জেন অস্টেনের উপন্যাস 'পারসুয়েশান'

পারসুয়েশন উপন্যাসে নায়িকা অ্যানের চরিত্রে কি অস্টেনের ব্যক্তিগত জীবনের ছায়াপাত ঘটেছে? পাঠকের এই কৌতূহল উপন্যাসটির প্রতি আগ্রহের একটি কারণ হতে পারে৷ এটা সত্যি, অস্টেনের কোনো উপন্যাসের পটভূমি ও কাহিনীতে বর্হিবিশ্বের ঘটনার আলোড়ন নেই৷ অস্টেন নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধের শেষে ইংরেজ সেনাদের ঘরে ফিরে এসে প্রেমে পড়বার বাসনার কথা লিখেছেন৷ টলস্টয়ের লেখাতে নেপোলিয়নের আক্রমণের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া যেভাবে বিশদ আকারে এসেছে, জেন অস্টেনের উপন্যাসে অনুরূপ কিছু নেই৷ অস্টেনের ব্যক্তিগত জগত এমনই নিরালা যে তাঁর জীবনী কারেরাও পাঠকের কাছে অস্টেনের জীবনে কোন অবাঞ্ছিত গোপন রহস্য উন্মোচন করে তাঁকে কাঠগড়ায় তুলতে পারেননি৷ এই নিভৃত জগতে সংস্থিত থেকে অস্টেন শেষ জীবনের যখন অ্যানকে পাঠকের কাছে হাজির করলেন, সমালোচকেরা নিশ্চিত হলেন অস্টেন আর কোনো চরিত্রকে ব্যক্তিগত ভাবে এতটা ভালোবাসেননি৷ যদিও Pride and Prejudice - এর এলিজাবেথ বেনেট ও এমা উপন্যাসের নামাঙ্কিত এমা উডহাউস অস্টেনের উজ্জ্বলতম চরিত্র তবু Presuasion-এর অ্যান ব্যতীত অস্টেনের কোনো চরিত্র তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের অনুষঙ্গে চর্চিত হয়নি৷ উপন্যাসটিতে Northanger Abbey বা Mansfield Park - এর মত স্থানগত কিংবা Emma-র মত নামগত মাহাত্ম্য নয়, অ্যানের প্রতি উপরোধ ও নিষেধবার্তার বিমূর্ততা কাহিনীর মুখ্য তাৎপর্য হয়েছে৷ প্রাণবন্ত, অভিমানী এলিজাবেথ বেনেট, Mansfield Park-এর দুঃখিনী সিন্ডারেলা ফ্যানী প্রাইস কিংবা অতি আত্মবিশ্বাসী এমার নির্ভীক তেজস্বিতা নয়, আট বছর তিতিক্ষা ও স্থৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যৌবনের উপান্তে প্রবেশ করে হারিয়ে যাওয়া প্রেমকে পুনরার্জন করে Persuasion-এর অ্যান আজকের পাঠকের হৃদয়ের আরও কাছের চরিত্র হয়েছে৷ এলিজাবেথের মত কুড়ি বছরে অ্যানের প্রেম বিবাহে পূর্ণতা পায়নি৷ পারিবারিক উপদেশ, নিষেধ মেনে উনিশ বছরের অ্যান তার ভালো লাগার মানুষকে ফিরিয়ে দিয়েছে৷ সেই প্রেমিক ফ্রেডেরিক ওয়েন্টওয়ার্থকে আবার ফিরে পেতে অ্যান উপলব্ধি করেছে যৌবনের গ্লানিমা, টের পেয়েছে বয়সের নিঃশব্দ পদচারণা৷ প্রত্যাখ্যাত প্রেমিককে ফিরে পেতে অ্যান জীবনের অনেক আপস সহনীয় করেছে৷ প্রেমের পূর্বরাগ হারিয়ে ফ্রেডেরিকের প্রতি গভীর মায়া deep affection হৃদয়ে ধরে রেখেছে৷ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও লেখক সমালোচক হ্যারল্ড ব্লুম তাঁর The Western Cannon’ বই-এ পশ্চিমী সাহিত্যের চিরায়মান পঁচিশটি গ্রন্থের যে আলোচনা করেছেন সেখানে Democriatic Age --- উনিশ শতকের গণতান্ত্রিক যুগের ইংরাজী সাহিত্যে স্থান দিয়েছেন শুধুমাত্র ওয়ার্ডস ওয়ার্থের কবিতা ও জেন অস্টেনের Persuasion’৷ ব্লুমের এই ব্যক্তিগত নির্বাচনে অনেকেই একমত হবে না এটা স্বাভাবিক৷ ধ্রুপদী পশ্চিম সাহিত্যের বিপুল সম্ভারে শেক্সপীয়র থেকে স্যামুয়েল বেকেট পর্যন্ত সীমানা টেনে পঁচিশ জন কবি কথাকার ও নাট্যকারের নির্বাচন আপতিক ও পক্ষপাতদুষ্ট মনে হবে অনেকের৷ ব্লুমের তালিকায় টি.এস এলিয়ট, বার্ণার্ড শ, দস্তভয়েস্কির অনুপস্থিতি অমার্জনীয় অপরাধ মনে হবে তাদের৷ তবে ব্লুম জেন অস্টেনের জনপ্রিয় পাঁচটি উপন্যাসকে পাশে রেখে অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত ও পঠিতPersuasion-কে পশ্চিমী সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্মারক বিবেচনা করে আজকের পাঠক সমালোচকের সম্মতি পেতে পারেন৷ সমালোচকেরা একমত হবেন, অস্টেনের কমেডি চেতনা আশ্রিত উপন্যাসগুলিতে প্রাণোচ্ছল নায়িকা চরিত্রদের উপস্থিতিতে একমাত্র ব্যতিক্রম অ্যান যে তার ঝিলিমিলি আনন্দহীন জীবনে প্রেমকে দুঃখ ও উদ্বেগের দহনে পরিশুদ্ধ করেছে৷

Persuasion জেন অস্টেনের শেষতম উপন্যাস৷ Emma উপন্যাস লেখার পরেই অস্টেন এই উপন্যাস রচনায় হাত দেন৷ লেখা শেষ হয় ১৮১৬ সালের আগস্ট মাসে৷ পরের বছর ১৮১৭ সালে ১৮ই জুলাই তার প্রয়াণের পর ঐ বছর ২০ ডিসেম্বর Persuasion আর Northanger Abbey উপন্যাস এক সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল৷ অস্টেন ভেবেছিলেন যেহেতু অ্যান এলিয়টের পরিবার কথাই কাহিনীর আধার হবে তাহ The Eliots উপন্যাসের উপযুক্ত নাম করণ হতে পারে৷ কিন্তু যে বিষয় ও ভাবনা কাহিনীর উপজীব্য সেটা এক গুণাত্মক ক্রিয়া৷ তাই উপন্যাসের নামকরণ Persuasion৷ ইংরেজী Persuasion শব্দটির উৎস ল্যাটিন শব্দ Persuasion যা Per ও Suader এই দুই শব্দের যৌগ৷ Per শব্দের ল্যাটিন অর্থ প্রভাব খাটানো Suadere অর্থে প্ররোচিত উপদেশ৷ তাই উপন্যাসের নামকরণের পশ্চাতে নায়িকা অ্যানের উপর আরোপিত উপদেশ কাহিনীকে সামগ্রিক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে৷ কাহিনীর নির্যাসটি তুলে ধরা যাক৷

       উপন্যাসের ঘটনা ক্রম শুরুর সাত বছর আগে অ্যান এলিয়ট বুদ্ধিমান উচ্চাভিলাষী, সুদর্শন নৌসেনা আধিকারিক ফ্রেডেরিক ওয়েন্টওয়ার্থের প্রেমে পড়ে৷ ওয়েন্ট ওয়ার্থ পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা ও দুই পরিবারের অসম আর্থিক স্তরের কারণে ব্যারন বংশের উত্তরাধিকারী উন্নাসিক অ্যানের বাবা স্যার ওয়াল্টার এলিয়ট ও বড় বোন এলিজাবেথ অ্যানের প্রেম ও বিবাহ ইচ্ছাকে অনুমোদন করে না৷ অ্যানের মাতৃ বিয়োগের পর তার মাতৃস্নেহের অভাব মিটিয়েছিলেন যে প্রতিবেশী সেই লেডি রাসেলও অনভিজাত ওয়েন্টওয়ার্থ পরিবারে অ্যানের বিবাহ না মঞ্জুর করেন৷ আমরা বুঝি উনিশ শতকে ইংল্যান্ডের উচ্চ মধ্যবিত্ত সমাজে সামাজিক ডারউইন তত্ত্বের কি রকম অনড় অবস্থান ছিল৷ লেডি রাসেলের উপরোধ অ্যান উপেক্ষা করতে পারে না৷ এক মৌন অভিমানে নিজেকে আবৃত রেখে অ্যান তার যৌবনকে অপচয়িত হতে দেয়৷ তার প্রথম প্রেমের নির্বাপন হয় সম্মিলিত পরিবারিক নিষেধাজ্ঞায়৷ এলিজাবেথ বেনেট ও এমা ছাড়াও অস্টেনের বর্ণময় সৃষ্টি যেমন ক্যাথলিন মরল্যান্ড ও ফ্যানী প্রাইস থেকে সরে এসে পাঠককে উপহার দিয়েছেন, নিরাভরণ গত যৌবনা, অপাপবিবদ্ধ অ্যান এলিয়টকে যার মধ্যে অস্টেন তাঁর মৃত্যুর পূর্বে হয়ত নিজেকে খুঁজেছিলেন৷

       সাতাশ বছর বয়সে অ্যানের জীবনে একদা প্রত্যাখ্যাত ওয়েন্টওয়ার্থের দ্বিতীয় প্রবেশ এক নাটকীয় পরিহাসের মত৷ যে কারণে ওয়েন্টওয়ার্থ অ্যানের জীবনসঙ্গী বিবেচিত হয়নি, মধ্যবিত্ত ওয়েন্টওয়ার্থের নিম্নতর সামাজিক মর্যাদা অ্যানের বিবাহের অন্তরায় হয়েছিল, সে তার কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণে আজ ক্যাপটেন পদে উন্নীত৷ বিভিন্ন দেশে নৌ-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বিজয়ের বরমাল্য তার ভাগ্যে এনেছে প্রভূত আর্থিক সাফল্য৷ ওয়েন্টওয়ার্থের সামাজিক সম্মান আজ ঈর্ষণীয়৷ এদিকে অ্যানের বাবা বেহিসাবী স্বেচ্ছাবিলাসী ওয়াল্টার এলিয়ট ভাগ্যের ক্রুরতায় প্রাচীন অর্থের অহংকার হারাতে বসেছে৷ কেলিঞ্চের বিলাসবহুল খামার বাড়ি অর্থ সংকটের কারণে ভাড়া দিতে বাধ্য হয়েছে ওয়েন্টওয়ার্থের ভগ্ণি পতি অ্যাডমিরলে ক্রফটকে৷ স্যার ওয়াল্টার, বড় মেয়ে এলিজাবেথকে সঙ্গে নিয়ে স্থানান্তরিত হয়েছে বাথ শহরে৷ সেখানে তাদের নিয়মিত সঙ্গ দেয় মিসেস ক্লে সে তাঁর স্বামীকে হারিয়েছে সম্প্রতি৷ বিপত্নীক স্যার ওয়াল্টারের প্রতি মিসেস ক্লের অগোপন দুর্বলতা স্যার ওয়াল্টারকে দ্বিতীয় বিবাহের আশায় আশান্বিত করে৷ অ্যান থেকে যায় কেলিঞ্চে --- বিবাহিত বোন মেরি ও তার স্বামী চার্লস মাসগ্রোভের পরিবারের সঙ্গে৷ ওয়েন্টওয়ার্থের ভগ্ণিপতি ক্রফ্‌ট মাসগ্রোভ পরিবারের প্রতিবেশী হওয়ার কারণে মেরি ও চার্লস আশা করে চার্লসের দুই বোন হেনরিয়েটা ও লুইসা কোন একজনের ওয়েন্টওয়ার্থ পাণিপ্রার্থী হবে৷ অ্যান মেরি ও চার্লসের এহেন কথাবার্তায় উদ্বিগ্ণ হয়ে পড়ে৷ তবু ওয়েন্টওয়ার্থের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা সে হারাতে পারে না৷ অ্যান তার সম্পর্কিত দাদা উইলিয়াম এলিয়েটের প্রেম প্রত্যাখান করে৷ যদিও পুত্রহীন স্যার ওয়াল্টার ভ্রাতুষ্পুত্র উইলিয়ামকে তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী মনস্থির করে অ্যানের সঙ্গে তার বিবাহকে অনুমোদন করেছিল৷ উপন্যাসের শেষে অ্যানকে প্রেরিত চিঠিতে ওয়েন্টওয়ার্থ তাকে জীবন সঙ্গিনী পাওয়ার ইচ্ছা জানায়৷

Persuasion উপন্যাসে কাহিনীর সরল বিন্যাস অ্যান ওয়েন্টওয়ার্থের অনাডাম্বর প্রেমের গল্পকে হৃদয়স্পর্শী করেছে, কারণ উৎসুক পাঠক অ্যানের জীবনে খুঁজতে গেছে লেখিকার আত্ম জৈবনিক উপাদান৷ অ্যানের প্রতি সমাজ ও পরিবারের উপরোধের দমন অস্টেনকে নিশ্চিত বিবিক্ত করেছিল৷ ‘তাঁর না বলা বাণী’ অ্যানের সমমর্মী হয়ে আত্ম প্রকাশ করেছে অ্যানের চরিত্রে৷ অ্যানকে অস্টেন নিজের জীবনে হয়ত প্রতিবিম্বিত করতে চেয়েছেন৷ শেক্সপীয়ারের রোজালিন্ডের মত প্রাণোচ্ছল এলিজাবেথ বেনেট পাঠককে যে ভাবে হর্ষিত করেছে লঘু কৌতুক ও হাস্যরসের সেই জীবনবোধ রোগশয্যাগ্রস্ত অস্টেনের জীবন থেকে তত দিনে হারিয়ে গিয়েছে৷ উপন্যাসে অস্টেন অ্যানের অচপল তিতিক্ষিত চরিত্রের ছায়া অনুগামীনি হয়েছেন৷ অস্টেনের জীবনীকার ক্লেয়ার টোমালিন লিখেছেন পার্সয়েশন উপন্যাসকে অস্টেন উপহার দিয়েছেন তাঁর প্রিয় বান্ধবী লেখিকা মিস শার্প, মার্থা লয়েড, বোন কাসান্দ্রা ও নিজেকে যাদের জীবনে প্রেম ক্ষণিক ঋতুর মত আবির্ভূত হয়ে দ্বিতীয় বার ফিরে আসেনি৷ অস্টেনের জীবনে আইরিশ যুবক ট্রমাস লেফরয়ের স্বল্প স্থায়ী প্রেম ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ পায়নি৷ কিন্তু গতযৌবনা অ্যানকে অস্টেন দ্বিতীয়বার প্রেমের সুযোগ দিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছেন৷ তার ঘনবদ্ধ তমিস্রার জীবনের অবসান ঘটিয়েছেন৷

Persuasion কাহিনীর আধার অনেকটা সিন্ডারেলার অনুরূপ৷ বস্তুত সিন্ডারেলা রূপকথার উত্তর আধুনিক ব্যাখ্যান পশ্চিমী সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের একটি জনপ্রিয় উপাদান৷ মহাকাব্য থেকে উপন্যাসের ধারায় এই তদগত রূপকথার অনুরণন খুঁজে পাওয়া যাবে৷ অস্টেনের উপন্যাসে নায়িকা অ্যান ও তার পরিবারের উপেক্ষিতা, পিতৃ স্নেহবঞ্চিতা৷ ওয়েন্টওয়ার্থের প্রতি অ্যানের গভীর মায়ার আকর্ষণ সত্ত্বেও সুদর্শন ওয়েন্টওয়ার্থের মাসগ্রোভ পরিবারের দুই বোন হেনরিয়েটা ও লুইসার প্রতি দৃশ্যত ভালোলাগা অ্যানের নিরাশার কারণ হয়েছে৷ শেষে অ্যান ও ওয়েন্টওয়ার্থের প্রেমের মধুর সমাপ্তিতে অ্যানের পরিবারের সকলে পরিতাপের সঙ্গে উপলব্ধি করেছে অ্যানের প্রতি তাদের সহানুভূতি এক উদাসীন ভালোবাসাতে নির্দিষ্ট করা ছিল৷ অ্যানের পছন্দ অপছন্দ স্বপ্ণ ও ইচ্ছা --- পরিবারের এমনকি লেডি রাসেলের কাছেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়নি৷ শেক্সপিয়রেব Tempest -এ প্রসপেরোর মতো Persuasion-এ অস্টেন দুঃখের আরতিতে তার জীবনের সমাপ্তির ইঙ্গিত জানিয়ে মিলনের কাহিনী রচনা করেছেন৷ মিরান্ডা ফার্দিনান্দ ও অ্যান ওয়েস্টওয়ার্থ কাহিনী ভিন্ন প্রেক্ষাপটে তাদের রচয়িতার Swan song অন্তিম গান হয়ে উঠেছে৷ অস্টেনের বিদ্রপাত্মক কমেডি চেতনায় মুখ্য নারী চরিত্ররা এলিজাবেথ থেকে অ্যান এলিয়ট --- এক প্রোটেস্ট্যান্ট ইচ্ছাশক্তিতে জীবিত৷ অ্যানের চরিত্র ঐ ইচ্ছাশক্তির আত্মপীড়নমূলক এক কুণ্ঠিত মায়ায় জড়ানো প্রকাশ৷

অস্টেনের ওয়েন্ট ওয়ার্থ চরিত্রকে দেখেছেন একজন স্বয়ং সম্পূর্ণ মানুষের প্রতীকে। তাকে মনে করেছেন সমাজ বিবর্তনের ইচ্ছাশক্তির ফলশ্রুতি৷ 

অস্টেন তাঁর চেনা বৃত্তে তাঁর খণ্ডিত, জীবিত পৃথিবীর সামাজিক পরিমণ্ডল, ও পারিবারিক গৃহস্থালিতে দেখেছেন আভিজাত্যের বিভ্রমে লুব্ধ পিতৃতন্ত্রের দমনমূলক অনুশাসন৷ তবু তিনি মনে করেছেন জীবন নিরীক্ষার সত্যসার পারিবারিক জীবনের মধ্যেই নিহিত৷ তবে ‘পরিবার’ মাত্রই ‘পবিত্র গাভী’ নয়৷ আদর্শ নিষ্ঠা হীন রক্ত সম্পর্কে কখনই নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ সম্ভব নয়৷ অ্যান ও তার বাবা স্যার ওয়াল্টারের সম্পর্কের তিক্ততা সেই সত্যকে তুলে ধরে৷ সাতাশ বছরে অ্যান কিশোরীর জীবন মুগ্দতা হারিয়ে নির্র্মেহে চিনেছে পরিবার জীবনের নির্মম বাস্তব৷ বোন মেরী তার ননদ অসুস্থ লুইসার পরিচর্যা করলেও লুইসার পুত্রের দায়িত্ব নিতে চায়নি৷ অ্যান বুঝেছে পরিবারে নারীর যৌক্তিক অবস্থান সম্পূর্ণভাবে পুরুষের করুণার উপর নির্ভর করে৷ পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ ও পরিবারের সব গল্পের সূচনা ও পরিনতি নারীকে মেনে নিতে হয়৷ এর একমাত্র প্রতিষেধক অ্যান কিংবা এলিজাবেথ বেনেটের মত, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য় মতি এবং কুমুদের মত অবরুদ্ধ জীবনের অর্গল খুলে পরিবার থেকে ছুটি নেওয়া৷ একমাত্র বিবাহই তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারে৷ 

ইংরেজি সাহিত্যে জেন অস্টেনের অবির্ভাব নিঃশব্দ বিপ্লবের মত৷ ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়নের স্টিভেনটন গ্রামে মধ্যবর্গীয় অভিজাত যাজক পরিবারে অস্টেন (১৭৭০-১৮৭১) জন্মেছিলেন৷ রাজা তৃতীয় জর্জের যুগ সেসময়৷ পূর্ববর্তী আলেকজান্ডার পোপ ও জন ড্রাইডেনের সামাজিক শৃঙ্খলা ও ভারসাম্যের সাহিত্য যুগের অবসান হয়েছে৷ লঘুচিত্ত, বিত্তবান, অভিজাত সমাজের কুশীলবদের প্রতি পোপের ব্যঙ্গ বিদ্রুপ ও লপেটাচালের সাহিত্য আর গৌরবান্বিত নয়৷ রক্ষণশীল সাহিত্যের পূজ্যবাদ ড্রাইডেনের সাহিত্য নতুন রোমান্টিক যুগের কবিদের সমালোচনায় ধরাশায়ী হয়েছে৷ সাহিত্যের নবীনতম শাখা উপন্যাসের সমৃদ্ধ ঋতুর কাল সে সময়৷ রিচার্ডসনের ‘পামেলা’ ও ফিল্ডিং-এর ‘টম জোনস্‌’ হয়ে জেন অস্টেনের ‘পার্সুয়েসন’ Persuasion) --- সাহিত্যের ইতিহাসের এই ক্ষুদ্র পরিক্রমণে ইংরাজী উপন্যাসে মধ্যবিত্ত সমাজ ও পরিবারিক চিত্রে সূক্ষ্ম রহস্য ভরা মানবিক সম্পর্কের চিরন্তন ঘাত প্রতিঘাতের কাহিনী অস্টেনের হাতে শুধু আধুনিকই নয় --- একুশ শতকের পাঠকের কাছে ও সমসাময়িকতা লাভ করেছে৷ জেন অস্টেন পূর্ব সামাজিক শিষ্টাচারের Novel of Manners) ধারাকে জনপ্রিয় করেছিলেন স্যামুয়েল রিচার্ডসন ও হেনরী ফিল্ডিং৷ ফিল্ডিং-এর টম জোনসের মত মহাকাব্যীয় পরিসরে পারিবারিক জীবনালখ্য রূপায়ণের উচ্চাকাঙ্ক্ষা অস্টেন দেখাননি৷ ‘পামেলা’ ও ক্লারিসা উপন্যাসের চিত্রিত রিচার্সনের নৈতিক বিশ্বে ধর্মপ্রাণতার পুরস্কৃত জীবনকে উপন্যাসের বিষয়বস্তু করতেও অন্টেন চাননি৷ সামাজিক সঙ্গতি রক্ষার পূর্ব উপন্যাস ধারাকে অনুসরণ করে জীবনকে দেখেছেন গভীর তবু নিরাসক্ত৷ সেই নিরাসক্তিতে স্থিত থেকে প্রবৃত্তির স্বতঃস্ফূর্ততা ও ব্যক্তিগত নৈতিকতার টানা পোড়েনকে উপন্যাসের মুখ্য চালিকা করেছেন৷ সংযত কৌতুকে তাঁর বেড়ে ওঠা চেনা সামাজিক পরিমন্ডলের মধ্যবিত্ত সমাজও পরিবার জীবনে মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, কপটতা, অহংকার ও অহমিকাকে কৌতুকের উপহাসে বিদ্ধ করেছেন৷ মহানগর লন্ডন থেকে দূরে গ্রাম্য ইংল্যান্ডের ক্ষুদ্র শহরের সামাজিক বৃত্তে মানুষের দৈনিক জীবনের ক্ষুদ্রতম পরিসরে আত্মীয় বন্ধুদের নিয়মিত সৌজন্যে সাক্ষাতের বর্ণনা, একত্রিত পরিবারগুলির নৈশআনন্দ অনুষ্ঠান, বল রূম নৃত্য, যেখানে বিবাহযোগ্য তরুণ অরুণীরা মিলিত হয়ে রচনা করে প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবন৷ এমনই এক পরিশীলিত সম্ভ্রান্ত সমাজের জগত জেন অস্টেনের চরিত্রদের বিচরণ ভূমি৷

উনিশ শতকে শিল্প বিপ্লবোত্তর বৈভব ও সামাজিক স্থিতিশীলতার ঐ যুগে অস্টেনের উপন্যাসে সমাজ ও পারিবারিক জীবন চিত্রের উপাদানগুলি এই রকম

(১) শিল্পীর অর্ন্তদৃষ্টিতে ধরা পড়া অভিজ্ঞতার নির্র্মেহ বাস্তব

(২) মুখ্য চরিত্র গুলিতে স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে রীতির সংঘাত

(৩) ব্যক্তিগত নৈতিকতার সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া সামাজিক ও আর্থিক ঔচিত্যবোধ

(৪) সর্বোপরি অস্টেনের উপন্যাসে নারীর প্রত্যয়ী আনুগত্যেও তার দৃপ্ত স্বাধীন ভূমিকা৷

স্মার্ট ফোনে বিশ্ব মানচিত্রের উপর চোখ রেখে দেখুন৷ আটলান্তিক মহাসাগরে ইউনিকর্ন সদৃশ এক ক্ষুদ্র দ্বীপ ব্রিটেন আজ থেকে দুশো বছর আগেও ছিল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী দেশ৷ উনিশ শতকে জেন অস্টেনের যুগে ঐ দ্বীপটির রাজনৈতিক প্রভুত্ব ছিল বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ দেশে যাদের নিষ্কাশিত হোমে ব্রিটেন ছিল পৃথিবীর ধনীতম দেশ আর ভারতবর্ষ ছিল তার বৃহত্তম উপনিবেশ৷ বিজিত বঙ্গদেশ ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশের প্রথম গড়৷

       ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজউদদৌলার পরাজয়ের পর কোম্পানীর আমলে ব্রিটিশ শাসন নিশ্চিত হলে তার অন্যতম সাংস্কৃতিক পরিণতি হয়েছিল এ বঙ্গে ইংরাজী শিক্ষার সুত্রপাত ও বিস্তার, যার অভিঘাত পরবর্তী একশ বছরে বাঙ্গালি মননে উপপ্লবী আলোড়ন এনেছিল৷ পলাশী বিজয়ের আট দশক পর ১৮৫৩ সালে লর্ড মেকলের ইংরাজী শিক্ষা আইনের প্রস্তাব বড়লাট বেটিংক দেশে কার্যকর করার পর ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হলে তার আওতায় সুদুর আগ্রা থেকে রেঙ্গুন পর্যন্ত কলেজগুলিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল বিজয়ী জাতির সাহিত্যের পাঠক্রম৷

       আমরা অবাক হই না ব্রিটিশ রাজত্বের দুশো বছর পর আজও আমাদের মত পূর্ব উপনিবেশিক দেশগুলিতে শেক্সপিয়রের নাটক, ডিকেন্স, জেন অস্টেনের উপন্যাস, ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা প্রতিনিধিত্ব মূলক সাহিত্যের গুরুত্ব পায়৷ আমাদের দেশে বিশ্ব বিদ্যালয়ের পাঠক্রমে উত্তর আধুনিক প্রতিরোধী সাহিত্যের অগ্রাধিকার সত্ত্বেও চিরায়ত বা বলা যায় প্রত্ন আধুনিক শেক্সপিয়র, জেন অস্টেনের অন্তর্ভুক্তি আজও নিশ্চিত৷ আজ থেকে দুশো বছর আগে শিক্ষায় অনগ্রসর বঙ্গ জাতির আলোক প্রাপ্ত হওয়ার উন্মেষ পর্বে পশ্চিমী সমাজ, সংস্কৃতি ও উন্নত সভ্যতার বাহন ইংরেজী সাহিত্য তার আত্মার শুশ্রূষা করেছিল এবং তাতে কোন সংকোচ ছিল না৷

       বাংলা সাহিত্যের উপন্যাসের সৃষ্টি ও সিদ্ধি দুইই বঙ্কিমচন্দ্রের কল্যাণে৷ তাঁর জন্ম ইংরেজি উপন্যাসিক জেন অস্টেনের মৃত্যুর (১৮১৭) একুশ বছর পরে (১৮৩৮)৷ বঙ্কিম চন্দ্রের অন্যতম জনপ্রিয় উপন্যাস ‘বিষবৃক্ষে’ (১৮৭৩) কুন্দনন্দিনীর আত্মবলিদানে পাঠকের হাহাকার আজও অপ্রশমিত৷ তবু তার জীবনের গ্লানির দহন ভুলে থাকতে বাঙালি পাঠক সুদূর ইংল্যান্ডের ক্ষুদ্র শহরের পটভূমিতে জেন এস্টেনেরPride and Prejudice-এ এলিজাবেথ ও ডার্সির প্রণয়ের মান অভিমান পর্বের সম্মোহিত পাঠক হয়েছিল৷ জার্সির ‘আত্মগর্বী’ অভিজাত্যের প্রতি এলিজাবেথের ভ্রান্ত ব্যক্তিগত বিরাগ ও তার প্রতি ডার্সির উন্নাসিক অবিশ্বাস শেষে যুগলের মিলনে সমাপ্ত হয়েছে৷

       শেক্সপীয়র ও জেন অস্টেনের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি আজও৷ এ দেশে ইংরেজি সাহিত্য প্রেমী পাঠক সমাজের কাছে ২০২৫-এ অস্টেনের আড়াইশো তম জন্মবর্ষে বাঙালির শ্রদ্ধা অর্পণ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়৷ এর এক ঐতিহাসিক সামাজিক প্রেক্ষাপট আছে৷ প্রাথমিক পর্বে বাংলা গার্হস্থ্য উপন্যাসে সামাজিক শ্রেণি বৈষম্যের বিষয় চরিত্রদের সংবেদী মনের সূক্ষ্মতম প্রকাশ, নায়ক-নায়িকার প্রেমানুভূতির আকর্ষণ বিকর্ষণে মানসিক আলোড়ন, প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার প্রতি ব্যঙ্গ বিদ্রুপ ও লঘু চপল কৌতুকের অনায়াস বিচরণের ঐতিহ্য কোথাও জেন অস্টেনের উপন্যাসের বিষয়বস্তু ও ভাবগত আবেদনের সমধর্মী৷ তাছাড়া শিক্ষায়তনিক (academic) ও জ্ঞান জাগতিক পরিসরেও জেন অস্টেনের কর্মের মূল্যায়নে সাহিত্যে জীবিদের একটি দায় থেকে গেছে৷