জেন অস্টেনের 'প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস'
- 07 December, 2025
- লেখক: সৌভিক ঘোষাল
জেন অস্টেনের উপন্যাসগুলি দুশো বছরের বেশি সময় জুড়ে দেশ বিদেশের নানা গোত্রের পাঠককে অবিরত আকর্ষণ করে চলেছে। সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি, ম্যানসফিল্ড পার্ক, এমা, নর্দাঙ্গার অ্যাবে, পারসুয়েশান – কোনটির আকর্ষণই কম নয়। তবে অস্টেনের উপন্যাসগুলির মধ্যে যেটি সবচেয়ে জনপ্রিয়, সেটি সম্ভবত প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস। এই উপন্যাসটি জেন অস্টেন লিখতে শুরু করেন ১৭৯৬ সালের অক্টোবর মাসে, যখন তাঁর বয়েস প্রায় একুশ, এই উপন্যাসের নায়িকা এলিজাবেথের বয়েসের প্রায় সমান। উপন্যাসটির প্রাথমিক খসড়াটি জেন লিখে ফেলেন ১৭৯৭ সালের অগস্ট মাসের মধ্যেই। এই প্রথম খসড়ায় উপন্যাসটির নাম ছিল ‘ফার্স্ট ইম্প্রেশান’। অনেকে মনে করেছেন এই প্রথম খসড়ায় উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল চিঠির আকারে, যে রীতিতে তখনকার দিনে উপন্যাস লেখার বেশ চল ছিল। স্যামুয়েল রিচার্ডসনের বিখ্যাত উপন্যাস পামেলা (১৭৪০) যে রীতিতে লেখা হয়েছিল এবং পাঠক মহলে বিস্তর সাড়া ফেলেছিল। কিন্তু ‘ফার্স্ট ইম্প্রেশান’ নামক খসড়াটির কোনও অংশই যেহেতু পাওয়া যায় নি, তাই চিঠির আকারে সত্যিই এটা প্রথমে লেখা হয়েছিল কীনা, তাই নিয়ে বিস্তর সন্দেহ আছে। কিছুকাল আগে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছে জেন অস্টেন রচনাবলীর সুসম্পাদিত সংস্করণ। ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এর সম্পাদক প্যাট রজার্স তাঁর গবেষণামূলক ভূমিকায় আমাদের জানিয়েছেন জেন অস্টেনের বাবার লেখা এক চিঠির ভুল ব্যাখ্যার সূত্র ধরেই সম্ভবত একসময়ে অনেকে মনে করেছিলেন ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এর প্রথম খসড়া ‘ফার্স্ট ইম্প্রেশান’ চিঠির আকারে লেখা হয়েছিল। ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে সেই চিঠিটি জেনের বাবা জর্জ অস্টেন লিখেছিলেন লন্ডনের বই ব্যবসায়ী থমাস ক্যাডেলকে। জানিয়েছিলেন তাঁর হাতে একটি তিন খণ্ডে প্রকাশযোগ্য উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি আছে আর জানতে চেয়েছিলেন এর প্রকাশ সম্ভাবনা বিষয়ে তাঁদের আগ্রহ বিষয়ে। উপন্যাসের আয়তন সম্পর্কে প্রকাশককে জানাতে গিয়ে জর্জ অস্টেন বলেছিলেন মিস বার্নলের ‘ইভেলিনা’র কথা। যেহেতু বার্নলের ইভেলিনা একটি পত্রোপন্যাস, চিঠির আকারে লেখা, তাই অনেকে ধরে নিয়েছিলেন জেন অস্টেনের ‘ফার্স্ট ইম্প্রেশান’ও তাই ছিল। কিন্তু প্যাট রজার্স সঠিকভাবেই সম্পূর্ণ চিঠিটি উদ্ধৃত করে বলেছেন যে এই চিঠিতে ‘ইভেলিনা’র প্রসঙ্গ উপন্যাসের আকার বোঝাতেই এসেছে বলে মনে করা সঙ্গত, এর সঙ্গে উপন্যাসের রূপরীতির কোনও সম্পর্ক নেই। এও তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এর আদিরূপ সম্পর্কে জল্পনার বিশেষ সুযোগ আমাদের নেই।

১৭৯৭ সালে প্রকাশকের কাছে মেয়ের উপন্যাস প্রকাশের আর্জি জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন জেনের বাবা আর এই সংক্রান্ত আশা যে পরিবারের মধ্যে ১৭৯৯ সালেও জীবন্ত ছিল, তা বোঝা যায় সেই বছরে দিদি ক্যাসান্দ্রা অস্টেনকে বোন জেনের লেখা একটি চিঠির সূত্র ধরে। তবে প্রকাশকের কাছ থেকে আর কোনও সাড়া এল না এবং ধীরে ধীরে উপন্যাসটি প্রকাশের সম্ভাবনা কিছুদিনের জন্য থিতিয়ে পড়ল। ইতোমধ্যে ১৮০১ সালে মার্গারেট হলফোর্ডের ‘ফার্স্ট ইম্প্রেশানস’ নামে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হল চার খণ্ডে। এরপর জেন অস্টেন যখন তাঁর খসড়ার পরিমার্জন করলেন, তখন উপন্যাসের নামটিও ‘ফার্স্ট ইম্প্রেশান’ থেকে বদলে দিলেন ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’এ। ১৮০৯ সালের জুলাই মাস থেকে ১৮১০ সালের জুলাই মাসের মধ্যে অস্টেন তাঁর আরো কিছু পূর্বতন পাণ্ডুলিপির সঙ্গে সঙ্গে ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’এর পাণ্ডুলিপিরও অনেক পরিমার্জন করেন বলে জানিয়েছেন জেন অস্টেনের ভাইপো তথা জীবনীকার জেমস এডওয়ার্ড অস্টেন লেই। ১৮১১ সালে সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি প্রকাশের পর আবারো ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এর পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে পরিবর্তন, পরিমার্জনের কাজে বসেন অস্টেন। তারপর পরিমার্জন শেষে সেটিকে পাঠিয়ে দেন প্রকাশকের ঘরে। একথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, অষ্টাদশ শতকের শেষে ১৭৯৬-৯৭ তে স্টিভেনটনে বসে লেখা ‘ফার্স্ট ইম্প্রেশান’ এর প্রভূত উপাদান, এমনকী মূল কাঠামো ও চরিত্রগুলি ব্যবহৃত হলেও ১৮০৯ থেকে ১৮১২ সালের মধ্যে চাওটনে অবস্থানকালে কয়েকদফা পুনর্মাজনের পর নির্মিত ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ প্রায় এক নতুন সৃষ্টি। উপন্যাসটির কেম্ব্রিজ সংস্করণের সম্পাদক প্যাট রজার্স তাই তাঁর ভূমিকায় বলেছেন যে ‘ফার্স্ট ইম্প্রেশন’ স্টিভেনটনের সৃষ্টি আর ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ হল চাওটনের নির্মাণ।

১৮১২ সালের ৩০ নভেম্বর মার্থাকে লেখা এক চিঠিতে জেন অস্টেন ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এর কপিরাইট বিক্রির খবরটি দেন। ১৮১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি মর্নিং ক্রনিকেল সংবাদপত্রে বইটি প্রকাশের বিজ্ঞাপন বেরোয়। তিনখণ্ডের বইটির দাম ছিল ১৮ শিলিং। প্রথম খণ্ডে ছিল তেইশটি অধ্যায়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডে উনিশটি করে। মোট পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ৮৬৯। উপন্যাসটি প্রকাশের পরেই যাঁরা বইটি সম্পর্কে আগ্রহী ও সপ্রশংস ছিলেন তাদের একজন ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিং – অস্টেন পরিবারের সঙ্গে যাঁর ছিল হৃদ্যতার সম্পর্ক। প্রকাশের পরেই হেস্টিংসের সূত্র ধরে ভারতে এই বই এসেছিল এটা বোঝা যায়, কিন্তু কতজন সে সময় এদেশে এই বই পড়েছিলেন ও কী প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন, তা জানা যায় না। অনতি পরেই এদেশের পাঠক ও নব্য লেখকদের মধ্যে যে ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে উঠবেন, সেই স্যর ওয়াল্টার স্কট যে ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ পড়েছিলেন এবং মুগ্ধ হয়েছিলেন, সেকথা অবশ্য জানা যায় তাঁর জার্নাল থেকে। উনিশ ও বিশ শতকে বিশ্বের প্রধান প্রধান ভাষায় ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ অনূদিত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে স্প্যানিশ (উনিশটি), ইতালিয়ান (আঠারোটি), ফরাসী (আটটি), পর্তুগীজ (সাতটি), জার্মান (ছটি), চেক (চারটি), ডাচ (তিনটি), রাশিয়ান, সুইডিশ, গ্রীক, হিব্রু, হাঙ্গেরিয়ান, আইসল্যান্ডিক, দিনেমার, ফিনিশ, সার্বোক্রোট, নরওয়েজিনান, রোমানিয়ান, পোলিশ, তুর্কি (তিনটি), জাপানী (চারটি), আরবিক, চিনা, কোরিয়ান, সিংহলী প্রভৃতি। যে সমস্ত ভারতীয় ভাষায় ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ অনূদিত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে বাংলা, হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠি, কন্নড়, তামিল ও তেলেগু। এরই পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ উপন্যাসটির বিপুল জনপ্রিয়তার কথা মাথায় রেখে নির্মিত হয়েছে নানা চলচ্চিত্র, যেগুলি অত্যন্ত বাণিজ্য সফল। ১৯৪০ সালে ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ অবলম্বনে প্রথম সিনেমাটি নির্মিত হয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে ১৯৮০, ১৯৯৫, ২০০৩, ২০০৫, ২০১৩, ২০১৬, ২০১৯ – সালে ধারাবাহিকভাবে এই উপন্যাসকে অবলম্বন করে নানা ধরনের চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। মুম্বাইতেও ২০০৪ সালে ঐশ্বর্য রাইকে নায়িকা এলিজাবেথের ভূমিকায় ললিতা বক্সী নামে রেখে গুরিন্দর চাড্ডা একটি বাণিজ্যসফল সিনেমা তৈরি করেছেন।




বিশ্বজুড়ে ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এর এই বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ কী ? এই প্রশ্নের তথা জেন অস্টেনের সামগ্রিক জনপ্রিয়তার উত্তর দিতে গিয়ে মনে হয় সমাজ পরিবেশ সম্পর্কে নিখুঁত ধারণা, আকর্ষণীয় প্লট বিন্যাস, নিপুণ চরিত্র নির্মাণ এবং উপন্যাস নির্মাণ টেকনিক সম্পর্কিত দক্ষতার কথা।

উপন্যাসটি শুরু হয় এক ভাগ্য বিড়ম্বিত জমিদার পরিবারের কাহিনী দিয়ে। বেনেট পরিবারের কর্তা মিস্টার বেনেট এবং মূলত গিন্নিমা, মিসেস বেনেট সদা সর্বদাই উদ্বিগ্ন হয়ে থাকেন তাঁদের পাঁচ বিবাহযোগ্যা কন্যাকে নিয়ে। খুব বেশি বড়লোক না হলেও বর্তমানে তাঁরা মোটামুটি স্বচ্ছল এক জমিদার পরিবার। কিন্তু সমস্যা হল মিস্টার বেনেটের মৃত্যু হলে এই সমুদয় জমিদারীর কিছুই আর তাঁদের অধিকারে থাকবে না, মা মেয়েদের অথৈ জলে পড়তে হবে। উইলের নিয়মানুসারে সম্পত্তি চলে যাবে পরিবারের নিকটতম পুরুষ আত্মীয় মিস্টার কলিন্সের কাছে। সম্পত্তির উত্তরাধিকার সম্পর্কে সেকালের পুরুষতান্ত্রিক নিয়মের জাঁতাকলে বেনেট পরিবারের মতো অনেককেই পড়তে হত এবং জেন অস্টেন সেই বিষয়টিকে খোলাখুলিভাবে এই উপন্যাসে নিয়ে এসেছেন। মেয়েদের পেশাজগতে সে সময় প্রবেশের কোনও সুযোগ ছিল না, গৃহকর্মে রত থাকাই ছিল একমাত্র কাজ। সামাজিকভাবে উত্তরণের একমাত্র পথ ছিল ভালো বর খুঁজে বিবাহ। গোটা বেনেট পরিবার যে উপন্যাস জুড়ে সুপাত্র খুঁজে চলেছে, একালের অনেক অনভিজ্ঞ পাঠক তাতে কৌতুক খুঁজে পান এবং উপন্যাসের এই বিন্যাস তাঁদের কাছে নারীবিরোধী অবস্থান বলে মনে হয়। কিন্তু তাঁদের মনে রাখা দরকার সেকালের সমাজ ব্যবস্থাই এই বাধ্যবাধকতা তৈরি করেছিল এবং জেন অস্টেন সেই সমাজ বাস্তবতাজাত মনস্তত্ত্বকেই নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন এবং হয়ত এর মধ্যে দিয়েই সেকালের মতো করে কৌতুকের আবরণে নিজের নারীবাদী বয়ানটি উপস্থিত করেছেন। চরিত্র আলোচনা প্রসঙ্গে এই প্রসঙ্গে আরো বিস্তারে প্রবেশের সুযোগ আমাদের হবে।

উপন্যাসের একদম শুরুতে ‘a single man in possession of a good fortune, must be in want of a wife’ এই ধারণাকে সার সত্য ধরে নিয়ে এগোতে চান মিসেস বেনেট। তাঁর ঘরে পাঁচ অবিবাহিত কন্যা, সকলকেই একে একে পাত্রস্থ করতে হবে। তাই তিনি যখন জানতে পারলেন উত্তর ইংলণ্ডের এক অল্পবয়সী অবিবাহিত ধনী পরিবারের ছেলে মিস্টার বিংলে ভাড়া নিয়েছে তাদের পাশের ‘নেদারফিল্ড পার্ক’ তখন থেকেই তিনি আশায় মন বেঁধে ফেললেন। ভাবতে শুরু করলেন বছরে চার পাঁচ হাজার বাঁধা আয়ের এই মানুষটি তার মেয়েদের কাউকে না কাউকে পছন্দ ঠিকই করবে। একজনকে তিনি পাত্রস্থ করতে পারবেন। তবে তাদের প্রতিবেশী স্যর লেডি লুকাস ও তাঁর স্ত্রীও যে নিজের মেয়ের জন্য একইভাবে উদ্যোগী হবেন এবং তার মেয়েদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হতে পারে, এই আশঙ্কাও তার ছিল। কালক্রমে অবশ্য রূপে গুণে অনন্যা বেনেট পরিবারের বড় মেয়ে জেনই শেষপর্যন্ত মিস্টার বিংলের মনোহরণ করতে সমর্থ হল। তবে ভালোলাগা ভালোবাসা ও বাগদান পর্বে পরিণতি পাওয়ার আগেই এসে গেল কিছু বিপত্তি। মিস্টার বিংলের ভালোবাসায় বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন একদিকে তার বন্ধু মিস্টার ডার্সি, অন্যদিকে তার অবিবাহিত বোন ক্যারোলিন। বোন ক্যারোলিন চায় দাদা মিস্টার ডার্সির বোনের সঙ্গে সম্পর্কের দিকে এগোক, কারণ তারা অনেক ধনী আর রুচিশীল। এতে তার নিজেরও সুবিধে হয়। এক আত্মীয়তার বন্ধন নতুন আত্মীয়তার সম্ভাবনাকে জোরদার করতে পারে, সে স্বামী হিসেবে পেতে পারে মিস্টার ডার্সিকে। মিস্টার ডার্সি অবশ্য যে ক্যারোলিনের প্রতি বিশেষ কোনও অনুরাগ পোষণ করতেন তা নয়। তিনি বন্ধু বিংলেকে বেনেট পরিবার ও তার বড় মেয়ে জেনের থেকে সরিয়ে রাখতে চাইলেন সম্পূর্ণ অন্য কারণে। এক বেনেটদের আর্থিক স্বচ্ছলতা তেমন নয়। দ্বিতীয়ত তাদের, বিশেষ করে মিসেস বেনেটের মোটা দাগের রুচি ও আচরণ, যা তার একেবারেই পছন্দ হয় নি। উপন্যাসের প্রথম পর্বে ডার্সি যথেষ্ট অহংকারী ও কর্তৃত্ব পরায়ণ। সে বন্ধু বিংলেকে নিজের সিদ্ধান্ত দিয়ে প্রভাবিত করতে অনেকটাই সক্ষম হয়। প্রাথমিক বন্ধুত্বের পর্ব সমাপ্ত হলে দীর্ঘদিন আর যোগাযোগ থাকে নি বিংলে আর জেনের।

এই সময় রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ মিস্টার কলিন্সের। তিনি বেনেটদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। বেনেট পরিবারে কোনও পুত্রসন্তান না থাকায় উইলের নিয়মানুসারে নিকটবর্তী পুরুষ আত্মীয় হিসেবে সম্পত্তির উত্তরাধিকার মিস্টার বেনেট গত হলে তার ওপরেই বর্তাবে। মিসেস বেনেট ও তার পাঁচ কন্যা সব মিলিয়ে সাকুল্যে পাবেন মাত্র পাঁচ হাজার পাউন্ড। মিস্টার কলিন্স জনৈকা আর্ল কন্যা ও বিপুল সম্পদের অধিকারী লেডি ক্যাথরিনের বদান্যতায় যাজক বৃত্তিতে ঢুকেছেন। এবার তার একটি পাত্রী দরকার। সেই পাত্রী সন্ধানেই তিনি আসেন বেনেট পরিবারে। বড় মেয়ে জেন অন্যত্র বাগদত্তা হতে চলেছে এমন ইঙ্গিৎ পেয়ে সরাসরি বিবাহ প্রস্তাব দেন মেজো মেয়ে এলিজাবেথকে। কিন্তু এলিজাবেথ সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এই প্রত্যাখ্যানের দুদিনের মধ্যেই মিস্টার কলিন্স এলিজাবেথের বন্ধু শার্লটিকে বিবাহ প্রস্তাব দেন। এইবার তিনি সফল হন। এলিজাবেথ বন্ধুর এই সিদ্ধান্তে আশ্চর্য ও ক্ষুব্ধ হলে শার্লটি বন্ধু এলিজাবেথকে জানায় তাঁদের আর্থিক অবস্থা তত মজবুত নয়। সে তত রূপবতীও নয় আর তার বয়েস হয়ে গিয়েছে সাতাশ। এই বিবাহ প্রস্তাব ফিরিয়ে দেবার জো তার নেই। শার্লটির এই বাধ্যবাধকতার মধ্যে দিয়ে মেয়েদের তৎকালীন পরিস্থিতিকে জেন অস্টেন ভালোভাবেই তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন।
উপন্যাসের প্রথম খণ্ডে আর যে পুরুষটি এই পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হয় সে হল উইকহ্যাম। একদা ডার্সির পরিবারের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতা ছিল, কিন্তু পরে মিস্টার ডার্সি তাঁকে সম্পত্তি ও বন্ধুবৃত্ত থেকে দূর করে দেন। সে যোগ দেয় অস্থায়ী সেনাবাহিনীতে। উইকহ্যাম আকর্ষণীয় চতুর তরুণ ও নারী মন জয়ে পারদর্শী। প্রথমে সে এলিজাবেথের মনকে খানিক আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিল। পরে ডার্সির সঙ্গে নিবিড় পরিচয় ও ডার্সির বিস্তারিত চিঠির সূত্রে সে উইকহ্যামের কলঙ্কিত ইতিবৃত্তান্ত জানতে পারে। উইকহ্যামকে এলিজাবেথ এরপর থেকে তীব্র ঘৃণায় এড়িয়ে গেলেও বেনেট পরিবারের ছোট মেয়ে লিডিয়া উইকহ্যামকে দেহ মন সমর্পণ করে ও বাড়ি থেকে তার সঙ্গে পালিয়ে যায়।

লিডিয়ার পালানোর ঘটনাটি যখন ঘটছে তখন মামা মামির সঙ্গে এলিজাবেথ ছিল পেম্বার্লিতে, যেখানে ডার্সির বিরাট জমিদারী ও বৈভবে পূর্ণ অট্টালিকা। ততদিনে ডার্সি এলিজাবেথ সম্পর্ক নতুন পথে অনেকটা মোড় নিয়েছে। প্রথমে ডার্সি গোটা বেনেট পরিবারের সঙ্গে এলিজাবেথকেও তীব্র অপছন্দ করেছিল। এলিজাবেথও ডার্সির অহংকারকে একেবারেই মেনে নিতে পারে নি। সেই সঙ্গে ডার্সি সম্পর্কে তাঁর তীব্র বীতরাগের সৃষ্টি করেছিল আরো দুটি কারণ। তখনো অবধি উইকহ্যামের অন্ধকার দিকগুলি সম্পর্কে অনবহিত ও তার প্রতি মোহমুগ্ধ এলিজাবেথ ভেবেছিল ডার্সি উইকহ্যামের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে তার জীবনকে কন্টকাকীর্ণ করেছেন। তার চেয়েও বড় কথা দিদি তথা প্রিয় সখী জেনের থেকে তাঁর মনের মানুষ বিংলেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন ডার্সি। উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের এই বীতরাগ দ্বিতীয় খণ্ডে এসে অন্য দিকে মোড় নিতে শুরু করে।

মোড় ফেরার পালা প্রথম শুরু হয়েছিল ডার্সির অন্তরে। এলিজাবেথকে বাইরে বাইরে অপছন্দ করলেও ভেতরে ভেতরে কখন যে তার প্রতিই ডার্সি অনুরক্ত হয়ে পড়েছে তা সে নিজেই বোঝে নি। যখন এই প্রেম তাঁর কাছে স্পষ্ট হল সে প্রস্তাব দিল এলিজাবেথকে। যে ডার্সি তাকে অপছন্দ করে বলেই সে জানত, তার কাছ থেকে এই আকস্মিক প্রেম প্রস্তাব পেয়ে সে বিস্মিত হল। দিদি ও উইকহ্যাম জনিত কারণে ডার্সিকে অপছন্দ করা এলিজাবেথ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল। এরপর এল ডার্সির কাছ থেকে এক বিশদ চিঠি, এই উপন্যাসে যার ভূমিকা বিরাট। এই চিঠি থেকেই এলিজাবেথ জানতে পারল উইকহ্যাম চরিত্রের অন্ধকার দিক। ডার্সির বোনের সঙ্গে তার নিন্দনীয় আচরণ ও সেই সূত্রে ডার্সির সঙ্গে তার সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। বেনেট পরিবার সম্পর্কে, তাদের রীতিনীতি সম্পর্কে যে সব আপত্তি ডার্সির ছিল তার কারণ সে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছিল চিঠিতে, যার যুক্তিবিন্যাসকেও এলিজাবেথ অস্বীকার করতে পারে নি। সে নিজেও তো তার মা ও ছোট দুই বোনের আচরণে প্রায়শই লজ্জিত হত।
ডার্সি সম্পর্কে এলিজাবেথের ধারণার পরিবর্তন যদি প্রেম প্রস্তাব ও বিশদ ব্যাখ্যা সহ চিঠি পাওয়া দিয়ে শুরু হয়, তাহলে তা নতুন মোড়ে এসে দাঁড়ায় পেম্বার্লিতে ডার্সির সম্পত্তির বৈভব ও রুচিশীলতা প্রত্যক্ষভাবে দেখার পর। ডার্সি সম্পর্কে সে যখন আগ্রহী হতে শুরু করেছে পেম্বার্লিতে অবস্থানকালে, সেই সময়েই ঘটে যায় লিডিয়ার উইকহ্যামের সঙ্গে পলায়নের ঘটনাটি। চিঠি থেকে সেই ঘটনাটি জেনেই সে মামা মামিকে নিয়ে ঘরের দিকে রওনা দেয়, ডার্সিকে জানিয়ে যায় নতুন এসে পড়া এই ভয়ংকর বিপদের কথা।
এরপর মূলত ডার্সির উদ্যোগ ও অর্থব্যয়েই উইকহ্যাম লিডিয়া পর্ব খানিকটা সম্মানজনক পরিণতির দিকে এগোয়। উইকহ্যাম লিডিয়ার শরীর ভোগেই আগ্রহান্বিত ছিল, বিপুল ঋণের জালে বন্দী উইকহ্যামের পক্ষে সামান্য অর্থের অধিকারী লিডিয়াকে বিয়ে করে সংসার নির্বাহ সম্ভব ছিল না। ডার্সির বদান্যতায় উইকহ্যামের ঋণ শোধ হয় এবং সে এই ঋণমুক্তির সূত্র ধরে বিবাহ করতে সম্মত হয়। বেনেট পরিবার চরম অসম্মানের হাত থেকে উদ্ধার পায় শেষপর্যন্ত এই পলায়ন বিবাহ সম্পর্কে পরিণতি পাওয়ায়। ডার্সি গোপনেই এই সাহায্য সহযোগিতা করেছিলেন, বিষয়টি গোপনও রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু লিডিয়ার মুখ থেকেই প্রকৃত সত্য জানতে পারে এলিজাবেথ। সে বোঝে তার প্রতি নিগূঢ় ভালোবাসা থেকেই ডার্সি বেনেট পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এই সময়েই ডার্সির আগ্রহ প্রশ্রয় পেয়ে বিংলের পুরনো প্রেম আবার প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। জেনের সঙ্গে তাঁর বাগদান সম্পন্ন হয়। সবদিক থেকে পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ডার্সি সম্পর্কে এলিজাবেথের মূল্যায়নকে একেবারে পালটে দেয়, বীতরাগ রূপান্তরিত হয় অনুরাগে। বড় মেজো দুই মেয়ের দুই ধনবান পাত্রের সঙ্গে বিবাহ বেনেট পরিবারে নিয়ে আসে খুশির হাওয়া।

‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এর প্লটটি সহজ, সুন্দর ও আকর্ষণীয়। এই আকর্ষণ আরো বেড়েছে চরিত সৃজনের দক্ষতায়। নায়ক বা নায়িকার চরিত্রকে জেন অস্টেন তো বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তৈরি করেছেনই, এতটুকু অবহেলা করেন নি গৌণ চরিত্রগুলি নির্মাণেও। ধরা যাক উইকহ্যাম বা মিস্টার কলিন্সের কথা। কলিন্স উপন্যাসের প্রথমদিকে যে একপেশে, অনুজ্জ্বল, ভোঁতা, গোঁড়া, নৈতিক বাগাড়ম্বপূর্ণ, ধনী মুরুব্বির স্তাবকতায় উচ্চকিত হাস্যকর বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হয়, তাই মূলত পরবর্তীকালেও বজায় থাকে। তবে একদা যে এলিজাবেথ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, সেই এলিজাবেথই যখন পত্নীবন্ধু হিসেবে তার অতিথি হয়ে আসে, তখন তাঁকে সে উপযুক্ত মর্যাদা ও সম্মান দিতে কার্পণ্য করে নি। এইটা তাঁকে খানিকটা ইতিবাচক করেছে। অন্যদিকে উইকহ্যাম এসেছিল বেনেট পরিবারের মেয়েদের মনে আকর্ষণের ঝড় তুলে। কিন্তু ক্রমশ তাঁর চরিত্রটি নানা ঘটনার উন্মোচনের মধ্যে দিয়ে ক্রমশ কালিমালিপ্ত হয়েছে। মিসেস বেনেট চরিত্রটি এই উপন্যাসে আগাগোড়া উপস্থিত এক কন্যাদায়গ্রস্থ উদ্বিগ্ন মাতা হিসেব। মিসেস বেনেট উচ্চকিত ও তরল প্রকৃতির। এজন্যই ডার্সির মতো ভদ্রলোকবৃত্তের অনেকে তাঁকে অপছন্দ করেছে তীব্রভাবে। লিডিয়াও মায়ের মতোই উচ্চকিত ও তরল। ছেলেদের দেহ মন সমর্পণই ষোড়শী লিডিয়ার জীবনের প্রথম ও পরম উদ্দেশ্য। মিস্টার বেনেট শান্ত স্থিতধী পিতা হিসেবে অনেক কিছুকেই হাসিমুখে মেনে নেন, কিন্তু লিডিয়ার আচার আচরণকে তিনি পিতা হয়েও প্রায়শই মানতে পারেন নি। জেন এবং মূলত এলিজাবেথই তাঁর মনের সবচেয়ে কাছের।
উপন্যাসের প্রথম পর্বের অন্যতম মুখ্য চরিত্র জেন ও বিংলে। দুজনের স্বভাবই মধুর। বিংলে পুরুষ বলেই যতটা খোলামেলা হতে পারেন, জেন মহিলা বলে খানিকটা আর নিজের স্বভাবগত কারণে খানিকটা - ততটা খোলামেলা হতে পারে নি। তবে বিংলে এবং জেন, মাঝের দীর্ঘ পর্বের অদর্শন ও যোগাযোগহীনতা সত্ত্বেও আগাগোড়া পরস্পরের প্রতি অনুরক্ত থেকেছে। উপন্যাসের শুরু থেকেই তাদের বিবাহ ছিল সুনির্দিষ্ট, মাঝের জটিলতাপর্ব পেরিয়ে শেষমেষ তা সুসম্পন্ন হওয়ায় পাঠকমন খুশি হয়ে ওঠে।
সে তুলনায় ডার্সি এবং এলিজাবেথের সম্পর্কের রসায়নে রয়েছে অনেক ওঠাপড়া। তাঁদের চরিত্রও বহুস্তরিক। বস্তুতপক্ষে উপন্যাসের নায়ক নায়িকার চরিত্রনির্মাণের অসামান্য মুন্সিয়ানাই ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এর সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি।
মিস্টার ডার্সিকে প্রথমে অহংকারী, অর্থ ও সামাজিক মর্যাদার দম্ভে পরিপূর্ণ, নিম্নতর সামাজিক গোত্রে থাকা মানুষ জনেদের প্রতি উপেক্ষাপ্রবণ, কখনো কখনো কটূভাষী হিসেবে আমরা দেখি, এই লোকটিই পরে বদলে গেল, যখন এলিজাবেথ বেনেটের প্রেমে সে ভেসে গেল। নায়িকার প্রেমের টানে নায়কের এই রূপান্তর প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস এর অন্যতম বিশিষ্টতা।
এলিজাবেথ চরিত্রটি এই উপন্যাসের প্রধান আকর্ষণ। সে স্নেহশীল কন্যা, দিদির আদরের বোন ও পরম বন্ধু, প্রয়োজনে কলিন্সের মতো মানুষকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যানে সক্ষম, আবার মিস্টার ফিজউইলিয়মের মতো পুরুষের সঙ্গে সহজ বন্ধুত্বে দ্বিধাহীন। বোনের ভাবী বর হিসেবে মিস্টার বিংলে আগাগোড়া তার প্রশ্রয় পেয়েছে। একসময় মিস্টার ডার্সিকে সে বিপুল সম্পত্তির লোভ পাশে সরিয়ে রেখেই দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে নিজের নৈতিক মর্যাদার জায়গা থেকে। অন্যদিকে রূপান্তরিত পরিস্থিতিতে ডার্সির প্রেমের আহ্বানে সাড়া দিতেও অতীতের সংস্কার বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। এরই বিপ্রতীপে একসময়ে যে উইকহ্যাম তার মনে দোলা দিয়েছিল, তার কদর্য দিক সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর তাকে শীতল প্রত্যাখ্যানে তার একটুও সমস্যা হয় নি। এলিজাবেথ চরিত্রটির দৃঢ়তা ও আত্মমর্যাদার সর্বোৎকৃষ্ট পরিচয় আছে লেডি ক্যাথরিনের সঙ্গে তাঁর চূড়ান্ত কথোপকথনে। বিপুল সামাজিক মর্যাদা, বৈভব ও বয়সের ভার সঙ্গে নিয়ে তাঁকে দুমড়ে দিতে চেয়েছিলেন লেডি ক্যাথরিন, ডার্সিকে তার জীবন থেকে সরিয়ে নিজের মেয়ের সঙ্গে তাকে বেঁধে দিতে চেয়েছিলেন। প্রেম ও আত্মমগ্নতায় দেদীপ্যমান এলিজাবেথ সেই সময়ে যে ভাষা ও ভঙ্গীতে লেডি ক্যাথরিনকে মোকাবিলা করেছে, তা অতুলনীয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উদার মনোভাবই যে এলিজাবেথ চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য তা বোঝা যায় স্ত্রীর অসম্মানের কথা ভেবে লেডি ক্যাথরিনের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ত্যাগে উদ্যত ডার্সিকে সে যখন আবার লেডি ক্যাথরিনের সঙ্গে আত্মীয়তাসূত্রে মিলিয়ে দিতে চায়। নায়িকা এলিজাবেথ চরিত্র চিত্রণে একইসঙ্গে দৃঢ়তা ও কমনীয়তা, হৃদয়বৃত্তি ও বিচক্ষণতা, ধৈর্য ও আকুলতার আশ্চর্য সমন্বয় ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’কে অনন্য করে তুলেছে।

জেন অস্টেনের ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ মূলত একটি প্রেমের উপন্যাস। কিন্তু সময় ও সমাজের নিখুঁত উপস্থাপণ তার মূল্য বহুগুণ বাড়িয়েছে। একালে এই উপন্যাসটিকে একটি পিরিয়ড পিস হিসেবে পড়া সম্ভব, যাতে অষ্টাদশ উনিশ শতকের সন্ধিলগ্নের ইংলণ্ডের সময়কালটি ধরা আছে।
জেন অস্টেন ইংলণ্ডের যে সমাজ পটভূমিতে তাঁর উপন্যাসগুলিকে স্থাপণ করেছেন সেখানে মূলত পাঁচটি শ্রেণি রয়েছে। অভিজাত, জমিদার ভদ্রলোক, বুর্জোয়া মিল মালিক ও ধনী ব্যবসায়ী, শ্রমিক শ্রেণি ও কৃষক শ্রেণি। জেন অস্টেনের উপন্যাসে সমাজের ওপরের স্তরের তিন শ্রেণির মানুষদেরই মূলত দেখা যায়, শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণির তেমন প্রতিনিধিত্ব নেই। অভিজাত মানুষেরা - ডিউক, মার্কুইস, আর্ল, ভাইক্যান্ট ইত্যাদি মাঝে মাঝে উপন্যাসে দেখা দেন বটে, কিন্তু জমিদার ভদ্রলোক ও বুর্জোয়া ব্যবসায়ীরাই জেন অস্টেনের উপন্যাসের মূল চরিত্র। ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ উপন্যাসে লেডি ক্যাথরিন একজন আর্ল এর কন্যা এবং তিনি অভিজাত সমাজের প্রতিনিধি। কর্নেল ফিজ উইলিয়ামও এক আর্ল পরিবারের সন্তান এবং স্যর খেতাবধারী তথা অভিজাত। কিন্তু বিরাট জমিদারী থাকলেও মিস্টার ডার্সির অভিজাত খেতাব নেই, তিনি জমিদার ভদ্রলোক শ্রেণির প্রতিনিধি। অন্যদিকে বেনেট পরিবারও জমিদার ভদ্রলোক শ্রেণিরই মানুষ, যদিও তাদের জমিজমা এবং আয় অনেক কম। উপন্যাসের শেষের দিকে লেডি ক্যাথরিন যখন নায়িকা এলিজাবেথকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, ডার্সির সঙ্গে তার সামাজিক বিন্যাস মেলে না, তখন এ কারণেই এলিজাবেথ লেডি ক্যাথরিনকে মুখের ওপর জানিয়ে দিয়েছিল ডার্সি যেমন একজন ভদ্রলোক জমিদার, সেও তেমনি এক ভদ্রলোক জমিদারের মেয়ে, একই সামাজিক বর্গের মানুষ তাঁরা। বাস্তবে অবশ্য এক সামাজিক বর্গের মধ্যেও তফাৎ কত ব্যাপক হয়ে থাকে, সেটা এই উপন্যাসে বারবার ধরা পড়েছে। ডার্সির বন্ধু এবং এই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র মিস্টার চার্লস বিংলে কিন্তু জমিদার সম্প্রদায়ের মানুষ নন। তাঁদের ধন সম্পদের উৎস পারিবারিক ব্যবসা এবং তাঁরা বুর্জোয়া ব্যবসায়ী শ্রেণির প্রতিনিধি। এঁদের অনেকেই সে সময় জমিদারী কিনে জমিদার ভদ্রলোক শ্রেণিতে প্রবেশের জন্য ব্যাগ্র ছিলেন। চার্লস বিংলের বোন ক্যারোলিন বিংলের মধ্যে এই সংক্রান্ত উদগ্র আকাঙ্ক্ষা আমরা দেখেছি। সমাজের ওপর তলার এই তিনটি শ্রেণির প্রতিনিধিরা নিজ নিজ সামাজিক বর্গের অহংকার ও সংস্কার নিয়ে কীভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কের নানা জাল জটিলতায় জড়িয়ে পড়ে, বিত্ত ও চিত্তের নানামুখী দ্বন্দ্ব কীভাবে আবির্ভূত ও মীমাংসিত হয় – ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ উপন্যাসটি সেই কাহিনীকেই আকর্ষণীয় ও জীবন্তভাবে তুলে ধরেছে।

চরিত্রদের আয় এবং স্বচ্ছলতা কতটা, সেই সম্পর্কে ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এর লেখিকা উপন্যাসে তার বেশ কিছু স্পষ্ট গাণিতিক হিসেব দিয়েছেন। সেই হিসেবকে আজকের মূল্যমানে রূপান্তর করে, এমনকী আমাদের টাকার অঙ্কে নিয়ে এসে আমরা চরিত্রদের আর্থিক সঙ্গতি অসঙ্গতিকে বুঝে নেবার চেষ্টা করতে পারি।
মিস্টার ডার্সির আয় বছরে দশ হাজার পাউন্ড। মিস্টার বিংলের আয় বছরে সাড়ে চার হাজার পাউন্ড। এই আয় আজকের হিসেবে কত? অন্তত তিরিশ গুণ। হয়ত আরো সঠিক বিচারে প্রায় তেত্রিশ গুণ। সেই নিরিখে আজকের ভারতীয় মুদ্রায় প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিসের নায়ক মিস্টার ডার্সির আয়ের পরিমাণ অন্তত বার্ষিক তিন কোটি টাকা। মিস্টার বিংলের আয় এক কোটি পঁয়ত্রিশ লক্ষ টাকার কাছাকাছি। অন্যদিকে মিস্টার বেনেট মারা গেলে সম্পত্তি চলে যাবে নিকটতম পুরুষ আত্মীয় মিস্টার কলিন্সের কাছে, মিসেস বেনেট ও তার কন্যার জন্য সব মিলিয়ে থাকবে মোট পাঁচ হাজার পাউন্ড বা আজকের হিসেবে দেড় কোটি টাকার সম্পত্তি। এই টাকাটা ব্যাঙ্কে রাখলে সুদ বার্ষিক ৫% হলে সুদ বাবদ বেনেট পরিবারের বার্ষিক আয় দাঁড়াবে ২৫০ পাউন্ড। লিডিয়া উইকহ্যামের সঙ্গে বিয়ের পরে তার অংশটি অর্থাৎ মোট এক ষষ্ঠাংশর হিসেব বুঝে নেয় ও তার সম্পত্তি থেকে সুদ বাবদ বার্ষিক আয় দাঁড়ায় বছরে চল্লিশ পাউন্ড, আজকের ভারতীয় মুদ্রায় বার্ষিক এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা বা মাসিক মাত্র দশ হাজার টাকা। উইকহ্যামের স্থায় আকর্ষণীয় কোনও জীবিকা না থাকায় এজন্যই বিয়ের পর তাদের অন্যদের থেকে সাহায্য নিয়ে কৃচ্ছসাধনের মধ্যে দিয়ে দিন চালাতে হত।
সমকালের ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ জেন অস্টেনের উপন্যাসে কমই এসেছে। ‘পারসুয়েশন’ উপন্যাসটিতে নেপোলিয়নের পরাজয়ের পর ব্রিটিশ সেনাদের ঘরে ফেরার প্রসঙ্গ ছিল। প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস এ এসেছে ফরাসী বিপ্লবের পর ফ্রান্স থেকে আসা সম্ভাব্য আক্রমণের মোকাবিলার জন্য স্থায়ী সৈন্যবাহিনীর পাশাপাশি মিলেশিয়া গড়ে ওঠার প্রসঙ্গ। এই ঘটনাপর্বকেই জেন অস্টেন তাঁর উপন্যাসে ব্যবহার করেছেন যদিও ঐতিহাসিক পটটিকে বিস্তারে ব্যবহার করেন নি। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য জেনের দাদা হেনরি অস্টেন নিজেই অক্সফোর্ডশায়ার মিলেশিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৮০১ সালে সেই কাজ থেকে সরে এসে তিনি তাঁর ব্যাঙ্কিং জীবন শুরু করেন। ঠিক কোন বছরগুলির কথা এই উপন্যাসে এসেছে সে সম্পর্কে অবশ্য অস্টেন বিশেষজ্ঞ গবেষকদের মধ্যে কিছু ভিন্নমত দেখা যায়। আর ডব্লু চ্যাপম্যান মনে করেছেন শেষতম পরিমার্জনের পর ১৮১১-১২ সালের সঙ্গেই ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এর ঘটনাপর্ব মিলে যায়। অন্যদিকে পি বি এস অ্যান্ড্রুজ মনে করেছেন ১৮০২-০৩ সালের পুনর্মাজনের সময়কার দিনকালটিই উপন্যাসে অনুসৃত। এই বিতর্কে খুব নির্দিষ্টভাবে প্রবেশ না করে ১৭৯০ থেকে ১৮২০ – ইংলণ্ড ইতিহাসের রিজেন্সি যুগের প্রেক্ষাপটকে ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ ধারণ করে আছে – সাধারণভাবে এটা মাথায় রেখেই আমরা উপন্যাসটির রসগ্রহণ করতে পারি। বস্তুতপক্ষে ফরাসী বিপ্লবের পর জেকোবিয়ান ফ্রান্সের মোকাবিলার আবহেই ইংলণ্ডে মিলেশিয়াগুলি জন্ম নিয়েছিল। নেপোলিয়নের ফ্রান্সের মোকাবিলার সময়কাল, ১৮১৫ অবধিও সেগুলি সক্রিয় ছিল।
সমাজ পরিবেশ আবহর যথাযথ বিন্যাস, প্লট নির্মাণ, চরিত্র চিত্রণে দক্ষতার পাশাপাশি এই উপন্যাসের অনবদ্যতাকে সম্ভব করে তুলেছে অস্টেনের রচনারীতি। বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক সমারসেট মম জেন অস্টেন সম্পর্কে বলেছিলেন, “অতি সাধারণ ও পরিচিত বিষয়ই তাঁর উপন্যাসের অবলম্বন। খুব চমকপ্রদ কোন ঘটনা তাঁর বইতে ঘটে না, তবু একটা পৃষ্ঠা শেষ হতেই পরের পৃষ্ঠায় কী ঘটবে তা নিয়ে পাঠকের কৌতূহল জেগে ওঠে। সে পৃষ্ঠাতেও কিছু ঘটে না, কিন্তু আবার পরের পৃষ্ঠার দিকে পাঠককে টানতে থাকে। এ ক্ষমতা যে ঔপন্যাসিকের আছে, তিনি সবচেয়ে দুর্লভ একটি ক্ষমতার অধিকারী সেটা বুঝে নিতে হবে। ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ উপন্যাসে জেন অস্টেনের এই সংক্রান্ত দক্ষতা আদ্যন্ত ধরা রয়েছে। এজন্যই উপন্যাসটি একইসঙ্গে অসম্ভব জনপ্রিয় ও নান্দনিক মূল্যে অসামান্য।
তথ্যসূত্র -
The cambridge edition of the works of JANE AUSTEN, Pride and Prejudice edited by Pat Rogers, Introduction
James EdwardAusten-Leigh, AMemoir of JaneAusten, by herNephew (London: Richard Bentley, 1870), p. 81.
P. & P. is sold.—Egerton gives £110 for it.—I would rather have had £150, but we could not both be pleased, & I am not at all surprised that he should not chuse to hazard so much.—Its’ being sold will I hope be a great saving of Trouble to Henry, & therefore must be welcome to me.—The Money is to be paid at the end of the twelve month.
https://www.theguardian.com/books/gallery/2017/jul/18/jane-austens-facts-and-figures-in-charts (chart - 3)
The Oxford Illustrated Jane Austen, 3rd edn, rev. M. Lascelles (Oxford: Oxford University Press, 1965), vol. 2, pp. 400–8.
P. B. S. Andrews, ‘The Date of Pride and Prejudice’, Notes & Queries, 213 (1968), 338–42.