জেন অস্টেনের ম্যান্সফিল্ড পার্ক প্রসঙ্গে

১৮১১ তে জেন অস্টেনের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’ এবং ১৮১৩ তে প্রকাশিত দ্বিতীয় উপন্যাস ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এর প্রথম খসড়া লেখা হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই, যদিও তা সে সময় মুদ্রণ সৌভাগ্য লাভ করে নি। ১৮০৯ সালে চাওটনে দাদার বাড়িতে এসে মা দিদির সঙ্গে থিতু হয়ে বসবাস শুরু করার পর তিনি আবার এগুলির পরির্মাজন করলেন, প্রেস কপি নতুন করে তৈরি করলেন ও তা প্রকাশকের হাতে তুলে দিলেন। এই দুটি উপন্যাস, বিশেষ করে প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস এর বিপুল সাফল্যের পর প্রকাশিত হয় ‘ম্যানসফিল্ড পার্ক’। ১৮১১ র ফেব্রুয়ারি নাগাদ এটা লেখা শুরু হয় এবং লেখা শেষ হয় সম্ভবত ১৮১৩ সালের জুন মাসে। তবে অস্টেন গবেষক Deirdre Le Faye মনে করেছেন ১৮১১ সালে লেখা শুরু করলেও প্রথম কয়েকমাসে প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিসের পরিমার্জনের কাজেই অস্টেন বেশি সময় দিয়েছিলেন, ১৮১২ র মার্চ এপ্রিল থেকেই জোরকদমে ‘ম্যান্সফিল্ড পার্ক’ এর কাজ এগোতে থাকে। উপন্যাসটি শুধু যে দীর্ঘদিন ধরে লেখা হয়েছিল তাই নয়, লেখা শেষ হওয়া আর প্রকাশকের কাছে পাঠানোর মধ্যেও ছিল কয়েক মাসের এক দীর্ঘ বিরতি। ১৮১৩ র শেষ বা ১৮১৪ র শুরুর দিকে তা পাঠানো হয় প্রকাশক ইগার্টনের কাছে। এই ইগার্টনই জেন অস্টেনের আগের দুটি উপন্যাস ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’ এবং ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এর প্রকাশক ছিলেন। প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস এর কপিরাইট এককালীন অর্থের বিনিময়ে প্রকাশকের হাতে তুলে দিয়েছিলেন জেন অস্টেন, যে সিদ্ধান্তের জন্য পরে বারেবারে তিনি অনুতাপ করেছিলেন। কিন্তু ‘ম্যান্সফিল্ড পার্ক’ এর ক্ষেত্রে এই পথে তিনি আর এগোন নি। ঠিক হয় ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’র মতো এটিও ছাপা হবে কমিশন প্রথায়। সম্পাদনার দিকটি দেখবেন জেন অস্টেন ও তার দাদা হেনরি। তারাই বইটির প্রুফ দেখবেন ও প্রয়োজনীয় অদল বদল করবেন। প্রকাশক ইগার্টন উপযুক্ত দামে কাগজ কেনা, ছাপাখানা ঠিক করা, মুদ্রণ ও বই বিপণনের দিকটি দেখবেন ও বই বিক্রির আয়ের থেকে এজন্য দশ শতাংশ পাবেন। কপিরাইট থাকবে জেন অস্টেনের কাছেই। তখনকার দিনে একটি বইয়ের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন মুদ্রককে দিয়ে ছাপানো ছিল এক প্রচলিত প্রথা। প্রকাশক ইগার্টন বই এর প্রথম ও তৃতীয় খণ্ড ছাপতে দেন জি সিডনি নামক এক মুদ্রককে আর দ্বিতীয় খণ্ডটি যায় চার্লস রোওয়র্থ নামের এক মুদ্রকের কাছে। গ্রন্থ নির্মাণের গোটা পর্বটি দেখভালের জন্য দাদা হেনরির সঙ্গে জেন অস্টেন নিজে অনেকবার চাওটন থেকে লন্ডনে আসেন। গ্রন্থ নির্মাণ শেষ হবার পর দ্য স্টার নামক পত্রিকায় এর প্রকাশ সম্পর্কিত বিজ্ঞাপন বেরোয় ১৮১৪ সালের ৯ মে। ‘ম্যান্সফিল্ড পার্ক’ এর প্রথম সংস্করণ ছাপা হয়েছিল ১২৫০ কপি। অনুমান করা হয় ইগার্টনকে দেওয়া কমিশন বাদ দিয়ে জেন অস্টেনের এই উপন্যাস থেকে আয় হয়েছিল প্রায় ৩৫০ পাউন্ড। ১৮১৪ সালের ১৮ নভেম্বর, উপন্যাসটি প্রকাশের ছ মাসের মাথায় ভাইঝি ফ্যানিকে লেখা একটা চিঠিতে জেন অস্টেন জানান যে ‘ম্যান্সফিল্ড পার্ক’ উপন্যাসের প্রথম সংস্করণের সমস্ত কপি বিক্রি হয়ে গেছে এবং এর দ্বিতীয় সংস্করণের প্রস্তুতি শুরু হচ্ছে।

দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের সময় ‘ম্যান্সফিল্ড পার্ক’ এর প্রকাশক বদলে যায়। ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’, ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এবং ‘ম্যান্সফিল্ড পার্ক’ এর প্রথম সংস্করণ – তিনটিরই প্রকাশক ইগার্টনের সঙ্গে ঠিক কোন প্রশ্নে অস্টেনের বোঝাপড়া ভেঙে গিয়েছিল তার সঠিক খবরাখবর পাওয়া যায় না। জেন অস্টেনের চতুর্থ উপন্যাস ‘এমা’ প্রকাশের সময় থেকে অস্টেনের নতুন প্রকাশক হলেন জন মারে। সে সময় মারে ছিলেন লন্ডনের সবচেয়ে নামকরা প্রকাশকদের অন্যতম। বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে এই ব্যবসা তিনি পেয়েছিলেন। একদিকে তিনি ছিলেন বায়রন, ওয়াল্টার স্কট এর মতো সেকালের আলোড়ন তোলা লেখকদের বই এর প্রকাশক, অন্যদিকে তার সংস্থাই ছাপত অতি বিখ্যাত ‘কোয়াটার্লি রিভিউ’ নামক সাময়িক পত্রিকাটি। মারের লন্ডনের বিরাট বাড়িটি সে সময়ে লন্ডনের সাহিত্য আড্ডার অন্যতম কেন্দ্র উঠেছিল। মারের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ‘কোয়াটার্লি রিভিউ’ এর সম্পাদক উইলিয়াম গিফোর্ড। রাজপরিবার ও পার্লামেন্টের অভ্যন্তরেও মারের পরিচিতি ছিল। মারে অস্টেনের ম্যান্সফিল্ড পার্ক এর দ্বিতীয় সংস্করণ আর পরবর্তী উপন্যাস ‘এমা’র প্রথম সংস্করণ ছাপেন কাছাকাছি সময়ে। ‘এমা’র প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৮১৫ সালের ডিসেম্বরে আর ‘ম্যান্সফিল্ড পার্ক’ এর দ্বিতীয় সংস্করণ বেরোয় ১৮১৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। ‘ম্যান্সফিল্ড পার্ক’ এর দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপা হয়েছিল ৭৫০ কপি। প্রথম সংস্করণের চেয়ে এখানে বেশি মোটা ও ভালো কাগজ ব্যবহার করা হয়েছিল। প্রথম সংস্করণের পাতা পিছু পঁচিশ লাইনের বদলে দ্বিতীয় সংস্করণে পাতা পিছু তেইশ লাইন করে ছাপা হওয়ায় মুদ্রণ সৌন্দর্য বেড়েছিল। তবে ‘ম্যান্সফিল্ড পার্ক’ এর দ্বিতীয় সংস্করণ ব্যবসায়িক সাফল্য পায় নি। উপন্যাসের দ্বিতীয় সংস্করণ সাধারণভাবে প্রকাশ করা হত না, কারণ উপন্যাস লোকে সে সময় কিনে পড়ার বদলে লাইব্রেরি বা বুক ক্লাব থেকে নিয়ে পড়তেই পছন্দ করত আর সে সব জায়গায় উপন্যাসের প্রথম সংস্করণ আগেই চলে যেত। পিঠোপিঠি প্রকাশিত এমার প্রথম সংস্করণ ভালো বিক্রি হওয়ায় মোটের ওপর জেন অস্টেনের আর্থিক ক্ষতি হয় নি, ‘ম্যান্সফিল্ড পার্ক’ এর দ্বিতীয় সংস্করণের খরচের টাকা এমার বিক্রি পুষিয়ে দিতে পেরেছিল। চিঠিপত্রে অস্টেন ‘এমা’র প্রথম সংস্করণ বাবদ লাভের যে সামান্য অঙ্কের কথা বলেছেন, তা আসলে ম্যান্সফিল্ড পার্ক এর দ্বিতীয় সংস্করণের ক্ষতি মিটিয়ে হাতে থাকা উদ্বৃত্তের হিসাব।

ফ্যানি প্রাইস ‘ম্যান্সফিল্ড পার্ক’ উপন্যাসের নায়িকা। ‘ম্যান্সফিল্ড পার্ক’ এর এর আগে অস্টেনের যে দুটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল সেই ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’ ও ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এ রয়েছে কয়েক মাসের ঘটনাক্রম। অন্যদিকে ‘ম্যান্সফিল্ড পার্কে’ আছে দীর্ঘ দশ বছরের কাহিনি। উপন্যাসের শুরুতে এর নায়িকা ফ্যানি প্রাইসের বয়েস আট বছর। যখন উপন্যাস শেষ হচ্ছে তখন ফ্যানির বয়েস আঠারো।

এই উপন্যাসের শুরুতে আমরা দেখি দশ বছরের বালিকা ফ্যানি প্রাইস তার বাবা মা ভাই বোনদের ছেড়ে চলে আসছে তার মেজো মাসি মিসেস বার্টামের কাছে। বিয়ের আগে মিসেস বার্টাম ছিলেন মিস মারিয়া ওয়ার্ড, এক সাধারণ পরিবারের সুন্দরী মেয়ে। বছর তিরিশেক আগে তার কপাল খুলে যায় এক শাঁসালো পাত্রকে বর হিসেবে পেয়ে। মাত্র সাত হাজার পাউন্ডের অধিকারিণী হয়েও মিস মারিয়া ওয়ার্ড নর্দাম্পটন কাউন্টির স্যর থমাস বার্ট্রামকে পাকড়াও করে ফেললেন। বিয়ের পর স্যর থমাস বার্ট্রামের স্ত্রী হিসেবে তিনি যে শুধু ব্যারোনেট লেডির পদে উন্নীত হলেন তাই নয়, আগের সাধারণ জীবন ছেড়ে ‘ম্যান্সফিল্ড পার্ক’ নামের এক বিশাল বাড়ি আর অতুল সম্পদের আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্যর মধ্যে প্রবেশ করলেন। মারিয়ার দুই বোন -মিস ওয়ার্ড আর মিস ফ্রান্সেস মারিয়ার সমান রূপসী ছিলেন। পরিবার পরিজনেরা আশা করেন মারিয়ার মতন সৌভাগ্য তাঁর বাকি দুই বোনেরও হবে। অবশ্য অস্টেন টিপ্পনী কেটে জানান যে ‘মুশকিল এটাই দুনিয়ায় যত রূপসী মেয়ে আছে, তত বেশি ধনী পুরুষ নেই’। বাস্তবেও আমরা দেখি মারিয়ার বাকি বোনেরা এরকম সৌভাগ্যবতী হলেন না। বছর ছয়েক পর মিস ওয়ার্ডকে চার্চের পাদরি রেভরেন্ড মিস্টার নরিসের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে খুশি থাকতে হলো। এক মেরিন লেফটেন্যান্টকে ভালোবেসে বিয়ে করে মিস ফ্রান্সেস থেকে মিসেস প্রাইস হলেন এই উপন্যাসের নায়িকা ফ্যানির মা। রাইস দম্পতির এমনিতেই অসচ্ছল সংসার দারিদ্রের জালে আরো আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ল প্রায় প্রতি বছর একটি করে নতুন সন্তান আসতে থাকায়। অনেকগুলি সন্তান সন্ততি হওয়ার পর পরিবারের ভার বহন প্রাইস দম্পতির পক্ষে একপ্রকার অসম্ভব হয়ে গেল। বহু বছর নানা অভিমানে দিদিদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলেও অবশেষে মিসেস সাহায্য চেয়ে তাঁদের চিঠি লিখতে বাধ্য হলেন। বোনের সংসার খরচের ভার কিছুটা লাঘব করে তাকে সাহায্য করার জন্য মিসেস প্রাইসের দিদিরা ডেকে নিলেন তাঁদের বোনঝি দশ বছরের ফ্যানি প্রাইসকে। প্রিয় দাদা উইলিয়াম, অন্য ভাইবোন ও মা বাবাকে ছেড়ে অনেক দূরের পথ পেরিয়ে বার্ট্রাম পরিবারের প্রাসাদোপম বাসগৃহে ফ্যানি প্রবেশ করল।

মাসি মেসোর ম্যান্সফিল্ড পার্ক নামের বিরাট বাড়িতে বৈভব আর স্বাচ্ছন্দ্যর স্বাদ পেলেও একটা চাপা ভয় সব সময়েই ফ্যানির মধ্যে কাজ করত। অনুগৃহীতা হবার স্বাভাবিক সংকোচ তার ছিলই। এটা আরো বেড়ে যেত তার থেকে যথাক্রমে দুই ও তিন বছরের বড় দুই মাসতুতো দিদি – জুলিয়া ও মারিয়ার নানা তুচ্ছতাচ্ছিল্যভরা মন্তব্যে। সে যে তেমন কিছু না জেনেই সম্ভ্রান্ত জগতে চলে এসেছে, দিদিরা এটা সুযোগ পেলেই তাকে বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করত। সেকালে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েরা প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যায়তনে সেভাবে না গেলেও গৃহশিক্ষিকার কাছ থেকে নানা বিষয় শিখত। মারিয়া, জুলিয়াও তাই শিখেছিল। কিন্তু গৃহশিক্ষিকা না থাকায়, কখনো প্রথাগতভাবে পড়াশুনোর অবকাশ না মেলায় ফ্যানি সে সুযোগ পায় নি। ফ্যানির এই খামতিই ছিল দুই দিদির নিয়মিত টিপ্পনির বিষয়। - “কিন্তু মাসি, ও সত্যিই কিচ্ছু জানে না! – তুমি জানো, কাল রাতে আমরা ওকে জিজ্ঞাসা করলাম যে কোন রাস্তা ধরে আয়ারল্যান্ডে যাওয়া যায়, ও বলে কী না, আইল অফ ভাইট পেরিয়ে যেতে হবে। আইল অফ ভাইট ছাড়া আর কিছুই ও ভাবে না। ওর মতে আইল অফ ভাইটই একমাত্র দ্বীপ, যেন দুনিয়ায় আর কোনও দ্বীপ নেই। আমার তো মনে হয় ওর বয়সে আমি যদি এসব না জানতাম তাহলে আমার খুবই লজ্জা লাগত। আমরা ছোটবেলাতেই যেসব জানতাম, সেসব জিনিসের ব্যাপারে ফ্যানি এখনও একদম কিচ্ছু জানে না। তুমিই বলো মাসি সেসব কত দিন আগের কথা, যখন পরপর ইংল্যান্ডের রাজাদের নাম, তাঁদের শাসনকাল, কবে তাঁরা সিংহাসনে  বসেছেন, তাঁদের শাসনকালে কী কী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে সব কিছু কেমন বারে বারে মুখস্ত বলতাম আমরা!”

আরেক বোন আরও জুড়ে দেয়, “হ্যাঁ, সম্রাট সেভেরাস পর্যন্ত আমরা রোমের সম্রাটদের নাম আর তাঁদের শাসন সম্পর্কেও মুখস্ত বলতে পারতাম। এছাড়াও বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি, সমস্ত ধাতু, আধা ধাতু, গ্রহ ও বিখ্যাত দার্শনিকদের ব্যাপারও আমাদের মুখস্ত ছিল।”

ভাই বোনেদের যদিও শেখানো হত মাসতুতো বোনকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করে তার সঙ্গে নম্র ভদ্র ব্যবহার করতে, বাস্তবে আমরা দেখি এই উপদেশ মারিয়া, জুলিয়া দুই দিদির কেউই সেভাবে মানত না। তবে মেজদা এডমন্ড ছিল ব্যতিক্রম। কেবল বড়দের উপদেশ মেনেই যে এডমন্ড ফ্যানির সঙ্গে ভালো ব্যবহার করত তা নয়। তার মধ্যে ছিল এক ধরনের স্বাভাবিক সহৃদয়তা। এই সহৃদয়তাই তাকে অন্য ভাই বোনেদের চেয়ে আলাদা করে এবং ফ্যানির পাশে স্নেহশীলভাবে দাঁড় করায়। এডমন্ডের স্নেহ প্রীতির সূত্র ধরেই ফ্যানি ধীরে ধীরে ম্যান্সফিল্ড পার্কে নিজের স্বাচ্ছন্দ্যটি খুঁজে পায়। উপন্যাসের দ্বিতীয় অধ্যায়ে এই নৈকট্যর ছবিটি বিস্তারে বর্ণনা করেছেন জেন অস্টেন। ফ্যানি এডমন্ডের পরবর্তী পর্বের সম্পর্কের রসায়ন বুঝতে উপন্যাসের এই অংশটির দিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া দরকার। -

‘একদিন সকালে বাড়ির ছোট ছেলে এডমন্ড দেখে ও চিলেকোঠার সিঁড়িতে বসে কাঁদছে।

তাই দেখে এডমন্ড ওর পাশে বসল। অনেক চেষ্টা করল যাতে ও যে ফ্যানিকে এভাবে কাঁদতে দেখে ফেলেছে সেই লজ্জা কাটিয়ে ফ্যানি ওর সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলে। এডমন্ড খুব মিষ্টি করে জিজ্ঞাসা করল, “এ কী! কী হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ লাগছে? কেউ রাগারাগি করেছে তোমার সঙ্গে? নাকি মারিয়া বা জুলিয়া কারোর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে? কিম্বা পড়াশোনার কোনও কিছু বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে? সেরকম কিছু হলে আমাকে বলো, আমি নিজে তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। তোমার কিছু লাগলে বলো, দেখি আমি যদি যোগাড় করে দিতে পারি।” “না, না – কিচ্ছু লাগবে না – কিচ্ছু হয় নি আমার, অনেক ধন্যবাদ তোমাকে” – অনেকক্ষণ পর্যন্ত এর থেকে বেশি আর কোনও উত্তর পাওয়া গেল না ফ্যানির কাছ থেকে। এডমন্ড কিন্তু তাও ধৈর্য ধরে চেষ্টা চালিয়ে গেল। ও যখনই ফ্যানির বাড়ির কথা তোলে তখনই ফ্যানির কান্নার বেগ বেড়ে যায় দেখে শেষ পর্যন্ত এডমন্ড বুঝল ফ্যানির মন খারাপের আসল কারণ কী। তাই বুঝে ও ফ্যানিকে সান্ত্বনা দেওয়ার অনেক চেষ্টা করল।

“মায়ের জন্য মন খারাপ করছে তাই না ফ্যানি? তুমি খুবই লক্ষ্মী একটা মেয়ে। আর দেখো, তুমি তো এখন তোমার আত্মীয়স্বজনদের কাছেই আছ। সবাই তোমাকে ভালোবাসে আর তোমাকে খুশি রাখতে চায়। চলো, আমরা বরং একটু পার্ক থেকে হেঁটে আসি। সেখানে তুমি তোমার ভাইবোনদের কথা বলবে আমাকে, ঠিক আছে?”

এডমন্ড এই নিয়ে আরও কিছুটা কথা বলে বুঝল যদিও সব ভাইবোনের জন্যই ফ্যানির মন খারাপ করছে, তবে যার কথা সবথেকে বেশি ওর মনে পড়ছে সে হলো দাদা উইলিয়াম। ফ্যানি উইলিয়ামের কথাই বেশি বলল আর ওর জন্যই যে মনটা সবথেকে বেশি ছটফট করছে সে কথাও বলল। ভাইবোনদের মধ্যে সবথেকে বড় উইলিয়াম ফ্যানির থেকে মাত্র এক বছরের বড়। ওর সব সময়ের সঙ্গী আর বন্ধু। যেহেতু মা সব থেকে বেশি উইলিয়ামকেই ভালোবাসে, তাই যে কোনও ঝামেলায় উইলিয়ামই ফ্যানির হয়ে মাকে বোঝায়। “উইলিয়াম বলছিল, তুই চলে যাবি, আমার একটুও ভালো লাগছে না রে, আমার বড্ড মন খারাপ করবে তোর জন্য।“ “উইলিয়াম তোমাকে চিঠি লিখবে নিশ্চয়ই?” “হ্যাঁ, ও কথা দিয়েছে, কিন্তু আমাকেই আগে চিঠি লিখতে বলেছে।” “তাহলে কবে লিখবে তুমি চিঠি?” এবার মাথাটা নিচু করে ফ্যানি একটু দ্বিধার সুরে উত্তর দিল, “আমি জানি না, আমার কাছে তো কোন কাগজই নেই।”

“শুধু এটাই যদি তোমার সমস্যা হয় তাহলে শোন, আমি তোমাকে কাগজ আর তার সঙ্গে যা যা লাগে সব যোগাড় করে দেব। তাহলেই তো তুমি যখন ইচ্ছে চিঠি লিখতে পারবে। উইলিয়ামকে চিঠি লিখতে পারলে তুমি খুশি হবে তো?”

“হ্যাঁ, খুউব খুশি হব।”

“বেশ, তাহলে আর কী! এই কাজটা তো এক্ষুনি করে ফেলা যায়। চলো, আমার সঙ্গে সকালের জলখাবার খাওয়ার ঘরে চলো, ওখানে তোমার যা কিছু লাগবে সব পেয়ে যাব। আমরা নিজেদের মতন সময় নিয়ে গুছিয়ে করতে পারব কাজটা।”

“কিন্তু চিঠিটা পোষ্ট অফিসে পৌঁছবে কি?”

“আরে, একদম চিন্তা কোরো না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, সে ব্যবস্থা আমি করে দেব। অন্য সব চিঠির সঙ্গেই এই চিঠিও পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আর তোমার মেসোমশাই চিঠিটা ফ্র্যাঙ্ক করে এমন করে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন যে কোনও স্ট্যাম্প লাগবে না, আবার উইলিয়ামকেও এই চিঠির জন্য এক পয়সা খরচ করতে হবে না।”

“মেসোমশাই!” ভীত গলায় বলে উঠল ফ্যানি।

“হ্যাঁ, তোমার চিঠি লেখা হলে আমি আমার বাবার কাছে নিয়ে যাব চিঠিটা, ফ্র্যাঙ্ক করে পাঠানোর জন্য।”

আমরা দেখি এডমন্ড শুধু মৌখিক প্রতিশ্রুতি দেয় নি, বাস্তবেও কাজগুলো দায়িত্ব নিয়ে করেছে। এডমন্ড ফ্যানির চিঠি লেখার কাগজের ব্যবস্থা করে ওই কাগজে লাইনও টেনে দেয়। কাজটা এত পরিপাটি করে সে করে যে ফ্যানি ভাবে তার দাদা উইলিয়ামও বুঝতে পারবে যে কাজটা কতটা যত্ন করে করা হয়েছে। ফ্যানি যতক্ষণ চিঠি লেখে, এডমন্ড ততক্ষণ ওর সঙ্গে থেকে ওকে নানাভাবে সাহায্য করে – পেন কেটে সরু করার ছুরি এগিয়ে দিয়ে, বানান ঠিক করে দিয়ে, যখন যেমন দরকার। ফ্যানির মনে হয় এডমন্ড এসব করছে ওর ভাই উইলিয়ামের প্রতি মমতা থেকে। আর সেটাই ফ্যানিকে সবথেকে বেশি আনন্দ দেয়, কারণ বাড়ির মধ্যে দাদা উইলিয়ামের প্রতিই ছিল তার সবচেয়ে বেশি টান। এডমন্ড নিজের হাতে উইলিয়ামের প্রতি ওর ভালোবাসা জানিয়ে দু পংক্তি লিখে একটা অর্ধ গিনিও চিঠির খামের মধ্যে গুঁজে দিয়েছে দেখে ফ্যানি খুবই আপ্লুত হয়।

এডমন্ডের সঙ্গে নৈকট্য তৈরি হবার পর থেকে ফ্যানি ম্যান্সফিল্ড পার্কে কিছুটা স্বচ্ছন্দ বোধ করতে শুরু করে। ওর মনে ভরসা জাগে যে এখানেও ওর একজন বন্ধু আছে। এডমন্ড যখন পড়াশুনোর জন্য ম্যান্সফিল্ড পার্ক ছেড়ে অক্সফোর্ডে থাকত তখন ফ্যানি একাকিত্বে ভুগত। এডমন্ড ফিরলে ফিরে আসত তার আনন্দ। অনেক পরে ফ্যানি বোঝে এডমন্ডকে সে শুধু ভাই হিসেবে ভালোবাসছে না, এই ভালোবাসার মধ্যে মিশে গেছে অন্য রসায়ন। এটা বোঝার জন্য তাকে অবশ্য সেই দিনগুলির মুখোমুখি হতে হয়েছে, যেখানে এক অন্য নারী, মিস মেরি ক্রফোর্ড, এডমন্ডের জীবন রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করেছে।

পূর্বতন যাজক মিস্টার নরিসের মৃত্যুর পর ম্যান্সফিল্ড পার্ক সংশ্লিষ্ট চার্চটির নতুন পাদ্রি হয়ে এসেছিলেন মিস্টার গ্রান্ট। মিস্টার নরিসের মৃত্যুর পর নিঃসন্তান গ্রান্ট দম্পতি পাদ্রি হাউসে আসেন ও প্রতিবেশি বার্ট্রামদের সঙ্গে তাঁদের বন্ধুত্ব তৈরি হয়। মিসেস গ্রান্টের বোন হলেন মেরি ক্রাফট, ভাই হেনরী ক্রফোর্ড। মেরি আর হেনরি ক্রফোর্ড যখন রেক্টর হাউসে এসে দিদি জামাইবাবুর সঙ্গে থাকতে শুরু করল, তখন থেকে শুরু হল আখ্যানের এক নতুন পর্ব। ক্রফোর্ড ভাইবোনের সংস্পর্শে এসে ম্যান্সফিল্ড পার্কের সমস্ত তরুণ তরুণীই প্রবলভাবে আন্দোলিত হল। হাল আমলের শিক্ষা, রুচি, রাজধানী লন্ডনবাসের অভিজ্ঞতা, হাবভাব চালচলনের সপ্রতিভতা ও চটকদার সৌন্দর্য – নানা গুণ নিয়ে মেরি ক্রফোর্ড ম্যান্সফিল্ডের পার্কের চৌহদ্দিতে প্রবেশ করার পরে দেখা গেল তার প্রতি এডমন্ডের একটা আকর্ষণ তৈরি হয়েছে আর মেরির দিক থেকেও আসছে ইতিবাচক সাড়া। অন্যদিকে হেনরি ক্রফোর্ডের প্রতি ছোট বোন জুলিয়া ও তার দিদি মারিয়া, একইসঙ্গে প্রেমাসক্ত হয়। মারিয়া ইতোমধ্যেই মিস্টার রাসওয়ার্থের বাগদত্তা, ফলে হেনরির সঙ্গে তার মন দেওয়া নেওয়া চলতে থাকে আড়াল আবডালে। হেনরি দু বোনের সঙ্গেই নিরন্তর ফ্লার্টিং চালিয়ে যাবার ফলে তারা পরস্পরের প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে। অন্যদিকে মেরির প্রতি এডমন্ডের টান ঈর্ষান্বিত করে ফ্যানিকে। তরুণ তরুণীদের শরীর মনের টান, পারস্পরিক ঈর্ষা উপন্যাসকে বর্ণময় করে তোলে। পরিবারের অভিভাবক ও কড়া নজরদার থমাস বার্ট্রাম এইসময় আখের খামার ব্যবসা দেখভালের কাজে অ্যান্টিগার দূর প্রবাসে দীর্ঘদিন থাকায় ছেলেমেয়েদের এইসব কার্যকলাপ বাধাহীনভাবে বিকাশের উন্মুক্ত পরিসর পায়।

থমাস বার্ট্রামের অনুপস্থিতির অবকাশে বড় ছেলে টম বাড়িতে নিয়ে আসে তার বন্ধু ইয়েটসকে আর ইয়েটসের আগ্রহে এক রোমান্টিক থিয়েটারের মহড়া শুরু হয়ে যায় ম্যান্সফিল্ড পার্কে। এলিজাবেথ ইঞ্চবল্টের লেখা ‘লাভারস ভোস’ নামক নাটকের মহড়া ও সংলাপ বিনিময়ের সূত্র ধরে বিভিন্ন চরিত্রের প্রেম সম্পর্ক ও পারস্পরিক ঈর্ষা আরো গাঢ় হয়। ফ্যানি এই নাটকটা পড়ে এবং মনে করে এটা নৈতিকতার প্রশ্নে দোষাবহ ও সে কারণে অভিনয়ের উপযুক্ত নয়। তবে এডমন্ড ছাড়া বাড়ির অন্যরা তীব্র আগ্রহী ছিল বলে স্যর থমাসের বিলিয়ার্ড খেলার ঘরটিকে মহড়াকক্ষ বানিয়ে অভিনয়ের কর্মকাণ্ড জোরকদমে চলতে থাকে। মারিয়া ও জুলিয়া দুজনেই হেনরি ক্রফোর্ডের বিপরীতে অভিনয় করতে চায়।  মারিয়াকে এই চরিত্রের জন্য বেছে নেওয়া হলে জুলিয়া রাগ করে মহড়া থেকে বেরিয়ে যায়। মঞ্চের নাটকের পাশাপাশি শুরু হয়ে যায় এক পারিবারিক নাটক। অভিনয়ের সূত্র ধরে হেনরি ক্রফোর্ড মারিয়ার উদ্দেশ্যে প্রেমের চাটুবাক্য আওড়ে যাবার সুযোগ পায় আর অভিনয়ের আড়াল পেরিয়ে মারিয়া হেনরিকে তার মন প্রাণ সমর্পণ করে বসে। মেরি ক্রফোর্ডও একটি চরিত্রে অভিনয় করেন এবং তার বিপরীতে এডমন্ডকে অভিনয় করতে অনুরোধ করেন। এডমন্ড প্রথমে রাজি হয় নি। তখন বড়দা টম এই চরিত্রের জন্য পরিবারের বাইরের কাউকে নিয়ে আসার কথা বললে এডমন্ড পুনর্বিবেচনা করে এবং নিমরাজি হয়েই অভিনয়ের মহড়া দিতে শুরু করে। জুলিয়ার ছেড়ে দেওয়া চরিত্রটিতে মিসেস গ্রান্ট মহড়া দেওয়া শুরু করেছিলেন কিন্তু তিনিও অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সবার অনুরোধে তখন ফ্যানি প্রাইস মহড়া দিতে সম্মত হয়, কিন্তু সে কাজ শুরুর আগেই অ্যান্টিগা থেকে ফিরে আসেন স্যার থমাস।

নির্ধারিত প্রত্যাবর্তনের কদিন আগেই থমাস বার্ট্রাম ফিরে আসায় পালটে যায় পুরো পরিস্থিতি। অভিনয়ের যাবতীয় আয়োজন তাঁর তীব্র রোষের মুখোমুখি হয়ে বাতিল হয়ে যায়। দেখা যায় স্যার থমাস আর ফ্যানি দুজনেই মনে করেন এই সমস্ত অভিনয়, নাটক ইত্যাদি হল গৃহশান্তির পক্ষে বিঘ্নস্বরূপ। অভিনয়ের সূত্র ধরে কাছাকাছি আসার পর মারিয়া ভেবেছিল তার প্রতি প্রেমকে হেনরি ক্রফোর্ড প্রকাশ্যে ঘোষণা করবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় হেনরির দিক থেকে এটা ফ্লার্টিং এর বেশি কিছু ছিল না। স্যার থমাস ফেরার কিছুদিন পরেই সে ম্যান্সফিল্ড পার্ক ছেড়ে প্রমোদ নগরী বাথে চলে যায়। বিধ্বস্ত মারিয়া বাধ্য হয়ে মিস্টার রাসওয়ার্থের সঙ্গে বিবাহে সম্মতি দেয়। ভালোবাসার টানের বদলে সামাজিক প্রতিপত্তি ও অর্থসম্পত্তির ভিত্তিতে আয়োজিত এই বিবাহ প্রথম থেকেই ছিল দুর্বল এবং পরবর্তীকালে আমরা দেখি বিবাহ পরবর্তী জীবনেও মারিয়া হেনরি ক্রফোর্ডের সঙ্গে পরকীয়া চালিয়ে যাচ্ছে। মিস্টার রাসওয়ার্থের সঙ্গে বিবাহ সম্পর্কে ইতি টেনে একদিন মারিয়া হেনরির সঙ্গে পালিয়েও যায়।

এডমন্ডের সঙ্গে মেরি ক্রফোর্ডের যে প্রেম সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল দেখা যায় তার ভিত্তিও বেশ দুর্বল। দুজনের অন্তঃপ্রকৃতি আলাদা। এডমন্ড গ্রামীণ যাজকের শান্ত নিস্তরঙ্গ জীবন বেছে নিতে চায় আর মেরি ক্রফোর্ডের আকাঙ্ক্ষা উচ্ছলতা ও বর্ণময়তা। যাজকের চাকরীর বদলে অন্য কোনও জীবিকায় এডমন্ড গেলেই সে বেশি খুশি হবে একথা নানা সময়ে নানাভাবে সে ক্রমাগত এডমন্ডকে জানিয়ে যায়, যদিও তাতে এডমন্ডের বিচারধারা খুব একটা বদলায় না।

থিয়েটারপর্ব শেষের পর মেরি ক্রফোর্ড আর ফ্যানির মধ্যে আলাপচারিতা বাড়ে ও তাদের মধ্যে হালকা বন্ধুত্বের সম্পর্কও তৈরি হয়। দেখা যায় মেরি ও ফ্যানির প্রকৃতি ও পছন্দ সম্পূর্ণ আলাদা। ফ্যানি ভালোবাসে গ্রাম, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও নির্জনতা আর মেরি ক্রফোর্ডের আকর্ষণ শহর, বৈভব ও হৈ চৈ। এডমন্ড ক্রমশ অনুভব করতে থাকে তার মনের সঙ্গে মেরি ক্রফোর্ডের নয়, প্রকৃতিগত মিল আছে ফ্যানিরই। অন্যদিকে শহর থেকে ফেরা হেনরি ক্রফোর্ড ফ্যানিকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে ও ফ্যানির প্রতি তার আকর্ষণ বাড়তে থাকে। এইসময় ফ্যানির প্রিয় দাদা উইলিয়াম জাহাজের চাকরী থেকে ছুটির অবকাশে বোনের কাছে এলে হেনরি তার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করে। দাদার সঙ্গে হেনরির আচরণ ফ্যানির মনকে হেনরির প্রতি খানিকটা নরম করে। মারিয়া – হেনরি – জুলিয়া এবং হেনরি – মারিয়া – রাসওয়ার্থের পর উপন্যাসে আরো দুটি নতুন ত্রিকোণ সম্পর্ক তৈরি হয়; মেরি – এডমন্ড -  ফ্যানি এবং এডমন্ড – ফ্যানি – হেনরি।

হেনরি নানাভাবে ফ্যানিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালায়। মিস্টার গ্রান্টের পাদ্রি গৃহের ডিনার পার্টিতে উপস্থিত স্যর থমাস বার্ট্রাম ফ্যানির প্রতি হেনরির বাড়তি মনযোগ লক্ষ করে বেশ খুশি হন। ফিরে গিয়ে ম্যান্সফিল্ড পার্কে আরেকটি বল নাচের সন্ধ্যার আয়োজন করেন স্যর থমাস এবং সেটিই সমাজে ফ্যানির আত্মপ্রকাশের মঞ্চ হয়ে ওঠে। ফ্যানি হেনরি ক্রফোর্ড ও এডমন্ড – উভয়ের সঙ্গেই নাচে এবং তার সপ্রতিভতা সকলের নজর কাড়ে। ধনী আত্মীয়গৃহে আশ্রিতার কুন্ঠিত অবস্থানের গণ্ডিটি ভেঙে ফ্যানি এইসময় থেকে নতুন ভাবে জীবনে এগোতে শুরু করে। অন্যদিকে মেরি ক্রফোর্ড ক্রমশ দ্বিধা দ্বন্দ্বে দীর্ণ হতে থাকে। একদিকে এডমন্ডের প্রতি আকর্ষণ, অন্যদিকে এডমন্ডকে বিয়ে করলে যাজকের স্ত্রীর গ্রামীণ নিস্তরঙ্গ জীবনের একঘেয়েমির প্রতি বিকর্ষণ মেরির ভবিষ্যৎভাবনাকে জটিল দ্বিধায় ফেলে। এইসময়ে হেনরি ক্রফোর্ড ফ্যানিকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। স্যর থমাস মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন এই বিয়েটা হোক, কারণ এর মধ্যে তিনি ফ্যানির মঙ্গল এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন। মাসি মিসেস বার্ট্রামও একই মত পোষণ করেন। তবে পাণিপ্রার্থী হেনরি বা মাসি মেসো বার্ট্রাম দম্পতি – সবাইকেই হতাশ করে ফ্যানি হেনরিকে প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। প্রথমে এডমন্ড, তখনো অবধি যে মেরি ক্রফোর্ডের প্রেমিক এবং তারপর মেরি নিজে দাদা হেনরির পক্ষ নিয়ে ফ্যানিকে বোঝাতে আসে, কিন্তু তাদের চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। এরপর ভগ্ন মনোরথ হেনরি ফ্যানিকে বিয়ের আশা ছেড়ে বোন মেরিকে নিয়ে ম্যান্সফিল্ড পার্কের এলাকা ছেড়ে লন্ডনে চলে যায়।

হেনরির বিবাহ প্রস্তাব ফিরিয়ে দেবার পর মাসি মেসো সহ ম্যান্সফিল্ড পার্কের আত্মীয় পরিজনেরা যখন ফ্যানির ওপর খানিক বিরক্ত, সেইসময়ে সে দীর্ঘ আট বছর পর ম্যান্সফিল্ড পার্ক ছেড়ে দাদা উইলিয়ামের সঙ্গে পোর্টসমাউথ এ বাবা মা ভাই বোনেদের কাছে ফেরে। ফিরে সে আশ্চর্য হয়ে দেখে বড় হবার গোটা পর্ব জুড়ে পরিবারের সবার সঙ্গে দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা বাবা মা ভাই বোনেদের সঙ্গে তার একটা দূরত্ব তৈরি করে দিয়েছে। কেউ কারো সঙ্গে সহজভাবে মিশতে পারছে না। উইলিয়াম জাহাজের কাজে ফিরে যাবার পরে পোর্টসমাউথের বাড়িতে ফ্যানি বেশ অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। ফ্যানির মানসিক একাকিত্বের এই দিনকালে হেনরি ক্রফোর্ড আরো একবার তার বিবাহপ্রস্তাব ভেবে দেখার অনুরোধ নিয়ে পোর্টসমাউথে ফ্যানির কাছে আসে, তবে এবারও ফ্যানির মন বা সিদ্ধান্ত বদলায় না।

হেনরি ক্রফোর্ড লন্ডনে ফিরে যায়। ফ্যানিকে বিয়ের আশা শেষ হয়ে যাবার পর আবার শুরু হয় মারিয়ার সঙ্গে তার পরকীয়া পর্ব। পোর্টসমাউথে থাকতে থাকতেই ফ্যানি জানতে পারে মারিয়া তার বিত্তবান স্বামী মিস্টার রাসওয়ার্থকে ছেড়ে প্রেমিক হেনরি ক্রফোর্ডের সঙ্গে চলে গেছে। পরিবারের তরফে কেচ্ছা চাপা দেবার চেষ্টা হলেও এই রসালো খবর সংবাদপত্রের পাতায় প্রকাশিত হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এইসময় বার্ট্রাম পরিবারের বড়ছেলে টম মারাত্মক  অসুস্থ হয়ে পড়লে পরিবারের সকলের একান্ত অনুরোধে তার সেবা শুশ্রুষার জন্য ফ্যানি আবার ফেরে ম্যানসফিল্ড পার্কে। ফেরার পর এডমন্ড তাকে জানায় মেরির সম্পর্কে তার ধারণা বদলে গেছে। যেভাবে মেরি ভাই হেনরির পরকীয়া সম্পর্কের অপরাধকে লঘু করে দেখেছে, ফ্যানি হেনরির বিবাহ প্রস্তাবে সাড়া দেয় নি বলে এই রকম লজ্জাজঙ্ক ঘটনা ঘটেছে বলে ফ্যানির ওপরেই সব দোষ চাপিয়েছে, তা এডমন্ডের একেবারেই ভালো লাগে নি। এডমন্ড ফ্যানিকে জানিয়ে দেয় কেন সে মেরির সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে দিচ্ছে। মেরি এডমন্ডের জীবন থেকে সরে যাবার পর এডমন্ডের সঙ্গে ফ্যানির প্রেম সম্পর্ক শুরু হয় এবং অনতি পরে তা বিবাহে পরিণতি পায়। মিস্টার গ্রান্টের মৃত্যুর পর এডমন্ড ম্যান্সফিল্ড পার্ক সন্নিহিত চার্চটির যাজকের আসনে আসীন হয় ও পাদ্রি গৃহে ফ্যানির সঙ্গে দাম্পত্য জীবন শুরু করে। প্রসঙ্গত বলা দরকার আজকের বাঙালি পাঠকের চোখে তুতো ভাইকে বিয়ের ব্যাপারটি অদ্ভুত ও অনৈতিক ঠেকলেও সেকালের ইংলণ্ডে এ ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক ও বহুপ্রচলিত ব্যাপার। তাই এডমন্ড ফ্যানির প্রেম বিবাহের বিষয়টিকে আমাদের এখানকার অভ্যস্ত চিন্তার বাইরে থেকেই দেখা দরকার।

‘ম্যান্সফিল্ড পার্ক’ জেন অস্টেনের অন্যান্য উপন্যাসের থেকে স্বাদে গন্ধে বেশ খানিকটা আলাদা। পূর্ববর্তী ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ সহ নানা উপন্যাসেই নায়িকা হিসেবে উচ্ছল উজ্জ্বল যে সব নারীদের আমরা পেয়েছি, তাদের আবেগ অনুভূতির যে অবিশ্রান্ত উদগীরণ আমরা লক্ষ করেছি, তার থেকে এই উপন্যাসের নায়িকা ফ্যানি প্রাইস একেবারেই আলাদা। ফ্যানি চুপচাপ, নির্জনতাপ্রিয়, নৈতিকতার কঠোর আবরণে ঘেরা। নৈতিক শুদ্ধতার প্রতি অতিরিক্ত ঝোঁকের কারণে সে নিজের আকাঙ্ক্ষা অর্জনের জন্য সচেষ্ট নয়। আশ্রিতা হিসেবে আশ্রয়দাতার বাড়িতে ভাগ্যচক্রে যে জীবন তাঁর জন্য বরাদ্দ হয়েছে, সেটুকু নিয়েই সে চলতে চায়। অষ্টাদশ উনিশ শতকের ইংলণ্ডে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ যখন মাথাচাড়া দিচ্ছে আর আয়ান আয়াটের মতো উপন্যাসতাত্ত্বিকদের মতে সেই ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ থেকেই উপন্যাসের জন্ম। উপন্যাসের নায়ক বা নায়িকার মধ্যে এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ না থাকলে সে আধুনিক সাহিত্যবর্গ উপন্যাসের নায়ক বা নায়িকা হতে পারবে না, এটাই উপন্যাস পাঠক ও বিশ্লেষকদের সাধারণ অভিমত। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই অনেকে মনে করেন ফ্যানি প্রাইস নয়, এই উপন্যাসেরই আরেক উল্লেখযোগ্য চরিত্র মেরি ক্রফোর্ড বরং অনেক বেশি নায়িকা সুলভ, আকর্ষণীয় ও বর্ণময়। নিজের জীবনের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষাকে অর্জন করার জন্য তার সচেষ্টতা তাকে বর্ণময়, আকর্ষণীয়, গতিশীল করেছে। নিস্তরঙ্গ  ফ্যানিকে এখানে বানানো হয়েছে নায়িকা আর বর্ণময় মেরি ক্রফোর্ডকে পার্শ্বচরিত্র করে একপাশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে – এটা অনেকেই মেনে নিতে প্রস্তুত নন।

ফ্যানি নিঃসন্দেহে নির্জনতা প্রিয়, চুপচাপ, নৈতিক শুদ্ধতাবোধে স্পৃষ্ট, কিন্তু তাই বলে ফ্যানির মধ্যে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রতা নেই, এই অভিযোগ কি শেষপর্যন্ত সঠিক? নৈতিকতাতে দৃঢ় থাকার আকাঙ্ক্ষা থেকে কি এক ধরনের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ তাঁর মধ্যে আসে নি? সামাজিক ও আর্থিক প্রতিপত্তি সম্পন্ন হেনরি ক্রফোর্ডের বারবার প্রেম নিবেদন ও বিবাহ প্রস্তাব ফ্যানি যে বারবার দৃঢ়তার সঙ্গে ফিরিয়ে দেয়, আশেপাশের সকলের আগ্রহ, পরামর্শ ও অনুরোধকে অস্বীকার করে নিজের সিদ্ধান্তে দৃঢ় থাকে, তার পেছনে সক্রিয় থাকে তার কঠোর নৈতিকতাবোধ। যে হেনরি অনৈতিক সম্পর্কে এগোয় মারিয়ার সঙ্গে, প্রেমের চেয়ে ফ্লার্টিং যার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তাকে নেহাৎ যৌবনের স্বাভাবিক পদস্খলন ভেঙে ক্ষমা করে দিতে ফ্যানি প্রস্তুত নয়। মনে রাখতে হবে ফ্যানি শুধু হেনরি ক্রফোর্ডের প্রস্তাবকেই ফিরিয়ে দেয় নি। হেনরিকে বিয়ে করার জন্য তাঁর আশ্রয়দাতা মেসো থমাস বার্ট্রামের পরামর্শকেও অগ্রাহ্য করে তাঁর বিরাগভাজন হয়েছে। ম্যান্সফিল্ড পার্ক এর সুখ সমৃদ্ধির জীবন ছেড়ে পোর্টসমাউথের অপরিসর বাড়িতে এজন্য তাঁকে বেশ কিছুদিনের জন্য চলেও যেতে হয়েছিল। সেখানে সে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতেও পড়েছে। ফ্যানি যখন পোর্টসমাউথে নানা অস্বস্তির মধ্যে আছে, তখন সেখানে আরো একবার হেনরি ক্রফোর্ড তার প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল। ফ্যানি কিন্তু সে সময়েও হেনরিকে ফিরিয়ে দিয়েছে এবং অনৈতিক ব্যক্তিকে বিয়ের মাধ্যমে পার্থিব সুখ কিনতে চায় নি। ফ্যানি যে ঔপনিবেশিক দুনিয়ার উন্নতিকামী অন্যদের চেয়ে আলাদা ছিল তা বোঝা যায় উপনিবেশ প্রসঙ্গে, সেখানকার দাস ব্যবসা প্রসঙ্গে তার সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন থেকে। ঔপনিবেশিক শোষণের বিষয়টি উপন্যাসে যে কিছুটা হলেও সামনে আসে, তা সম্ভব হয় স্যর থমাসকে করা ফ্যানির প্রশ্ন ও এডমন্ডের সঙ্গে ফ্যানির কথাবার্তার সূত্র ধরে। এটা ফ্যানি চরিত্রের এমন একটা বৈশিষ্ট্যকে সামনে আনে, যা সেকালের ব্রিটিশ নভেলে খুবই ব্যতিক্রমী।

‘ম্যান্সফিল্ড পার্ক’ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ‘ওরিয়েন্টালিজম’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থের লেখক এডওয়ার্ড সইদ ফ্যানির এই প্রশ্নগুলিকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছেন। নারীবাদী দৃষ্টিকোণ, সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ, শ্রেণিগত দৃষ্টিকোণ ইত্যাদির পাশাপাশি এই উপন্যাসকে ভৌগলিক অবস্থানের নিরিখ থেকে, উপনিবেশের শাসক শাসিতর দৃষ্টিকোণ থেকেও পড়া দরকার বলে সইদ মনে করেন। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের কেউ বা ভারতে বসে কেউ যখন এই উপন্যাস পড়বেন, তখন সেই সমস্ত জায়গার যে সব উল্লেখ এই উপন্যাসে রয়েছে সেগুলিকে সেই পাঠক কীভাবে দেখতে পারেন, সেই প্রশ্ন সইদ তুলেছেন। এডওয়ার্ড সইদ দেখান এই উপন্যাসে থমাস বার্টার্ম অ্যান্টিগায় যাচ্ছেন তার আখের খামার দেখভাল করতে। সেখানে আফ্রিকা থেকে আনা দাসদের দিয়ে চাষাবাদ করিয়ে বিপুল মুনাফা তুলতেন ইউরোপের সাদা চামড়ার মানুষেরা। থমাস বার্ট্রামের মতো জেন অস্টেনের সময়কার নোবেলিটি ও জমিদার পরিবারগুলির অনেকেই এই মুনাফা থেকে রসেবশে থাকত। সাধারণভাবে এই ঔপনিবেশিক শোষণ বা দাসপ্রথার অনৈতিকতা নিয়ে শাসক দেশের লেখকেরা নীরব থাকেন। এডওয়ার্ড সইদ দেখান জেন অস্টেন কিন্তু এই বিষয়ে পুরোপুরি নীরব নন। তাঁর উপন্যাসের নায়িকা তথা কেন্দ্রীয় চরিত্র উপন্যাসের নায়ক এডমন্ডকে কথোপকথন প্রসঙ্গে জানায় সে তার মেসোমশাই থমাস বার্ট্রামকে অ্যান্টিগার দাস প্রথা বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, কিন্তু নীরবতা ছাড়া উত্তরে সে আর কিছুই পায় নি। এডমন্ড নিজে যদিও বাবাকে এই বিষয়ে কোনও প্রশ্ন করেনি, কিন্তু বিষয়টা নিয়ে যে তাঁর আগ্রহ ছিল এবং নিজে এই বিষয়ে প্রশ্ন করতে না পারলেও আরো কেউ কেউ ফ্যানির মতো বিষয়টি জানতে চাক এবং একটা উত্তর বেরিয়ে আসুক, এটা সে চেয়েছিল। ফ্যানির প্রশ্নের উত্তরে বাবার নীরবতা তার মধ্যেও হতাশা তৈরি করেছিল। ফ্যানি ও এডমন্ডের এই বিষয়ক কথোকপথনটা উদ্ধৃত করা যাক।

Did not you hear me ask him about the slave-trade last night?”

“I did—and was in hopes the question would be followed up by others. It would have pleased your uncle to be inquired of farther.”

“And I longed to do it—but there was such a dead silence!

(দ্বিতীয় খণ্ডের তৃতীয় অধ্যায়।)

এডওয়ার্ড সইদ দেখান দাসপ্রথার পাশাপাশি এই উপন্যাসে ঔপনিবেশিক শাসন এবং সেই সূত্রে শাসিত দেশগুলিতে ইংলণ্ডের নৌসেনা পাঠানোর দিকটিও কীভাবে এই উপন্যাসে এসেছে। মিসেস বার্ট্রামের সঙ্গে তাঁর বোনপো উইলিয়ামের হালকা চালের কথোপকথনটি খেয়াল করা যাক।

“And you have been in the East Indies, and the Persian Gulf, and all that part of the world, have not you? and brought me home a shawl?—William, my dear, how very kind you are! but you must not think I shall wear it; I shall only look at it.”

(দ্বিতীয় খণ্ডের অষ্টম অধ্যায়।)

ইংরেজ নেভিতে কর্মরত হওয়ার সূত্রে ব্রিটিশ সেনার অংশ হিসেবে ইস্ট ইন্ডিজ অর্থাৎ ভারত, পারস্য দেশ সহ বিশ্বের নানা প্রান্তে উইলিয়াম গেছিল এবং সেখান থেকে মাসির জন্য সে যে শাল নিয়ে এসেছে তাতে লেডি বার্ট্রাম খুবই খুশি। তিনি এই দেশগুলি, সেখানে ইংরেজ সেনার কাজ বা শাসন সম্পর্কে, সেখানকার মানুষ সম্পর্কে কিছু জানতে আগ্রহী নন। তাঁর আগ্রহ কেবল সেই সব দেশের সুন্দর পণ্য সম্পর্কে।

দাসপ্রথা বা ঔপনিবেশিক শাসনের প্রসঙ্গগুলি সংক্ষিপ্ত আকারে উপন্যাসে এলেও জেন অস্টেন যে বিষয়গুলিকে এড়িয়ে যান নি, সেটাকে এডওয়ার্ড সইদ গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ বলেই মনে করেন।