জেন অস্টেন ও সমকালীন ইংলণ্ড

জেন অস্টেন যে সময়টায় বড় হয়ে উঠছিলেন, লেখালিখি করছিলেন, সেটা ইতিহাসের এক ঝোড়ো সময়। ১৭৭৫ এ জেন অস্টেনের জন্ম। তার আঠারো বছর আগে পলাশীর যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হয়েছে। আর জেনের জন্মের চোদ্দ বছরের মাথায় ঘটবে ফরাসী বিপ্লব, যা ইতিহাসকে বদলে দেবে, সূচনা করবে এক নতুন যুগের। জেনের জন্মের বছরটি থেকেই শুরু হওয়া আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের কথাও এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার। ইংলণ্ড তথা ইউরোপ ও বিশ্ব ইতিহাসের সেই আলোড়ন তোলা সময়টা থেকে পেছনে, মধ্যযুগে ফিরে গেছিলেন স্যর ওয়াল্টার স্কট। আর জেন রাজনৈতিক উতরোলের বাইরে থাকা গ্রামীণ অভিজাতদের প্রেম বিবাহকে তাঁর উপন্যাসের উপজীব্য করেছিলেন। জেন অস্টেনের মতোই আর এক পৃথিবী বিখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স যেভাবে সমকাল দ্বারা স্পৃষ্ট হয়েছিলেন, তাঁর উপন্যাসকল্পনা ‘এ টেল অব টু সিটিজ’ এ যেভাবে ফরাসী বিপ্লবের সময়টাকে ধরেছিল বা অগুন্তি লেখায় ইংলণ্ডের সমকালীন সমাজ পরিবেশকে যেভাবে এনেছিলেন ডিকেন্স, তার একেবারে অন্য মেরুতে দাঁড়িয়ে আছেন জেন অস্টেন।

কিন্তু এতদ সত্ত্বেও এরকম একটা হঠকারী সিদ্ধান্ত আমরা নিয়ে নিতে পারি না যে জেন অস্টেন একজন সময় সমাজ রাজনীতি বিযুক্ত উপন্যাসকার, রোমান্টিক আখ্যানের জন্ম দিয়ে পাঠকের মন মাতানোই যার প্রধান ও পরম উদ্দেশ্য। এভাবে দেখাটা সাহিত্যের অত্যন্ত যান্ত্রিক বিশ্লেষণ হবে। ইতিহাসের দূরগত সময়কাল সম্পর্কেও ধারনাটিও হবে একপেশে।

জেন অস্টেনের ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এ ইংলণ্ড ও ফ্রান্সের যুদ্ধের আবহে তৈরি মিলেশিয়ার প্রসঙ্গ গুরুত্ব নিয়ে এসেছে বা ‘ম্যানসফিল্ড পার্ক’ এ রয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কলোনিতে বাণিজ্য ও মুনাফার কথা অথবা পারসুয়েশন এ নৌ বাহিনীর ক্যাপ্টেনদের কথা - কেবল এইসব মনে রেখেই আমরা জেন অস্টেনকে সময় সচেতন বলছি না। জেনের উপন্যাসে সমাজ ও সময় চেতনা কীভাবে অভিব্যক্ত তা বুঝতে হলে ঘটনার আলোড়নের বাইরে গিয়ে আমাদের তাকাতে হবে উপন্যাসের অন্তর্বয়ানের দিকে।

কিছুক্ষণের জন্য ধরে নেওয়া যাক একজন পাঠকের কথা যিনি আমাদের মতো দূর দেশকালে বসে জেন অস্টেন পড়ছেন। ফরাসী বিপ্লব বা আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সাল তারিখ কিছু কিছু জানলেও আমাদের সেই কল্পিত পাঠকটি বিশদে ইতিহাস পড়েন নি কখনো। তবে সাহিত্য, বিশেষত গল্প উপন্যাস পড়তে ভালোবাসেন। জেন অস্টেনের উপন্যাসগুলি বেশ মনযোগ দিয়ে একাধিকবার তিনি পড়েছেন বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। যদি তাঁকে সে সময়ের ইংলণ্ড সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনি কী এর নানা দিকের একটা ছবি ফুটিয়ে তুলতে পারবেন? দেখার বিষয় হল সে সময়ের ইংলণ্ড সম্পর্কে তাঁর প্রিয় জেনের উপন্যাসের ভিত্তিতে তিনি কী কী বলতে পারবেন আর কোন কোন বিষয়ে তিনি নীরব থাকবেন।

সে সময়ের ইংলণ্ডের রাজা রানী রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের কল্পিত এই অস্টেন পাঠক কিছুই বলতে পারবেন না। সে সময় যুদ্ধ চলছিল। স্থায়ী সেনাবাহিনীর বাইরে মিলেশিয়া তৈরি হয়েছিল, তরুণেরা তাতে সামিল হচ্ছিল, তাদের নিয়ে তরুণী মনে আগ্রহ উৎসাহ ছিল – ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ ভালোভাবে পড়া থাকার সূত্রে এসব খবর তিনি দিতে পারলেও কাদের সঙ্গে কার যুদ্ধ হচ্ছিল আর কেনই বা এই যুদ্ধ, এই সব প্রসঙ্গে তাঁকে নীরব থাকতে হবে। এই মিলেশিয়া বা তার সালতামামি তিনি বলতে পারবেন না। স্থলবাহিনীর পাশাপাশি নৌ বাহিনীরও বেশ গুরুত্ব ছিল - এই খবর তিনি ‘পারসুয়েশান’ উপন্যাসের ভিত্তিতে জানাতে পারলেও এর বিস্তারিত তথ্য হাজির করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না।

তবে একথাও আমাদের ভুললে চলবে না যে অস্টেনের অনেক উপন্যাসেই মিলেশিয়া ও নেভি ও সেখানে কর্মরতদের অনেক প্রসঙ্গ এসেছে। ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এর গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র উইকহ্যাম মিলেশিয়াতে কর্মরত, তা ছাড়াও মিলেশিয়াতে কাজ করা বেশ কয়েকজনের কথা এখানে আছে। নর্দাঙ্গার অ্যাবিতেও এসেছে সেনাবাহিনীর এক জেনারেল ও এক ক্যাপ্টেনের কথা, যারা নায়ক হেনরি টিনলের বাবা ও দাদা। তবে সেনাবাহিনী বিশেষ করে নেভিতে কর্মরত মানুষজনের কথা সবচেয়ে বেশি করে এসেছে ‘পারসুয়েশান’ উপন্যাসে। সেনাবাহিনী ও নেভি সম্পর্কে নানা ধারণা ও তথ্য সংবাদপত্রের পাতা বা বইপত্র থেকে যেমন জেন অস্টেন পেয়ে থাকবেন, তেমন ই পেয়েছেন তার দাদাদের মুখ থেকে শোনা নানা বর্ণনা ও কাহিনী থেকে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য জেনের দাদা ও ভাই - অস্টেন পরিবারের ষষ্ঠ ও অষ্টম সন্তান হলেন যথাক্রমে ফ্রান্সিস অস্টেন ও চার্লস জন অস্টেন। তারা দুজনেই ব্রিটিশ রয়াল নেভির অ্যাকাডেমিতে পড়াশুনো করেন ও তারপর নেভির চাকরীতে যোগ দেন। তারা উভয়েই দুটি করে বিয়ে করেন এবং উভয়েরই অনেক সন্তান সন্ততি নিয়ে ছিল বেশ বড়সড় পরিবার। চার্লস নেভির কাজে জাহাজেই বেশি থাকতেন। জেন অস্টেন তার এই ছোট ভাইয়ের সঙ্গে খুব বেশি সময় কাটানোর সুযোগ পান নি। তবে ফ্রান্সিস ও তার পরিবারের সঙ্গে জেন বেশ কিছু সময় কাটিয়েছিলেন ও সেই সূত্রে নেভি সম্পর্কে বেশ খানিকটা পরোক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন।

ইংলণ্ডের সে সময়ের শ্রেণি বিন্যাস সম্পর্কে তিনি বেশ কিছু কথা অবশ্যই জানাতে পারবেন। বিশেষ করে তিনটি শ্রেণি সম্পর্কে। নোবেলিটি, ল্যান্ডেড জেন্ট্রি ও ট্রেডার্স বুর্জোয়া সম্পর্কে বেশ কিছু গভীর পর্যবেক্ষণ তাঁর থেকে পাব আমরা। কিন্তু ‘এমা’ উপন্যাসের ভিত্তিতে রবার্ট মার্টিন নামক এক কৃষক ও তার পরিবার বিষয়ক কিছু খণ্ডচিত্র হাজির করতে পারলেও সে সময়ের ইংলণ্ডের এক প্রধান শ্রেণি - নবোদিত ওয়ার্কিং ক্লাস বা শ্রমিক শ্রেণি সম্পর্কে আমাদের এই কল্পিত উপন্যাস পাঠক তেমন কিছুই জানাতে পারবেন না। এর পর যদি তাঁর হাতে ডিকেন্স রচনাবলী ধরিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তিনি বিস্মিত হয়ে ভাববেন ডিকেন্সের উপন্যাসে এই যে এত দরিদ্র শ্রমিক, জেন অস্টেনের উপন্যাসে তারা একেবারেই নেই কেন। ধরে নিচ্ছি ইংলণ্ডের শিল্পবিপ্লবের ইতিহাস সম্পর্কে অল্পকিছু আমাদের এই কল্পিত পাঠকের জানা আছে। তাই তিনি ভেবে নিতে পারেন ডিকেন্স হলেন এই শিল্প বিপ্লবের পরের কালের মানুষ আর জেন অস্টেন ঠিক আগের।

জেন অস্টেন ইংলণ্ডের যে সমাজ পটভূমিতে তাঁর উপন্যাসগুলিকে স্থাপণ করেছেন সেখানে মূলত পাঁচটি শ্রেণি রয়েছে। অভিজাত, জমিদার ভদ্রলোক, বুর্জোয়া মিল মালিক ও ধনী ব্যবসায়ী, শ্রমিক শ্রেণি ও কৃষক শ্রেণি। জেন অস্টেনের উপন্যাসে সমাজের ওপরের স্তরের তিন শ্রেণির মানুষদেরই মূলত দেখা যায়, শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণির তেমন প্রতিনিধিত্ব নেই। অভিজাত মানুষেরা -  ডিউক, মার্কুইস, আর্ল, ভাইক্যান্ট ইত্যাদি মাঝে মাঝে উপন্যাসে দেখা দেন বটে, কিন্তু জমিদার ভদ্রলোক ও বুর্জোয়া ব্যবসায়ীরাই জেন অস্টেনের উপন্যাসের মূল চরিত্র। ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ উপন্যাসে লেডি ক্যাথরিন একজন আর্ল এর কন্যা এবং তিনি অভিজাত সমাজের প্রতিনিধি। কর্নেল ফিজ উইলিয়ামও এক আর্ল পরিবারের সন্তান এবং স্যর খেতাবধারী তথা অভিজাত। কিন্তু বিরাট জমিদারী থাকলেও মিস্টার ডার্সির অভিজাত খেতাব নেই, তিনি জমিদার ভদ্রলোক শ্রেণির প্রতিনিধি। অন্যদিকে বেনেট পরিবারও জমিদার ভদ্রলোক শ্রেণিরই মানুষ, যদিও তাদের জমিজমা এবং আয় অনেক কম। উপন্যাসের শেষের দিকে লেডি ক্যাথরিন যখন নায়িকা এলিজাবেথকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, ডার্সির সঙ্গে তার সামাজিক বিন্যাস মেলে না, তখন এ কারণেই এলিজাবেথ লেডি ক্যাথরিনকে মুখের ওপর জানিয়ে দিয়েছিল ডার্সি যেমন একজন ভদ্রলোক জমিদার, সেও তেমনি এক ভদ্রলোক জমিদারের মেয়ে, একই সামাজিক বর্গের মানুষ তাঁরা। বাস্তবে অবশ্য এক সামাজিক বর্গের মধ্যেও তফাৎ কত ব্যাপক হয়ে থাকে, সেটা এই উপন্যাসে বারবার ধরা পড়েছে। ডার্সির বন্ধু এবং এই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র মিস্টার চার্লস বিংলে কিন্তু জমিদার সম্প্রদায়ের মানুষ নন। তাঁদের ধন সম্পদের উৎস পারিবারিক ব্যবসা এবং তাঁরা বুর্জোয়া ব্যবসায়ী শ্রেণির প্রতিনিধি। এঁদের অনেকেই সে সময় জমিদারী কিনে জমিদার ভদ্রলোক শ্রেণিতে প্রবেশের জন্য ব্যাগ্র ছিলেন। চার্লস বিংলের বোন ক্যারোলিন বিংলের মধ্যে এই সংক্রান্ত উদগ্র আকাঙ্ক্ষা আমরা দেখেছি। সমাজের ওপর তলার এই তিনটি শ্রেণির প্রতিনিধিরা নিজ নিজ সামাজিক বর্গের অহংকার ও সংস্কার নিয়ে কীভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কের নানা জাল জটিলতায় জড়িয়ে পড়ে, বিত্ত ও চিত্তের নানামুখী দ্বন্দ্ব কীভাবে আবির্ভূত ও মীমাংসিত হয় – ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ উপন্যাসটি সেই কাহিনীকেই আকর্ষণীয় ও জীবন্তভাবে তুলে ধরেছে।

চরিত্রদের আয় এবং স্বচ্ছলতা কতটা, সেই সম্পর্কে ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এর লেখিকা উপন্যাসে তার বেশ কিছু স্পষ্ট গাণিতিক হিসেব দিয়েছেন। সেই হিসেবকে আজকের মূল্যমানে রূপান্তর করে, এমনকী আমাদের টাকার অঙ্কে নিয়ে এসে আমরা চরিত্রদের আর্থিক সঙ্গতি অসঙ্গতিকে বুঝে নেবার চেষ্টা করতে পারি।

মিস্টার ডার্সির আয় বছরে দশ হাজার পাউন্ড। মিস্টার বিংলের আয় বছরে সাড়ে চার হাজার পাউন্ড। এই আয় আজকের হিসেবে কত? অন্তত তিরিশ গুণ। হয়ত আরো সঠিক বিচারে প্রায় তেত্রিশ গুণ।  সেই নিরিখে আজকের ভারতীয় মুদ্রায় প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিসের নায়ক মিস্টার ডার্সির আয়ের পরিমাণ অন্তত বার্ষিক তিন কোটি টাকা। মিস্টার বিংলের আয় এক কোটি পঁয়ত্রিশ লক্ষ টাকার কাছাকাছি। অন্যদিকে মিস্টার বেনেট মারা গেলে সম্পত্তি চলে যাবে নিকটতম পুরুষ আত্মীয় মিস্টার কলিন্সের কাছে, মিসেস বেনেট ও তার কন্যার জন্য সব মিলিয়ে থাকবে মোট পাঁচ হাজার পাউন্ড বা আজকের হিসেবে দেড় কোটি টাকার সম্পত্তি। এই টাকাটা ব্যাঙ্কে রাখলে সুদ বার্ষিক ৫% হলে সুদ বাবদ বেনেট পরিবারের বার্ষিক আয় দাঁড়াবে ২৫০ পাউন্ড। লিডিয়া উইকহ্যামের সঙ্গে বিয়ের পরে তার অংশটি অর্থাৎ মোট এক ষষ্ঠাংশর হিসেব বুঝে নেয় ও তার সম্পত্তি থেকে সুদ বাবদ বার্ষিক আয় দাঁড়ায় বছরে চল্লিশ পাউন্ড, আজকের ভারতীয় মুদ্রায় বার্ষিক এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা বা মাসিক মাত্র দশ হাজার টাকা। উইকহ্যামের স্থায় আকর্ষণীয় কোনও জীবিকা না থাকায় এজন্যই বিয়ের পর তাদের অন্যদের থেকে সাহায্য নিয়ে কৃচ্ছসাধনের মধ্যে দিয়ে দিন চালাতে হত।

সমকালের ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ জেন অস্টেনের উপন্যাসে কমই এসেছে। ‘পারসুয়েশন’ উপন্যাসটিতে নেপোলিয়নের পরাজয়ের পর ব্রিটিশ সেনাদের ঘরে ফেরার প্রসঙ্গ ছিল। প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস এ এসেছে ফরাসী বিপ্লবের পর ফ্রান্স থেকে আসা সম্ভাব্য আক্রমণের মোকাবিলার জন্য স্থায়ী সৈন্যবাহিনীর পাশাপাশি মিলেশিয়া গড়ে ওঠার প্রসঙ্গ। এই ঘটনাপর্বকেই জেন অস্টেন তাঁর উপন্যাসে ব্যবহার করেছেন যদিও ঐতিহাসিক পটটিকে বিস্তারে ব্যবহার করেন নি। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য জেনের দাদা হেনরি অস্টেন নিজেই অক্সফোর্ডশায়ার মিলেশিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৮০১ সালে সেই কাজ থেকে সরে এসে তিনি তাঁর ব্যাঙ্কিং জীবন শুরু করেন। ঠিক কোন বছরগুলির কথা এই উপন্যাসে এসেছে সে সম্পর্কে অবশ্য অস্টেন বিশেষজ্ঞ গবেষকদের মধ্যে কিছু ভিন্নমত দেখা যায়। আর ডব্লু চ্যাপম্যান মনে করেছেন শেষতম পরিমার্জনের পর ১৮১১-১২ সালের সঙ্গেই ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ এর ঘটনাপর্ব মিলে যায়।  অন্যদিকে পি বি এস অ্যান্ড্রুজ মনে করেছেন ১৮০২-০৩ সালের পুনর্মাজনের সময়কার দিনকালটিই উপন্যাসে অনুসৃত।  এই বিতর্কে খুব নির্দিষ্টভাবে প্রবেশ না করে ১৭৯০ থেকে ১৮২০ – ইংলণ্ড ইতিহাসের রিজেন্সি যুগের প্রেক্ষাপটকে ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ ধারণ করে আছে – সাধারণভাবে এটা মাথায় রেখেই আমরা উপন্যাসটির রসগ্রহণ করতে পারি। বস্তুতপক্ষে ফরাসী বিপ্লবের পর জেকোবিয়ান ফ্রান্সের মোকাবিলার আবহেই ইংলণ্ডে মিলেশিয়াগুলি জন্ম নিয়েছিল। নেপোলিয়নের ফ্রান্সের মোকাবিলার সময়কাল, ১৮১৫ অবধিও সেগুলি সক্রিয় ছিল।

জেন অস্টেন আর ডিকেন্স পাশাপাশি পড়লে এঁদের পার্থক্য বিষয়ে আমাদের এই পাঠক বলবেন ডিকেন্স এর উপন্যাস থেকে তিনি ইংলণ্ডের শহরকে চিনেছেন আর জেন অস্টেন থেকে ইংলণ্ডের গ্রাম ও খামারকে। জেন অস্টেন আর ডিকেন্স - উনিশ শতকের এই দুই ঔপন্যাসিকের উপন্যাসের শ্রেণি আলাদা, ভূগোলও আলাদা।

ভূগোলের কথা প্রসঙ্গে জানতে ইচ্ছে হয় জেন অস্টেনের উপন্যাস পাঠক ইংলণ্ডের কোন কোন এলাকা সম্পর্কে আমাদের জানাতে পারবেন। লন্ডন সম্পর্কে কিছু এলোমেলো খবর দেওয়া ছাড়া তিনি জানাতে পারবেন লাইম রিজিস এর মতো সমুদ্র তীরবর্তী শহরটি সম্পর্কে। আর যে শহরটির বর্ণনা তিনি খুব ভালোভাবে দিতে পারবেন সেটি হল বাথ। জেন প্রথম যে উপন্যাসটির খসড়া লিখেছিলেন, সেই সুসান - যা সবার শেষে তাঁর মৃত্যুর পরে ‘নর্দাঙ্গার অ্যাবে’ নামে ছাপা  হল - সেখানে বাথ শহরের অনুপুঙ্খ বর্ণনা আছে। এই শহরের কথা আছে পারসুয়েশান উপন্যাসেও। পারসুয়েশানে আর আছে লাইম রেজিস এর কথা।

বিনোদন সম্পর্কে যদি তাকে প্রশ্ন করা হয়, তিনি বলবেন বল নাচের কথা। এর রীতিনীতিও তিনি জানাতে পারবেন বেশ বিস্তারে। ‘প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস’ বা ‘নর্দাঙ্গার অ্যাবে’র পাঠ তাঁকে অনেকটাই সাহায্য করবে। তবে থিয়েটার সম্পর্কে তিনি কিছু ভুল তথ্য ও ধারনা সরবরাহ করে বসতে পারেন ‘ম্যানসফিল্ড পার্ক’ পাঠের সূত্রে। তার মনে হতে পারে তরুণেরা থিয়েটার আগ্রহী হলেও প্রবীণ মুরুব্বী গোছের লোকেরা বোধহয় থিয়েটারকে নিচু নজরে দেখতেন। কিন্তু তা একেবারেই সঠিক হবে না। অবশ্য নর্দাঙ্গার অ্যাবের সূত্রে ম্যানসফিল্ড পার্ক এর পাঠ অভিজ্ঞতা থেকে আসা ভুল ধারনাকে খানিকটা ঠিক করে নেওয়ার সুযোগ তিনি পাবেন। আবার ম্যানসফিল্ড পার্কের সূত্রেই সে সময়কার ইংলণ্ডের একটি শ্রেণির কথা জানাতে আমাদের এই পাঠকের অসুবিধে হবে না, যাঁরা উপনিবেশের দেশ দেশান্তরে মুনাফা লোভে যেতেন ও সেখান থেকে প্রভূত অর্থ উপার্জন করে ইংলণ্ডে ফিরে আসতেন।

জেন অস্টেনের উপন্যাস পাঠক সেই সময়কার ইংলণ্ডের যানবাহন সম্পর্কে বেশ বিস্তারিত বর্ণনা দিতে পারবেন আর এক্ষেত্রেও ‘নর্দাঙ্গার অ্যাবে’ হবে তাঁর অন্যতম সহায়। তবে অন্যান্য উপন্যাসগুলো থেকেও আসবে অনেক তথ্য।

সে সময়ের ইংলণ্ডে সমস্ত যানই ছিল ঘোড়ায় টানা। ঘোড়ারা বেশি দূর একটানা যেতে পারত না। বিশ্রাম, খাওয়া দাওয়া বা বদলের দরকার পড়ত। আজকের দিনে মোটরগাড়ির রসদের জন্য যেমন পেট্রোল পাম্প থাকে সেই সময় তেমনি ঘোড়ার রসদ যোগানের জন্য রাস্তার মাঝে মাঝে ব্যবস্থা রাখতে হত। ঘোড়ার গাড়ি ছিল নানা রকমের। মাল টানা গাড়ি ছিল সবচেয়ে ধীর গতির। সবচেয়ে দ্রুত গতির ছিল ডাক বহনের গাড়ি। ডাক বহনের গাড়ি চারজন করে লোকও নিতে পারত। ব্যক্তিগত বা পরিবারের চলাচলের গাড়ি ছাড়াও ছিল নানা রকমের পাবলিক ক্যারেজ। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক গাড়ির মধ্যে ছিল কোচ, চেইজ, গিগ, ল্যান্ডাউ, বারুচ৷ কোন গাড়ি কীরকম, কোন শ্রেণির লোক সে গাড়িতে চড়ত - সেই ধারনাও জেন অস্টেনের উপন্যাস পাঠক দিতে পারবেন।

জেনের সময় ইংলণ্ডে তিন ধরনের যানবাহন চলত। ১) রোড ওয়াগান ২) মেল কোচ ৩) স্টেজ কোচ। রোড ওয়াগান ব্যবহৃত হত খুব ভারি জিনিসপত্র বহনের কাজে। আটটি ঘোড়া দিয়ে দশ চাকার এই বিরাট গাড়িগুলি টানা হত। গতি ছিল মন্থর, ঘন্টায় বড়জোর তিন মাইল। খুব গরীব কিছু মানুষ এতে করে যাতায়াতও করত,কারণ স্টেজ কোচে যাতায়াতের ব্যয় বহন করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।

মেল কোচ ছিল সরকারী ডাক পরিবহন ব্যবস্থা। এতে একজন চালক বা কোচোয়ান থাকত। তার পেছনে বসতেন এক বন্দুকধারী প্রহরী। ঘন্টায় প্রায় সাত/ আট মাইল বেগে এই গাড়িগুলি যাতায়াত করত। মেল কোচ বহনের জন্য ব্যবহৃত হত চারটি ঘোড়া। লন্ডন থেকে বাথ শহরের দূরত্ব ১১৬ মাইল। ১৭৮৪ সালের একটি হিসাব থেকে জানা যায় মেল কোচ এই দূরত্ব তেরো ঘন্টায় পাড়ি দিচ্ছে। মেল কোচ মূলত ডাক পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হলেও এক একটি গাড়িতে সর্বোচ্চ চারজন করে যাত্রী পরিবহনেরও ব্যবস্থা ছিল। তবে যাত্রীরা সঙ্গে ভারি মালপত্র নিতে পারতেন না।

গণ পরিবহণ -

সাধারন মানুষের যাতায়াতের মূল অবলম্বন ছিল স্টেজ কোচ। বিভিন্ন ব্যবসায়িক কোম্পানী নাগরিকদের এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় নিয়ে যাবার জন্য স্টেজ কোচ চালাত। এতে চার বা ছটি ঘোড়া ব্যবহৃত হত। ঘোড়ারা এক খেপে সাত থেকে দশ মাইল যেতে পারত। তাই স্টেজ কোচের ঘোড়াগুলি নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর বদলাতে হত। ঘোড়ারা দিনে দু খেপ যেতে আসতে পারত। এক খেপ এ নির্দিষ্ট আস্তাবল থেকে তারা রওনা দিত। পথিমধ্যে তাদের গাড়ি থেকে খুলে অন্য ঘোড়া গাড়িতে লাগানো হত। আগের ঘোড়াগুলি বিশ্রাম নিয়ে পরের কোনও গাড়ির সঙ্গে জুড়ে গিয়ে ফিরতি পথ ধরে আস্তাবলে ফিরে আসত। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে ঘোড়াদের পূর্ণ বিশ্রামের ব্যবস্থা ছিল। তবে অধিক মুনাফার দিকে তাকিয়ে অনেক কোম্পানী ঘোড়াদের উপযুক্ত খোরাকী বা বিশ্রাম দিত না। স্টেজ কোচ সাধারণভাবে ঘন্টায় সাত মাইল যেতে পারত। তবে ১৮১৬ সালে লন্ডনের এক স্টেজ কোচ কোম্পানী বলেছিল একটানা চালিয়ে তারা লন্ডন থেকে ব্রিঘটন এই বাহান্ন মাইল রাস্তা ছয় ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে দেবে। ঘোড়াদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ দিতে গিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে তাদের পনেরোটি ঘোড়া মারা যাওয়ায় তাদের প্রকল্পটি বন্ধ করে দিতে হয়।

স্টেজ কোচের ভেতরে ছ জনের বসায় জায়গা হত। পেছনে রাখা এক বড় বাক্সে যাত্রীদের মালপত্র ঢুকিয়ে দেওয়া হত। গাড়ির ছাদে বেশ কিছু মানুষ চড়ত। কতজন ছাদে উঠতে পারবে তার কোনও নিয়ম ছিল  না। বেশি মানুষ ছাদে উঠে পড়ায় প্রায়শই দুর্ঘটনা ঘটত। অনেক মাতাল ছাদ থেকে গড়িয়ে পড়ে আহত হত। আবার প্রবল শীতে ঠান্ডায় জমে ছাদের আরোহীর মৃত্যুর সংবাদও পাওয়া যেত।

পোস্ট চেইজ নামে স্টেজ কোচের এক বিকল্প ব্যবস্থা ছিল। তিন চারজন যাত্রি এক পথে গেলে সরাইখানার সঙ্গে যোগাযোগের ভিত্তিতে সরাইখানার তরফেই পোস্ট চেইজ এর ব্যবস্থা করে দেওয়া হত। সরাইখানাগুলিই ছিল পোস্ট চেইজ এর মালিক। পারিবারিক গাড়ি

কোচ -

পারিবারিক যানবাহন বা ক্যারেজের মধ্যে কোচ ছিল সবচেয়ে পুরনো, সবচেয়ে মজবুত ও ভারী, সবচেয়ে দামী। কোচের ভেতরে ছয়জন বসতে পারত। জেন অস্টেনের অনেক উপন্যাসেই চরিত্র পাত্রদের আমরা কোচ গাড়িতে যাতায়াত করতে দেখি। প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস এর বেনেট পরিবার, ম্যান্সফিল্ড পার্ক এর বার্টাম পরিবার, পারসুয়েশান এর মুসগ্রোভ পরিবার – সকলেই কোচ ব্যবহার করেছে।

রাস্তাঘাটের উন্নতির পর অপেক্ষাকৃত হালকা গাড়ি ব্যবহার করা সম্ভব হয়। চেইজ ও চ্যারিয়ট ছিল কোচের চেয়ে হালকা ধরনের পারিবারিক গাড়ি। চেইজ জাতীয় গাড়িতে তিনজন বসতে পারত, তার মধ্যে একজন গাড়িটা চালাত।

চেইজ -

নর্দাঙ্গার অ্যাবে উপন্যাসের জেনারেল টিনলে ব্যবহার করতেন চার ঘোড়ায় টানা একটি ফ্যাশেনেবল চেইজ। অস্টেনের উপন্যাস সমূহে অন্যান্য চেইজ ব্যবহারকারীদের মধ্যে আছে সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটির কর্নেল ব্রান্ডন, প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস এর মিস্টার বিংলে ও মিস্টার হার্ট, ম্যান্সফিল্ড পার্ক এর বার্টাম পরিবার ও মিস্টার রাসওয়ার্থ, এমার সাকলিনস পরিবার, পারসুয়েশান এর এলিয়ট পরিবার।

চ্যারিয়ট

চ্যারিয়ট ছিল চেজের মতোই আর একটি পারিবারিক গাড়ি। তবে চেজের সামনে আরো একটি অতিরিক্ত অংশ থাকত যেখানে আলাদা করে একজন চালক বসতেন। ‘সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি’ উপন্যাসের জন ড্যাশউডের এরকম একটি চারিয়ট ছিল। ম্যানসফিল্ড পার্ক এর মিসেস রাওয়ার্থও এরকম একটি চ্যারিয়টে চাপতেন।

কোচ, চেইজ আর চ্যারিয়ট ছিল পরিবারের অনেকের একসঙ্গে যাতায়াতের গাড়ি। দু একজনের যাবার জন্য যে সব ধরনের গাড়ি ছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ফিটন, কারিকল ও গিগ।

ফিটন ও পনি ফিটন -

একা বা এক সঙ্গী নিয়ে চলাচলের জন্য তরুণদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় গাড়ি ছিল ফিটন। চার চাকার এই গাড়িটি টানত দুটি বা তার বেশি ঘোড়া। একটু ঝুঁকিপূর্ণ এই গাড়িটি বেশ খানিকটা উঁচু ছিল বলে একে হাইফ্লায়ার বলা হত।

অনেকে, বিশেষত তরুণীরা এর অন্য একটি কম উঁচু ঘোড়ার, কম ঝুঁকিপূর্ণ সংস্করণ বেশি ব্যবহার করতেন, যার নাম ছিল পনি-ফিটন বা লো ফিটন।

কারিকল

কারিকল ছিল এক বা দুজনের যাতায়াতের আর একটি জনপ্রিয় গাড়ি। সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটির জন উইলোবি, প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস এর মিস্টার ডার্সি ও উইলিয়াম গোল্ডিং, ম্যানসফিল্ড পার্ক এর মিস্টার রাসওয়ার্থ, নর্দাঙ্গার অ্যাবে হেনরী টিনলে, পারসুয়েশান এর চার্লস মুসগ্রোভ ও উইলিয়াম এলিয়টকে আমরা ক্যারিকল ব্যবহার করতে দেখি।

গিগ -

ফিটন ও কারিকল ছিল একটুদামী গাড়ি। এক ঘোড়ায় টানা দু চাকার গিগ ছিল তুলনামূলক সস্তা দরের। সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটির নবীন আইনজীবীদের, প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস এর মিস্টার কলিন্সকে, নর্দাঙ্গার অ্যাবের জেমস মোরল্যান্ড ও জন থর্পেকে এবং পারসুয়েশন এর ক্রফটদের আমরা গিগ ব্যবহার করতে দেখি।

উনিশ শতকের একেবারে গোড়ায়, ১৮০০ সালে দুটি ইউরোপীয় গাড়ি ইংলণ্ডের বাজারে প্রবেশ করে। একটি হল জার্মান ল্যান্ডাউ (landau) ও তার ছোট সংস্করণ ল্যানডাউলেট (landaulette)। ল্যান্ডাউ ছিল কোচ এর মতো বড় গাড়ি আর ল্যান্ডাউলেট ছিল চ্যারিয়টের মতো। ল্যান্ডাউ এর চামড়ার হুড বা আচ্ছাদন মাঝখান থেকে দুদিকে খোলা যেত। ল্যান্ডাউলেট এর হুড বা আচ্ছাদনটি সামনের দিক থেকে পেছনের দিকে খুলত।

ইউরোপ থেকে আর যে গাড়িটি এই সময়ে ইংলণ্ডের বাজারে আসে সেটি হল বারুচ। ম্যানসফিল্ড পার্ক উপন্যাসে হেনরি ক্রফোর্ড এর বারুচ চালানোর একটি দৃশ্য বিখ্যাত হয়ে আছে। গাড়ির মূল অংশের ভেতরে বসেছিল আন্ট নরিস, ফ্যানি, ম্যারি ক্রফর্ট ও মারিয়া বার্টাম। পাশে জুলিয়াকে নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল হেনরি আর এটা হেনরির প্রতি আকৃষ্ট জুলিয়ার দিদি মারিয়াকে হিংসায় জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। পারসুয়েশন উপন্যাসে এক বর্ষার দিনে লেডি ড্যালরিম্পেল এলিজাবেথকে তাঁর বারুচে করে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু গাড়িতে উঠেও তাঁরা ভিজে যান কারণ বারুচের একমাত্র আচ্ছাদনটি কেবল সামনের আরোহীকেই রোদ জল থেকে বাঁচাত।

১৮০৪ সালে বারুচ ও ল্যান্ডাউ এর এক মিলিত সংস্করণ – ল্যান্ডাউ বারুচ বাজারে আসে। এমা উপন্যাসে মিসেস এলটন অপেক্ষা করে থাকেন কবে এই গাড়িটি তার কাছে আসবে, তবে শেষ পর্যন্ত গাড়িটি তার কাছে এসে পৌঁছয় নি।

জেন অস্টেনের উপন্যাসে ঘোড়ায় টানা নামা ধরনের গাড়ির প্রসঙ্গ বারবার এসেছে আর এই সব উল্লেখের মধ্যে দিয়ে জেন সামাজিক বিন্যাস, রুচি ও প্যাশনের দিকে ইঙ্গিৎ করেছেন। একাধিক গাড়ি থাকাটা ছিল বেশ বড়লোকী ব্যাপার।

প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস এর একেবারে শুরুর দিকে আমরা দেখি মিসেস বেনেট স্বামীকে যখন মিস্টার বিংলের বিষয় সম্পত্তির সমৃদ্ধির কথা উৎসাহ নিয়ে জানাচ্ছেন

you must know, Mrs. Long says that Netherfield is taken by a young man of large fortune from the north of England; that he came down on Monday in a chaise and four...  (Pride and prejudice)

এখানে চার ঘোড়ায় টানা চেইজ জাতীয় গাড়ি করে বিংলে পরিবারের নেদারফিল্ড নামের খামার বাড়িতে আসাটা তাদের সমৃদ্ধির দ্যোতক।

এমা উপন্যাসের আগুস্তা এলটনের ব্রাদার ইন ল মিস্টার সাকলিং এর একাধিক গাড়ি ছিল। আর এ থেকে বোঝা যাচ্ছিল খরচ করার মতো যথেষ্ট পয়সা তার ছিল। একই কথা প্রযোজ্য আরো বিত্তবান এবং প্রতিপত্তিশালী লেডি ক্যাথারিন ডি বগ এর ক্ষেত্রে। এলিজাবেথ বেনেটের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি কত ধনী ঘরের মেয়ে তা বোঝাতে তাঁর বাবার কত রকমের গাড়ি ছিল সেটা তিনি সবিস্তারে জানান। এলিজাবেথকেও তিনি জিজ্ঞাসা করেন তার বাবার কটা কী গাড়ি আছে। উপন্যাস থেকে আমরা জানতে পারি লেডি ক্যাথরিনের নিজের অনেক গাড়ি ছিল। তাঁর মেয়ে চড়ত একটি নিচু ফিটন। তিনি নিজে লন্ডন যাবার জন্য বারুচ ব্যবহার করতেন।

জেন অস্টেনের উপন্যাসগুলির মধ্যে গাড়ি ও ঘোড়া সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি কথা এসেছে নর্দাঙ্গার অ্যাবেতে। ঘোড়া কতটা একটানা যেতে পারে, কত গতিতে গাড়ি চলে – সে সব হিসাব নিকাশ এখানে রয়েছে। এই উপন্যাসের তরুণ কলেজ ছাত্র জন থর্পের গাড়ি নিয়ে আবেগ ছিল বেশ চড়া ধরনের। সে ক্যাথরিন মোরল্যান্ডকে আকৃষ্ট করতে তার সেকেন্ড হ্যান্ড ‘গিগ’টি সম্পর্কে অনেক ভালো ভালো কথা বলে। বোঝাতে চায় এটি অনেকটা কারিকলের মতোই স্মার্ট। তার ঘোড়া একটানা কতটা দৌড়তে পারে, সে কত দ্রুত গাড়ি চালায় - এসব অতিরঞ্জিত করে বলে এক তরুণীর মন পাওয়ার চেষ্টায় তার খামতি নেই।

সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি উপন্যাসে ফ্যানি ড্যাশউড ও তাঁর মা মিসেস ফেরার এর কথাবার্তা থেকে ধরা পড়েছে গাড়ির ধরন কেবল  বিত্ত নয়, সামাজিক স্থানাঙ্করও নির্দেশক। তাঁরা চান এডওয়ার্ড ফেরার রাজনীতি ও আইন ব্যবসায় প্রতিপত্তি অর্জন করুক আর স্ট্যাটাস সিম্বল বারুচ চালিয়ে ঘুরে বেড়াক। কিন্তু এডওয়ার্ড অত উচ্চাশী নয়। সে খ্যাতিও চায় না, বারুচে করে ঘোড়ার শখও তাঁর নেই। বারুচ অবশ্য অস্টেনের উপন্যাসের অনেক চরিত্রেরই ছিল। সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটির ফ্যানি ড্যাশউড ও মিসেস পালমার বারুচের মালিক ছিলেন। প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস এর লেডি ক্যাথরিন বারুচে চেপে লন্ডন যেতেন। ম্যানসফিল্ড পার্ক এর হেনরি ক্রফোর্ড এবং পারসুয়েশান এর লেডি ড্যালরিম্পেলকে আমরা বারুচ চালাতে দেখি।

পারসুয়েশান উপন্যাসের শুরুতেই আমরা জানতে পারি স্যর ওয়াল্টার এলিয়ট আর্থিক সঙ্কটে পড়েছেন। সম্পত্তি বিষয়ক পরামর্শ দিতে গিয়ে জোন্স স্যার এলিয়টকে জানন যে একাধিক গাড়ি রাখার খরচকে এখন অকারণ বিলাসিতা বলে ধরতে হবে ও তা বর্জন করতে হবে। কিন্তু তখনই গাড়ি বিক্রি না করে ওয়াল্টার এলিয়ট বিলাস বহুল গাড়ি সমেতই বাথে আসেন যাতে প্রতিবেশীদের কাছে তাঁর আর্থিক সঙ্কট ধরা না পড়ে। বোঝা যায় গাড়ি যেমন ছিল প্রয়োজন, তেমনি ছিল সামাজিক মর্যাদা, প্রতিপত্তি, আবেগ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা -  এসবের সঙ্গেও জড়ানো।