওর্থের দিকে বাধাহীনভাবে এগিয়ে যায়, যা অ্যানের অস্বস্তি ও যন্ত্রণা তৈরি করে। এই সময়ে অ্যানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে তার দূর সম্পর্কের আত্মীয় মিস্টার উইলিয়ম এলিয়ট, যিনি সম্প্রতি বিপত্নীক হয়েছেন। স্যর ওয়াল্টার এলিয়ট অপুত্রক বলে উত্তরাধিকার আইনের নিয়ম অনুসারে পরিবারের নিকটবর্তী পুরুষ হিসেবে তিনিই কেলিঞ্চ হলের উত্তরাধিকারী। অ্যানের বাবা এবং দিদি এলিজাবেথও এই সম্পর্ক বিষয়ে উৎসাহিত বোধ করেন। অ্যানে কিন্তু পুরনো প্রেমের বাইরে কিছু ভাবতে পারে না। অ্যানের পুরনো দিনের বন্ধু মিসেস স্মিথ মিস্টার এলিয়টের চরিত্রের নানা নেতিবাচক দিক, যার মধ্যে ছিল অকৃতজ্ঞতা ও প্রবল স্বার্থপরতার কথা নিজের জীবন অভিজ্ঞতা থেকে অ্যানেকে জানান। সব মিলিয়ে অ্যানে মিস্টার এলিয়টের সঙ্গে সম্পর্কের সম্ভাবনা বিষয়ে কোনও আগ্রহ দেখায় না।

লাইম রেজিসে থাকাকালীন ঘটে এক দুর্ঘটনা। সমুদ্র পাড়ের পাথরের মেঝেতে পড়ে মারাত্মক আহত হয় লাউসিয়া। এরপর সে অনেকদিন লাইম রেজিসে থেকে যেতে বাধ্য হয়। দুর্ঘটনার পর অ্যানের দ্রুত ব্যবস্থাপনা ফ্রেডরিক ওয়েন্টওর্থকে খুশি করে। ক্যাপ্টেন বেনউইক লাউসিয়ার পরিচর্যা করেন এবং তাদের মধ্যে এক সম্পর্ক তৈরি হয়, যা কয়েকমাস পরে তাদের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে। ওয়েন্টওয়র্থের সঙ্গে লাউসিয়ার সম্পর্ক সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাওয়ায় অ্যানে স্বস্তি পায়। এইসময়ে বিয়ে হয় হেনরিয়েত্তা ও চার্লস আয়তারেরও। অন্যদিকে অ্যানে ওয়েন্টওর্থের কাছ থেকে এক চিঠি পায়, যেখানে ওয়েন্টওর্থ জানান তিনি এখনো অ্যানেকে ভালোবাসেন এবং বিয়ে করতে চান। এই প্রস্তাবের জন্যই অ্যানে অপেক্ষা করে ছিল। সে সানন্দে রাজি হয় ও বিবাহ সুসম্পন্ন হয়। আগে এলিয়ট পরিবারের যারা এই সম্পর্কে আপত্তি জানিয়েছিল, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারাই এই বিবাহ সানন্দে মেনে নেয়।  

পারসুয়েশান জেন অস্টেনের পূর্ব প্রকাশিত উপন্যাসগুলি থেকে আকারে বেশ কিছুটা ছোট। মূল কাহিনীর পাশাপাশি শাখা কাহিনীর এখানে নামমাত্র উপস্থিতি। সংলাপ বা চরিত্রায়নের বিস্তারও পূর্ব প্রকাশিত উপন্যাসগুলির চেয়ে কম। অনেকেই মনে করেছেন যে জেন অস্টেন এই উপন্যাস যখন লিখছেন তখন তিনি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এই অসুস্থতা নিয়েই তিনি প্রয়াত হন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর দাদা এই উপন্যাসটি প্রকাশ করেন। সাধারণভাবে প্রাথমিক খসড়াকে চূড়ান্ত প্রকাশের আগে যেভাবে পরিবর্তন পরিমার্জন করতেন জেন অস্টেন, এই উপন্যাসে সেই সুযোগ তিনি পান নি। ফলে প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস বা এমা র মতো বিস্তার ও নির্মিতি কুশলতা এখানে দেখা যবে না। এই উপন্যাসের অনন্যতা তার নির্মিতিতে নয়, জীবন দর্শনে।

অনেকে পারসুয়েশানকে যে জনপ্রিয়তর ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ বা নির্মাণ সৌকর্যে মহত্তর ‘এমা’র চেয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে রাখতে চান, তার কারণ এর নায়িকার গভীরতর জীবনবোধ। ‘পারসুয়েশনে’র নায়িকা অ্যানে জেন অস্টেনের পূর্ববর্তী নায়িকাকুল - ম্যারিয়ানে, এলিজাবেথ বা এমার মতো উচ্ছ্বল বা বর্ণময় নয় - চিন্তাশীল ও গভীর। তার বয়েস জেন অস্টেনের অন্যান্য নায়িকাদের থেকে বেশি বলেই শুধু নয়, মনের গড়নের কারণেই সে অনেক বেশি পরিণত। সে কবিতার দর্শন বিষয়ে যেমন কথা বলতে পারে, তেমনি পারে বড় দুর্ঘটনার পর মাথা ঠান্ডা রেখে পরিচর্যাতে দক্ষতা দেখাতে। পরিবারের চাপে কুঁকড়ে গিয়ে কিশোরী বেলায় প্রেম সম্পর্ককে ভেঙে দিতে হলেও সে সেই প্রেমকে গভীর বিষাদ নিয়ে মনের মধ্যে রেখে দেবার মতো দৃঢ়। তাদের পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকার যার কাছে যাবে, সেই মিস্টার এলিয়টের বিবাহ প্রস্তাবকে হেলায় অবহেলা করে সে বুঝিয়ে দেয় টাকা পয়সা ও জাগতিক সুখের অঙ্কে সে জীবনকে বিচার করে না।

অ্যানে এলিয়টের জীবনবোধ কি ঔপন্যাসিকের জীবনদর্শনকেই ধারণ করে আছে? অ্যানে চরিত্রের মধ্যে কি আছে জেন অস্টেনের জীবনের উপাদান? এই প্রশ্নের উত্তর অস্টেন গবেষকরা খুঁজে চলেছেন। জেন অস্টেনের জীবনী লেখকরা আমাদের জানিয়েছেন যে ১৭৯৫ সালে জেন অস্টেনের জীবনে এসেছিল প্রথম এবং সম্ভবত শেষ প্রেম। প্রেমিকের নাম ছিল টম লেফ্রয়। জেনের বয়েস তখন উনিশ, টমও তার সমবয়সী। রেভারেন্ড জর্জ অস্টেনের বন্ধু রেভারেন্ট জর্জ লেফ্রয় থাকতেন অ্যাশে রেভারেন্সিতে, তার ভাইপো ছিলেন টম। স্টিভেনটন থেকে অ্যাশের দূরত্ব ছিল কয়েক মাইল। বয়সের অনেকটা ব্যবধান সত্ত্বেও জর্জ লেফ্রয়ের স্ত্রী অ্যানে লেফ্রয়ের সঙ্গে জেনের হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল। জেন অনেকবার অ্যাশেতে গেছেন, সেখানে বল নাচের আসরে অংশ নিয়েছেন। এই বল নাচের আসর টম ও জেনের সম্পর্ককে নিবিড় করে। দিদি ক্যাসান্দ্রাকে লেখা একটি চিঠিতে জেন লিখেছিলেন কীভাবে জেন ও টম বল নাচের আসরে অনেকগুলো নাচ একসঙ্গে নাচায় টমের ভাইবোনেরা – সতেরোর  লুসি, চোদ্দর জর্জ, এগারোর এডওয়ার্ড তাদের নিয়ে হাসিঠাট্টা করেছিল। ১৭৯৬ সালে হ্যাম্পশায়ার ছেড়ে টম লেফ্রয় লন্ডনে আইন পড়তে চলে যান। এরপর কোনও কারণে তাদের সম্পর্ক আর এগোয় নি। এই সময়েই জেন অস্টেন তাঁর জনপ্রিয়তম উপন্যাস ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এর প্রথম খসড়া ফার্স্ট ইম্প্রেশন লিখতে শুরু করেন।

স্টিভেনটনের বাড়িটি থেকে দাদা জেমস এর এই আবাসটির দূরত্ব ছিল প্রায় দু কিলোমিটার। এই বাড়িটিতে জেন ও ক্যাসান্দ্রা প্রায়ই চলে আসতেন পায়ে হেঁটে। এখানে বল নাচের আসরে তারা অংশ নিতেন। জেন নাচতে ভালোবাসতেন। তাঁর নানা উপন্যাসেই বলনাচের প্রসঙ্গ বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে এসেছে।

১৮০০ সালে জেনের বাবা জর্জ অস্টেন রেক্টরের দায়িত্ব থেকে অবসর নেবার সিদ্ধান্ত নেন। স্টিভেনটন চার্চের নতুন রেক্টর হন তাঁর বড় ছেলে জেমস অস্টেন। জর্জ অস্টেন ঠিক করেন স্ত্রী ও দুই কন্যা ক্যাসান্দ্রা ও জেন অস্টেনকে নিয়ে বাথ শহরে চলে যাবেন। বাথ শহরটি তখন ইংলন্ডের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। এর জল শরীরের পক্ষে খুব উপযোগী ও জলে নানা উপকারী খনিজ দ্রব্য মিশে আছে – এই ধারণা থেকে চিকিৎসার প্রয়োজনে অনেকেই সে সময় বাথ শহরে আসতেন। এছাড়াও শহরটি ছিল হরেক পণ্যের বিকিকিনির জন্য বিখ্যাত। সেকালে পাওয়া যায় এমন সব পণ্যই নাকী বাথের রাস্তাঘাটে দোকানীদের কাছ থেকে পাওয়া যেত। শহরে থিয়েটার, বল নাচ, গানের অনুষ্ঠান, তাসের আড্ডা সহ নানা ধরনের চিত্তবিনোদনের হরেক বন্দোবস্ত ছিল।

বাথ শহরে বাবা মা কে রেখে জেন ও তার দিদি ক্যাসান্দ্রা মাঝেমাঝেই চলে আসতেন স্টিভেনটনের বাড়িটিতে। সেখানে তখন তাঁদের দাদা জেমস অস্টেন থাকেন। স্টিভেনটনের পুরনো প্রতিবেশীদের বাড়িতেও তারা যেতেন, গল্পগুজব করে সময় কাটাতেন। এই প্রতিবেশীদের মধ্যেই ছিলেন দুই বোন ক্যাথারিন গিগ ও আলেথিয়া বিগ। একবার জেন আর ক্যাসেন্দ্রা যখন বাথ থেকে স্টিভেনটনে ফিরে বিগদের বাড়িতে গেছেন, ক্যাথারিন ও আলেথিয়ার ভাই হ্যারিস বিগ জেনকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। তখনকার মতো জেন কোনও কারণে সম্মতি দিয়েছিলেন। কিন্তু স্টিভেনটনে নিজেদের বাড়িতে ফিরে এক বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে তিনি বুঝতে পারেন এই বিয়ে অর্থহীন হবে, এর পেছনে কোনও প্রেমের উত্তাপ নেই। জেন কেন হঠাৎ রাজী হয়েছিলেন তা বলা কঠিন, কিন্তু এক রাতের ব্যবধানেই তিনি মত বদলে ফেলেন এবং পরদিন সকালেই দিদি ক্যাসান্দ্রাকে সঙ্গে নিয়ে স্টিভেনটন ছেড়ে বাথে ফিরে যান।

১৮০৩ সালের নভেম্বরে জর্জ ও ক্যাসান্দ্রা অস্টেন তাদের দুই মেয়ে জেন ও ক্যাসান্দ্রাকে নিয়ে লাইম রেজিসে বেড়াতে যান। ডরসেট ও ডেভন এর সীমান্তে অবস্থিত এই সৈকত শহরটি ততদিনে বেশ বিখ্যাত হয়ে উঠেছে ছুটি কাটানোর আস্তানা হিসেবে। ব্রিঘটন, সাউথ হ্যাম্পটন বা ওয়েমাউথের মতো সমুদ্র সৈকতের মত বিখ্যাত না হলেও লাইম রেজিসে এগুলির চেয়ে কম খরচে থাকা সম্ভব ছিল বলেই সম্ভবত অবসরপ্রাপ্ত জর্জ অস্টেন একে বেছে নিয়েছিলেন। এরপরেও একবার জেন বাবা মায়ের সঙ্গে লাইম রেজিসে যান, তবে দিদি ক্যাসান্দ্রা সেবার জাননি। লাইম রেজিস থেকে দিদিকে জেন অস্টেন যে সব চিঠি লিখেছিলেন সেখানে তিনি লাইম রেজিস ভ্রমণের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন। ১৮০৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বরে দিদি ক্যাসান্দ্রাকে লেখা জেনের একটি চিঠিতে বল নাচের অভিজ্ঞতার বিস্তারিত বর্ণনা আছে। আমরা জানি বাথ শহর ছাড়াও লাইম রেজিসকে জেন অস্টেন তাঁর শেষ উপন্যাস ‘পারসুয়েশন’ এর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার পটভূমি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এইসব জীবন তথ্যের সূত্র ধরে পারসুয়েশনের নায়িকা অ্যানে ও তার স্রষ্টা জেনের মধ্যে কিছু সমীকরণ তৈরির বিষয়টিকে একেবারে বাতিল করে দেওয়া যায় না। পারসুয়েশানকে আত্মজৈবনিক উপন্যাস বলাটা হয়ত অতিকথন হবে, তবে জেন অস্টেনের জীবন অভিজ্ঞতার নানা উপাদান যে এই উপন্যাসের ঘটনা, প্রেক্ষাপট ও চরিত্রায়নে প্রভাব ফেলেছে, সেকথা অস্বীকার করা যায় না।