জেন অস্টেনের “সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি” : নারীর কণ্ঠস্বর

জেন  অস্টিনের প্রথম উপন্যাস "সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি”। প্রথম উপন্যাসেই তাঁর লেখার ধরনের  সঙ্গে পরিচয় পায়ে পাঠক। রিজেন্সি পিরিয়েডের পারিবারিক রোম্যান্স অবলম্বন  করে এই উপন্যাসের বিস্তার। রচয়িতা মহিলা তাই স্বাভাবিক ভাবেই আমরা প্রত্যাশা করি নারীকেন্দ্রিক আখ্যান। পুরুষ চারিত্রগুলো যথেষ্ট জটিল হলেও তাদের মূলত পার্শ্ব চরিত্র হিসেবে দেখা হয়। প্রশ্ন হল মহিলা ঔপন্যাসিকের লেখাতে মহিলা চরিত্রের বর্ণনা কি বেশি প্রামাণিক? সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে গাইনোক্রিটিসিজম একটা বিশেষ ধারা, যেখানে ধরে নেওয়া হয়ে মহিলাদের লেখার একটা বিশেষ ধরন আছে। অর্থাৎ কিনা রচয়িতার লিঙ্গ পরিচিতি একভাবে লেখার বুননকে নির্ধারিত করে। এই ধরনের লেখার নিবিড় পাঠে একধরনের  মেয়েলি কণ্ঠস্বর শোনা যায়। প্রশ্ন থেকে যায় জেন অস্টিনের লেখাকে কি এভাবে দেখা যায়?

আমি এখানে “সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি” উপন্যাসটা নিয়ে লিখতে চাইনা। বরঞ্চ  “সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি” উপন্যাসের একটা বিশেষ চলচ্চিত্রায়ন নিয়ে কথা বলব। ১৯৯৫ সালে “সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি” উপন্যাসের  একটা এডাপটেশন  হয় যেটা করেন অ্যাং লি। এই এডাপটেশনটা বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল। এই ছবিটা অস্কার ও গোল্ডেন  গ্লোব অ্যওয়ার্ড পেয়েছিল এবং ছবিটার চিত্রনাট্য করেন এমা টমসন। টমসন এই চিত্রনাট্যের জন্য শ্রেষ্ঠ অ্যাডাপটেড স্ক্রিনপ্লের পুরস্কার পান। এই চিত্রনাট্যটাই ছবির মেরুদণ্ড। এক্ষেত্রে কাহিনীকার ও চিত্রনাট্যকার দুজনেই মহিলা। ছবির কাহিনী অবশ্যই মহিলাকেন্দ্রিক। আমার এখানে দেখার উদ্দেশ্য এই ছবিতে নারীর কন্ঠস্বর  কিভাবে প্রকাশ পেয়েছে।

একটা বিষয়  সতর্ক থাকা উচিত যে জৈবিক ভাবে নারীর লেখা মাত্রই তা নারীবাদী বয়ান হবে এমনটা নয়। মহিলা লেখিকার অবস্থান পুরুষতান্ত্রিক হতেই পারে। একইসঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক লেখালিখির  জগতে নারীর আত্মপ্রকাশ অবশ্যই পুরুষতান্ত্রিকতার একধরনের প্রতিবাদও বটে। বিশেষ করে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যখন জেন অস্টিন  লেখিকা হিসেবে অত্মপ্রকাশ  করছেন। জেন আস্টিন তার প্রথম উপন্যাসেই ইংল্যান্ডের জেন্ট্রি সমাজের সামাজিক জীবন যেভাবে তুলে ধরেছেন সেখানে মহিলা লেখিকার দৃষ্টিকোণ খুবই স্পষ্ট।

বৃদ্ধ ড্যাশউডের  মৃত্যুর পর যখন  তাঁর নরল্যান্ড পার্ক এস্টেট তাঁর প্রথম পক্ষের ছেলের মালিকানাধীন হয় তখন স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ও তিন কন্যা বঞ্চিত হয়ে পরে। তৎকালীন ইংল্যান্ডে মেয়েরা সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। ফলত এই ড্যাশউড কন্যাদের ভাগ্য নির্ভর করছিল তাদের বৈবাহিকসূত্রে পাওয়া সৌভাগ্যের উপর। প্রথম দুই কন্যা যেহেতু বিবাহযোগ্য তাই বাবার মৃত্যুর পর থেকেই তারা সুযোগ্য পাত্র নির্বাচনের প্রতি মনোযোগী। অস্টিন  এখানে এই আর্থ-সামাজিক  পরিস্থিতির কোন সমালোচনা করেননি কিন্তু তাঁর সমবেদনশীল লেখা এই মেয়েদের পরিস্থিতি চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। ড্যাশউড  মেয়েদের ভবিতব্য যে তাদের প্রেম ও বিবাহিত জীবনের সাফল্যের উপর নির্ভরশীল তা তিনি একভাবে মেনে নিয়েছেন। আপাতভাবে মনে হয় পুরুষতান্ত্রিক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ফলে তার লেখায় নারীবাদী উষ্মার অভাব। অর্থাৎ তাঁর সমবেদনশীলতা  নারীকেন্দ্রিক উপন্যাসের জন্ম দিলেও তাতে নারীর সমানাধিকারের দাবী নেই। কিন্ত এক্ষেত্রে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে  অস্টিনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত। তিনি যখন লিখছেন তখন ইংল্যান্ডে মেয়েদের  পৈতৃক সম্পতিতে অধিকার সুরক্ষিত ছিল না। জেনট্রি শ্রেণীভুক্তো মেয়েদের জন্য কোন পেশাও ছিল না। আজকের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে তাঁর কাছ থেকে নারীবাদী সাম্যের দাবী করা অবশ্যই উচিত নয়। এখানে আমি দেখতে চেয়েছি ছবিটা  কি লেখিকার লিঙ্গ পরিচয় দ্বারা কোনভাবে  প্রভাবিত? অর্থাৎ  কিনা নারীবাদী পাঠ্য হিসেবে না দেখলেও এই উপন্যাস  তথা চলচ্চিত্রে নারীকেন্দ্রিকতার  তাৎপর্য কি অন্যভাবে দেখা যায়?

পাঠ্যের শরীর এবং পাঠকের মনন এই দুয়ের  দ্বান্দিকতায় পাঠ্যের অর্থ তৈরী হয়। পাঠ্যের অন্তর্নিহিত অর্থ আসলে একটা বিশেষ পাঠ। ১৮১১ তে যে উপন্যাস লেখা হয়েছে আর ১৯৯৫ এ যে চলচ্চিত্র বানানো  হয়েছে  তার মধ্যে  একটা দীর্ঘ  সময়ের ব্যাবধান। এমা টমসন  অর্থাৎ যিনি চিত্রনাট্য লিখেছেন তাঁর আবস্থানটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি  বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকের কেমব্রিজ শিক্ষিত মহিলা। তাঁর ভাবনাচিন্তায় নারীবাদী ভাবধারা প্রচ্ছন্ন। একই সঙ্গে তিনি একটা জনপ্রিয় সাহিত্যের চলচ্চিত্রায়ন করেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি তাঁর নারীবাদী ভাবনাকে মূলধারার অন্তর্গত করতে চেয়েছেন। এটা বোঝা যায় তাঁর এডয়ার্ড ও ব্র্যাডনের চরিত্রায়নের মধ্যে দিয়ে।  টমসনের পুরুষেরা অনেক বেশী নরম। পুরুষালী উগ্রতার পরিরর্তে নারীসুলভ সহমর্মিতা তাদের মধ্যে স্পষ্ট। এই পুরুষেরা সমকালীন মহিলা দর্শকের কাছে অনেক প্রিয়। টমসনের পুরুষ চরিত্রায়ন আস্টিন অপেক্ষা মর্মস্পর্শী।  হিউ গ্র্যান্ট এডয়ার্ড হিসেবে এবং রিকম্যান কলোনেল ব্র্যাডন হিসেবে যথেষ্ট যৌন আবেদনপূর্ণ। ব্র্যাডনের দুখী, দূর্বল চরিত্র তাকে সত্যিকারের নায়কে পরিণত করেছে। বিশেষত মারিয়ানের অসুস্থতার সময় তাঁর অভিব্যক্তি তাঁকে  নরম অথচ কর্তব্যপরায়ন হিসেবে প্রকাশ করে। সে এলিজা উইলিয়াম ও তার মেয়েকে সামাজিক অসন্মান থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হলেও মারিয়ানকে উদ্ধার করতে সক্ষম। অস্টিন ওয়েলোবির চরিত্রকে যতটা  জীবনীশক্তিতে পূর্ণ ও আকর্শনীয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন টমসন সেই সবটাই দিয়েছেন এডয়ার্ড ও ব্র্যাডনের চরিত্রে। তাঁর পুরুষেরা অনেক বেশী পারিবারিক। এটা বোঝা যায় এডয়ার্ডের সঙ্গে মার্গারেটের সম্পর্কে। ছবিতে যেভাবে তাদের সখ্যতা দেখানো হয়েছে উপন্যাসে  তা অনুপস্থিত। এডয়ার্ড ও মার্গারেটের তলোয়ার লড়াই বা দুজনের পৃথিবীর মানচিত্র নিয়ে  কৌতুহল উপন্যাসে নেই। এডয়ার্ড ও মার্গারেটের এই সখ্যতা এডয়ার্ডকে নরম পারিবারিক পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। ব্র্যাডন ও মার্গারেটের আলাপচারিতায়ও দেখি একধরনের বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যাবহার। বিশেষত মার্গারেট  ব্র্যাডনের উপনিবেশ সফর নিয়ে উৎসাহী।

শুধু নারীবাদী ভাবনা নয়, উপন্যাসের ভাষা নির্ভর বর্ণনাকে দৃশ্যগ্রাহ্য বর্ণনায়  রূপান্তরও একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল থমসনের কাছে। এটা যেন অনেকটা উপন্যাসটাকে নতুন করে সাজানো। উপন্যাসে এলিনর লুসি স্টিলের কাছে এডয়ার্ডের হাতে লেখা চিঠি দেখে বিশ্বাস করে তাদের  সম্পর্কের কথা।  ছবিতে  দেখি লুসি ই সি এফ লেখা রুমাল ব্যবহার করছে যার আবেদন অনেক বেশী দৃশ্যগ্রাহ্য। দৃশ্যগ্রাহ্য  আবেদন তৈরি করতে মারিয়ানকে দেখা যায় ওয়েলোবির  ছবি আঁকতে। উপন্যাসে এডয়ার্ড ও ব্র্যাডন অনেকটা সময়  অনুপস্থিত কিন্তু থমসন তাঁর চিত্রনাট্যে তাদের নিয়ে আলোচনা সবসময় জিইয়ে রেখেছে্ন। পুরুষ চরিত্রদের অপেক্ষাকৃত রোম্যান্টিক  হিসেবে পেশ করতে থমসন সবসময়ে চেষ্টা করেছেন। তিনি মনে করেন চলচ্চিত্রের দর্শক সাহিত্যের পাঠক অপেক্ষা বেশী রোম্যান্স দাবী করে। তিনি  এডয়ার্ড ও এলিনরের মধ্যে  চুম্বনের দৃশ্য কল্পনা করে ছিলেন যা পরে লি বাতিল করে দেন।

চলচ্চিত্রায়নের  মাধ্যমে পাঠ্যের  গঠন যেমন পরিরর্তিত হয়েছে তেমনই পরিবর্তিত হয়েছে দর্শকের চরিত্র।  আমাদের এখানে খেয়াল রাখা উচিত অস্টিনের পাঠক ও থমসনের  দর্শকের মধ্যে  বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। থমসন তাঁর ডাইরিতে লিখছেন তাঁর চিত্রনাট্যকে কেন্দ্র করে তিনি নানান ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন। সমকালীন দর্শকের কাছে অস্টিনের সময়কালের আর্থসামাজিক অবস্থা বোঝাটা অনেক সময়েই সহজ নয়। তাই তারা প্রশ্ন করে , ড্যাশউড কন্যারা কেন চাকরি করতে যায়নি বা এডয়ার্ড কেন তার মায়ের উপর এত নির্ভরশীল। কেন সে লুসিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যখন সে আদতে লুসিকে ভালবাসে না, ইত্যাদি। ছবিতে মার্গারেট ও এলিনরের  মধ্যে কথোপকথন খানিকটা হলেও এই প্রশ্নগুলোকে মেলে ধরেছে। ট্রিহাউসেরর দৃশ্যে এলিনর  মার্গারেটকে বোঝায়  যে আইনত বাবার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় ছেলে, মেয়ে নয়। আবার এই  এলিনরের এডয়ার্ডের কাছে অনুযোগ করে যে জেন্ট্রি  সমাজের মেয়েদের  উপার্জনের অধিকারও নেই। অর্থাৎ বিবাহ, সম্পত্তি এবং পরিবারের ক্ষেত্রে মেয়েদের অসহায় অবস্থাটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

নারীর প্রেম ও বিবাহ কেন্দ্রিক ঘটনাবলী আসলে এখানে  নারী জীবনের  সার্থকতার সূচক। মূলধারার ছবিতে আমরা এটাই দেখে থাকি। এই  আখ্যানের বিপরীতমুখী কোন আখ্যান  হলে তবেই আমরা তাকে প্রতিবাদী বয়ান ভাবি। সমালোচকদের একাংশ  মূলধারার ছবিকে  তাই মনে করেন স্থিতাবস্থা বজায় রাখার হাতিয়ার। এই ভাবনা থেকেই মূলধারাকে অবজ্ঞা করার একটা মনোভাব তৈরী হয়। কিন্তু মূলধারাকে আবজ্ঞা করার  সঙ্গে মিশে থাকে একধরনের উন্নাসিকতা যা সাধারণ পাঠকের বিবেচনা বোধকে প্রশ্ন করে।  “সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি” উপন্যাসটা ও তার  ১৯৯৫র চলচ্চিত্রায়নের মধ্যে  সময়ের ব্যবধান থাকলেও দুটো পাঠ্যই মূলধারার অন্তরভুক্তো এবং  নারীকেন্দ্রিক উপস্থাপনার একটা ধরন।  এখানে বলা ভালো নারীকেন্দ্রিক উপস্থাপনার   ক্ষেত্রে নারী শুধু বিষয় নয়, বিষয়ীও বটে। মেলোড্রামা, সোপ অপেরা এগুলোকে সাধারণ ভাবে মেয়েদের ছবি হিসেবেই দেখা হয়। কিন্তু মেয়েরা এখানে সক্রিয় পাঠক। আগেই বলেছি পাঠ্যের শরীর এবং পাঠকের মননের দ্বান্দিকতায় পাঠ্যের অর্থ তৈরী হয়। অর্থাৎ  এই দুয়ের মধ্যে একধরনের নেগোশিয়েশন ঘটে।  নেগোশিয়েশন বলতে এখানে একধরনের টানাপড়েনের  কথাই বলা হচ্ছে। পাঠ্যের  আপাত পাঠ ও লেখাকে নিবিড়ভাবে  অনুসরণ করার মধ্যেকার টানাপড়েন।  অস্টিন এখানে নারীর  প্রেম ও বিবাহকে কেন্দ্র করে যেমন পারিবারিক রোম্যান্টিক আখ্যান তৈরী করেছেন তেমনই তার পাঠিকারা একধরনের বিসমকামী রোম্যান্সের স্বাদ পান। এই রোম্যান্সের ক্ষেত্রে কোর্টশিপের ধারনা খুব গুরুত্বপূর্ণ।। তৎকালীন ইংরেজ সমাজে প্রাক বিবাহ নারী পুরুষের  কোর্টশিপ প্রচলিত ছিল। এই কোর্টশিপ ছিল একে অপরকে চেনা জানার সুযোগ ও প্রেমে পরার অবকাশ। এর মাধ্যমে বিবাহ ব্যবস্থাকে  অটুট রাখার চেষ্টা যেমন দেখা যায় তেমনই বিবাহ প্রসঙ্গে নারীর সক্রিয় মতামত দেবার সুযোগ তৈরী হয়। এই কোর্টশিপের আবেদন তাই আস্টিনের সময়কালে যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনই থমসনের দর্শকের কাছেও গ্রহণীয়। বিশেষত মহিলা দর্শকদের উপর এর প্রভাব উল্লেখযোগ্য। পাঠিকার এই আকাঙ্ক্ষা অনেক্ষেত্রেই তাদের ব্যাক্তিগত জীবনে রোম্যান্সের অভাবের উপর নির্ভরশীল। ব্যাক্তিগত জীবনে যে  রোম্যান্স থেকে তারা বঞ্চিত সেই  রোম্যান্সের স্বাদ তারা উপন্যাস বা ছবিতে পেতে চান। তারা নিজের মত করে পাঠ্যের মানে তৈরী করেন।  তবে  অস্টিনের  উপন্যাসের রোম্যান্টিক  টানাপড়েন এক ধরনের পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর উপর প্রতিষ্ঠিত। এই পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোয় নারী  পুরুষের উপর নির্ভরশীল এবং তার জীবনের সার্থকতা কেবলমাত্র সুখী দাম্পত্য জীবনে। অস্টিন এই পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো বা মানসিকতার বিরোধিতা করেননি কোথাও। কিন্তু পাঠ্যের নিবিড় পাঠে ড্যাশউড কন্যাদের একধরনের সক্রিয়তা দেখা যায়। বিশেষ করে মারিয়ানের সঙ্গে ওয়েলোবির সম্পর্কের ক্ষেত্রে মারিয়ান তার অনুভূতি অপকটে প্রকাশ করে। এই সম্পর্ককে সে একভাবে উদযাপন করে। সে আদতে রোম্যান্টিক এবং একেবারেই মুখচোরা নয়। ওয়েলোবির সঙ্গে তার প্রথম দেখাও নাটকীয় ভাবে। বৃষ্টিতে ভিজতে গিয়ে তার যখন পা মচকায় তখন ওয়েলোবি তাকে উদ্ধার করে বাড়ি পৌছয়ে দেয়। প্রথম পরিচয় থেকেই মারিয়ান ওয়েলোবির প্রেমে পরে । এই প্রেমে পরার পিছনে সুযোগ্য পাত্রের চাহিদা প্রচ্ছন্ন থাকলেও এর মধ্যে দিয়েই মারিয়ান নিজের পছন্দকে প্রকাশ করে। এভাবে দেখলে ওয়েলোবিকে পছন্দ করা মারিয়ানের স্বাধিকারের বহিঃ প্রকাশ। পরে যদিও সে কলোনেল ব্র্যাডনকে বিয়ে করে। মারিয়ান  ও ওয়েলোবির রোম্যান্স চমৎকার ভাবে ফুটে ওঠে তাদের সেক্সপিয়ারের সনেট ১১৬ পাঠের মধ্যে দিয়ে। মারিয়ান কে এখানে আমরা দেখি আবেগপ্রবণ। সে কোন সামাজিক প্রথাকে তোয়াক্কা না করেই আবেগের প্রকাশ করে। এর আগে সে দিদির প্রেমিক এডয়ার্ডকে বাতিল করতে চেয়েছিল তার আবেগবিহীন সেক্সপিয়ার পাঠ শুনে। ওয়েলোবি যখন তাকে প্রত্যাক্ষান করে সে অসুস্থ হয়ে পরে। এই প্রত্যাক্ষান তার অস্তিত্বের সংকট ডেকে আনে। সে যতটা নিজের আবেগকে প্রকাশ করে তার দিদি ততটাই চাপা স্বভাবের। এলিনর আত্মমগ্ন ও সল্পভাষী । সে যেমন এডয়ার্ডের প্রতি তার অনুরাগ প্রকাশ করেনি তেমনই এডয়ার্ড ও লুসি স্টিলের এনগেজমেন্টের কথাও কাঊকে  জানায়নি। একদিক থেকে দেখতে গেলে এটা শুধু দুটো মেয়ের গল্প নয় এটা তাদের পারস্পরিক  ভালবাসার গল্প। তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট আলাদা। এলিনর যুক্তিবাদী মারিয়ান রোম্যান্টিক, আবেগপ্রবণ। কিন্তু দুজনের মধ্যে বৈপ্যরিত্য থাকা স্বত্তেও তারা দুজনে পরস্পরের পরিপূরক।   বিশেষত মারিয়ানের অসুস্থতার সময় এলিয়নরের অভিব্যাক্তি  বোনের প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশ। দুজনের কাছেই প্রেম এবং বিবাহ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বেঁচে থাকার একটা পন্থা। কিন্তু সেটাই সব নয়। প্রেম তথা পুরুষ সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের সক্রিয়তার মধ্যে নারীর প্রতিস্পর্ধা প্রকাশ পায়। তারা প্রেমে আঘাত পেলেও নিজেদের অনুভূতি প্রকাশে দ্বিধাগ্রস্থ নয়। অর্থাৎ আমি বলার চেষ্টা করছি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তাদের অবস্থান যাই হোগ না কেন তাদের আত্মপ্রত্যয়ের অভাব নেই। পাঠক বিশেষত মহিলা পাঠক যখন ছবিটা দেখে তখন তারা এই সক্রিয়তাকে উপভোগ করে। অনেক্ষেত্রেই পাঠিকারা নিজেদের জীবনে যে প্রেমে বঞ্চিত রূপালী পর্দায় তার উপস্থাপনা দেখতে উদগ্রীব। এখানে প্রশ্নটা নারীর সমানাধিকারের নয়। এখানে বিষয়টা নারীর আত্মতৃপ্তির তথা  অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। যদিও এই ধরনের রোম্যান্টিক আত্মপ্রকাশ পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত তবুও এর মধ্যেই নারীর সক্রিয়তাকে আমরা উপভোগ করি।

                             

ছবিটা শেষ পর্যন্ত দুই মহিলার প্রেম জীবনের সাফল্যের কাহিনী। মারিয়ান ওয়েলোবির দ্বারা প্রতারিত হয়েও শেষ পর্যন্ত কলোনেল ব্র্যাডনকে  সঠিক জীবনসাথী হিসেবে বেছে নেয়। ছবিটা  শেষ হয় ব্র্যাডন ও মারিয়ান বিয়ে করে চার্চ থেকে বেরচ্ছে এরকম একটা দৃশ্যে। তাদের পিছনে এলিনর ও এডয়ার্ড, যাদের আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। উপন্যাসে আমরা দেখি ওয়েলোবি ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে ড্যাশউড কন্যাদের কাছে যায় কিন্তু  থমসন তাঁর চিত্রনাট্যে  এটা বাদ দেন। থমসন দেখান ওয়েলোবি দূর থেকে বিয়ের অনুষ্ঠান দেখছেন। ব্র্যাডন বিয়ের পর আকাশে সোনার পয়সা ছুঁড়ছেন এবং ক্যামেরা সেই দৃশ্য ফ্রিজ করে। থমসন যথার্থই বলেছেন  ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’ আদতে ভালবাসা ও অর্থের গল্প।

ছবিটা শুরু হয় যে সমস্যাপট থেকে অর্থাৎ কিনা ড্যাশউড কন্যাদের পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চনা, তার সমাধান হয় বিবাহযোগ্য দুই কন্যার  সঙ্গী নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে। এই সমাধান অবশ্যই  পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত কিন্তু সমাধানে পঁঔছনোর  জন্য যে ঘটনাপ্রবাহ বোনা হয় তাতে মেয়েদের ব্যাক্তিগত  জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায়। এটা  নারীর  ক্ষমতায়নের গল্প না হলেও নিঃসন্দেহে নারীর অনুভূতির  বহিঃপ্রকাশের গল্প তো বটেই। নারীকেন্দ্রিক এই লেখা শুধু মহিলা ঔপ্যন্যাসিকের লিঙ্গ পরিচয়ের দ্বারা চিহ্নিত নয়, মহিলা পাঠকদের আত্মতৃপ্তিরও সুযোগ করে দেয়। এইভাবে দেখলে এই ছবিটা শুধু মেয়েদের গল্প নয় মেয়েদের জন্য বানানো ছবিও বটে। উপন্যাস ও চলচিত্রের মধ্যে সময়ের ব্যবধান এই অনুষঙ্গকে পালটাতে পারেনি।