জেন অস্টেনের এমা প্রসঙ্গে

‘এমা’ জেন অস্টেনের একমাত্র উপন্যাস যার নাম তার নায়িকার নামে। নায়িকার নামে অস্টেন প্রথমে আরো দুটি উপন্যাসের নাম রাখলেও শেষমেশ তাতে বদল আসে। 'এলিয়নর অ্যান্ড মারিয়ানে' বদলে হয় 'সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি', আর 'সুসান' বদলে হয় 'নর্দাঙ্গার অ্যাবি'। এদিক থেকে ‘এমা’ উপন্যাসটি ব্যতিক্রম। এর নামকরণ হয়েছে নায়িকার নামেই। তবে উপন্যাসের নাম নায়িকার নামে রাখলেও উপন্যাসে নায়িকা এমাকে নিয়ে জেন অস্টেন মাঝেমধ্যেই বেশ কৌতুক করেছেন। নায়িকা তার ধারাবাহিক ভুলভ্রান্তির জন্য সমালোচনাতেও বিদ্ধ হয়েছে বারবার। এই উপন্যাস যাঁর দৃষ্টিকোণকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়, তিনি উপন্যাসের নায়ক মিস্টার জর্জ নাইটলি। জর্জ নাইটলি এমার সঙ্গে শুধু হালকা খুনসুটিই করেন না, তিনি এমা চরিত্রের সমস্যাজনক নানাদিকের তীব্র ও তীক্ষ্ণ সমালোচক। এমার সমস্যাগুলি তিনি এমাকে সরাসরি জানিয়ে দেন, তাঁর সঙ্গে দৃষ্টিকোণগত পার্থক্য নিয়ে তীব্র বিতর্কে মাতেন। মতের অমিল মন কষাকষির পরিস্থিতি তৈরি করলেও তিনি সত্য কথন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন না।  

এই উপন্যাসে এমাকে দেখে আমাদের মনে হয় সে স্বভাবগতভাবে ম্যাচমেকার বা ঘটকালি প্রবণ। তার মধ্যে ভালো ঘটকসত্তা রয়েছে – এটা সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এবং অন্যদের তা জাঁক করে জানাতে ভালোবাসে। তবে উপন্যাসের ঘটনাবলী থেকেই বোঝা যায় এমার এই ধারণা কতটা ভুল। উপন্যাসের শুরুতে এমার গভর্নেস মিস টেলর ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী বিপত্নীক মিস্টার ওয়েস্টন এর বিবাহ সুসম্পন্ন হয়। এমা গর্ব করে বলে তার ঘটকালিতেই এই বিয়েটা হতে পারল। তবে বাস্তবে এর পেছনে এমার তেমন কোনও ভূমিকাই ছিল না। দুজনের সম্পর্ক নিজস্ব গতিতেই এগিয়েছিল এবং তা বিবাহে পরিণতি পেয়েছিল। এমার উদ্যোগ বা ভূমিকার সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক বা বিবাহের কোনও প্রত্যক্ষ যোগ ছিলই না। এই বিবাহে এমার ঘটকালির ভূমিকা রয়েছে – এমার এই আত্মপ্রচার ততটা সমস্যাজনক ছিল না কিন্তু এর সূত্র ধরে তার মাথায় আরো ঘটকালি করার যে ভূত চাপল, তার ফল হয় মারাত্মক। এমার আশেপাশের অনেকগুলি মানুষ তার ঘটকালি ক্রিড়ার দ্বারা নানাভাবে বিড়ম্বিত হয়। তৈরি হয় নানা বিপর্যয়কর পরিস্থিতি। এমা নিজে অন্যদের ভুল বোঝে, অন্যদের আবেগকে জোর করে ভুল পথে চালিত করতে চায় ও অনাকাঙ্ক্ষিত জটিল সব পরিস্থিতির জন্ম দেয়। উপন্যাসের প্রথম খণ্ডে হ্যারিয়েট স্মিথ, রবার্ট মার্টিন ও মিস্টার এলটনকে এমার এইসব পরীক্ষা নিরীক্ষা ও খেয়ালখুশির জন্য নানারকম ভোগান্তির শিকার হতে হয়।

এমার দীর্ঘদিনের গভর্নেস তথা সঙ্গী মিস টেলরের বিয়ের পর সে বেশ খানিকটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। জর্জ নাইটলির সঙ্গে মাঝে মাঝে আলাপচারিতার বাইরে তার আর তেমন কোনও বন্ধু ছিল না, যে তার একাকিত্ব কাটাতে পারে। তার বাবা, মিস্টার উডহাউস বৃদ্ধ এবং সর্ববিষয়ে সংশয়ী বা অনুযোগপ্রবণ বলে একুশ বছরের মেয়ের সঙ্গে তার আত্মিক যোগাযোগ সম্ভব ছিল না, আর বাস্তবেও তা বিশেষ হয় নি। এমা বাবার দেখভাল করত বা কথায় আপাতভাবে সায় দিত কিন্তু তার বাইরে বাবার সঙ্গে তার খুব একটা মানসিক নৈকট্য ছিল না।

এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় বোর্ডিং স্কুলের আবাসিক ছাত্রী হ্যারিয়েট স্মিথের সঙ্গে এমার আলাপ ও বন্ধুত্ব হয়। হ্যারিয়েট এমাদের হার্টফিল্ডের বাড়িতে নিয়মিত আসতে থাকে ও অনেকটা করে সময় কাটাতে থাকে। হ্যারিয়েটের বাবা মা কে তা জানা ছিল না। এমা ধরে নিয়েছিল সে নিশ্চয় কোনও ল্যান্ডেড জেন্ট্রির অবৈধ সন্তান। হ্যারিয়েট স্মিথকে কোনও ভদ্রসন্তান অর্থাৎ ল্যান্ডেড জেন্ট্রির সঙ্গে বিয়ে দেবার বাসনা তার মধ্যে তৈরি হয়। সে ভাবতে থাকে তার আশেপাশের চরিত্রদের কে সেই মানুষটি হতে পারে। অবশেষে তার মনে হয় স্থানীয় যাজক মিস্টার এলটনই হলেন সেই উপযুক্ত ব্যক্তি। এমা এলটনের দিকে হ্যারিয়েট স্মিথকে জোর করে ঠেলতে থাকে এবং হ্যারিয়েট স্মিথকে বোঝাতে থাকে যে এলটন তাকে ভালোবাসেন। বাস্তবে এলটনের আকর্ষণ ছিল এমাকে ঘিরেই। এমা এলটনের তার প্রতি আকর্ষণকে যেমন বুঝতে পারে নি, তেমনি বুঝতে পারে নি এলটনের চরিত্র বৈশিষ্ট্য ও মন মানসিকতা। সে যে প্রেম ও বিবাহকে সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক লাভক্ষতির জায়গা থেকে দেখে এটা বুঝতে পারলে এমার পক্ষে বোঝা কঠিন হত না, যে এলটন কখনোই হ্যারিয়েট স্মিথকে বিবাহ করবে না। কিন্তু এই সমস্ত বাস্তব বিচার বিশ্লেষণের পথে এমা এগোয় নি। সে এলটনের পাত্রী হিসেবে হ্যারিয়েটকে দেখার নেশায় ও কল্পনায় বাস্তবে হ্যারিয়েটের যে সম্পর্ক গড়ে উঠছিল তাকে নষ্ট করে দিল।

উদ্যমী বুদ্ধিমান কৃষক রবার্ট মার্টিন এবং হ্যারিয়েট স্মিথ এর মধ্যে আগেই সহজ স্বাভাবিক যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। হ্যারিয়েট রবার্ট মার্টিনের মা, বোন সহ সমগ্র পরিবারের মধ্যেও বন্ধুত্ব, আতিথ্য, ভালোবাসা লাভ করেছিল। এসবের সূত্র ধরেই রবার্ট মার্টিনের দিক থেকে হ্যারিয়েটের প্রতি এসেছিল বিবাহ প্রস্তাব। মার্টিনের প্রতি আগ্রহ আকর্ষণের কথা মাথায় রাখলে এই প্রস্তাবকে সুখদ পরিণতির পথ হিসেবেই দেখার কথা। কিন্তু এমার মাথায় তখন অন্য ভূত চেপেছে, সে ঠিক করে ফেলেছে যাজক মিস্টার এলটনের সঙ্গে সে হ্যারিয়েট স্মিথের সম্পর্ক তৈরি করবে, আর তাই হ্যারিয়েটকে নানাভাবে প্রভাবিত করে এমা তাকে দিয়ে মার্টিনকে বিবাহ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার চিঠি লিখিয়েছে।

অজ্ঞাত কুলশীল হ্যারিয়েট স্মিথকে এমা কতটা বন্ধু হিসেবে ভালোবেসেছিল আর কতটা খেলার পুতুল হিসেবে চালনা করে আনন্দ উপভোগ করতে চেয়েছিল, এই উপন্যাসের ঘটনাগতি সেই প্রশ্ন সামনে আনে। হ্যারিয়েট এবং এলটনের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি এক অসম্ভব কল্পনা এবং এতে এলটন কখনোই রাজি হবে না বলে মিস্টার জর্জ নাইটলি এমাকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেও এমা তা মানতে চায় নি। সে এই অবাস্তব ঘটকালি প্রচেষ্টায় এগিয়ে গেছে। এই প্রচেষ্টার বিভিন্ন দিককে জেন অস্টেন বিস্তারিতভাবে পাঠকের সামনে এনেছেন। সেখানে আমরা দেখি এমার আঁকা হ্যারিয়েটের পোট্রেট নিয়ে মিস্টার এলটনের উৎসাহকে কীভাবে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছে এমা। একই কাজ সে করেছে এলটনের থেকে পাওয়া একটি ধাঁধা নিয়েও। এমা বোঝার চেষ্টাই করেনি মিস্টার এলটন কোনওভাবেই হ্যারিয়েট স্মিথের প্রতি নয়, আসলে এমার প্রতিই অনুরক্ত।

ক্রিসমাসের সময় এমার দিদি ইসাবেলা তার স্বামী ও পাঁচ সন্তানকে নিয়ে হার্টফিল্ডের বাড়িতে আসেন। সে সময় ওয়েস্টন দম্পতি তাঁদের র‍্যান্ডালের বাড়িতে পুরো উডহাউস পরিবারকে এক দিন ডিনারে আমন্ত্রণ জানান। খুব বরফ পড়ায় আবহাওয়া ক্রমশ খারাপ হতে থাকে এবং বৃদ্ধ মিস্টার উডহাউস আবহাওয়া আরো খারাপ হওয়ার আগেই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে ব্যগ্র হন। দ্রুত ফেরার তাড়ায় এক গাড়িতে অনেককে আগে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এমা নিতান্ত অনিচ্ছাতেই আর এক গাড়িতে একাকী থাকা মিস্টার এলটনের সঙ্গী হন। গাড়ি চলতে শুরু করার পরেই মদ্যপানে নেশাসক্ত মিস্টার এলটন এমার প্রতি নিজের আকর্ষণকে মেলে ধরেন। এমা চূড়ান্ত বিব্রত, বিরক্ত এবং ক্ষুব্ধ হয়। কথোপকথনকালে এটাও স্পষ্ট হয়ে যায় মিস্টার এলটন হ্যারিয়েট স্মিথকে কোনওদিনই বিন্দুমাত্র পছন্দ করে নি, পুরোটাই ছিল এমার তরফে এক স্বকপোলকল্পিত ভুল ভাবনা।

এমার তরফে নানাবিধ ভুল বোঝা, ভুল বোঝানো এবং ভুল সিদ্ধান্তের নানা পরম্পরা রবার্ট মার্টিন আর হ্যারিয়েটকে যন্ত্রণাকাতর পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়।

কয়েকদিন প্রচণ্ড খারাপ আবহাওয়ার কারণে সকলে যখন বাধ্যত ঘরবন্ধি থাকে, এমা নিজের এলোমেলো বিপর্যস্ত দশাকে খানিকটা গুছিয়ে নেবার সুযোগ পায়। আবহাওয়ার উন্নতি হলে এমার দিদি স্বামী সন্তানদের নিয়ে লন্ডনের বাড়িতে ফিরে যান। মিস্টার এলটন চলে যান প্রমোদ নগরী বাথে। এমা যায় হ্যারিয়েটের কাছে এবং তার সমস্ত ভুল স্বীকার করে। হ্যারিয়েট সব শুনে আশাহত হলেও নিজেকে সামলে নেয় এবং এমাকে এই বিড়ম্বনা তৈরির জন্য কোনও দোষ না দিয়ে বলে মিস্টার এলটনের মতো মানুষের সে যোগ্য ছিল না বলেই এই সম্পর্ক পরিণতি পায় নি। উপন্যাসের এই অধ্যায়ে (১/১৬) আমরা দেখি হ্যারিয়েটের জন্য এমার বেদনা সত্যিই আন্তরিক এবং সেখানে কোনও খাদ নেই। উপন্যাসের এই অধ্যায়টি অন্য এক কারণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এখানে ঘটনার গতিকে থামিয়ে রেখে ঔপন্যাসিক জেন অস্টেন এমার মনের গহন প্রদেশের ভাবনাচিন্তার কথা বিস্তারে বলেছেন। সেকালের উপন্যাসে এই ধরনের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ খুব একটা দেখা যায় না বলেই এই অধ্যায়টিকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে হয়।

মিস্টার এলটনের সঙ্গে গাড়িতে আসার সময়কার তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে এমার মধ্যে কিছু আত্মোপলব্ধি হয়েছিল। সে ঘটকালি সম্পর্কিত নিজের ভুলগুলি বুঝতে পারে এবং কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়। সে সিদ্ধান্ত নেয় ঘটকালির সমস্ত প্রচেষ্টা সে বন্ধ করবে। তবে ঘটকালির সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসলেও তার আসল সমস্যার উৎস যে চরিত্র বৈশিষ্ট্য – ঘটনাবলীকে বাস্তবের আলোয় বিশ্লেষণ না করে একধরনের রোমান্টিক স্বকপোলকল্পিত ভাবনা দিয়ে বিশ্লেষণ করা ও প্রায়শই ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া – তার কোনও পরিবর্তন তখনো ঘটেনি। পরবর্তীকালে আমরা দেখব ঘটনার বাস্তব বিশ্লেষণ না করে কল্পনাপ্রবণভাবে সব কিছুকে ব্যাখ্যা করা ও ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হবার বৈশিষ্ট্যটি এমার মধ্যে থেকেই গেছে।

উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ডে এসে এই প্রবণতা নতুন ধরনের কিছু সমস্যার জন্ম দেয়। তবে ভুল বোঝাবুঝি ও জটিলতা উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ডে এসে যে আরো ব্যাপ্ত ও গভীর হবে, তার সব দায় নায়িকা এমার ভুল ভাবনাচিন্তার নয়। উপন্যাসের নানা চরিত্রই আধা প্রকাশ্য, আধা গোপনভাবে এখানে চলাফেরা করেছে ও তার ফলে শুধু এমা নয়, অনেকেই অনেকের সম্পর্কে বিভ্রান্ত হয়েছে এবং এইসব বিভ্রান্তি উপন্যাসে নতুন নতুন জট জটিলতা তৈরি করেছে।

উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্বে প্রথম পর্বের গুরুত্বপূর্ণ দুই চরিত্র – হ্যারিয়েট স্মিথ ও রবার্ট মার্টিন খানিকটা পাশে সরে যান ও নতুন দুই চরিত্র ঘটনাপ্রবাহে বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে প্রবেশ করেন। একজন ফ্রাঙ্ক ওয়েস্টন চার্চিল ও অন্যজন মিস জেন ফেয়ারফক্স। এই ফ্রাঙ্ক ওয়েস্টন চার্চিল হলেন মিস্টার ওয়েস্টন এর ছেলে। মিস্টার ওয়েস্টনের প্রথম স্ত্রী মারা যাবার পর তাদের নাবালক সন্তান শিশু ফ্রাঙ্ককে তার নিঃসন্তান মামা মামি চার্চিল দম্পতি তাঁদের কাছে ইয়র্কশায়ারে নিয়ে যান ও মানুষ করেন। ফ্রাঙ্ককে দত্তক নেবার পর তার নামের সঙ্গে জুড়ে যায় মামাবাড়ির চার্চিল পদবীটিও। ফ্রাঙ্ক ওয়েস্টন পরিচিত হন ফ্রাঙ্ক ওয়েস্টন চার্চিল নামে। মামা মামির বিপুল সম্পত্তির উত্তরাধিকারীও হন মিস্টার ফ্রাঙ্ক ওয়েস্টন চার্চিল। এই বিত্তশালী যুবক সারের হাইবেরিতে বাবা মিস্টার ওয়েস্টনকে দেখতে আসবে বলে বারবার খবর তৈরি হয়, এমাও মনের গোপনে আশান্বিত হয়। কিন্তু শেষমেষ প্রতিবারই কোনও না কোনও কারণে এই আগমন বাতিল হয়ে যেতে থাকে। মিস্টার ওয়েস্টনের পুনর্বিবাহের সময়, যা সম্ভবত সেপ্টেম্বর মাসের ঘটনা, ছেলে ফ্রাঙ্ক আসতে পারে নি মামির অসুস্থতার জন্য। তবে জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সে আসছেই বলে জানিয়েছিলেন তার বাবা মিস্টার ওয়েস্টন। কিন্তু দেখা গেল মামির শরীর খারাপ থাকায় এবারও তার আসা হল না। ফ্রাঙ্ক না আসায় এমা হতাশ হয় এবং নিজের হতাশা প্রিয় বন্ধু মিস্টার জর্জ নাইটলির কাছে প্রকাশ করে। মিস্টার নাইটলি ফ্রাঙ্ক ওয়েস্টন চার্চিলকে বাবার প্রতি দায়শূন্য বলে সমালোচনা করেন। এমা মনে মনে বোঝে যে মিস্টার জর্জ নাইটলি ভুল কিছু বলছেন না। কিন্তু কথোপকথনকালে সে ফ্রাঙ্ক এর পক্ষ নিয়ে মিস্টার নাইটলির সঙ্গে তর্ক চালিয়ে যায়।

এইসময় হাইবেরিতে তিন মাসের জন্য আসেন মিস বেটসের বোনঝি মিস জেন ফেয়ারফক্স। মিস জেন এমার সমবয়সী, যথেষ্ট শিক্ষিতা এবং সুন্দরী। মিসেস বেটসের সর্বকনিষ্ঠা কন্যা তথা মিস বেটসের বোনের মেয়ে জেন মাত্র তিন বছর বয়সেই বাবা মাকে হারিয়ে অনাথ হয়ে পড়েছিল। তারপর থেকে সে দীর্ঘদিন ছিল কর্নেল ক্যাম্বেল ও মিসেস ক্যাম্বেলের কাছে। তাঁদের কন্যা মিস ক্যাম্বেলের সাথী হিসেবেই সে সেখানে বেড়ে ওঠে। সম্প্রতি মিস ক্যাম্বেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে মিস্টার ডিক্সনের এবং তারা আয়ার্লান্ডে চলে গেছেন। ফলে জেনের সুযোগ হয়েছে তার মাসি ও দিদিমা - মিস বেটস ও মিসেস বেটসের কাছে আসার। এই সময়ে আমরা দেখি উপন্যাসের প্রথম পর্বের নানা বিড়ম্বিত অভিজ্ঞতার পরও বাস্তবকে কল্পনার রঙ মিশিয়ে পল্লবিত ও ভ্রান্তভাবে দেখার অভ্যাস এমার যায় নি। জেন ফেয়ারফক্সকে ঘিরে সে আবারও নানা স্বকপোলকপিত ভাবনাজালে জড়িয়ে পড়ে। কোনও কারণ ছাড়াই এমা ধরে নেয় মিস জেন ফেয়ারফক্সের সঙ্গে মিস্টার ডিক্সনের কোনও অবৈধ সম্পর্ক আছে। একবার এক দুর্ঘটনার হাত থেকে মিস্টার ডিক্সন মিস জেন ফেয়ারফক্সকে উদ্ধার করেছিলেন, এই তথ্যটুকুকেই আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে পল্লবিত করে এমা এই অদ্ভুত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। সমবয়স্ক সুন্দরী জেনের প্রতি তার একধরনের ঈর্ষার মনোভাবও দেখা দেয়। জেন আসার পর এমা তার সঙ্গে বন্ধু হিসেবেই মিশতে গিয়েছিল। কিন্তু জেনের অন্তর্মুখী চরিত্র বৈশিষ্ট্যর কারণে এবং তার থেকে মিস্টার ডিক্সন সম্পর্কিত নানা ব্যক্তিগত তথ্য জানার জন্য এমার চেষ্টা ফলপ্রসু না হওয়ায় সে জেনের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়।

অন্যদিকে এই সময়ে মিস্টার এলটন ব্রিস্টলের এক ধনী বণিকের কন্যা অগুস্তা হকিন্সকে বিয়ের মধ্যে দিয়ে সম্পদশালী হয়ে ওঠেন। এই বিবাহের ফলে পাওয়া বরপণের মধ্যে দিয়ে তাঁর সম্পত্তিতে যুক্ত হয় আরো দশ হাজার পাউন্ড। সকলে ধরে নেয় নেহাৎ অর্থলোভেই মিস্টার এলটন এই বিয়ে করেছেন। অগুস্তা হকিন্স ধনী ব্যবসায়ীর মেয়ে, উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ডে মিসেস এলটন হিসেবে তাঁর উপস্থিতি মাঝেমধ্যে দেখা যায় হাইবেরির সমাজে। তিনি জেন ফেয়ারফক্সকে গভর্নেসের জীবিকা গ্রহণের উপদেশ দেন।

মিস জেন ফেয়ারফক্স ও ফ্রাঙ্ক চার্চিলের মধ্যে যে সম্পর্ক ও গোপন বোঝাপড়া ছিল তারা নিজেরা যেমন তা অনেক মাস অন্যদের কাছে গোপন রেখেছিল, তেমনি জেন অস্টেন নিজেও তা পাঠককে সরাসরি জানান নি, যদিও কিছু ইঙ্গিৎ দিয়েছেন। ফলে তাদের নিয়ে, তারা কে কার প্রতি আকৃষ্ট বা সম্পর্কে আগ্রহী – তা নিয়ে নানা রহস্য তৈরি হয়। উপন্যাসে ফ্রাঙ্ক ও জেন ফেয়ারফক্স যেভাবে তাদের প্রেম সম্পর্ককে সবার সামনে থেকে লুকিয়ে রাখে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের প্রেম সম্পর্কে সন্দেহ বা ভ্রান্ত ধারণাকে সামনে আনে, সেটা এই উপন্যাসে অনেক সময়ে খানিকটা রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনির আবহ তৈরি করে।

মিস জেন হাইবেরিতে আসার কিছুদিন পরে হাইবেরিতে আসেন ফ্রাঙ্কও। মিস জেনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করলেও স্বাভাবিক সামাজিক সৌজন্যের বাইরে তারা প্রকাশ্যে কোনও ঘনিষ্ঠতা দেখান নি। বরং প্রকাশ্যে এমার সঙ্গেই ফ্রাঙ্ক তাঁর নৈকট্য দেখান। জেন ফেয়ারফক্সের জন্য এইসময় একটি নতুন দামি পিয়ানো এসে পৌঁছয় উপহার হিসেবে। এমা ধরে নেন এটি কর্নেল ক্যাম্বেল পাঠান নি, পাঠিয়েছেন জেন এর গোপন প্রেমিক মিস্টার ডিক্সন। অন্যদিকে একটি বল নাচের অনুষ্ঠানের আগে মিস বেটস ও মিস জেন ফেয়ারফক্সকে আনতে মিস্টার নাইটলি নিজের গাড়ি পাঠানোর ঘটনায় মিসেস ওয়েস্টন এমাকে বলেন মিস্টার নাইটলি হয়ত মিস জেনের প্রতি অনুরক্ত। এমা মিসেস ওয়েস্টনের এই ধারণাকে অসম্ভব বলে বাতিল করে দেয়।

একটি বল নাচের আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়েও তার আগেই ফ্রাঙ্ক মামির অসুস্থতার জন্য হাইবেরি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হলে এমা বিষণ্ন হয়। এমা বুঝতে পারে ফ্রাঙ্ক ওয়েস্টন চার্চিলের দিকে তার মন গিয়েছে। তবে সে নিজেকে বোঝায় চায় ফ্রাঙ্ক এর সঙ্গে মেলামেশা করতে ভালো লাগলেও কোনও গভীর প্রেমে সে আদৌ পড়ে নি। আর যেহেতু সে বিয়ে করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাই একটু আধটু মেলামেশার বাইরে পাকাপাকি কোনও সম্পর্ক ফ্রাঙ্কের সঙ্গে গড়ে তোলার বাসনা তার মনে তৈরি হয় না। বরং সে ভাবতে থাকে হ্যারিয়েট স্মিথের সঙ্গে ফ্রাঙ্কের সম্পর্ক হলে ভালো হয়।

ফ্রাঙ্কের অসুস্থ মামিমা মিসেস চার্চিলের জন্য চার্চিল পরিবার লন্ডনের বাড়িটি ছেড়ে দু মাসের জন্য হাইবেরি থেকে মাত্র ন মাইল দূরে রিচমন্ডে একটা বাড়ি ভাড়া নিলে হাইবেরিতে ফ্রাঙ্কের যাতায়াত বেড়ে যায়। একটি বল নাচের আসরে হাইবেরির সকলে একত্রিত হয়। সেখানে সঙ্গী হয়ে ফ্রাঙ্ক আর এমার নাচ মিস্টার নাইটলি খানিকটা ঈর্ষান্বিত চোখে দেখেন। অন্যদিকে হ্যারিয়েট যখন কোনও নাচের সঙ্গী না পেয়ে বিড়ম্বিত এবং এলটনের আচরণে অসম্মানিত ও বিব্রত, সে সময় মিস্টার নাইটলি হ্যারিয়েটকে তার সঙ্গে নাচার প্রস্তাব দিয়ে তার বিড়ম্বনা কাটান। মিস্টার নাইটলির এই আচরণ এমাকে মুগ্ধ করে। পরদিন একদল জিপসির তাড়া থেকে হ্যারিয়েটকে উদ্ধার করে ফ্রাঙ্ক এবং এই সময়ে তাদের একসঙ্গে দেখে এমার পুরনো ঘটকালির নেশা আবার জেগে ওঠে। এবার সে হ্যারিয়েটের সঙ্গে ফ্রাঙ্কের কল্প সম্পর্ক নিয়ে জল্পনায় রত হয়।

এইসময়ে জানা যায় পূর্বসিদ্ধান্ত বদলে হাইবেরিতে জেন ফেয়ারফক্স আরো বেশ কিছুদিন থাকবেন। মিস্টার জর্জ নাইটলি অনুমান করেন ফ্রাঙ্ক চার্চিল ও মিস ফেয়ারফক্স এর মধ্যে হয়ত কোনও গোপন প্রেম সম্পর্ক আছে। মিস্টার নাইটলির এও মনে হয় ফ্রাঙ্ক হয়ত একইসঙ্গে জেন ফেয়ারফক্স আর এমার মন নিয়ে খেলছে। ফ্রাঙ্কের মামি মিসেস চার্চিলের মৃত্যুর পর ফ্রাঙ্ক জেনের সঙ্গে তার আটমাসের গোপন সম্পর্কের কথা প্রকাশ্যে আনে। মামা মিস্টার চার্চিল সানন্দে এই সম্পর্ক মেনে নেন। বাবা ও সৎ মা ওয়েস্টন দম্পতিও ছেলের এই সম্পর্কের কথা জেনে খুশি হন। তারাই এমাকে ডেকে এই খবরটি জানান। এমা আবারও বুঝতে পারে প্রেম ও ঘটকালি সংক্রান্ত বিষয়ে তার অনুমান ক্ষমতা ও পারদর্শিতা কত দুর্বল।

এমা ভাবে মিস্টার এলটনের পর ফ্রাঙ্ককে কেন্দ্র করে আবার হ্যারিয়েটের মন ভাঙলো। হ্যারিয়েটকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে অবশ্য এমা বোঝে ফ্রাঙ্ক নয়, হ্যারিয়েট আসলে অন্য একজনের প্রেমে পড়েছে। সেই নামটি তখন হ্যারিয়েট বলে নি। পরে এমা জানতে পারে হ্যারিয়েটের সেই মনের মানুষ মিস্টার নাইটলি। একথা জানার পর এমার মনের অন্তঃকরণে তোলপাড় ওঠে।

মিস্টার জর্জ নাইটলি ফ্রাঙ্কের বিবাহ সংবাদ পেয়ে ভাবেন এমা এই খবরে বিমর্ষ হয়েছে। কারণ তিনি ভেবেছিলেন এমা ফ্রাঙ্কের প্রতি অনুরক্ত। তিনি এমার সঙ্গে দেখা করেন। যখন কথা বলে বোঝেন এমা ফ্রাঙ্কের প্রতি অনুরক্ত ছিল না, তখন নাইটলি নিজের গোপন হৃদয়ের কথা এমার কাছে তুলে ধরেন এবং জানান তিনি নিজেই এমার প্রতি অনুরক্ত। নাইটলির এই প্রেম প্রস্তাব এমাকে আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়ে দেয় এবং সে বুঝতে পারে শত বিবাদ বিসম্বাদের অন্তরালে তার মনও নিজের অজান্তে মিস্টার জর্জ নাইটলিতে আসক্ত ছিল।

সমস্ত ভুল বোঝাবুঝির পর্ব পেরিয়ে রবার্ট মার্টিন ও হ্যারিয়েট স্মিথ এর সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয় এবং তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। যার তীব্র তীক্ষ্ণ সমালোচনা এমার আত্মোপলব্ধিতে সাহায্য করল এবং তাকে বদলে দিল, সেই মিস্টার জর্জ নাইটলিকেই এমা বিয়ে করল, সরে আসল কখনো বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত থেকে। এমা – নাইটলি, জেন – ফ্রাঙ্ক, হ্যারিয়েট – মার্টিন এই তিন বিবাহের মধ্যে দিয়ে উপন্যাসের মধুর পরিসমাপ্তি ঘটল।

এমা উপন্যাসের গঠনশৈলি ঔপন্যাসিক জেন অস্টেনের দক্ষতা প্রমাণ করে। এই উপন্যাসের সমস্ত অধ্যায় এবং সমস্ত ঘটনাবলী একটি কেন্দ্রীয় ভাবনার চারপাশে নিখুঁতভাবে বিন্যস্ত। তিন খণ্ডের এই উপন্যাসের প্রথম দু খণ্ডে এমা হ্যারিয়েটের জন্য উপযুক্ত পাত্র সন্ধান করে যায়, শেষ খণ্ডে এসে নিজের মনকে সে বুঝতে পারে এবং পূর্ব সিদ্ধান্ত ভেঙে নিজেকে আবিষ্কার করে মিস্টার নাইটলির অনুরক্তা ও পাত্রী হিসেবে। প্রথম খণ্ডের শেষ অধ্যায়ে মিস্টার এলটন অন্যতম প্রধান চরিত্র থেকে সরে যান পার্শ্ব চরিত্র হিসেবে আর অন্যতম প্রধান চরিত্র হিসেবে আবির্ভাব ঘটে মিস্টার ফ্রাঙ্ক চার্চিলের। দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম দুই অধ্যায়েই গুরুত্ব নিয়ে হাজির হন জেন ফেয়ারফক্স এবং এমা ও মিস্টার জর্জ নাইটলির পাশাপাশি আর এক জোড়া গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র – ফ্রাঙ্ক ও জেনকে আমরা পেয়ে যাই। দ্বিতীয় খণ্ডের শেষে এসে ফ্রাঙ্কের প্রতি এমার রোমান্টিক আকর্ষণের অল্পবিস্তর মোহমায়া কেটে যায় আর সেটা তৃতীয় তথা শেষ খণ্ডে নায়িকা এমার আত্মজগৎ আবিষ্কারের প্রেক্ষাপট তৈরি করে দেয়।

এমা উপন্যাসের সাফল্যের একটি বড় দিক এর নির্মিতি। এই উপন্যাসে যে স্থানগত ও সময়গত ঐক্য দেখা যায়, তা পরিণত ও দক্ষ উপন্যাসকল্পনার ফসল। উপন্যাসের ঘটনাগুলি ঘটেছে লন্ডন থেকে ষোল মাইল দূরবর্তী সারের হাইবেরি অঞ্চলে। চরিত্ররা মাঝেমধ্যে লন্ডনে বা অন্যত্র নানা প্রয়োজনে গেছেন এবং ফিরে এসেছেন। এমার দিদি লন্ডন নিবাসী, তবে উপন্যাসে তার ও তার স্বামী সন্তানদের উপস্থিতি দেখা যায় তারা খ্রিস্টমাস উৎসবে হাইবেরিতে আসার পর। জেন অস্টেন তার চরিত্রদের মাঝেমধ্যে হাইবেরি থেকে এদিক ওদিক পাঠালেও বা বাইরের মানুষজনকে হাইবেরিতে নিয়ে এলেও উপন্যাসের স্থানিক প্রেক্ষাপটকে ছড়ান নি, হাইবেরির চৌহদ্দির মধ্যেই রেখেছেন। উডহাউসদের হার্টফিল্ড, ওয়েস্টনদের রান্ডাল, মিস্টার নাইটলির ডনওয়েল অ্যাবে, মিসেস ও মিস বেটসের বাড়ি, রবার্ট মার্টিনের অ্যাবে মিল ফার্ম – সব এই হাইবেরির মধ্যেই অবস্থিত।

স্থানিক ঐক্যের পাশাপাশি রয়েছে কালগত ঐক্যও। এমা উপন্যাসের ঘটনাবলী সময়কালের দিক থেকে এক বছরের মধ্যেকার ব্যাপার। সেই ঘটনাসমূহকে বছরের নির্দিষ্ট মাস ধরে পরপর সাজিয়ে নেওয়া যায়। জেন অস্টেন গ্রন্থাবলীর বিখ্যাত সম্পাদক আর ডব্লু চ্যাপমানের মতে কোনও এক বছরের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ থেকে উপন্যাসের ঘটনাবলীর শুরু। প্রথম অধ্যায়েই আছে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসের কথা। দশম অধ্যায়ের ঘটনাগুলি সবই ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ের ব্যাপার। পরের বছরের জুলাই মাসের মধ্যেই বিবাহ অনুষ্ঠানগুলির মাধ্যমে উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটে।

উপন্যাসের শুরু এক বিবাহ সম্পর্কের কথা দিয়ে। সেই বিবাহ এক প্রৌঢ় বিপত্নীকের সঙ্গে এক মধ্য বয়স্কার। উপন্যাসের শেষ দু জোড়া নিতান্ত তরুণ তরুণী – ফ্রাঙ্ক জেন ও মার্টিন হ্যারিয়েট এবং একুশ বছরের নায়িকা এমা ও আটত্রিশ বছরের নায়ক মিস্টার জর্জ নাইটলির বিবাহের মধ্যে দিয়ে। উপন্যাসের মাঝপর্বে এসেছে আরো এক বিবাহের কথা। সেই বিবাহ মিস্টার এলটনের। এই মিস্টার এলটন এমা উপন্যাসের সবচেয়ে নেতিবাচক চরিত্র। এমার দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হবার মুহূর্তে যেভাবে তিনি হ্যারিয়েট স্মিথের জন্ম ও সামাজিক অবস্থানের কথা তুলে তাকে ব্যঙ্গ করেন, সেটাই তার চরিত্রের অন্ধকার দিকটিকে দেখিয়ে দেয়। এর সঙ্গে মিলে যায় এমার দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হবার পরেই বাথে গিয়ে এক বণিককন্যার সঙ্গে নতুন সম্পর্কে জড়ানো এবং দশ হাজার টাকা বরপণের বিনিময়ে তাকে বিবাহ করা। এরপরেও এক বল নাচের আসরে সে যে ভাষা ও ভঙ্গীতে হ্যারিয়েটের সঙ্গে নাচের সঙ্গী হবার প্রস্তাবটিকে অগ্রাহ্য করে, তা বুঝিয়ে দেয় বিন্দুমাত্র সৌজন্য বা ভদ্রতাবোধ তার নেই, চারিত্রিক উদারতা তো অনেক দূরের ব্যাপার।

জেন ফেয়ারফক্স আর ফ্রাঙ্ক খুবই আকর্ষণীয় দুই চরিত্র। তারা যেভাবে বাস্তব কারণে তাদের সম্পর্ককে গোপন রেখেছে, নিজেদের প্রেম সম্পর্ক বিষয়ে হাইবেরির সমাজে ইচ্ছাকৃত নানা বিভ্রান্তি ও ধোঁয়াশা ছড়িয়েছে, তা তাদের বুদ্ধিমত্তাকে প্রকাশ করে। ফ্রাঙ্ক একইসঙ্গে বিত্তশালী ও সামাজিক মর্যাদার অধিকারী হলেও সাধারণ সমাজ থেকে আসা ও বিত্তহীন অনাথ মেয়ে জেন ফেয়ারফক্সকে যে ঐকান্তিকতার সঙ্গে ভালোবেসেছে ও বিয়ে করেছে তা তার চরিত্রকে উজ্জ্বল করে তোলে। এমার কল্পবিলাসের উল্টোদিকে যদি জেন অস্টেন এই উপন্যাসে মিস্টার নাইটলির যুক্তিবাদকে স্থাপণ করে থাকেন, তাহলে মিস্টার এলটনের নিচতা ও লোভের বিপ্রতীপে উজ্জ্বল করে তুলেছেন ফ্রাঙ্কের দৃষ্টান্তটিকে। এমার সমবয়সী জেন এবং সামান্য বড় ফ্রাঙ্ক যে পরিণতিবোধ ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়, তা নায়িকা এমার আচার আচরণ যে অনেকটাই শিশুসুলভ ও অপরিণত, তা পাঠকের সামনে আরো স্পষ্ট করে দেয়।

হ্যারিয়েট স্মিথ এই উপন্যাসের এমন এক অন্তর্মুখী চরিত্র যে বারবার অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে এবং পরিশেষে যন্ত্রণা পেয়েছে। প্রথমে সে ভালোবাসল রবার্ট মার্টিনকে, কিন্তু এমার পরামর্শে মার্টিনের বিবাহ প্রস্তাব অগ্রাহ্য করতে হল তাকে। এমার প্রণোদনায় তার মন ঝুঁকল মিস্টার এলটনের দিকে। মিস্টার এলটন তাকে শুধু প্রত্যাখ্যানই করে নি, তার জন্ম পরিচয় ও সামাজিক আর্থিক পরিস্থিতির কথা তুলে অপমানও করেছে। এরপর এমা হালকাভাবে হলেও তাকে ঠেলতে চেয়েছে ফ্রাঙ্ক চার্চিলের দিকে। সে অবশ্য ফ্রাঙ্কের প্রেমে পড়ে নি। পড়েছে মিস্টার নাইটলির প্রেমে। তার এই প্রেমটিও পরিণতি পেল না, দেখা গেল নাইটলি ও এমা পরস্পরের প্রতি অনুরক্ত। বারবার প্রেমের ব্যর্থতা হ্যারিয়েট স্মিথকে দুমড়ে দিতে পারত। কিন্তু দেখা গেল সে প্রেমের ব্যর্থতায় আহত হলেও তাকে মেনে নিতে পারছে। মিস্টার মার্টিনের সঙ্গে তার সম্পর্কের পুনঃস্থাপণ ও বিবাহ হ্যারিয়েটের ইতিবাচক পুনর্বাসন বলে ধরে নিতে হবে।

জেন অস্টেনের উপন্যাস জগৎ মূলত ল্যান্ডেড জেন্ট্রি ক্লাস বা জমিদার শ্রেণির চরিত্রপাত্রদের নিয়েই তৈরি। মিস্টার উডহাউস সেই শ্রেণির মানুষ। জমিদারি আয় থেকে তার দিন চলে, আলাদা করে কোনও পেশায় তিনি যুক্ত নন। তবে এই উপন্যাসে নানা পেশার মানুষকে আমরা পেয়েছি। মিস্টার নাইটলি জমিদার এবং পেশাগতভাবে ম্যাজিস্ট্রেট। তার ভাই জন নাইটলি উকিল। মিস্টার পেরি চিকিৎসক। মিস্টার এলটন যাজক। মিস টেলর আগে ছিলেন গভর্নেস, জেন ফেয়ারফক্সও সেই পেশা বেছে নিতে যাচ্ছিলেন। মিসেস গোদার স্কুলের শিক্ষিকা। প্রথম খণ্ডে কৃষক সমাজের মানুষ রবার্ট মার্টিনকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় পেয়েছি। দ্বিতীয় খণ্ডে পার্শ্ব চরিত্র হিসেবে পাই বণিক পরিবারের কন্যা অগুস্তা হকিন্স তথা মিসেস এলটনকে। উপন্যাসের একদম শেষে এসে জানা যায় হ্যারিয়েট স্মিথ এর পিতৃপরিচয়, সেও আসলে এক ব্যবসায়ীর কন্যা। তবে উপন্যাসজুড়ে তার পারিবারিক পরিচয় কুয়াশাচ্ছন্নই থেকেছে। মিস বেটস বা মিসেস বেটসের জীবিকা সম্পর্কে কোনও তথ্য নেই, তবে তারা যে নিম্নবিত্ত তা বোঝা যায়। উপন্যাসে গৌন চরিত্র হিসেবে পাই কোল পরিবারের কথা, তারা ব্যবসার মাধ্যমে নব্য ধনী হয়ে উঠেছে ও সমাজে মর্যাদা পেয়েছে।

জেন অস্টেনের ‘এমা’ উপন্যাসটি সেই সময়ে লেখা, যখন ওয়ার্ডসওয়র্থ, কোলরিজ, স্কট, বায়রন প্রমুখ রোমান্টিক কবিদের কাব্যগ্রন্থগুলি একের পর এক প্রকাশিত হচ্ছে। সেই রোমান্টিক যুগে দাঁড়িয়ে জেন অস্টেন এই উপন্যাসে রোমান্টিক কল্পময়তার বিপরীতে জোর দিলেন বাস্তব যুক্তিবোধের ওপর। নায়িকা এমা চরিত্রের যে দিকটি সবচেয়ে সমালোচনাযোগ্য হয়ে দেখা দিল সেটা হল যে কোনও ঘটনা, ব্যক্তি বা সম্পর্ককে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে কল্পনার দৃষ্টিতে দেখা। এইরকম স্বকপোলকল্পিত অলীক দৃষ্টিকোণ থেকে কত ধরনের সমস্যা জন্ম নেয়, বিভিন্ন মানুষজনের জীবন কীভাবে বিপর্যস্ত হয় – এই উপন্যাস তা তুলে ধরে। নায়িকা এমার নামে নাম রাখলেও এমার এই রোমান্টিক কল্পবিহারী দৃষ্টিকোণটিকে জেন অস্টেন আগাগোড়া সমালোচনা করেন। উপন্যাসকথকের দৃষ্টিকোণ হিসেবে সামনে আসে মিস্টার নাইটলির যুক্তিবাদী মনন ও আচার আচরণ। এমা চরিত্রটিকে অলীক কল্পনা প্রবণতার জায়গা থেকেই শুধু সমালোচনা করা হয় না, জেন ফেয়ারফক্সের প্রতি তার ঈর্ষা, মিস বেটসের প্রতি তার অকারণ রূঢ় ভাষণও সমালোচনাযোগ্য বলে প্রতিভাত হয়। অন্যদিকে মিস্টার নাইটলির যুক্তিবাদী মননের পাশাপাশি প্রশংসিত হয় তার উদারচিত্ত মনোভাব। হ্যারিয়েট যখন বল নাচের আসনে কোনও সঙ্গী পাচ্ছে না এবং মিস্টার এলটনের রূঢ় আচরণে ব্যথিত, তখন মিস্টার নাইটলি শ্রেণি ও সামাজিক মর্যাদার ব্যবধান ভুলে তাকে নাচের সঙ্গী করেন। মিস বেটস এমার রূঢ় কথায় আহত হলে এমাকে তিনি ভৎসনা করে ভুল ধরিয়ে দেন। মিস্টার নাইটলির মধ্যে রসবোধ, ভদ্রতা ও যুক্তিবোধ মিলেমিশে গিয়ে তাঁকে এক আদর্শ চরিত্র করে তোলে। প্রেমিকের চাপা ঈর্ষাও তার মধ্যে পরিস্থিতি বিশেষে জাগ্রত হয়, তবে তিনি তাকে মনের মধ্যে চেপে রাখতে সমর্থ হন, কোনও সামাজিক অভদ্রতার জায়গায় ব্যক্তিগত ক্ষতকে নিয়ে যান না। মিস্টার নাইটলি অন্যের চরিত্র ও ঘটনাধারারও এক নিপুণ বিশ্লেষক। তিনিই প্রথম বুঝতে পারেন যে ফ্রাঙ্ক ও জেন ফেয়ারফক্সের মধ্যে কোনও গোপন বোঝাপড়া রয়েছে। মিস্টার এলটনের চরিত্র ও সিদ্ধান্তবলীর গতিপ্রকৃতি বুঝতেও প্রথমাধি তার কোনও ভুলচুক হয় নি। এমা যে সব বিষয়ে বারবার ভুল করেছে, সেই সব বিষয়ের প্রায় প্রতিটিতেই মিস্টার নাইটলির ধারনা শেষমেষ সঠিক প্রতিপন্ন হয়েছে। উপন্যাসের শেষে বাস্তববাদী মিস্টার জর্জ নাইটলির কাছে কল্পনার আতিশয্যে অবগাহী রোমান্টিক এমার সমর্পণ জেন অস্টেনের জীবন দৃষ্টির বার্তাবাহী।